Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ট্রেকার্স || Bani Basu » Page 17

ট্রেকার্স || Bani Basu

এ বছরটা একটা স্পেশ্যাল বছর— বাবাই ভাবছিল। ঠান্ডা আর যেতেই চাইছে না। একটু গরম পড়লেই বৃষ্টি চলে আসছে। আবার চারদিকটা এমন আরামদায়ক ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! বাবাই নাম কে ওয়াস্তে হস্টেলে ফিরেছে বটে, কিন্তু তাকে দিয়াদের বাড়ি থাকতেই হয়। আর এখন কোনও অস্বস্তি নেই। সত্যি-সত্যিই বাবাইয়ের মনে হয় সে নিজের বাড়িতে রয়েছে। কত কথা দিয়ার। মুখে কথা, ডায়েরি ভর্তি কথা, খাতা ভর্তি কথা, বাবাই শোনে, পড়ে। দিয়া ভীষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর কী মনে হয়, ঠিক ভাবছি?” নানারকম জীবনদর্শন নিয়ে আলোচনা হয় দু’জনের। বাবাই কখনও ভাবেনি ধনীর দুলালি, আপাতদৃষ্টিতে অপরিণত দিয়া এত কথা ভাবে।

একদিন সে বলল, “দেখ বাবাই, মা-বাবাকে আমি প্রচণ্ড ভালবাসি, ভীষণ নির্ভরও করতাম। কিন্তু ওদের বিচ্ছেদের পর, আমার উপর দিয়ে এইসব ঘটে যাওয়ার পর আস্তে-আস্তে আমি বুঝতে পারছি আমি একটা আলাদা মানুষ। আমার জীবনটা একটা আলাদা জীবন। আমাকে শেষ পর্যন্ত একাই বাঁচতে হবে, একাই মরতে হবে। আমার বাঁচাটা কেউ বেঁচে দিতে পারবে না।”

উজ্জ্বল ছিল, কফি মাঝখানে নিয়ে তিনজনের আড্ডা চলছিল। সে বলল, “ধুর এটা আমি বহুদিন আগে বুঝে গিয়েছি। ঠিক এইভাবে বলতে হয়তো পারিনি কাউকে, কিন্তু বুঝে গিয়েছি। বেশিরভাগ ছেলেই বুঝে যায়। মানে, ভিতরে-ভিতরে ইন্ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যায়। তোরা পারিস না। ওটা বহুযুগের অভ্যাসের ফল, কী করা যাবে! আজ যদি বিয়ে করিস আবার বরের উপর নির্ভর করতে শুরু করবি।”

বাবাই বলল, “বাজে কথা বলিসনি। ওটা মিউচুয়াল নির্ভরতা, পারস্পরিক। একটা নতুন ইউনিট গড়তে হচ্ছে। দু’জনের সহযোগিতা, সহমর্মিতা না থাকলে হওয়া সম্ভব?”

উজ্জ্বল বলল, “তুই একটা আইডিয়াল সিচুয়েশনের কথা বলছিস। রিয়্যালিটি তা বলে না। রিয়্যালিটি বলছে, মেয়েরা সব ব্যাপারে একেবারে বসের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বরের কথাই বসের কথা। যারা উপার্জন করে সেসব মেয়েও বরকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করে না।”

“অথচ ছেলেরা যা ইচ্ছে তাই করে। করার যুক্তিও খুঁজে নেয়।”

উজ্জ্বল বলল, “দিয়া, এই স্বাধীনচিত্ততার একটা দায়দায়িত্বও আছে কিন্তু। আমার কাজের জন্য আমি, একমাত্র আমিই দায়ী এই মনোভাবটা মানুষকে দারুণ সিরিয়াস করে তোলে।”

“হ্যাঁ”, বাবাই বলেছিল “ওই বদমাশ ছেলেগুলো তো বড়দের সঙ্গে পরামর্শ করে আমাদের উপর অত্যাচারটা করেনি, করেছে নিজেদের মর্জিতে। দায়িত্ব বৈকি, সিরিয়াসনেসও অবশ্যই।”

তার গলাতে তিক্ততা, তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ ফুটে উঠছিল।

উজ্জ্বল তার দিকে তাকিয়ে রইল। রানাঘাটের ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস মিটে যে-মেয়েটির সঙ্গে তার একদা আলাপ হয়েছিল সে ছিল যেমন সরল, তেমনই প্রতিক্রিয়াহীন। বাবাই নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করে যেত। কিন্তু যেসব অন্তর্নিহিত পলিটিক্স, রাক্ষুসে প্রতিযোগিতা, খেয়োখেয়ির চোরাস্রোত এসব জায়গায় সর্বদা বয়, সে হালকা পায়ে সেখান থেকে সরে দাঁড়াত। কোনও অভিযোগ ছিল না। লং জাম্পে ওজন আর হাইট নিয়ে সেবার কী একটা কারচুপি হয়েছিল। বাবাই তার পাওনা পেল না। কিন্তু সে নির্বিকার। প্রাণতোষদার উপর সে কথা বলবে না। তবে হ্যাঁ, সে ছিল অবিসংবাদী স্প্রিন্ট কুইন। শেষের ল্যাপে যখন ক্যানটার করত সে একটা দেখবার জিনিস। পাঁচ তিন-এর বেশি হাইট নয়। অথচ ক্যানটার করছে রেসের ঘোড়ার মতো। শিল্প একটা, নিজের শিল্পে বিভাবরী নিজেই মগ্ন। কোথায় কে কী অন্যায় করল তার উপর তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। এখনও আপাতদৃষ্টিতে সেই ঝগড়াবিমুখ ঠান্ডাস্বভাব বাবাইয়ের কোনও পরিবর্তন অন্যে টের পাবে না। কিন্তু উজ্জ্বল স্ফুলিঙ্গ দেখছে, রাগের স্ফুলিঙ্গ, তার মধ্যে অপমানের ক্রুদ্ধ অশ্রু মিশে আছে। তার খালি আফশোস হয় কেন বাবাই তাকে সেদিন ডাকল না। নতুন কিছু করলেই সে উজ্জ্বলকে বলে থাকে, অথচ সেদিনই…।

বাবাই লক্ষ করছিল উজ্জ্বলের ভাবান্তর। তার হঠাৎ কেমন মনে হল মফস্সল থেকে চলে এসে সে কি ভুল করেছে? বারবার সেইজন্যেই ঠেকে যাচ্ছে ভালবাসাহীন, নীতিহীন, বিবেকহীন একটা চোরা জালে? দূর, তা-ও আবার কখনও হয় নাকি? উচ্চশিক্ষার জন্য, চাকরির জন্য, মানুষ ক্রমাগত যাতায়াত করছে গ্রাম থেকে গঞ্জে।. গঞ্জ থেকে শহরে। আরও বড় শহরে, স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে। এক জায়গায় থেকে গেলে হয়তো একটা নিরাপদ জীবন পাওয়া যায়, কিন্তু সেটা কুয়োর ব্যাঙেরও জীবন। আসলে সে যে কোথাও একটা হেরে যাচ্ছে, তাকে লোকে ঠকাতে পারছে, ঠকিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে এই ব্যাপারটাই ক্রমাগত তার আত্মসম্মানে ঘা দিয়ে যাচ্ছিল। আর একটা জায়গায় এসে আত্মসম্মান আর আত্মবিশ্বাসে তেমন কোনও তফাত থাকে না। বাবাইয়ের আত্মবিশ্বাসটা তার অজান্তেই চুরচুর হয়ে যাচ্ছিল। যেহেতু আপাতদৃষ্টিতে দিয়া আরও ভঙ্গুর এবং তাকে ক্রমাগত মরাল সাপোর্ট দিয়ে না গেলে সে ভেঙে পড়তে পারে, তাই বাবাইয়ের নিজের ভঙ্গুরতা যেন মুলতুবি থাকছিল সমস্ত সময়টা। মানে, কাউকে সে বুঝতে দিচ্ছিল না তার কথা। সে যেন বরাবরের মতোই স্প্রিন্টকুইন, জিতবেই। একটুর জন্যে জয় ফসকে গেলেও কান্নাকাটির বান্দা নয়। উজ্জ্বল কি বুঝতে পারছে? কেউ যদি পারে, একমাত্র উজ্জ্বলই পারবে। কেননা ক্রীড়াজগতের নোংরা পলিটিক্সের মধে তাকে দেখেছে একমাত্র উজ্জ্বলই। উজ্জ্বলই বোঝে তার স্বভাব। অনেকবার বলেছে, মাঝে মাঝে ফোঁস কর, সব সময়েই যদি সদাশিব আশুতোষ হয়ে থাকিস, বরাবর কিন্তু লোকে তোরটা লুটে নিয়ে যাবে। বস্তুত তার স্বভাবের মধ্যেই এই প্রশান্তি, স্থিরচিত্ততা আছে বলেই মা-বাবা তাকে কাছছাড়া করতে সাহস পেয়েছেন। দিদি যখন সংশয় প্রকাশ করেছিল মা বলেন, “না রে ও খুব ধীরস্থির, চট করে ভড়কাবার, ভেঙে পড়বার মেয়ে নয়।”

উজ্জ্বল, উজ্জ্বল তুই কী ভাবছিস জানি না, কিন্তু আমার প্রশান্তি টুটছে, কোথাও-কোথাও একটা ঘোর পরিবর্তন আসছে, সেটা শেষ বিচারে ভাল কি মন্দ তা আমি জানি না। কিন্তু বদলটা যে আসছে, আমি হাজার মলম লাগিয়েও তার জ্বালা যে আটকাতে পারছি না, এ-কথা তুই অন্তত বুঝিস।

ঠিক সেই সময়েই রিনার গোয়েন্দাগিরির প্রত্যক্ষ ফলাফল পৌঁছে যাচ্ছিল রূপরাজের কাছে। এক নং, দু নং, তিন নং করে করে যতদূর সে বার করতে পেরেছে। শক্ত হয়ে যাচ্ছিল রূপরাজের ঠোঁট, চোয়াল। সংকল্প জমছিল ভিতরে। লৌহ-কঠিন সংকল্প। রিনা ভয় পাচ্ছিল, “রূপ, নিজেকে সামলা, এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?”

“দেখ রিনা, প্রথম কথা তুই যেন পুরোটা আমায় ফ্যাক্স করেছিস, আমার মুখের কী ভাব হল না হল তোর দেখার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, এরপরও আমাকে কার্তিক ঠাকুরটির মতো দেখাতে হবে? বাঃ, আপাতত তুই ফোট্, আমায় একা থাকতে দে। অনেক কিছু ভাববার আছে, থ্যাঙ্কস্।”

“একটা বিদ্রোহ দরকার। একটা অজানা জায়গা, যেখানে কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না। কিছুটা নিশ্চিন্ত অবসর। সম্পূর্ণ একটা একলা, কারও উপর অ-নির্ভর নিজস্ব পৃথিবী, যেখানে নিজের সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তি পরিষ্কার কাজ করে। একমাত্র বন্ধুদের নিয়ে কোনও ঝামেলা নেই। পৃথিবীতে এরকম কোনও জায়গা আছে যেখানে মানুষ নেই বা থাকলেও সম্পর্কের মধ্যে আসে না, বা আসলেও বিরক্তি উৎপাদন করে না, অনাবশ্যক কৌতূহল দেখায় না।”

“আছে, আছে, সব আছে। আমি এক ডজন জায়গার নাম করতে পারি,” রূপ বলল।

“আই নিড ইট ভেরি মাচ,” আরিয়ান বলল।

কথা হচ্ছিল, শুকতারার বাড়িতে একটা জোর টেনিস সেশনের পর। প্রত্যেকেরই কাঁধে সাদা তোয়ালে, সামনে লম্বা গ্লাস শরবত।

শুকতারা বলল, “উই আর আ পার্ফেক্ট সিক্স-সাম। তিন ছেমরি, তিন ছ্যামরা। চল কেটে পড়ি।”

“আর একটু বেশি হলে জমত ভাল,” উজ্জ্বল বলল। “আরিয়ান দেখ না তোদের ক্লাব থেকে যদি আরও জনা চার পাওয়া যায়।”

“ক্লাব, আরে ধুস ইয়ার! ওই ফান্টুস ক্লাবটার কথা তোর কী করে মনে এল? ওরা তো সব ব্যাবসাদার, টাকা-আনা-পাই ছাড়া কিছু বোঝে না। ওরা করবে অ্যাডভেঞ্চার?”

“ঠিক আছে, এবারে ছোট করে হোক পরে সার্কল বাড়লে দেখা যাবে।”

রূপরাজ বলল, “কিন্তু তোরা মেয়েরা বাড়িতে না বলে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারবি?”

“আরে ক’টা দিনের জন্য তো!” শুকতারা বলল। “ম্যানেজ করে নেব।”

দিয়া বলল, “আমার মা-বাবা কেউই এখানে নেই, স্রেফ বাসুদিকে বলে বেরিয়ে যাব।”

বাবাই কাচুমাচু হয়ে গেল, “আমি অনায়াসেই মা-বাবাকে না বলে যেতে পারি। প্র্যাক্টিক্যাল ডিফিকাল্টি কিছু নেই। কিন্তু টাওয়ার থাকলে ফোন করব রে।”

আরিয়ান বলল, “একেই বলে ‘যেতে যেতে চায় না যেতে ফিরে ফিরে চায়।’”

বাবাই অবাক, “তুমি রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা জানো?”

“মানে, হোয়ট ডু ইউ মিন? আমার মা বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ রবীন্দ্রসঙ্গীত চালিয়ে রাখে।”

“রিয়্যালি,” শুকতারা বলল। “তুই বোর হোস না?”

“হলে কী করা! শি ইজ ডেড সিরিয়াস। আর শুনতে-শুনতে লাগসই লাইনগুলো কেমন মুখস্ত হয়ে গিয়ে কাজে দিচ্ছে বল? আই ক্যান ইমপ্রেস লটস অব পিপল। শুক্‌স, তুই সে জায়গায় একটা রবি-লাইন বল জনগণ ছাড়া, বন্দেমাতরম ছাড়া।”

সবাই হেসে উঠল।

“কী ব্যাপার, হঠাৎ এত হাসি?”

“তুমি কি ভেবেছিলে, বন্দেমাতরমটাও রবীন্দ্রসংগীত?”

“নয়? আয়াম সরি, রিয়্যালি সরি। কার ওটা?”

“বঙ্কিমচন্দ্রের।”

“দেবদাসের রাইটার ?”

“ওঃ আরিয়ান তুই এবার ক্ষান্ত দে,” শুকতারা বলল।

‘“দেবদাস’ শরৎচন্দ্রের, আর ‘বন্দেমাতরম’ বঙ্কিমচন্দ্রের, যিনি ‘রাজসিংহ’, ‘আনন্দমঠ’, লিখেছিলেন।”

“ওঃ হো সেই কমিউন্যাল রাইটার?”

উজ্জ্বল বলল, “তোর মাথা, এইভাবেই কি তুই লোকজনকে ইমপ্রেস করিস?”

“আরে রাম, লোকজন ইজ অলরাইট, এই বন্ধুবান্ধবরাই দেখছি বড্ড টাফ।”

আবার একদফা হাসি উঠল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress