Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জনতোষণ || Samaresh Majumdar

জনতোষণ || Samaresh Majumdar

আমাদের পাড়ার শিবু ঘোষ এখন ফিল্ম লাইনে ভালো টাকা করেছে। প্রথমে ট্রাম বাস তারপর ট্যাক্সি শেষে পুরোনো মডেলের অ্যাম্বাসাডার চাপতে শুরু করেছিল। এখন একটা মারুতি ডিল্যাক্সে ওকে দেখি। এসব বদল হলেও শিবুর কথাবার্তা চালচলন বড় একটা পালটায়নি। ওর বাবার একটা কারখানা ছিল ভালো জায়গায়। কিন্তু শ্রমিক বিক্ষোভ বেড়ে যাওয়ায় সেটি বন্ধ করে দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। অনেক চেষ্টা করেও শান্তি না আসায় একদিন হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়েছিল তাঁর। শিবু তখন কারখানা বিক্রি করে দিয়ে মোটা টাকা পেল। তার পড়াশুনা বেশিদূর নয়। কিন্তু কলকাতার জল পেটে থাকলে নিরক্ষর ছেলেও এসে পাশের ভঙ্গি করতে পারে। এই শিবু, বোধহয় লিখি বলেই, আমায় খানিক সমীহ করত। বাড়িতে আসত। একদিন তেমনি এসে বলল, ‘দাদা ব্যাবসা শুরু করছি।’ ‘কীসের?’ ভাবলাম আর একটা কারখানা বোধহয় খুলতে যাচ্ছে। ‘ফিল্মের। ঝটপট পয়সা আসবে। বাবার মতো ঠুকুর-ঠুকুর ব্যাবসা করা আমার পোষাবে না। আমি নগদা-নগদি হাতে গরমে বিশ্বাসী।’

বললাম, ‘কিন্তু শিবু, ফিল্মের ব্যবসায় সব ঝুঁকি আছে। অনেকে শেষ হয়ে গেছে।’

‘না দাদা, আমি শেষ হওয়ার জন্যে জন্মায়নি।’

এরপর বছরখানেক তার দেখা পাইনি। শুনেছিলাম ধর্মতলা স্ট্রিটে শেয়ারে টেবিল ভাড়া করে বসেছে শিবু। যেসব ছবি প্রোডিউসারের টাকায় কোনও মতে শেষ হয়, ডিস্ট্রিবিউটার কোনও আকর্ষণ বোধ করে না, প্রিন্ট পাবলিসিটির অভাবে রিলিজ বন্ধ থাকে সেইসব ছবিকে উদ্ধার করার দায়িত্ব নিয়েছে সে। নিজের পয়সায় প্রিন্ট পাবলিসিটি করিয়ে হলে ছবি রিলিজ করে। এই হলের ডেট পেতে যে ধরাধরির খেলা চলে সেটা সে-ই খেলে। ছবির বিক্রি থেকে প্রথমে নিজের। টাকা তুলে নিয়ে পরে প্রযোজককে টাকা ফেরত দেয় কমিশন কেটে রেখে।

এক বছরে তিনটে ছবি রিলিজ করিয়েছে শিবু, কোনওটাই তিন সপ্তাহের বেশি চলেনি। তার মধ্যে একটা অবশ্য ইন্ডিয়ান প্যানোরমায় নির্বাচিত হয়েছে শ্ৰেষ্ঠ আঞ্চলিক ছবি হিসেবে। অবশ্য দর্শক দেখেনি। শিবুর জন্যে চিন্তা হচ্ছিল। বোধহয় পথে বসল ছেলেটা।

এই সময় শিবু ট্যাক্সিতে চলাফেরা করত। একদিন রাসবিহারীর মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখি শিবু ট্যাক্সি থেকে ডাকছে। সে যাচ্ছে শ্যামবাজারে, সুবিধেই হল। কিছু বলার আগে শিবু বলল, ‘এখন দাদা আমার নাম এ-লাইনে শিবু বুকার। ডিস্ট্রিবিউটার হওয়ার ক্ষমতা নেই তো। ডিস্ট্রিবিউটার হতে গেলে ছবির তৈরির সময় প্রোডিউসারকে টাকা দিতে হয়। হিট হলে লাল হয়ে যায় ডিস্ট্রিবিউটার। আমি মরা ছবি নিয়ে ব্যাবসা করছি, জ্যান্ত ছবি কে দেবে আমাকে?’

