ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 17
পরদা, কুশন কভার সব পালটে দিয়েছেন এবার। উজ্জ্বল কমলা রঙে ঝলমল করছে বাড়ি। বদলেছেন পাপোষ। তোয়ালে। শক্তি বলে একটি ছেলে মাসে মাসে পরিষ্কার করে দিয়ে যায় সব। মেঝে ঝকঝক করছে। পেতলের টব, ফুলদানি থেকে আলো ঠিকরোচ্ছে। আসবাবপত্র সব ভাল করে মুছে চকচকে করে দিয়ে গেছে। অন্ধকার বাড়ি! অন্ধকারে আর ঢুকতে হবে না নবগোপালকে। যতই ভালবাসুন শ্রীকে, এ বাড়ির আবহাওয়া, চেহারা কোনওদিনই ভাল লাগেনি তাঁর।
—হ্যাঁরে শ্রী, পরদাটরদা কাচতে দিস না?
—ও হ্যাঁ তা মাঝে মাঝে দিই তো, পঞ্চমীকে বলা আছে।
—বললেই হবে! নিজে একটু-আধটু দেখলেও তো হয়।
—ধোপার বাড়ি দিলেই কেমন রং জ্বলে যায়, বুঝলি!
—ধোপার বাড়ি দিবি কেন। ওয়াশিং মেশিনে কাচা।
—কে মেশিন চালাবে রে! পঞ্চমীকে বলব, হয়তো মেশিন বিগড়ে বসে থাকবে, তখন ধুন্ধুমার বকুনি খাব।
—মেয়ে তো যথেষ্ট বড় হয়েছে, ওকে ইনভল্ভ কর।
—ও না হলে, হতে চাইলে আমি কী করব বল।
—একটা আঠারো-উনিশ বছরের মেয়ে শুধু হোটেলের মতো ব্যবহার করবে বাড়িটাকে? কোনও মায়া মমতা রুচি
কিচ্ছু থাকবে না? ওর ঘরটা দেখেছিস?
—আগে দেখেছি। অনেক শিখিয়েছি। শি রিফিউজেস টু লার্ন।
—শ্রী, ওর কি একটু কাউনসেলিং দরকার? বয়সটা টিন এজ পেরোচ্ছে তো? ভেতরে কোনও জটিলতা তৈরি হচ্ছে না তো? তুই নবগোপালের সঙ্গে কথা বল।
—তুই-ই বল না সর্বাণী।
—আমি বলবার কে? তুই থাকতে তোর মেয়ের কথা আমি বলব?
—তুই এ-বাড়ির অনেক। আর আমি মা হতে পারি। কিন্তু তুই তো ওর টিচারও!
শ্ৰীলার কোনও শখ, ইচ্ছাশক্তি কিছু ছিল না। এমন অদ্ভুত চরিত্র আর দেখেননি সর্বাণী। যেহেতু নবগোপালের সঙ্গে বনিবনা হল না, তার বাড়ি-সংসার কিছুকেই কোনওদিন আপন মনে করতে পারল না শ্রী। একমাত্র মেয়েটি ছিল তার দায়, তার আনন্দ। সেই মেয়েও যখন দূরে সরে যেতে থাকল, গোঁয়ার, উচ্ছৃঙ্খল, স্বার্থপর হয়ে উঠতে লাগল—শ্রী দ্বিতীয় দফায় সরিয়ে নিল নিজেকে। আর যেন তার কোনও কর্তব্য রইল না। নিজে ডুবে যেতে থাকল নিজের গভীরে। সেখানে কোনও ইতিবাচক কিছু ছিল কিনা তা বুঝতে পারেননি সর্বাণী। পরলোকে বা পরজন্মে বিশ্বাস। ঈশ্বর অথবা ঠাকুরদেবতা। দুর্বল, হতাশ মানুষরা যখন ঠাকুরদেবতা, ধ্যান-পূজা এসব আঁকড়ে ধরে, তখন এক হিসেবে বেঁচে যায়। কেননা কোথাও-না-কোথাও মানুষের একটা নোঙর থাকা দরকার, নোঙর অথবা শেকড়। শ্রীর কোনওটাই ছিল না। জামশেদপুরের মেয়ে। ওর মা ওর বিয়ের অল্প পরেই মারা যান। বাবার দেখাশোনা করতে মাঝে মাঝে জামশেদপুর যেত শ্রী। নিজের সংসার যে সামলাতে পারে না, সে বিপত্নীক প্রৌঢ় বাবার ছোট্ট ফ্ল্যাটের সংসারটি কেমন সুন্দর সাজিয়ে রাখত। হাতের কাছে সব, লোকজনেদের কড়া নির্দেশ, কেউ দিদির কথা অমান্য করবার সাহস পেত না। অবশ্য, ওর বাবাও খুব গুছোনো ধরনের মানুষ ছিলেন। দীর্ঘদিন টিসকোয় কাজ করেছেন। জীবনটা একটা ছন্দে বাঁধা। তাঁরও স্ত্রী খুব জোরালো ছিলেন না। এই অক্ষম শরীর-মন কি শ্রী মা’র কাছ থেকেই পেয়েছিল?
যাই হোক মিমির বছর দশ-এগারো বছর বয়সের সময়ে তিনিও মারা গেলেন। এইবারে শ্রীর আর কোনও আশ্রয় রইল না।
—চল তোদের সোনারির ফ্ল্যাট থেকে ক’দিনের জন্যে ঘুরে আসি। তুই, আমি আর মিমি।
—ও ফ্ল্যাট তো বিক্রি হয়ে গেছে সর্বাণী।
—কেন?
—কে দেখবে? বাবার সব ফার্নিচার বইটই সবসুদ্ধু বিক্রি হয়ে গেছে। নবগোপাল বলল ওর পক্ষে দেখাশোনা সম্ভব নয়।
—কেমন সুন্দর একটা বেড়াবার জায়গাও তো ছিল আমাদের।
—তো চল না, পুণে, গোয়া, বাঙ্গালোর, উটি—নব সব ব্যবস্থা করে দেবে, তুচ্ছ জামশেদপুরি ফ্ল্যাট তোকে কী ছুটির স্বাদ দেবে রে সর্বাণী! কিচ্ছু না! তা ছাড়া টাকাটাও তো আমারই অ্যাকাউন্টে জমানো আছে। যা খুশি করতে পারি।…একটু থেমে বলেছিল, খালি আমার সেই খুশিটার কোনও দেখা নেই।
বাইরে থেকে দুর্বল। কোনও প্রতিরোধ নেই। প্রতিকূল পরিবেশকে বাগে আনবার কোনও ইচ্ছেই নেই। পরিবেশটা যে প্রতিকূল এটাই তার অভিমান। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভীষণ জেদ। দাওনি যখন পাবেও না, গ্রহণ যখন করোনি, তখন আমারও কোনও গ্রহণ করার প্রশ্ন নেই। সারা জীবন ধরে এমন জেদ এই মনোভঙ্গি টিকিয়ে রাখতেও তো কম শক্তি লাগে না, কম অহংকার লাগে না। সর্বাণী এমনটা ভাবতে পারেন না। তাঁর দর্শন হল—ফরগিভ অ্যান্ড ফরগেট। জীবনকে হাসিখুশি ঝলমলে মালিন্যহীন রাখবার চেষ্টা করো, যেন একটা খেলার মাঠ। উঁচু-নিচু সব ভেঙেচুরে সমান করা হয়েছে। চারপাশে গ্যালারি, অথবা গ্যালারিহীন শান্ত ভোরবেলা। পায়ের তলায় উচ্ছ্বসিত সবুজ। এইবারে তুমি সেই ঘাস-না-ছাঁটা সমান পথ পরিক্রমা করো। খড়ির দাগ আছে। গণ্ডি আছে। তুমি যদি মসৃণ ছোটো তা হলে তুমি ঠিকঠাক নিজস্ব ট্র্যাকেই ছুটবে। গণ্ডিটার কথা ভুলে যাও। ভোরের হাওয়া তোমার ঘামে এসে লাগছে। ভেতরে তোমার রক্ত জোরসে ছুটছে। ধমনী বেয়ে নির্ভুল পথে হৃদয়ে। স্বাস্থ্যকর ছন্দে গাইছে হৃৎপিণ্ড। তোমার শরীরে স্বাস্থ্য, প্রাণে শক্তি, মননে স্বচ্ছতা, হৃদয়ে দরদ। ব্যস এবারে তুমি মোকাবিলা করতে পারবে সব রকম সমস্যার। জীবনে কোনও সমস্যা হবে না, তা তো আশা করা যায় না! হবেই! কিন্তু শরীর, প্রাণ, মন, হৃৎ যদি স্বচ্ছন্দে চলে তা হলে মুখোমুখি হওয়া যায় সব বিপদের। বিপদে আমি না যেন করি ভয়। ওই যে ওই মেয়েটি অদিতি সরকার! তনিকার কাছে শুনেছেন ওর জীবনের বাইরের কথাগুলো । দু’বার ডিভোর্স হয়েছে। তনিকাও জানে না কেন, তিনিও না। কিন্তু যে কারণেই হোক, ওর নিজের কারণে না হওয়াই সম্ভব। এত স্থিরবুদ্ধি, এতটা সাহায্যশীল। নমনীয় বলেও মনে হয়েছে তাঁর। এ যে কাউকে ক্ষমার অতীত বলে মনে করতে পারে তা যেন ধারণায় আসে না। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছেন তিনি শুনে যে এখন ওর বাড়িতে ওর দ্বিতীয় স্বামীর মা। রোগশয্যায়। আর মানুষ কী করতে পারে!
—তনি তোদের বয়স অল্প, তাতেই অনেক কথা জেনে গেছিস। আমরা হয়তো এতটা জানতাম না। কিন্তু জানা মানেই জানা নয়…জানতে হলে দৃষ্টান্ত দিয়ে জানতে হয়, অভিজ্ঞতা দিয়ে জানতে হয়। যদি তা প্রত্যক্ষ হয় ভাল। কিন্তু যদি হয় পরোক্ষ, তা হলে অন্যের সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজের মনের গভীরে নাড়াচাড়া করতে হয়। এ কথা যদি তোদের ধাঁধার মতো লাগে তা হলে বুঝতে হবে তোরা অপরিণত আছিস। বড় হয়েছিস শুধু। অনেক তথ্য তাদের হাতের মুঠোয়, কিন্তু মনটা কাঁচা।
মিমিও ছিল। নিঃশব্দ। ওপরের দালানে বসার জায়গায় একটা গুর্জরি দোলনা আছে। তাইতে বসে আস্তে আস্তে দুলছিল। তিনি তনিকেই বলছিলেন। কিন্তু মিমিকে তো বাদ দিয়ে নয়। কিন্তু এই জায়গায় মিমি একলাফে দোলনা ছেড়ে উঠে ঘরে চলে গেল।
—যাই বলিস আর তাই বলিস। মেয়েটিকে আমার বড় ভাল লেগেছে। অত নামকরা আর্টিস্ট! প্যারিসের বিখ্যাত স্কুলের অ্যাওয়ার্ড পাওয়া মেয়ে, কী নিরভিমান! ওগুলো যেন ওর বাইরে পড়ে আছে। ও হল আসলে একটা মানুষ যে ছবি আঁকে।
—তা সবাই-ই তো তাই আন্টিমাসি—একজন মানুষ যে ছবি আঁকে। একজন মানুষ যে লেখে…
—না, একটা সূক্ষ্ম তফাত আছে। তো দের ওই ভাস্কর চক্রবর্তী! ও হল আগে ছবি আঁকিয়ে, তার পরে মানুষ, অদিতি আগে মানুষ পরে তার ছবি।
—তুমি তো ওঁর ছবি দেখোনি মাসি, ওঁর আঁকার সময়েও ওঁকে দেখোনি, তখন এই যে এত মিশুকে, এখান থেকে ওখান দৌড়ে বেড়াচ্ছেন—এসব বোঝা যায় না।
—কেমন তখন?
—একেবারে মগ্ন। কে পাশে দাঁড়িয়ে আছে টের পাবেন না। আমি একদিন গেছি, শীলাদি বলে ওঁর বাড়িতে একজন থাকেন, তিনি বললেন—আঁকার ঘরে আছে। তুমিও তো আঁকো। যাও না, যাও। আমি পাশে একটা মোড়া টেনে বসলাম। একটু পেছন দিকে। ডান দিকে টুলের ওপরে রঙের বাটি বসানো। একটা পোর্ট্রেট করছিলেন অয়েলে। উনি মগ্ন হয়ে থাকলে মনে হয় উনি কারও নন। উনি ছবির। সেই মুহূর্তের ছবিটার।
—সে তো হবেই। তোর হয় না?
—আমি? খানিকটা আঁকব, তারপর জল খাব, আবার কাজ করছি, হঠাৎ উঠে পড়লাম। একটু ঘুরে এলাম। আমার ছবি খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় মাসি। না হলে আমার ধৈর্য থাকে না।
—তাই কি অমন ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া ছবি আঁকিস?
—আসলে আমি ছবি আঁকি না মাসি, আমি একটা… মানে… একটা মেজাজ, একটা মানসিক অবস্থা আঁকি।
—অন্যের মেজাজও আঁকিস বোধহয়। নিজের ঘরের দরজার কাছ থেকে মিমি বলল।
—মেজাজ?
—ওই যে তো র সুবীর রাস্না সব বলছিল সে দিন তো দের চুলোচুলির ছবিটা চুলোচুলির আগেই আঁকলি কী করে?
—সে আবার কী!
—ওই যে সেই দুটো বিচ্ছিরি বেড়াল এঁকেছিলি! প্রাইজ পেলি। যেদিন অ্যাকাডেমিতে তোর সঙ্গে আমার একহাত হয়ে গেল।
—ও, যেদিন রাতে ভাস্কর চক্রবর্তীর স্টুডিয়ো থেকে তোকে পাঁজাকোলা করে তুলে আনা হল? উনি দূর করে দিয়েছিলেন রাতে? সেদিন?
কুটিল চোখে তার দিকে তাকিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল মিমি।
—খ্যাপাচ্ছিস কেন শুধু শুধু?—সর্বাণী বললেন।
—খ্যাপাচ্ছি না, মনে করিয়ে দিচ্ছি।
উঠে গিয়ে দরজায় টোকা দিল তনিকা—মিমি, মিমি…দরজা খোল। একটু পরে খুলে দিল—এবার আবার কার কথা মনে করাতে এলি? তস্কর?
—না, তনিকা হেসে বলল—তোকে নিয়ে ‘চিত্রভানু’তে যেতে বলেছিলেন অদিতিদি। আমি ঘুরে এসেছি। যাবি?
চোখ সরু করে মিমি বলল—ও ঘুরে আসা হয়ে গেছে? আমার নামে আরও এক দফা বলে এলি বোধহয়।
—তোর কথা কাউকে, আবার অদিতির মতো সেলিব্রিটিকে বলা যায়?
—যেখানে যেখানে আমার যাওয়ার থাকে, ঠিক আগে আগে পৌঁছে যাস, না?
আবার একটা কথা কাটাকাটি শুরু হতে যাচ্ছে দেখে, সর্বাণী বলেছিলেন—নীচে আয়, রান্না রেডি। দেরি করবি না। ডাক্তার মিমিকে খুব সময়ে খাওয়াদাওয়া করতে বলেছেন। ওর কিন্তু আলসারের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তিনি নেমে গেলেন। শুনতে পেলেন মিমি বলছে—তনি, তোকে হাত করে নিল, বাবাকে হাত করে নিল। কিছু করতে পারলাম না। এখন ডাক্তারগুলো কেও হাত করে নিচ্ছে।
মিটিমিটি হেসেছিলেন তিনি। এত সহজে রসবোধ যায় না ওঁর।
দুঃখের বিষয়, বেরোতে শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আবার অনিয়মিত হয়ে যেতে শুরু করেছে মিমি। শরীরটা সেরেছে। কী সুন্দর দেখায় আজকাল। পোশাক পরিচ্ছদগুলো সব ড্রাই ক্লিন করিয়ে দিয়েছেন। সেই রকম জিপসি জিপসি পোশাকই পরে, কিন্তু এখন ওগুলো বেশ ঝকঝক করে। কিছুটা টিফিন নিতে ওকে বাধ্য করেন তিনি। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ। কিন্তু আজ এখনও ফিরল না।
—এত রাত? মিমি?
খাবার টেবিলের ওপর হাত রেখে বসেছিলেন। মেয়ে ঢুকতে একদিন বললেন। পঞ্চমী দরজা খুলে দিয়ে চলে গেছে।
কোনও জবাব দিল না।
—দেখো মিমি, রাত এগারোটা বাজছে। এসব চলবে না। যদি কিছু হয়, আমার নিজের ভাবনাচিন্তা টেনশনের কথা ছেড়েই দাও। তোমার বাবাকে কী কৈফিয়ত দেব বলো তো! একটু বোঝবার চেষ্টা করো । কলকাতা এখন খুব আনসেফ। আমার ভয় করে।
—আমি খেয়ে এসেছি। আমার জন্যে এত রাত অবদি না খেয়ে বসে থাকবার দরকার নেই। আমার নিজের মা-ও বসত না। আমি এসব পছন্দ করি না।
বলতে বলতে তিন লাফে ওপরে চলে গেল মিমি।
এই গেল একদিন।
আজ সকাল ন’টার সময় কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেছে। বাড়ি ঢুকল রাত দশটা।
—মিমি কাউকে কিছু বলে যাওনি কেন? ঘরে ঘরে খুঁজছি আমরা। এইভাবে ভাবাবে আমাকে? আমি কিন্তু এবার স্টেপ নেব।
বলে চলে এলেন। ঘুম আসছে না। ঘুম আসছে না। রাত তিনটে নাগাদ ফোন করলেন—
—হ্যালো।
—সর্বাণী বলছি। আমি মিমিকে হ্যান্ডল করতে পারছি না। আমার খুব ভয় করছে।
—কেন? কী হল আবার।
—এত ক্যাজুয়ালি কথা বোলো না নবগোপাল। ও আমাকে একেবারেই মানছে না। এত রাত করে বাড়ি ফেরে আমার প্রচণ্ড টেনশন…
—আরে, মিমি কি তোমার সেই স্কুলের মেয়েটি আছে? শি ইজ কোয়াইট এব্ল টু টেক কেয়ার অব হারসেলফ।
—ও যে মাস দেড়েকের ওপর ভাস্করের কাছে চলে গিয়েছিল ওর স্টুডিয়োতে ছিল—ও কথা তোমাকে জানাইনি।
এখন জানিয়ে দিলাম। অনেক কষ্টে নিয়ে এসেছি।
—হোয়ট?
—হ্যাঁ, অনেক কষ্টে নিয়ে এসেছি। খুব শরীর ভেঙে গিয়েছিল। সেরে উঠেছে, আবার উচ্ছৃঙ্খলতা শুরু করেছে।
তুমি শিগ্গিরই এসো।
ফোন নামিয়ে খাটে বসতে গিয়ে দেখলেন জ্বলন্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক যেন একটা কেউটে সাপ।
—কাকে? কাকে ফোন করছ?
কথার কোনও জবাব দিলেন না। ভেতরে ভেতরে চমকে গেছেন খুব।
—কী লাগাচ্ছিলে, বাবার কাছে? আমার বাবার কাছে। আমার বিষয়ে?
ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কেমন একটা ঘাম দিচ্ছে তাঁর। তিনি কথা না বলে শুয়ে পড়লেন।
দু’পা এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল হঠাৎ। আঁচড়ে কামড়ে দিচ্ছে, চুল ধরে হিড়হিড় করে টানছে—কে তোমাকে বলেছিল বাড়ি সাজাতে, কেন সাজিয়েছ আমাকে জিজ্ঞেস না করে?
সমস্ত শক্তি দিয়ে ওকে দূরে ঠেলে দিলেন তিনি। যথাসম্ভব ঠান্ডা চোখে চেয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন, তুমি আলোচনা করলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হত না। কিন্তু ঢুকলে কী করে ঘরে?
—বাবাকে কী বলছিলে, বলো?
—সে কথা জেনে তোমার লাভ নেই। তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। আমি যা করার কাল সকালে করব। যা-ও।
—কী করবে? পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেবে? চমৎকার। মাকে খুন করেছ, এবার মেয়েকে পাগল বানাচ্ছ। চমৎকার খেলছ!
—কী বলছ! আমার ধৈর্য চলে যাচ্ছে। চলে যাও বলছি।
—মায়ের মুখের অক্সিজেন মাসক খুলে নাওনি? খাবি খেতে খেতে মরে গেলে আবার রিপ্লেস করে রাখোনি? আমি কিছু জানি না মনে করেছ, না? বাবা আসুক তোমার কীর্তির কথা সমস্ত ফাঁস করে দিচ্ছি।
তিনি বাক্যহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কিচ্ছু ঢুকছে না মাথায়, কী শুনছেন? কে বলছে? এ কী? এসব কী?
হঠাৎ তাঁর শরীরে একটা প্রচণ্ড বেগ এল। মন কাজ করছে না, শুধু শরীর। তিনি ড্রয়ার খুলে গাড়ির চাবিটা নিলেন। উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে গেলেন। ঝড়ের মতো দরজা খুললেন। একটার পর একটা দরজা খুললেন। শব্দ হতে লাগল। পঞ্চমী ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে। তিনি বেরিয়ে যাচ্ছেন। নিজের গাড়িটা বার করলেন। তারপর বেরিয়ে গেল গাড়ি।
—কী হল? পঞ্চমী চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল— কার কাছে? কোথায় যাচ্ছে মাসি? কারও কোনও খারাপ খবর… মিমি!
মিমি তখন সিঁড়ির ধাপে আস্তে আস্তে বসে পড়ছে।
—মাসি যে নাইটি পরে বেরিয়ে গেল গো? বাবুর কিছু হয়নি তো? এয়ারপোর্ট থেকে কিছু…
মিমি আস্তে আস্তে সিঁড়ির ওপর শুয়ে পড়ছে।
—কী হল মিমি? তোমার তোমারই শরীর খারাপ? না কি? মিমির গায়ে ঘাম দিচ্ছে। কথা বলতে পারছে না।
খবরটা সকালে পড়ল অদিতি। রেড রোডে অদ্ভুত অ্যাকসিডেন্ট। শেষ রাতে একটা নেভি ব্লু সান্ট্রো রেড রোডে ছোটাছুটি করছিল। তারপর স্কিড করে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের সঙ্গে ধাক্কা খায়। সাদার ওপর নীল ফুল ফুল নাইটি-পরা এক ভদ্রমহিলাকে মারাত্মক আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। কোনও ব্যাগ, কোনও পরিচয় বা লাইসেন্স কিচ্ছু নেই। তাঁকে এস. এস. কে. এম.-এ সংকটজনক অবস্থায় ভরতি করা হয়েছে। ছবিটা দেখবামাত্র চিনতে পারল অদিতি। মিসেস সর্বাণী সাহা রায়।
আর তারপরেই ফোনটা বাজল…
—দিদি আমি তনিকা বলছি। মিমি মানে অনোহিতার বাড়ি থেকে।
—দেখেছি—সংক্ষেপে বলল অদিতি,—কী ব্যাপার বলো তো?
—দিদি আমরা আপনার কাছে এক্ষুনি যাচ্ছি। আপনি একটু শৌনককে যেতে বলবেন? আমাদের তো হাসপাতালে যেতে হবে।—তনিকার গলা কাঁপছে।
—এসো—অদিতি চায়ের কাপটা তুলে আবার নামিয়ে রাখল। কাগজটা আবার তুলে ধরল। ইনি শেষ রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এত তাড়া, এত বিপদ যে নাইটি-টা পর্যন্ত বদলাননি। কিন্তু উনি কোথাও যাচ্ছিলেন না। রেড রোডে ওঁর গাড়িটা ছোটাছুটি করছিল। উনি হঠাৎ কোনও কারণে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। কোনও চৈতন্য ছিল না। না হলে অন্তত…বড় অস্থির লাগছে।
আজ প্রথম আঁদ্রে তার বাড়িতে আসছে। ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন করেছে সে। ছবি দেখাবে, মাধুরী ও শীলার সঙ্গে পরিচয় করাবে। বলে রেখেছে ওঁদের। শীলাদি চান করে উঠেই জলখাবারের আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। ওকে কি ফোন করে বারণ করে দেবে? মাথাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। টেবিলের ওপর মাথাটা রাখল সে। এত নার্ভাস বোধহয় কখনও হয়নি। মেয়েটি একেবারে একা…তার বাবা বাইরে কোথাও। খুব গোলমেলে মেয়ে!
—কী হল বউমা? শীলাদি মাথায় হাত রেখে আস্তে জিজ্ঞেস করল, চা খেতে খেতে নামিয়ে রেখেছ?
সে কোনওমতে কাগজটা দেখিয়ে বলল—চিনি। এঁকে। কাগজটা তুলে নিল শীলাদি।
—বলো কী? তোমার চেনা? যেন চেনা না হলে অ্যাকসিডেন্টটা কম মারাত্মক হত।
মাথা নাড়ল সে।
দরজার বেল বাজল। খুলে দিতে চলে গেল শীলাদি। এত তাড়াতাড়ি এসে গেল মেয়ে দুটো? না। বিদেশি গলা শুনতে পেল। আঁদ্রে বলছে—একটু সকাল সকাল এসে গেছি। ভোরবেলায় কলকাতা দেখতে বেরিয়েছিলাম। তোমাদের কোনও অসুবিধে করলাম না তো?
শীলাদি কোনও উত্তর দিচ্ছে না। একটু পরে মাথায় ঘোমটা শীলাদি আর তার পেছন পেছন আঁদ্রে এসে ঢুকল তার বসবার ঘরে।
সাহেব আসবে বলে ক’দিন ধরেই খুব বাড়ি সাফ করছে শীলাদি। উঠোনটাকে একেবারে শ্যাওলা-মুক্ত, পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছে। অদিতির বসবার ঘরে একটা বিরাট রাজস্থানি কলসি ছিল। পাথরের ওপর মিনে কাজ করা। সেইটা নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছে নিমতলায়। কয়েকটা ফুলের টব, বোধহয় ফুলসুদ্ধু কিনে এনেছে। জড়ো করে রেখে আড়াল করে দিয়েছে পেছনে ড্রেনের অংশ, আর কিছুতেই পরিষ্কার না হওয়া উঠোন আর ভাঙা রোয়াক।
—অদিতি!
ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে অদিতি। চুপ করে বসে আছে। শান্ত। একটু ফিকে হেসে আঁদ্রেকে বসতে বলল।
—কী হয়েছে? তোমাকে যেন কেমন দেখাচ্ছে!
—কিচ্ছু না। চলো আমার শাশুড়ির সঙ্গে আলাপ করবে। শীলাদির সঙ্গেও পরিচয় করাল। —ইনি ওঁর বোনের মতো। সব সময়ে সঙ্গে থাকেন।
তারপর শীলাদিকে বলল— যা হয়েছে খাবার দিয়ে দাও।
শীলাদি চোখ তুলে তাকাল একবার তার দিকে।
চোখে চোখে তার দিকে চেয়ে অদিতি বলল—দাও।
আঁদ্রে বলল—অনেকটা হেঁটেছি। খিদেও পেয়েছে খুব। বলে হাসতে গিয়ে আবার চাইল—তুমি যেন ভীষণ ডিসর্টাবড মনে হচ্ছে? ওদিৎ কী হয়েছে বলো তো?
কী আশ্চর্য কতদিন পরে এলে। গল্প করো না! উত্তরে সে বলল, —কী রকম দেখলে কলকাতা?
—খুব স্বাস্থ্যচর্চা হচ্ছে, দেখলাম রাস্তার সাইডওয়াকে লোক হাঁটছে। ইয়াং পিপল দৌড়োচ্ছে দেখলাম। দারুণ উৎসাহ। স্পোর্টস প্রায়রিটি পাচ্ছে এখানে দেখছি।
—আমাদের এখানে খুব বেশি খোলা জায়গা তো নেই!
—জানি। জানি। তোমাকে তোমার শহরের হয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে না।
শীলাদি খাবার নিয়ে ঢুকেছে। সাজিয়ে দিয়েছে দুটো প্লেটে।
—বাঃ এটা কী? স্টফ্ড্ ডাম্পলিং মনে হচ্ছে?
একটা মাংসের শিঙাড়া তুলে নিয়ে বলল, এটা দিয়েই শুরু করি!
—এটা চাটনি। এইটে দিয়ে খাও— শুকনো হেসে বলল অদিতি।
—তুমি খাও।
—আমার আর সেই আগের অভ্যেস নেই আঁদ্রে। ব্রেকফাস্ট বেশি খেতে পারি না। তোমাকে সঙ্গ দিতে খাচ্ছি একটু। এখানে আমরা সামান্য লাঞ্চ খেয়ে কাজে বেরোই।
—কী খাও?
—ভাত, ডাল, মাছ।
—ওহ্ দারুণ সুস্বাদু তোমাদের মাছ। খাচ্ছি ক’দিনই। মনে আছে সাঁজেলিজে গেলেই তুমি ভেন্ডরদের থেকে ক্রেপ কিনে খেতে?
—আর রাত্তিরে রান্নার ভয়ে বাগেৎ আর চিজ নিয়ে বাড়ি ফেরা!
—রান্নার ভয় তোমার ছিল, আমার ছিল না। আমি তোমার জীবনে আসবার আগে তুমি ড্রাই ফ্রুটস, ক্রোয়সোঁ আর চিজ বাগেৎ খেয়েই দিন কাটিয়ে দিতে। আর ফল। তাই না?
—দুধ। দুধও খেতাম। আইসক্রিম।
—তাই বেশ গোলগাল ছিলে। এখন অনেক কালো হয়ে গেছ ওদিৎ। রোগাও।
শীলাদি চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকল।
অদিতি চা ঢেলে দিল। নিজেও এক কাপ তুলে নিল।
—তুমি যে আমার জন্য আবার আলাদা করে ড্রেস করোনি, তোমার হাউজকোটেই দেখা দিয়েছ, এ জন্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। একটু নিচু গলায় বলল আঁদ্রে।
—কেন?
—না, এই ইনফর্ম্যাল আচরণ আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে তুমি সেই আগেকার ওদিৎ, আমি সেই আগেকার আঁদ্রে। মাঝখান দিয়ে আদ্রিয়াতিক, ভূমধ্য সাগরের জল বয়ে গেছে, কিন্তু আমরা বদলাইনি।
—তুমি আমাকে কাপড় বদলাবার সুযোগ দিলে কোথায়? হাসিটা তার মুখে ফুটব ফুটব করেও ফুটল না পুরোপুরি। একটা সৌজন্যের ভঙ্গির মতো দাঁড়িয়ে রইল।
—চা-টা কিন্তু তোমার সেই চায়ের মতো অত দুর্ধর্ষ নয়।
—কী চা?
—ওই যে চা দিয়ে বলেছিলে চুপ করে খাও, কথা বলো না …
—বাৎ হোয়াৎস্ রঙ্ মা শেরি!
টুকরো টুকরো জবাব দিয়ে, আঁদ্রের খাওয়াটা সে শেষ করাতে পেরেছে। বলল— আঁদ্রে আসলে সকালে কাগজে একটা খবর পড়ে আমি বড় অস্থির হয়ে পড়েছি।
—কী খবর?
কাগজটা তুলে ওর হাতে দিল অদিতি, বলল— আমি এঁকে চিনি। খুব ভাল করে! ওঁর কাছে হসপিটালে যেতে হবে আমাকে, এক্ষুনি।
—শিয়োর। চলো যাওয়া যাক। —মুখের ভাব বদলে গেল, উঠে দাঁড়াল আঁদ্রে।
—না, তুমি নয়। আমাদের হাসপাতালের চেহারা তুমি দেখতে পারবে না আঁদ্রে। তোমাকে আমি দেখাতে চাই না। তুমি আজ ফিরে যাও। আবার একদিন গল্পসল্প হবে।
—নেভার। কখনও না। তোমাকে এত কষ্টের মধ্যে, বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে, নোংরার ভয়ে হাসপাতালে যাব না, এতটা স্বার্থপর তুমি আমাকে পাওনি। তুমি কিছুতেই আমাকে এড়াতে পারবে না। কে ইনি?
—ধরো, আমার একরকম দিদি!
—তুমি কাপড় বদলে এসো, আমি বসছি।
এর চেয়ে বেশি তর্কাতর্কি করবার এখন ক্ষমতা নেই তার। সে চট করে তার ঢোলা প্যান্ট আর পাঞ্জাবি পরে, চুলে চিরুনি চালিয়ে ক্লিপ দিয়ে মাথায় আটকে নিল। আরও কয়েক মিনিট অস্থির হয়ে বসবার পর বেল বাজল। কয়েক কদম এগিয়ে দরজা খুলে দিল সে। তনিকা। একা।
—ও কোথায়?
—হিস্টিরিক হয়ে গেছে দিদি, খালি বলছে আন্টিমাসি মরে যাবে, বাবা আমায় দূর করে দেবে, আমার আর কেউ রইল না। পঞ্চমীদির কাছে ওকে রেখে আমি ছুটে এসেছি। শৌনককে পেয়েছি। ও সোজা এস.এস.কে.এম-এ চলে গেছে। … দিদি আপনি কি যাবেন?
—তোমার সন্দেহ আছে? কিন্তু নিজের আত্মীয় কারও যাওয়া দরকার। না হলে হাসপাতালে অসুবিধে হবে।
—আমি … আমি মেয়ে ধরুন!
—তাতে কি হবে, তনিকা?
বুকে প্রচণ্ড জখম। একবারের জন্যই জ্ঞান ফিরেছিল। কাউকে খুঁজেছিলেন। কাকে? কে জানে? তারপর একটা হেঁচকি তুলে চলে গেলেন। ক্লিয়ার কেস অব সুইসাইড। বডি মর্গে যাচ্ছে।
অদিতি হাসপাতালের করিডরে কাঠের বেঞ্চির ওপর বসে পড়ল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তনিকা দু’ হাতে মুখ ঢেকেছে। তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে প্রপাত। কেঁপে কেঁপে উঠছে শরীরটা। আঁদ্রে শৌনককে নিয়ে চলে গেছে। পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক কথা বলাবলি, ব্যবস্থাদি আছে।
দাহকার্য সেরে শুকনো মুখে নবগোপাল বললেন— আপনাদের কী বলে যে ধন্যবাদ দেব, জানি না, আপনারা আমাদের কেউ নন, তবু বিপদের সময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তনি তোমাকে আর কী বলব! ভাল থাকো মা।
গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। একটু অপেক্ষা করলেন— অনোহিতা এল না। হুস করে গাড়ি ছেড়ে গেল।
ফ্যাকাশে মুখে অনোহিতা বলল— বাবা আর আমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। আমি কোথায় যাব?
—চলো, তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি— অদিতি বলল।
নবগোপাল ঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করে আছেন। একবারও মেয়ের দিকে তাকাননি। একটা কথাও তার সঙ্গে বলেননি। পঞ্চমী তাঁকে খাবার সময়ে খাবার দিয়ে আসছে ঘরে। একটু ফাঁক দরজা, তার ভেতর দিয়ে দেখা যায়, সেই এক পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বসে। সামনে টেবিলের ওপর হুইস্কির বোতল ও গ্লাস।
—তনি … বাবাকে বারণ কর। এত হুইস্কি খেলে বাবা মরে যাবে।
—মরে গেলে তো ভালই মিমি। তোকে আর কেউ কোনও বিষয়ে বাধা দেবে না। ভাল থাকবি।
—তনি এমন করে আমাকে বলিস না … আমার বুকের ভেতরটা যে কী হচ্ছে!
—ন্যাকামি করিস না মিমি। শোন, কাল সকালে আমি চলে যাব। তারপরে এটা তোর সংসার, তোর বাবা, তুই সামলা।
—আমি পারব না। পারি না।
—পারতে হবে। সামনে আর কোনও বিকল্প নেই!
—অদিতিদিকে ডেকে দিবি?
—তোকে নম্বর দিয়ে দিচ্ছি, তুই ডাক। আমি এর মধ্যে নেই।
—আমার সাহস হচ্ছে না।
—তা হলে ডাকিসনি! আমি শুতে যাচ্ছি।
অনেক রাতে গুটিসুটি হয়ে তার পাশে শুয়ে পড়ল মিমি। ঠিক পাঁচ দিন পর সামান্য শ্রাদ্ধকার্য শেষ হয়ে গেলে আবার লন্ডনে ফিরে গেলেন নবগোপাল। নিজের স্যুটকেসটা তুললেন, চলে গেলেন।
পঞ্চমী বলল— আমাকে ছুটি করে দাও মিমি। আমি আর এখানে কাজ করব না।
—কেন? পঞ্চমীদি!
—আমার সব সময়ে মনে হয় মাসি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ করছে!
—ও তোমার মনের ভুল। এ রকম একটা কাণ্ড হলে ভয় হয়।
—বেশ আমার তাই হচ্ছে। তুমি মাইনে দেবে দিয়ো। নইলে আমি চললুম। ওহ্— জলজ্যান্ত মানুষটা গো! আজ বিশ বছর ধরে … কী করাটাই না …
মুখে কাপড় দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল পঞ্চমী।
কেউ জানে না ঠিক কী হয়েছিল। জানে একমাত্র তনিকা। দুর্বল মুহূর্তে প্রবল কষ্টে অনুশোচনায় তাকেই শুধু বলে ফেলেছিল। তা ছাড়া এ কথাটা সে আগেও তনিকাকে বলেছে। অনেকভাবে আঘাত সে মাসিকে করেছে। কিছুতেই কিছু হয়নি। কোনখানে আঘাত করলে মাসির বিষদাঁত ভেঙে যাবে সে ঠিক বুঝতে পেরেছিল। ফল হবে এতেই। কিন্তু যা হল তা তার ধারণাতেও ছিল না। নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সে। স্পষ্ট করে জানে না কার জন্য। নিঃশব্দে। কেননা এখন তার চিৎকার আর কেউ শুনবে না।