ঝড়ের খেয়া (Jhorer Kheya) : 16
বাইশে শ্রাবণ শীলাদিরা জোড়াসাঁকো যাচ্ছে। দেখে, রবীন্দ্রসদন থেকে গান শুনে ফিরবে। নন্দিনী, চৈতালি, আর শৌনক সঙ্গে যাচ্ছে। আজ মাধুরীর শরীরটা ভাল লাগছে না, শীলাদি যেতে চায়নি, কিন্তু মাধুরীই জোর করে পাঠিয়েছেন। অদিতিকে থাকতেই হচ্ছে তাঁর কাছে। তার অবশ্য আপত্তি নেই। প্রত্যেক রবিবারেই শীলাদিকে তার ছাত্র সহযোগে এখান-ওখান পাঠাচ্ছে সে। ফলে শীলাদি অসম্ভব স্মার্ট হয়ে গেছে আজকাল। অল্পবয়সিদের হইহল্লার সঙ্গে ঘোরবার জন্য কিনা কে জানে, একটু যেন বেশি হাসিখুশি, বয়স যেন কমে গেছে।
কবির প্রয়াণপক্ষে দুর্দান্ত ভ্যাপসা গরম! এই বাড়ির গাঁথনি আগেকার বলে, বিশ ইঞ্চি মোটা দেওয়াল আর উঁচু সিলিংয়ের মধ্য দিয়ে তাত তেমন আসতে পায় না, এই রক্ষা। জানলাগুলোতে খসখসের পরদা লাগানো থাকে। সহনীয় গরম ঘরে। বাইরে থেকে এলে মনে হয় বুঝি বাতানুকূলিত। অদিতি একটা ইজেল টেনে আনে এ ঘরে, বসে বসে আঁকে। তার ফাঁকে ফাঁকে কথাও বলে। এ সময়টা খেলা-খেলা আঁকা। আজকে একটা স্কেচবুক নিয়ে বসেছিল। অলস আঙুলে স্কেচ করতে করতে মাধুরীর দিকে চোখ পড়ল। উনি একটা আরাম চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন, পায়ের কাছে একটা মোড়া, পা তুলে দিয়েছেন তার ওপরে। জানলা দিয়ে আলো এসে পড়েছে অর্ধেক মুখে। মুখটা খুব অদ্ভুত। এতদিন সে খেয়াল করেনি। রবীন্দ্রনাথের রহস্যময়ী নারী যেন ওঁর চামড়ার তলা থেকে ফুটে উঠছে। উলটোদিকের দেওয়ালের দিকে মুখ, আপাতদৃষ্টিতে শান্ত। কিন্তু কীসের যে অত কাটাকুটি মুখে। সারাজীবন খুব দুঃখ পেলে, সে দুঃখ নিজের ভেতরে অবিরত আটকে রাখলে চাপা কষ্টে, রাগে এমন চেহারা হতে পারে। সাধারণত প্রতিকৃতি সে আঁকে না। হঠাৎ মনে হল এমন জীবন্ত বিষয় সামনে, আঁকলেই তো হয়! একটা ছবি কম্পোজ করতে হলে আইডিয়ার জগতে মগ্নচৈতন্যের ঘরে বড় হাতড়াতে হয়। লাগে অনেকটা তন্ময়তা। আপাতত তার মন বড় বিক্ষিপ্ত। সে পারছে না। এই সময়ে বিষয় যদি সামনে উপস্থিত থাকে তা হলে মনের, আঙুলের একটু সুবিধে তো হয়ই। আর যেহেতু বিষয় ভেতরের নয়, বাইরের, তাই একটা মুক্তির স্বাদ পাওয়া যায়। ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’ যাকে বলে। দ্রুত হাতে কয়েকটা রেখা টানল সে। মাধুরী যেন চটকা ভেঙে জেগে উঠলেন।
—আজকে ইজেলের সামনে তো বসলে না বউমা!
—না, এমনি স্কেচ করছি।
—তোমার শ্বশুরের জন্যে কত স্কেচ করে দিয়েছ মনে আছে!
ছবির রেখার দিকে মন, অদিতি বলল—হ্যাঁ—অ্যা! ওঁর বইয়ে সেগুলো তো বেরিয়েওছে। মন্দিরের রোয়াকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা… মা মুখটা প্লিজ একভাবে রাখুন।
—কেন? আমাকে আঁকছ নাকি?
