জায়গা নেই
নিচে নেমে এল নিখিলেশ।
সন্ধের পর শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে আজ। হোস্টেলে ফিরে চুপচাপ আলোয়ান জড়িয়ে শুয়েছিল ও, দারোয়ান খবর দিতে শেষপর্যন্ত নিচে নামল। ওর রুমমেট সুধাংশু চোখ বড়-বড় করে বলেছিল, কি কপাল করেছ গুরু–বিকেলের রজনীগন্ধা, রাত্রের হাসনুহানা, তুমি লাইন দাও আমি ছাদ থেকে দেখছি। ওদের হোস্টেলের ছাদ থেকে নিচের রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়।
বাইরে এসে নিখিলেশ দেখল সামনেই একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। দারোয়ান বলেছিল ট্যাক্সিতে করে এক জেনানা তাকে ডাকতে এসেছে। নিখিলেশ আস্তে-আস্তে ট্যাক্সির পাশে এসে ঝুঁকে দাঁড়াল। সাদা হলুদ পাড়ের শাড়ি, ঈষৎ মোটা এক মহিলা বসে আছেন একা, যাঁর হাতে বেশ মোটা মকরমুখী সোনার বালা।
আমায় খুঁজছেন? নিখিলেশ কথা বলার সময় ধীরে-ধীরে বলে, ফলে গলাটা খুব নরম এবং রোমান্টিক শোনায়।
আপনি নিখিলেশ রায়? বেশ শক্ত গলা মহিলার, কোনও জড়তা নেই, কথাগুলো সোজা আছড়ে পড়ে।
হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে–নিখিলেশ দেখল ট্যাক্সির দরজা খুলে যাচ্ছে। ও একটু সরে দাঁড়াতেই ভেতরে আলো জ্বলে উঠল, দরজা খোলা।
ভেতরে উঠে আসুন। গলার স্বর একটুও কাঁপল না।
কী ব্যাপার বুঝতে পারছিল না, তবে মহিলাকে দেখে খুবই ঘরোয়া মনে হচ্ছে ওর। হয়তো কোনও কথা আছে যা বলতে সময় নেবে, নিখিলেশ মাথা নিচু করে ট্যাক্সিতে উঠে বসল।
ভদ্রমহিলাঝুঁকে দরজা বন্ধ করেই সুন্দর হিন্দিতে বললেন, চলিয়ে সর্দারজি, জাঁহাসে আয়া।
কী করছেন কি, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল নিখিলেন, কী আশ্চর্য ব্যাপার!
চুপ করে বসে থাকুন। প্রায় দাঁতে দাঁত চেপে বললেন মহিলা।
বলার মধ্যে এমন একটা ভাব ছিল যে নিখিলেশমুখ ঘুরিয়ে মহিলার দিকে তাকাল। ট্যাক্সির ভেতরে আলো কম। তবু এঁকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। ও বুঝতে পারছিল না কি ব্যাপার।
কিন্তু আপনাকে আমি চিনি না, জানি না। আপনার প্রয়োজনটা কি যদি না বলেন আমি নেমে যাচ্ছি। নিখিলেশ এবার উত্তেজিত।
চিনবেন! ব্যস্ত কেন? মেয়েদের পেছনে ঘোরা ছাড়া তো আর কোনও কাজ নেই আপনার। আর নেমে যাওয়ার চেষ্টা করলে আমি চিৎকার করব। কেটে-কেটে শব্দগুলো উচ্চারণ করলেন মহিলা।
বিস্ময়ে নিখিলেশের মুখ দিয়ে প্রথমে কথা বেরুল না। মহিলাদের পেছনে-পেছন ঘোরা–উনি কি বলতে চাইছেন? কোন মহিলা–ছুটন্ত ট্যাক্সিতে বসে ও শীত লাগা দোকানপাট দেখল। কোথাও গোলমাল হয়ে গিয়েছে–এ হতেই পারে না। শ্যামবাজার পাঁচমাথায় লাল সংকেত পেয়ে ট্যাক্সিটা দাঁড়াল। এখন যদি ও চট করে দরজা খুলে নেমে যায় তাহলে সত্যি কি মহিলা চিৎকার করবেন? আর ও যদি সবাইকে ডেকে বলে এই মহিলা তাকে জোর করে নিয়ে যাচ্ছেন–হেসে ফেলল ও। লোকে ওকে পাগল ভাববে। একজন চল্লিশ পার হওয়া মহিলাকে এইসব অপবাদ দেওয়া যায়?
বেলগেছিয়া ব্রিজের ওপর ট্যাক্সিটা উঠলে মহিলা বললেন, আমি গোপার পিসিমা।
গোপা? কে গোপা? চট করে ও কিছু মনে করতে পারল না প্রথমটায়। তারপর অনেক খোঁজাখুঁজির পর বুকপকেটেই কলম আবিষ্কার করার মতো মুখ করে ফেলল নিখিলেশ। এই মহিলা গোপার পিসিমা? কি যেন উপাধি বলেছিল, আঃ, মিত্র বোধহয়। মাথা ঝাঁকাল ও।
এক-একটা মুখ আছে যার দিকে তাকালে মনে হয় বুকের মধ্যে কোথাও কিছু খালি জায়গা পড়ে আছে, গোপাকে দেখলে এইরকম মনে হয়। ওদের থেকে অনেক জুনিয়র মেয়ে, সবে ঢুকেছে। কদিন আগে অ্যাডমিশন হয়ে যেতেই নতুন ছেলেমেয়েরা এসে গেল, গোপাও এল। বসন্ত কেবিনে বসে রুনু বলেছিল, নতুন একটা মেয়ে এসেছে দারুন দেখতে।
নিখিলেশ বলেছিল, ভ্যাট, তোর যত নভিস ব্যাপার।
মৃন্ময় মাথা নেড়ে জিগ্যেস করেছিল, কার কথা বলছিস, ওই কমলা রঙের শাড়ি, থ্রি কোয়ার্টার ব্লাউজ!
ঝালর দেওয়া। বাকিটা শুধরে দিয়েছিল রুনু, নভিস নয় ভাই, দেখলেই সূর্যমুখী ফুল মনে পড়বে, সূর্য খুঁজছে।
আজ নিখিলেশ দেখল ওকে। লম্বা ছিপছিপে চেহারা। গায়ের রং বিকেলের রোদের মতো। হাঁটার সময় চিবুক গলার কাছে নামিয়ে রাখে। দেখলেই কোনওরকম দুষ্টুমি করার ইচ্ছে হয় না।
তারপর ওরা বাজি ধরল নিজেদের মধ্যে। মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করতে হবে, খানিকটা দূর হাঁটতে হবে অথবা বসন্ত কেবিনে এসে চা খেতে হবে। যেন কিছুই নয়, এইভাবে নিখিলেশ এগিয়ে গেল, মেয়েটি তখন বাসস্টপে।
চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল মেয়েটি। অনেক দূরে একটা টেম্পো আসছে দেখা যাচ্ছে, বাস-ট্রাম নেই। দু-হাত জড়ো করে নিখিলেশ ওর নিজস্ব হাসিটা হাসল, আমি নিখিলেশ, আমরা অবুbণবাবুর ছাত্র, আপনি ও আমি, তাই আলাপ করতে এলাম।
কেমন কেঁপে উঠল মেয়েটি। রুমাল দিয়ে চিবুক মুছল। তারপর মাটির দিকে তাকাল। মাফ করবেন, আপনি কেমন গম্ভীর হয়ে আছেন, খুব গম্ভীর আপনি না?
ঘাড় নাড়ল ও, না।
যাঃ হতেই পারে না, তাহলে বলতেন। নিখিলেশ হাসল।
কিছু বলল না মেয়েটি, খানিক দাঁড়িয়ে থেকে নিখিলেশ বলল, চলি, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে নিজেকে ভিলেন-ভিলেন মনে হবে।
মেয়েটি হেসে ফেলল। তারপর টুকরো-টুকরো কথা ওরা বলেছিল। নিখিলেশই বেশি। অনেকক্ষণ বাস না আসায় ওরা একটু এগিয়ে গেল শ্যামবাজারের দিকে। মেয়েটি নাম বলেছিল, নিখিলেশনিজের ঠিকানা। বলেছিল, যদি কোনও সাহায্য দরকার হয় ওকে স্মরণ করতে। তারপর একটা বাস কোনওমতে এসে দাঁড়ালে নিখিলেশ ভিড় সরিয়ে গোপাকে তুলে দিয়েছিল।
সেই গোপার এরকম জাঁদরেল পিসিমা আছে? আর থাকলেও ওর হোস্টেলে হানা দেওয়ার কি যুক্তি থাকতে পারে? ইন্দ্ৰবিশ্বাস রোডে এসে ট্যাক্সি দাঁড় করালেন মহিলা। ভাড়া মিটিয়ে ওকে বললেন, আসুন।
এতক্ষণে ওর খেয়াল হল ও পাজামা আর আলোয়ান পরে এসেছে। গোপার কথা ভেবে কেমন লজ্জা করতে লাগল ওর। ওকে নিয়ে মহিলা হলুদ বাড়ির দরজায় এসে কলিং বেল টিপলেন। ছোট্ট একটা বাচ্চা চাকর দরজা খুলে দিলে ওরা ভেতরে এল।
বসুন। সামনের সোফার দিকে আঙুল বাড়াল মহিলা। ঘরটা দেখল নিখিলেশ, বেশ ছিমছাম, রুচিটুচি আছে। সবুজ ঢাকনা দেওয়া সোফায় বসল ও, সামনেরটায় মহিলা।
আপনার সঙ্গে গোপার কতদিনের আলাপ? চোখে চোখ রেখে খুব বেশি মহিলা কথা বলতে পারে না, ইনি পারেন।
আজই। নিখিলেশ সুরটা ধরতে পারছিল না।
কদিন ধরে ঘুরছেন?
কি যা-তা বলছেন?
কেন আলাপ করতে গেলেন? বলুন আপনার কি উদ্দেশ্যে? আমি ওর গার্জেন, আমি জানতে চাই! বেশ উত্তেজিত মহিলা।
এসব কথা তো আমার হোস্টেলের সামনেই বলতে পারতেন। এখানে আসার কি দরকার ছিল? নিখিলেশ বলল।
গোপা আমার কাছে আছে। আপনি এ কি করলেন! আমি ওর মা-বাবার কাছে মুখ দেখাব কী করে? ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়ালেন।
কী হয়েছে, আমি তো কিছু করিনি! বিস্ময়ে নিখিলের গলার স্বর অন্যরকম শোনাল।
দেখুন মেয়েকে আমি চিনি। রোজ চারটের সময় বাড়ি আসে। আজ এসেছে সন্ধে পেরিয়ে। এক পা ধুলো। খেতে দিলাম, ভালো করে খেল না। তখন থেকে বিছানায় শুয়ে আছে। অনেক কষ্টে বের করতে পারলাম ওর সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছে, ওকে ঠিকানা দিয়েছেন। দেখুন, আপনার কাছে আমার অনুরোধ ওকে আর বিরক্ত করবেন না। ওর বাবা-মার ইচ্ছে ছিল না কো এডুকেশনে পড়ে–আমি জোর করে–
ঠিক এই সময় বাইরের ভেজানো দরজা খুলে গেল। নিখিলেশ দেখল একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। স্পষ্ট বোঝা যায় ওঁর পা টলছে। পুরোদস্তুর সাহেবি চেহারা, হাতে সুন্দর কাজ করা লাঠি, ছাইরঙা স্যুট পরনে, শরীর হালকা।
ঘরে ঢুকতেই ভদ্রলোক বললেন, গিয়েছিলে?
মহিলা বললেন, হ্যাঁ। এর নাম নিখিলেশ।
সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওকে দেখলেন ভদ্রলোক, তারপর জড়ানো গলায় বললেন, ইউ…।
নিখিলেশ বুঝতে পারছিল না ও কি করবে। শেষপর্যন্ত নমস্কার করল। লাঠিটা শূন্যে ঘুরিয়ে নমস্কারটা গায়ে ক্রশ মেরে দিলেন উনি, তুমি আমার ভাইঝির সঙ্গে প্রেম করতে চাও?
ঘাড় নাড়ল নিখিলেশ, না, আপনাদের ভুল হয়েছে। আমরা বাজি ধরেছিলাম–
বাজি! কি যা-তা বলছ–, ধমকে ওঠেন মহিলা।
এসব কথা শুনলে ও লজ্জা পায়। শোনো, বাজিটাজির ব্যাপার গোপার সঙ্গে নয়। একদম ওর ছায়ার বাইরে থাকবে, বুঝলে? তোমার বাবা কী করেন? টলতে-টলতে সামনে এসে বসেন ভদ্রলোক। বসে সিগারেটের প্যাকেট খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন।
ডাক্তার। নিখিলেশ বলল, আমি হেলপ করব? ।
গুড। ম্যানার্স জানো দেখছি। আমি তখনই বলেছিলাম, ছেলেটি যদি ভালো হয় চলে আসবে। অবশ্য তুমি একটু রিক্স নিয়েছিলে। কথাগুলো মহিলার দিকে তাকিয়ে বলা।
হাত থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ওপরের পাতলা কাগজ ছিঁড়ে সিগারেট বের করে দিল নিখিলেশ।
আরে তুমি নাও একটা। চোখ বন্ধ করে প্যাকেটটা এগিয়ে ধরলেন ভদ্রলোক। সঙ্গে-সঙ্গে হাতজোড় করল নিখিলেশ, আমি খাই না।
রিয়েলি? খুব ভালো, খুব ভালো। তাহলে তুমি ওকে চা খাওয়ায়, আমি ভেতরে যাচ্ছি। বাজিটাজি ধরার মধ্যে একটা থ্রিলিং আছে, বুঝলে– বিড়বিড় করতে-করতে ভেতরে চলে গেলেন ভদ্রলোক।
উঠে দাঁড়াল নিখিলেশ, এবার আমি যেতে পারি?
মাথা নিচু করলেন মহিলা, তারপর বললেন, বসো, এক কাপ চা খেয়ে যাও।
আর সঙ্গে-সঙ্গে ভেতর থেকে একটা চাপা কান্না বাইরের ঘরে ছিটকে এল। নড়ে উঠলেন যেন। মহিলা, এবার নিখিলেশকে দেখলেন, তারপর বললেন, তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি। দ্রুত পায়ে উনি ভেতরে চলে যেতেই নিখিলেশের মনে হল ওর এবার চলে যাওয়া উচিত। মেয়েলি গলায়। কে ডুকরে-ডুকরে কাঁদছে। ভীষণ কৌতূহলে ও ভেতর-দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। গোপার পিসিমার গলা পেল নিখিলেশ, কী হয়েছে তোর, এই গোপা, আঃ, কাঁদছিস কেন?
ডুকরে উঠল গোপা। তারপর কান্নার দমকে-দমকে বলল, তোমরা ওর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছ কেন? ওকে তাড়িয়ে দিতে পারছ না? আমি তো তাই তোমাকে ওর কাছে পাঠিয়েছিলাম। ইস, কাল আমি ক্লাসে গিয়ে মুখ দেখাব কি করে! ও মা।
এমন এক-একটা কণ্ঠ আছে যা শুনলে মনে হয়, বুকের ভেতর কোথাও কিছু খালি জায়গা নেই, এক বিন্দুও না।