লখাই চলেছে
৪৫.
লখাই চলেছে। লণ্ঠনের কড়া ধরা মুঠিটা তার তখনও অস্বাভাবিক শক্ত হয়ে আছে। কঠিন চোয়াল, নিষ্ঠুর দৃষ্টি, এবং সব মিলিয়ে যেন একটা ভীষণ উত্তেজনার ঘোর তাকে আচ্ছন্ন করে রয়েছে। নিজেকে অত্যন্ত কষ্ট করে সে সামলেছে। এই গভীর রাত্রে, একলা সাহেবকে দেখে, তার বুকের ভিতর দামামা বেজে উঠেছিল। বিগত জীবনের এক পুঞ্জীভূত প্রতিশোধের আগুন জ্বলে উঠেছিল তার মনে। শিকার সামনে পড়ে যাওয়া বাঘের মতো, হিংস্র আক্রমণের উদ্দেশে শক্ত হয়ে উঠেছিল সর্বাঙ্গ। দিশেহারা প্রাণে একটা শুভকর্মে এই রাত্রে ছুটে বেরিয়েছে সে। এ সময়ে গোরাসায়েব দর্শন একটা অশুভ প্রতাঁকের মতোই মনে হয়েছিল তার। আরও বিশেষ করে তাই সেই মুহূর্তেই, অশুভ মূর্তির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে, গুপ্তঘাতকের মতো ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল সে।
কিন্তু ওয়ালিকের গলায় কোনও উস্কানির সুর ছিল না। এবং হীরার মুখখানি সহসা চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। হীরার জন্যেই বেরিয়েছে সে। হীরার গা এখনও জ্বরে ফুটছে, চোখ ও সর্বাঙ্গ রক্তবর্ণ। থেকে থেকে গেঁচুনি হচ্ছে, ভুল বকছে, কেঁপে কেঁপে উঠছে। সবাই বলেছে, বৈদ্যে কী করবে। এ তো যেমন তেমন রোগ নয়, এ ব্ৰহ্মশাপ!
যখন মানুষ ভয়ে অসহায় হয়, রাত্রির অন্ধকার তখন তাকে আরও দুর্বল করে। লখাই শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ল। কালী বলেছে, ওগো ঠারপো, ভাটপাড়ায় যাও সেই ঠাকুরের কাছে গিয়ে হাত জোড় করো, স্তব করো, বলল, শান্ত হও, অবুঝ ছেলেটার প্রাণ ফিরিয়ে দাও।
লখাই তাই চলেছে। জীবনকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের বাড়ি চলেছে, জোড় হাতে স্তব করতে। ছেলেমানুষের এমন লঘুপাপে এত গুরুদণ্ড দিয়ো না।
লখাই অসহায় প্রাণের বেগে ছুটেছে। হীরালালের মুখ মনে পড়ে গেল, তাই হিংস্র আক্রমণের উত্তেজনা তার থমকে গেল। না, এখন কিছু নয়, এখন শুধু হীরার প্রাণ ফিরে চাই। হীরার প্রাণ! হয়তো ঠাকুর এত রাত্রে দেখা দেবে না, বাড়ির অর্গল বন্ধ। ডাকলেও কেউ সাড়া দেবে না। কিন্তু যতক্ষণই বসে থাকতে হোক, বসে থাকবে লখাই। ঠাকুরের দর্শন না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। জবাব নিয়ে ফিরতে হবে।
যেন দক্ষিণা হাওয়ার বেগ ছুটিয়ে নিয়ে চলল লখাইকে। বাতিটা বারেবারেই নিভু নিভু করে। এই বাতির আলোয় পথের কিছুই দেখা যায় না। একটা অবলম্বন মাত্র। অন্ধকার নিশীথের বুকে একটা চিহ্ন শুধু।
দেখতে দেখতে কাঁকিনাড়া চলে এল সে। দূর থেকেই চোখে পড়ে গলায় দড়ের কারখানার নানান চিহ্ন। গলায় দড়ের কারখানা (জার্ডিন-স্কিনারের চটকল) একটা বড় সম্পন্ন গ্রামের অনেকখানি গ্রাস করেছে। বাকিটা এখনও আছে, কিন্তু থাকছে না। অধিকাংশই ভাটপাড়ায় গিয়ে বসতবাড়ি করছে। কাঁকিনাড়ায় ঠাকুরদের (ভট্টাচার্যদের) বাসই বেশি ছিল, তাদেরই আধিপত্য ছিল। এখন ভাটপাড়া ক্রমে ঘিঞ্জি গ্রামে পরিণত হচ্ছে। কাঁকিনাড়ায় এত বাইরের লোক এসে জুটছে, এত রকমের লোক, গ্রাম সেখানে থাকতে পারে না। কারখানার ভিড়, কাজ ও ব্যস্ততার মধ্যে এক দণ্ডের শান্তি নেই, তাই মানুষ এখানে সংসার পরিজন মন্দির স্নান আহ্নিক, এই সব প্রাত্যহিকতা নিয়ে বাস করতে পারে না। লখাই দেখতে পাচ্ছে, এত রাত্রেও কারখানার আশেপাশে আলো চলাফেরা করছে। মানুষের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে। এতবড় কারখানা এ অঞ্চলে এখনও আর একটাও হয়নি। এমন বিরাট ইমারত, এত বিশাল গুদামঘর, তার সঙ্গে, গঙ্গার ধার জুড়ে সাহেবদের বাংলো। যেন একটা প্রকাণ্ড যজ্ঞ চলছে, এখনও দিন রাত্রি এখানে মানুষ ব্যস্ত। ওরাই রাজা, ওদের সবকিছুই প্রকাণ্ড আর বিশাল।
কিন্তু হীরা…হীরালাল। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে লখাই ছোটে। যা কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্ব রাগ ক্ষোভ বিশ্বাস, সকল কিছুই পিছনে ফেলে ছুটেছে ধৃতরাষ্ট্র। আগে পুত্র, তারপরে আর সব।..ফাঁকা পেরিয়ে ক্রমেই ভাটপাড়ার মধ্যে এসে পড়ল লখাই। অন্ধকার যেন নিবিড়তর হল। বনমালী ঠাকুরের বাড়ি অনেকবার এসেছে সে। জীবনঠাকুরের বাড়িও চেনে।
দুই পাশেই বাড়ি, ঘন বসতি, শিব মন্দির, তার মধ্যে সরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেল লখাই। জীবনঠাকুরের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। কোনও পাঁচিলের বেষ্টনী নেই। সামনেই গুটি তিন-চারেক নারকেল গাছ, ছোট একটা শিব মন্দির। একটি কিশোর দেবদারু আর বেল গাছ সামনের জমিতে। তার মাঝখান দিয়ে গৃহাঙ্গনের পথ। সামনের বারান্দায় আলো জ্বলছে টিমটিম করে। পাকা বারান্দা, কিন্তু বাড়িটা পুরোপুরি পাকা নয়। ছাদ তোলা পাকা ঘরের পাশেই, গোলপাতার ছাউনি দেওয়া ঘরও রয়েছে। ঠাকুর এখনও পুরোটা পাকা করে তুলতে পারেনি।
কিন্তু এত রাত্রে আলো জ্বলছে কেন? টিমটিম আলোয় মানুষের ছায়াও দেখা যায় বারান্দায়। আর কয়েক পা এগিয়েই, লখাই চিনতে পারে, জীবনঠাকুর বসে আছেন। পা ছড়িয়ে ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে, এলিয়ে পড়ে বসে আছেন। খালি গা, কাপড় হাঁটুর উপর উঠে আছে। লখাইয়ের দিকেই তাকিয়ে আছেন, কিন্তু যেন বাহ্যজ্ঞান নেই। দৃষ্টিতে শূন্যতা। যেন শোকে দুঃখে মুহ্যমান, আত্মহারা। পাশেই ঠাকুরানি। অবিন্যস্ত লালপাড় শাড়ি, হাতে শাঁখা আর নোয়া। কালী বউঠানের বয়সি হবেন। পায়ে আলতা। গলায় সোনার মোটা বিছাহার। কানে মাকড়ি, অল্প আলোয় চিকচিক করছে। ঠাকুরের ঘন সান্নিধ্যে বসে, স্বামীরই মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ খালি গা লণ্ঠন হাতে লখাইকে দেখে চমকে উঠলেন। আঁচল টেনে বিন্যস্ত হলেন, ঘোমটা একটু টানলেন। ভয়ে ও বিস্ময়ে ভ্রুকুটি করে দ্রুত স্বামীর দিকে মুখ ফেরালেন। অস্ফুট গলা শোনা গেল, কে এসেছে!
জীবনকৃষ্ণ তাকিয়েই ছিলেন। সহসা তাঁর মুখে কোনও কথা ফুটল না। যেন এখনও সংবিৎ ফিরে পাননি। কিন্তু তাঁর গভীর আচ্ছন্নতা থেকে যেন, চোখে চেতনার আভাস ফুটে উঠতে লাগল।
লখাই বারান্দা স্পর্শ করল না। সিঁড়িতে উঠল না। স্পর্শ করতে নেই। এতখানি চলে আসাও উচিত হয়েছে কি না, জানে না। এটা বৈদিক ভট্টাচার্যের বাড়ি ও প্রাঙ্গণ। লখাই বাগদি। সে ঘাস জমির উপরে লণ্ঠন রেখে, আভূমি প্রণত হয়ে ভেঙে পড়ল। লখাইয়ের চোখের সামনে ছেলের জ্বরতপ্ত অপ্রকৃতিস্থ মূর্তি ও ঠাকুরের এই ভাবলেশহীন নিশ্চল মূর্তি, দুই-ই ভেসে উঠল। আর মনটা নতুনতর ভয় ও শঙ্কায় ভরে উঠল, অশুভ চিন্তায় আরও অসহায় হয়ে উঠল। তার মনে হল, ঠাকুরের মুখ কঠিন, নিদ্রাহীন প্রাণের ভিতরে হীরার প্রাণহরণের মন্ত্র হানছে। সে আর্তস্বরে বলে উঠল, ঠাকুরমশায়, দেবতা, শান্ত হন গো মশায়, আমার অবুঝ ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিন।
ঠাকুরানি আবার বলে উঠলেন, এ কে, এ কে এসেছে গো?
ঘরের দরজা খোলা ছিল। চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একজন যুবক খালি গায়ে বেরিয়ে এল। তার বুকের উপর এলানো মোটা উপবীত। আচমকা ঘুম ভাঙা চোখে বিস্ময়। জীবনকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ছেলে। বাড়ির সকলেই জগদ্দলের সব ঘটনা শুনেছে। এ বাড়িতে আজ শোকেরই অবস্থা। সেই সঙ্গে একটা শঙ্কাও বটে, জীবনকৃষ্ণ না একেবারে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান। তাঁর মস্তিষ্কের ভারসাম্য না চিরদিনের জন্যেই হারিয়ে যায়। তাঁকে যখন চক্রবর্তী বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন, তখন সেই অপমানস্তব্ধ মূর্তি দেখে মৃত্যুশোকের গাম্ভীর্য নেমে এসেছিল। তিনি একটি কথাও বলেননি। যা বলবার চক্রবর্তীই বলেছিলেন। সবাই ভট্টাচার্যকে ঘিরে এসেছিল। তিনি সরে গিয়ে একলা বসেছিলেন। তিনি একাহারী। কিন্তু গত রাত্রে অন্ন গ্রহণ করেননি। বাড়ির আর সকলেই খেয়েছে, তাঁর স্ত্রী স্বামীর সঙ্গেই উপবাস রয়েছেন। ভট্টাচার্য যথাবিহিত সান্ধ্য আহ্নিক করেছেন, স্ত্রী কাছে কাছেই থেকেছেন। তারপর সেই যে বাইরে এসে বসেছেন, রাত্রির শেষ যাম চলেছে, এখনও ওঠেননি। একভাবেই বসে আছেন। ছেলে এসে বলেছিল, ভেতরে শোবেন চলুন। মাথা নেড়ে, হাতের ইশারায় তাদের শুতে যেতে বলেছেন। স্ত্রীকে বলেননি। সবাই শুতে যাবার পর, স্ত্রীর হাতটি ধরে বসে ছিলেন। চোখের কোণ বেয়ে জল পড়েছিল। স্বামীর চোখের জল দেখে গৃহিণীর চোখেও জল এসেছিল। তবু তিনি স্বামীর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আপনার এত দুঃখ পাবার কী আছে? আপনার ধর্ম তো কেউ নষ্ট করতে পারেনি।
কিন্তু জীবনকৃষ্ণ তখন সে কথা ভাবছিলেন না। ধর্মকে তো তিনি কারুর হাতে গচ্ছিত রাখেননি। বারেবারেই কেবল মনে হচ্ছিল, তাঁর অনেক অহঙ্কার যেন আজ চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। এবং ক্রমেই একটা অপরিসীম লজ্জা ও আত্মধিক্কার তাঁকে গ্রাস করছিল। পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা যতই ভাবছিলেন, ততই যেন মরমে মরে যাচ্ছিলেন। ক্রোধ চণ্ডাল। তিনি অত্যন্ত তীব্রভাবে অনুভব করছিলেন, ক্রোধই তাঁর সকল অপমানের কারণ। আর সে ক্ৰোধ কতগুলি মিথ্যা অহঙ্কার ও বিশ্বাসজাত। অবাধ্য ছেলেটার উপর তিনি অমন রুদ্র হয়েছিলেন কেন? ওয়াল্টারদের খাবার আসরে বিচারপ্রার্থীই বা হয়েছিলেন কেন? আঃ আঃ, ছি ছি ছি, কেন তিনি অমন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন! জ্ঞানই তো শুদ্ধ। তবে তিনি কীসের জন্যে অমন উগ্রমূর্তি ধারণ করেছিলেন। ব্রহ্মতেজের অলৌকিকতা কি তাঁর সকল জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করেছিল?
স্ত্রীর কথার কোনও জবাব দেননি। তিনি এই সব ভাবছিলেন। এবং এই সব চিন্তার গ্লানির গভীরেই তিনি ডুবে ছিলেন। আর সেই সঙ্গেই, এই ঘটনার সঙ্গে জীবনের ভবিষ্যৎ রূপকে দেখতে চাইছিলেন। স্মৃতির পাঠ নিয়েছেন, তিনি স্মার্ত। কিন্তু মহাকালের রূপ ভিন্নতর। টোলে অধ্যাপনা করে যে ছেলেদের ঠিকমতো মানুষ করতে পারবেন, কন্যা দুটিকে উপযুক্তভাবে পাত্রস্থ করতে পারবেন, এমন মনে হয় না। এই বসতবাটি আছে, আর জমিজমা নেই, যার থেকে আয় হতে পারে। চাকরিটি সম্বল। বড় ছেলেটি গরিফায়, বেরি কোম্পানির চটকলে একটি কাজ পেয়েছে, সংসারে তা ঈষৎ স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে বটে, দায়িত্ব নেবার মতো কিছু নয়।
এই সব অতি রূঢ় বর্তমান বাস্তবের সঙ্গে তিনি আজকের ঘটনাকে মিলিয়ে নিচ্ছিলেন। ভাবছিলেন, কোন পরিণতির দিকে তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। মহাকালের কাছে নতিস্বীকার করে, আবার তিনি জগদ্দলে ফিরে যাবেন কী করে। আবার গিয়ে সসম্মানে সেই তেসুতিকলের গোলপাতা ছাওয়া অফিসঘরের বড়বাবুর চেয়ারে বসবেন কেমন করে।
এই সব বাস্তব চিন্তার নানান তীক্ষ্ণ কাঁটা তাঁর সংস্কারসমূহে বিদ্ধ করছিল। যত বিদ্ধ করছিল, ততই যেন তিনি ঘোর অসহায়তার মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলেন। ক্ষুধা নিদ্রা, কিছুই তাঁকে কাতর করতে পারছিল না। এমনি সময় লখাই এল। বারান্দার সামনে গাছপালার আঁধার আঁধার ছায়ায়, খালি গা প্রকাণ্ড চেহারা, লণ্ঠন হাতে মূর্তি দেখে, তিনি যেন কী এক দৈব দর্শনের বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ যেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। ঠিক কিছু দেখেছেন কিনা, সেটাও বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না। গৃহিণীর গলার স্বর কানে যেতে, ওঁর বদ্ধ চেতনার স্রোতের মুখ খুলেছিল। তিনি তাকিয়েছিলেন, এবং শুনেছিলেন লখাইয়ের আর্তস্বর, ঠাকুরমশায়, দেবতা, শান্ত হন গো মশায়, আমার অবুঝ ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিন।
লখাই আবার বলে উঠল, আমার প্রাণ নিন গো ঠাকুরমশায়, ওকে ফিরিয়ে দিন। ও আমার অবুঝ ছেলে, ছেলেমানুষ, তায় সায়েব ন্যাওটো, ওর দোষ নাই।
জীবনকৃষ্ণের চেতনায় প্রশ্ন ফুটে উঠল, কে ও? কার প্রাণ ভিক্ষা চায়, কার কাছে? এই গভীর রাত্রের অন্ধকারে, আবার কী নতুন পরীক্ষা এসে উপস্থিত হল? আবার কী নতুন ঘটনা দৈব তার ঝুলি থেকে প্রকাশ করতে চাইছে? যেন কোন সুদুর পারাবার থেকে জীবনকৃষ্ণের গলা ভেসে এল, কে তোমায় ছেলে?
হীরা, হীরালাল।
হীরা, হীরা! নামটা শোনা শোনা, চেনা চেনা লাগছে। একটু মূর্তিও যেন ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ফরসা, একহারা শক্ত পেটানো শরীর আট-দশ বছরের ছেলে, তেসুতি কলের অফিসঘরের বারান্দায় বাঁশের খুঁটি ধরে পাক খাচ্ছে, জীবনকৃষ্ণ দেখতে পেলেন। আর চকিত মুহূর্তের জন্যে ব্রাহ্মণের সুদূর আচ্ছন্ন চোখে চণ্ডালের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝিলিক দিয়ে উঠল। এবং পরমুহূর্তেই চমকে উঠলেন। মনে মনে শঙ্কিত ধিক্কারে বলে উঠলেন, আবার, আবার!
জীবনকৃষ্ণের স্ত্রী ও ছেলে বিস্মিত চোখে যেন এক রহস্যময় ঘটনা দেখতে লাগলেন। কেউ কিছু বুঝতে পারছেন না।
জীবনকৃষ্ণ বললেন, তুমি কে?
ঠাকুরের এই আচ্ছন্নতা, এই অচেতনভাবের প্রশ্ন, লখাইকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠিত করে তুলল। তার মনে হল, ঠাকুর এই বাহ্যজগতে নেই। ভিন্ন জগতে যেখানে মানুষের দৃষ্টি যায় না, যেখানে মানুষের জীবনমরণের হিসাব চলেছে, সেখান থেকে কথা বলছেন। সে ব্যাকুল উৎকণ্ঠায় বলল, আমি তার বাপ ঠাকুরমশায়, আমি লখাই, লখাই বাগদি।
লখাই বাগদি! সেনপাড়ার লখাই বাগদি। হীরার বাবা। চেতনা স্বচ্ছ হয়ে এল জীবনকৃষ্ণের। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোমার ছেলের? ঠাকুর তাকে পরীক্ষা করছেন? লখাই আর্ত গলায় চিৎকার করে বলল, আপনার কোপ লেগেছে গো ঠাকুরমশায়, আপনি তো সবই জানেন। আপনার কোপ লেগেছে, তেসুতি কল থেকে ফিরে গিয়ে আর তার জ্ঞান হয়নি। গা আগুন, রক্ত বণনো, কাটা পাঁটার মতন ছটফট করছে। খ্যাপা খ্যাপা চোখে তাকায়, মানুষ চিনতে পারে না, বেভুল বকছে। আপনার কোপে ঠাকুরমশায়, সেনপাড়ার সবাই বলছে, তাই ছুটে এসেছি। ছেলেমানুষকে ক্ষমা করেন ঠাকুর, প্রাণে মারবেন না। সে অবুঝ, আপনার কোধের যুগ্যি নয়।
যেমন করে দেবদেবীর থানে হত্যে দেয়, লখাই তেমনি করে উপুড় হয়ে পড়ে বলতে লাগল। এখন তার পরিপূর্ণ বিশ্বাস, ঠাকুরের হাতেই হীরার প্রাণ। তাই তার চোখ ফেটে জল এসে পড়েছে। আর জীবনকৃষ্ণ যেন নতুনতর বিস্ময়ের ঘোরে আবার আচ্ছন্ন হয়ে গেলেন। তেসুতি কল থেকে ফিরে আর জ্ঞান হয়নি ছেলেটার! গা আগুন, রক্তবর্ণ, কাটা পাঠাঁর মতো ছটফট করছে? আমার কোপে? আমার কোপে? সেনপাড়ার সবাই বলছে, আমার কোপে! ব্রাহ্মণের কোপে! আমি ব্রাহ্মণ! আমি ব্রাহ্মণ! আমার কোপে ছেলে মরে যায়।
সহসা জীবনকৃষ্ণের চোখ ফেটে জল এসে পড়ল। হে কালেশ্বর। হে কালেশ্বর, এ কী বিচিত্র তোমার রহস্য! এ কী নিষ্করুণ তোমার বিদ্রূপ!
কিন্তু জীবনকৃষ্ণের স্ত্রী স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন না। স্বামীর অপমানের ব্যথা ও শোকের মধ্যে সহসা তাঁর তীব্র প্রতিশোধের বহ্নি জ্বলে উঠল। বলে উঠলেন, সে তা হলে তোমারই ছেলে?
লখাই বলে উঠল, হ্যাঁ, মা ঠাকরুন, হ্যাঁ, ঠাকুরকে বিষ ফিরিয়ে নিতে বলেন।
জীবনকৃষ্ণের ছেলের চোখেও মায়ের মতোই বিদ্বেষের আগুন। সে বলে উঠল, মরণ পাখা যার গজিয়ে উঠেছে, তাকে বাঁচাবে কেমন করে?
জীবনকৃষ্ণ যেন আর্তস্বরে ধমকে উঠলেন, চুপ, চুপ করো তোমরা, এ সব কী বলছ। ছি!
নিজেরই কাপড়ের অংশ দিয়ে চোখের জল মুছে, তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন জীবনকৃষ্ণ। লখাইকে বললেন, উঠে বসো বাবা, উঠো বসো। ছেলের অবস্থা যা যা বললে, এ সবই ঠিক তো?
-ছেলের মরণ নিয়ে কি কেউ মিছে কথা বলে ঠাকুর?
-না না, মিথ্যের জন্যে বলছি না, অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করছি। তোমার বসবার সময় নেই বাবা, তাড়াতাড়ি ওঠো, তাড়াতাড়ি ওঠো।
জীবনকৃষ্ণ অস্থির ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। বারান্দা থেকে তাড়াতাড়ি নেমে এসে বললেন, ছুটে যাও তাড়াতাড়ি কাঁকড়ায়, কুঞ্জ রায় কবরেজকে গিয়ে সব লক্ষণ বলে। তাকে নিয়ে যাও। কুঞ্জকে গিয়ে বলল, আমি বলেছি তাকে যেতে। আমার নাম করে বলবে। ওষুধ দিয়ে সে যেন তোমার ছেলের জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত থাকে, তারপরে যেন আমার কাছে আসে। যা বাবা যা আর দেরি করিস না।
লখাই কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যায়। ঠোঁট নড়ে, কিন্তু কথা বলতে পারে না। তারপরে হঠাৎ বাতিটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাঁচবে তো ঠাকুরমশায়?
–বাঁচবে বাঁচবে, তুমি তাড়াতাড়ি যাও।
বলেই হঠাৎ হাত তুলে বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও, একটু দাঁড়াও, আমি এখুনি আসছি।
বলে দ্রুত পায়ে বাড়ির মধ্যে গেলেন। অন্ধকার ঘরের মধ্য দিয়ে, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন। ঠাকুরঘরের দরজা খুললেন। অতি স্তিমিত একটি প্রদীপ জ্বলছে। ফুল বেলপাতা ধূপ আর প্রদীপের তেলের গন্ধ ঘরের মধ্যে। দেবতার আসনে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। জীবনকৃষ্ণ মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। বললেন, অন্যায় অনেক করেছি, তার জন্যে যা শাস্তি হয় দিও, কিন্তু এই মিথ্যে দুর্নামের হাত থেকে বাঁচাও, দোহাই দোহাই!
দুহাতে চোখ মুছে, ঘরের এক কোণ থেকে বের করলেন ছোট মাটির ভাঁড়। তামার কোষা থেকে চরণামৃত ঢাললেন তাতে। ফুল বেলপাতা তুলে নিলেন। আবার দরজা বন্ধ করে, নীচে নেমে এলেন তাড়াতাড়ি। মাটির ভাঁড় মাটিতে রেখে বললেন, এই চরণামৃত নিয়ে যাও, কুঞ্জ না বললে ছেলের মুখে দিও না, মাথায় চুঁইয়ে দিও। যাও, তাড়াতাড়ি চলে যাও। কুঞ্জ কবরেজকে নিয়ে যাও। আমার কথা তাকে বলবে।
লখাই তেমনি হতভম্ব বিস্ময়ে ও উৎকণ্ঠায় উচ্চারণ করল, যে আজ্ঞে।
বলে নত হয়ে মাটিতে কপাল ঠেকাল। জীবনকৃষ্ণের স্ত্রী ও ছেলের প্রতিও হাত তুলে গড় করে, চরণামৃতের ভাঁড় আর বাতি নিয়ে ছুটল।
জীবনকৃষ্ণ তাকিয়ে রইলেন লখাইয়ের অপসৃয়মাণ আলোর বিন্দুর দিকে। বাতাসের সেই উদ্দামতা আর নেই, সহসা যেন তার বেগ শিথিল হয়ে গিয়েছে। ঝিঁঝি ডাকের সঙ্গে, কোনও একটা পাখির সরু গলা করুণ সুরে বেজে চলেছে। জীবনকৃষ্ণ মনে মনে বলছেন, দোহাই হে কালেশ্বর, অনেক উপহাস করেছ, এবার এই মিথ্যা দুর্নামের পাপ থেকে বাঁচাও।
লখাইয়ের আলোর বিন্দু অদৃশ্য হল। জীবনকৃষ্ণ ফিরলেন। স্ত্রী ও ছেলে, দুজনেই তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। জীবনকৃষ্ণ ছেলের উদ্দেশে বললেন, যাও শুতে যাও, বউমা একলা রয়েছেন। তোমাকেও রাত পোহালে আবার গরফেয় ছুটতে হবে।
ছেলে বিস্ময় করুণ চোখে পিতার দিকে তাকিয়েছিল। পিতার চোখের জল ও সমস্ত ব্যবহার তার কাছে রহস্যময় বোধ হচ্ছিল, সঠিক কিছু হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিল না কিন্তু একটা ব্যথা অনুভব করছিল। সে বাড়ির মধ্যে চলে গেল।
জীবনকৃষ্ণ আবার এসে তাঁর স্ত্রীর কাছে বসলেন। গৃহিণী তাকিয়ে ছিলেন স্বামীর দিকেই। জীবনকৃষ্ণ স্ত্রীর দিকে চোখ তুলে দেখলেন। বললেন, বড় বউ, অহঙ্কারই পাপ। জীবন যারা দিতে পারে না, জীবন তারা নিতেও পারে না। এখন এই মিথ্যা অপবাদ থেকে বাঁচলে হয়। নইলে আমাকেও মরতে হবে।
স্ত্রী চমকে উঠে বললেন, ও কথা বলবেন না।
জীবনকৃষ্ণ বললেন, তার চেয়ে চলো, ঠাকুরের কাছে গিয়ে বসি, ছেলেটার প্রাণভিক্ষা করি গে!
–তাই চলুন।
স্ত্রী বাতি হাতে তুলে নিলেন। দুজনে বাড়ির মধ্যে চলে গেলেন। জীবনকৃষ্ণ কথা বলেছেন, স্বাভাবিক হয়েছেন, তাঁর স্ত্রী তাই ভাগ্য মানছিলেন।
.
লখাই কুঞ্জবিহারী রায় কবিরাজকে নিয়ে বাড়িতে এল। এসে ডাক দিল, বউঠান।
ঘরের ভিতর থেকেই আর্ত চিৎকার শোনা গেল কালীর, এসেছ, ওগো ঠারপো, শিগগির এসো, আর বুঝিন রাখা গেল না।
লখাই ভুলে গেল কবিরাজের কথা। উঠোনে বাতি বসিয়ে দিয়ে, চরণামৃতের ঘট নিয়ে ছুটে ঘরে গেল।
রাত্রি প্রায় শেষ। চৈত্রের ছোট রাত্রি পার হয়ে, ঊষা দেখা দিয়েছে। কুঞ্জবিহারী ঘরের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। কালো লোমশ শক্ত খাটো চওড়া শরীর কবিরাজ এক মুহূর্ত চিন্তামগ্ন হলেন। গায়ে উড়নি। চোখ দুটি আরক্ত। এমনিই লাল থাকে, অসময়ে ঘুম ভাঙায় আরও বেশি লাল এখন। কোঁচকানো চুল এই পঞ্চাশোর্ধ্বে একটিও পাকেনি। হাতে ওষুধের থলি। নাম করা কবিরাজ। নাড়ি দেখেই নাকি জীবনমৃত্যুর ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। সেই কিংবদন্তির মতে, তাঁর নামেও শোনা যায়, অন্তঃপুরের অন্তরালবর্তিনীর মণিবন্ধে সুতো বেঁধে, আড়াল থেকে সেই সুতো ধরেই নাকি তিনি নাড়ি দেখতে পারেন, এবং চিকিৎসার বিধান দেন।
ঘরের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, গুটিকয়েক ছায়া মাটির দেওয়ালে স্থির হয়ে রয়েছে। শুনলেন, লখাই ডাকছে, হীরা, হীরালাল, শোন বাবা, দ্যাখ ঠাকুরমশায় তোকে চুন্নামেত্ত দিয়েছেন, একটু খা, একটু খা।
কুঞ্জবিহারী ভ্রূ কোঁচকানো মুখখানি যেন সবসময়েই বিরক্তিপূর্ণ, গম্ভীর। তিনি আস্তে আস্তে ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন, পচা তেলের প্রদীপ জ্বলছে, ঘরে তার দুর্গন্ধ। ঘরের এক ধারে শ্যাম শুয়ে রয়েছে। আর একদিকে হীরা। লখাই আর কালী ছাড়া, পাড়ার আরও জনা দুয়েক ঘরের মধ্যে ছিল। কুঞ্জবিহারী হীরার দিকে তাকিয়ে দেখলেন। কালী তখন হীরার ঠোঁট ফাঁক করে চরণামৃত ঢালতে যাচ্ছিল।
কুঞ্জবিহারী গম্ভীর গলায় বললেন, কী দিচ্ছ ওটা?
কালী বলল, ঠাকুরের চন্নামেত্ত।
–থাক, এখন দিয়ো না। ওই ঘটিতে কী?
–জল, গঙ্গাজল।
দিয়েছ নাকি?
বড় যে তেষ্টা কবরেজ মশাই, ছেলে খালি জল জল করছে।
–থাক, আর দিয়ো না। বাতিটা এগিয়ে দাও, সরে যাও তোমরা।
সকলেই কুঞ্জবিহারীর দিকে তাকিয়েছিল। তাঁর আরক্ত চোখ, কালো শক্ত চওড়া শরীর ও গম্ভীর গলা সবাইকে তটস্থ করে তুলল। যেন সাক্ষাৎ কালান্তকের রূপ ধরে এসেছেন। কালী তাড়াতাড়ি বাতি এগিয়ে দিল। আসন পেতে দিল। কুঞ্জবিহারী আসনে বসলেন না। উটকো হয়ে বসে হীরার দিকে তাকালেন। তীক্ষ্ণ চোখে সর্বাঙ্গে বারেবারে চোখ বুলিয়ে, হাত তুলে নাড়ি দেখলেন। ঘাড় কাত করে, চোখ বুজে নাড়ি দেখতে লাগলেন। হঠাৎ তেসুতিকলের বাঁশি বেজে উঠল। হীরা চোখ খুলে তাকাল। শুকনো উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল, কে?…তুই সর। এইটুকু বলেই আবার চোখ বুজল, আবার মাথা চালতে লাগল।
কুঞ্জবিহারী চোখ মেলে দেখছিলেন, হাত ধরে নাড়ি টিপে রেখেছিলেন। একটা শব্দ করলেন, হুঁ। আবার চোখ মুদে নাড়ি দেখতে লাগলেন ওই ভাবেই বললেন, কবার মাথা ধুয়ে দিয়েছ?
কালী বলল, কাল সন্ধের মধ্যে দুবার।
–এখন আবার ধোয়াও, অনেকক্ষণ ধরে ধোয়াও। কপালে জলপটি দাও, অনবরত বাতাস করো। কদিন পায়খানা করেনি?
কালী বলল, তা তো জানি না।
হুঁ।
কুঞ্জবিহারী চোখ খুললেন। কুটি আরক্ত চোখে দেওয়ালের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তারপর যেন দেওয়ালের দিকেই কাউকে বললেন, অষ্টাহ? না, বিষ প্রয়োগ করতে হবে, অনেক দূরে চলে গেছে।
কালীর দিকে ফিরে বললেন, খল আছে?
আছে।
মধু?
–আছে।
–নিয়ে এসো।
কালী হঠাৎ কেঁদে উঠে বলল, বাঁচবে তো কবরেজ মশাই?
কুঞ্জবিহারী হীরার হাত নামিয়ে দিয়ে বললেন, দেখা যাক। তবে মেলা প্যাচাল পেড়ো না এখানে। বলে কালো কুচকুচে থ্যাবড়া হাতটা হীরার রক্তাভ কপালে রাখলেন।
.
চৈত্র শেষ হয়ে গেল। গতকাল নীলের পূজা আর উপোস গিয়েছে। আজ চৈত্র সংক্রান্তি। আজ জলসংক্রান্তি, চড়ক পূজা, শিবের গাজন, ধর্মঘট ব্রত। আজ প্রায় সকাল থেকেই ঢাক বাজছে। গতকালও বেজেছে। গঙ্গার এপার ওপার দুইপারেই স্নানের ভিড়। কালও ছিল, আজও চলেছে।
কালীও স্নান করতে এসেছে। গতকালও এসেছিল। গলা অবধি জলে ডুবিয়ে দূর গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে জলের ধারা। চৈত্র মাসও শেষ হয়ে গেল। এইবার কি কোনও আশা আছে? চৈত্রে আসা যাওয়া, দুই-ই গৃহস্থের বারণ। চৈত্র শেষ হয়ে গেল, এবার কি মধু আসবে? যম মধু, পেটের শত্রু!..
কিন্তু বেশি দেরি করার উপায় নেই কালীর। হীরাটার এখনও অন্নে পথ্য জোটেনি, জ্বরটা ছেড়েছে। আজ একটু মুগের ডালের জুস, একটু মিছরি, আর কুমড়োর ডাঁটা সেদ্ধ নুন দিয়ে মেখে দেবার কথা। কদিন ধরে কুঞ্জ কবরেজমশাই প্রায় রোজই এসেছেন। কিন্তু সবাই জানে, ওষুধ নিমিত্ত মাত্র। ভাটপাড়ার ঠাকুরের চরণামৃতই সার। ঠাকুরের দেওয়া ফুল বেলপাতা এখনও ঘরে আছে, চিরদিনই থাকবে! সেনপাড়া-জগদ্দলের সবাই জানে, সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকেই হীরাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন জীবনকৃষ্ণ। সবাই শুনেছে, মাঝরাত্রে তিনি জেগে বসে বাণের মন্ত্র পড়ছিলেন। লখাই গিয়ে হত্যা দিয়ে পড়ায়, দয়া হয়েছিল। নিজের হাতে অমৃত তুলে দিয়েছেন, ডাক দিয়ে দিয়েছেন।
কালী অনেকগুলি ডুব দেয় পর পর। জলের ঝাপটা দিয়ে দিয়ে চোখ ধোয়। পোড়া চোখের জলকে এত জল দিয়েও ধোয়া যায় না। আশেপাশে অনেক মেয়ে পুরুষেরা স্নান করছে। একটু দূরে, সেনবাড়ির ঘাটে ব্রাহ্মণ কায়স্থরা স্নান করছে।
আতপুরের রাজবাড়ি থেকে ঢাকের দগড় ভেসে আসছে। সেখানে শিব মন্দির, মন্দিরের সামনের মাঠে আজ চড়ক পূজার নৃত্যকৃত্য বাণ-ফোঁড়ার উৎসব। গোটা চৈত্রমাসের সন্ন্যাসের অবসান, সবাই গিয়ে সেখানে জুটছে। ফল ফুল দুধ মিষ্টি বেলপাতার ছড়াছড়ি। প্রতি বছরই একবার যায় কালী। আগে দল বেঁধে যেত, ইদানীং হীরার হাত ধরে একলা যাচ্ছিল। এবার তাও হবে না। হীরাটা সকাল থেকে কান পেতে ঢাকের বাজনা শুনছে। কালী তো জানে, ছেলেটার বুকের মধ্যে কী হচ্ছে! শ্যামকে রেখে দু-এক দণ্ডের জন্যে যাওয়া যায়। হীরাকে রেখে কি যাওয়া যায়। চড়ক যে তেতো লাগবে কালীর।
গতকালই অনেকে তারকেশ্বরে চলে গিয়েছে। কিংবা আরও দু-তিন দিন আগেই রওনা হয়ে গিয়েছে। এখানকার গাজনের সন্ন্যাসীর ধ্বনিই যে তাই, জয় বাবা তারকেঘেরো লাগি।.. কেউ কেউ উঁচড়োর ষাঁড়ের তলাতেও গিয়েছে। শিবের থানের অভাব নেই।
চৈত্র মাসে একদিনও বৃষ্টি হয়নি, বছরের শেষ দিনে সে কথা অনেকে বলাবলি করছে। চৈতে খরো খরো, বোশেখে ঝড় পাথর। পাথর বৃষ্টি না হোক, অগ্নিবৃষ্টি হবে বটে। আর যদি হয় চৈতে বিষ্টি, তবে হয় ধানের ছিষ্টি। চৈত্র মাসে বৃষ্টি সুলক্ষণ। কিন্তু কুয়াশা তার থেকে খারাপ, চৈতে কুয়ো, ভাদরে বাণ, নরমুণ্ডু গড়াগড়ি যান। তা অন্তত দু-তিন দিন ভোরবেলার দিকে কুয়াশা দেখা গিয়েছে। আগামীকাল নতুন বছর পড়বে, লক্ষণ ভাল নয়। এখন বৈশাখের ভরসা।
জল ছেড়ে উঠে আসে কালী। মনটা আবার হীরার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ওর বাপ তো বাড়ি নেই, মাঠের বাঁশঝাড়ে গিয়েছে। সারা মাসে খেয়াল ছিল না, আজ চড়কের দিন গিয়েছে ঝাড়ে মাটি দিতে। ফাল্গুনে আগুন আর চৈত্রে মাটি দিলে, বাঁশঝাড়ের দ্বিগুণ গতর হয়। লখাই বেরিয়েছে। দোষই বা কী। পনেরো-ষোলটা দিন তো গেল ছেলেকে নিয়ে। শ্যাম তা থেকেও না থাকার মতো। ছেলেটা একলা রয়েছে। চারদিকে ধিতিং তিতিং নাচ, ঢাক বাজছে নাই কুড়কুড় নাই কুড়কুড়, মন পুড়ছে ছেলেটার। তবে, কী জানি কেন, ছেলেটা বড় চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। যেন চুপচাপ শুয়ে বসে কী ভাবে। অবিশ্যি কথা বলবেই বা কী। গলায় কি স্বর আছে? কথা বলবার শক্তিটুকুও নিংড়ে নিয়েছে।
বড় সড়কে পা দিয়ে কালী দেখল, তেসুতিকলের পাগলা সায়েব চলেছে আতপুরের দিকে। সঙ্গে ভূতো বোস, আরও দু-একজন। ওয়াল্টার চলেছে রাজবাড়ির চড়কতলায়। গতকাল থেকে কারখানা বন্ধ। শ্রমিক মেয়েপুরুষেরা সব বেপাত্তা। নেটিভদের এই চরিত্রটাই বোঝা ভার। একটা কিছু পুজো পার্বণ লাগল তো, সব একযোগে কামাই। তাও একদিন যাও। তা নয়। আজ দুদিন হল, বেশির ভাগ লোকেরই দেখা নেই। কাল থেকে হয়তো কেউ কেউ আসবে, কিন্তু পুরোপুরি জের কাটতে সাতদিন। বাড়ি বাড়ি আর অনুষ্ঠানের স্থানে গিয়ে তাড়া দিলে যদি কিছু কাজ হয়। তাই চলেছে ওয়াল্টার। ভূতো বোস হাত পা নেড়ে বলতে বলতে চলেছে, অল বেলাডি কাউ সার। আপকো যেই দেখে গা, ভাগ যায়েগা।
কালী মনে মনে বলল, না, চড়কের দিনও তোমার সায়েবের কল চালাবে গিয়ে।
যতই বেলা বাড়তে লাগল, ততই ঢাকের শব্দ চড়তে লাগল। এপারে আর ওপারে ফরাসডাঙায়, সর্বত্রই ঢাকের শব্দ, রৌদ্রদগ্ধ আকাশ আর খর বাতাসকে মাতিয়ে তুলছে। নানান জায়গায় নানানরকমের উৎসব। বর্ষ শেষ আর শুরু, কদিন ধরে যাত্রা পাঁচালি ভাঁড় সংএর নৃত্যকৃত্য চলবে নানান জায়গায়। মেলায় আরও বহুতর উৎসবের আয়োজন। ঝুমুর খ্যামটা হাফ আখড়াইয়ের মাতামাতি। আরও কত কত রঙ্গ রাতবিরেতের মেলায়। তবে দরকারি কাজকর্ম সেরে। সামনে বর্ষা। মেলায় এখন খড়, দক্ষিণের গোলপাতা, তৈরি দরজা-জানালা, ঘর তৈরির তাবৎ সামগ্রী, গৃহস্থালির নানান দ্রব্য, ঘর করতে যা লাগে, বর্ষায় চাষবাসের সময় যার জন্যে ছুটোছুটি চলবে না, সব কিনে নিতে হবে।
আতপুরেও মেলা বসে, তেমন মেলা নয়। নিতান্ত লোকজনের ভিড় হয়। তাই কলকাতার নানান শৌখিন সামগ্রী নিয়ে কেউ কেউ বসে। পথে গোলামের সঙ্গে দেখা। কালীর বুকটা আবার টনটনিয়ে ওঠে। মধুর কথাই মনে পড়ে যায়।
–কোথায় চললি রে গোলাম।
–যাই একবার আতপুরে, দূর থেকে চড়ক দেখে আসি।
কিন্তু কালীর গতি শিথিল হয়। গোলাম দাঁড়িয়ে পড়ে। জিজ্ঞেস করে, খবর কিছু পেলে খুড়ি?
অর্থাৎ মধুর খবর। কালী নিশ্বাস ফেলে বলে, না বাবা।
গোলাম দাঁড়ায় না, কিন্তু কালী দাঁড়িয়ে পড়ে। কী যেন জিজ্ঞেস করতে চাইল, মনে করতে পারল না। কাল থেকে নতুন বছর পড়বে। এবারও কি মধুর নিজ গ্রামের কথা মনে পড়বে না।
.
ওদিকে গোঁসাইদের নায়েব গা এলিয়ে দিয়ে চেয়ারে বসে আছেন কাছারির বারান্দায়। একটু গরম বটে, হাওয়াটা মন্দ লাগছে না। গড়গড়ার নলটা মুখের মধ্যে পুরে, চোখ অর্ধ নিমীলিত করে, এলিয়ে পড়ে আছেন। যেন একটা সুখস্বপ্নের প্রশান্তি সারা মুখে। কিন্তু একটা ভ্র বেঁকে রয়েছে। তাঁর চোখের সামনে এ অঞ্চলের সমগ্র ভূমিখণ্ড ভাসছে। শুধু বেগডানলপ কোম্পানি নয়, আরও অনেক, অনেক কোম্পানির সংবাদ আসছে, যারা টাকার বোঝা নিয়ে জমির সন্ধানে আসবে শীঘ্রই। নায়েব মশাইয়ের কাছে এই রকম সংবাদ আসছে। চৈত্রের কিস্তি যা অনাদায়ী, তার কাজ আর ফেলে রাখা যাবে না। এখন আর চাতরায় ফিরে যাওয়া চলবে না। জম্পেশ হয়ে বসে, আগের থেকেই যদি কিছু বেনামি দখল রাখা যায়, তবে ঈশ্বরের অসীম কৃপা লাভ করা যাবে। আপাতত চৈত্রের নায়েবি নজরানাও মন্দ পাওয়া যায়নি। আঃ, ফরাসডাঙা থেকে আনা এই তামাকটা সত্যি মিষ্টি। ভুড়ুক করে একটু টান দেন, একটু ধোঁয়া বেরোয়। আর ধোঁয়াটুকু যেন হাবেলিশহর পরগনার ভৌগোলিক আকৃতির মতো হয়ে ওঠে।
সেনবাড়ির দুই গোমস্তা রাশি রাশি নথিপত্রের মাঝখানে বসে আছে। বর্ষশেষের হিসাবপত্র দাখিল করতে হবে, দাবি করেছেন সব শরিকেরা। যাঁরা কলকাতায় আর চুঁচুড়ায় চাকরি করতে যান, এবং যাঁরা যান না, সকলেই। আর মূল দেওয়ানি অংশ যাঁর, তাঁকে তো সারা বছরের খতিয়ান দিতেই হবে। বৃদ্ধা দেওয়ান গিন্নির চোখ এখনও খোলা। আসলে হিসাব-কেতাব যা কিছু, তিনিই দেখবেন।
কিন্তু এই হিসাবে আর মন বসে কই। শুধু ধুলো ঝাড়া, পোকা তাড়ানো ছাড়া আর তো কিছু করার নেই। তার চেয়ে চিৎপুরে ছাপা, ইংরেজি অক্ষর ও শব্দ শিক্ষা গ্রন্থ নিয়ে বসা ভাল। ওই তো চপলা ঝি এসেছে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছে আর দেখছে। নতুন বিদ্যার বহর তার কাছে ফলাও করা যাক।
একজন বলে, তা হলে, জি ইউ টি, জুট।
আর একজন সংশোধন করে, উঁহু, জে ইউ টি, জুট।
দুজনে একসঙ্গে উচ্চারণ করে, জুট মানে পাট।
তারপর দুজনে বলে যেতে থাকে।
ম্যান মানে মানুষ।
–মেন মানে মানুষগুলো।
–মানি মানে টাকা।
–ব্রাইব মানে ঘুষ।
–স্যালারি মানে বেতন।
–ওয়ার্কার মানে শ্রমিক।
প্রৌঢ়া ঝি চপলার চোখ দুটি বড় বড় হয়ে ওঠে। কাছে এসে দুজনের মাঝখানে বসে পড়ে। একবার এর দিকে তাকায়, আর একবার ওর দিকে। বলে, ওমা, তোমরা কি সত্যি সত্যি ইনজিরি শিখে ফেললে নাকি গো?
দুজনের কী হাসি। সশব্দে নয়, নিঃশব্দে। সশব্দে হাসতে ওরা অনেকদিন ভুলে গিয়েছে। আর এই প্রাচীন জীর্ণ রাশিকৃত নথিপত্রের মাঝখানে বসে কে-ই বা গলা খুলে হাসতে পারে। হাসবার কারণই বা কী আছে। দুজনে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে হাসে। একজন চপলার কাঁধে একটা হাত রাখে। আর একজন উরতে।
চপলা বলে তেমনি বড় বড় চোখে, তোমরা কি তালে সত্যি সত্যি চটকল কোম্পানিতে কাজ নেবে নাকি গো?
প্রৌঢ়া হলেও চপলার গতরের ছিরি এখনও যেতে গড়িমসি করছে। পাতা পেড়ে চুল আঁচড়িয়ে, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করলে, এখনও বেশ লাগে। চপলার কথা শুনে দুজনের হাসি আরও উদ্দাম হয়, আরও ফুলে ফুলে ওঠে। চপলা আবার বলে, এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে? তবে আর পিরিতে কী দরকার?
দুজনে আরও ঘনিষ্ঠ হয়, থাবা শক্ত করে চপলাকে ধরে। একজন বলে, ওম্যান মানে?
আর একজন বলে, মেয়েমানুষ।
একজন আপত্তি করে বলে, না, চপলা।
আর একজন উল্লাসে ফেটে পড়ে বলে, হ্যাঁ, চপলা।
চপলা বলে, কেন আর জপাচ্ছ বাবু, তোমরা তো কোম্পানির লোক হয়ে যাবে।
একজন বলে, তোমাকেও নিয়ে যাব, তুমি আমার কাছে কাজ করবে আমি হব তোমার হাজিরাবাবু।
আর একজন বলে, আমি তোমাকে মাইনে দেব, আমি হব তোমার খাজাঞ্চিবাবু।
চপলা তার দুই প্রেমিকের মাঝখানে বসে স্বপ্নে ডুবে যায়। দেওয়ান বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে, কোম্পানির কাজের স্বাধীনতার সুখ কেমন হবে, সেই স্বপ্নে ডুবে যায় সে।
.
লিটলজন এসেছে, একজন দেশীয় কর্মচারীকে নিয়ে। জমির সীমানাকে সুস্পষ্ট দাগ দিয়ে ঘিরে ফেলতে হবে। কারখানার কাজ শুরু করতে আর দেরি নেই। কোম্পানির ওভারসিয়াররা আসবে কয়েক দিনের মধ্যেই। সমগ্র জমির সীমানাটা পরিষ্কার না পেলে, কারখানা এবং বাংলোর নকশা করতে পারবে না। তারপরে চাই লোক, অনেক অনেক লোক।
কালো দুলেনি চুপটি করে বসে আছে সেনবাড়ির ঘাটে। এখন আতপুরে বসত, কিন্তু থাকতে পারে না। আতপুর থেকে লাঠি ঠকঠকিয়ে বুড়ি স্নান করতে এসেছে সেনপাড়ায়। কাছারিতে বারান্দায় নায়েবকে দেখে এসেছে। সেনবাড়িতে উঁকি দিয়ে এসেছে। এখন ঘাটে বসে সাহেবের জমির সীমানা ভাগ দেখছে।
যখন বুড়ি সেনপাড়ায় থাকত তখন আতপুরে রাজবাড়িতে চড়ক পূজা দেখতে যেত। এখন আতপুরে থাকে, তাই চড়ক পূজার থেকে সেনপাড়ার এই নিরিবিলি ঘাটেই বেশি মন টেনেছে। জীবনের সব উৎসবের ছবি যে আজ এ ঘাটে বসেই সে ভাল দেখতে পায়। এই ঘাটই যে সব!
.
৪৬.
কয়েকদিন আগে রথযাত্রা উৎসব হয়ে গিয়েছে। উল্টোরথ পর্যন্ত, সাত দিন ধরে মহোৎসব গিয়েছে মাহেশে। অনেকেই সেখানে গিয়েছিল। কেউ কেউ গিয়েছিল কাঁটালপাড়া, চাটুয্যেদের রাধাবল্লভের রথের মেলায়। আতপুরেও এই একটি উৎসবেই সবথেকে বড় মেলা হয়, ঘোষবাড়ির রথযাত্রা উৎসব। দেবদ্বিজে ভক্তিমান এই সদগোপ পরিবার রথযাত্রা উৎসবের আয়োজন, নিজেদের ক্ষমতানুযায়ী ভালই করে। যাত্রা পাঁচালি কবিগানের আসর হয়। তবু বাইরের টান যে বড় টান! তার উপরে মাহেশের আকর্ষণ বেশি, কারণ তার নাম ডাক বেশি। কলকাতা থেকে শুরু করে, নানান জেলার মানুষ সেখানে জড়ো হয়। যেখানে যত বেশি জনতা, সেখানেই তত বেশি আড়ম্বর, মেলার আড়ম্বর। বাইরের থেকে লোক আসে, তাই এক দিনেই তার ভিড় কাটে না। উৎসব লেগেই থাকে। ফুর্তির বান ডাকে। নেশা আর জুয়ার আসর জমজমাট হয়ে ওঠে। ঝি বউ হারিয়ে যাবার হিড়িক পড়ে যায়। সজ্জনের হাতে পড়ল তো ভাল, নইলে বুক চাপড়েও খুঁজে পাওয়া দায়। মেলা মানেই তো তাই। সোমথ মেয়ে বউ হারায় না, এমন মেলা কোথায় হয়? এই আতপুর সেনপাড়া-জগদ্দলে খোঁজ নিলেও কি এমন দু-একটা হারানোর খবর পাওয়া যাবে না? তাও যাবে; অবিশ্যি হারিয়ে ফেরত পাওয়ার নজিরও আছে। স্বয়ং অধরা নাকি স্বামীর হাত ফসকে হারিয়ে আবার ফেরত এসেছিল কাঁটালপাড়া থেকে। হারু কৈবতের কড়ে রাঁড়ি বোনকে তো কয়েকজন ভদ্রলোক নৌকায় করে, মাহেশ থেকে পৌঁছে দিয়েই গিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছে মনে করে তার আশা সবাই ছেড়ে দিয়েছিল আতপুরে। কিন্তু উল্টোরথের আগেই সে ফিরে এসেছিল। আর পরের বছরের রথের সময় তার কোলে সবাই আড়াই মাসের ছেলে দেখেছে। আ মরণ! রাঁড়ি ছুঁড়ি গলায় দড়ি দিতে পারেনি? নিদেন, পেটের শত্রুটাকেও তো অকালে নিকেশ করতে পারত।
হারু কৈবর্তের বালবিধবা বোন তা পারেনি। সেও আজ সাত-আট বছর আগের কথা। ছেলেটি এখন ডাগর হয়েছে। পিতৃপরিচয় বঞ্চিত সে ছেলে মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়নি। আর মানুষের স্মৃতি, তার দায় কেঁদে গিয়েছে। নিতান্ত ঘরের মানুষের কথা আলাদা। বাইরের লোকের স্মৃতি তখনই জাগ্রত, যখন তুমি আপনাকে তার মনে বিঁধিয়ে রাখ। হারুর বিধবা বোনের ধনদৌলত কোঠাবাড়ি কোনও কিছুই নেই, এক ঐশ্বর্যের জন্যেই তার কথা ও ছেলের কথা এখনও লোকেরা মনে রেখেছে। এখনও তার শরীরে জোয়ারের কাল, দেখলে মনে হয়, বানের কোটাল চলেছে। যখন হারুর বোনের বয়স হয়ে যাবে, তখন সে আর কারুর চোখে পড়বে না, তাকে আর কেউ মনে রাখবে না, তার ছেলের জন্মবৃত্তান্তও লোকে আস্তে আস্তে ভুলে যাবে। কত বড় বড় বাড়ির কলঙ্কই লোকেরা ভুলে যায়। হারুর বোনের তো আর নতুন করে বিয়ে হবে না। মানুষের স্মৃতিশক্তি এত তীব্র নয় যে, অপরের কলঙ্কের স্মৃতি সে চিরকাল বহন করবে। নিজেরটাই কি সে চিরকাল করে।
মেলায় হারিয়ে ফিরে আসার নজির হয়তো আরও আছে। তেমনি চিরদিনের জন্যে হারিয়ে যাবার ঘটনাও কম নয়। এবারকার রথের মেলার সেরকম সংবাদ কিছু শোনা যায়নি। তবে ভূত বোস, জগু মিস্তিরি, আর লক্ষ্মী বাগদিনিরা দল বেঁধে মাহেশে গিয়েছিল। বিনু মুচিনি, আর ইন্দিরও বাদ যায়নি। এমন লোকও পাবে, যারা গুপ্তিপাড়ায় বৃন্দাবনচন্দ্রের রথ দেখতে গিয়েছিল। এক রথযাত্রা দেখতেই লোকে কত জায়গায় যায়। বারুইপুর, মহেশতলা, ষষ্ঠীতলা, খড়দা, বারাসত, বনগাঁয়ের চড়কতলা, নানান জায়গায়।
বাংলাদেশে রথের পরে, সবথেকে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। সবাই সেই শারদ দুর্গোৎসবের দিনগুলির মুখ চেয়ে থাকে। কিন্তু ফরাসডাঙা আর ফরাসডাঙার কাছাকাছি, নদীর এপার ওপারের মানুষদের কাছে তা নয়। রথের পরেই, বড় উৎসব ফরাসডাঙার ফ্যাস্তা। কোনও কোনও বছর, রথের সঙ্গে সঙ্গেই ফ্যাস্তার দিন পড়ে যায়, কিংবা উল্টোরথ পার না হতেই, সেই দিনটি এসে পড়ে। আবার রথ হয়ে যাবার পরেও আসে সেই দিন। এবার তাই এসেছে।
.
আজ ফ্যাস্তা। কেউ বলে ফায়স্তা। এ দেশের লোকেরা, বাংলা মাসের হিসাবে এ দিনের সংবাদ জানে না। পাঁজিতে এ দিনের কথা লেখা থাকে না। দিনক্ষণ যাঁরা বলে দেন, সেই বামুন ঠাকুরেরা এ দিনের কথা বলতে পারেন না। মুখে মুখে সংবাদ আসে, হাট বাজারে ফেরতা মানুষের মুখে, মাঝিদের মুখে ফঙায় যারা রাতবিরেতে আমিরি ওম্রাহি করতে যায়, তাদের মুখে, অমুকদিন ফরাসডাঙায় ফ্যাস্তা।
তাই তো হবে, কারণ এ তো এ দেশের লোকের পুজোপাটের মেলা নয়, এ খাস ফরাসি সাহেবদের উৎসব। ইংরেজি মাসের হিসেবে, চৌদ্দই জুলাই, ফরাসি চন্দননগরে আজ ফ্যাস্ত। আজ আশেপাশের, মায় কলকাতার রাস্তাও ফরাসডাঙার দিকে। যাবৎ নৌকা আজ ফরাসডাঙার ঘাটে নোঙর করছে। জগদ্দল সেনপাড়া আতপুরের তো কথাই নেই। আজ সকলের টান ওপারে, আজ ফ্যাস্তা।
ফ্যাস্তা শব্দের মানে কী? তা কেউ বলতে পারে না। চন্দননগরের গোরারা বলে, আজ ফ্যাস্তা। লোকেরাও বলে, আজ ফ্যাস্তা।
বড় সাহেবের (গভর্নরের) বাড়ির কলি ফেরানোর পালা চলে আগে থেকেই। উৎসবের দিন পতাকা ওড়ে ইমারতের মাথায়। গঙ্গার ধার জুড়ে যত সরকারি ভবন, মায় জেলখানা, সবখানেই নিশানা ওড়ে। রঙিন কাগজ দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা হয়, Fiasta! Fiasta! যারা পড়তে পারে, তারা পড়ে। তারা কেউ বলে, ফিয়াস্তা, কেউ বলে ফায়স্তা। সবাই বলে ফ্যাস্তা। সবাই শোনে, তাই আজ তোপ দাগা হয় সকালবেলাই গুড়ুম! গুড়ুম!
কাগজে কাগজে আরও লেখা হয়, Nacanel De Fet! বড় বড় হরফে রাস্তার এপারে ওপারে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, Viv La Bastil Day! Viv La France! …লেখা হয়, Liberty Equality Fraternity! যারা পড়তে পারে, তারা পড়ে, তারা মানে বোঝে।
সাধারণ লোকেরা, মেয়ে পুরুষ যারা ভিড় করে আসে ফরাসডাঙায়, তারা জানে না, এ কীসের জাতীয় উৎসব। কেন ফ্রান্সের এই জয়ধ্বনি বাস্তিল দিবস-এর মানে কী। তারা দ্যাখে, আজ বাধ্যতামূলক পথ পরিষ্কার করা। ফরাসডাঙার কোথাও আজ একটু ময়লা নেই। রূ দ্য আলেয় থেকে তাঁতিপাড়া, কোথাও আজ কেউ অপরিষ্কার রাখতে পারবে না। দোকানিরা আজ দোকান সাজায়, অধিবাসীরা সাজগোজ করে। ফরাসডাঙার যত বাজনা আছে, সব আজ বাজানো হবে। গভর্নরের বাড়ির কাছে এসে বাজায়, পথে পথে ঘুরে ঘুরে বাজায়।
আজ কোনও কাজ নয়, আজ সরকার ছুটি ঘোষণা করেছেন। আজ কেবল উৎসব, কেবলই উৎসব! খাও দাও ফুর্তি কর। আজ যত খুশি জুয়া খেলা শুরু করে দাও পথে পথে। পাঞ্জা লড়ো, লাঠি খেলো, সাপ খেলাও, বাঁদর নাচাও, লড়িয়ে দাও বুলবুলি। রাজ্যে যত নটী আছে, দেশি কিংবা বিদেশি, নাচিয়ে দাও সবাইকে। আজ নাচঘরের দরজা খুলে দাও, সব সরাইখানার দেউড়ি খোলল। আজ সব বাঁধন ছেঁড়া, সকল বাধা খোলল।
আজ ব্রিটিশ চন্দননগরের সীমান্তে আর তেলিনিপাড়ার দিনেমার গড়ের সীমান্তের প্রহরা তুলে দাও। অবারিত প্রবেশের ঢালাও হুকুম আজ। সিপাই সান্ত্রীদের আজ বাধ্যতামূলক ধোয়া পোশাক। আজ তাদের কাজ শুধু সাবধান করা আর সামলানো। গ্রেপ্তার নয়, বেত্রাঘাত নয়, তুড়ুম ঠোকা নয় কাউকে। আজ কয়েদিদের যত বেশি সম্ভব মুক্তি দাও। যারা খুনি নয়, যারা ডাকাত নয়, যারা ফরাসি চন্দননগর রাজ্যের শত্রু নয়, তাদের মুক্তি দাও। দীর্ঘ মেয়াদিদের উপায় নেই, তাতে আইনের খেলাপ হয়। যাদের এখনও দু-চার মাস বাকি আছে খাটা, তাদের মুক্তি। বাইরে এসে তারাও অংশ নিক উৎসবে।
আজ ফ্যাস্তা! আজ ফ্যাস্তা!
অঢেল পুরস্কার দেবে আজ গভর্নমেন্ট। যত প্রতিযোগিতা, তত পুরস্কার। সরকারের চেলা চামুণ্ডারাই সব ব্যবস্থা করছে। দেখতে বেরুবেন নানান ওজনের সাহেব আর মেমসাহেবেরা, তাঁদের নিমন্ত্রিতেরা। সকলের আগে বড় সাহেব, যাকে বলে গভর্নর ফরাসডাঙার লাটবাহাদুর। তাঁর পিছে পিছে তাকে ঘিরে ঘিরে বাকিরা,
প্রতিযোগিতা, নানান বয়সের, নানান লোকের। ছেলে বুড়ো, সব রকমের। দৌড় শুধু মাঠে নয়। রাস্তা থেকে রাস্তায়, পাড়া থেকে পাড়া ঘুরে, আবার এই গঙ্গার ধারেই আসতে হবে, ঘণ্টাঘড়ির নীচে। যারা দৌড়বে, মোড়ে মোড়ে পথে পথে তাদের লক্ষ রাখে ভারপ্রাপ্ত লোকেরা। টুকে রাখে, কে আগে কোন জায়গা পার হয়েছে। লাঠি খেলার প্রতিযোগিতা, কুস্তির লড়াই, কপাটির দম নিয়ে মারের হার-জিত। যার যেখানে মন টানে, সে সেখানেই ভিড় করে।
আবার রাস্তার ধারেই গর্ত করে পুঁতে দেওয়া হয়েছে, পালিশ করা কাঠের গোল খুঁটি। পনেরো হাত উঁচু। তার গায়ে মাখিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্রিজ। উঠে যাও খুঁটি বেয়ে। খুঁটির মাথায় আছে টাকা আর খাবারের ডালি। যে উঠতে পারবে, ডালি তারই জয়ের পুরস্কার। কিন্তু হাতে ধুলো মাখতে পারবে না, মাটিতে ঘষতে পারবে না, হাত মুছে দেবার লোক আছে কাছে। হাত মুছিয়ে দেবে ভাল করে।
বড় মজার খেলা, অতি উত্তেজক। খুঁটির সর্বাঙ্গে তৈলাক্ত জিনিস মাখানো। কেউ দু হাত ওঠে, আর হড়কে পড়ে যায়। ভিন্ন প্রতিযোগী দলের লোকেরা হাসে। হাততালি দেয়। অন্যেরা চেঁচায় উত্তেজিত হয়ে। একটা নয়, এমনি অনেক খুঁটি আছে পর পর খাড়া। খুঁটি যত উঁচু, তত বেশি পুরস্কার তার শিখরে।
আর এক রকমের খুঁটি আছে, খাড়া নয়, একটু হেলিয়ে দেওয়া। তাতেও তেল জবজবে করে মাখানো। কোনওরকমে ডগায় যেতে পারলেই হয়, সেখানে আছে পুরস্কার। তবে ছোট পুরস্কার। যাদের শক্তি কম, হেলানো খুঁটির প্রতিযোগিতা তাদের জন্যেই।
গঙ্গার দূর স্রোতে ছুঁড়ে দেওয়া হয় পাতিহাঁস। প্রতিযোগীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। হাঁসই পুরস্কার, যে যতগুলি নিতে পারে সাঁতার কেটে।
এই প্রতিযোগিতার উপরে আবার বাজি আছে। দলের সঙ্গে দলের, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাজি। এসে লড়ে যাই, পারলে আরও বিশ টাকা দেব, না পারলে বিশ টাকা নেব। আরও আছে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কে কয় বোতল মদ খাবে এসো। কয়টা রান্না পাঁঠা গিলতে পারবে এসো।
টাকা হাঁস মদ খাবার। নাচ গান বাজনা। খেমটাউলিরাও বাদ যায় না। গঙ্গার এপার ওপার থেকে লোক আসে ঝেটিয়ে। লোক আসে কলকাতা থেকে। ফরাসডাঙায় অঢেল মদ, গঞ্জে অগঞ্জে অনেক মেয়েমানুষ। কেউ নাচে ইরানি নাচ, কেউ নাচে তুর্কি। কতটুকু আর জীবন! লুটে নাও।
সাহেব মেম অনেক আসে নিমন্ত্রিত হয়ে। অনিমন্ত্রিত যারা আসে, তাদেরও ফুর্তির অভাব হয় না। দাইয়া মেমসাহেবের নাচঘরে যায় তারা। মাস্টার হরিচরণের বাজনা বাজে, মেমসাহেব আর দেশি মেয়েরা নাচে। তাস খেলা, তীর আর ছুরি দিয়ে নিশানা বেঁধার খেলা জমে।
প্রায় সকাল থেকেই উৎসবের মহা কলরোল শুরু হয়। চারিদিকে মেলা বসে যায়। উড়তিবাজারের কাছেই মেলা জমে ওঠে। তারপরে সন্ধ্যার অন্ধকার যখন নেমে আসে, তখন আর এক খেলা, বাজি পোড়ানো। আকাশ আলোয় আলো, রং-এ রং, যেন ক্ষণে ক্ষণে ফুলের হাট বসে যায়। দূর দেশান্তর থেকেও দেখা যায় সেই বাজির ঝলক। শুধু রঙিন ফুলের ঝলক নয়, আকাশে বাজির রং-এ লেখা ফুটে ওঠে, Viv La Bastil Day! Viv La France! Nacanel De Fet! যারা লেখাপড়া জানে তারা পড়তে পারে। যারা জানে না, তারা শুধু আকাশে রঙিন অক্ষরমালা দেখেই, অবাক খুশিতে তাকিয়ে থাকে।
আজ ফ্যাস্তা, আজ সেই ফ্যাস্তা!
কিন্তু ফ্যাস্তা মানে কী? সাধারণ লোকে Fiasta শব্দের অর্থ জানে না। তারা বলে, আজ ফ্যাস্তা। এবং চন্দননগর আর তার এপারে ওপারে, আশেপাশের লোকেরা, সময় অসময়ে ঘরে বাইরে বলে, আ মরণ। আর ফ্যাস্তা করতে হবে না।অর্থাৎ, আর ঢঙ করতে হবে না। কিংবা, খুব যে ফ্যাস্তা হচ্ছে। আঃ কী ফ্যাস্তা যে করিস।তোর ফ্যাস্তা দেখে বাঁচি না।
আজ সেই ফ্যাস্তা! তাই রথের পরে এ অঞ্চলে দুর্গাপূজা নয়। তার আগেই ফরাসডাঙার ফ্যাস্তা।
ওয়াল্টার তার কুঠির ঘরে বসে, চন্দননগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কারখানার ছুটি ঘোষণা করা হয়নি। কিন্তু অঘোষিত ছুটিই সবাই ভোগ করতে চলে গিয়েছে আজ। গতকাল সে সবাইকে ধরে ধরে অনেক বুঝিয়েছে, অনেক ধমকেছে। সবাই বলেছে, কাজে কামাই কেউ করবে না। অথচ শতকরা আশিভাগই আসেনি। একমাত্র বাবুরা সবাই এসেছে। বাধ্য হয়েই কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। শয়তানগুলি একটা বেলা যদি কাজ করত, কিছু উৎপাদন হত।
ওদিকে ফার্ডিনান্ড ছটফট করছে, কখন ওয়াল্টারের মেজাজ ভাল হবে। তাকে ডেকে বলবে, ইচ্ছে হলে তুমিও যাও। ওয়াল্টার নিজেও তা জানে। ফার্ডিনান্ড কাছেপিঠেই অনুমতির জন্যে ঘোরাফেরা করছে। চন্দননগরের ফরাসিদের এই উৎসবে সে প্রতি বছরই যায়। কখন ফিরে আসে, ওয়াল্টার তা জানতে পারে না। হয়তো ভোরবেলা ফিরে এসে সে, একেবারে কারখানার বাঁশি বাজিয়ে দেয়। কিন্তু এখন রাগে ও বিরক্তিতে ওয়াল্টারের মন পরিপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে সপ্তাহে পাঁচ দিন কাজ হয়। শনি ও রবিবার ছুটিই থাকে। তারপরেও যদি এভাবে উৎপাদন ব্যাহত হয়, সেটা সহ্য করা মুশকিল। অবিশ্যি এ কথা ঠিক, গোটা সপ্তাহে প্রতিদিনই দু-এক ঘণ্টা করে কাজের সময় বাড়িয়ে এটা উশুল করে নেওয়া যাবে। এবং তাতে নেটিভ শ্রমিকরা কখনও কার্পণ্য করে না। তবু কারখানার এই নিশ্চল স্তব্ধতা মনটাকে বিমর্ষ করে দেয়। ওয়াল্টারের মনে হয়, সে নিজেই যেন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তার খেতে সুখ হয় না, শুতে শান্তি নেই! তাই সে ভ্রূকুটি বিরক্ত মুখে চন্দননগরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
সে যে একলাই এমনি তাকিয়ে রয়েছে তা নয়। শ্যামনগর মিলেরও নিশ্চয় আজ এ দুর্গতি চলেছে। কাঁকিনাড়ার জার্ডিন-স্কিনারদেরও নিশ্চয়। সম্ভবত গৌরীপুর বেঁচে গিয়েছে। ওদিককার লোকেরা কথায় কথায় চন্দননগর আসে না। তবে ইন্ডিয়া জুট মিল বা ওয়েলিংটনেরও প্রায় এই অবস্থাই বোধহয়। একমাত্র ভরসা, ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তের লোকেরা প্রচুর এসে পৌঁছুচ্ছে। যাদের নেতৃত্বে এসে পৌঁছুচ্ছে, সেই সর্দারদের অনুমতি ভিন্ন, ওরা এক পা কোথাও যায় না। তাই একেবারে পূর্ণ বন্ধ হয়তো কোনও কারখানাই থাকবে না।
কিন্তু ওয়াল্টারের পক্ষে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা অসম্ভব। কিছু নেটিভ ছেলে ছোকরা নিয়ে যে একটু মেশিন ঘাঁটাঘাঁটি করবে, হই-হুঁল্লোড় করবে তারও উপায় নেই। মাডু (মধু) এখানে নেই, সে একটি বিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে নাকি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। অদ্ভুত কর্মী ছেলে। কোনও কাজে না বলে না, আর চটপট বুঝে নিতে পারে। কিন্তু বাড়ির আপত্তিতে কাজ নিতে চায় না, অথচ নিয়মতান্ত্রিকতার কোনও ধার ধারে না। মধু না থাকায়, অন্যান্য ছেলেরাও বিশেষ আসে না। ও দলের পাণ্ডা। বাঁশঝাড়ের উত্তরে যে জিমনাশিয়াম ক্লাব খোলা হয়েছে, সেখানেও বিশেষ কেউ আসে না। ওদের খেলা শিখিয়ে, কুস্তি লড়িয়ে, নিজে লড়ে বেশ একরকমভাবে ছুটির দিনগুলি কাটত। মধু না থাকলে, ওয়াল্টারের নিজেরও কোনও উৎসাহ হয় না। স্থানীয় জেন্টুদের ছেলেরা তো আসেই না। গোলাম নিরুৎসাহ, বিটা দেখাই দেয় না। আর গত মার্চ মাসের সেই ঘটনার পর থেকে হীরা ছেলেটা এক দিনও আসেনি। ওয়াল্টার তার খোঁজ নিয়েছিল। সে নাকি বাড়ি থেকেই আর বেরোয় না।
তবু ওয়াল্টার মনে মনে স্থির করে, সে বেরিয়ে পড়বে। ঘুরতে ঘুরতে একবারে ইচ্ছে হলে গারুলিয়া পর্যন্ত চলে যাবে। লাঞ্চের সময়ে ফিরলেও হবে। কিন্তু চন্দননগরে সে আজ যাবে না। ওই ভিলা বাস্তিল ডে আর ভিড় লা ফ্রান্স, এবং যত ভিড় হট্টগোল নাচনকোঁদন, ও সব তার ভাল লাগে না। এমন নয় যে, শ্রীমতী দাইয়ার হোটেলে একটু নিরিবিলি পাওয়া যাবে, একটু নিবিড়ভাবে সময় কাটানো যাবে। তার চেয়ে গারুলিয়া ভাল। ওয়ালিকের সঙ্গে কিছু আলোচনাও করা যাবে। ম্যাকলিস্টারকে একটা লট সুতো পাঠানো হয়েছে বাউড়িয়ায়। ডান্ডিতে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, তাই এখন ভাবনা। তা ছাড়াও কানাডার একটা বড় অর্ডার রয়েছে। একদিকে ডান্ডি, আর একদিকে ম্যাকলিস্টার ও অন্যদিকে বাইরের অর্ডার, এই তিন দিকে সামলানো নিশ্চয় এই কারখানার পক্ষে অসম্ভব। এবং ম্যাকলিস্টারের কথা শুনে আমার লাভ কী? হয়তো ডান্ডি, ম্যাকলিস্টারের ধমকে রাজি হয়ে যাবে। বলবে, ওকে সুতো সাপ্লাই। করো। কিন্তু আমার পাওয়ার লুম সন্নিবেশিত পরিপূর্ণ জুট মিলের স্বপ্ন কি তাতে সার্থক হবে? বিশ্বাস হয় না। একমাত্র ওয়ালিকই নিঃস্বার্থভাবে আমাকে পরামর্শ দিতে পারে, অন্য কোনও হোম কোম্পানির সঙ্গে আমি যোগাযোগ করব কি না। ফোর্ট গ্লাস্টার কোম্পানি যদি রাজি না হয় একটা পরিপূর্ণ মিল আমার হাতে গড়তে দিতে, আমি আমার অংশ নিয়ে, অন্য কোথাও চেষ্টা করব। একেবারে একলা। এতকাল ধরে এই কারখানাকে ভালভাবে চালাবার কোনও পুরস্কারই কি নেই?
ওয়াল্টার ফার্ডিনান্ডকে ডাকল। সে কাছাকাছিই ছিল। ছুটে এল ডাক শুনে। ওয়াল্টার বলল, যারা কাজে এসেছে, তাদের চলে যেতে বলল। বাবুদের আজ আর দরকার নেই। তুমি একবার বয়লারটা চেক করো। আর তোমার কোনও কাজ নেই আজ।
ফার্ডিনান্ড বলল, আচ্ছা স্যার!
.
অফিসের চালাঘরেই সবাই হাত-পা গুটিয়ে বসে ছিলেন। তেমন গরম ছিল না। বাইরে রোদ ছিল বটে, বাতাসও ছিল। বর্ষাকালের স্বাভাবিক গুমোট একটুও ছিল না। সাত দিন নাগাড় বৃষ্টি গিয়েছে রথের সময়। কয়েক দিন একটু শুকনো যাচ্ছে। সব মিলিয়ে যেন শরৎকালের ছোঁয়া লেগেছে সর্বত্র। আকাশ বোয়া, উজ্জ্বল নীল। পুব-দক্ষিণ থেকে মেঘ মাঝে মাঝে পাড়ি দিচ্ছে উত্তর পশ্চিমে। এখনও প্রজাপতি তেমন ওড়েনি, ফড়িং-এর ভিড় কেবল।
অফিসেও ফ্যাস্তার হাওয়া। গোপাল পালাবার কথা ভাবছে। কিন্তু জীবনকৃষ্ণ উঠছেন না। তিনি আবার কাজে এসেছেন। স্বয়ং ওয়াল্টার গিয়ে তাঁকে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে নিয়ে এসেছে। তাঁর সমস্ত ক্ষোভ শান্ত হয়ে গিয়েছিল। ওয়াল্টার বলেছিল, আমার যদি কোনও অন্যায় হয়ে থাকে, তা হলে তুমি আমাকে ক্ষমা করো পণ্ডিত। কিন্তু সেদিনের সেই সিচুয়েশন আর সিনটা তুমি একবার চিন্তা করো। আর সত্যি বলতে কী, ছেলেটা তোমাকে এত ভয় পেয়েছিল, শুধু ভয়ের আঘাতেই বেচারি জ্বর-বিকারে ভুগছে। সেটা যাই হোক, তোমার মতো অনেস্ট লোক আমাকে ছেড়ে গেলে, আমি খুবই দুঃখিত হব।
আরও অনেক কথা বলেছিল ওয়াল্টার। কাজে ফিরে আসার যেটুকু সংকোচ ছিল, সেটুকু কেটে গিয়েছিল। তিনি যে ভবিষ্যতের জন্যে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। যে সব দুঃস্বপ্ন দেখেছিলেন, তার কিছুই ঘটেনি। নিজের ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ ব্যবহারের জন্যে, তিনি নিজেই বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। হীরার প্রতি ব্যবহারের জন্যে লজ্জিত হয়ে নিজেকেই ধিক্কার দিয়েছিলেন। হীরার জীবন ও আরোগ্য কামনায় নিজেই ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। তাই তিনি ওয়াল্টারকে বলেছিলেন, আমি যাব, আমি কাজে ফিরে যাব সাহেব, হীরা ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠুক, তারপরে যাব। নইলে আমি আর কোনওদিন সেনপাড়া-জগদ্দলে যেতে পারব না।
ওয়াল্টার অবাক হয়েছিল সে কথা শুনে। ভাটপাড়ার পণ্ডিতের মতিগতি সে কিছুই বুঝতে পারেনি। তবু জীবনকৃষ্ণের কথা শুনে, তার বিদেশি মন বিস্ময়ের মধ্যেও সুখী হয়েছিল। সে বলেছিল, থ্যাঙ্কস, মেনি থ্যাঙ্কস পণ্ডিত। তোমার কথায় আমি খুব খুশি হয়েছি। ভগবান নিশ্চয় হীরাকে ভাল করে দেবে।
হীরার আরোগ্য সংবাদ পেয়ে তবে কাজে এসেছিলেন জীবনকৃষ্ণ। তিনি হীরাকে দেখতেও গিয়েছিলেন। এবং ইদানীং সকলেই লক্ষ করেছে, জীবনকৃষ্ণের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি আজকাল সবসময়েই হাসিখুশি। সর্বদাই প্রসন্ন। দুপুরবেলা মানের পর কেউ ছুঁয়ে দেবার ভয়ে সচকিত হয়ে উঠলে, উনি হেসে বলেন, অত ভয়ের কী আছে? না হয় আর একবার স্নান করব। যিনি স্নানের পর আহারের পূর্বে, শূদ্রের ছায়া পর্যন্ত মাড়ান না, তাঁর মুখ থেকে ওরকম কথা শুনলে অবাক হতে হয় বইকী। কিন্তু জীবনকৃষ্ণ অবাক হন না, হা হা করে হাসেন। আজকাল প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরের কালীভক্ত রাকৃষ্ণঠাকুরের কথা বলেন। ঠাকুরের শিষ্যদের কথা বলেন। রামকৃষ্ণের নানান কথা বলেন। দক্ষিণেশ্বরে যান মাঝে মধ্যে। এমনকী শ্যামনগরের ব্রহ্মময়ী কালীদেবীর মন্দিরেও। ভাটপাড়ার ভট্টাচার্যরা তো শ্যামনগরের কালীবাড়িতে যান না। ব্রহ্মময়ী যে পাথুরিয়াঘাটার পিরিলি ব্রাহ্মণদের প্রতিষ্ঠিত! পিরিলি ঠাকুরদের দেবী যে স্বীকৃত দেবী হতে পারেন না। কারণ পিরিলিরাই যে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকৃত নন!
কিন্তু কী আশ্চর্য, জীবনকৃষ্ণের মুখ দিয়ে বেরিয়েছে, কালীর আবার পিরিলি আর বৈদিক। দেবীর কি কোনও জাত আছে?
লোকে শুধু মুখের কথা শুনেই আশ্চর্য! যদি মনের কথা শুনত? জীবনকৃষ্ণ মনে মনে বলেন, আমি জানি হে কালেশ্বর, তোমার গায়ের লিখন আমি পড়তে পারি। দেব-দেবী তো বহুত দূর, মানুষেরই জাতি-বিচার আর থাকবে না। আমি দেখছি, বর্ণাশ্রমের সকল বন্ধন ধ্বংস করার জন্যে, অতি ভীষণ নিষ্ঠুর আয়ুধ তোমার হাতে উদ্যত। তোমার সেই উদ্যত আয়ুধ দেখেই, আমার অনেকখানি মোহভঙ্গ হয়েছে। ভাটপাড়া সমাজের গভীর রন্ধ্রকে আমি দেখতে পেয়েছি। তোমার অশেষ করুণা, অনেক আগেই তুমি আমার অহংকার চূর্ণ করেছ। কৃষ্ণ যেমন অর্জুনকে বলেছিলেন, তোমার এই সব প্রতিযোদ্ধা আত্মীয়গণ, সকলেই প্রবৃদ্ধকালের গ্রাসে পতিত হবেন, সংসারের এই-ই রূপ। আমি এদের পূর্বেই সংহার করেছি, মৃত্যুর চিহ্ন সকলের অঙ্গে, অতএব সব্যসাচী! নিমিত্তমাত্র হয়ে, তুমি এদের হত্যা করো, ঠিক তেমনি যেন অপ্রতিরোধ্য জাত-বিচারের সংহার আমি তোমার মহাকালরূপের মধ্যে দেখতে পেয়েছি।
জীবনধারণের রীতিনীতির মধ্যে জীবনকৃষ্ণের কিছুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু তাঁর ভিতরে ভিতরে এক বিচিত্র পরিবর্তনের উজান বহেছে। এখন তিনি সংসারের অনেক কিছুই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছেন। সর্বত্রই, নিজের যা কিছু অনিচ্ছা, সেখানে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন না। উপরের ঘরে, তাঁর ইষ্টদেবতার কাছে বলেন, নিয়ম সংস্কার নয়, ভক্তি দাও একটু, ভক্তি দাও। তাঁর হাবভাব দেখে, ব্রাহ্মণী বরং একটু বিচলিত। তাঁর সদা হাসি প্রসন্নতা দেখে গৃহিণী বারেবারে থমকে যান। আগে কারখানা থেকে বাড়ি আসার আগে, গৃহিণী রাস্তার ধার থেকে ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত গোবর জলের ছিটা দিয়ে রাখতেন। এখন জীবনকৃষ্ণ সস্নেহে হেসে বলেন, এত কষ্টের কী প্রয়োজন বড় বউ। রোজ রোজ আর তোমাকে গোবরজলের ছিটা দিতে হবে না। চিরজীবনের অভ্যাস, ভট্টাচার্য গৃহিণী এত সহজে তা ছেড়ে দেবেন কেমন করে। তিনি কথা শোনেন না। কিন্তু কর্তার যে এতে আর কিছুই যায় আসে না, তাঁর এই কর্তব্যজ্ঞানে যে স্বামীর সুখ-অসুখ কিছুই হয় না, তাতে বিষণ্ণ হয়ে ওঠেন গিন্নি। একটা উৎকণ্ঠাও মনের মধ্যে বেড়ে উঠছে।
.
আপাতত অফিসে গোপাল বেচারি একটু বিপদে পড়েছে। সে অফিসের আর্দালি, বড়বাবুর হুকুম বিনা যেতে পারে না। ছুটি তো ঘোষণা হয়েছে অনেকক্ষণ। কিন্তু জীবনকৃষ্ণ চক্রবর্তীর সঙ্গে গল্প জুড়েছেন। মেশিনঘরের বাবুরা অনেকক্ষণ বেরিয়ে গিয়েছে। ভূতো বোস এক বিরাট দল নিয়ে ফরাসডাঙায় চলে গিয়েছে। খুব মাতামাতি করবে আজ। আর ওই গগন কায়েত তো পাগলা। গোপাল মনে মনে বলল, শালা তখন থেকে একটা ছাপা কাগজ হাতড়ে নিয়ে পড়ে আছে।
জীবনকৃষ্ণ বলছিলেন, কখনও তো কাছে গিয়ে দেখিনি, এবার চলো, কাছে গিয়েই ফ্যাস্তা দেখে আসি।
চক্রবর্তী অবাক হয়ে বললেন, আপনি ফরাসডাঙায় গিয়ে ফ্যাস্তা দেখবেন! অত লোকজন ভিড়?
জীবনকৃষ্ণ বললেন, ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যাবে বলছ? ডুব দিয়ে দিয়ে নাইব হে, গঙ্গায় খুব কষে ডুব দিয়ে নেব, তা হলেই তো হবে। চলো না যাই। বরাবর তো দূর থেকেই দেখে আসছি। চক্রবর্তী বললেন, আমার কোনও আপত্তি নেই। আমি অনেকবার গেছি।
–তবে আর কী।
চক্রবর্তী গগনকে দেখিয়ে, নিচু স্বরে বললেন, তা হলে ওই পাগলাটাকেও বলুন না, ওর অনেক চেনাশোনা লোক আছে ফরাসডাঙায়।
–আত্মীয়স্বজন আছে বুঝি?
-না, আত্মীয়স্বজন নয়, বন্ধুবান্ধব। ওর তো আবার সেনপাড়ায় বেহ্মদের সঙ্গে পোট খায় না। তাই আড্ডা দিতে যায় ফরাসডাঙায়। ইংরেজি ফরাসি জানা মনের মতন লোক সব ওপারে।
জীবনকৃষ্ণ গগনের দিকে তাকালেন। গগন তখন চেয়ারের উপর পা তুলে গভীর অভিনিবেশে কাগজ পড়ছে। চক্রবর্তীকে জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়ছে ওটা?
চক্রবর্তী বললেন, রাম বাঁড়ুজ্জের মুষল।
–অ! বঙ্গসিন্ধু?
–হ্যাঁ। গগন তো আবার রামদাস বাঁড়ুজ্জেরই চেলা।
–শুনেছি। কিন্তু ও কি ডাকলে যাবে?
–ডেকে দেখুন না। আপনি ভাল করে বললে, নিশ্চয়ই যাবে।
জীবনকৃষ্ণ কয়েক মুহূর্ত গভীর অভিনিবেশে পাঠরত গগনকে দেখলেন। খানিকটা যেন আপন মনেই বললেন, ভূতো বোসও গগনেরই জ্যাঠতুতো ভাই, অথচ কত তফাত। ছেলেটার কি সত্যি মাথা খারাপ বলে মনে হয় তোমার চক্রবর্তী?
চক্রবর্তী বললেন, বুঝতে পারি না ভটচায মশাই।
জীবনকৃষ্ণ ডাকলেন, ওহে, ও গগন, বলি অত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছ?
গগন মুখ না তুলেই বলল, কেন বলুন তো?
–বলই না কী পড়ছ?
বঙ্গসিন্ধু পড়ছি। কোনও কাজ আছে নাকি?
নীরস গলায়, প্রায় রুক্ষুস্বরে জিজ্ঞেস করল গগন। জীবনকৃষ্ণ বললেন, আরে না, আজ আর কাজ কোথায়? কী পড়ছ বঙ্গসিন্ধুতে একটু বলল না শুনি, আমরা কি জানতে পারি না?
গগন মুখ তুলে তাকাল। এমনিতে তার গজ চোখ নয়। কখনও কখনও তার কালো বড় বড় চোখ দুটি গজ চোখ বলে মনে হয়। চুলে কোনও রকমে একটা সিঁথি কাটা হয়। বাকি চুল যেন খালের দু পাশে এবড়ো খেবড়ো মাটির মতো এলোমেলো উঁচু। গোঁফ রাখলে কী হবে, খোঁচা খোঁচা দাড়ির জন্যে গোঁফজোড়া বেশ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। সে সন্দিগ্ধ চোখে জীবনকৃষ্ণের দিকে তাকাল। দেখল, পিছনে লাগবার জন্যে ডাকছেন কি না। বলল, ফরাসি বিপ্লবের কথা পড়ছি।
চক্রবর্তী অস্ফুটে বলে উঠলেন, বুঝুন এখন! এ নয়, সে নয়, একেবারে ফরাসি বিপ্লব!
জীবনকৃষ্ণ কিন্তু সে কথায় কান দিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, সেটা আবার কী গগন, এখন ফরাসি বিপ্লবের কথা লিখেছে কেন?
–ওই যে ফ্যাস্তা হচ্ছে, সেই জন্যে।
–ফ্যাস্তার সঙ্গে বিপ্লবের কী সম্পর্ক হে?
গগনের বিরক্ত সন্দিগ্ধ দৃষ্টি বিদ্ধ হল আবার জীবনকৃষ্ণের উপর। বলে উঠল, কেন মিছিমিছি আমাকে জ্বালাতন করছেন মশাই? আপনাদের অসুবিধে হলে না হয় আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।
গগন চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেল। গোপাল মনে মনে বলে উঠল, হে ভগবান, পাগলাটাকে আরও খেপিয়ে দাও, তা হলে আপনা থেকেই সব ভেঙ্গে পড়বে। নারদ নারদ নারদ নারদ, লেগে যা, লেগে যা।
কিন্তু জীবনকৃষ্ণ তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে গগনের হাত ধরলেন। বললেন, আরে তুমি চটছ কেন, আমি জানি না বলেই যে জানতে চাইছি হে, বিশ্বাস করো।
গগন তেরিয়া হয়ে বলল, আপনি জানতে চান?
জীবনকৃষ্ণ স্নিগ্ধ হেসে বললেন, সত্যি জানতে চাই। ফরাসি বিপ্লবই বা কী, ফ্যাস্তাই বা কীসের, কিছুই জানি না। তুমি একটু পড়ে শোনাও না, বাঁড়ুজ্জে কী লিখেছে শুনি।
গোপাল রুদ্ধশ্বাসে বলে চলেছে, নারদ নারদ নারদ।
কিন্তু গগন তীক্ষ্ণ চোখে জীবনকৃষ্ণের দিকে তাকাল। মোটেই হাত-পা ছুড়ল না। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, বেশ, একটা বঙ্গসিন্ধু দিচ্ছি, পড়ে নিন, তা হলেই সব বুঝতে পারবেন।
-কেন, তুমিই পড়ে শোনাও না। যেটা বুঝতে পারব না, সেটা জিজ্ঞেস করে নেব। তোমরা অনেক পড়-টড়, খোঁজখবর রাখ, সব জান। কাজ যখন হলই না, একটু জ্ঞানবৃদ্ধিই হোক।
গগন ক্রমেই বিস্মিত হচ্ছিল। কিন্তু সাহস বাড়ছিল না। রামদাস বাঁড়ুজ্জের প্রবন্ধ তাকে এমনিতেই উত্তেজিত করে তুলেছিল। ভাষা, লিখনভঙ্গি ও বিষয়বস্তু, সবই তার এত ভাল লাগছিল, এই সময় একজন শ্রোতা পাওয়া পরম ভাগ্য বলে মনে হল তার। তবু সন্দেহ ঘুচতে চায় না। সে কালো বড় বড় চোখে, বারেবারে জীবনকৃষ্ণের দিকে তাকাতে লাগল। নাকের ছিদ্র দিয়ে যে নস্যের গলিত রস প্রায় গোঁফ অতিক্রম করার উদ্যোগ করেছে, তাও তার খেয়াল নেই। বলল, সত্যি শুনতে চান?
-হ্যাঁ। এই গোপাল, গগনের কাছে আমাকে একটা কুরসি দে তো বাবা।
গোপাল মনে মনে বলল, যাঃ শালা! সবাই খেপে উঠল?
সে তাড়াতাড়ি একটা চেয়ার এগিয়ে দিল। ওদিকে চক্রবর্তীর অবস্থাও প্রায় গোপালের মতোই। জীবনকৃষ্ণ যে সত্যি এমন করে বসে পড়বেন, উনি ভাবতে পারেননি। বললেন, আপনি যে বলছিলেন, ফ্যাস্তা দেখতে যাবেন–ফরাসডাঙায়?
জীবনকৃষ্ণ বললেন, যাব হে যাব, এটা আগে শুনে নিই। গগনও তো যাবে, কী বলো হে?
গগন বলল, তা যেতেও পারি।
চক্রবর্তী বিস্মিত হলেন। বিরক্তও। এখন বসে বসে রাম বাঁড়ুজ্জের ফ্যাস্তা শুনতে হবে? ছ্যাঃ, তার চেয়ে কারখানা থেকে পঁচিশ পাউন্ড চোরাই সুতোর বান্ডিলটা ভাণ্ডার সঙ্গে বেচতে গেলেই ভাল হত। কাজটা মিটে থাকত। এর মধ্যে তো একদিন সেই সুতোর গতি করতেই হবে। আজ বেশ ফাঁকায় ফাঁকায় হয়ে যেত।
গোপাল আর পারল না। ফরাসডাঙার ফ্যাস্তার নিঃশব্দ ডাক তাকে পাগল করে তুলল। সে জীবনকৃষ্ণকে বলল, বড়বাবু, আপনারা কি তবে এখানেই বসবেন? ২৩৪
জীবনকৃষ্ণ বললেন, হ্যাঁ, তাই তো ভাবছি। কেন, তুমি যাবে?
-আজ্ঞে আপনার দয়া হলে যাই। বাড়িতে সব বসে আছে কিনা, ফ্যাস্তা দেখতে যাবে।
–বেশ যাও, সব আলমারি বন্ধ করে আমাকে ঘরের চাবি দিয়ে যাও, আমি বন্ধ করে দরোয়ানকে চাবি দিয়ে যাব এখন।
গোপাল একেবারে ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিল।
গগন বলল, একেবারে প্রথম থেকেই পড়ব?
–নিশ্চয়। নইলে বুঝব কেমন করে?
গগনের মুখখানিই শুধু ঝকঝকিয়ে ওঠেনি, চোখ দুটিও চকচকিয়ে উঠেছে। নাসারন্ধ্র পর্যন্ত স্ফীত। সে প্রায় কম্পিত গলায় পড়তে আরম্ভ করল।
বঙ্গসিন্ধু। ২৯ আষাঢ়, সাল ১২৮৯ বঙ্গাব্দ, ১৪ই জুলাই, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ।
চন্দননগরের বর্তমান ফায়স্তা ও ফরাসি বিপ্লব।
আমরা এতদ্দেশীয় অধিবাসিগণ কয়েক বৎসর যাবৎ ফরাসি অধিকৃত চন্দননগরে ফায়স্তা উৎসব দর্শন করিয়া আসিতেছি। বোয়রবন ও বোনাপার্ত স্বৈরতান্ত্রিক রাজা ও সম্রাটদের উৎপাত গত হইয়া, ফরাসি দেশে বর্তমানে তৃতীয় রিপাব্লিক প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। যদিও।
জীবনকৃষ্ণ বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, ওই তৃতীয় রিপাব্লিক বস্তুটা কী গগন?
গনন থমকে গিয়ে এক মুহূর্ত ভাবল। বলল, মানে, তৃতীয় রিপাব্লিক হল রাজা বা সম্রাট ছাড়া, জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে যে শাসন চালানো হয়, ফরাসিরা তার নাম দিয়েছে রিপাব্লিক। একজন প্রেসিডেন্ট, একটি সিনেট আর ডেপুটিদের একটি চেম্বার-এর সকল সদস্য মিলে দেশ শাসন করেন এঁরা। এর আগে দুবার রিপাব্লিক হয়েছিল, দুবারই ভেঙে গেছে। তৃতীয় রিপাব্লিকের যুগ চলেছে।
জীবনকৃষ্ণ চোখ বুজে শুনলেন, এবং চোখ বুজেই বললেন, অর্থাৎ দেশের লোকেরা রাজাকে সরিয়ে, নিজেরাই নিজেদের ভাল মন্দ দেখছে এই তো?
–হ্যাঁ ।
–তার নাম রিপাব্লিক?
–হ্যাঁ, প্রজাতান্ত্রিক।
বেশ বেশ, এবার পড়ো।
গগন আবার পড়তে আরম্ভ করল, যদিও এই তৃতীয় রিপাব্লিক রাষ্ট্রকে ধ্বংস করিবার জন্য রাজতান্ত্রিক ব্যক্তিরা সর্বদাই ঘৃণ্য প্রয়াস পাইতেছে, তথাপি তাদের প্রয়াস বারংবার ব্যর্থ করিয়া রিপাব্লিক জীবিত রহিয়াছে। এবং বর্তমান চন্দননগরের শাসকবর্গ স্বদেশীয় তৃতীয় রিপাব্লিকের অনুমত্যানুসারে প্রতিবৎসর এই ফায়স্তার ব্যবস্থা করিয়াছেন। পাঠকগণের জ্ঞাতার্থে জানান যাইতেছে, ফায়স্তা একটি বিদেশি শব্দ, উহার ইংরাজি বানান Fiasta শব্দের অর্থ উৎসব।
কিন্তু কীসের উৎসব কেন উৎসব, অতীব পরিতাপের বিষয়, তাহা অধিকাংশ এতদ্দেশীয়গণের অজ্ঞাত। ইহার ভিতর ইতিহাসের যে অমোঘ নিয়তি লীলাখেলা করিয়াছে, তাহা ভারতীয়গণের গোচরীভূত করা বিশেষ আবশ্যক মনে করি। চন্দননগরের ফরাসিস শাসকবর্গের ইহা ব্যাখা করিবার কোনও প্রয়োজন হয় না, তাঁহারা নিজেরা উৎসব করিয়া, অপরকে মাতাইয়া, আপনার রাজ্যে শান্তিতে বিরাজ করিতেছেন, কিন্তু আমরা বিচার করিয়া, বিলক্ষণ জানিবার চেষ্টা করি না, ইহা কীসের উৎসব, কীসের ফায়স্তা, ইহাতে আমাদিগের আনন্দের কারণ কী। আমরা সকলে মিলিয়া, মদ খাইয়া খেমটা নাচাইয়া, বুলবুলি লড়াইয়া সাপ খেলাইয়া, বহুবিধ প্রমোদ করিয়া, রাত্রে বাজি পুড়ানো পর্যন্ত আনন্দের রস আকণ্ঠ পান করিয়া, স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করি ও ভাবিয়া সুখী হই, ফায়স্তাটি বড়ই আমোদে কাটিল।
কিন্তু এই উৎসবের অন্তর্নিহিত অর্থ অতীব গভীর, এই ইংরাজি ১৪ই জুলাই দিবস সেইজন্যই ফরাসিসদিগের নিকট এত আনন্দপূর্ণ ও পবিত্র। ইহা তাঁহাদিগের নিকট অতিভয়ংকর নারকীয় জীবন যন্ত্রণা হইতে, পরাধীনতার গ্লানিকর অন্ধকার হইতে, মুক্তির দিবস বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে, ফরাসি দেশের জনসাধারণ স্বাধীনতা সাম্য ও মৈত্রেয়ীর নামে যে ভীষণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন, ইহা সেই দিবস। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই জুলাই, অত্যাচারী রাজা ও অভিজাত ধনীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হইয়া ফরাসির নিপীড়িত দরিদ্র জনতা, রাজধানী পারিতে অবস্থিত কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গ ধ্বংস করিয়াছিলেন, সেই উপলক্ষেই, এই দিবসকে তাঁহারা পুণ্য বাস্তিল দিবস বলিয়া থাকেন, সেই উপলক্ষেই চন্দননগরের এই ফায়স্তা। অতএব ইহা আনন্দের দিন বটে, কিন্তু এতদ্দেশীয়গণের স্মরণ রাখিতে হইবে, শতাব্দীব্যাপী নিষ্ঠুর পীড়ন, বহু শত প্রাণ ও রক্ত দিয়া এই দিবসের সমুদয় আনন্দকে তাঁহাদিগকে ক্রয় করিতে হইয়াছে। আমরা মনে করি, নিপীড়িত অত্যাচারিত বিশ্ববাসী মাত্রেরই এই দিবস অতি পুণ্যদিবস বলিয়া গণ্য হইবে, কিন্তু তাহা বাঁচাল আনন্দের দ্বারা অনুভব করা যাইবে না। আমরা জানি ইহাকে পুণ্য দিবস বলিয়া বর্ণনা করায় কেহ কেহ আপত্তি করিবেন, পূর্বে পূর্বে আমরা সেই প্রকার রচনাদি পাঠ করিয়া অবগত হইয়াছি। তাঁহারা এইরূপ ব্যক্ত করিয়া থাকেন যে, বিপ্লবের সেই দিবস অতীব কলঙ্কজনক দিবস বলিয়া জগতে গণ্য হইবে, কারণ রাজা বহু রাজপুরুষকে বলি দিয়া রক্তপাত ঘটাইয়া, অজ্ঞ-জনতা বীভৎস নিষ্ঠুরতা দর্শাইয়াছিল। আমরা এইরূপ মনে করি না। বহু রক্তপাত হইয়াছিল সত্য, কিন্তু তৎপূর্বে যে পরিমাণ রক্তপাত রাজপুরুষেরা ঘটাইয়াছিলেন, মানুষকে পশুবৎ পীড়ন করিয়াছিলেন, তাহার তুলনায় উহা বেশি নহে। এক্ষণে আমাদিগকে যদি কেহ প্রশ্ন করেন, সেই রক্তপাতের দিবসকে স্মরণ করিয়া বিশ্ববাসীর আনন্দ করিবার কী আছে, তবে বলি, ঘোর কৃষ্ণা কালী করালী দেবীর পূজা সেইরূপ ভীষণতার মধ্যেও হৃদয়ের অজ্ঞতা দূরীকরণের উৎসব আমোদ বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে, এই দিবসও সেইরূপ সুখকর। ইহাতে ঘোর তমসা ও পশুবলি দেখিয়া আতঙ্কিত হইবার কিছু নাই।
জীবনকৃষ্ণ অস্ফুটে বলে উঠলেন, বাঃ, বাঁড়ুজ্জে উপমাটি বেশ দিয়েছে, কী বলল হে গগন?
গগন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। সে শুনতে পায়নি। জীবনকৃষ্ণ আবার চেঁচিয়ে বললেন, উপমাটি বেশ ভালই দিয়েছে বাঁড়ুজ্জে। ওই যে তোমার কালীপুজোর সঙ্গে তুলনা করেছে, সেই কথা বলছি।
গগন এতই মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল, এতই উদ্বুদ্ধ এবং উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, জীবনকৃষ্ণের কথায় তার কোনও ভাবান্তর হল না। তাড়াতাড়ি কাঠের ডিবে থেকে এক দলা নস্য পুরে দিয়ে, আবার কাগজের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। পড়তে আরম্ভ করল, যাহা হউক। ফরাসি দেশের কী অবস্থায় সেই ১৪ই জুলাই দিবসের উদ্ভব হইয়াছিল, ইতিহাস হইতে তাহাই আমরা পাঠকবর্গের সম্মুখে উপস্থিত করব। ইহাতে সেই অজ্ঞ-জনতার কতখানি দোষ ছিল, তাহা সহজেই অনুমতি হইবে। সেই অজ্ঞ জনতা অর্থাৎ প্রজাসাধারণের সহ্য করিবার ক্ষমতা ও রাজশক্তির উপর বিশ্বাস এতই প্রবল ও সীমাহীন ছিল যে, অত্যাচারীরা কখনও ভাবিয়া দেখে নাই, সকল কিছুরই একটা সীমা আছে।
প্রধানত বিভিন্ন প্রকার জনসাধারণকে শোষণ করিয়া, বিভিন্ন প্রকারের কর আদায় করা ছিল, বিবিধ নিয়মতান্ত্রিক নিষ্ঠুর প্রথা। যে কারণে ফরাসি দেশে, তৎকালে একটি প্রচলিত প্রবচনই ছিল– উচ্চবংশীয় অভিজাত সম্ভ্রান্তরা যুদ্ধ করিয়া থাকে। যাজক ও পুরোহিতেরা প্রার্থনা করিয়া থাকে, আর জনসাধারণ কেবলমাত্র কর দিয়া থাকে। ফরাসি দেশে তখনও শিল্পের উদ্ভব হয় নাই, জনসাধারণের অধিকাংশই কৃষিজীবী, এবং কৃষিজীবী জনতার একমাত্র বাঁচিবার প্রয়োজন হইয়া উঠিয়াছিল, রাজশক্তি, অভিজাত ও ধর্মযাজকদের অপরিমিত সুখ ও সম্ভোগের উপকরণ জোগাইতে। ব্যবস্থাপক পরিষদ ছিল নামে মাত্র, শেষ পর্যন্ত তাহাও পরিত্যক্ত হইয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে ফরাসি দেশের তৎকালীন অবস্থা জ্ঞাত হইতে হইলে একটি কথা বিশেষভাবে লক্ষ রাখিতে হইবে যে, একটি সামাজিক শাসনতান্ত্রিক নিয়ম-কানুন, শৃঙ্খলার পরিবর্তে, সেখানে দুইটি রাজনৈতিক ধারা প্রবাহিত হইতেছিল, যাহাদের রাহুর ক্ষুধা ও বিচারবিবেচনাহীন সুখভোগের লক্ষ্য ছিল অদ্বিতীয়, সেই দুই ধারার নাম, রাজকীয় ও অভিজাত। অভিজাতদের সঙ্গে অবশ্যই ধর্মযাজক সম্প্রদায় যুক্ত ছিল, বলাবাহুল্য। এই দুই রাজনৈতিক ধারার কাছে, আইনের মূল্য একটি কানাকড়িও ছিল না, সুবিচার দূরে থাকুক, সাধারণ বিচার ছিল পদদলিত। ইহার মধ্যে, অভিজাত সম্প্রদায় ছিল নিষ্ঠুরতম। তাহাদিগের লোভ ও লালসা কোনও রীতিনীতিই মানিত না। এমনকী রাজাও ইহাদের ভয় করিয়া চলিতেন, কারণ তাঁহার নিজের নিরাপত্তা ও সুখের জন্য, এই শ্রেণীকে তিনি পার্শ্ববর্তী রক্ষক ব্যাঘ্রের মতো লালন-পালন করিতেন ও প্রশ্রয়দান করিতেন। সেই সব ব্যাঘ্রবৃন্দ বহুকাল রক্তদান করিতে অভ্যস্ত হইতেছিল, দুর্দিন যত নিকটবর্তী হইয়া আসিয়াছিল, তাহাদের রক্তপানের তৃষ্ণাও তত বাড়িতেছিল। তখন তাহারা আর রাজাকেও মানিয়া চলিতে পারিতেছিল না, বরং লোভের প্রতিযোগিতায় মাতিয়া, রাজার নিজস্ব ভোগ্যও আপন গ্রাসে উদরস্থ করিতেছিল। রাজাকে তাহারা নিজেদের হাতের ক্রীড়নকে রূপান্তরিত করিয়াছিল, এবং রাজশক্তির দুর্বলতায়, ক্রীড়নক না হইয়া কোনও উপায়ও ছিল না। ব্যবস্থাপক পরিষদ ভাঙিয়া দিবার পুর্বেই, ইহা পরিষ্কার হইয়া উঠিয়াছিল যে, তৎকালে ফরাসি রাজশক্তি মাত্র ত্রিশজন ব্যবস্থাপক (intendants) দ্বারা পরিচালিত হইতেছিল। বলাবাহুল্য, সেই ত্রিশজন ব্যবস্থাপক সকলেই অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত লোক। প্রদেশগুলিতে ইহায়া যারা খুশি তাহাই করিত। পরিষদ, মন্ত্রণা, বিচার, আইন, সবকিছুই ইহাদের ইচ্ছামতো চলিত, এবং প্রজাসাধারণের নিকট ইহারা ছিল সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত, ইহাদের ইচ্ছাই ছিল মানুষের জীবন মৃত্যু। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের ইহা এক বীভৎস রূপ, এবং যেখানে শাসন ও বিচার বিভাগের এই প্রকার দশা, সেখানে রাজা যে পরিষদ ও মন্ত্রীবর্গের ও ধর্মযাজকদের হাতের ক্রীড়নক মাত্র হইবেন, তাহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। বিশেষ করিয়া রাজা যেখানে প্রজার শুভ ও মঙ্গল কামনা করেন না, নির্বীর্য সুখের লালসায় নানা প্রমোদে কাল যাপন করিয়া থাকেন, তাঁহাকে শয়তানের হাতের অসহায় যন্ত্ররূপে আপন ভাগ্য মানিয়া লইতেই হইবে। অন্যথায়, রাজা যখন রাজকোষ শূন্য দেখিয়া, ধর্মযাজকদের নিকট সঞ্চিত প্রভূত স্বর্ণ, অর্থ ও সম্পত্তির কিছু অংশ প্রার্থনা করিয়াছিলেন, তখন ধর্মযাজকেরা এইরূপ উত্তর করিত না, ঈশ্বর ও রাজার মধ্যে আমরা কাহাকে বাছিয়া লইব, তাহা আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিও না কারণ তোমরা নিশ্চয়ই জ্ঞাত আছ, আমাদিগের জবাব কী হইবে। ইহার অর্থ আর কিছুই নহে, স্পষ্ট ও সোজা করিয়া রাজাকে প্রত্যাখ্যান মাত্র। শুধু তাহাই নহে, এই কথার মধ্যে একটি সুপ্ত গর্জনও শুনা যাইতেছে, যাহাতে ইঙ্গিত করা হইয়াছে, গির্জার সম্পত্তি গ্রহণে রাজা কোনওরূপ জোর করিলে, তাহারা বিদ্রোহ করিবে। অথচ সেই বিশাল সম্পত্তি যে ঈশ্বর স্বর্গ হইতে আপন বাহু বাড়াইয়া ভোগ করিতেন না, তাহা বুদ্ধিমান ব্যক্তিমাত্রেরই বুঝিবার ক্ষমতা আছে। প্রকৃতপক্ষে ধর্মযাজকরাও পঙ্কিল ভোগের স্রোতে ভাসিতেছিল, দেবালয়গুলি ইহাদের পাপচক্রের সঙেঘ পরিণত হইয়াছিল, এবং যেহেতু জনসাধারণের মনে তাহারা ঈশ্বর সম্পর্কে নানান অলীক ভয়ের ও কুসংস্কারের সৃষ্টি করিতে পারিয়াছিল, এবং নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিভূ বলিয়া চালাইতে সমর্থ হইয়াছিল, সেই হেতু রাজা তাহাদের বিরুদ্ধাচরণ করিতে সাহসী হন নাই। যে রাজা ও শাসক প্রজাসাধারণের মনের সংবাদ রাখেন না, তাহাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন না, শুভাশুভের ধার ধারেন, তাঁহাকে অতএব আপন স্কন্ধ গুটাইয়া সরিয়া আসিতেই হইবে। রাজা যদি তাঁহার সুখ ও সম্পত্তির কারণ বলিয়া প্রজাদের বিবেচনা করিতেন, তাহা হইলেও তাঁহার কিছু কণামাত্র করুণা থাকিত। যে কলু ঘানিতে তৈল নিষ্কাশন করিয়া থাকে, সেও তাহার বলদকে পেট পুরিয়া খাইতে দিয়া থাকে, কিন্তু রাজা তাহাও দিতে অপারগ ছিলেন। কারণ, এই প্রকার শাসনের দরুন, প্রজাসাধারণকে শোষণের স্বভাবতই কোনও সীমা পরিসীমা থাকিতে পারে না।
সাধারণত মাথা পিছু একজন ব্যক্তির জন্যেই পোল ট্যাক্স ধার্য হইত, শতকরা তেপান্ন লিরা। যাজক ও পুরোহিতদের প্রাপ্য হিসাবে, শস্য ফসলের বিশ ভাগ দিয়া দিতে হইবে, এবং মনে রাখিতে হইবে, সাধারণ মানুষ সকলেই কৃষিজীবী। দেখা গিয়াছে, বিপ্লবের সময়, একমাত্র এই কারণেই প্রজাসাধারণের বিরুদ্ধে চারি লক্ষ মামলা ঝুলিতেছিল। ইহার উপরে গির্জাকে দিতে হইত আয়ের দশমাংশ, যাহাকে বলা যায়, চার্চের সমগ্র খরচই তাহাদের বহন করিতে হইত। সম্ভ্রান্ত ও অভিজাতদের দিতে হইত তাঁহাদের জায়গীর কর, যাহাকে বলা হইয়া থাকে ফিউডাল ডিউজ। তাহা ছাড়া রাজকর সমুদয় প্রজাসাধারণের দেয় ছিলই। এমনকী, রাজা ও অভিজাতদের মৃগয়াস্থানগুলি, যেখানে বন্য বরাহ, হরিণ পাখি ইত্যাদি ছিল, সেই সব স্থানসমূহ কঠিন আইন দ্বারা শুধু সংরক্ষিতই ছিল না, রক্ষণাবেক্ষণের সমগ্র খরচ জনসাধারণকেই দিতে হইত, অথচ সেইস্থানে তাহাদের শিকারের অধিকার ছিল না। এই শিকারের অধিকারও অত্যন্ত ঘৃণ্য বলিয়া গণ্য হইত। বেগার প্রথা তো ছিলই।
এখন, অভিজাত ও ধর্মযাজক সম্প্রদায়ের যাঁহারা এই সব কর আদায় করিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাঁহারা যে কেবল নিয়মানুযায়ী কর আদায় করিয়াই ক্ষান্ত হইতেন, তাহা নয়, নানান ফন্দি ফিকির করিয়া, যদৃচ্ছা আদায় করিতেন, এবং যথেচ্ছা আদায়ীকৃত করের সমুদয় অর্থ কখনই রাজকোষে জমা পড়িত না। তাঁহাদের নিজেদের দেয় কর তো কখনওই দিতেন না, উপরন্তু তাহারা নিজেরাই সেই অর্থ আত্মসাৎ করিয়া ভোগ করিতেন, বিলাসমত্ত রাজা ইহার কোনও খবর করিতেন না। রাজা যদি চোখ মুদিয়া থাকেন, তবে সেই দেশের প্রজাদের উপায় কী থাকে। ক্রীতদাস অপেক্ষাও ফরাসি প্রজাসাধারণের অবস্থা সঙ্গীন হইয়াছিল। অনেকে এইরূপ বলিয়া থাকে, প্রজারা ক্রীতদাস ছিলেন না, নিজেরাই জমির মালিক ছিলেন।অতি উত্তম কথা, কিন্তু দেশের কৃষিযোগ্য সমগ্র জমির এক চতুর্থাংশ মাত্র, এবং জমি থাকিলেই প্রজার সুখ হয় না। বাঁচিবার রসদ সংগ্রহ করিতে হয়। জমি চাষ করিতে হইলে যাহা যাহা প্রয়োজন, তাহা সকলই মুষ্টিমেয় প্রভুদের হাতে ছিল। অধিকাংশ জলাশয়, যন্ত্রপাতি ও পশু, প্রভুদিগের সম্পত্তি। গম ভাঙিবার কল, আঙুর নিংড়াইবার মেশিন, রুটি গড়িবার বিশেষ ব্যবস্থাযুক্ত উনানঘর, সকলই, অভিজাত, অমাত্য, ধর্মযাজক প্রভুদের হাতে। অতএব, গম ভাঙানো, রুটিগড়া, আঙুর নিংড়ানো, সবকিছুর জন্যে তাহাদের কাছে যাইতে বাধ্য করা হইত এবং ইহার জন্যে যাহা খুশি মূল্য আদায় করা হইত। ফসল ও অন্যান্য দ্রব্য বিক্রয় করিবার কেন্দ্র বাজার সকলও প্রভুদের করায়ত্ত। এত উচ্চহারে তাহার তোলা দিতে হইত যে ফসলের মূল্যে কুলাইত না। আঙুরজাত মদ্য প্রজারা তৈরি করিত, কিন্তু সমগ্র জেলার একচেটিয়া ব্যবসা ছিল একমাত্র সামন্ত প্রভুদিগের। শুধু তাহাই নহে, রাস্তাঘাট সেতু পর্যন্ত এই সব মুষ্টিমেয় পরিবারেরা নিজেদের সম্পত্তিরূপে ভাগ করিয়া লইয়াছিলেন এবং চলাচলের জন্যে যদৃচ্ছা কর আদায় করিতেন। লবণ ছিল রাষ্ট্রের নিজস্ব একচেটিয়া ব্যবসা, নিয়ম ছিল, পরিবারের প্রত্যেকের জন্যে বৎসরে সাত পাউন্ড লবণ ক্রয় করিতেই হইবে। সাত বৎসরের শিশুরও ইহা হইতে রেহাই ছিল না। ইহাকে বলা হইত কুখ্যাত লবণ কর। এক কথায়, প্রজাদের সমস্ত কিছু ইহারাই শুষিয়া লইতেন, এবং প্রজাদের অসহায় বুভুক্ষু চক্ষের সমক্ষে ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকিতেন। ইহার জন্যে কাহারও নিকট নালিশ করিবার উপায় ছিল না। রাজার কাছে অভিযোগ পৌঁছাইলেও তিনি কর্ণপাত করিতেন না, এবং ঈশ্বরকেও ধর্মব্যবসায়ী যাজকেরা এমনভাবে কুক্ষিগত করিয়া রাখিয়াছিলেন, যেন ঈশ্বরকে রাজার ন্যায় তাহাদের হাতেরই ক্রীড়নক, দারিদ্রের নালিশ তিনিও শুনিতে চাহেন না। এবং তৎসত্ত্বেও যদি কেহ প্রকাশ্যে অভিযোগ করিত, তবে কারাগারের অন্ধকারে তাহাকে ঠেলিয়া দেওয়া হইত। এমনকী অনেক সময়, কোনওপ্রকার কারণ না দর্শাইয়াই তাহাদিগকে দলে দলে কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গের ভয়ংকর কারাগারে আটক করিয়া রাখিত। হেবিয়াস কর্পাস আইন থাকা সত্ত্বেও, তাহার দ্বারা কেহ বিচার প্রার্থনা করিতে পারিত না। কারণ জানিতে চাহিলেও শাস্তি ছিল, উপবাস, প্রহার ও অপমান। তখন বাস্তিল দুর্গের নাম করিলে প্রজাবৃন্দের হৃঙ্কম্প উপস্থিত হইত। দুর্গের দিকে চাহিলে ভয়ে ঘৃণায় অভিশাপ দিয়া চোখ ফিরাইয়া লইত।
একদিকে যখন প্রজাবৃন্দের এইরূপ অবস্থা, তাহার জন্যে যাহারা দায়ী, সেই উচ্চবংশীয় অভিজাতরা তখন রাজকোষ হইতে উচ্চহারে পেনসন ভোগ করিতেছিলেন, রাজসভা অলংকৃত করিতেছিলেন। পারি ও ভার্সাই প্রাসাদে এই সব প্রভুরা যখন ভোগের সাগরে ডুবিয়া রহিয়াছেন, প্রজাবৃন্দ তখন এদেশে রাস্তার কুকুরের ন্যায় পচিয়া মরিতেছিলেন। আর হায় ধর্ম! যাঁহারা অজ্ঞ প্রজাদিগকে ঈশ্বরোপলব্ধি করাইবেন, সেই কয়েকজন ধর্মযাজকের হাতেই ছিল সমগ্র দেশের তৃতীয় ভাগ ভূমি, এবং সেই যাজকেরাও উচ্চ অভিজাত বংশ হইতেই নির্বাচিত। সেই সমগ্র জমি প্রায় সকলই ছিল নিষ্কর। তাঁহাদিগের শরীরে দয়া ধর্মের লেশমাত্র ছিল না। ধর্ম তাঁহাদিগের একপ্রকার ঘানি ঘুরাইবার কল, গরিব জনতাবৃন্দকে ইহারা সর্ষপের মতো ফেলিয়া নিংড়াইয়া আপনাদিগের সুখোপকরণের তৈল সংগ্রহ করিতেন। ভোগ বাসনা পাপাচারকেই এই যাজকেরা জীবনের ধর্ম বলিয়া বুঝিয়াছিলেন।
এই পর্যন্ত পড়ার পর গগনকে থামতেই হল। উত্তেজনায় তার গলার স্বর এত তেজি আর দ্রুত হয়ে উঠেছে, উচ্চারণ প্রায় অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। তা ছাড়া একদিকে নাসারন্ধ্র থেকে নস্যের দরানি, অন্যদিকে মুখের কষের দুপাশে লালার গাঁজলা, অসুবিধের সৃষ্টি করছে। পকেট থেকে রুমাল নামক বস্তুটি বের করে সে তাড়াতাড়ি নাক মুছে নিল। কোঁচার অংশ দিয়ে মুখ মুছল।
ইতিমধ্যে কখন এক সময় বিপিন চক্রবর্তীও কাছে এসে বসেছিলেন। গগনের উচ্চারণ ভাল, পড়বার সুর ও ভঙ্গিটিও চমৎকার। আর এ শুধু পড়া নয়। বিষয়বস্তুর প্রতিটি শব্দ যেন তার অনুভূতিকে আন্দোলিত করছে। ঘৃণায় এবং ধিক্কারে, তার মুখ জ্বলজ্বল করছে। রামদাসের লেখার গুণে নয়, যেন গগনের পড়বার ভঙ্গিতেই চক্রবর্তী মজেছেন। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, এ যে ইংরেজদের থেকেও খারাপ হে গগন।
গগন বলে উঠল, ও সবই এক গোত্রের। উনিশ আর বিশ।
জীবনকৃষ্ণ বললেন, কিন্তু ওদের দেশে তো রাজা প্রজা সবাই ফরাসি, ওটা তো আর পরাধীন দেশ নয়। ওখানেও এরকম অত্যাচার হত?
গগন বলল, এই একটা ব্যাপারে সব শিয়ালের এক রা। কেন, ইংলন্ডের রাজা প্রথম চার্লসের বেলায় সেখানেও, রাজায় প্রজায় মারামারি হয়নি? অলিভার ক্রমওয়েলের কথা পড়েননি? উনিই তো নেতা ছিলেন।
জীবনকৃষ্ণ অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বললেন, না তো, সেই সব আর পড়লুম কোথায়। তুমি বলছ ইংরেজ রাজা ইংরেজদের ওপরেই পীড়ন করত?
প্রশ্নটা বিপিন চক্রবর্তীরও। তাঁর দুই ভ্রুকুঞ্চিত জিজ্ঞাসু চোখের সঙ্গে, হাঁ মুখের ভিতর দিয়ে যেভাবে জিভ বেরিয়ে পড়েছে, তাতে মনে হয় এমন বিস্ময়কর কথা চক্রবর্তী কখনও আন্দাজ করতে পারেননি।
গগনের বোধহয় আর একবার সন্দেহ হল, সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল তার চোখ। জীবনে যাঁরা কোনওদিন এ সব প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেননি, ফোর্ট গ্লাস্টারের তেসুতি কলের সেই বড়বাবু আর সেজোবাবু, দুই ঠাকুর তার সঙ্গে চিরাচরিত মশকরা করছেন না তো! নইলে যে সংবাদ এখন স্কুলের ছোট ছোট পড়ুয়ারাও জানে, ইতিহাসের সেই সংবাদ কি এরা সত্যি জানেন না! সে গম্ভীর হয়ে বলল, তা পীড়ন করত বইকী, নইলে কি আমি মিছে কথা বলছি?
জীবনকৃষ্ণ হাত তুলে বললেন, এই তোমার এক দোষ গগন, মাথাটি বড্ড তাড়াতাড়ি গরম করে ফেল। তুমি একটা হুগলির কলেজে পড়া ছেলে, তুমি কত কী জান। আমি জানলে কি আর তোমার কাছে শুনতে চাইতুম?
গগন মনে মনে একটু অপ্রতিভ হল। একটু লজ্জাও পেল। জীবনকৃষ্ণের মুখে কোথাও ছলনার আভাস ছিল না।
জীবনকৃষ্ণ আবার হঠাৎ সনিশ্বাসে বলে উঠলেন, কিছুই তো জানলুম না হে, আজকাল সবকিছু জানবার জন্যে মনটা কেমন আঁকুপাঁকু করে। বাপ পিতাম, অত করে স্মৃতিশাস্ত্র পড়ালে, আর এখন যে কেনই বা এতসব জানতে ইচ্ছে করে!…
অবাক হন চক্রবর্তী। ভটচাযের যেন কোথায় কী ঘটে গিয়েছে। লোকটা সত্যি আর আগের মতো নেই। এ বয়সে কি সত্যি মানুষটার ভীমরতি হল?
গগন লজ্জা পেল, কিন্তু প্রায় ক্ষমা চাইবার মতোই টেবিলে আঙুল ঘষতে ঘষতে বলল, আজ্ঞে না, মানে বলছিলুম কী যে, ইংরেজ রাজাও তার দেশের লোকদের সত্যি সত্যি পীড়ন করত। আজকাল তো বইও বেরিয়েছে, বাংলা বই, তার মধ্যে সব লেখা আছে।
-তোমার কাছে আছে সে বই?
আছে।
–একটু দিও তো, পড়ব।
–আজ্ঞে দেব। পড়ে দেখবেন, বিলেতের রাজা দ্বিতীয় জেমসের বেলাতেও প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল, বিপ্লব যাকে বলে।
চক্রবর্তী বললেন, কিন্তু গগন, ফরাসিদের কথা তুমি যা পড়ছ, তাতে বাপু বোঝা যাচ্ছে, ইংরেজ অনেক সদয়। বিদেশি হয়েও তারা আমাদের ওপর জুলুম করে না।
গগন তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে বলল, আপনি তা হলে কিছুই জানেন না চক্কোত্তি মশাই। এ দেশে রাজপুরুষ সাহেবের কুকুরের পেছনে মাসে মাসে যা খরচা হয়, আপনার মাস মাইনের থেকে তা বেশি, খোঁজ নিয়ে দেখুন গে।
চক্রবর্তী একটু যেন থতিয়ে গেলেন। জীবনকৃষ্ণ আপন মনে, আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়তে লাগলেন। কিন্তু চক্রবর্তী সহসা হার মানতে পারলেন না। বললেন, কিন্তু ফরাসিদের ধর্মযাজকেরাও যেরকম পাষণ্ডবিত্তি করেছে, আমাদের এখানে তো আর তা নেই।
–নেই?
গগন একেবারে মারমুখী হয়ে বুড়ো আঙুল উৎক্ষিপ্ত করে চেঁচিয়ে উঠল, আপনি জানেন কাচকলা। সারা দেশটা ঘুরে দেখে আসুন গে, পাদ্রি সাহেবদের কত সম্পত্তি আছে। আর শুধু পাদ্রি সাহেবদেরই আমরা ধরব নাকি? এ দেশি মঠ মন্দিরের মোহান্তরা? বলতে গেলে তো আপনাদের গায়ে লাগবে। বলবেন ধম্মেকম্মো সব গেল। এই সিদিনেও কাগজে লিখেছে, গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনমঠের মোহান্ত দুজন কিষেণকে পিটিয়ে আধমরা করেছে। এই যে সব হাজার হাজার বিঘে জমি দেবোত্তর দেওয়া হয়েছে, সোনার হার গলায় দিয়ে, আর মদে মেয়েমানুষে রাজাগিরি তো ফলাচ্ছেন সব মোহান্ত মহারাজেরা। এরা তো সবাই এক-একজন খুদে রাজা। চাষিবাসী গরিব লোকেরা তো এদের যমের মতন ভয় করে, খবর জানেন না? এরা ডাকাত বম্বেটের দল পর্যন্ত পোষে, ঘরের বউ-ঝি টেনে নিয়ে চলে যায়।
জীবনকৃষ্ণ বলে উঠলেন, এটা ঠিক বলেছ, ঠিক, আমি নিজে সংবাদপত্রে পড়েছি, গুপ্তিপাড়ার কেষ্টানন্দ মহারাজ ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। তার চরিত্রও যাকে বলে একেবারে নষ্ট। তারকেশ্বরেরও সেগুণে ঘাট নেই।
চক্রবর্তীর পক্ষে এ সব কথা অস্বীকার করবার উপায় ছিল না। তিনি যেন অস্বস্তিতে একবার জীবনকৃষ্ণ আর একবার গগনের দিকে দেখতে লাগলেন।
গগন আবার বলল, আর ভারতবর্ষের মধ্যে এত যে সব মন্দির আছে, খোঁজ করে বার করুন দেখি, কটা জ্ঞানী আর ধার্মিক ব্রাহ্মণ সেখানে আছে? কোটি কোটি টাকা আর কাঁড়ি কাঁড়ি দেবদাসী তো রয়েছে। এখন হিসেব করে দেখুন গে, ঠাকুরের দোর ধরা কত লক্ষ লক্ষ বিঘে জমি পড়ে আছে। আর সে সব কাদের ভোগে লাগছে। মশাই চাষ তো আর দেবতায় করে না, চাষারাই করে। তবে আর তফাতটা কোথায়?
চক্রবর্তী মাথা নেড়ে বললেন, তেমনি হাজার হাজার লোকে রোজ পেসাদ ভোগ পায়, ওই খেয়েই তারা বেঁচে আছে।
–মিছে কথা। ভিখিরিদের পাতে কী পড়ে, সবাই জানে। ভোগ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। এ সব লালন-পালনের কথা ফরাসি যাজকেরাও বলত, কেন মিছিমিছি বকাচ্ছেন! একবার নিরিবিলিতে চোখ বুজে ভেবে দেখবেন, এখনকার ফরাসিদের চেয়ে, আমরা খুব ভাল নেই। রামঠাকুর কি আর এমনি চোখে আঙুল দিয়ে এ সব দেখাচ্ছেন!
জীবনকৃষ্ণের লোমশ ভ্রূর তলায় চোখ দুটি তীব্র বিস্ময়ে চিকচিক করে উঠল। ঘাড় নেড়ে বলে উঠলেন, হু, তাই বলো! ওই কারণেই বাঁড়ুজ্জে ফরাসডাঙার ফ্যাস্তার কথা লিখেছে! মানে–মানে–
জীবনকৃষ্ণের গলার স্বর নীচে নামতে নামতে ডুবে গেল। তিনি একবার সন্ত্রস্ত চোখে বাইরের দিকে ফিরে তাকালেন। তারপর প্রায় চুপিচুপি বললেন, মানে প্রজাবিদ্রোহকে উসকোচ্ছে? সে যে বড় ভীষণ কথা হে গগন! তোমাদের সুরীনবাঁড়ুজ্জেও তো ঠিক এমনটি বলছে না। কিন্তু এ লেখা নিয়ে শেষটায় গোলমাল হবে না তো?
গগন বলল, গোলমাল আর কী হবে। কাগজ সরকারে বাজেয়াপ্ত করতে পারে, কাগজ বন্ধ করে দিতে পারে।
চক্রবর্তীর এতক্ষণে মগজে ঢুকেছে। বলে উঠলেন, রামকে ধরেও নিয়ে যেতে পারে?
–তাও পারে।
চক্রবর্তী হাত তুলে বললেন, তবে আর আপিসে বসে ও সব পড়াশোনা থাক বাপু। আমরা সব সাহেব কোম্পানির দৌলতেই করে খাই, কোথা থেকে কী হয়ে যাবে, দরকার নেই।
চক্রবর্তী জীবনকৃষ্ণের দিকে তাকালেন তাঁর সম্মতি পাবার আশায়। জীবনকৃষ্ণ বললেন, আরে ওয়াল্টার তো নেই, ভান্ডাও ভেগেছে। গগন একটু গলা নামিয়ে পড়ো, ব্যাপারটা একটু শুনি। ও সব ঘরে নিয়ে একলা একলা পড়ে সুবিধে হবে না। পড়ো পড়ো হে গগন, তারপর কী হল।
গগন আর এক দলা নস্যি না ছুঁজে পারল না। আবার শুরু করল সে, কিন্তু ফরাসীস শাসক অভিজাত সম্প্রদায় বিস্মৃত হইয়াছিলেন, সমস্ত কিছুরই একটা সীমা মানিতে হইবে। যে দুধের শিশুদের, শ্রমে বাধ্য করা হইতেছিল, যে নারীদের সম্মাননা দূরে থাকুক, গণিকাবৃত্তিতে ঠেলিয়া দেওয়া হইতেছিল, তখন ক্ষয়প্রাপ্ত শিশুর বলি যজ্ঞে, নারীর দেহ ধৌত সুরা, নারীর পাদুকা পূর্ণ করিয়া, আকণ্ঠ পানে এই সব দুরাচারীরা নৃত্য করিতেছিলেন। ঘৃণার যে ভয়ংকর হলাহল তাঁহাদের পদতলে তরঙ্গায়িত হইয়া উঠিতেছিল, জনতার ক্রোধ যে বিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির ন্যায় অন্তরে অন্তরে গর্জিতেছিল, এক প্রবল ধ্বংসের শক্তি আহরণ করিতেছিল, তাহা এই দুর্ভাগা শাসকগণ টের পান নাই। তাঁহারা এতই মত্ত ছিলেন যে, রাজশক্তির উপর জনতার প্রাচীন বিশ্বাস যে ক্রমান্বয়ে ভাঙিয়া চূর্ণবিচূর্ণ হইতেছে, চিরাচরিত ভয় ও ভক্তি, তীব্র ঘৃণায় রূপান্তরিত হইতেছে, তাহা দেখিয়াও অনুভব করিতে পারেন নাই।
ভিতরে ভিতরে ছাইচাপা আগুন রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের আমল হইতেই জ্বলিতেছিল, এবং সেই সময় ইহাতে ইন্ধন জোগাইতেছিলেন ফরাসিদেশের মহাপ্রাজ্ঞ সুসন্তানবৃন্দ, যথা ভলতের, রুশো, মন্টেসকিউ, দিদেবরা, দ্য আলেমবার্ত মনীষিগণ। দেশের মানুষের মনে যে সব চিন্তা ভাবনা, ভিতরে ভিতরে বিক্ষিপ্তরূপে আন্দোলিত হইতেছিল, এইসব মনীষিবৃন্দ তাহা সম্যক উপলব্ধি করিয়া, একটি সুসংবদ্ধ রূপ দান করিয়াছিলেন। ভলতেয়ার বলিয়াছিলেন, যদি ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকে, তবে তাঁহাকে তৈরি করা প্রয়োজন। রুশো বলিয়াছিলেন, জন্মসূত্রে মানব স্বাধীন, তথাপি সে সর্বত্র শৃঙ্খলিত। এই সব উক্তির ভিতর দিয়া ইউরোপের অধিবাসীরা অনুভব করিতে শিখিয়াছিলেন, দুর্ভাগ্য লইয়া কেহ জন্মায় না, ইহা সকলই আরোপিত। মানুষ মাত্রেই স্বাধীন, অথচ সে অপরের পাপের শিকার হইয়া, মুখ বুজিয়া অবিচার সহ্য করিতেছে। উক্ত মনীষিবৃন্দ শাসকদেরও নানাভাবে উপলব্ধি করাইবার চেষ্টা করিয়াছেন, সমূহ বিপদের সংকেত দিয়াছেন। কিন্তু বঙ্গদেশীয় প্রবাদবাক্যের ন্যায় তখন উহা প্রতীয়মান হইয়াছিল যে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।তাহা ছাড়া, ইহারা পীড়নে অত্যাচারে লোভে লালসায় এতদূর বর্ধিত হইয়াছিলেন যে, বাধা পাইলে রক্তচক্ষু লইয়া আরও নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করিতেন।
অতঃপর ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চদশ লুইয়ের মৃত্যু হইল। ইহার সভাসদ ও পারিষদবৃন্দ ছিলেন প্রজাপীড়ক, এবং উনি নিজে ছিলেন, অতি কূটবুদ্ধিপরায়ণা, কুখ্যাত মাদাম পম্পাডৌরের হাতের ক্রীড়নক। সেই সময়ে ইনি করালগ্রাসে পতিত হইলেন। হায়, তখন কি কেহ জানিত, ফরাসি রাজবংশের সেই শেষ রাজকীয় শব-শোভাযাত্রা। পঞ্চদশ লুই-এর পরে আর কাহাকেও উক্তপ্রকার শোভাযাত্রায় বহন করিবার সুযোগ আসে নাই। তাঁহার বিংশবর্ষীয় পৌত্র, ষোড়শ লুই রূপে রাজার স্থলাভিষিক্ত হইলেন। রাজা হইবার কিছুকাল পূর্বেই ইনি অস্ট্রিয়া রাজ্যের সাম্রাজ্ঞীর কন্যা, লঘুচিত্ত অতীব সুন্দরী মোহময়ী আর্কডাচেস মেরি আন্তয়নেতকে বিবাহ করেন। রাজা হইয়াই তিনি দেখিলেন, রাজকোষ শূন্য, আনন্দের স্রোতে গা ঢালিবার উপকরণাদি নাই। অতএব প্রথমেই প্রয়োজন হইল, অর্থ। আরও অর্থ চাই। ঋণ শুরু হইল, এবং রাজা অভিজাত ও উচ্চযাজকদের নিকট যাঞ্চা করিলেন, তাঁহাদের কুক্ষিগত স্বৈরতান্ত্রিক অধিকার সমূহ হইতে রাজকোষকে কিছু প্রাপ্য দেওয়া হউক। কিন্তু স্বেচ্ছাচারী অভিজাত ও যাজকেরা বাঁকিয়া বসিল। তখন স্টেটস-জেনারেল ডাকিয়া, এই অবস্থার অবসান ঘটাইবার ব্যবস্থা হইল। অভিজাত, যাজক ও জনসাধারণের প্রতিনিধিদের লইয়া স্টেটস জেনারেল গঠিত হইল। কিন্তু সেখানে অভিজাত ও যাজকদের প্রতিনিধি ডেপুটিবৃন্দের সংখ্যা বেশি হওয়ায়, জনসাধারণ আপত্তি করিলেন, তাহারা দাবি করিলেন, সমস্ত স্বৈরতান্ত্রিক কর আদায় ও বেগার বন্ধ করিতে হইবে, কর সবাইকে সমানভাবে দিতে হইবে। তাঁহারা তৃতীয় স্টেটস বলিয়া পরিগণিত হইলেন, এবং স্টেটস জেনারেলের নিকট দাবি জানাইলেন সমানাধিকার ও সুবিচারের।
স্টেটস জেনারেল ক্রমে রাজা অভিজাত ও উচ্চ পর্যায়ের ধর্মযাজকদের চক্রে পরিণত হইতে লাগিল, জনসাধারণের প্রতিনিধি ডেপুটিবৃন্দ ক্ষুব্ধ হইতে লাগিলেন, এবং শেষ পর্যন্ত তাঁহারা আর স্টেটস জেনারেলের মধ্যে না থাকিয়া, নিজেরা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি প্রতিষ্ঠা করিলেন। ইহা ঘটিয়াছিল ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে। অভিজাত ও যাজকদের প্রতিনিধিদের তাঁহারা ন্যাশনাল আসেম্বলিতে আহ্বান করিলেন, জানাইলেন, ভোটাভুটি যাহা হইবার, তাহা এখানেই হইবে, অন্যথায় জনসাধারণের ডেপুটিবৃন্দ আপনকর্ম নিজেরাই চালাইয়া যাইবেন। শাসকবৃন্দ তাহাতে আপত্তি করিলেন ও রাজা বিদ্রোহী ডেপুটিদিগকে বহিষ্কৃত করিয়া, সভাকক্ষের দ্বারে প্রহরী নিযুক্ত করিলেন। জনসাধারণের মুখ খুলিতেছিল, তাঁহারা চুপ করিয়া রহিলেন না। তাঁহাদের প্রতিনিধিবর্গ সভাকক্ষের বাইরে, টেনিস খেলিবার অঙ্গনে ভিড় করিয়া নিজেদের দাবি জানাইতে লাগিলেন।
এই সময়ে কয়েকটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটিতে লাগিল, এবং তাহা অবনিকাষ্ঠের ঘর্ষণের ন্যায় কার্য করিতে লাগিল, যাহাতে কিনা পুঞ্জীভূত বারুদে আগুন স্পর্শ করিতে সাহায্য করিল। অচিরাৎ কয়েকজন সদ্বুদ্ধিপ্রণোদিত অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যক্তি ও যাজকদের একটি ডেপুটি অংশ, জনপ্রতিনিধিদের সহিত যোগদান করিলেন। কিন্তু তাঁহাদের আকর্ষণ অন্যদিকে, রাজার বক্তৃতা শুনিয়া, তাঁহারা অনেকে ফিরিয়া গেলেন, এবং রাজার নির্দেশ অনুযায়ী জনপ্রতিনিধিদের যখন জ্ঞাত করা হইল, তৃতীয় স্টেটসের কক্ষে গিয়া তাঁহাদের আসনগ্রহণ করিতে হইবে, তখন, মিরাবিউ নামক গণপ্রধান দূতকে জানাইলেন, আপনাকে যাঁহারা নির্দেশ দিয়া পাঠাইয়াছেন তাঁহাদের যাইয়া বলুন, আমরা এখানে জনগণের নির্দেশে আসিয়াছি, আমাদিগকে বেয়নেট দিয়া খোঁচাইয়া ছাড়া, এই স্থান ত্যাগ করানো যাইবে না। এই কথা শুনিয়া রাজা বলিয়া উঠিলেন, তাহারা এইরূপ বলিতেছে? বেশ, বলুক। এই বলিয়া প্রকৃতপক্ষে তিনি পশ্চাৎপদ হইলেন। কারণ জানিতেন কিছুই করা যাইবে না।
আর মাত্র একটি শলাকা প্রজ্বলিত হইবার অপেক্ষা ছিল, এবং তাহাও জ্বলিয়া উঠিল। ভার্সাইতে যখন এবম্বিধ সংকটকালে, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিকে মানিয়া লইবার ব্যবস্থা হইতেছে ঠিক উক্ত সময়েই একজন জনপ্রিয় মন্ত্রীকে বরখাস্তের সংবাদ প্যারিসে রটিয়া গেল। রটিবামাত্র জনতা বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। ১৭৮৯ খ্রিষ্টঅব্দের ১৪ই জুলাই সকালবেলা এক বিরাট জনতা, তাঁহাদের পুঞ্জীভূত ঘৃণার, অপমানের, লাঞ্ছনার ও স্বৈরতান্ত্রিক সকল পাপের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ আক্রমণ করিয়া বসিলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁহারা সমগ্র দুর্গসমূহ দখল করিয়া লইলেন। শত শত বৎসরের অত্যাচারিত জনতার ক্রোধের ঘৃণার ভয়ংকর রূপ দেখা দিল। দুর্গাধিপতি ও তাঁহার অন্যান্য কর্মচারীদের হত্যা করিয়া, লাঠির ডগায় তাঁহাদের কর্তিত মুণ্ড সকল তুলিয়া ধরিলেন, চিরঘৃণিত দুর্গপ্রাকার ভাঙিয়া, তাহার উপর জনতা নৃত্য করিতে লাগিলেন। মুহূর্তে সমগ্ৰ ফরাসি রাজ্যে এ সংবাদ রাষ্ট্র হইয়া গেল, আগুন জ্বলিয়া উঠিল। দূর জেলাসমূহের গ্রামাঞ্চলে কৃষকেরা প্যারিসের পন্থা গ্রহণ করিলেন, তাঁহারা স্থানীয় দুর্গগুলি আক্রমণ করিয়া ধ্বংস করিতে লাগিলেন। বিশেষ করিয়া জমিদারের সেরেস্তা সরকারের দপ্তর ও জমিদারের খামারবাড়িগুলি তাঁহাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হইয়া উঠিল। অভিজাতদের প্রাসাদাদিও রেহাই পাইল না। এই সংবাদ যখন রাজার নিকটে গেল, তিনি বলিয়া উঠিলেন, কী! বিদ্রোহ! জবাব পাইলেন, না হুজুর, ইহা বিপ্লব।ইহা আমাদিগেরও বুঝা উচিত, বিদ্রোহ ও বিপ্লবের মধ্যে তফাত কী। আমরা এতদ্দেশীয়গণ, সিপাহিবিদ্রোহ বা প্রজাবিদ্রোহ বিষয় অবগত আছি, যাহাতে প্রজাবৃন্দের বিক্ষোভ, কোনও পথ সন্ধান না করিয়া, নেতৃত্বহীনভাবে আপনা-আপনি ফাটিয়া পড়ে। কিন্তু বিপ্লব হইল জনতার নেতৃবৃন্দ কর্তৃক বিক্ষোভকে ও জনতাকে পরিচালিত করিবার জন্য শক্তিশালীদল গঠন, শত্রুকে পরাজিত করিবার জন্যে সুচিন্তিত রণরীতি ও কৌশল অবলম্বন করিয়া ক্ষমতা দখল করা। কিন্তু সম্ভবত যোড়শ লুই তাহা বুঝিতে পারেন নাই। অদ্যকার ফরাসডাঙার ফায়স্তা সেই ১৪ই জুলাই দিবসকে স্মরণ করিয়া অনুষ্ঠিত হইতেছে। ১৭৮৯ খ্রিস্টঅব্দের ১৪ই জুলাই সকালবেলা যে আগুন জ্বলিয়াছিল, তাহা সহজে নির্বাপিত হয় নাই। প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধিকারণ, তাহার বিস্তৃত বিবরণ লিখিতে আমরা অপারক। সংক্ষেপে এইটুকু মাত্র লিপিবদ্ধ করি, ইহার পর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি কার্যত রাজভার গ্রহণ করিলেন, এবং বিপ্লবীরা নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করিয়া, মানুষের অধিকারের সংগ্রামে লিপ্ত হইলেন। এই সময়ে, রাজা সদলবলে বিদেশে পলাইয়া যাইবার কালে সীমান্তের নিকটেই বিপ্লবীদের নিকট ধরা পড়েন ও বন্দি হন। জনগণ রিপাব্লিকের জয় বলিয়া উল্লাস করিতে লাগিলেন। কিন্তু ফরাসি রাজ্যের চারিপাশে রাজন্যবৃন্দই তখন রাজ্য শাসন করিতেছিলেন। তাঁহারা দেখিলেন, ফরাসির রাজা শুধু বিপদগ্রস্ত নহেন, যদি ফরাসির হাওয়া অন্যান্য দেশে বহিতে আরম্ভ করে, তবে তাঁহাদেরও সমূহ বিপদ। অতএব, তাঁহারা দল বাঁধিয়া রাজাকে উদ্ধার ও সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠাকল্পে, বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। এই যুদ্ধ ভীষণাকার ধারণ করিল। কিন্তু ফরাসি জনগণ দমিবার পাত্র নহেন। দেশের নানান অংশ হইতে তাঁহারা দল বাঁধিয়া মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হইলেন। দীর্ঘদিন সংগ্রামের পর, দেশকে বাহিরের শত্রুর হাত হইতে মুক্ত করিয়া, ভিতরের শত্রুদের প্রতি তাঁহারা দৃষ্টিপাত করিলেন। তৎপূর্বে, ১৭৯২ খ্রিস্টঅব্দের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম রিপাব্লিক প্রতিষ্ঠিত হইল। রিপাব্লিকের প্রথম কাজ হইল, দেশ হইতে অত্যাচারী রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মূলোচ্ছেদ। দেশের ভিতরে যাঁহারা বিপ্লবের বিরোধিতা করিতেছিলেন ও রিপাব্লিককে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করিতেছিলেন ও রাজতন্ত্রকে পুনর্জীবিত করিতে প্রয়াস পাইতেছিলেন তাঁহাদের মূলোচ্ছেদ। যাঁহারা বাহিরের শত্রুকে ডাকিয়া আনিয়াছিলেন, সাহায্য করিয়াছিলেন, তাঁহাদের কঠোর বিচার শুরু হইল। এই বিচারের প্রথম শাস্তি নামিয়া আসিয়াছিল স্বয়ং রাজার উপর, তাঁহাকে মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা দেওয়া হইয়াছিল। ইতিহাসের সেই ভয়ংকর দিনটি বিশ্বের সমগ্র রাজশক্তিকে কাঁপাইয়া দিয়াছিল। রানিও রক্ষা পান নাই। তাঁহাকে কিছুদিন পরে স্বামীকে অনুসরণ করিতে হইয়াছিল। বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার দরুন বহু অভিজাত, ধর্মযাজক ও অন্যান্যদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হইয়াছিল।
এইরূপ রক্তপাতের ভয়াবহতায় বিশ্ববাসীমাত্রেই শিহরিয়া উঠিয়াছিলেন, কিন্তু অত্যাচারের মাত্রা এতই প্রবল হইয়াছিল যে, জনতা হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়াছিলেন। যদিচ ইহা একপ্রকার নিয়তিচালিত অপ্রতিরোধ্য ঘটনায় পর্যবসিত হইয়াছিল, বাঁধ ভাঙা প্লাবনের ন্যায় উহার গতিরোধ করিবার সাধ্য কাহারও ছিল না।
পাপের ভরাডুবি হইলে, ঈশ্বরের আসন যেমন টলিয়া উঠে এবং তিনি স্বয়ং যেইরূপ দণ্ড হাতে আবির্ভূত হন, ইহা সেইরূপ ঘটিয়াছিল। পৃথিবীর প্রজাপীড়ক শাসকদের যুগে যুগেই এই প্রকার শিক্ষা গ্রহণ করিতে হইয়াছে, অথচ আমরা বিলক্ষণ লক্ষ করিতেছি, ঈশ্বরের সর্বোত্তম শাস্তি আজিও বাকি রহিয়াছে, কারণ প্রজাপীড়ক শাসকেরা আজিও ইতিহাসের পাতাকে ছিন্ন করিয়া পদদলিত করিতেছেন। তাঁহাদিগের অদ্যাবধি শিক্ষা হয় নাই।
যাহা হউক, এখানে আমরা পুনরায় এতদ্দেশীয়গণকে স্মরণ করাইতেছি, ফরাসডাঙার ফায়স্তা কেবলমাত্র বাজি পুড়াইবার বা বুলবুলি লড়াইবার অর্থহীন উৎসব নহে। এই উৎসবের উদ্দেশ্য অতীব গভীর। এই উৎসব বিশ্বের নিপীড়িত জনসাধারণকে তাঁহাদিগের মুক্তির কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছে। আজি হইতে প্রায় একশত বছর পুর্বে, এই দিবসে সকল পাপ ও অত্যাচারের প্রতীক বাস্তিল দুর্গ জনতা দখল করিয়াছিলেন, সেই জয়ের বার্তা অদ্যকার উৎসবে ঘোষিত হইতেছে। এতদ্দেশীয়গণ! আসুন অদ্য আমরাও সোল্লাসে চিৎকার করিয়া বলি, জয়, বাস্তিল দিবসের জয়! জয়, ফরাসি দেশের জয়! জয়, মানুষের জয়!
গগন নিজেই এমন চিৎকার করে উঠল, যেন সে সত্যি জয়ধ্বনি দিচ্ছে। চক্রবর্তী বলে উঠলেন, আস্তে হে আস্তে। কোথা দিয়ে কে শুনবে, তারপরে একটা ফ্যাস্তা হয়ে যাবে।
জীবনকৃষ্ণ গম্ভীর বিস্ময়ে মাথা নাড়ছিলেন। বললেন, রামের বুদ্ধি আছে। কিন্তু বিদ্যা না থাকলে এ সব বুদ্ধি হয় না। লেখাটি বেশ লিখেছে। ফ্যাস্তা কেন, কীসের জন্যে, সে কথাও বলা হল, আবার দেশের লোককেও ঠারে ঠোরে বোঝানো হল। যেন শ্রীভগবানুবাচ, তস্মাৎ ত্বমুত্তিষ্ঠ! কেন? না, কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো..দ্রোণঞ্চ ভীষ্ণঞ্চ জয়দ্রথঞ্চ কর্ণং তথান্যানপি যোধবীরান ময়া হতাংস্ত্বং জহি মা ব্যথিষ্ঠা যুধ্যস্ব জেতাসি রণে সপত্নান।
গগন একবার লাফ দিয়ে উঠে জীবনকৃষ্ণের পায়ে হাত ঠেকিয়ে মাথায় ছোঁয়াল। বলল, বাঃ বাহবা বাহবা বড়বাবু, কী শোনালেন আজ! এর আর জুড়ি নেই। এ কথা আমি আজই বলব রামকাকাকে।
জীবনকৃষ্ণ হেসে বললেন, পাগল। রামকে আবার কী বলবে, সে কি আর এ সব জানে না?
এ গগন ঠিক সেরকম রাগি খ্যাপাটে গগন নয়। এ আর এক রকমের খ্যাপা। ওর আসল চেহারা। বলল, তা জানুক না, কিন্তু সত্যি বলছি ভটচায মশাই, আপনার মুখ থেকে এরকম কথা শুনব কোনওদিন ভাবিনি। রামকাকা একেবারে লাফাবে এ কথা শুনলে।
জীবনকৃষ্ণ বললেন, আমার যেন সেইরকম মনে হল। রামের লেখার মধ্যে ওটাই যেন ফুটে উঠেছে, এদেশের লোকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, ভয় পেয়ো না, শত্রুকে জয় করো।
গগন উত্তেজিত খুশিতে বলে উঠল, তাই তো ভটচায় মশাই ঠিক তাই।
অবাক হচ্ছিলেন বিপিন চক্রবর্তী। গীতা প্রায় তাঁরও মুখস্থ। কিন্তু গীতার শ্লোকের সঙ্গে, রামবাঁড়ুজ্জের প্রবন্ধের যোগাযোগ এত তাড়াতাড়ি তাঁর বোধগম্য হল না। বিমূঢ় বিস্ময়ে তিনি দুজনকেই দেখতে লাগলেন, আর এখনও মনে মনে উচ্চারণ করতে লাগলেন, কলোহস্মি লোককথায়কৃৎ প্রবৃদ্ধো…।
জীবনকৃষ্ণ বললেন, কিন্তু আমি ভাবছি গগন, সংসারে কত ঘটনাই না ঘটে। ভাব, রাজা রানি, প্রজার কোপে তারাও প্রাণ দেয়, অ্যাঁ? সবেরই কারণ, আমরা কালান্ধ। মহাকাল এমন মিশমিশে কালো, তাঁর সব আমরা দেখতে পাইনে। চলো হে গগন, আজ যখন কারখানা চললই না, তখন একটু ফরাসডাঙাতেই বেড়িয়ে আসি।
গগন উৎসাহে ঝকঝকিয়ে উঠল। বলল, যাবেন? চলুন চলুন, আমি তো যেতামই।
চক্রবর্তী অবাক হয়ে বললেন, আপনি ফ্যাস্তা দেখতে যাবেন?
জীবনকৃষ্ণ বললেন, যাই একবার। কখনও তো কাছে গিয়ে দেখিনি, দুর থেকেই বরাবর দেখেছি। আমাদের ভাটপাড়ার ঘাটে দাