জন্মভূমি মাতৃভূমি (Janmabhumi Matribhumi) : 14
স্বর্ণেন্দু হঠাৎ এইভাবে সেরিব্র্যাল অ্যাটাকে মারা যাবে, ভাবতেও পারি নি। একেবারে সুস্থ সবল মানুষটা। অথচ শরীর ভরা যন্ত্রণা নিয়ে এখনও দিন চলছে বড় বউদির। যতবার যাই বলেন, ‘সেজোঠাকুরপো এবার আমায় ছেড়ে দাও, আর পারছি না।’ বাকি জীবনটা খুব নিশ্চিন্তে আপনজনদের মধ্যে কাটাব বলে এসেছিলুম। বাবার বড় ছেলে। বিদেশে গিয়ে সব সময়ে ভেতরে একটা কাটা খচখচ করত। বুঝি নিজের কর্তব্যে গাফিলতি করেছি। সেই যন্ত্রণা থেকে, পাবলিশ অর পেরিশের তাড়না থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু মুক্তি যাদের পাবার নয়, তাদের হাতকড়া বোধহয় ফাঁকা আকাশ থেকে পড়ে। বাবাকে আমি সুখী করতে পারলুম না। বাধাটা ওঁর নিজেরই মধ্যে কোথাও আছে। স্বাস্থ্য ভালো আছে এখনও, ইচ্ছে করলেই জীবনটাকে উপভোগ করতে পারতেন। কিন্তু ভেতরে কোথাও মানসিক জটিলতা আছে, আমরা নাগাল পাই না। বাবা এখনও লিপ্ত থাকতে ভালোবাসেন। মাসখানেক ছুটকির ওখানে ছিলেন। বরাবরের চাপা স্নেহ ছিল ওর ওপর। কতকটা সংস্কারবশে, কতকটা বড়মার ভয়ে দূরে সরেছিলেন। এখন বোধহয় মনে মনে আফসোস করেন। কিন্তু মাসখানেক পর আবার সেই বউবাজারের বাড়ি। রীণা আর সুমিতের সংসার এখনও বাবার মর্জিমতো চলে। কষ্ট হয় ওদের জন্য। বাইরে বাবা কত উদার, আমাদের কাছে কত ন্যায়পরায়ণ। কিন্তু ওই গর্তটুকুর মধ্যে বাবা এখনও গর্তের ব্যাঙের মতোই ব্যবহার করেন। টুলটুলকে একা ছাড়বেন না। কোনও অল্পবয়সী ছেলের বাষ্প বাড়িতে দেখলেই অস্থির হয়ে পড়েন। রীণা বেচারি একেবারে নড়তে পারে না বাড়ি থেকে। বাবু মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে থাকে, ওখান থেকেই ইনস্টিট্যুটে যায়। বাবু থাকলে রীণা এবং সুমিতের ছেলেমেয়েরা আনন্দে থাকে। আমি তাই বাধা দিই না। কমলিকাও মনে হয় ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। কিন্তু সুকৃত বা আমার কাছে বাবা একেবারেই থাকতে চান না। ওঁর কি ইচ্ছে ছিল নিউইয়র্ক থেকে ফিরে আমরা ও বাড়িতেই থাকি? সুকৃতের ফ্ল্যাট কিনে চলে যাওয়াটাও বাবা ভালো মনে নিতে পারেননি। অথচ, একসঙ্গে তাল পাকিয়ে থাকলে ঠোকাঠুকি ছাড়া আর কিছুই হয় না। ও বাড়ির পার্টিশন আমিই জোর করে করালুম। বাবার যেন তেমন ইচ্ছে ছিল না। বলেছিলুম, ‘দেখো, এবার বড়দা-মেজদার ব্যবহার পাল্টে যাবে।’
ম্লান মুখে হেসেছিলেন বাবা। আমরা আসার দিন বাবা বলেছিলেন, বাড়িটা বলতে গেলে ওঁরই করা। জ্যাঠামশাইয়ের শেয়ার কমই ছিল। সেই নিয়েই কি কোনও খেদ রয়ে গেল বাবার মনে? আমি এসে কতকগুলো পারিবারিক সমস্যার মধ্যে মাথা গলিয়ে বাবাকে অসুখী করলুম কি না বুঝতে পারছি না। আমার দিক থেকে মনে করছি সব কেমন ঠিকঠাক করে দিলুম! কত আত্মত্যাগ করলুম! সুকৃতকেও রাজি করিয়েছি, কত কৃতিত্ব আমার! ওদিকে হয়ত ওই বৃদ্ধ ভাবছেন সারা জীবনের সঞ্চয়, স্ত্রীর সম্পত্তি দিয়ে তিল তিল করে গড়া বুকের পাঁজরের মতো ওই বাড়ি বেহাত হয়ে গেল। বাবাদের পৈতৃক যা কিছু ছিল বড়দা মেজদা তো সবই আত্মসাৎ করেছেন! একজনের উপকার করতে গেলে অন্যদের ওপর অবিচার করা হয়ে যায়। কর্মচক্র এমনই এক দুষ্টচক্র। আমি চাইলুম সুমিতের তিনটি ছেলেমেয়ে, একটু ছড়িয়ে ভালোভাবে থাক। সুকৃত একবার ক্ষীণস্বরে বলেছিল, ‘ফ্ল্যাট করেছি ঠিকই দাদা, কিন্তু জমি বলে তো কিছু নেই!’ মত দিল অবশ্য। কিন্তু হয়ত বাধ্য হয়েই দিল। চক্ষুলজ্জায়। এইসব পারিবারিক জটিলতার প্রশ্ন ওখানে ছিল না। ছুটকির পুনর্বাসন চেয়েছিলুম আমাদের বাড়িতে। হল। কিন্তু আমার হাত দিয়ে নয়, মৃত্যুর হাত দিয়ে।
অ্যালবার্ট সোয়াইটজার সভ্যতার অর্থ করেছেন রেভারেন্স ফর লাইফ। আমরা তাঁর চেয়ে ছোটমাপের মানুষ, তাঁর এই সংজ্ঞার দিকে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিয়ে চেয়ে থাকি। অতটা পারি না। কিন্তু আশপাশের যেসব মানুষের সঙ্গে জন্মসূত্রে, কর্মসূত্রে, বিবাহসূত্রে, বসবাসসূত্রে জড়িয়ে পড়েছি তাদের জন্য কিছু করতে না পারলে জীবনের অর্থ কী? অথচ করতে চাইলেই কি পারা যায়? বড় বউদির চিকিৎসার ব্যবস্থা করলুম, কিন্তু সেই সঙ্গে আমার মাধ্যমেই তিনি জানতে পারলেন, তিনি বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছিলেন, স্বামীর অনেক টাকা থাকা সত্ত্বেও। এই ভয়ানক কথা জানবার পর, চিকিৎসিত হয়েও বউদি একেবারে মলিন হয়ে গেছেন। তাহলে কি মিথ্যেটাই ভালো ছিল? বেশি কথা কি? নিজের মেয়ের জন্যেই কিছু করতে পারলুম না। মণি খুব একটা ধাক্কা খেয়েছে। হঠাৎই যেন ও খুব বড় হয়ে গেছে। ওর কাছে, বাবুর কাছে আমার আজকাল নিজেকে খুব শিশু মনে হয়। মণির ডিপ্রেশন দেখে আমার বুক ভেঙে যায়। ও এবং কমলিকা কি এই শিক্ষা-ব্যবস্থায় ওকে নিয়ে আসার জন্য আমাকে মনে মনে দোষী করে? নিজের সুখের জন্য আমি কি মণির অসুবিধে ঘটালুম? কিন্তু ও যে সেই বিপজ্জনক বয়ঃসীমায় পৌঁছে গিয়েছিল যখন ওদেশে ছেলেমেয়েরা নিজস্ব জীবনযাপন করতে আরম্ভ করে! ওদের ভাবতে শেখানো হয় ওরা সব জেনে ফেলেছে, জীবনটা এবার বাবা-মার হাত থেকে বুঝে নিক। মা বাবা হাত ধুয়ে ফেলে। কৈশোরের ওই স্পর্শকাতর দিনগুলোর এমনি বোঝা মাথার ওপর পড়ায় অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। অনেক ছেলেমেয়ে দেখেছি যাদের ষোলতে মনে হয় ছত্রিশ কি ছেচল্লিশ। মুখে রেখা, চোখে স্বপ্নহীন শূন্যতা; ঠোঁটে চাপা কাঠিন্য। কেউ কেউ হয়ত স্বাধীনচেতা, স্বাবলম্বী হয়। কিন্তু বেশিরভাগই প্রথম দলের।
আচ্ছা, মণি তো এভাবেও জিনিসটা নিলে পারে! এই পরীক্ষা-ব্যবস্থার শিকার লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে। ওর কেসটা আলাদা কিছু না। ওর সমবয়স্কদের সঙ্গে ও যদি একাত্ম হয়ে থাকতে পারে, তাহলে কষ্টটা ওর আপনি কমে যাবে। এসব জিনিস আপনা-আপনিই মনের মধ্যে ঘটতে থাকে। বুঝিয়ে হয় না। যুক্তি মানেই প্রতি-যুক্তি। তর্ক মানেই তকাতর্কি। মন তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশীল। পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য তার মধ্যে যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি চালু হয়ে আছে তার ওপরই আমার ভরসা বেশি। ওর বন্ধুগুলো তো বেশ! সত্রাজিৎ, নাদিয়া, নবনীতা! ইতিমধ্যে আমি আর কি করতে পারি! হাসিতামাশা করে বাড়ির আবহাওয়াটা হালকা রাখতে পারি, যাতে অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া ওর পক্ষে সহজ হয়।
ছুটকির জন্যও আমার এই চেষ্টা। কাল ছুটকি প্রথম এল ওই ঘটনার পর। শর্মি সঙ্গে আছে। ওর বড় মেয়ে বোম্বাইতে থাকে, খবর পেয়ে এসেছিল, ছিলও অনেকদিন। এখন চলে গেছে। দেখলুম, ছুটকি কালো পাড় সাদা শাড়ি পরেছে। সাদা ব্লাউস। ওর রং চাপা, মাথা-ভর্তি কোঁকড়া চুল, মুখটা খুব সুগঠিত, সুডৌল, নাক চোখ মুখ যেন কেউ যত্ন করে কেটে কেটে বসিয়ে দিয়েছে। বড়মার মুখশ্রীর তীক্ষ্ণতাটা ওর আছে, কাঠিন্য নেই। বয়সের তুলনায় অনেক ছেলেমানুষ লাগে। অনেক যত্ন, অনেক ভালোবাসা পেলে তবে মেয়েদের চেহারায় এমন শ্ৰী আসে। ওর আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না। স্বর্ণেন্দু তাই দশহাতে ওকে ঘিরে রেখেছিল। স্বর্ণেন্দু মারা যাবার পর থেকেই ওর এই বেশ দেখছি। প্রথমটা কিছু বলতে বাধো-বাধো ঠেকেছিল। কাল বললুম, ‘হ্যাঁরে ছুটকি, তুই তো খুব সাহসিকা, আনকনভেনশনাল অনেক কিছু করিস। তা এটা কি করছিস?’
‘কোনটা সেজদা?’
‘এই সাদা কাপড়, কালো পাড়। তোকে একদম মানাচ্ছে না।’
শর্মি বলল, ‘বলো তো মামু, মা আমার কথা একদম শোনে না।’
আমি বললুম, ‘তুই হয়ত বলার মতো করে বলতেও পারিস না।’
ছুটকি বলল, ‘বলাবলির কী আছে? বয়সটা তো আমার বাড়ছে বই কমছে না।’
আমি বললুম, ‘এসব করিসনি। হাস্যকর আজকালকার দিনে। আমরা প্রাণপণে তোদের কাঁধ থেকে জোয়ালগুলো নামাতে চাইছি। আর তোরাও প্রাণপণে বোকা বলদের মতো সেগুলো আঁকড়ে আছিস।’
মণি ছিল, বলল, ‘ছুটকি! লোকের চোখে নিজেকে দাগী করে রেখে তুমি কি সুখ পাও? তোমাদের সমাজ তোমাকে এইরকম আত্মনির্যাতন থেকে আনন্দ পেতে শিখিয়েছে, না? নিজেকে এভাবে অপমান করো না প্লীজ।’
ওর কথা শুনে আমি অবাক। অবশ্য ও অনেক বড় হয়ে গেছে। কিন্তু ঠিক এতটা আমি ওর কাছ থেকে আশা করিনি। বাংলাটাও সুন্দর বলছে! কিন্তু ‘তোমাদের সমাজ’ কথাটা আমার কানে খট্ করে লাগল। ওটা কি কথার কথা? না এখনও এদেশের সঙ্গে ও একাত্ম হতে পারেনি!’
বাবু ফিরেছে, ও একপ্লেট পকৌড়া নিয়ে বারান্দায় বসে পড়ল।
‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে তোমাদের?’
কমলিকা সারাক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। ছুটকি এলেই ওর চোখ ছলছল করে। এখন বাবুর কফি আনবার ছল করে উঠে গেল। এই অপ্রিয় প্রসঙ্গের মধ্যে বোধহয় ও থাকতে চায় না। বাবুর ব্যক্তিত্বে কেমন একটা সহজ আপন-করা ভাব আছে, সবাই ওকে কাছে টানে, ওকে দেখলে আজকাল আমার ভরসা বাড়ে। আমি বললুম, ‘ছুটকির এইসব সাদা কাপড়-টাপড় পরা তুই অ্যাপ্রুভ করিস? কিছু বল তো!’
বাবু বলল, ‘টকটকে ফর্সা রঙে সাদা সবচেয়ে মানায়। যেমন, বড়পিসি, যেমন দিদিমা। যাদের গায়ের রং একটু গাঢ় তাদের সাদা অ্যাভয়েড করাই ভাল। তাছাড়া, পিসে ওর ওয়ার্ডরোবটা অত যত্ন করে সাজিয়ে দিয়ে গেল, ও যদি সেটাকে পুরোপুরি ইগনোর করে, তাহলে···।’
ছুটকি কেঁদে ফেলল।
বাবু যেন লক্ষ্য করল না। একই ভাবে বলে চলল, ‘আচ্ছা ছুটকি, তুমি বরাবর হালকা নীল, পীচ, লাইল্যাক এই সবের পক্ষপাতী ছিলে না? তোমার এসথেটিক সেন্স আমার দারুণ মনে হয়েছে। তোমাদের ফিলম ওয়ার্ল্ডের যেসব ডল আসতো তোমাদের বাড়ি পার্টি উপলক্ষ্যে, তাদের পাশে তোমাকে একদম তাজা ফুলের মতো দেখাত। এক ঘর কাগজের শস্তা ফুলের মাঝখানে। আমার কথা যদি শোনো তো সব সময়ে ইউনিফর্মের মতো সাদাটা পরোনা। মাঝে মাঝে পরবে।’
শর্মি, বাবু আর মণি চলে গেল। আজকাল মণির এই এক ঝোঁক হয়েছে, ক্যাসেট চালিয়ে, দরজা বন্ধ করে এখন তিনজনে নাচবে।
অন্ধকার হয়ে গেছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না ভাল। ছুটকির সাদা কাপড় শুধু অন্ধকারের মধ্যে ফুটে রয়েছে। ছুটকি ধরা গলায় বলল, ‘সেজদা তুমি হঠাৎ আমার আনকনভেনশন্যালিটির কথা তুললে কেন? তুমিও কি মনে করো আমাদের পাপের জন্যই ও এভাবে চলে গেল?’
‘ছি ছি! তুই কি কথার কী মানে করলি? পাপ-টাপ কি বলছিস রে? আর “তুমিও” বলছিস কেন? কেউ কি তোকে এসব বলেছে না কি?’
‘বলেনি, তবে ভাবে বোধহয়।’
‘কে?’
‘মা, কাকাবাবু। সে সময়ে কাকাবাবু পাপ কথাটা উচ্চারণ করেছিলেন সেজদা, সারাজীবন ভুলতে পারিনি। স্বর্ণেন্দুকে এতো ভালোবাসতুম, ও ছাড়া আমার উপায় ছিল না। ভীষণ ইনভলভড্ হয়েও পড়েছিলাম। কিন্তু কাকাবাবুর কথাটা কাঁটার মতো বিঁধে ছিল সারাজীবন। দাম্পত্য সুখ যাকে বলে, সেজদা সত্যি বলছি তোমায় কোনদিন ভালো করে এনজয় করতে পারিনি। ওকে কষ্টই দিয়েছি শুধু।’
আমি বললুম, ‘বড়মার স্বামী আর কাকাবাবুর স্ত্রী তাহলে কোন্ পাপের ফলে অকালে গত হলেন বল?
তো বোধহয় ষাট পূর্ণ হয়নি।
ছুটকি চুপ করে রইল।
আমি বললুম, ‘কার আয়ু কখন শেষ হয় কে বলতে পারে। আমরা সবাই তো প্রোগ্র্যাম্ড্!’
কমলিকা মৃদুস্বরে বলল, ‘তুমি আবার কবে থেকে অদৃষ্টবাদী হয়ে উঠলে?’
আমি চমকে বললুম, ‘অদৃষ্টবাদ বলতে পুরোপুরি যা বোঝায় সেভাবে আমি কথাটা বলিনি কিন্তু। অদৃষ্টবাদের সঙ্গে আরও কতগুলো গাদাবোট আছে। সবসময় সঙ্গে সঙ্গে চলে। যা ঘটার তা ঘটবেই, যাই করো না কেন, নিয়তিকে আটকানো যায় না। ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি সেদিকে যাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের সিস্টেমের কর্মক্ষমতার একটা সীমা আছে তো, ফুরিয়ে যাবার সময়টা ধার্যই করা থাকে!’
কমলিকা বলল, ‘স্বর্ণেন্দুদা অত রিচ ফুড খেতেন। ওদের বাড়িতে পেঁয়াজ রসুন লঙ্কাবাটা ছাড়া রান্না হত না। এই গরম দেশে প্রতিদিন মাংস। তাতে বাটি বাটি ঘি। না হলে স্বর্ণেন্দুদা চেঁচামেচি করতেন। ড্রিঙ্ক-ট্রিঙ্কও ভালোই করতেন। ছুটকির কথা তো একেবারেই শুনতেন না। আমি তো মনে করি সেইজন্যেই উনি এতো তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। প্রোগ্র্যাম্ড্ না আরও কিছু। তোমরা আমাদের কথা ভাবো না। ভীষণ স্বার্থপর আসলে, এবং অসংযমী।’
‘বাঃ, তুমি তো বেশ জেনারালাইজ করে ফেললে! থার্ড পার্সন থেকে চট করে সেকেন্ড পার্সন-এ চলে এলে তো বেশ?’
কমলিকা বলল, ‘কেন এলাম তুমি ভালোই জানো। ব্রীফকেসে ওষুধ নিয়ে ঘুরছো। পকেটে কার্ডিওলজিস্টের প্রেসক্রিপশন। অথচ আমি বিন্দু-বিসর্গ জানি না। জীবনটা কি ছেলেখেলা?’
ছুটকি বলল, ‘সে কি রে সেজদা! তোর হার্টের গোলমাল হয়েছে, কাউকে জানাসনি? সেজবউদি জানে না? তোদের হল কি?’
‘তেমন কিছু তো নয়। সামান্য একটু অ্যানজাইনার ব্যথা। যবে থেকে জ্যোতি বলেছে আমি নিয়মিত চেকআপ করাই। বলবার মতো কিছু নয় বলেই বলিনি।’
কমলিকা বলল, ‘উঁহু। বলোনি কারণ তাহলেই আমি তোমার খাওয়া-দাওয়ার ধরা-কাট করব। গতিবিধির ওপর পাহারা বসাবো···’
আমি বললুম, ‘তা ঠিক নয়। সাবধান তো আমি নিজেই হয়েছি। স্মোক করা ছেড়ে দিয়েছি বললেই হয়। তবে অসুস্থ লোকের মতো থাকতে আমার একেবারে ভাল লাগে না, এটা ঠিক।’
‘তাই বলে তুমি বউদিকে লুকোবে?’ ছুটকি ভীষণ ব্যস্ত ও বিরক্ত হয়ে বলল। কমলিকা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। বুঝতে পারছি মুখটা থমথম করছে।
কেন লুকিয়েছি ওকে কি বোঝাবো? আমি নিজেই যে জানি না। বাবার বড় ছেলে। আমাদের বাড়ির বড়মা-তন্ত্রে বাবা পর্যন্ত অসহায় বালকের মতো বাস করতেন। সেখানে স্বাধীন চিত্তবৃত্তির সঙ্কল্প টিকিয়ে রাখতে গিয়ে অনেক সংযম, অনেক স্বাবলম্বন স্বভাবের মধ্যে ঢুকে গেছে। অসুখের কথা কি ছেলেবেলাতেও কাউকে বলতুম? খুব ছোটতে মা ধরে ফেলতেন। কিন্তু তারপর থেকে নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিয়েছি। কমলিকা জেনে গেল ব্যাপারটা। আমি কোনও সদুত্তর দিতে পারিনি। আজ আমার কপালে দুঃখ আছে।
আসলে আমি সবাইকে খুব সুখী, হাসিখুশী দেখতে চাই। আমার জন্য কারো মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ুক এ আমি চাই না। জীবন তো একটাই। চারপাশে যেসব অশুভ ছায়া নাছোড়বান্দার মতো ঘোরাফেরা করছে তাদের অগ্রাহ্য করাটা তাই ভীষণ জরুরি। আমার অসুখের কথা শুধু কমলিকার কাছ থেকেই নয়, আমার নিজের সচেতন মনের কাছ থেকেও আমি গোপন করে রাখি। যা করার করব, কিন্তু নিজেকে কোনমতেই সুস্থ সবল মানুষ ছাড়া আর কিছু ভাবব না। এ চিন্তাধারা কি ভুল? ভুল হলেও আমার কিছু করার নেই। আমি যে এভাবেই তৈরি!