‘খুব লস হল তোমার।’

‘না দাদা, আপনার আশীর্বাদে এখনও বেঁচে আছি।’

‘সেকি! তোমার ছবিগুলো তো চলেনি।’

‘ঠিক কথা। প্রোডিউসার মরেছে কিন্তু আমি বেঁচে গেছি।’

শিবু আমাকে হিসেবটা বোঝাল। কলকাতার তিনটে হল আর দমদম গড়িয়ার দুটো হলে ছবি রিলিজ করিয়েছিল। ধরা যাক তিনটে হলের সাপ্তাহিক ভাড়ান-টাকা। তিন সাতে একুশটি শো হাউসফুল গেলে ট্যাক্স বাদ দিয়ে হল ভাড়া বাদ দিয়ে থাকবে আরও ন-টাকা। তা ওর ছবি হাউসফুল দূরের কথা প্রথম সপ্তাহে বারো টাকার ব্যাবসা করেছিল, দ্বিতীয় সপ্তাহে দশ টাকার, তৃতীয়তে সাড়ে আট টাকার। ডেফিসিট কেটে হলের মালিক টাকা দেওয়ামাত্র সে ছবি তুলে। নিয়েছে। কিন্তু বাড়তি যে টাকা পাওয়া গেল তা প্রিন্ট পাবলিসিটির খরচ হিসেবে সে কেটে রেখেছে। এর ফলে প্রোডিউসার এক পয়সাও পায়নি। সে বলল, ‘দাদা এই প্রোডিউসার কোনও মতে ছবি শেষ করেই জানত পয়সা পাবে না। তাই ওদের নিয়ে দু:খ নেই। আর্ট ফিল্ম বানালে পয়সা আসে? আর যে-দুটো কর্মাশিয়াল ফিল্ম তার গল্প যেমন ডাইরেকশন অ্যাক্টিংও তেমন। কলকাতার হল থেকে আমি কুড়িভাগ খরচ পাইনি কিন্তু জেলার হলগুলোতে আন্ডার রেটে ছবি পাঠাচ্ছি। যা পাচ্ছি তাই ঘরে তুলছি।’

‘প্রযোজক তার হিসেব রাখেন না?’

‘পাগল! বেলকোবা কোথায় জানেন?’

‘না।’

‘তবে? সেখানে এক সপ্তাহ ছবি চললে তার হিসেব আপনি পাবেন?

‘তোমার তো হিসেব দেওয়ার কথা।’

‘নিশ্চয়ই। দেব। দু-লাখ প্রিন্ট পাবলিসিটিতে গিয়েছে সেটা আগে তুলি, অফিস খরচ আছে, ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে যে সুদ পেতাম তা উঠুক তারপর যা আসবে তার ওপর কমিশন কেটে প্রোডিউসারকে ফেরত দেব।’

‘শেষপর্যন্ত প্রোডিউসার কত পাবে বলে তোমার মনে হয়?

‘বিশ-পঁচিশ হাজার পেলে চৌদ্দ পুরুষের পুণ্য।’

‘লোকটা তো মরে যাবে হে!’

‘দাদা যারা এদের টুপি পরিয়ে ফিল্ম প্রোডিউস করতে নামায় দোষটা তাদের। আর জেনেশুনে সেইটুপিটা যারা পরে তাদের জন্যে কোনও মায়া-মমতা নেই।’

আমি আর কিছু বলিনি। সত্যি কথা, যার ব্যাবসা সে ভালো বুজবে। শিবু যদি আগে নিজের টাকা তুলে নিতে চায় তাহলে তাকে দোষ দিতে পারি না।

শিবুর সঙ্গে আমার দেখা মাস ছয়েক বাদে। এক প্যাকেট সন্দেশ নিয়ে এল সে। হেসে বলল, ‘দাদা, একটা বড় ছবি পেতে যাচ্ছি।’’

‘কীভাবে?’

‘এক বোম্বাইয়ের প্রোডিউসার বাংলা ছবিতে টাকা ঢালতে চায়। আমাকে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছে। বাজেট বেশি নয় কিন্তু খারাপও বলব না। ডিস্ট্রিবিউটার চায় না। বলেছে, শিবু বুকার তুম হামারা বিজনেস দেখভাল করো।’

‘এতো খুব ভালো কথা।’

‘কিন্তু আপনাকে একটা উপকার করতে হবে।’

‘বলো।’

‘আপনার সঙ্গে সঞ্জিতদার আলাপ আছে। বলে-টলে ডেট পাইয়ে দিন না। এখন তো ওঁকে ছাড়া ছবি চলে না।’

সঞ্জিত বাংলা ছবির একজন সফল নায়ক। প্রথম দিকে খুব পাত্তা পায়নি এখন অবস্থা বদলেছে। খুব ভদ্র ছেলে। আমার সঙ্গে যথেষ্ট সখ্যতা আছে। কিন্তু তবু আমি ইতস্তত করছিলাম। শিবু ঘোষ সেটা বুঝেই বলে ফেলল, ‘আমাকে ওই বাজেটের মধ্যে ছবিটা করিয়ে নিতে হবে। না পারলে ছবি হাতছাড়া হয়ে যাবে। আমি গেলে সঞ্জিতবাবু হেভি টাকা চাইবে, ডেটও দেবে না। বাঙালি যুবক ব্যবসায় নেমেছি, আপনি আমাকে বাঁচাবেন দাদা?’

অগত্যা সঞ্জিতকে ফোন করলাম। শুনলাম সে ইন্দ্রপুরি স্টুডিওতে শুটিং করছে। শিবুকে বললাম সে কথা। সে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি যদি আমার সঙ্গে একবার ওখানে যান তাহলে কি ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়ে?’

বললাম, ‘শিবু, আমার যাওয়া ঠিক হবে না।’ কিন্তু এমনই কপাল সঞ্জিতকে টেলিফোনে ধরাই যাচ্ছিল না। এদিকে বাড়িতে রোজ মিষ্টির প্যাকেট আসছে। নিষেধ রাগারাগিতেও কোনও কাজ হচ্ছেনা। শেষপর্যন্ত প্রায় বাধ্য হয়েই শিবুর সঙ্গে স্টুডিওতে গেলাম। এর আগেও লক্ষ্য করেছি

স্টুডিও-র ফ্লোরে যখন নানান ছবির শুটিং হয় তখন একটা চাপা রাখো-ঢাকো ভাব থাকে পরস্পরের সঙ্গে। ফ্লোরে ঢোকার সময় কাকে চাই, কেন চাই ইত্যাদি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। শিবু সেসব সামলে ভেতরে নিয়ে গেল। তখন শট নেওয়া হবে। পরিচালক সাইলেন্স বলে ধমকে উঠলেন। আলো জ্বলছে। সঞ্জিত গম্ভীর মুখে এগিয়ে গেল নায়িকার দিকে। নায়িকা মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সঞ্জিত দুই আঙুলে চিবুক তুলে বলল, ‘তুমি কেন আমাকে বারবার ভুল বোঝো? পৃথিবী রসাতলে গেলেও এই আমি তোমার।’ সঙ্গে-সঙ্গে নায়িকা ঠোঁট ফুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘সত্যি?’ পরিচালক চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কাট। লাইটস অফ।’

যেন রাজ্য জয় করা হয়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে শু্যটিং জোন থেকে বেরিয়ে আসছিল সঞ্জিত, পেছনে ব্যস্ত পরিচালক। সঞ্জিত বলছিল, ‘না, না, আপনার সঙ্গে কথা ছিল হাফ শিফট কাজ করব। ওদিকে এক নম্বরে ‘প্রাণ চায়’ ছবির সবাই আমার জন্যে বসে আছে। আর আমাকে বলবেন না।’

অনুরোধ উপরোধ উপেক্ষা করে সঞ্জিত বেরিয়ে আসছিল সদর্পে। এই সময় সে আমাকে দেখতে পেল, ‘আরে আপনি?

‘তোমার খোঁজে আসতে হল।’

‘আসুন-আসুন।’ সে আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেল তার মেকআপ রুমে। সেখানে বসে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি এখন কেমন ব্যস্ত?

‘খুব। দিনে তিন শিফট করে কাজ করছি।’

‘ও।’

‘কি ব্যাপার বলুন তো?

‘আমার ভাই-এর মতো এই ছেলেটি। ছবি করছে। তুমি যদি ওকে একটু সাহায্য করো তাহলে ওর উপকার হয়।’

সঞ্জিত শিবু ঘোষকে দেখল। তারপর মাথা নাড়ল, ‘আপনি ভাই সকাল সাড়ে সাতটায় আমার বাড়িতে আসুন। দাদার গল্প?

শিবু কিছু বলার আগেই আমি মাথা নাড়লাম, ‘নাহে। এখন চলি, তুমি তো আবার একটা কাজে বেরুবে।’

শিবু খুব বিগলিত। এর তিনদিন বাদে সঞ্জিত নিজেই আমাকে টেলিফোনে জানাল সে তারিখ দিয়েছে।

ছেলেটির কথাবার্তা তার ভালো লেগেছে। আমার কথা মনে রেখে সে এখন যা নেয় তার অর্ধেকে কাজ করে দেবে। শিবুকে আমি আর দেখতে পাইনি অনেকদিন। হঠাৎ কাগজে বিজ্ঞাপন। দেখলাম অমুক রাম আগরওয়াল প্রযোজিত অমুক ছবি মুক্তি পাচ্ছে, বুকিং শিবু ঘোষ। রিলিজের আগের দিন শিবু এল বাড়িতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে, ‘দাদা, আশীর্বাদ করুন যেন পার হয়ে যাই।’

‘ছবি কেমন হল।’

‘আপনার ভালো লাগবে না তবে পাবলিক খাবে। কিশোরের চারখানা গান আছে, ফাইট আছে, মায়ের কান্না আর প্রেমিকার আত্মত্যাগ–সবই আছে। দেখা যাক। আপনি আসুন প্রেস শোয়ে।’ যেতে পারিনি কাজ থাকায়। তবে তার পরের সোমবার হলের সামনে হাউসফুল বোর্ড ঝুলতে দেখলাম, ম্যাটিনি ইভনিং নাইট। পরের সপ্তাহে কাগজে সমালোচনা বের হল খুব বাজে ছবি। বলে। কিন্তু আমার বাড়ির কাজের মেয়েটি এরমধ্যে দুবার দেখে এসেছে ছবিটা। শিবু একদিন অ্যাম্বাসডার চড়ে আমার কাছে এল। এলে বলল, ‘দাদা, মনে হয় উতরে গেছি। প্রথম দিন অ্যাডভান্স খুলে দেখি মাছি তাড়াচ্ছে। ভয়ে বুক হিম হয়ে গেল। পাঁচটার বদলে ন’টা প্রিন্ট করিয়ে নিয়েছে প্রোডিউসার, পাবলিসিটির খরচ বেড়েছে। শেষে নিজেই তিনটে হলের ম্যাটিনি ইভনিং টিকিট অ্যাডভান্স কেটে নিয়ে হাউসফুল বোর্ড ঝুলিয়ে দিলাম।’

‘সেকি! নিজের পয়সায় টিকিট কিনলে, হল ফাঁকা গেল?’

‘না না। সব টিকিট আত্মীয়স্বজন সেলসট্যাক্স ইনকামট্যাক্সের লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দিলাম। কিন্তু পাবলিক শো-এর আগে গিয়ে টিকিট না পেয়ে পরের দিনেরটা অ্যাডভ্যান্স কেটে ফিরে গেল। এখন দাদা ছবি লেগে গিয়েছে।’

‘তোমার কেমন থাকবে?

‘এই ভাবে যদি চলে তাহলে কলকাতা থেকেই প্রিন্ট পাবলিসিটি উঠে যাবে। লাখ পঞ্চাশেক বিজনেস যদি করে তাহলে আমি পাব সাড়ে সাত লক্ষ।’

‘প্রোডিউসার তাহলে টাকা ফেরত পাবে?

‘পাবে মানে? হেভি প্রফিট করবে।’

‘সব টাকা দেবে ওকে?’

‘না দিয়ে উপায় নেই। ওর লোক রোজ বসে থাকে আমার অফিসে।’ ভাবলাম একটা বাঙালি ছেলে নিজের জোরে পায়ের তলায় মাটি পেল। এ-লাইনের সব নিয়মকানুন শিখে ফেলেছে সে। কিন্তু বিস্ময় আরও অবশিষ্ট ছিল আমার জন্যে।

মাস ছয়েক বাদে শিবু এল অ্যাম্বাসাডার চেপেই মিষ্টির বাক্স হাতে নিয়ে। বললাম, ‘তুমি মিষ্টি আনো কেন বলত? ওটা আমি একদম খাই না।’

‘কাউকে দিয়ে দেবেন। কিন্তু আপনার বাড়িতে এটা হাতে নিয়ে এলে আমার খুব ভালো হয়। লাকি ব্যাপার বলতে পারেন?

‘তাহলে ফিল্ম করে এখন তুমি বড়লোক।’

‘না-না। এতো সামান্য। দাদা, এবার ভাবছি নিজেই ছবি করব।’

‘মানে?’

‘প্রোডাকশন-ডিস্ট্রিবিউশন আমার। অজিত গুহকে সাইন করিয়েছি।’

‘সে আবার কে?’

‘ওঃ, আপনি কোনও খবর রাখেন না। টপ হিট ডিরেক্টার। আমার খুব ইচ্ছে আপনার গল্প নিয়ে ছবি করার। তবে এখনই না। দুটো ছবির পর।’

হেসে বললাম, ‘কেন?’

‘না, দুটো হিট হওয়া পর একটা ফ্লপ করানো উচিত।’

‘আমার গল্প নিয়ে ফ্লপ হবে ভাবছ কেন?’

‘দাদা রাগ করবেন না। আপনি সাহিত্য লেখেন। ফিল্মের জন্যে তো গল্প লেখেন না। এটা আলাদা ওটা আলাদা।’

‘তোমার এই গল্পের লেখক কে?’

লজ্জায় মুখ নামাল শিবু, ‘আজ্ঞে, আমিই।’

‘তুমি গল্প লেখো নাকি?’

‘না দাদা কক্ষনো না। সেইজন্যেই আপনার কাছে এসেছি। ধরুন একটা সুখের পরিবার। তিন দাদা, দুই বউদি, মা, বোন আর অবিবাহিত ভাই। বউতে-বউতেও খুব ভাব। হঠাৎ বড় ভাই। লটারির প্রাইজ পেল। পাঁচ লাখ। মানুষটা ভালো। সংসারের জন্যে টাকাটা খরচ করতে চায়। কিন্তু স্ত্রী রাজি নয়। এই নিয়ে দুই বউতে মন কষাকষি। ছোট ভাইকে সবাই যে-যার দলে টানতে চাইছে। মা নির্দল। ছোট বোন প্রেম করছে একটা লাফাঙ্গার সঙ্গে। ছোট ভাই গান গায়। তার। সঙ্গে একটা বড়লোকের মেয়ে প্রেম করতে চাইছে। মানে একেবারে পারিবারিক সোস্যাল ড্রামা। ঘরে-ঘরে যা হয়। তার সঙ্গে আছে ভাই-এর সঙ্গে বোনের লাফাঙ্গা প্রেমিকের ফাইট। সেই। বদমাশ মেয়েটাকে আরবে পাচার করছে চেয়েছিল। আউটরাম ঘাটের জেটিতে শুটিং করব ফাইটিংন্টার। বোনকে জাহাজ থেকে উদ্ধার করবে হিরো। তার প্রেমিকা ভুল বুঝে সিমলায় চলে যাবে বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে। সেখানে বরফের ওপর আর একটা ফাইটিং। এবার প্রেমিকার ভাবী স্বামীর সঙ্গে। এদিকে দুই ভাই পরস্পরকে সহ্য করতে না পেরে আলাদা হয়ে গেল। মা নামল পথে। প্রচণ্ড জ্বর। শুধু ছোট ছেলের নাম করছে আর চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে। কী জল কী জল। হিরো একাই কলকাতায় ফিরে মাকে না পেয়ে আকাশবাণীতে গিয়ে গান গাইতে লাগল। সেই গান রাস্তার রকে শুয়ে জ্বরগ্রস্ত মা শুনল, কুটিল মেজদা মেজোবউদি শুনল, মহান বড়দা আর বড়বউদিও। এমনকী নায়িকাও। সিমলায় কলকাতা রেডিও ধরা যায় না। ভাবছি রেডিও না করে দিল্লি টি.ভি . করে দেব। দিল্লির প্রোগ্রাম সারা দেশে একসঙ্গে শোনা যায়। এবার শেষটা একটু করে দিন দাদা।’

হেসে বললাম, ‘বেশ তো লিখছ। বাকিটাও লিখে ফেল না।’

‘একটু গোলমাল হচ্ছে। মেজদাকে করেছি অসৎ পুলিস অফিসার। ঘুষ নেয়, হৃদয় নেই। শেষে তাকে সততার পথে ফেরাব। নায়ক শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদ করে যাবে। একদম শেষে মাকে। বুকে জড়িয়ে ধরবে।

দয়ালু বড়দা তখন সবাইকে নিয়ে ওদের কাছে আসবে। মা বলবে, ‘আমি আদেশ করছি তুই রমাকে বিয়ে কর।’

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রমা কে?’

‘ওঃ, রমা হল সেই বড়লোকের মেয়ে। যার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।’

‘ও। তারপর।’

‘শেষ দৃশ্য। রমা এগিয়ে আসছে। হিরো এগোচ্ছে। একটা স্বপ্নের দৃশ্য। ধোঁয়া-ধোঁয়া চারধার। আ যা রে টাইপের গান।’

‘এ ছবি দর্শকের ভালো লাগবে।’

‘একশোবার। শরৎচন্দ্র থেকে সবাই নিয়েছে। একসময় খোকন দাস ওই লাইনেই হিট করে গিয়েছিল। এখন বিজন চৌধুরীর অবস্থা জানেন? লাখ টাকার গল্প বেচে। এই একই ফর্মুলা। ভাবছি ওকে দিয়ে সংলাপ লেখাব। চোখাচোখা সংলাপ।’

শিবু ঘোষ তারপর দীর্ঘদিন আসেনি। এবার এল মারুতি চেপে। হেসে বলল, ‘ছবি শেষ। পরশু সেন্সর হবে। সামনের সপ্তাহে রিলিজ। কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে।’

‘কি ব্যাপার?’

‘যখন সব ভাগাভাগি হয়ে গেল তখন মায়ের মুখে একটা সংলাপ থাকা দরকার। খুব ইমোশনাল। ওটা নেই ছবিতে। মনে হচ্ছে না থাকলে পাবলিক পাম্প খাবে না।’

‘কি আর করবে। সব যখন শেষ।’

‘না দাদা, আজ দুপুরে রেকডিং করে লাগিয়ে দেব।’

‘লাগিয়ে দেবে মানে? কোনও চরিত্রের মুখে নতুন সংলাপ বলাতে হলে তোমাকে রিশু্যট করতে হবে। সেটার একটা প্রসেস আছে, এডিটিং আছে। সময় লাগবে না।’

‘লাগবে। তাই শু্যটিং করব না। একটা দৃশ্য আছে যেখানে মা ব্যাক টু দ্য ক্যামেরা, একবার সাইড ফেস আছে। মায়ের ডায়লগটা সেইসময় ছুঁড়ে দেব। পাবলিক ভাববে মা পেছন ফিরে বলছে। অজিত, মানে ডাইরেক্টার আজ কলকাতায় নেই তাই আমিই করে নিচ্ছি ব্যাপারটা। ডায়ালগটা শুনবেন? আজ লিখলাম।’

‘কেন? বিজন চৌধুরী লেখেনি?’

‘আহা পুরো ছবির সংলাপ লিখে পঞ্চাশ হাজার নিয়ে নিয়েছে আগেই। এখন যদি এক্সট্রা ডায়লগ লেখাতে যাই আবার টাকা চাইবে। আরে আমি প্রমাণ করব যে আমিও কিছু কমতি নই। অবশ্য লোকে মনে করবে ওর ডায়ালগ, নাম হবে ওর।’

‘সংলাপটা কি?’

‘হ্যাঁ, ভাই-এ ভাই-এ ভাগাভাগি হচ্ছে। দারুণ টেনসন। এমনসময় মা বলবে কাঁদো-কাঁদো গলায়, ‘ওরে, তোরা টাকাপয়সা, জমি-জমা বাড়ি-ঘর সব টুকরো-টুকরো করে নিতে পারিস কিন্তু আমি তোদের আমার বুকের ভালোবাসা কি করে ভাগ করে দে! তোরা যে আমার পাঁজর। ব্যাস দাদা, হাততালিতে হল ফেটে যাবে। এক্সট্রা রুমাল সাপ্লাই করতে হবে।’

‘ছবি শেষ হয়ে যাওয়ার পর নতুন করে শব্দ ঢোকানো যাবে?

‘যাবে দাদা। রিলিজ করেও ছবিতে যোগ-বিয়োগ করা হয়।’

কৌতূহল হল। শিবু ঘোষের প্রেস শো-তে ছবি দেখতে গেলাম। ভিড়ে চারপাশ ফেটে পড়ছে। ম্যাটিনি শো-এর রিপোর্ট পেয়েছে দর্শকরা। পাঁচগুণ দামে টিকিট ব্ল্যাক হচ্ছে। শিবু এগিয়ে এসে হাত ধরল, ‘খুব খুশি হলাম দাদা। আসুন আলাপ করিয়ে দিই।’

সঞ্জিতদা ভালো বড় ভাই করছেন, ওঁর সঙ্গে তো আপনার আলাপ আছেই। মেজো ভাই করছেন পেলব চ্যাটার্জি, ছোট ভাই হিরো অভিজিত, নায়িকা দেবশ্রী, আর ওদের মা উষারাণী, বাংলা ছবির সুপারহিট মা। আর উনি হলেন কালী ব্যানার্জি। আসলে এই টিম একসঙ্গে থাকলে ছবি ফ্লপ করে না।’

দেখলামও তাই। হাততালিতে হল ফাটছে। সেইসঙ্গে ফোঁসফোঁসানি। মেয়েরা নাকের জল টানছেন।

বোম্বাইয়ের কাউকে দিয়ে হিরোর গলায় গান বাজল, ‘আমার বুকের পাঁজরে আঁকা তোমার ছবি, ওগো মা, তুমি আমার সবি।’ শুনতে-শুনতে আমারই মন কেমন হয়ে যাচ্ছিল। তারপর এল সেই সংলাপ। মা মুখ ফিরিয়ে বলছে, তোদের আমার বুকের ভালোবাসা কি করে ভাগ করে দেব? এত হাততালি এর আগে কখনও শুনিনি।

গত পাঁচ বছরে মুক্তি পাওয়া ছবির তালিকায় সুপারহিট ছবি ‘স্নেহের শেকল’। তিন মাসেও হাউসফুল বোড নামছে না। বিজ্ঞাপনে দেখছি একসঙ্গে পঁচিশটি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি চলছে। রজত, স্বর্ণ শেষে হীরক জয়ন্তী পার করে শিবু এল আমার কাছে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে।

বললাম, ‘ওটা আবার কেন?’

‘না দাদা, এটা আমার লাকি ব্যাপার। আপনার আশীর্বাদে দেড় কোটি টাকার বিজনেস করবই। আপনি যদি সঞ্জিতদাকে ঠিক করে না দিতেন তাহলে আজ এখানে দাঁড়াতে পারতাম না।’

‘পরের ছবি কি?’

‘গল্প ভাবছি দাদা।’

‘ডাইরেকশন?’

শিবু হাসল,’ওটা আমিই করব।’

‘তুমি?’ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল।

‘দেখলাম তো। কিস্যু না। ভালো গল্প, ভালো স্ক্রিপ্ট, ভালো সংলাপ, ভালো অভিনেতা অভিনেত্রী, ভালো ক্যামেরাম্যান এডিটার আর ভালো অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টার সঙ্গে থাকলে ছবি ডাইরেক্ট করা কিছু না। মিছিমিছি ঘরের টাকা অন্য লোককে দেবো কেন?’

‘তাহলে মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়–।’

মাথায় হাত ঠেকাল শিবু, ‘সেটাও ভেবেছি। ওরা মহান, ঠাকুরঘরের মানুষ। এর পরে যে ফ্লপ ছবি করব সেটা আপনার গল্প। আগেই বলেছি। দেখবেন ঠিক প্যানোরমায় যাবে, আপনার দৌলতে। ডিরেক্টার-প্রোডিউসার হয়ে আমি বার্লিন ফেস্টিভ্যাল ঘুরে আসব। তার আগে বার্লিন নয়, বালির জন্যে একটা ছবি করে ফেলি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress