Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জোজো অদৃশ্য || Sunil Gangopadhyay » Page 9

জোজো অদৃশ্য || Sunil Gangopadhyay

দ্বীপটার দিকে তাকালে যে সেখানে ভয়ের কিছু আছে, তা কল্পনাও করা যায়। সূর্য সবেমাত্র ড়ুবে গেলেও এখনও লালচে রঙের আলো ছড়িয়ে আছে, দূরের সাদা বাড়িটাও যেন রাঙা হয়ে উঠেছে। কয়েকটি সিগাল পাখি দুলছে তীরের কাছে। এই অপরূপ ছবিটি শুধু দূর থেকে দেখে আশা মেটে না।

কিন্তু আলি আর কাছে যেতে রাজি নয়। সে এখন ফিরতে চায়। এতক্ষণ সে বেশ হাসিখুশি মানুষ ছিল, এখন কীসের যেন আশঙ্কায় তার মুখ শুকিয়ে গেছে।

কামাল তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে বলল, মিঞা, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? এই দ্যাখো, আমার কাছে পিস্তল আছে। ভূত-টুত যে-ই আসুক, একেবারে কুঁড়ে দেব!

কাকাবাবু বললেন, আমরা ভুতুড়ে আগুন দেখলাম না, দৈত্যের চিৎকার শুনলাম না, এর মধ্যেই ফিরে যাব?

আলি বলল যে, সেসব রোজ-রোজ না-ও হতে পারে। এক-একদিন হয়। যদি মাঝরাত্তিরে হয়, ততক্ষণ কী বসে থাকব?

কাকাবাবু এবার দৃঢ়ভাবে বললেন, ঠিক আছে, তুমি ফিরে যেতে চাও, ফিরে যাবে। আমাদের ওই দ্বীপে নামিয়ে দাও। কাল সকালে এসে আমাদের নিয়ে যাবে।

আলি এবারে হতভম্ব হয়ে গিয়ে বলল, আপনেরা ওইখানে সারারাত থাকবেন?

কাকাবাবু বললেন, আমার আর সন্তুর এরকম অভ্যেস আছে। কামালও ফিরে যাক।

কামাল জোর দিয়ে বলল, মোটেই না। আমিও থাকব। ওই বাড়িটা কেউ দখল করেছে কি না সেটা আমারও জানা দরকার। ফিরে গিয়ে রিপোর্ট করব।

আলি তবু বিড়বিড় করে বলল, অপয়া জায়গা। সতু শেখের ভটভটি এর ধারেকাছে এসে ড়ুবে গিয়েছিল, আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি!

আবার সে স্টার্ট দিল। ক্রমশই দ্বীপটা কাছে আসছে, সেখানে জনপ্রাণীর কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। গাছগুলো বড় হয়ে উঠছে ক্রমশ। এক জায়গায় এসে মোটর বোটটা থামল, সেখানে কাদা নেই, বেশ পরিষ্কার বালি। দুটো কচ্ছপ সেখান থেকে সরসর করে জলে নেমে গেল। •

সই প্রথম নেমে গেল এক লাফ দিয়ে। কামাল নেমে কাকাবাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ধরব?

কাকাবাবু বললেন, না। অন্যের সাহায্য ছাড়াই তো জীবনটা কাটাতে হবে।

তাঁর ক্রাচ নরম বালিতে গেঁথে গেলেও আস্তে-আস্তে তিনি ওপরে উঠে গেলেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে বললেন, ঠিক আছে আলি, তুমি যাও, কাল সকালে এসো!

কামাল বলল, তুমি চাঁদপাড়ায় গিয়ে থাকতে পারো।

আলি তবু ফেরার উদ্যোগ করল না। একটুক্ষণ মুখোনা গোঁজ করে থেকে সে নোঙর ফেলল। তারপর বোট থেকে নেমে এসে বলল, আপনাদের ফেলে চলে যাব, আমারও তো একটা ধর্ম আছে!

তারপর সন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, ওইটুকু পোলাড়া যদি ভয় না পায়, আমি বুড়া মানুষটা ভয়ে পালাব?

কামাল তার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে বলল, বাঃ, এই তো চাই। বাংলাদেশের মানুষ অত সহজে ভয় পায় না।

চারজনে একসঙ্গে এগোল। এর মধ্যে আকাশের রং মিলিয়ে গেছে, নেমে এসেছে অন্ধকার। দূরের সাদা বাড়িটা দেখা যাচ্ছে আবছাভাবে। চতুর্দিক। একেবারে নিস্তব্ধ, শুধু সমুদ্রের ঢেউ পাড়ে আছড়ে পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।

কামাল বলল, মনে হয়, মাঝে-মাঝে দু-চারজন জেলে রাত্তিরে থেকে যায়। আগুন জ্বেলে রান্নাবান্না করে। সেই আগুন দূর থেকে দেখে লোকে ভয় পায়।

আলি বলল, তেমন আগুন না। হা-হা আগুন।

কাকাবাবু বললেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এখনও এ-দ্বীপে লোক আছে। তারা আড়াল থেকে আমাদের দেখছে!

পকেট থেকে টর্চ বার করে কাকাবাবু চারদিকে আলো ঘুরিয়ে দেখলেন। গাছপালা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না।

কামাল হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কে আছ? কেউ আছ এখানে?

অমনই খানিক দূরে কয়েকটা গাছের আড়ালে দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। যেন মস্ত বড় একটা মশাল মাটিতে পোঁতা, লকলক করল তার শিখা।

এরকম দেখলে বুকটা ধক করে উঠবেই। আলি কাকাবাবুর গায়ের কোট চেপে ধরল।

সেই আগুন থেকে ধোঁয়াও বেরোচ্ছে, তাতে পাওয়া যাচ্ছে ধূপের মতন একটা মৃদু গন্ধ।

কামাল রিভলভারটা উঁচিয়ে ধরে বলল, কে ওখানে আগুন জ্বালল? মনে হচ্ছে একটা মাটিরহাঁড়ি থেকে বেরোচ্ছে। কিছু একটা বাজি নাকি?

কামাল এগিয়ে গেল সেটা দেখতে।

কাকাবাবু বললেন, বেশি কাছে যেয়ো না, ওটা ফেটে যেতে পারে।

ফাটল না, আগুনটা কমে গিয়ে ভলকে-ভলকে ধোঁয়া বেরোতে লাগল, গন্ধটাও তীব্র হল।

এবার পেছনদিকেও আর এক জায়গায় জ্বলে উঠল ওইরকম আগুন! কাকাবাবু এবার চেঁচিয়ে উঠলেন, গ্যাস! কামাল, সাবধান! কিছু একটা গ্যাস বেরোচ্ছে।

কামাল ততক্ষণে মাতালের মতন টলতে শুরু করেছে, হাত থেকে খসে গেছে রিভলবার, ঝুপ করে পড়ে গেল মাটিতে।

আলি দারুণ ভয়ে চিৎকার করে উঠল, হায় আল্লা!

তারপর সে কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরে বলল, হুজুর বাঁচান আমারে। দমবন্ধ হয়ে আসছে!

কাকাবাবু অস্থিরভাবে বললেন, ছাড়ো, ছাড়ো! এখান থেকে সরে যেতে হবে।

আলি আরও জোরে আঁকড়ে ধরল কাকাবাবুকে। তিনি এবার জোরে ধাক্কা দিয়ে আলিকে ফেলে দিলেন মাটিতে। তা করতে গিয়ে একটা ক্রাচ খসে পড়ল মাটিতে। সেটা তুলতে গিয়ে আর সময় পেলেন না। তাঁর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।

অজ্ঞান হওয়ার আগে তিনি কোনওক্রমে বললেন, সন্তু, পালিয়ে যা, এখান থেকে অনেক দূরে সরে যা!

সন্তুরও চোখ জ্বালা করতে শুরু করেছিল, সেই অবস্থাতেও সে বাঁই বাঁই করে ছুটে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।

আলি, কামাল আর কাকাবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন সেখানে।

একটু পরেই দ্বিতীয় আগুনটাও নিভে গেল, বাতাসে মিলিয়ে গেল ধোঁয়া। তারপর গাছপালার আড়াল থেকে চারজন লোক বেরিয়ে এসে ওদের তিনজনকে টানতে-টানতে নিয়ে গেল সাদা বাড়িটার দিকে। কাকাবাবুর ক্ৰাচদুটো পড়ে রইল সেখানে।

সাদা বাড়িটার নীচের তলায় কোনও ঘর নেই। বড়বড় ফ্ল্যাট বাড়ির নীচের তলায় যেমন শুধু পিলার থাকে আর গাড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকে, সেইরকম। এবারে সেখানে একটা হ্যাজাক বাতি জ্বালা হল, তাতে দেখা গেল ঠিক মাঝখানে সিংহাসনের মতন লাল মখমলে ঢাকা একটা উঁচু চেয়ার রয়েছে। ওপরের সিঁড়ি দিয়ে চটি ফটফটিয়ে নেমে এল একজন মধ্যবয়স্ক লোক, ফরসা রং, চেহারাটা বেশি বড় নয়, রোগা-পাতলাই বলা যায়, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল পাতলা হয়ে এসেছে। সে আলখাল্লার মতন একটা পোশাক পরে আছে, সেটা দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তাতে নানা রঙের জরির লম্বা-লম্বা স্ট্রাইপ, যখন যেদিকে আলো পড়ে, অমনই ঝকমক করে ওঠে।

লোকটিকে বাঙালি বলে মনে হয় না, তবে ঠিক কোন জাতের, তাও বোেঝ যায় না, কোরিয়ান, চিনে বা জাপানি কিছু একটা হতেও পারে। তার হাতে এক-দেড় হাত লম্বা একটা ছোট লাঠির মতন, সেটা মনে হয় সোনার তৈরি। সে এসে সিংহাসনটার কাছে দাঁড়াতেই একসঙ্গে অনেক গলা শোনা গেল, মাস্টার! মাস্টার!

তখন বোঝা গেল, পেছনদিকের অন্ধকারে অনেক লোক চুপ করে বসে ছিল এতক্ষণ। এবার তারা উঠে এল। প্রথমে পরপর দুজন মুখোশপরা লোক তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে গেল। তারপর এল লাইন দিয়ে একদল ছেলে, তাদের প্রত্যেকের বয়েস ষোলো থেকে আঠারোর মধ্যে, সকলের উচ্চতা সমান। তারা প্রথমে সেই লোকটিকে ঘিরে সাতবার গোল হয়ে ঘুরল। তারপর একজন-একজন করে তার সামনে বসল হাঁটু গেড়ে। সেই লোকটি তাদের কাঁধে সেই সোনার দণ্ডটা ছুঁইয়ে বলতে লাগল, আই ব্লেস ইউ। তোমাদের ট্রেনিং প্রায় ফিনিল্ড। তোমরা হবে আমার হিউম্যান রোবট! আমি যা আদেশ করব ইউ উইল ওবে!

লোকটি কথা বলে ইংরিজি বাংলা মিশিয়ে। বাংলা শব্দগুলোর উচ্চারণ অন্যরকম। সাহেবের নতুন শেখা বাংলার মতন। লোকটির কথা বলা শেষ হতেই ছেলেগুলি প্রত্যেকে যন্ত্রপুতুলের মতন বলতে লাগল, ইয়েস মাস্টার! ইয়েস মাস্টার!

সন্তু বিষাক্ত ধোঁয়া থেকে পালিয়ে গিয়েছিল অনেকটা। সাদা বাড়িটার তলায় আলো জ্বলতে দেখে সে গুটিগুটি এগিয়ে এসেছে সেদিকে। অন্ধকারে একটা গাছের আড়াল থেকে সব দেখছে।

যে-ছেলেগুলো রঙিন আলখাল্লা পরা লোকটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসছে, তাদের মধ্যে জোজোও আছে! জোজোকে দেখেই সে এমন উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল যে, আর-একটু হলে জোজো বলে ডেকে উঠত। নিজেই মুখচাপা দিয়েছে। কিন্তু জোজো ওরকম অদ্ভুত ব্যবহার করছে কেন? চোখের মণিদুটো একেবারে স্থির, যেন পলকও পড়ছে না। হাঁটছে দম-দেওয়া পুতুলের মতন!

সন্তু গুনে দেখল, জোজোর বয়েসী, অর্থাৎ তারও বয়েসী, মোট একুশটা ছেলে আছে ওখানে। সকলেরই ভাবভঙ্গি একই রকম। হাঁটাচলা আর চোখ অস্বাভাবিক। ওই আলখাল্লা পরা লোকটা বলল, ওদের হিউম্যান রোবট বানাবে। যন্ত্র দিয়ে বানানো রোবট অনেক সময় মানুষের মতন কাজকর্ম করতে পারে। কিন্তু জীবন্ত মানুষ কি রোবট হতে পারে? ওই লোকটা এই ছেলেদের হিপনোটাইজড করে রেখেছে। সেই অবস্থায় নাকি মানুষকে দিয়ে ইচ্ছেমতন কাজ করানো যায়। ওই লোকটা জোজোদের দিয়ে কী কাজ করাবে?

জোজো আর সবকটা ছেলেই ওই লোকটাকে বলছে, মাস্টার। তার মানে, ওই লোকটা প্রভু, আর সবাই ভৃত্য? ছি ছি ছি ছি। জোজো কী করে বলছে, ওর লজ্জা করে না? এটা জোজোর চরিত্রের সঙ্গে মেলে না মোটেই। কিংবা জোজো ইচ্ছে করে ওরকম সেজে আছে?

সবকটা ছেলেকে আই ব্লেস ইউ বলে সোনার দণ্ডটা ছোঁয়াবার পর আলখাল্লা পরা লোকটা মাটিতে পড়ে থাকা কাকাবাবুদের দিকে তাকাল। একজন মুখোশধারীকে ডেকে আঙুল দেখিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করল।

সেই মুখোশধারীটি খুব সম্ভবত বুঝিয়ে দিল ওরা কীভাবে এসেছে, কীভাবে ধরা পড়েছে। লোকটি ঠোঁট বেঁকিয়ে অবহেলার সঙ্গে শুনল। তারপর বলল, একটা ছেলে ভেগেছে? ফাইন্ড হিম! গেট হিম! ওকে ধরো। এই আইল্যান্ড থেকে সে পালাবে কোথায়? ঠিক আসতে হবে আমার কাছে!

তারপর কামাল আর আলির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, উহাদের বেঁধে রাখো। পরে ব্যবস্থা হবে। অন্য লোকটার জ্ঞান ফেরাও।

দুজন লোক কাকাবাবুর মুখে জলের ছিটে দিতে লাগল। একটু পরেই কাকাবাবু চোখ মেলে তাকালেন। লোক দুটো কাকাবাবুর দু হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল।

আলখাল্লা-পরা লোকটি কাকাবাবুর দিকে একটা আঙুল নেড়ে বলল, কাম হিয়ার। আমার নিকটে এসো।

কাকাবাবু লোকটিকে ভাল করে দেখার চেষ্টা করলেন। এখনও তাঁর মাথা একটু-একটু ঘুরছে। চোখের দৃষ্টি পরিষ্কার হয়নি। তিনি বললেন, আমার ক্রাচদুটো কোথায়? আমি খোঁড়া লোক, হাঁটতে পারি না।

এমনই সময় একটা লোক একটা লাঠি দিয়ে সজোরে কাকাবাবুর মাথায় মেরে বলল, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারো, হাঁটতে পারো না? মাস্টার ডাকছেন, যাও!

বেশ জোরে লেগেছে, ঘাড়ের কাছটায় কেটে গিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে খুব শান্ত গলায় বললেন, আমাকে মারলে কেন? তোমাকে কেউ অমনভাবে মারলে কেমন লাগবে? আমি সত্যি খোঁড়া, আমার কাচদুটো দাও! আলখাল্লা-পরা লোকটি হুকুমের সুরে বলল, ভোন্ট আগু, ইধারে এসো! কাকাবাবু বললেন, এখানে কী হচ্ছে? যাত্রাপালা?

একজন লোক কাকাবাবুর হাত ধরে টানতেই কাকাবাবু প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য লোকটি লাঠি দিয়ে আবার খুব জোরে মারল কাকাবাবুর মাথায়। কাকাবাবু সেটা সামলাতে পারলেন না, জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।

আলখাল্লা-পরা লোকটি ফিক করে মাটিতে থুতু ফেলল। তারপর বলল, ডোন্ট ওয়েস্ট টাইম। উহাকে ফেলে দাও! একটা স্পিড বোটে চাপিয়ে অনেকখানি সমুদ্রে নিয়ে যাও। থ্রো হিম! শার্ক ওকে খাবে! ক্রোকোডাইল ওকে খাবে। উহার কোনও চিহ্ন থাকবে না।

দুজন লোক মাটি থেকে তুলে নিল কাকাবাবুকে। সন্তু সব দেখছে, এবার আর সামলাতে পারল না। তীরের মতন ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকদুটোর ওপর। লাথি মেরে ফেলে দিল একজনকে। তারপর সে কাকাবাবুকে ধরে ঝাঁকাতে লাগল, যদি তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে। তার ধারণা, জ্ঞান ফিরে পেলে কাকাবাবু উদ্ধার পাওয়ার ঠিকই উপায় বার করে ফেলবেন।

কিন্তু কাকাবাবুর জ্ঞান ফিরল না। দুজন মুখোশধারী সন্তকে মাটিতে চেপে ধরে একজন তার পিঠের ওপর পা রাখল।

হা-হা করে খুব জোরে হেসে উঠল সেই আলখাল্লা-পরা লোকটি। অমনই। বাকি সকলেই একই রকম ভাবে হা-হা করে হাসতে লাগল।

তারপর আলখাল্লাধারী যখন বাঁ হাত তুলে বলল, চুপ! অমনই সঙ্গে সঙ্গে সবাই থেমে গেল।

আলখাল্লাধারী এবার দুজনকে ইঙ্গিত করল কাকাবাবুকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য।

তারা কাকাবাবুকে ধরাধরি করে নিয়ে এল জলের ধারে। তারপর যে স্পিড বোটে কাকাবাবুরা এসেছিলেন, সেটাতেই ভোলা হল তাঁকে। সেটা চালিয়ে অনেকটা দূর এসে থামল। এখানে সমুদ্রের কোনও দিক দেখা যায় না, শুধুই সমুদ্র, লোক দুটো কাকাবাবুকে চ্যাংদোলা করে তুলে কয়েকবার দুলিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল জলে। অন্ধকারে ঝপাং করে শব্দ হল।

স্পিড বোটটা আবার ফিরে গেল ফট-ফট শব্দ করে। একটু বাদেই মিলিয়ে গেল শব্দটা।

কাকাবাবু ড়ুবতে লাগলেন। ড়ুবতে-ড়ুবতে তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। যারা সাঁতার জানে, জ্ঞান থাকলে তারা কক্ষনও ডোবে না। কাকাবাবু ভেসে উঠলেন।

প্রথমে তিনি মনে করতে পারলেন না, ঠিক কী হয়েছে। জলের মধ্যে পড়লেন কী করে? এটা কি স্বপ্ন দেখছেন নাকি? না, স্বপ্ন কী করে হবে, এই তো ওপরে আকাশ দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের নোনা জল লেগে জ্বালা করছে। মাথার ক্ষতস্থানটা।

আস্তে-আস্তে তাঁর মনে পড়ল, একটা লোক তাঁর মাথায় লাঠি দিয়ে মেরেছে। দুবার। লোকটাকে দেখতে কেমন ছিল? মুখোশ পরা ছিল, মুখ দেখা যায়নি। মুখোশ পরা থাক আর যাই-ই থাক, লোকটাকে খুঁজে বার করতে হবে। প্রতিশোধ নিতে হবে না? তাঁর গায়ে কেউ হাত তুললে তিনি প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়েন না। লোকটার মাথায় ঠিক ওইভাবে মারতে হবে দুবার!

এই অবস্থাতেও কাকাবাবুর হাসি পেয়ে গেল। আগে তো বাঁচতে হবে, তারপর প্রতিশোধের চিন্তা। এই অবস্থায় বাঁচবেন কী করে? কতক্ষণ সাঁতার কাটতে পারবেন? একটা পায়ে জোর নেই, অন্য পা-টা কিছুক্ষণ পরেই অসাড় হয়ে যাবে। প্যান্ট-কোট-জুতো-মোজা পরে কি সাঁতার কাটা যায়? শরীরটা ভারী হয়ে আসছে ক্রমশ।

ক্রাচ দুটো কোথায় গেল? আঃ, এই এক জ্বালা! কোথাও একটু মারামারি হলেই ক্রাচ দুটো হারিয়ে যায়। কতবার যে ক্রাচ তৈরি করতে হয়েছে তার ঠিক নেই। এখন তিনি ক্রাচ পাবেন কোথায়? ক্রাচ ছাড়া যে তিনি অচল।

আবার হাসি পেল। এখানে যদি ড়ুবেই মারা যান, তা হলে আর ক্রাচ দিয়ে কী হবে? প্রাণে বাঁচলে অনেক ক্রাচ পাওয়া যাবে!

এত বড় বিপদের সময়ও মানুষের কত তুচ্ছ কথা মনে পড়ে।

কাকাবাবু টের পেলেন যে, জলে স্রোত আছে। তিনি শুধু ভেসে থাকার চেষ্টা করছেন। স্রোত তাঁকে একদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। জোয়ার না ভাটার টান? যদি ভাটা হয়, তা হলে আরও সর্বনাশ, তিনি গভীর সমুদ্রে চলে যাবেন। জোয়ার হলে এগোতে পারবেন কক্সবাজারের দিকে।

জোয়ার না ভাটা, তা বোঝার উপায় নেই। চাঁদ নেই আকাশে, অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না।

এই সমুদ্রে হাঙর থাকতে পারে। একরকমের ছোট-ছোট হাঙরকে বলে কামঠ। সেগুলো কচাত করে এক কামড়ে পা কেটে নিয়ে যায়। সেই কামঠের পাল্লায় পড়লেই হয়েছে আর কী! দুটো পা-ই যাবে। দুটো পা গেলে আর বেঁচে লাভ কী! রাজা রায়চৌধুরী এইভাবে মরবে? সন্তু ওই দ্বীপে রয়ে গেল। কী হবে সন্তুর?

হঠাৎ একটা বিকট আওয়াজ পেয়ে কাকাবাবু চমকে গেলেন। দূরে দেখতে পেলেন একটা জ্বলজ্বলে আলো। প্রথমে ভাবলেন, সেই দ্বীপের কাছে ফিরে এসেছেন নাকি? এ সেই দৈত্যের চিৎকার? তারপরই বুঝতে পারলেন, এসব একেবারে আজেবাজে ভাবছেন। একটা লঞ্চ কিংবা স্টিমার আসছে, সেটা একবার ভোঁ দিল, সামনে সার্চলাইট জ্বলছে।

কাকাবাবুর বুকের মধ্যে আনন্দ উছলে উঠল। এই তো বাঁচার উপায় পাওয়া গেছে। লঞ্চের সারেং নিশ্চয়ই তাঁকে দেখতে পেয়ে তুলে নেবে। কাকাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, হেল্প! হেল্প! বাঁচাও, বাঁচাও!

সমুদ্রের ঢেউ আর লঞ্চের আওয়াজে সে-চিৎকার শোনা গেল না। আরও বিপদ হল। লঞ্চের জন্য বড় বড় ঢেউ উঠতে লাগল, তাতে কাকাবাবু উঠছেন আর নামছেন, তাঁকে দেখা যাবে না। কাকাবাবুর গায়ে কালো কোট, আলো পড়লেও মনে হবে, কিছু একটা ময়লা।

হলও তাই, লঞ্চটা সার্চলাইট ঘোরাতে-ঘোরাতে খানিকটা দূর দিয়ে চলে গেল। কাকাবাবু যতটা আশার আনন্দ পেয়েছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি নৈরাশ্যে ভরে গেল তাঁর বুক। আর কি বাঁচার কোনও উপায় আছে? হাত দুটোয় ব্যথা হয়ে গেছে, পা অবশ। আর ভেসে থাকতে পারছেন না। এত ক্লান্ত লাগছে যে, ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে পড়তে। সমুদ্রের একেবারে তলায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়াই তো ভাল। কাকাবাবুর চোখ বুজে এল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress