জঙ্গলগড়ের চাবি : 06
সন্তু এখন ঠিক কী করবে, তা প্রথমে কিছুতেই ঠিক করতে পারল না।
এখন সে কি প্রকাশ সরকারকে ভাল করে খুঁজে দেখতে যাবে? কিন্তু তা হলে কাকাবাবুর কাছে কে থাকবে?কাকাবাবুকে একা ফেলে রাখা যায় না।
প্রকাশ সরকার এত সকালে কোথায় গেল? সন্তুকে কিছু না বলে সে সার্কিট হাউসের বাইরে চলে যাবে, এটা ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। নিশ্চয়ই ওর কোনও বিপদ হয়েছে।
দরজার সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্তু একটুক্ষণ ভাবতে লাগল।
এই জায়গাটায় কারুকেই সে চেনে না। এখানে থাকবার ব্যবস্থা করেছে। প্রকাশ সরকার। সে যদি আর না ফেরে, তা হলে তো সন্তু মহা মুশকিলে পড়ে যাবে। কাকাবাবুর চিকিৎসার জন্য এক্ষুনি একজন ডাক্তার ডাকা দরকার।
কপালে হাত দিয়ে সন্তু নিজের ভুরু দুটো সোজা করল। ভুরু কুঁচকে থাকলে চলবে না। কেউ যেন বুঝতে না পারে সে ঘাবড়ে গেছে। হয়তো শত্রুপক্ষের লোক নজর রাখছে তার দিকে।
কিন্তু কারা শত্রুপক্ষ?
প্ৰকাশ সরকার যদি সত্যিই আর না ফেরে, তা হলে এখানে সন্তু কতদিন থাকবে কাকাবাবুকে নিয়ে? ফিরবেই বা কী করে?
সন্তু একবার ভাবল, বাড়িতে বাবার কাছে একটা টেলিগ্রাম পাঠাবে।
তারপরই ভাবল, এর আগে যতবার সে কাকাবাবুর সঙ্গে অভিযানে বেরিয়েছে, কোনওবারই সে বাড়িতে কোনও বিপদের কথা জানায়নি। মা-বাবা বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। কিন্তু এবারে তা ছাড়া আর উপায়ই বা কী?
এই সময় ঘরের ভেতর থেকে কাকাবাবু গম্ভীর গলায় ডাকলেন, ব্ৰজেশ্বর! সাহেব সিং!
সন্তু ভেতরে এসে বলল, কী কাকাবাবু? কাকে ডাকছ?
কাকাবাবু গভীর মর্মভেদী দৃষ্টিতে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সন্তুর দিকে।
তারপর বললেন, চেনা চেনা লাগছে! তোমার নাম কী খোকা? তুমি কাদের বাড়ির ছেলে?
সন্তু বলল, আমি তোমাদের বাড়ির ছেলে।
সত্যি করে বলে তো, অশ্বখামা হত, ইতি গজ মানে কী? অশ্বখামা নামে সত্যিই কি কোনও হাতি ছিল? কই, আগে তো কোনওদিন ঐ নাম শুনিনি!
সন্তু এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে তা বুঝতে পারল না। তার বুকের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে। কাকাবাবু তাকে চিনতে পারছেন না!
প্রচণ্ড ধমক দিয়ে কাকাবাবু বললেন, চুপ করে আছ কেন? ঠিক করে বলো, কাচ্চু মিঞা কোথায়?
কাচ্চু মিঞা কে?
কাচ্চু মিঞা হল রাবণের ছোট ভাই। রাবণ ছিল লঙ্কার রাজা, আর কাচ্চু মিঞা গোলমরিচের ব্যবসা করে।
আমি কোনওদিন কাচ্চু মিঞার নাম শুনিনি।
কাচ্চু মিঞা জঙ্গলগড় থেকে পালিয়েছে। সে এখন লুকিয়ে আছে কোনও জায়গায়।
জঙ্গলগড়? জঙ্গলগড় কোথায়?
কাকাবাবু শুকনো গলায় হেসে উঠলেন। হাঃ হাঃ হাঃ করে। তারপর বললেন, অত সহজে কি জানা যায়? তুমি কোন দলের স্পাই?
কাকাবাবু, আমায় চিনতে পারছি না? আমি সন্তু!
আমি সবাইকেই চিনি। আমি কুম্ভকৰ্ণকেও চিনি, আবার বেলগাছতলায় যে বসে থাকে, তাকেও চিনি।
দরজার কাছে একটা ছায়া পড়তেই সন্তু চোখ তুলে তাকাল।
খাঁকি প্যাণ্ট-শার্ট পরা একজন লোক।
লোকটি বলল, প্ৰকাশ সরকার কে আছে?
সন্তু বলল, আমাদের সঙ্গে এসেছেন। এখন এখানে নেই। কেন?
লোকটি বলল, এখানে নেই? ঠিক আছে!
সন্তু বলল, কেন? কে প্রকাশ সরকারকে খুঁজছে?
টেলিফোন আছে।
সন্তু যেন হাতে স্বৰ্গ পেল। টেলিফোনে প্ৰকাশ সরকারকে এখানে কে ডাকবে? নিশ্চয়ই মিলিটারির লোক। কিংবা কলকাতার, সেই মিঃ ভার্মা।
সন্তু বলল, আমি টেলিফোন ধরছি। আপনি যান। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
সন্তু দেখল কাকাবাবু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার দিকে।
কাকাবাবুকে এক মুহূর্তের জন্যও একা ফেলে রেখে যেতে চায় না। সন্তু। কিন্তু টেলিফোনটাও ধরা দরকার।
টেবিলের ওপর তালা-চাবি পড়েছিল, সন্তু সেটা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দরজা টেনে তালা লাগিয়ে দিল। তারপর চাবিটা পকেটে ভরে সে দৌড় লাগাল অফিস-ঘরের দিকে।
ফোন তুলে সন্তু শুধু হ্যালো বলতেই একটি ভারী কণ্ঠস্বর জিজ্ঞেস করল, প্ৰকাশ সরকার? ইয়োর কোড নাম্বার প্লিজ।
সন্তু বলল, প্ৰকাশ সরকার। এখানে নেই, কোথায় যেন গেছে। আমি—
কট্ করে লাইনটা কেটে গেল।
সন্তু পাগলের মতন হ্যালো হ্যালো বলে চিৎকার করলেও আর কোনও শব্দ শোনা গেল না।
সন্তু দারুণ দমে গেল। আসল দরকারি কথাটাই বলা হল না। প্ৰকাশ সরকারকে যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা জানানো খুব দরকার ছিল। ওরা তাহলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা করত।
হতাশভাবে সন্তু ফিরে এল আবার। চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলল।
কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে মনে হল, উনি দারুণ রেগে গেছেন। কাকাবাবুকে ঘরে তালা বন্ধ করে যাওয়াটা উনি নিশ্চয়ই পছন্দ করেননি। কিন্তু এ ছাড়া উপায় কী?
সকাল থেকে কাকাবাবুর চা-ও খাওয়া হয়নি। সন্তুরও খিদে পেয়েছে।
সে বেয়ারাকে ডাকবার জন্য বেল বাজাল। বেয়ারা খাবার তো দিয়ে যাবে, কিন্তু তারপর পয়সা দেবে কে? কাকাবাবুর কাছে কি টাকাকড়ি আছে? সে না-হয় দেখা যাবে এখন।
বেয়ারা আসতে সন্তু তাকে দুটো ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিল। আর বলে দিল, চা যেন খুব ভাল হয়। বাজে চা হলে ফেরত দেওয়া হবে।
কাকাবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, কে ফোন করেছিল?
সন্তু বলল, জানি না! প্ৰকাশ সরকার নেই শুনেই লাইন কেটে দিল।
আমার কোনও কথা শুনলাইনা। কোড় নাম্বার জিজ্ঞেস করছিল।
কাকাবাবু বললেন, কালো কোট না সাদা কোট?
কোট না, কাকাবাবু, কোড নাম্বার।
নাম্বার, প্লাম্বার, স্লাম্বার, কিউকাম্বার…
সন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাকাবাবুর কাছ থেকে সাহায্য পাবার কোনও আশাই নেই। প্ৰকাশ ডাক্তার যে এই সময় কোথায় গেল!
চুপ করে বসে রইল সন্তু। কাকাবাবু আপন মনে অনেক কথা বলে যেতে লাগলেন। সে-সব কোনও কথারই কোনও মানে নেই।
সন্তু ঠিক করে ফেলল, আজ বিকেলের মধ্যে যদি কোনও সাহায্য না আসে, তাহলে বাড়িতে টেলিগ্রাম পাঠাতেই হবে।
বেয়ারা খাবার নিয়ে এল, সঙ্গে এল একজন বেশ সুন্দরী মহিলা। এই পঁচিশ-ছাবিবশ বছর বয়েস।
মহিলাটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, সন্তু? ওমা, তুমি কত বড় হয়ে গেছ?
মহিলাকে সন্তু চেনেই না। জীবনে কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না।
মহিলাটি ঘরের মধ্যে ঢুকে বলল, কাকাবাবু কোথায়? ও এই তো কাকাবাবু!
ঝুঁকে পড়ে মহিলাটি কাকাবাবুর পায়ের ধুলো নিল। তারপর বলল, আপনার শরীর এখন ভাল আছে নিশ্চয়ই?
কাকাবাবু তীক্ষ্ণ চোখে দেখছেন মহিলাটিকে।
সে এবার সন্তুর দিকে ফিরে বলল, আমায় তুমি চিনতে পারোনি মনে হচ্ছে। আমার নাম ডলি। আমি তোমার মাসতুতো বোন হই। তুমি তোমার বেলি মাসিকে চেনো তো? আমি তোমার সেই বেলি মাসির মেয়ে।
সন্তু ডলি কিংবা বেলি মাসির নাম তো কোনওদিন শোনেই নি, এমন কী, আগরতলায় তার যে কোনও মাসি থাকে তাও সে জানে না!
ডলি বলল, আমরা আগে শিলচর থাকতুম। এই তো গত মাসেই বাবা এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, আপনি জানলেন কী করে যে আমরা-মানে কাকাবাবু এখানে এসেছেন?
ডলি বলল, বাঃ! জানাটা এমন কী শক্ত! আমার ভাই এয়ারপোর্টে কাজ করে। কাল রাত্তিরবেলা বাড়ি ফিরে এসে সে বলল, কাকাবাবু আর সন্তুকে দেখলুম। এয়ার ফোর্সের একটা প্লেন থেকে নামতে। কাকাবাবুর মতন লোক এখানে এলে সার্কিট হাউসেই উঠবেন, সেটা খুব স্বাভাবিক। তারপর বলো, তোমাদের বাড়ির সবাই কেমন আছেন? আর তোমার কুকুরটা?
সন্তু ক্রমশই অবাক হচ্ছে। আর এই মাসতুতো দিদি তার কুকুরটার পর্যন্ত খবর রাখে, অথচ সে নিজে ওঁদের সম্পর্কে কিছুই জানে না? মা তো কোনওদিন এই বেলি মাসির কথা বলেননি।
ডলি বলল, কাকাবাবু, আপনারা আগরতলায় এসে সার্কিট হাউসে থাকবেন, এর কোনও মানে হয় না। আমাদের বাড়িতে যেতেই হবে। আমাদের মস্ত বড় কোয়াটরি-মা বললেন, যা ডলি, যেমন করে পারিস কাকাবাবু আর সন্তুকে নিয়ে আয়।
সন্তু বলল, কাকাবাবু এখন নিজে নিজে হাঁটতে পারেন না।
ডলি বলল, জানি, সে খবরও পেয়েছি। তুমি আর আমি ধরে-ধরে নিয়ে যাব। আমি একটা গাড়ি এনেছি সঙ্গে।
সন্তু বলল, আমাদের এখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়া বারণ। এখানেই থাকতে হবে।
ডলি বলল, বারণ? কে বারণ করেছে?
সন্তু বলল, না, মানে, আমাদের সঙ্গে আর একজন ছিলেন, তিনি এখন নেই। সেইজন্যই এখন অন্য কোথাও যাওয়া মুশকিল।
ডলি বলল, তাতে কী হয়েছে? এখানে আমাদের ঠিকানা রেখে যাব। তিনিও পরে যাবেন। নাও, খাবার ঠাণ্ডা করছি কেন, আগে খেয়ে নাও! কাকাবাবুকে খাইয়ে দিতে হবে তো? আমি দিচ্ছি।
সন্তু দেখতে চাইল, ডলি নামের এই মেয়েটি খাইয়ে দেওয়ায় কাকাবাবু কোনও আপত্তি করবেন কি না।
কিন্তু কাকাবাবু একটুও আপত্তি করলেন না। লক্ষ্মীছেলের মতন সব খেয়ে নিতে লাগলেন।
খেতে-খেতে একবার মুখ তুলে ছেলেমানুষের মতন গলা করে বলে উঠলেন, মাসির বাড়ি দারুণ মজা কিল-চিড় নাই!