জীব জগতের আজব কথা
ছোটবেলায় বোধহয় এই নামে কিংবা এরই কাছাকাছি নামে একটা আশ্চর্য বই পড়েছিলাম। সে ছিল প্রকৃত তথ্যে ও বর্ণনায় ভরপুর রোমাঞ্চকর কাহিনী।
সে জাতীয় কোনও তথ্যময় রোমাঞ্চকর নিবন্ধ রচনা যে আমার উদ্দেশ্য নয় সেটা পাঠিকা ঠাকরুন অবশ্যই অনুমান করতে পারছেন। আমি হালকা লেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব, তবে এবার আর মানুষ নয়, একটু জীবজন্তুর কথা বলি।
দিনের পর দিন ক্রমাগত স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, ছাত্র-শিক্ষক এমনকী রোগী-ডাক্তার, উকিল ব্যবসায়ীর মতো বিপজ্জনক বিষয়ে অনবরত রসিকতা করে করে কলম ভোঁতা হয়ে গেছে। রসিকতাও বেশ ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, নিজেই টের পাই।
সুতরাং, আপাতত এ যাত্রা জীবজন্তুর উপর নির্ভর করতে যাচ্ছি। তবে পুরোপুরি জীবজন্তু নিয়ে রসিকতা করা সম্ভব হবে না, মানুষকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া যাচ্ছে না।
প্রথম গল্প এক অধ্যাপক এবং তাঁর গৃহপালিত গোরু নিয়ে। এ আখ্যানে অবশ্য মানুষের ভূমিকাই গুরুতর।
এক দর্শনের অধ্যাপক তাঁর পোষা গোরুকে নিয়ে একটা গবেষণা করছিলেন। গবেষণার বিষয়বস্তুটি রীতিমতো চমকপ্রদ এবং অভিনব।
অধ্যাপক মহোদয়ের ধারণা হয়েছিল যে জীবমাত্রকেই যা ইচ্ছে শেখানো যায়। সে যা কিছু করে সবই অভ্যাসবশত, তাকে ঠিকমতো শিক্ষা দিলেই সে তা করবে না। যেমন তাঁর নিজের পোষা গোরু, সে যে ঘাস বিচালি খায়, সে নিতান্ত একটা অভ্যাস মাত্র। তাকে ধীরে ধীরে খাওয়া ছাড়ানো শিক্ষা দিতে লাগলেন।
প্রতিদিন এক আঁটি, দু’ আঁটি করে ঘাস বিচালি গোরুর বরাদ্দ খাদ্য থেকে কমিয়ে আনতে লাগলেন অধ্যাপক। এইভাবে কমাতে কমাতে অবশেষে একদিন গোরুটির খোরাক তিনি শূন্য পরিমাণে নামিয়ে আনতে সমর্থ হলেন।
দুঃখের বিষয় অনাহারে ক্লিষ্ট অবলা জীবটি সেই দিনই দেহত্যাগ করল। গোরুর মৃত্যুতে অধ্যাপক একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। তাঁর এতদিনের গবেষণা এত পরিশ্রম বিফলে গেল। অধ্যাপক মহোদয় দুঃখের সঙ্গে বললেন, ‘অপূরণীয় ক্ষতি হল আমার গবেষণার। এত কষ্ট, এত পরিশ্রম করে বোকা গোরুটাকে যখন না খেয়ে বাঁচা শেখালাম, ঠিক তখনই গোরুটা মরে গেল।’
বলা বাহুল্য, এই আখ্যানের অধ্যাপক ভদ্রলোক তাঁর গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করতে আক্ষম হয়েছিলেন এবং নিরীহ জীব আত্মদান করেও তাঁকে কোনও শিক্ষা দিতে পারেনি।
জীবজন্তুর শিক্ষার অন্য একটা গল্প। তবে সে গল্প গোরুর নয়, কুকুরের। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা উচিত যে গল্পটি বেশ পুরনো এবং কোনও কোনও পাঠক বা পাঠিকা অন্য কোথাও না হলেও আমার লেখাতেই হয়তো লেখাটি আগে পড়েছেন।
আমার প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক কুকুর পুষতেন এবং শুধু পোষা নয় প্রচণ্ড ভালবাসতেন তাঁর কুকুরকে। তাঁর কুকুরের সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণাও তিনি পোষণ করতেন এবং সে জন্যে তাঁর অহংকারের কমতি ছিল না।
আমরা দু’জনে সকালে ময়দানের একই প্রান্তে মর্নিং ওয়াক করতে যাই। সেখানে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে নানারকম কথা হয়। সেদিন হঠাৎ কুকুরের কথা উঠল এবং ভদ্রলোক দাবি করলেন যে তাঁর কুকুরের এখন এত বুদ্ধি হয়েছে যে সে মুখে মুখে বিয়োগ কষতে পারে। অবশ্য বড় বিয়োগ নয়, ছোট ছোট বিয়োগ।
সেদিন মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার পথে তিনি জোর করেই আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সাত সকালে সিড়ি ভেঙে তাঁর চারতলার ফ্ল্যাটে উঠতে হল। তিনি চা আর বিস্কুট খাওয়ালেন।
চা খাওয়ার সময় তাঁর কুকুরটিও এল। প্রভুর বিস্কুটে ভাগ বসাল। আমাকেও দু’বার সামনের ডান পায়ের থাবা দিয়ে আঘাত করে আমার কাছে বিস্কুটের ভাগ চাইল। কুকুরটি যে বুদ্ধিমান এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই কিন্তু তাই বলে অঙ্ক কষতে পারবে, একেবারে বিয়োগ?
সামান্য পরেই সন্দেহের নিরসন হল। কুকুরটির প্রভু তাকে বললেন, ‘নিউটন বল তো দশ থেকে দশ বিয়োগ করলে কত হয়? কুকুরটির নাম নিশ্চয় নিউটন, সে কিন্তু এই প্রশ্নে চুপ করে রইল। তার প্রভু আমাকে বললেন, ‘দেখলেন?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কী দেখলাম?’ প্রভু বললেন, ‘উত্তর শূন্য বলে চুপ করে আছে কিছু বলছে না।’
বলা বাহুল্য আমি আর কথা না বাড়িয়ে চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে তরতর করে চারতলা থেকে নেমে এসেছিলাম।
ওপরের সেই গল্পটা হয়তো অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। তাঁদের কোনও দোষ নেই তবু তাঁদের জন্যেই জীবজন্তু বিষয়ক আর একটা অবিশ্বাসযোগ্য কাহিনী বলছি।
এ কাহিনী অনেকদিন আগেকার। আমাদের অল্প বয়সের পাড়াগাঁয়ের গল্প।
এ গল্প খাঁটি সরষের তেলের যুগের। ভেজাল রেপসিডের যুগে এ গল্প বিশ্বাস করা কঠিন।
আদ্যিকালের এক কলুর বলদ। সকাল থেকে সে কলুর ঘানি ঘোরাচ্ছে তো ঘোরাচ্ছেই । তার দু’ চোখে ঠুলি বাঁধা, ডাইনে-বাঁয়ে কিছুই সে দেখতে পারছে না।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে কলু মশায় মাঝে মধ্যে চেঁচাচ্ছেন, ‘এই মোংলা, এই রবি, এই ভোমলা, এই সাধু জোরে ঘোর, জোরে পাক দে।’ সে চিৎকার শুনে বলদটা মাঝে মাঝে তার চলার গতি বাড়াচ্ছে।
রাস্তা দিয়ে এক ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। তিনি পথের ধারে কলু মশায়ের বাড়ির সামনে একটা ঝাঁকড়া আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম করতে করতে বলদ-মানুষের এই নাটক দেখছিলেন। কিছুক্ষণ দেখার পরে সেই ভদ্রলোকের মনে একটু সন্দেহ দেখা দিল, তিনি কলু মশায়কে বললেন, ‘আচ্ছা আপনার বলদকে আপনি এই যে চার পাঁচটা নামে ডাকছেন, এর কি সত্যিই এতগুলো নাম?’
হাতের থেলো হুঁকো টানতে টানতে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে কলু মশায় বললেন, ‘একটা বলদের ক’টা নাম রাখব? ওর একটাই নাম। ওর নাম মোংলা।’
পথচারী ভদ্রলোক অবাক প্রশ্ন করলেন, ‘তা হলে ওকে এতগুলো নামে ডাকছেন কেন?’ এই জিজ্ঞাসা শুনে কলু মশায় পথচারীর কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘এদিকে একটু গাছের আড়ালে আসন, আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। কিন্তু মোংলা জানতে পারলে সর্বনাশ হবে।’
হতবাক পথচারীকে একটা বড় তেঁতুল গাছের আড়ালে নিয়ে গিয়ে কলু মশায় বললেন, ‘দেখুন ওর নাম মোংলা। কিন্তু ওর চোখে তো ঠুলি বাঁধা। ও তো আশেপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তাই আমি যখন এই মোংলা, এই রবি, এই সাধু এইসব বলছি, ও ভাবছে ও একাই ঘানি টানছে না ওর সঙ্গে আরও অনেক বলদ রয়েছে এতে ও মনে ফুর্তি পায়, গায়ে জোর পায়। আরও শক্তি দিয়ে ঘানি টানে।’
পুনশ্চঃ আমার সেই অখাদ্য গল্পটা মনে আছে তো? ক্যাঙারু মা বাস থেকে নেমে ক্যাঙারু বাবাকে বলল, ‘সর্বনাশ হয়েছে। খোকা পকেটে নেই। আমাদের খোকা এইমাত্র পকেটমারি হয়ে গেল।’