—আপনি রাখুন না মুখটা। অমনি নয়, ঠিক আগের মতো। একটু বাঁদিকে হেলে… —হ্যাঁ…
—তা হলে কথা বলতে বারণ করছ?
—কথা বলুন না, ভঙ্গিটা ঠিক রেখে। থ্রি ফোর্থ আসছে। মুখটা।
—কী আঁকছ? তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, এখন আঁকবার কী অবশিষ্ট আছে? অদিতি হেসে ফেলল —মা। ছবি হল ছবি। বাইরের আকৃতি, ভেতরের প্রকৃতি যেই মিলব মিলব করে অমনি একটা ভাল ছবি হয়। তার সঙ্গে বয়স বা দৈহিক সৌন্দর্যের কোনও সম্পর্ক নেই।
—সর্বনাশ! তুমি কি আমার ভেতরটা আঁকবে নাকি?
—ভেতরটা আঁকা কি খুব সহজ মা? আঁকলেও সেটা হয়তো আপনার ভেতর হবে না। আমারই ভেতর হবে। ইন্টারপ্রিটেশন যাকে বলে।
—বুঝলাম না। একটু বুঝিয়ে দাও।
—ধরুন, আপনিই একটা উদাহরণ দিন রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়রের চরিত্র থেকে, এগুলো তো আপনি খুব পড়তেন!
—কে বলল?
—কে আবার বলবে, আমি দেখেছি। তা ছাড়া বাবাও বলতেন।
—কী বলতেন?
—এই, রবীন্দ্রনাথ আপনার কণ্ঠস্থ মুখস্ত। শেক্সপিয়র ভালবাসতেন বলে বাবা আপনাকে কত পড়িয়ে দিয়েছেন শেক্সপিয়র।
—এইসব কথা তোমাদের হত?
—হত না?
—আর কী বলতেন? মেয়েটি আমার প্রথম…তার কথা।
—নিশ্চয়। এ তো তাঁরও চাপা কষ্ট ছিল!
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন— কী যে উদাহরণের কথা বলছিলে?
—ইন্টারপ্রিটেশন বোঝাবার জন্যে। যে-কোনও একটা চরিত্র বলুন, রবীন্দ্রনাথ থেকেই হোক, শেক্সপিয়র থেকেই হোক…
—তা হলে ধরো ডেসডিমোনা…
—আচ্ছা বলুন ডেসডিমোনাকে আপনার কী লাগে? কী মনে হয়? অন্যে কে কী বলে—ছাড়ুন। আপনার কথা বলুন।
—তা যদি বলো অদিতি ডেসডিমোনাকে আমার খুব বোকা মনে হয়, ওই আরেকটা মেয়ে জুলিয়েট! —ও দুটোই রামবোকা। তবে কী জানো! কতই বয়স! ভুল করবারই বয়স! বেঘোরে চলে গেল। ও তোমার রোমিও-ও যেমন পাঁঠা, ওথেলোও তেমন একটা নিষ্ঠুর, গোঁয়ারগোবিন্দ। আবার এ-ও বলি, বেশ কিছু বোকা আর গোঁয়ার না মিললে একটা ট্রাজেডিও হয় না। কে তোকে বউয়ের কথা শুনে ডানকানকে খুন করতে বলেছিল? কী করতে যাচ্ছিস তা তো ভালই বুঝেছিলি! এমনও নয়, তোর ব্যক্তিত্ব বউয়ের চেয়ে কিছু কম! একবার একটা মার্ডার করার পরে তো তুই বউয়ের গাউনের তলা থেকে বেরিয়েই এলি! তখন তো তার একটি কথাও আর শুনলি না!
—বাঃ—অদিতি মুখ ভাসিয়ে হেসে বলল। আপনার প্র্যাকটিক্যাল ইনটারপ্রিটেশন। এটা আপনার নিজস্ব। আপনি গল্পের সারটুকু নিয়ে তার থেকে আপনার ব্যাখ্যাটা দাঁড় করিয়েছেন। এটাই আপনার নিজস্ব ব্যাখ্যা। ছবির ক্ষেত্রে ব্যাপারেও যদি কোনও পোর্ট্রেট আঁকি, মানুষটার যে ভাব আমার কাছে ধরা পড়ছে সেটাই আমার ছবিতে ফুটে উঠবে। ফুটিয়ে তুলব। ধরুন খুব সুন্দর বা সুন্দরী কাউকে যদি আমার অন্তঃসারশূন্য মনে হয়, আমার আঁকা ছবিতে সেটা ধরা পড়বে। না পড়লে সে ছবির কোনও মানে থাকবে না।
—তা আমার এই জীর্ণ মুখখানার কী ব্যাখ্যা তুমি দিচ্ছ?
—সেটা আমি এখনও জানি না মা। একটা রাফ স্কেচ আগে করে নিই। তার ওপর ভিত্তি করে ছবিটা আঁকব। আপনার মুখ আমার কাছে কী ভাবে ধরা দেবে তা তো জানি না! আচ্ছা এবার আপনার ফলের রসটা আনি।
রসটা তৈরি ছিল, ফ্রিজ থেকে বার করে ঠান্ডাটা কাটানো হচ্ছিল এতক্ষণ। উনি রসের গ্লাসটা হাতে ধরে বললেন—কার কাজ! কে করে!
এ কথার কোনও উত্তর হয় না।
—আমার মেয়েটা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো তার সেবা পেতাম। তবে সে-ও যদি বিয়েথা হয়ে দূর দেশে চলে যেত তবে…
অদিতি মুখ তুলে তাকাল—চোখে যেন একটা দুষ্টু হাসি… বলল… এ হল বউমারই কাজ!
এ কথারও উত্তর হয় না।
উনি বললেন—কী হল কিছু যে বললে না?
—কী বলব?
—তোমার কখনও মনে হয় না, কী অদ্ভুত এই পরিস্থিতি! আমি তোমার ছেড়ে দেওয়া বরের মা, তোমার বাড়িতে বসে তোমার হাত থেকে সেবা নিচ্ছি। …আর আর বউমা, আমার কিন্তু খুব ভাল লাগছে। তোমার খুব বিরক্ত লাগছে, আমি জানি।
—না, আপনি ভুল ভাবছেন। অদিতি একটু স্নেহের হাসি হেসে বলল—গোড়ায় গোড়ায় হতাম। পরিস্থিতিটা তো সত্যিই অদ্ভুত। কিন্তু এখন আর কিছু লাগে না।
—কেন বলো তো? অভ্যাস?
—তাই হবে বোধহয়।
—না, বউমা। অভ্যাস নয়। তুমি একজন বুদ্ধিমতী মেয়ে, তুমি আরও একটু তলিয়ে ভাবলে ধরতে পারতে, এটা শুধু অভ্যাস নয়। যে তোমার সঙ্গে বেইমানি করেছে, সে আমারও সঙ্গে বেইমানি করেছে। এই থেকেই আমাদের সম্পর্ক…
—কিন্তু মা ওটা আপনার ভাবনা, আমি ওভাবে ভাবি না। আর কেনই বা ভাবছেন ও আপনার সঙ্গে বেইমানি করেছে! দূর থেকে ও কি খেয়াল রাখছে না?
—অমন খেয়ালের আমার কী দরকার বলো? আমি একলা মানুষ, রাজার বাবা আমার জন্যে যা রেখে গেছেন, তা-ই আমার যথেষ্ট। আমি কি ওর ডলারের তোয়াক্কা করি নাকি! ছেলের কাছে মায়ের কি শুধু ডলারই পাওনা? —কী রকম একটা বিতৃষ্ণার মুখ করে মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন উনি। অদিতি শুনছিল। কিন্তু দেখছিল আরও মন দিয়ে। লোকে মুখে কথা বলে বিতৃষ্ণা জানায়। কিন্তু উনি মুখের রেখায় রেখায় বিতৃষ্ণা জানাচ্ছেন। খুবই অভিনব এই অভিব্যক্তি। যদি ছবিতে সে তুলতে পারে তা হলে এ হবে এক চিরন্তন প্রশ্নচিহ্ন। এই বৃদ্ধা কি রাগ করছেন? ঘৃণা করছেন? ক্ষুণ্ণ হচ্ছেন? নাকি তাচ্ছিল্য অবজ্ঞা করছেন কাউকে? কাকে? কোনও নিকট সম্পর্ককে? নাকি সারা পৃথিবীকেই, সভ্যতাকে? মোনালিসার হাসির কী মানে? উনি কি দাঁত তুলিয়েছিলেন? উনি কি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন? নাকি হাসলে ওঁর মুখের পেশিগুলো ওইভাবেই বিন্যস্ত হত?
মুসাম্বিটা শেষ করে উনি পাশের টেবিলে রাখলেন।
—আমি একটু উঠি এবার। একটু হাঁটাহাঁটি করি। না না তোমায় ধরতে হবে না। চেয়ারের হাতলে ভর রেখে উনি উঠে দাঁড়ালেন। ক’দিন এইটুকু হাঁটাহাঁটি করছেন। ডাক্তার বলেছেন। তবে সব সময়ে কারও-না-কারও উপস্থিতিতে। আস্তে আস্তে ঘর পার হয়ে বাইরে এলেন। বারান্দার পাটি ধরে ধরে বেশ এগোচ্ছেন।
—বেশ বাড়ি তোমার। সেখানে যেন অত বড় বাড়িটা হাঁ-হাঁ করে খেতে আসে।
অদিতি মনে মনে বলল—আমাকেও যে এ বাড়ি খেতে আসে না মাঝে মাঝে তা নয়। তবে কাজের মধ্যে থাকলে, নিয়মিত বেরোলে অত খারাপ লাগে না।
—কোথায় ছবি আঁকো, ঘরখানা দেখাবে?
—চলুন।
ছবির ঘরে এসে উনি বসলেন। এখানেও একটা আরামচেয়ার আছে, আর একটা ডিভান। আরামচেয়ারে বসলেন গিয়ে উনি। বললেন—তোমাদের বেশিরভাগ ছবিই আমি বুঝি না মা। …কী এঁকেছ ওটা কালো কালো সাদা সাদা, ভূত প্রেত নাকি?
—তা ভূতই একরকম। আচ্ছা এটা দেখুন তো!
বৃষ্টিতে ধুয়ে যেতে থাকা পথ গাছপালা, গাড়ি… আর ওপরে ভাসমান প্রবহমান এক খুব তন্বী মূর্তির আভাস।
—অতশত না বুঝলেও ভাল লাগছে। রংগুলো লাগালেই যদি তবে আবার যেন ধুয়ে দিয়েছ! কেন?
—ভাল লাগছে বলছিলেন যে!
—আচ্ছা অদিতি আমার ছবি তো আঁকতে চাইছ, শীলার একখানা আঁকো না!
—আমার আঁকতে ইচ্ছেটা তো হওয়া চাই!
—অমন সুন্দরী, ওকে ছেড়ে আমাকে?
—আমি তো আগেই বললুম মা, বাইরের আকার কিছু নয়।
—তা হলে তুমি বলছ ওর ভেতরটায় তেমন কিছু নেই।
—তা বলিনি। এখন এই মূহূর্তে আপনার মুখটাই আমার আঁকতে ইচ্ছে হচ্ছে।
—তবু, তুমিই তো একদিন আমাকে ফেলে ওকেই প্রণাম করতে গিয়েছিলে মা!
সর্বনাশ! সেই কথা এখনও মনে রেখেছেন উনি? ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ পুষে রেখেছেন? সেই জন্যেই কি অমন রুক্ষ ব্যবহার করতেন?
সে বলল— শীলাদিই বরণডালা হাতে সামনে ছিল মা।
—না, না, দুধ ওথলাচ্ছিল। বরণডালা রোয়াকের পাঁচিলে রাখা ছিল। তুমি খেয়াল করোনি, আমার বড় জা তোমায় বরণ করেছিলেন পরে।
—সে যাই হোক, সামনে রয়েছে, দেখতেও ভদ্র, আমি কী করে জানব! তারপর বাবা বুঝিয়ে দিতেই…
—একটা কথা আমাকে বলবে?
—কী?
—কথা দাও এই বৃদ্ধাকে মিছে কথা বলবে না!
—মিছে কথা? কেন?
—কথা দাও, কিছু মনে করবে না?
কী জিজ্ঞেস করবেন উনি? অদিতি মাথা হাতড়ায়। রাজর্ষির সঙ্গে তার বিচ্ছেদের কারণ তো উনি জানেন। বেইমানি। কিন্তু কী ধরনের বেইমানি তা হয়তো জানেন না। বেশ, উনি যদি এ কথা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, সে-ও বিবৃত করতে পারবে। কিন্তু কথাটা হল ব্যাপারটা তার ভাল লাগবে না। মনমেজাজ খিঁচড়ে যাবে। দিনের পর দিন ভুষোকালিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে পৃথিবী।
—মিছে কথা বলে আমার কী লাভ বলুন! আর মনে করা? তার ওপর তো আমার কোনও হাত নেই! তেমন কিছু হলে না হয় না-ই বললেন!
—এতখানি বয়সেও যদি বুকের কথা বুকে চেপে রাখতে হয়, মরণের আগে যদি প্রশ্নগুলোর ঠিকঠাক উত্তরগুলো না পাই, তুমি মনে করো না আমার মৃত্যুতেও কোনও শান্তি থাকবে না! সান্ত্বনা থাকবে না!
—বলুন, বলে ফেলুন। অদিতি ওঁকে এতটা বিচলিত দেখে হেসে ব্যাপারটা সহজ করে দিতে চায়।
—এই যে রাজ তোমার অনুপস্থিতিতে একটা কাজ করে বসল। জঘন্য কাজ, তোমার কখনও মনে হয়নি— এটা ওর তোমরা যাকে বলে জেনেটিক? অদিতি চমকিত হল। জঘন্য কাজ! তা হলে উনি নীল দৃশ্যটার কথা জানেন?
সে বলল— জেনেটিক? এক অর্থে তো বটেই! পুরুষরা মোটের ওপর একটু অসংযত প্রকৃতির হয়। বেসামাল। মেয়েরাও যে হয় না তা নয়, কিন্তু তারা সংযমকে মূল্য দিতে শিখেছে মা অনেক যুগ ধরে।
—না। আমি জিজ্ঞেস করছিলুম রাজ কি তার বাবার থেকেই স্বভাবটা পেয়েছিল?
—বলছেন কী মা! ও কথা ভাবতে যাব কেন? দোষ করল একজন। সে দোষের দায় চাপাব তার পিতৃপিতামহের ওপর?
—তুমি কি সত্যিই মনে করো তোমার শ্বশুরের কখনও মতিভ্রম হয়নি। হতে পারে না!
অদিতি এবার বুঝতে পারল, কেন উনি মনে না করার কথা তুলেছিলেন। তার নিজের বাবা-মা’র বাইরে অদিতি সত্যিই এতটা শ্রদ্ধা আর কাউকে করেনি। তার বাবা-মা দুজনেই খুব স্নেহশীল ছিলেন। চরিত্রের জোর ছিল। ব্যক্তিত্ব ছিল। তা সত্ত্বেও তাঁদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ভালবাসা তাঁরা মা-বাবা বলেই। কিন্তু প্রকাশ গুপ্ত অগাধ পণ্ডিত, নিরভিমান, অথচ বলিষ্ঠ মনের মানুষ। তাঁকে সে সম্পর্কের কারণে তো শ্রদ্ধা করেনি, করেছিল তিনি বলেই। আর ভালবাসত, তিনি ভালবাসার মতো আচরণ করেছিলেন তাই। ইনি কি সে জন্যে এতই ঈর্ষাতুর যে… তার মুখটা কঠিন হয়ে যেতে থাকল। এ কেমন মহিলা যিনি শ্রদ্ধার সম্পর্ক বুঝতে পারেন না, স্নেহের সম্পর্ক বুঝতে পারেন না!
খুব কাতর গলায় মাধুরী বললেন— তুমি কি সত্যিই মনে করো শীলার সঙ্গে ওঁর কখনও কিছু হয়নি!
প্রায় বজ্রপাতের মতো এল কথাটা। বজ্রপাত তো তর জীবনে হয়েছে। কিন্তু সেটা ব্যক্তিগত ভালবাসার ক্ষেত্রে। শ্রদ্ধা-ভক্তির ওপর এমন আঘাত! …যদি আজ কোনও খ্রিস্টভক্ত শোনে— যিশুখ্রিস্ট পতিতালয়ে যেতেন নিয়মিত; কিংবা রবীন্দ্রনাথ লম্পট ছিলেন…।
—কিছু বলছ না যে? রাগ করলে! অদিতি কিছু মনে কোরো না, তুমিও ওই ডেসডিমোনা, জুলিয়েটের ধরনের বোকামেয়ে! নইলে কেউ মাসি নয় পিসি নয়, একটা যুবতী মেয়েকে এনে ঘরে তোলে? অমন সুন্দর সুযোগ করে দেয়!
তার মনে হল, ভাগ্যে সে তথাকথিত সুযোগটা করে দিয়েছিল। তাই তো সময় থাকতে রোগটা ধরা পড়ল!
মাধুরী বললেন— আমি তোমার মতো অতটা সরল না হলেও কিন্তু বিশ্বাস করতুম। মেয়ে গেছে, ছেলে থাকে দূরে দূরে বোর্ডিংয়ে, কিন্তু উনি আছেন, আমার মস্ত ভরসা। কিন্তু যেদিন কোথা থেকে একটি সুন্দরী অল্পবয়সি বিধবা এনে আমাকে বললেন— এ-ই এবার থেকে রান্নাবান্না করবে মাধু— আমি কেমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি বলছি, তখন শীলার আরও অল্প বয়স। সত্যিকারের রূপসি। না-ই রইল তোমাদের মতো শহুরে পালিশ। ওকে ডেকে ওর সব ইতিবৃত্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিই। উনি গিয়েছিলেন সোনামুখী… ওখানকার রেশম সম্পর্কে কিছু খবরাখবর নিতে। সেখানেই নাকি শীলার দাদা ওঁকে ধরে পড়ে, বোনটির একটি গতি করে দিতে। তা গতি উনি আর কোথায় করবেন? অগতির গতি এই আমারই ঘাড়ে এনে ফেললেন। সারা জীবনটা আমার কী যে আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় কেটেছে আর কাউকে সে কথা বলতে পারিনি। এই প্রথম বললাম তোমাকে। এই শেষ। মরণের আগে জেনে নিতে চাই, যে মানুষটাকে আমার শ্রদ্ধা ভালবাসা বিশ্বাস দিয়েছিলাম সে তার যোগ্য ছিল কিনা। ও সব বিদ্যা গুণ ঢের ঢের দেখা আছে অদিতি। যার যত বিদ্যা সে তত বিদ্যাধর, ওসবের মূল্য আমার কাছে কানাকড়িও নেই। আসল কথা মানুষটা হৃদয়ে কেমন। মানুষটা আমার কাছ থেকে যে বিশ্বস্ততা পেয়েছিল, দাবি করত, ততটাই আমাকে দিতে পেরেছিল কিনা। অদিতি আমাকে ভাল ভাবো, মন্দ ভাবো, তাতেও আর আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু একমাত্র তোমার বুদ্ধিবৃত্তির ওপরই আমার আস্থা আছে। তুমি এই কাজটুকু আমার করে দাও। সান্ত্বনা নয়, মিথ্যে নয়। একেবারে তুমি যা ঠিক বলে বুঝছ তাই। যদি আমার সন্দেহ ঠিক হয়, তাতেও আমার কিছু দুঃখ নেই। বিশ্বাস করো, শেষ জীবনে এই তুমি আর ওই শীলা-ই আমার সত্যিকারের আপনজন। ওকে এ কথা জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তোমাকে তাই…।
কী অদ্ভুত পরিহাস! যে শীলাকে চিরদিন সন্দেহ করে এসেছেন, ঈর্ষা করে এসেছেন, সেই শীলাই ওঁর আপনজন! যে অদিতিকে উনি উঠতে-বসতে বকাঝকা করতেন সেই অদিতিই আজ ওঁর একমাত্র আস্থার পাত্র! আশ্চর্য।
—প্রথমেই আপনাকে বলে দিই মা, —সে সামান্য গম্ভীর হয়ে বলল— আপনার সন্দেহটা আমার একেবারে অবাস্তব লাগছে। আর দ্বিতীয় কথা গোয়েন্দাগিরি করতে আমি যে খুব পটু নয় সে কথা তো আপনি জানেনই। তার ওপরে ফেলে-আসা দিন চলে-যাওয়া মানুষ নিয়ে এমন গোয়েন্দাগিরি!
—তুমি যদি মনে করো, তা হলে পারবে। সেই বুদ্ধির ধার তোমার আছে।
ছবি-আঁকার মেজাজ তার একেবারেই চলে গেছে। সকাল ঘন হচ্ছে। দু’জনেরই চান সারা। খাওয়ার সময় হল। তার ভেতরটা কেমন অস্থির-অস্থির লাগছে। তোলপাড় হয়ে গেল। বোধ-বুদ্ধি। যা মনে হয়নি কখনও, যা জানার তার দরকারও নেই, তারই চিন্তায় তাকে নামতে হবে?
খাবার টেবিলের দু’পাশে দু’জন। মুখোমুখি।
—ওই জন্যেই কি শীলাদিকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বেড়াতে? সে মুখে ভাত তুলতে তুলতে বলল।
—এই তো বুঝতে শুরু করেছ, তোমাকে বলতেও আমাকে একটু সাহস করতে তো হয়েছেই? তবে ওকে একটু ছুটি দেওয়া, আনন্দ দেওয়া এ-ও আমার ইচ্ছে বই কী! কী পেয়েছে ও জীবনে?
অদিতি অবাক হয়ে চেয়ে রইল। —যদি জানতে পারেন, আপনার সন্দেহ সত্যি নয়, তবু ধরুন যদি সত্যি হয়, তা হলেও কি ওর প্রতি এই করুণা আপনার থাকবে?
—করুণা কী গো? —উনি হাত থামিয়ে বললেন— আমি যে ওকে আমার ছোট বোনের মতো দেখি! সইতেও পারি না। একেক সময়ে, আবার ফেলতেও পারি না। শুধু নিজের স্বার্থে মনে কোরো না কিন্তু। আজ যদি ও চলে যায়, আমি হয়তো ওরকম সেবা কারও কাছে পাব না, তবু কিছু-না-কিছু ব্যবস্থা আমি করে নিতে পারব। কিন্তু আমি রয়েছি, অথচ ও সেখানে নেই… না। এ আমি ভাবতেও পারি না। বড় দুঃখী বঞ্চিত, অনেক ছোট ও তো বটে!
একটু পরে গলাটা পরিষ্কার করে সে জিজ্ঞেস করল— আপনার সন্দেহের মূলে কিছু যুক্তি নিশ্চয় আছে। সেগুলো যদি বলেন… আমার খুব সংকোচ হবে শুনতে…।
—আমার ছিয়াত্তর বছর বয়স হল মা। কালরোগে ধরেছে, যে-কোনও সময়ে চলে যেতে পারি। আমার কোনও সংকোচ নেই। মানুষের জীবন আর কতটুকু! যে-ই ইহকাল থেকে পরকালে পাড়ি দেয় অমনি সব শেষ। যেটুকু থেকে যায় সে শুধু অন্য মানুষের মনে। কত স্নেহ, কত দরদ, কত বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল মানুষটার। মগজে একজন যত বড়ই হোক, মগজ দিয়ে তার মনুষ্যত্ব আমি মাপি না। সে কতটা খাঁটি ছিল তাই দিয়েই মাপি৷ রাজের ওপর কি আর আমার মাতৃস্নেহ নেই! এতদিন অব্যবহারে তাতে খানিকটা মরচে পড়ে গেছে, কিন্তু আছে। তবু সে যদি একবারও আমার কাছে এসে ক্ষমা না চায়, তার আসায় আমার কোনও দরকার নেই। সে একটা মিথ্যে মানুষ। ভুল মানুষ। আমার যে ছেলেকে আমি চিনি, গড়ে তুলেছি, সে নয়। তার খোলসে অন্য কেউ। যাকে তোমরা বলো— ইমপস্টর।
ওঁর দিকে একবার তাকাল অদিতি। জটিল মানুষ, কিন্তু কুটিল নন। বিদ্বান নন, কিন্তু ক্ষুরধার বুদ্ধি। চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আবেগের কী অদ্ভুত সঙ্গতি ওঁর!
—তোমার শ্বশুর অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতেন একেক দিন। একটা-দুটো। আমি দশটার সময়ে ঘড়ি ধরে শুয়ে পড়তাম। আবার অনেকদিন উনি খুব ভোরে উঠে যেতেন, ধরো সাড়ে তিনটে, চারটে। শীলা শুত একতলায়। আমি কিন্তু কখনও নিশ্ছিদ্র ঘুমোতাম না। বিশেষ করে উনি না থাকলে ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হত। একদিন মনে হল তিনটে বেজে গেছে, উঠে দেখি সাড়ে তিনটে। এত দেরি তো কখনও করেন না! কী হল? পড়ার ঘরে গিয়ে দেখি নেই। তারপর দেখি নীচ থেকে উঠে আসছেন। —‘কোথায় গিয়েছিলে? এত রাতে?’ —‘মাথাটা জ্যাম হয়ে গিয়েছিল, একটু বাইরে বাগান থেকে ঘুরে এলাম’ —‘চলো শুতে চলো’ আমি বলি। শুয়ে আছেন কিন্তু ঘুমোচ্ছেন না, এপাশ-ওপাশ করছেন। ‘কী হল? ঘুমোও!’ হঠাৎ পাশ ফিরে আমাকে আঁকড়ে ধরলেন। তারপর যেন… ছিঁড়েখুঁড়ে ফেললেন। এই প্রকাশ গুপ্ত আমার অচেনা। একেবারে অচেনা।
চোখ নিচু করে রইল অদিতি। একটু পরে বলল— আর কিছু?
—নাঃ, আর তেমন কিছু… ওই থেকে থেকেই শীলাবতী, শীলাবতী-ই। সে-ও বাবার সুবিধে-অসুবিধেয় একপায়ে খাড়া।
‘বাবা’, শব্দটা খট করে লাগল তার কানে। বলল—শীলাদি ওঁকে ‘বাবা’ বলত মনে রাখবেন মা। এটা একটা মস্ত প্রমাণ। এই ডাকের দেওয়াল কেউ ডিঙোতে পারে বলে আমার জানা নেই।
—কিন্তু উনি তো মেয়ে বলতেন না। উনি তো ডাকতেন— শীলাবতী-ই শীলাবতী-ই।
—কোনও অবৈধ সম্পর্ক হলে অত সহজে আদরের নাম ধরে ডাকতে পারতেন না মা।
—তা হলে ওঁর চোখে অনেক সময় যে অপরাধের ছাপ দেখেছি তা মিথ্যে বলছ? —আমি সেদিনের পর থেকে তো খুব সাবধান হয়ে যাই। দোতলার গেটের কোল্যাপসিব্ল লাগিয়ে চাবি রেখে দিতাম নিজের বালিশের তলায়।
—পরদিন কেউ জিজ্ঞেস করেননি, হঠাৎ এই ব্যবস্থা কেন?
—নাঃ!
—করেননি? শীলাদি না, বাবা না?
—নাঃ।
—টের পেয়েছিল?
—নিশ্চয়। আমি বেশ শব্দ করেই গেটটা বন্ধ করতাম তো! ওঁর শুনতে পাবার কথা। আর শীলা পরদিন ভোর-ভোর এসে ফিরে গেছে। আবার এসেছে পরে। কেন গেট বন্ধ, তো কই একবারও জিজ্ঞেস করল না!
—চলুন এবার শুতে চলুন।
আস্তে আস্তে ঘরে গেলেন। খাটটা তো ইংলিশ খাট নয়, পালঙ্ক। একটু উঁচু। উনি তারই মতো লম্বা মানুষ বলে পারেন উঠতে। তবু একটু ধরল অদিতি।
—আমার স্যুটকেসটা একটু খোলো তো মা!
—এখন?
—হ্যাঁ, এখনই। দেখো স্যুটকেসের একেবারে তলায় একটা ফাইল আছে। পেয়েছ?
—হ্যাঁ।
—ওটা নিয়ে এসো।
নীল রঙের কভার ফাইল। হাতে করে উনি বললেন— এই ফাইলটা আমি চলে যাবার পর খুলবে। ওতে কিছু নির্দেশ আছে। না, না, নিয়মকানুন… কী ভাবে…কী… সে সব কিছু নয়। তবে আগে দেখো না। একটু পরে বললেন— তোমারও খটকা লেগেছে, না?
চমকে উঠে অদিতি বলল— খটকা? না, ভাবছি…।
—এই যে ভাবছ, আমাকে স্তোক দিলে না— এই জন্যেই তোমায় ভরসা করি মা। তার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লেন। আর সেই ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চোখে জল এসে গেল তার। সে আবেগপ্রধান মানুষ নয়। তার অন্তরের যা কিছু নিহিত আবেগ সে প্রকাশ করে তার ছবিতে। কিন্তু মাধুরীর সুপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ এমন একটা প্রতিবিম্ব দেখতে পেল! ভাল কিছু খুব নিজস্ব কিছু যদি সহসা খানখান হয়ে ভেঙে যায়! বড় কষ্ট হয়! সে কষ্টের অভিজ্ঞতা তার আছে। হয়তো পার হয়ে এসেছে। অনেকটা। কিন্তু অসর্তক মুহূর্তে জ্বালা করে। বড় জ্বালা করে।