জীবন ও মৃত্যু নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দর ভাবনা
স্বামী বিবেকানন্দর ভাবনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রথমেই তাঁর উক্তি কে স্মরণ করি ,তিনি বলেছেন, ” জীবন ও মৃত্যু একটা ব্যাপারেরই বিভিন্ন নাম মাত্র। একই টাকার এপিঠ ওপিঠ। উভয়েই মায়া। এই অবস্থাটাকে পরিষ্কার করে বোঝাবার জো নেই। এক সময় বাঁচার চেষ্টা হচ্ছে আবার পরমূহুর্তেই বিনাশ বা মৃত্যু চেষ্টা।” এই হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দের অগণিত বাণীর একটি বাণী।
এই বাণী কে ভিত্তি করে আমি যে আলোচনার অবতারণা করছি তা ভারতীয় দর্শন ও মহাপুরুষ দের উপলব্ধির সামান্য বিচ্ছুরণ মাত্র। আর সেই প্রেক্ষিতের উপর নির্ভর করে স্বামীজীর বাণীর ব্যাখ্যা করার সামান্য চেষ্টা করেছি মাত্র।
প্রথমেই বলি, স্বামীজীর এই বাণীকে ভিত্তি করে যাকিছুই লিখিনা কেন তা অপ্রতুল হবে তাও এক নির্দিষ্ট শব্দ সংখ্যার মধ্যে। ক্ষমা চেয়ে নিয়ে প্রথমেই বলি, আলোচ্য বিষয়টি হল ভারতীয় দর্শনের এক গভীর নির্মোহ আত্মদর্শন ও ভাবসমাধির এক অতি উচ্চস্তরের অনুভবের উপলব্ধি।
স্বামীজী নিজেই বলেছেন, এ অবস্থাটা পরিষ্কার করে বোঝবার জো নেই। সত্যিই তো, সিদ্ধ যোগী যদি সহজে সেই আত্মদর্শনের হদিস না পায়, তবে সাধারণ মানুষ তদগত সাধনা ছাড়া তার হদিস পাবে কি করে।
নির্মোহ আত্মোদর্শনের উপলব্ধি যে সিদ্ধ যোগী উপলব্ধি করেন ,তার কোন কিছুর প্রতি না থাকে পিছু টান না থাকে কোন মোহ। জীবন মৃত্যু তার কাছে পায়ের ভৃত্য। সেই তত্ত্বজ্ঞানে তিনি বলীয়ান কেননা তিনি মৃত্যঞ্জয় মহামন্ত্রকে উপলব্ধি করেছেন। তবে উপলব্ধি করা আর আয়ত্ত করার মধ্যে ফারাক আছে। মহাভারতীয় পৌরাণিক আখ্যান মঞ্জরীতে ভগবান শিব ই সেই মৃত্যুঞ্জয় মহামন্ত্রের অধিকারী। কথিত আছে, কঠোর সাধনার পর দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য মহাদেবের বর প্রাপ্ত হয়ে সেই মহামন্ত্রের জ্ঞান লাভ করেছিলেন।
আমরা জানি, জগত ও জীবন বড়ই মায়াময়। এক গভীর মায়ায় জগত আবর্তিত হয় আর মায়ায় বশীভূত হয়ে আমরা ধরা পড়ি মোহের কবলে। মায়া আমাদের আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে জাগতিক কর্মকাণ্ডে। মায়ার বশেই আমরা জন্ম নিই আর জন্ম দিই। শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের বিপুল মায়ার মোহে আমরা আবর্তিত হই। সংসার করি, নতুন জীবনকে বা বলা ভালো নতুন প্রাণকে পৃথিবীতে আনি। স্নেহ, মায়া ,মমতা, হাসি, আনন্দ দু:খ বেদনা, ভয়, গ্লানি সবই মনকে পরাভূত করে। আমরা তিল তিল করে এগিয়ে যাই সেই মহাগতির দিকে, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সমগ্র জীবকুল ও প্রাণী জগতের একমাত্র পরিণতি। সেই কালের গতির অভিমুখ এত তীব্র এত অবশ্যম্ভাবী যে সমগ্র জীব ও প্রাণী জগত কিছুতেই ঠেকাতে পারেনা সেই চরম গতির প্রবহমান কালচক্রকে। মৃত্যু লয় বা ধ্বংস গ্রাস করে। একেই বলে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাওয়া। এই সুন্দর পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ বারি চিরতরে হারিয়ে যায়। নশ্বর দেহ লীন হয় মহাকালের কালগর্ভে।
তাহলে প্রশ্ন জাগে, মৃত্যুর পরে কি??
অবান্তর প্রশ্ন। মৃত্যুতে চেতনার অবলুপ্তি ঘটে। সব আলো নিভে যায় তাই কোন মৃত ব্যক্তিই মৃত্যুর পরে তার কি উপলব্ধি তা জানাতে ফিরে আসে না। কোন জাগতিক মানুষই মরণের পরের অবস্থা তাই বর্ণনা করতে পারে না। যদি কেউ সে বর্ণনা দিয়ে থাকে সে ব্যাখ্যা অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও কল্পনাপ্রসূত বলেই ধরে নিতে হবে। যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তার আজ পর্যন্ত হয়েছে বলে জানা নেই।
এখানে আবার ভারতীয় দর্শনের উপলব্ধির কথা এসে পড়ে। সত্য ত্যাগ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে সিদ্ধ যোগী যা উপলব্ধি করেন সেই উপলব্ধিকেও আবার বিজ্ঞান সম্মত যুক্তি ও বুদ্ধির বেড়াজালে বাঁধা যায়না। ভারতীয় উপমহাদেশের বহু সিদ্ধ যোগীর জীবন কাহিনী সেই সাক্ষ্য দেয়। জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি এক অকল্পনীয় যোগাবস্থান এক অদ্ভূত রহস্যময়তা গড়ে তোলে, যার কোন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা মেলেনা।
অতিরঞ্জন বা কল্পকাহিনীটুকু বাদ দিলে,জন্ম বৃত্তান্ত আমরা জানতে পারি বটে, কিন্তু দেহাবসানের খন্ডচিত্র আজও অধরা।
জীবন এবং মৃত্যুর মূল ফারাকটা হল চেতনা আর চেতনার অবলুপ্তি।
মধু কবির কথা মনে পড়ে, “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে , চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন নদে”।
জীবন আর মৃত্যু তাই জীব ও প্রাণীর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। এক জীবনেই সেটা ঘটে। তাই স্বামী বিবেকানন্দের উক্তি এখানে তাৎপর্যপূর্ণ। যুগপুরুষ ও সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দ যা বলেছেন তা অমরবাণী হিসাবে গৃহীত হয়েছে আর আজ পর্যন্ত তিনি আমাদের ও বিশ্ববাসীর কাছে শ্রদ্ধার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত।