Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জন্মভূমি মাতৃভূমি || Bani Basu » Page 17

জন্মভূমি মাতৃভূমি || Bani Basu

হেমন্ত এসে গেছে। সামনের রাধাচূড়া আর নিমের কালচে সবুজ ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া মাথাগুলো ফাঁকা হতে শুরু করেছে এবার। বারান্দার অনেক নিচে দেখা যায় রাস্তাটা ভরে আছে ঝরা পাতার স্তূপে। মাঝে মাঝে ঝেঁটিয়ে নিয়ে যায় কর্পোরেশনের জমাদার। নইলে ওই শুকনো পাতার গদীর ওপর বসে খেলা করে কতকগুলো উলঙ্গ বাচ্চা। বাতাসে এরই মধ্যে বেশ টান। অগাস্টের পর থেকে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে হয়ে বোধহয় শুকনো হয়ে গেছে বাতাস। আজ সুদীপের জন্মদিন। কমলিকা, বাবু, মণি বারান্দায় বসে। গাছপালার মাথা টপকে লেকের জল। মাথার ওপরে কালচে আকাশ। আজকাল সাতটার মধ্যেই খাওয়া হয়ে যায়। দরকার থাকলে কিছুক্ষণ পড়াশোনা, যে যার কাজ, তারপর তিনজনে বারান্দায় এসে বসে থাকে। আরও রাতে জবা চকোলেট দেওয়া দুধ দিয়ে যাবে।

বাবু সন্তর্পণে বলল, ‘মা গান শুনবে না?’

কমলিকা অন্যমনস্ক গলায় বলল, ‘শোনা।’

‘ঘরে যাবে? না এখান থেকেই শুনবে?’

‘এখানেই তো বেশ আছি। জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দে। ভল্যুমটা একটু বাড়িয়ে দিস।’

বাবু হোল্ডার থেকে বেছে বেছে বার করল একটা বিশেষ ক্যাসেট। বাবা-মার যৌবনের প্রিয় বাংলাগান সব। অনেক ধৈর্য ধরে বাবা পুরনো রেকর্ড থেকে টেপ করে রেখেছে। বিশেষ বিশেষ দিনে বাবার প্রিয় ব্যসনই ছিল এইসব গান শোনা।

বোতাম টিপতেই হৈমন্তী কলকাতার ভারী বাতাসে উদাস সুর ছড়িয়ে পড়ল—‘কোন দূর বনের পাখি বারে বারে মোরে ডাক দেয়’··· ‘কূল ছেড়ে এসে মাঝ দরিয়ায় পিছনের পানে চাই,’ ··· ‘বালুকা বেলায় কুড়াই ঝিনুক মুকুতা তো কভু মেলে না···।’ বাবু আর মণি আগে ঠাট্টা করত—এগুলো ‘বাবা-মার’ গান। খুব মন দিয়ে কোনদিন শোনেনি ওরা। আজ সায়ন্তনী বারান্দায়, বিরহবিধুর হেমন্তে মাথা নিচু করে শুনতে লাগল বাবার সঙ্গে, মার সঙ্গে। কোনোটা সোজা সরল, কোনোটা ছোট ছোট মুড়কি কাজে ভরা, কিন্তু অব্যর্থভাবে স্মৃতি-জাগানিয়া। রোম্যান্টিক। ‘তোমার চরণ চিহ্ন ধরি পথ যে আমার কাঁদে···’ দরাজ গলার সুর খোলা জানলা দিয়ে বেরিয়ে এসে দরদী হাতের স্পর্শ রাখতে লাগল মাথায়। সুদীপ বলতেন বাংলা গানে কথাটা খুব ইমপর্ট্যান্ট। বাণী দরিদ্র হয়ে গেলেই বাংলা গান গেল, যতই সুরের বৈচিত্র্য আনো।

হঠাৎ টান-টান হয়ে উঠে বসল তিনজনে। স্পীকারে পরের গানের বদলে গমগম করে উঠেছে সুদীপের কণ্ঠস্বর:

‘আজ আমার প্রণতি গ্রহণ করো পৃথিবী

শেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদিতলে।

তোমার অযুত নিযুত বৎসর সূর্যপ্রদক্ষিণের পথে

যে বিপুল নিমেষগুলো উন্মীলিত নিমীলিত হতে থাকে

তারই এক ক্ষুদ্র অংশে কোনো একটি আসনের

সত্যমূল্য যদি দিয়ে থাকি

তবে দিয়ো তোমার মাটির ফোঁটার একটি তিলক আমার কপালে।

হে উদাসীন পৃথিবী

আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে

তোমার নির্মম পদপ্রান্তে

আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।’

গান থেমে গেছে। কবিতা থেমে গেছে। ফ্লোরেসেন্ট আলোয় শুধু ধাবমান গাড়িগুলোর চকচকে মাথা। হর্নের শব্দ টেনিস বলের মতো ওপরের বারান্দায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে হাওয়া। আরাত্রিকা বলল, ‘মা আমি কর্নেলে অ্যাডমিশন পেয়ে গেছি।’

চমকে কমলিকা বললেন, ‘সে কী রে? কবে?’

‘দিন তিনেক হল চিঠি পেয়েছি। প্যাসেজের ব্যবস্থা করবেন মিসেস ফার্গুসন। মনে আছে আমাদের ন্যু ইয়র্ক সেন্ট্রালের কাউন্সেলর ছিলেন? যাঁকে তুমি একটা র সিল্কের ড্রেস করে দিয়েছিলে। হার্ভার্ডেও পেয়েছিলাম, কিন্তু ডক্টর স্টোকার, যাঁর কাছে আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছে, তিনি এখন কর্নেলেই আছেন।’

‘আগে বলিস নি তো। তুই কি গ্র্যাজুয়েশনটা এখানে শেষ করবি না?’

‘না।’

‘কী পড়তে চাইছিস?’

‘প্রধানত লিটরেচার। তারপর দেখি··· এখুনি চাকরি করতে হচ্ছে না। ডক্টর স্টোকারের চেষ্টায় স্কলারশিপ পেয়ে গেছি ভালো। প্রায় আঠার হাজার ডলার।’

বাবু বলল, ‘কবে এতো সব করলি মণি?’

‘হায়ার সেকেন্ডারির পর থেকেই চিঠি লেখালেখি করছি। “স্যাট”-এর পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম। আমার নাম ছিল সবার ওপরে। সারা এশিয়ায়। ‘অ্যামেরিকান ন্যাশন্যালস লিভিং অ্যাব্রড’ এই খাতে স্কলারশিপটা পেয়ে গেলাম। হায়ার সেকেন্ডারির পরই ঠিক করেছিলাম দেশে ফিরে যাব।’

বাবু, কমলিকা দুজনেই চমকে উঠলেন।

কমলিকা খুব আস্তে বললেন, ‘আমাকে ফেলে চলে যাবি?’

আরাত্রিকা মায়ের হাত ধরে ভিজে গলায় বলল, ‘বিদেশে পড়তে গেলে তো যেতেই হত মা। বিয়ে হয়ে গেলেও যেতে হত। তাছাড়া ওখানে পৌঁছেই তোমাদের যাবার ব্যবস্থা করে ফেলব শীগগিরই। দাদা তো এনি ডে চাকরি পেয়ে যাবে। তোমার জন্য আমি আলেকজান্ডারের সঙ্গে কথা বলব। প্রথমটা তোমরা গিয়ে জ্যোতিকাকুর কাছে উঠবে। জ্যোতিকাকুর সঙ্গে কথা হয়ে গেছে আমার।’

বাবু বলল, ‘কিন্তু মণি, আমি তো যাচ্ছি না।’

আরাত্রিকার গলায় ঝাঁজ, ‘এখনও, এতো কিছুর পরও তুই যাবি না দাদা? বলতে পারলি কথাটা?’

বাবু বলল, ‘তোর মতো বয়সের আরও কতো ছেলেমেয়ে এমনি হতাশায় ভুগছে এখানে, বিশ্বাসঘাতক শিক্ষা-যন্ত্রের শিকার হচ্ছে রোজ, বাবার মতো কত সৎ আন্তরিক মানুষ প্রতিদিন শহীদ হচ্ছে, হতে পারে। মার্কিন নাগরিকত্বের সব-খোল চাবি তো তাদের হাতে নেই! তাদের ফেলে আমি কোথায় যাবো?’

‘থেকে কি তুই তাদের জন্য কিছু করতে পারবি? একা-একা আন্দোলন করবি না কি?’

‘চেষ্টা তো করবো। কিছু না পারি এক দুর্ভাগ্যও তো ভাগ করে নিতে পারি! আফটার অল আমি তো ভারতীয়ই!’

‘তুই তো এখন থেকেই হবু-শহীদের মতো কথাবার্তা বলছিস!’

‘না রে মণি, আমি এইভাবে দেখি জিনিসটাকে। ধর, টাইটানিকের মতো বিশাল একটা জাহাজ ডুবছে, তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমার মতো একজন সক্ষম যুবক যাত্রী কি লাইফবোট নিয়ে সেখান থেকে পালাতে পারে? না পালানো উচিত?’

‘জাহাজটা ডুবছে এটা স্বীকার করছিস তাহলে?’

‘ওটা একটা উপমা। উপমা দিয়ে কিছুটা বোঝানো যায় মণি। সবটা তো যায় না! ডুবন্ত টাইটানিকের এস. ও. এস. তো কেউ শোনে নি! আমাদের সাহায্যপ্রার্থনা যে নিজেদের রক্তেরই কাছে। বাঁচব বাঁচব। বাঁচাব বাঁচাব। প্রতিটি রক্তবিন্দু এখন জপ করে চলেছে। হয়তো এ টাইটানিক শেষ পর্যন্ত ডুববে না। তাছাড়া, ছুটকি, শর্মি, দাদু, বড়মা, আমার মা এরা তো সব এখন অভিভাবকহীন। এদের ফেলেই বা আমি যাবো কোথায়?’

‘মা তো যাচ্ছেই।’

কমলিকা আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমার পক্ষে আর যাওয়া সম্ভব নয় মণি। তোদের নতুন যৌবন, উৎসাহ বেশি, শক্তি বেশি। তোদের প্রজন্মের সঙ্গে কি আমি তাল মেলাতে পারি? তার চেয়ে আমার নিজের সময়ের মানুষরা যাঁদের সঙ্গে আমি এক স্মৃতি ভাগ করে নিয়ে বাঁচতে পারি তাদের কাছে থাকাই আমার ভালো। তোর দিদিমা, দাদাই, পিসিরা, কাকীরা, তোর বাবা···।’

আরাত্রিকা বলল, ‘তুমি এমন স্মৃতি-স্মৃতি করছ যেন তুমি এখুনিই ফুরিয়ে যেতে পারলে বাঁচো।’

‘ইচ্ছে করে কি আর কেউ ফুরিয়ে যায় রে! ওটা তো অনিবার্য ঘটনা! তবে সেভাবে ফুরিয়ে যাবার কথা কিন্তু আমি বলিনি। এখন আর বিদেশে থাকতে ভালো লাগে না মণি। এখানে আমার কাজকর্ম, বাড়িঘর, আপনজন সবই তো আছে। সবার সঙ্গে ভালই থাকব। তোর যদি একান্তই যেতে হয়, যাবি। আমার কথা ভাবিস না।’

বাবু বলল, ‘মা, তুমি মণির ওপর অভিমান করছ কেন? ওর তো এখানকার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনার ইচ্ছেটা না থাকাই স্বাভাবিক। ওর দিকটাও দেখো। পড়াশোনা শেষ করে আসুক না! চার পাঁচ বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে। প্রতি বছর হয় আমরা যাবো, নয় ও আসবে একবার।’

আরাত্রিকা চুপ করে রইল। চোখ ছলছল করছে। কিন্তু ভেতরে সংকল্প অনমনীয়। মনে মনে বলল, ‘হ্যাঁ আসব ঠিকই। এই পরবাসে আমার মা পড়ে রইল, দাদা পড়ে রইল, এখানকার মাটিতে আমার বাবাকে রেখে যাচ্ছি। বারে বারে আসতেই হবে। কিন্তু সে শুধু আসাই, ফেরা নয়। জন্মভূমি আর মাতৃভূমির এই দড়ি-টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত জিতুক আমার জন্মভূমির মাটি। মানুষের পক্ষে সব রকম বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। আছে অভ্যাসের বন্ধন, স্বভাবের বন্ধন, সময়ের বন্ধন, সব শেষ এই রক্তের, ভালোবাসার বন্ধন। কিন্তু যে-মেয়ে জীবনের চোদ্দটা বছর তার জন্মভূমির দুরন্ত স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে বড় হয়েছে, এবং তারপর বুকভরা আশা নিয়ে বাবা-মার দেশে এসে পদে পদে সেই স্বাধীনতা খণ্ডিত হবার ভয়ানক অভিজ্ঞতায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে সে সর্বদাই হাতে মুক্তির মশালটা জ্বালিয়ে রাখবার কথা স্মরণে রাখবে। স্ট্যাচু অব লিবার্টির মতো।

‘মুক্তির দায়িত্ব আছে। যন্ত্রণা আছে। আছে নৈঃসঙ্গ। কিন্তু এইসব দায়িত্ব, যন্ত্রণা, একাকিত্বের শরিকানা তো অনেকের! আছে স্টীভ, ব্যাথশেবা, তানি, অ্যাডাম রকহার্ট, প্রিয়াঙ্কা। আছে এমিলি, জ্যোতিকাকু।

‘এখন নিশ্চয়ই আমার জন্মভূমির পত্রমোচী অরণ্যে ফল এসেছে। লাল-বাদামি-কমলা-গোলাপি-সোনালি-হলুদ। আদিগন্ত ক্যানভাসে তেল রঙে আঁকা জীবন্ত ছবি। প্রাণবান স্বাস্থ্যবান গাছ সব। নভেম্বরের অন্তিম বৃহস্পতিবার ভালো ফসলের কৃতজ্ঞতায় থ্যাঙ্কস গিভিং ফেস্টিভ্যালে টার্কির রোস্ট ঘিরে বসবে সবাই। ইয়াম, ব্রকোলি, মিষ্টি আলু, ব্রাসেল্‌স স্পাউট···। তারপরই আস্তে আস্তে শীতের চাদরে ঢেকে যাবে উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের শহর গ্রাম। স্তব্ধ হয়ে যাবে নায়াগ্রা। মহিমময় সে স্তব্ধতা। হাডসন, কলোরাডো, মিসিসিপির বুকে যখন কল্লোল জাগবে, পথের ধারে মাথা দোলাবে বেগুনি সাদা, কলামবাইন রক্তলাল কারনেশন কিংবা বাটারফ্লাই ভায়োলেটরা তখন পিঠে রুকস্যাক আরাত্রিকা মুখার্জি হয়তো বেরিয়ে পড়বে পূর্ব সমুদ্রতটে কমলালেবুর কুঞ্জে ভরা বসন্তের ফ্লোরিডা কিংবা পশ্চিম সমুদ্রতটে গোল্ডেন গেট সেতু পেরিয়ে স্যানফ্রানসিসকো উপসাগরের ভিজে ভিজে হাওয়া গায়ে মেখে আরও দক্ষিণে। নেভাদা মরুর মাঝখানে তৈলদানবের তৈরি বিলাসপুরী ক্যাসিনো-শহর লাস ভেগাস, ডেট্রয়েটের বেগুনি আকাশে রাতভর কারখানার জ্বলন্ত মশাল। রকির মুকুটিত ছায়ায় পাইন স্প্রুসের জঙ্গলে ঝরে-পড়া কোনের পুরু গালচের ওপর বসে বসে গাছে হেলান দিয়ে বিশ্রাম। সঙ্গে থাকতে পারে বহুদিনের বন্ধু ব্যাথশেবা, স্টীভ, কিংবা অ্যাডাম রকহার্ট, থাকতে পারে কৌতূহলী কোনও হিচ্-হাইকার যে তারই মতো জন্মভূমিকে সত্যি-সত্যি চিনতে চায়। কিন্তু কে থাকলো, কে থাকলো না, তাতে খুব বেশি আর এসে যাবে না। কারণ একজন সব সময়ে সঙ্গে সঙ্গে থাকবেন, বুকের মধ্যে নির্ভয় আত্মপ্রত্যয় জাগিয়ে। তিনি লিবার্টি। আমার দেশে নাগরিকের ইচ্ছেমতো, মানুষের মতো বাঁচবার স্বাধীনতা কেউ কারো কাছ থেকে কেড়ে নেয় না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17
Pages ( 17 of 17 ): « পূর্ববর্তী1 ... 1516 17

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress