Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay » Page 11

জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay

প্রায় আধঘণ্টা বাদে নিরাশ হয়ে বেরিয়ে এলেন নরেন্দ্র ভার্মা। মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, নাঃ, কিচ্ছু হল না! মাথা একদম গড়বড় হয়ে গেছে।

আমার কোনও কথাই বুঝতে পারছেন না।

সন্তু উদগ্রীবভাবে দাঁড়িয়ে ছিল দরজার বাইরে। সে বলল, তা হলে এখন কী হবে?

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কোনও ডক্টর কি তোমার আংকেলকে দেখেছিলেন, সনটু?

সন্তু বলল, না, মানে, আমাদের সঙ্গেই তো একজন ডাক্তার এসেছিলেন কলকাতা থেকে। ডাক্তার প্রকাশ সরকার। কিন্তু তাঁকে আজ সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

নরেন্দ্র ভার্মা ভুরু কুঁচকে বললেন, প্রকাশ সরকার তাকে পাওয়া যাচ্ছে? কেন?

ভোর থেকেই তাঁকে আর দেখতে পাইনি।

এসব কী কারবার চলছে এখানে? তবে তো আর এখানে থাকাই চলে না।

আমার মনে হচ্ছে এবার কলকাতা ফিরে যাওয়াই ভাল। ওখানে আমাদের চেনা ভাল ডাক্তার আছে।

তা ঠিকই বলেছ। লেকিন তোমার আংকেল ফিরে যাবেন কি এখানে। থাকা পছন্দ করবেন, সেটা তো জানা যাচ্ছে না। উনি তো কোনও কথাই ঠিক ঠিক বুঝছেন না।

সেকথা আমিও ভেবেছি, নরেনকাকা। কাকাবাবু কোনও ব্যাপারেই শেষ না দেখে কখনও ফিরে যেতে চান না। কিন্তু এখানে আর তো উপায় নেই। এবার আমাদের ডিফিট, মানে হার স্বীকার করতেই হবে।

ডিফিট? কিন্তু লড়াইটা কার সঙ্গে সনটুবাবু? সেটাই তো এখনও বোঝ। গেল না। ঠিক আছে, এবার কলকাতাতেই চলে যাওয়া যাক। আজ রাত সাবধানে থাকো। কাল মর্নিং ফ্লাইটে কলকাতা ব্যাক করব। আমি এখন সার্কিট হাউসে ওয়াপস্ যাচ্ছি।

ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, আমি তবে এখন যাচ্ছি।

কাকাবাবু হুংকার দিয়ে দিয়ে বললেন, গেট আউট! যত সব রাসূলে এসে গোলমাল করছে এখানে।

নরেন্দ্র ভার্মার মুখখানা কালো হয়ে গেল। সন্তুরই খুব লজ্জা করতে লাগল কাকাবাবুর ব্যবহারে।

একটু পরেই নরেন্দ্র ভামা আবার হাসলেন। জিভ দিয়ে চুকচুক শব্দ করে বললেন, ইশ, এমন গুণী মানুষটা একেবারে বে-খেয়াল হয়ে গেছে! ভাল করে ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। আমি চলি সনটুবাবু!

নরেন্দ্র ভার্মা চলে যাবার পর কাকাবাবু আবার চিৎকার করে বললেন, কফি! কেউ আমায় এক কাপ কফি খাওয়াতে পারে না?

সন্তু দৌড়ে নীচে চলে গেল কফির অর্ডার দিতে।

কফি আনবার আগেই নার্সটি গরম জলে তোয়ালে ভিজিয়ে কাকাবাবুর মুখ টুখ মুছিয়ে দিয়েছেন আর জামাও পাল্টে দিয়েছেন।

কাকাবাবু কফি খাওয়ার সময় কোনও কথা বললেন না। শুধু মাঝে-মাঝে চোখ তুলে দেখতে লাগলেন সন্তুকে। সন্তুর খুব আশা হল কাকাবাবু তাকে কিছু বলবেন।

কিন্তু কফি খাওয়া শেষ করার পর কাকাবাবু নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি চামেলির দিদি?

নার্স অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চামেলি? চামেলি কে? আমি তো তাকে চিনি না।

কাকাবাবু তবু জোর দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, তুমি চামেলির দিদি। তোমার নাম কী?

নার্স বললেন, আমার নাম সুনীতি দত্ত।

কাকাবাবু বললেন, মোটেই তোমার নাম সুনীতি নয়। তোমার নাম পারুল। সাত ভাই চম্পা জাগো রে, কেন বোন পারুল ডাকো রে? এবার বলো তো, আমি কে?

নার্সটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সন্তুর দিকে তাকাল।

কাকাবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, আমায় চিনতে পারলে না তো? সিংহের মামা আমি নরহরি দাস, পঞ্চাশটি বাঘ আমার এক এক গেরাস! হালুম।

নার্স বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি আমায় খুব ছেলেমানুষ ভাবছেন, কিন্তু আমার বয়েস চল্লিশ।

কাকাবাবু আর কিছু না বলে চোখ বুজলেন।

নার্সটি বাইরে চলে এসে সন্তুকেও হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

দুজনে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াবার পর নার্স জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা ভাই, তোমার কাকাবাবুর এই রকম অবস্থা কতদিন ধরে?

সন্তু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, বেশি দিন নয়। কারা ওকে বাঘ-মারা গুলি মেরে পালিয়ে গেল–

বাঘমারা গুলি? বাঘ মারতে আলাদা গুলি লাগে বুঝি?

ভুল বলেছি, বাঘ-মারা গুলি নয়। বাঘকে ঘুম-পাড়ানো গুলি। তারপর থেকেই ওর গায়ের জোর সব চলে গেল, আর মাথাতেও গোলমাল দেখা দিল।

উনি কিছু মনে করতে পারেন না?

না। আমাকেই চিনতে পারছেন না?

উনি খুব নামকরা লোক বুঝি? ওঁর জন্য এখানকার পুলিশ আর গভর্নমেন্টের বড় বড় অফিসাররা সব ব্যস্ত দেখছি।

হ্যাঁ উনি খুবই নামকরা লোক।

আহা, এমন লোকের এই দশা! জানো না, এই রকম পাগলরা আর কোনওদিন ভাল হয় না।

সন্তু নার্সের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাগের সঙ্গে বলল, নিশ্চয়ই ভাল হয়। কলকাতায় অনেক বড় বড় ডাক্তার আছে?

নার্সটি সমবেদনার সুরে বলল, আমি তো ভাই এরকম কে অনেক দেখেছি, সেইজন্য বলছি। যারা চেনা মানুষ দেখলে চিনতে পারে না, তারা আর কখনও ভাল হয় না! দ্যাখো কলকাতায় নিয়ে গিয়ে চেষ্টা করে।

সন্তুর আর নার্সের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হল না। সে সেখান থেকে সরে গেল।

সন্ধে হয়ে এসেছে। আকাশটা লাল। সামনের বাগানটা সেই লাল আভায় বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু সন্তুর আর বাগানে যাবার শখ নেই। বাস্তু সাপ হোক আর যাই হোক, অত বড় সাপের কাছাকাছি সে আর যেতে চায় না।

সন্ধেবেলা দেববর্মন এলেন খবর নিতে।

কাকাবাবু সেই একভাবে চোখ বুজে শুয়ে আছেন। সেইজন্য দেববর্মন আর ওঁকে বিরক্ত করলেন না। সন্তুর সঙ্গে একটুক্ষণ গল্প করার পর বললেন, আমি তা হলে নরেন্দ্র ভামার কাছেই যাই। তোমরা যদি কাল চলে যাও, তা হলে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। রাত্তিরটা তা হলে ঘুমিয়ে নাও ভাল করে। মর্নিং ফ্লাইটে গেলে খুব ভোরে উঠতে হবে। এই নার্স সারারাতই থাকবে এখানে।

নটার মধ্যে রাত্তিরের খাওয়া-দাওয়া সেরে ওরা শুয়ে পড়ল। কাকাবাবু আর এর মধ্যে একটাও কথা বলেননি। সন্তু অনেকবার ভেবেছিল, কাল কলকাতায় ফিরে যাবার কথা কাকাবাবুকে জানাবে কি না। শেষ পর্যন্ত আর বলতে ভরসা পায়নি। কাকাবাবু হয়তো কিছুই বুঝতে পারবেন না, শুধু আবার উল্টোপাল্টা কথা শুনতে হবে। কাকাবাবুর মুখে ছেলেমানুষি কথা শুনতে সন্তুর একটুও ভাল লাগে না।

কিছুক্ষণ বারান্দার আলো জ্বেলে সন্তু ওডহাউসের লেখা আংকল ডিনামাইট নামে একটা মজার বই পড়ার চেষ্টা করল খানিকক্ষণ। কিন্তু এই পরিবেশে সে মজার বইতে মন বসাতে পারছে না। এক সময় সে এসে শুয়ে পড়ল কাকাবাবুর পাশের খাটে। নার্স বসে রইলেন চেয়ারে, ওই ভাবেই উনি সারারাত জেগে থাকবেন।

মাঝরাত্রে একটা চেঁচামেচির শব্দ শুনে সন্তুর ঘুম ভেঙে গেল। সামনের বাগানে কে যেন কাঁদছে।

সন্তু মাথার কাছে টর্চ নিয়েই শুয়ে ছিল। তাড়াতাড়ি সেই টর্চটা নিয়ে ছুটে গেল বারান্দায়। আলো ফেলে দেখল, একটা লোক কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে, বাঁচাও! বাঁচাও! মেরে ফেলল!

তক্ষুনি সন্তু বুঝতে পারল ব্যাপারটা কী। একটা কোনও চোর এসে বাগানে লুকিয়ে ছিল। সে পড়েছে ওই বাস্তু সাপের পাল্লায়। চোর, না শত্রুপক্ষের কোনও লোক?

সাদা পোশাকের পুলিশ দুজনও ঘুমিয়ে পড়েছিল নিশ্চয়ই। তাদের নজর এড়িয়ে ঢুকে পড়েছিল লোকটা। কিন্তু ধরা পড়ে গেছে সাপটার কাছে।

এইবারে পুলিশ দুজনের সাড়া পাওয়া গেল। সন্তুও নেমে গেল নীচে।

পুলিশ দুজন টর্চের আলো ফেলে জিজ্ঞেস করছে, কে? তুমি কে? বাগানে ঢুকেছ কেন?

ভয়ে পুলিশ দুজনও রাত্তিরে বাগানে ঢুকতে চাইছে না। সেই লোকটার গলা নেতিয়ে আসছে, বোধহয় এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে।

আলো ফেলে সন্তু দেখল, সাপটা ওই লোকটার একটা পা জড়িয়ে আছে। কিন্তু কামড়ায়নি। ফণাটা লকলক করছে বাইরে। বাস্তু সাপের গুণ আছে বলতে হবে।

দুতিনটে টর্চের আলো পড়ায় সাপটা আস্তে আস্তে লোকটাকে ছেড়ে পাশের ঝোপের মধ্যে ঢুকে যেতে লাগল। লোকটা টলতে টলতে ছুটে এল এদিকে।

একজন পুলিশ লোকটার কাঁধ চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল, তুই কে?

কিন্তু লোকটা উত্তর দেবার অবসরও পেল না। ঠিক সেই সময় প্রচণ্ড শব্দ করে একটা ট্রেকার ঢুকল গেট পেরিয়ে। গেট কী করে খোলা ছিল তা বোঝা গেল না।

সন্তু ভাবল, নিশ্চয়ই নরেন্দ্র ভার্মা কিংবা দেববর্মনরা কেউ এসেছেন। জরুরি কোনও খবর দিতে।

ট্রেকারটা বাড়ির সামনে এসে যাবার আগেই তার থেকে টপাটপ করে লাফিয়ে নেমে পড়ল পাঁচ-ছজন লোক। প্রত্যেকের মুখে সরু মুখোশ আঁটা। তাতে তাদের চোখ দেখা যায় না। সবাইকেই একরকম দেখায়। একজনের হাতে একটা মেশিনগান, অন্য দুজনের হাতে রিভলভার। পুলিশ দুজনের বুকের কাছে রিভলভার ঠেকিয়ে ওদের দুজন বলল, মরতে যদি না চাস তো চুপ করে থাক্।

সন্তু এরই মধ্যে তীরের মতন ছুটে উঠে গেল দোতলায়। কাকাবাবুর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে হাঁফাতে লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগল দুম দুম করে।

নার্সটি নিজেই খুলে দিল দরজার ছিটকিনি। তিনজন তোক এক সঙ্গে ঢুকে পড়ল, তাদের একজনের হাতে মেশিনগান। একজন সন্তুর মুখ চেপে ধরল। মেশিনগানধারী বলল, চলুন মিঃ রায়চৌধুরী।

গোলমালে কাকাবাবু জেগে উঠে চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলেন, এবারে বললেন, রাত দুপুরে ভূতের উপদ্রব।

আগন্তুকদের একজন বলল, নার্স, তোমার পেশেন্টকে তৈরি করে নাও, এক্ষুনি যেতে হবে।

নার্স বললেন, সব তৈরিই আছে। আমি চট করে ইঞ্জেকশানটা দিয়ে দিচ্ছি।

নার্স একটা সিরিঞ্জ বার করে কাকাবাবুর ডান হাতে একটা ইঞ্জেকশান দেওয়া মাত্র তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ওরা দুজনে কাকাবাবুকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেল। সন্তুকেও অন্য লোকটি ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে এল বাইরে।

মাত্র দুতিন মিনিটের মধ্যেই ট্রেকার গাড়িটি ওদের তুলে নিয়ে আবার স্টার্ট দিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *