জন্মভূমি মাতৃভূমি (Janmabhumi Matribhumi) : 02
—‘হ্যালো, হ্যাল্ লো!’
—‘কে রে সোনাটা? কচি গলা মনে হচ্ছে!’
—‘অ্যাটম স্পিকিং। মাসিয়া না কি? মা শপিং-এ বেরিয়েছে। পনের মিনিট আগে ফোন করলেও পেতে।’
—‘তুই যে আজ বাড়ি?’
—‘প্রজেক্ট-ওয়ার্ক ছিল মাসিয়া অনেক রাত জেগেও শেষ করতে পারি নি। আজ মেড সার্টিফিকেট দেবো।’
—‘সে কি রে? এখন করছিস তো?’
—‘ওহ শিওর। আমারটা সবচেয়ে দারুণ হবে। মাকে কয়েকটা জিনিস আনতে দিয়েছি ইলাসট্রেশনের জন্য। বেটার লেট দ্যান আর্লি।’
—‘তাই?’
নিশ্বাস ফেলে ফোনটা রেখে দিই। দীপালি বাড়ি নেই। শপিং-এ। দীপালির শপিং মানে একটা বিস্তারিত ব্যাপার। হয়ত নিউজার্সিতে আদৌ নেই। মানহাটান চলে এসেছে। ফেরবার পথে আমার এখানে ঢুঁ মারতেও পারে, অন্য কোথাও ড্রপ ইন করল তো হয়ে গেল। ওকে যা বলার তা অবশ্য আমি ফোনেই বলতে চাই। একটা আড়াল থাকলে আমার সুবিধে হয়। খুব একা লাগছে। এরকম আগে কখনও হয়নি। দীপালির সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হত। জ্যোতি সম্প্রতি নিজের চেম্বার করেছে ব্রঙ্কস-এ নিউ জার্সিতে প্রাসাদোপম বাড়ি। অজন্তার মতো প্যানেল ওর লিভিং রুমে। দেশ থেকে করিয়ে এনে লাগিয়েছে। মাঝে মাঝে যখন পার্টি দেয় এদেশীরা ওই প্যানেলের ধার থেকে সরতে চায় না। ‘হাউ লাভলি’? ‘ফ্যানটাসটিক’-এর ফোয়ারা ছোটে। ওরা স্বামী-স্ত্রী মিলে অজন্তার গল্প করেই জমিয়ে রাখে অর্ধেক সময়। বিরাট ডেন। কখনও তানির গ্রুপ রোলিং স্টোন শুনছে, কখনও অ্যাটম-বুলেটের গ্রুপ কুস্তি দেখছে এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও করে যাচ্ছে। দীপালিটা পারেও ঝামেলা নিতে। গার্ডেনিং-এর বই দেখে অপূর্ব বাগান করেছে। হাউজ-প্লান্টই ওর কতো! আবার একটা পোষা ম্যাকাও। ম্যাকাওটার ঝামেলাই কি কম নাকি? পাঁচটা বেডরুম, তার পাঁচ রকম অঙ্গসজ্জা। অল-হোয়াইট, অল-ব্লু, অল-পিঙ্ক। বাড়ির জন্যে এটা-সেটা কিনতেই যে কত ডলার মাসে খরচ করে! নিজের চেম্বারে যখন বসে থাকে জ্যোতি, আত্ম-প্রত্যয়ের জন্য সত্যিই তখন ওকে পরিত্রাতা বলে মনে হয়। ওর পেশেন্টরা সব এখানে ওকে আদর করে ‘সেভিয়র’ বলে ডাকে। এখানকার মেডিক্যাল শিক্ষা আমার খুব অসম্পূর্ণ মনে হয়। এতো যান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে ছাত্রগুলোকে যেতে হয় যে দু-বছরের ইনটার্নশিপের আগে ওরা প্রায় সত্যিকার ডাক্তারির কিছুই শেখে না। বেশিরভাগই তো দেখি বায়ো-মেডিক্যাল লাইনে চলে যায়। ইংল্যান্ডের ডাক্তার তো বটেই, ভারতীয় ডাক্তারদেরও এখানে খুব খাতির। নীলরতন সরকারের সেই মুখচোরা জ্যোতির্ময় এখন মানহাটানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রেসিডেন্টের হাউজ-ফিজিশিয়ান গ্রুপের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। জ্যোতি মজা করে বলে ওয়াটারগেটের সময়ে নাকি নিক্সনের ব্লাড-প্রেশার চেক করার জন্যেও ওকে ফি সপ্তাহে ওয়াশিংটন ডি সি ছুটতে হয়েছে।
একসময় জ্যোতির সঙ্গেই আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। হৃদয়ঘটিত কোনও ব্যাপার ছিল না। বাবার বন্ধুর ছেলে। বাবার এবং সুধাময়কাকারও বোধহয় মনে মনে ইচ্ছে ছিল। ওঁদের ইচ্ছেটা প্রকাশিত হবার আগেই আমার তরফ থেকে অন্য ইচ্ছে প্রকাশ পেয়ে গেল। জ্যোতিই প্রথম সুদীপকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসে। সুদীপের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ায় জ্যোতির কোনও আক্ষেপ আছে কিনা বলতে পারি না। মাঝে মাঝে যেভাবে ওল্ড টাইমস ওল্ড টাইমস করে! তবে দীপালির বর হবার পর ওর আর কোনও আক্ষেপ থাকার কথা নয়। দীপালি যদ্দূর জানি, মিরান্ডা হাউজের সেরা সুন্দরীর পোস্টটা দখল করে ছিল চার বছর ধরে, স্বভাব সুন্দরী পাঞ্জাবি ও সিন্ধিললনাদের হারিয়ে। নামকরা ফ্যামিলির মেয়ে। এ ধরনের কনেকশন তো যে কোনও ছেলেরই বাঞ্ছনীয়। এম আর সি পি এফ আর সি এস করে ইংল্যান্ড থেকে ফেরবার পরই ওদের বিয়ে হয়। তার পর বছরখানেকের মধ্যেই বোধহয় নিউ ইয়র্ক। দীপালি মেয়েও খুব ভালো। জ্যোতি নিশ্চয় বিজয়ী ও সুখী। দীপালিটা বড্ড মোটা হয়ে যাচ্ছে ইদানিং। গলায় ডাব্ল চিন দেখা দিয়েছে ভালো মতো। আমার থেকে দু বছরের ছোট। একদিন বলেছিলাম ব্যায়াম করার কথা। বলল—‘এসব সুখের লাইনিং বুঝলে? আমি ওসব স্লিমিং ট্রিমিংএ বিশ্বাস করি না। সপ্তাহে ক পাউণ্ড আইসক্রিম কনজিউম করি জানো?’
—‘কেন করো?’
—‘আরে বাবা, মিল্ক্ প্রোডাক্ট্স ছাড়া এদেশে খাবার মতো কিছু আছে?’ জ্যোতি বলল—‘কুমু কিন্তু ঠিকই বলেছে। আমি আজকাল তোমাকে বেড়ে পাচ্ছি না।’
দীপালি বলল—‘কুতুব মিনারের কাছে সেই লৌহস্তম্ভটার কথা মনে আছে? বেড়ে যে সম্পূর্ণ ধরতে পারবে তার আর সুখের সীমা থাকবে না! ওল্ড্ দিল্লির মেয়ে বাবা আমি। তোমাদের মতো মিচকে পটাশের হাতে সুখের পাত্তরটা পূর্ণ করে তুলে দিয়ে মরি আর কি!’
অতি সামান্য ছুটির কোটা থেকে দুটো দিন তুলে নিয়েছি। রান্না-টান্না বেশিরভাগই সারা হয়ে গেছে। তার জন্য নয়। আসলে আমার একটু দরকার ছিল। ভাববার অবসর। বাড়িতে যখন কেউ থাকে না, লিভিং রুমের কোণে ইয়েলো ড্র্যাগনের পাতাগুলো দেয়ালে ছায়া ফেলে, মধুবনী পেন্টিং-এর স্ক্রোল থেকে প্রসাধনরত কালো মেয়েটি চিবুক ঈষৎ তুলে টেরাকোটার ঘোড়াটার দিকে তাকিয়ে থাকে তখন ঘরের মধ্যে কেমন একটা অতিরিক্ত স্পেস তৈরি হয়, যার মধ্যে আমি আমার ভাবনাগুলোকে পাঠাতে পারি। ভেতর থেকে কিছু যেন একটা মুক্তি পায়, আজকাল এই মুক্তি মাঝে মাঝেই দরকারি মনে হচ্ছে।
পনের বছর এদেশে কেটে গেল। নিরঙ্কুশ তা বলব না। জ্যোতির্ময় দীপালির মতো ‘রোজেস, রোজেস অল দা ওয়ে’ হয়নি। সমস্যাহীন, সম্পূর্ণ দুঃখহীন জীবন আমি আশাও করি না। কিন্তু মোটের ওপর ভালো আছি এ কথা স্বীকার না করলে অপরাধ হবে। প্রথম যখন আসি, কি অনিশ্চয়তার মধ্যে সে আসা ভাবলেও এখন ভয় করে। নিউ-ইয়র্ক ওয়াই এম সি এর ঘরে বসে সুদীপের কোলে মাথা রেখে কেঁদে ফেলেছিলাম। স্যাঁতসেঁতে, জঘন্য একটা বৃষ্টিঝরা দিন ছিল সেটা। হাড়-কাঁপানো ঠাণ্ডা। রাস্তায় তো বাবু শীতে কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছিল। এতো শীতের জন্য প্রস্তুত হয়ে আমরা আসিনি। গ্রীন কার্ড হাতে মরিয়ার মতো অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেওয়া। ওয়াই এম সি এর ঘরে বসেই ও বলেছিল কথাটা। স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ ফেলাডেলফিয়া যারা ওকে স্পনসর করায় ও গ্রীন কার্ড পেলো। তারা নাকি আসার মুখেই ওকে জানিয়েছে ওরা ফেডার্যাল গ্রান্ট পাচ্ছে না, ওদের ওখানে কাজ অনিশ্চিত। এদেশে ইউনিভার্সিটিগুলো বড় কোনও স্কীম বা প্রোজেক্দের জন্য অধিকাংশই কেন্দ্রীয় অনুদানের ওপর নির্ভর করে। সুদীপ সেদিন নিজের ভেতরের দুশ্চিন্তা চেপে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল—‘ভয় নেই, একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চিঠিপত্র অনেক ছেড়েছি। ডিগ্রিগুলো আমার ভালোই আছে কমলিকা।’ এদিকে শরদ পারেখ বলে এক গুজরাটি বন্ধুর কাছে কিছু ডলার পাবার কথা ছিল আমাদের। কেনেডি এয়ারপোর্টে সে মোটে টার্ন আপই করেনি। এয়ার-পোর্টের বিশাল চত্বরে নাকানি-চোবানি খেয়ে অবশেষে ওয়াই এম সি এ। প্রায় কপর্দকহীন। তখনই মনে পড়েছিল জ্যোতি-দীপালির কথা। গাইড খুঁজে খুঁজে ওদের নিউজার্সির ফোন নম্বর। আধঘন্টার মধ্যে দুজনে এসে হাজির। ভীষণ অবাক এবং ওদের না জানানোর জন্য ভীষণই আহত। ওয়াই এম সি এ থেকে সোজা ওদের বাড়ি। সেখানে কী আশ্চর্য ব্যাপার তারপর। আমি আর দীপালি বাবুকে খাইয়ে দাইয়ে শোয়াচ্ছি, সুদীপ স্নানে ঢুকেছে, কে যেন এলো জ্যোতির সঙ্গে কথা বলছে শুনতে পাচ্ছি—‘আরে ডক্টর, মহা মুশকিলে পড়েছি। সাড়ে দশটার ফ্লাইটে এক ইন্ডিয়ান বন্ধু আসার কথা। স্ত্রী বাচ্চা রয়েছে সঙ্গে। আসেনি। কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। খুব দুশ্চিন্তা।’
আমি তখন ছিটকে বেডরুম থেকে লিভিংরুমে। জ্যোতি বলল—‘যদ্দূর মনে হচ্ছে পারেখ এই হল তোমার সেই বন্ধুর স্ত্রী। বাচ্চা কেঁদে কেঁদে এখন ঘুমোচ্ছ। তোমার ইন্ডিয়ান বন্ধু সাঙ্ঘাতিক ঘাবড়েছে। বাথরুমে।’
শরদ পারেখকে আমি সেই প্রথম দেখলাম। আমাকে নমস্কার করে বললেন—‘কি ব্যাপার বলুন তো? আমি এতক্ষণ এয়ার পোর্ট তোলপাড় করে ফেলছি। আপনারা এসেছেন কখন, কিসে?’ সব শুনে বললেন—‘বাঃ আপনারা প্যান-অ্যামে আসছেন জানাবেন তো! প্যান অ্যামের বিল্ডিংই তো আলাদা!’
আসলে কেনেডি এয়ারপোর্ট যে এতো বিশাল সে ধারণাই আমাদের ছিল না। আসার কথা ছিল এয়ার-ইন্ডিয়ায়। টাইম মোটামুটি একই বলে আর জানাবার দরকার মনে করিনি। এর ক’দিন পরেই হিউসটনের চাকরিটা যেন আকাশ থেকে পড়ল। সব কটা ঘটনা পর পর ঘটে গেলে সুদীপ প্রাণ খুলে হেসেছিল, বলেছিল—‘দেখলে তো, কেঁদে-কেটে, ভাবনা করে কি কাণ্ডই না করছিলে! আরে বাবা হ্যাভ ফেথ ইন হাজব্যান্ড অ্যান্ড গড। সব ঠিক হো যায়গা।’ বাবু তখন ঠিক সাত বছরের।
হিউসটনেই কি কম সমস্যা! আইনস্টাইন মেডিক্যাল সেন্টারে ও কাজে যোগ দিয়েছে। আমি বাড়ি বসা। যাবার আগেই আমি ওকে বলে দিয়েছিলাম নতুন দেশে মানিয়ে নিতে আমার আর বাবুর খানিকটা সময় লাগবেই। গিয়েই আমি কাজে লাগতে পারবো না। বাড়ি পাইনি তখনও, আছি দীপঙ্কর গুপ্তর বাড়ি। খুব অস্বস্তি। ওর বউ আমেরিকান। সে বেচারির কোনও দোষ নেই। আমাদের সে সমানেই আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করত। কিন্তু আমার সঙ্কোচ লাগত। নিজেদের মাস্টার বেডরুমটাই ওরা আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। আরও অস্বস্তি তাই। বাড়ির খোঁজ পাচ্ছি, যাচ্ছি, কেঁচে যাচ্ছে। শেষে একদিন দীপঙ্কর এসে হাসতে হাসতে বলল—‘তোমরা অ্যাপার্টমেন্ট পাচ্ছো না কেন জানো সুদীপ? হাইলি ইমমরাল লাইফ লীড করো।’
সুদীপ আর আমি তো অবাক!
দীপঙ্কর বলল—‘ওয়ান রুম অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজছো। অতবড় ছেলে নিয়ে শোও। ইমমর্যাল ছাড়া কি!’
দুঘরের অ্যাপার্টমেন্ট নেওয়া হল অতঃপর। কিন্তু বাবুকে আলাদা শোয়াতে পারতাম না, কাঁদত, ভয় পেত। দু তিন দিন খাট থেকে দুমদাম পড়ে গেল। নীচের ফ্যামিলি দেখি বাড়ি ছেড়ে চলেই যাচ্ছে। কি ব্যাপার! না ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি মাঝ রাতে ভূত নামায়। আমার বাবুর জন্য কষ্ট হত। একে ও দিদুকে ছেড়ে এসেছে। তাঁর কাছেই শুত তো দেশে। বহুদিন পর্যন্ত বাবুর আমাদের মাঝখানে শোয়ার অভ্যাস ছিল। আমার নাইট-ড্রেসের ফ্রিলগুলো মুঠো করে ধরে থাকত। তারপর একটা ভারি অদ্ভুত ব্যাপার হল। বাবুর সঙ্গে খেলা করত রয় জেনকিন্স্ বলে একটা বাচ্চা। ওর চেয়ে কিছু বড়। প্রতিবেশী ছিল আমাদের। তার বাবা-মার মধ্যে কি হল জানি না, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। একদিন সকালে উঠে রয় দেখল নেই। বাবা ওইটুকু ছেলেকে বলল—‘য়ু প্যাক আপ অ্যান্ড গেট আউট অফ হিয়ার। ছেলেটা ফোঁপাতে ফোঁপাতে আমাদের বাড়ি হাজির। ওর আর্জি আবার আমাদের কাছেও নয়। বাবুর কাছে। বাবুকেই গিয়ে ওর বাবাকে বোঝাতে হবে। আমাদের তো খুব মুশকিল। বলতে পারি। কিন্তু কিভাবে নেবে কে জানে? খুব কড়া মেজাজের লোক বলে শুনেছি। খুব সম্ভব বউকে ধরে পিটত, সেও পাল্টা পিটুনি দিত। মানমর্যাদা পকেটে পুরে সুদীপ ওর বাবার সঙ্গে কথা বলল। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাবা ছেলেটাকে রেখে দিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার দ্বিতীয় মা এসে হাজির। রয় ছেলেটাকে আমরা স্নেহ করতে আরম্ভ করি। একেবারে ব্লন্ড। মাথাভর্তি সোনালি চুল। ভুরু, চোখের পাতা সব সোনালি। চোখগুলো নীল। কি যে সুন্দর মায়াকাড়া চেহারা ছিল ছেলেটার। আমাদের বাড়ি এলে আর যেতে চাইত না। রাত্তিরের ঘুমটা বাদে সব এখানে। মাঝে মাঝে বোধহয় ওর বাবার মানে লাগত। একটা মস্ত মোটা চেন নিয়ে এসে হাজির হত। ওইটে দিয়ে নাকি মারবে। অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে ঠাণ্ডা করে ছেলেকে তার সঙ্গে পাঠিয়ে দিতাম, প্রতিজ্ঞা করিয়ে যে মারবে না। সুদীপ বলত—‘মায়া বাড়াচ্ছো কমলিকা, কষ্ট পাবে ভীষণ ভবিষ্যতে।’ ভবিষ্যৎ কি! তখনই ছেলেটাকে দেখলে আমার বুক হু হু করত। অথচ সব সময় বাবুর সঙ্গে পাকা-পাকা কথা বলত। বিশ্রী স্ল্যাং ছিল মুখে, চার অক্ষরের অশ্লীল শব্দগুলো পর্যন্ত অবলীলায় উচ্চারণ করত। বুঝে কি না বুঝে ঈশ্বর জানেন। বাবুকে ওর সঙ্গে মিশতে দিতে মন চাইত না। কিন্তু মুখ ফুটে বলতেও পারতাম না সে কথা। ভেবে ভেবে কূলকিনারা পেতাম না। অবশেষে রয়ের বাবাই সমস্যার সমাধান করে দিল। একদিন আমাদের কাছে এসে বলে গেল চলে যাচ্ছি, যাবার আগে ছেলেটাকে ওর মা’র কাছে ডাম্প করে দিয়ে যাবো। খোঁজ পেয়েছি তার।’ লিজ অর্থাৎ ওর নতুন বউ নাকি বাচ্চা-কাচ্চার ঝুটঝামেলা পছন্দ করে না। সেই সনাতন দ্বিতীয়পক্ষ-সতীন-সৎমা সমস্যা!
কী যে হল বাবুর! এরপর থেকে আর আমাদের কাছে শুতে চাইত না। ভীষণ চাপা স্বভাব ওইটুকু ছেলের। বুঝতে পারতাম আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ্য করছে। সামান্যতম কথা কাটাকাটি হলেও রি-অ্যাক্ট করত তখন। খেতে চাইত না। জ্বর এসে যেত। ভুল বকত। জ্বরের মধ্যে ফিট। সে এক দিন গেছে আমাদের।
ফোনটা বাজছে দেখছি।
—‘কমলিকা বলছি—’
—‘সে তো গলা শুনেই বুঝতে পারছি! এমন বুলবুল-কণ্ঠ আর এখানে কই? সবই তো হাসকি ভয়েস! দুচোখে দেখতে পারি না।’
—‘দুকানে শুনতে পারি না বলো।’
—‘ওই হলো।’
—‘ও কথা কিন্তু আর বলো না। জুডি বলে যে মেয়েটির সঙ্গে শর্মার বাড়ি আলাপ হল, মনে আছে? কানট্রি গায়! আমাদের এখানে এসেছিল, রসমালাই খেয়ে ফ্ল্যাট। কিন্তু লতার লন্ডনের ক্যাসেটটা শুনে কী বলল জানো? “ওহ্, শী স্কুইকস ফ্রাইটফুলি!” সন্ধ্যা মুখার্জী আমি আর বার করতেই সাহস পাই নি!’
—‘ওই জুডির কথা শুনে তুমি ঘাবড়ে গেলে? হিউসটনে তোমার গানের স্কুল কি রকম পপুলার ছিল, কটা মার্কিন ছাত্র-ছাত্রী ছিল, বলেছ? ওর ব্যাপার কি জানো? আঙুর ফল টক। আড়াল থেকে জুডির গলা শুনে আমার তো মনে হয়েছিল কোনও রাগী যুবক কথা কইছে। যাক তোমার আজকের অ্যারেঞ্জমেন্ট কদ্দূর এগোল?’
—‘কাবাবগুলো ভাজবার সময়ে তুমি হাজির থাকবে তো ঠিক?’
—‘নিশ্চয়! লুচি বানাচ্ছো না।’
—‘উঁহু অত লুচি করতে হলে, তোমাকে আমাকে কিচেনেই থাকতে হয়। তাছাড়া লুচির গ্যাসে ঘরদোর ভরে যাবে একেবারে।’
—‘আমি একটা সারপ্রাইজ ডিশ নিয়ে যাবো কমলিকা। আগে থেকে জিজ্ঞেস করবে না খবর্দার। আমি পেট-আলগা মানুষ, এখুনি সব বলে ফেলব তাহলে।’
—‘শোনো, দরকারি কথা আছে দীপালি। জ্যোতিদাকে বলো ও মনে মনে কিছু একটা ভাঁজছে। কথায় কথায় সেটা যেন বার করে নেয়।’
—‘কীভাবে? গিলিয়ে না কিলিয়ে?’
—‘ঠাট্টা নয়। আমি কিন্তু ভীষণ ফ্যাসাদে পড়েছি।’
—‘ব্যাপারখানা কী বলো তো? সুদীপদার পেটের কথা জানবার জন্য জ্যোতির দরকার হবে কেন? দাম্পত্য-কলহ চলছে নাকি?’
—‘ও বোধহয় বরাবরের মতো দেশে ফিরে যাবার কথা ভাবছে দীপালি। আমার মনের কথা ও ভালোভাবেই জানে। তাই এখনই ভাঙতে চাইছে না।’
—‘তা হয় না কি? তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে তোমাকে নিয়ে যাবে? সুদীপদা? তোমার মাথা খারাপ হয়েছে কমলিকা।’
—‘আমিই বা ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে এখানে রাখি কী করে বলো? তা ছাড়া ও তো জোর করবে না। আমাকে কনভিন্স্ করবে। আমিও কনভিন্স্ড্ হবো।’
প্রচণ্ড হাসছে দীপালি। উত্তর দিচ্ছে না।
—‘দীপালি! দীপালি! হেসো না। ওর চেষ্টাটাকে আমি শুরুতেই থামাতে চাই। কতকগুলো পয়েন্ট আছে যেখানে আমি কোনও কথা বলতে পারি না। খুব ডেলিকেট।’
—‘দ্যাখো কমলিকা, আমরা সুযোগ পেলে বলবো ঠিকই। কিন্তু সেটা কোনও কাজের কথা নয়। তুমি ফ্র্যাঙ্কলি তোমার আপত্তির কথা ওকে বলো। বাইশ তেইশ বছরের বিবাহিত বরের কাছে আবার সঙ্কোচ কি? দরকার হলে কষে ঝগড়া করো। আমিও কোমর বাঁধছি। তোমরা চলে গেলে আমাদের কী হবে বলো তো? আচ্ছা, সেই সারপ্রাইজটা তৈরি করতে হবে। আমি এখন রাখছি কমলিকা। ঘাবড়িও না।’
বোঝে না। ওরা কেউ আমার কথা বুঝবে না। দীপালি প্রায় গোড়ার থেকেই একা। শ্বশুর বাড়ি বা বাপের বাড়ি কারো কোনও দায় স্বীকার করবার মেয়েই নয়। খুব অনায়াসে হাসতে হাসতে সব দায়-দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে। বিয়ের বছরখানেক পর থেকেই নিউ ইয়র্ক। দু তিন বছর অন্তর অন্তর নিয়ম করে দেশে যায়। সুধাময়কাকার ঘর বিদেশি জিনিসে ভরে গেছে। কাছে থাকে শুভময়। ওঁর ছোট ছেলে। দীপালির কাছ থেকে ওঁদের আর কোনও প্রত্যাশা বোধহয় নেই। এতো স্বাভাবিকভাবে দীপালি এসব করে যে স্বার্থপর বলে ওকে সমালোচনা করাও হাস্যকর। আসলে দীপালিরা ঠিক মধ্যবিত্ত সমাজের নয়। ওর বাবা ছিলেন মিলিটারিতে, এয়ার ফোর্সে খুব বড় পোস্টে কাজ করতেন। অন্যরকম মানসিকতায় গড়া ওরা। বাইরে ঘরোয়া দেখালেও ভেতরে ভেতরে আমাদের থেকে আলাদা। ওদের বাড়িতে সন্ধেবেলা নিয়মিত সুরার আসর বসত। ওর বাবা দাদা সব একসঙ্গে। দীপালির মা-ও যোগ দিতেন বোধহয় মাঝে মাঝে। ‘মধ্যবিত্ত’ এই কথাটার ব্যঞ্জনা যে কি সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি। কত জটিলতা, কত মানসিক বাধা নিষেধ ওই শব্দটায়। এখানে এসে যখন বাবুর নানারকম অসুখ হতে লাগল আমি ভাবতাম আমার শাশুড়ির অভিশাপে হচ্ছে এসব। অভিশাপ কথাটার হয়ত ঠিক ব্যবহার করলাম না। ভাবতাম ওঁদের অমতে এখানে চলে আসায় আমার পাপের ফলে হচ্ছে এসব। ভেবে ভেবে আমি নিজেও দড়ি পাকিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন হতো যে রাতে ঘুম হত না। মাঝ রাতে উঠে ট্রাংকুইলাইজার খেতে হত। শেষে শনি মঙ্গলবার করতে শুরু করলাম। প্রথমটা ও ধরতে পারেনি। তারপর এক শনিবার ও নিজে হাতে বীফ স্টেক করেছে, বার্বেকিউড। বাগানে বসে রাই-ব্রেড আর মাখনে-ডোবানো ব্রাসেল্স্ স্প্রাউট দিয়ে খাওয়া হচ্ছে। সঙ্গে ক্রীম শেরি। দীপঙ্কররা আছে। আমি না খেতে বোধহয় ব্যাপারটা ওর কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগে। ওরা চলে গেলে জেরার পর জেরা। কবে থেকে শনি-মঙ্গলবার করছি। কেন? তবে আমার মানসিক দুর্বলতার আসল কারণটা কিন্তু ও আঁচ করতে পারেনি। বাবুর অসুখটাই কারণ বলে ধরে নিয়েছিল। শেষে আমাকে নিজমুখেই আমার পাপবোধের কথা বলতে হয়েছিল। ও আশ্চর্য।—‘সে কি? এখানে আসার সিদ্ধান্ত তো আমার! তুমি তো আসতে চাওনি! সবাই সেটা জানেও। কেউ তোমায় দোষ দিচ্ছে না। গালাগাল খেলে আমারই খাওয়া উচিত। তুমি মিছিমিছি এইসব ভেবে কষ্ট পাচ্ছো? একটা উচ্চশিক্ষিত মেয়ে তুমি। এতো দুর্বল!’
উচ্চশিক্ষার সঙ্গে এইসব ধারণা, মনে হওয়া এসবের কোনও যোগ নেই। সুদীপ সেটা বুঝতে পারে না। কতকাল থেকে আমাদের রক্তে এসব রয়েছে। উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্তি বুদ্ধির কারবার। হৃদয়, সংস্কার এসবে সে হাত দিতে পারে না। দেশে সাড়ম্বরে ষষ্ঠী করতে হত। দুর্গা ষষ্ঠী, শেতল ষষ্ঠী, চাপড়া ষষ্ঠী, নীল ষষ্ঠী, তার ওপরে অঘ্রাণ মাসে ইতুপুজোর পালনী, জ্যৈষ্ঠ মাসে জয় মঙ্গলবার। তখন আমার তিতিবিরক্ত লেগে যেত। মুখে যদিও কিছু বলতাম না। আমার শাশুড়ি অনেকসময় বড়মাকে বলতেন—‘থাক না দিদি, বাইরে বেরোতে হয়, হাজার কাজ, আমি করলেই ওর করা হবে।’ বড়মাকে টলানো যেত না; বলতেন—‘তুমি করছো তোমার ছেলে, তোমার স্বামীর জন্যে, ওর ছেলে আর তোমার ছেলে, কি এক?’ এখানে এসে আমি নিয়ম করে ষষ্ঠীগুলো করি। কেন জানি না। প্রত্যেক বছর দেশ থেকে বাংলা ক্যালেন্ডার আনাই। সুদীপ হাজার বাধা দিলেও আমি এসব বন্ধ করতে পারি নি। কিরকম বুক দুবদুর করে।
সেদিন ও দীপালির তুলনা দিয়েছিল। কথায় কথায় ও দীপালির তুলনাটা আমাকে দিত। আমি জানি, দীপালি খুব সুন্দরী, সপ্রতিভ, কোথাও কোন দিনও অসুবিধে হবে না এমনভাবেই তৈরি। কিন্তু তুলনাটা আমার ভালো লাগত না। মনে হত সুদীপ যেন দীপালিকে একটু বেশি বেশিই অ্যাডমায়ার করছে। সেদিন কেমন রাগ হয়ে গিয়েছিল, বলেছিলাম— ‘ভেবে দ্যাখো, দীপালির সঙ্গে কিন্তু আমার তুলনা চলে না। দীপালিকে কি চাকরি করতে হয়? এখানকার সংসার চালিয়ে, ভবিষ্যতের সঞ্চয় রেখে দেশে কত পাঠানো যায় তার হিসেব কষতে হয়! জ্যোতি এতই ডলার ম্যানুফ্যাকচার করে…’ আমি ঠোঁট কামড়ে থেমে গিয়েছিলাম। বাস্তবিক, আমার কথাগুলো তো অপ্রাসঙ্গিক! দীপালির সঙ্গে তুলনা করে ও আমায় কষ্ট দিয়েছে। জ্যোতির ডলারের কথা তুলে, দেশে টাকা পাঠাবার বাধ্যবাধকতার কথা তুলে আমি তাই ওকে পাল্টা কষ্ট দিয়েছি। ভেবে-চিন্তে দিইনি। অভিমানে দিয়েছি। কিন্তু ও বুঝল না। গুম হয়ে গেল।
বহুদিন ও এমনি গুম হয়ে ছিল। সুদীপের গুম হয়ে থাকাটা একটা সাঙ্ঘাতিক জিনিস। যে মানুষের মুখে সব সময়ে হাসি, ঠোঁটের আগায় সর্বদা ঠাট্টা। সে যদি দিনের পর দিন মুখ কালো করে থাকে, নিতান্ত দরকার ছাড়া কথা না বলে, মনের আগুনে শুকিয়ে যেতে থাকে, তাহলে তার স্ত্রীর পক্ষে ব্যাপারটা কি মারাত্মক হতে পারে আমার অবস্থায় যে পড়েনি সে বুঝবে না। খোলাখুলি কোনও বোঝাপড়ার প্রশ্নই নেই, এমন অচল অবস্থা। একদিন চেষ্টা-চরিত্র করে বলে ফেললাম, ‘আমার ভুল হয়েছে, আমি তোমার কাছে মাপ চাইছি।’
‘কিসের জন্য? ওঃ হো, সেই কথা! ছাড়ো তো! তাছাড়া তুমি তো ঠিকই বলেছ। একদম ঠিক।’ এমন করে ও আমার গাল টিপে দিল যেন আমি বাচ্চা মেয়ে। অথচ চোখে হাসি নেই। ওর মুখের সেই কালচে ভাব দূর করার জন্যে আমার সে কি মর্মান্তিক চেষ্টা! আমি সোনালি রঙের শাড়ি পরলে ওর ভালো লাগে, দেশি নিরামিষ রান্না ওর খুব পছন্দ…। কিছুতেই কিছু না। শেষকালে আমি অসুস্থই হয়ে পড়লাম। নার্ভাস ব্রেক-ডাউন। বুকের মধ্যে আঁকড়ে-ধরা ভয়। ও বোধহয় আমাকে ডিভোর্স করবে। গা শিরশির করত সব সময়ে। মাথাটা ফাঁকা। জ্যোতি এখান থেকে গেল, ও-ই ডায়াগনোজ করল। বলল, ‘চাকরিটা যদি তোমার খুব স্ট্রেইন মনে হয়, ছেড়েই দাও না কুমু, পরে আবার দেখা যাবে।’ তখনই দেখলাম সুদীপের মুখে এক রকমের মেঘ সরে অন্যরকম মেঘ জমছে। সেই কটা বিশ্রামের দিন আমার কি সুখেই যে কেটেছিল! সক্কালবেলা ইনস্টিট্যুটে যাবার আগে ব্রেকফাস্ট-ট্রে হাতে সুদীপ বিছানায় হাজির। ছোট ছোট হাতে বাবু গরম জল এনেছে। ‘উঁহু মা, তুমি একেবারে উঠবে না।’ প্রতিদিন ব্রেকফাস্টের সঙ্গে সুদীপ ট্রেতে ফুল আর একটা মেসেজ গুঁজে দিত। সেটা আবার তক্ষুণি পড়লে হবে না। ও বেরিয়ে যাবার পর পড়তে হবে। পড়তে-পড়তে আমার মুখ লাল, হাসিও পেত ওর ছেলেমানুষি দেখে, ভালোও লাগত ভীষণ। এতে মনোযোগ কজন স্ত্রী পায়? বিয়ের এত বছর পরে? দীপালি যে পায় না, সেটা অন্তত জানি। জ্যোতির স্বভাবে অত সূক্ষ্ম শিল্প নেই। দীপালি অবশ্য গ্রাহ্যও করে না। খেলো দেলো, হইহই করে বেড়িয়ে এলো, ঘর সাজালো, কাজকর্ম করল, ব্যস ফুরিয়ে গেল। তাই-ই বলছিলাম ‘মধ্যবিত্ত’ ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। এই মানসিকতা আমাদের একটা পঞ্চম মাত্রা দেয় যা উচ্চবিত্ত ফ্যাশনের মহলের বাসিন্দাদের থাকে না। সেই সময়কার ভালোবাসার ফুলই মণি, আরাত্রিকা। বাবু বাঞ্ছিত, কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট। মণিকেই আমরা সচেতনভাবে আমাদের নিবিড় সমঝোতা আর আকাঙ্ক্ষা দিয়ে গড়েছি। সুদীপ যে আমায় কতখানি বোঝে তা এখন আরও স্পষ্ট হয়েছিল আমার কাছে। মেয়ে হওয়ার পর যখন জ্ঞান হল, তখন অনেক রাত। কী হয়েছে তাও জানি না। নার্স আমার কাছে একগোছা কারনেশন আর একটা সুন্দর কার্ড নিয়ে এলেন, কার্ডে লেখা, ‘উই হ্যাভ এ বেবি গার্ল। শী ইজ অল আওয়ার্স।’ শেষের কথাগুলো পড়তে পড়তে আমার গায়ে কাঁটা দিল, কেঁদে ফেললাম। ওকে আমি কোনদিনই বলিনি, কিন্তু ও চিরদিনই জেনেছে বাবুকে আমি পুরোপুরি পাইনি। আমার প্রথম সন্তান বাবু যেন পুরোপুরি আমার ছিল না। শাশুড়িকে মা ডাকত। আমাকে বলত বউমা। ডাকটা আমার অসহ্য ছিল। এখানে এসে অনেক চেষ্টা করে ওকে মা ডাকতে শিখিয়েছি। কি লজ্জা ওর মা ডাকতে আমাকে! সিস্টার বললেন, ‘ডোণ্ট ক্রাই। য়ু আর দা প্রাউড মাদার অফ আ মোস্ট বিউটিফুল ডটার। শী উড গ্রো আপ টু বি আ প্যারাগন।’ আমার চোখদুটো মুছিয়ে দিলেন উনি। দু চোখ ভরে তখন আমার শুধু বাবুরই ছবি। বাবু! আমার প্রথম সন্তান! কত কষ্ট করে তাকে পেয়েছি। এখন কী করছে ও! মধ্যবিত্ত মানসিকতার তাড়নায় আবার সেই পাপবোধ। শী ইজ অল আওয়ার্স। তাই কি মেয়েকে আমি বেশি বেশি ভালোবাসবো! বাবু কি দূরে সরে যাবে! বাবু। তুই কি এখন আগের মতো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাঁদছিস? ভাবিস না বাবু, আমি তোকেই কিন্তু বেশি ভালোবাসি। তারপরই মনে হল ছোট্ট পুঁচকিটা পৃথিবীতে নামবার সঙ্গে সঙ্গেই এইসব কথা ভাবছি! ছি ছি পাপ! আমার পাপে আবার না কিছু হয়!
বিত্তের ওপর কিন্তু মধ্যবিত্ত মানসিকতা সব সময়ে নির্ভর করে না। সেটা আমার জ্যাঠতুতো ননদ, যাকে সবাই ছুটকি বলে ডাকে, তাকে দিয়েই বুঝেছি। ও বড়দেরও ছুটকি, ছোটদেরও ছুটকি। আবার এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও ওকে ছুটকি ডাকে। আমার থেকে সামান্য ক মাসের বড়; আমিও ছুটকিই ডাকতাম। কি কাণ্ডটাই না করে বসল। সাক্ষাৎ ফাস্ট কাজিন, নিজের মাসতুতে দাদা—তাকে বিয়ে করে বসল। আবার ফিল্ম অ্যাকটর। জ্যাঠা-শ্বশুর তখন গত হয়েছেন, আমার শ্বশুরমশাই-ই বাড়ির কর্তা। ছুটকিকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন। লিবার্যালও ছিলেন মোটামুটি। না হলে আমার সঙ্গে সুদীপের বিয়ে হওয়া শক্ত ছিল। দৃশ্যটা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে। ছুটকিকে ধরে আনা হয়েছে। মাথায় একগাদা সিঁদুর। উশকো খুশকো চুল। ছোট্ট মিষ্টি মুখখানা। রোয়াকে চেয়ারের ওপর বসে আছে। শ্বশুরমশাই বলছেন, ‘এ বিয়ে অসিদ্ধ ছুটকি, এ পাপ, এ হয় না। তুই এসব সিঁদুর-টিদুর মুছে ফ্যাল মা। আমি তোর জন্যে খুব ভালো পাত্র দেখেছি।’
আমরা সব ঠকঠক করে কাঁপছি। ছুটকি মুখ তুলে বলল, ‘তুমি যা বললে সেসব কথা রিলেটিভ কাকা। আমাদের ছাড়া আর সব সমাজেই কাজিনকে বিয়ে করার রীতি আছে। আমি কোনও অন্যায়ও করিনি। পাপও করিনি।’
বড়দা এই সময়ে এগিয়ে এসে ঠাস করে ওর গালে একটা চড় মারলেন। আঙুলের দাগ তক্ষুণি ওর নরম গালে দাগড়া হয়ে ফুলে উঠল। মাথাটা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। সুদীপ গিয়ে তাড়াতাড়ি ধরল। শ্বশুরমশাই বড়দাকে ধমক দিলেন, ‘ছিঃ সুধী, মেয়েদের গায়ে হাত তুলছ? এভাবে? কী করলে দেখো তো!’ ছুটকিকে উনি বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। বড়মা রান্নাঘরের চৌকাঠ থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘ওকে যে ভাগাড় থেকে এনেছিলি সুধী, সেই ভাগাড়েই ফিরিয়ে দিয়ে আয়। ডোম-ডোকলা। এদিকে ঢুকলে সর্বস্ব ধোয়া-পাকলা করতে হবে।’ মা বটে বাবা! ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। ব্যস, ওদের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।
আমরা কিন্তু থাকতে পারতাম না। চুপি-চুপি কলেজ-ফেরৎ অনেক সময় ওর বাড়ি গেছি। মার বাড়ি, মাসির বাড়ি উভয় দিক থেকেই তাড়া খেয়ে ও আর স্বর্ণেন্দুদা তখন ডোভার লেনে একটা ছোট্ট দু-কামরার ফ্ল্যাটে থাকত। সুন্দর ছবির মতো সাজিয়ে রাখত ফ্ল্যাটটা। সুদীপ তো মাসে একবার করে যাবেই, বলত, ‘অসামাজিক কাজ একটা করে ফেলেছে, অত আদরের বোন, ফেলে দিতে তো পারি না! সবাই মিলে এইভাবে তাড়না করলে ওরা বাঁচবে কী করে?’ আমার বাপের বাড়ি থেকে কাছে। আমি প্রায়ই ওখান থেকে যেতাম। সিনেমা-পত্রিকাগুলো উল্টে পাল্টে বলতাম, ‘ছুটকি, তোমার ভয় করে না? সত্যি করে বলো তো?’
ও খুব হাসত, বলত, ‘সেজদা এতো ছাত্রী পড়ায়, গাইড করে তোর ভয় করে না সেজ বউদি?’
‘বারে, তা হবে কেন?’
‘আমারই বা হবে কেন? এক এক পেশার চাহিদা এক একরকম। একটু আনকনভেনশ্যন্যাল বলে মেনে নিতে প্রথমটা দেরি হয়, বউদি। তোদের আর দোষ কি? না আমার ভয়-টয়, জেলাসি-টেলাসি হয় না। তাছাড়া শুটিং দেখেছিস কখনো? এতো লোকজন, আলো-টালোর মাঝখানে, জায়গা মেপে, চোখে গ্লিসারিন দিয়ে প্রেমালাপ করতে হয় যে প্রেমের বাবা পালিয়ে যাবে, বুঝলি? নে, চা খা।’
সত্যিই ও দিব্যি ছিল। মনে কোনও খেদ বা গ্লানি ছিল না। আমাদের সবারই ধারণা ছিল এ বিয়ে টিকবে না। স্বর্ণেন্দুদা তখন বাংলা ছবির হিট রোম্যাণ্টিক নায়ক একজন, চুপি চুপি বাড়িতে না বলে ওর ছবি দেখতে যেতাম আমি আর সুদীপ। পর্দায় কি কাণ্ড করছে না করছে তার ওপর চোখ রাখা। অভিনয় দেখে আমার গা শিরশির করত। কিন্তু এখনও ওরা তেমনি সুখেই আছে। আমাদের নিয়মিত চিঠিপত্র দেয়। স্বর্ণেন্দুদা বোধহয় আজকাল নায়কের দাদা-বাবা গোছের কিছু সাজে। প্রচুর পয়সা করেছে। নানান কোম্পানির শেয়ার-হোল্ডার। বড় মেয়ে লায়লীর বিয়ে দিল কদিন আগে। আমরা এখান থেকে সব কসমেটিকস্ আর দুজনের ঘড়ি পাঠাবো লিখলাম। তা ওসব বিদেশি জিনিস-টিনিস বোধহয় ওদের কাছে নস্যি। জানাল সব যোগাড় হয়ে গেছে। ডুপ্লিকেট হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত ভেবে-চিন্তে সাড়ে সাতশ’ ডলারের ড্রাফট্ পাঠাল ও। মামার বাড়ি থেকে কিছু পাবে না মেয়েটা! আশীর্বাদ বলেও তো একটা জিনিস আছে!
বরং বড়দির জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। খুব ট্যালেণ্টেড ছিলেন শুনেছি। লীলাবতী বলত কলেজে। প্রথমে উত্তরটা লিখে তারপর তলা থেকে ওপরে অঙ্ক কষতে পারতেন নাকি। এতো মেধা! জ্যাঠাশ্বশুর জোর করে বি-এ পাশ করার পরই বিয়ে দিয়ে দিলেন। বংশ, রূপ আর টাকা দেখে বিয়ে। বিয়েতে নাকি অসাধারণ জাঁকজমক হয়েছিল। কিন্তু ও বাড়িতে দিদির গুণের আদর বোধহয় হয়নি। পড়বার অনুমতি পেয়েছিলেন। কিন্তু এক বছর পরই বাচ্চা। দু বছর পর আবার। পাঁচ বছর পর দিদি এম-এ-তে বসে উঠে এলেন সেকেন্ড পেপার দিয়ে। ঊনত্রিশ নম্বর কিছুতেই উত্তর করতে পারেননি। পরদিন আর পরীক্ষা দিতে গেলেন না। সন্ধেবেলায় য়ুনিভার্সিটির ম্যাথমেটিকস্ ডিপার্টমেণ্টের তিনজন দিকপাল আমাদের বাড়ি। সুচিত্রা পরীক্ষা দিতে যায়নি কেন! দিদি বললেন, ‘ঊনত্রিশ নম্বর সেকেন্ড পেপারে উত্তর করতে পারিনি, আর পরীক্ষা দিয়ে কী করব?’ ওঁর মাস্টারমশাইরা বললেন, ‘সে কি! তোমার একবারও অকার করল না সুচিত্রা চ্যাটার্জী যা উত্তর করতে পারেনি তা আর কেউই পারবে না।’ শোনা গেল, ওই ঊনত্রিশ নম্বর আর কেউ তো উত্তর করতে পারেইনি। এই তিন দিকপাল সারা দিনরাত মাথা ঘামিয়ে বার করেছেন ওর মধ্যে একটা জটিল ভুল ছিল। এরপর আর দিদিকে কেউ পরীক্ষা দেওয়াতে পারেনি। দুটি ছেলের একটিও দিদির প্রতিভা পায়নি। বড়টি তো নকশাল মুভমেণ্টে নিরুদ্দেশ, ধরে নেওয়া যেতে পারে সে নেই। ছোটটি জামাইবাবুর ব্যবসা দেখে। পুতুপুতু করে তাকে একেবারে নাড়ুগোপাল বানিয়ে রেখেছেন জামাইবাবু। বড়দির অসীম কষ্ট, ডিপ্রেশান বুঝতে পারি। কিন্তু উনি নিজে কোনদিন অভিযোগ, অভিমান, আক্ষেপ করেননি। আঁচলে হলুদের দাগ, শান্ত, নীরব দিদিকে দেখে কে বলবে ইনি একসময়ে ক্যালকাটা য়ুনিভার্সিটির ডাকসাইটে ছাত্রী ছিলেন, বাঘা বাঘা মাস্টারমশাইদের কান কাটতে পারতেন। বড়দির জীবনটা জ্যাঠাশ্বশুর নষ্ট করে দিলেন।
কমলিকা উঠে স্টিরিওটা চালিয়ে দিলেন। নারায়ণ রাও ব্যাসের বৃন্দাবনী সারং। কমলিকা অন্যমনস্ক হয়ে গান শুনতে পারেন না। নারায়ণ রাওয়ের পেছন পেছন যাচ্ছে গলা। এইসব সপট তান আজকাল গলায় আটকে যাচ্ছে। হিউসটনে নিজের বাড়িতে ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটা ছোট্ট ক্লাস নিতেন। স্থানীয় ভারতীয়দের সবারই ছেলে বা মেয়ে তালিম নিত। তিনটি মার্কিন ছাত্রছাত্রী ছিল। সান্ড্রা বলে একটি মেয়ে তাঁদের ‘ইন্ডিয়ান কালচার্যাল সোসাইটি’র বার্ষিক অনুষ্ঠানে দিব্যি ভজন গেয়েছিল। উচ্চারণটা কিছুতেই বাগে আনতে পারেনি।
‘মীরা খে প্রাভু, গিড়ঢড় নগড়’ শুনে সবাই মুচকি মুচকি হেসেছিল। কিন্তু সুরটা গলায় তুলেছিল সুন্দর। বিচ্ছিরি হেঁড়ে গলা ছিল কার্সন বলে আর একটি ছেলের। কিন্তু ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অন্ধ ভক্ত। কমলিকাকে বলত, ‘তুমি শুধু আমার বেসিসটা তৈরি করে দাও। তারপর আমি ইন্ডিয়ায় চলে গিয়ে একজন গুরু খুঁজে নেব। শুনেছি, শিখতে হলে হাত পা মাসাজ করতে হয়, জল বয়ে আনতে হয়। তবে নাকি শেখায় ওরা। তাই করব।’ পাগল সব!
আরেক পাগল বাবু। বেছে বেছে ব্ল্যাক অ্যামেরিকানদের সঙ্গে ভাব করে। জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘হোয়াইট্স্? একটা দেশের আসল বাসিন্দাদের মেরে ধরে তাদের বিলিয়নস অ্যান্ড বিলিয়নস অফ একার জমি দখল করে নিয়েছে, আরেকটা দেশ থেকে মানুষকে জানোয়ারের মতো ধরে এনে জানোয়ারের মতই খাটিয়েছে, বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে আরেকটা দেশের ওপর আবার অ্যাটম বোমার এক্সপেরিমেন্ট করেছে, ওদের সম্পর্কে আমার ইন্টারেস্ট কম মা!’
কমলিকা ইতিহাস ভালো জানেন না। কিন্তু মনে হয় সব দেশের অতীত ইতিহাসই তো এই! মহেঞ্জোদারোর দ্রাবিড়দের ধ্বংস করেই তো আর্যরা এসেছিল। ব্রিটনদের তাড়িয়ে রাইন উপত্যকার সেই তিন দুর্ধর্ষ জাতি অ্যাঙ্গল্স্, স্যাক্সনস অ্যান্ড জুট্স্। আর, আমেরিকার ইতিহাসে যেমন ট্রুম্যানরা আছে তেমন লিঙ্কনরাও তো আছেন! লিঙ্কনের কঠোর সংকল্প ছাড়া কি কালো আমেরিকা মুক্তি পেতো? যে যাই বলুক, আমেরিকার সাধারণ মানুষদের কিন্তু বেশ লাগে। বড় বড় ডিগ্রিধারী, বড় বড় চাকরি করছে সব, কিন্তু এক্কেবারে সরল মন, নিজের গণ্ডিটির বাইরে আর কিচ্ছু জানে না, টিভির সোপ অপেরাগুলো হাঁ করে দেখে, কারো সাতে নেই, পাঁচে নেই। হিউসটনে প্রতিবেশী ছিল লিণ্ডা আর হ্যারি প্রেস্টন। লিণ্ডা অবলীলায় জিজ্ঞেস করত, ‘তোমরা দুজনেই প্রোফেশন্যাল, এতো আর্ন করো, একখানা গাড়ি কেন। ইমপোর্টেড কারই বা কেননি কেন? দুজনেই পি. এইচ. ডি? কি সাংঘাতিক বিদ্বান তোমরা? মেল রিপ্রোডাকটিভ সেলের ওপর কাজ করছ? হাউ ফ্যানটাসটিক! ওমা! ইন্ডিরা গ্যান্ডি মহাটমা গ্যান্ডির ডটার-ইন-ল নয়?
প্রেস্টনরা কমলিকাকে বাগান করতে শিখিয়েছিল। জেক, ওদের ছেলে বেড়া মেরামত করে দিয়ে হাসতে হাসতে মজুরি নিয়ে গেল। লিণ্ডা পরের দিনই চীজ পেস্ট্রি করে হাজির। অনেকটা সরপুরিয়ার মতো খেতে। পেছনের দরজা দিয়ে হেঁকে বলল, ‘কমলিকা, প্লীজ সি ইফ ইয়োর হাবি ইজ প্রেজেন্টেবল্।’ সুদীপ ইনস্টিট্যুট থেকে ফিরেই পাজামা পরে ফেলতেন। সেই অবস্থায় কোন লেডিকে অভ্যর্থনা করা ওদের কাছে অকল্পনীয়। এদিকে মেয়েগুলো যা-খুশী পরে ঘুরবে।
পাড়াতে ব্ল্যাক এলেই কিন্তু বাড়িগুলো বিক্রি হয়ে যেত ঝপাঝপ। দক্ষিণের লোক এখনও কালোদের দেখতে পারে না। গ্রীষ্মকালের এক রবিবারের সকালে অবাক হয়ে গার্ডেনিয়ার ফুল দেখছেন সুদীপ আর তিনি। দেশের গন্ধরাজ কি অপূর্ব স্বাস্থ্যমণ্ডিত মহিমায় ফুটেছে টেক্সাসের মাটিতে! বাবু গুঁড়ি-গুঁড়ি চুল, চ্যাপটা নাক, অনবদ্য ফিগারের একটি কালো মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ঢুকল, ‘মা, মীট মাই ফ্রেন্ড ক্যাথি।’ গন্ধরাজের সৌরভে বুঁদ হয়ে ছিলেন দুজনে, বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠেছিল। এই পশমী চুল কৃষ্ণকন্যাকেই যদি স্টেডি ডেট-টেট করে বসে ছেলে!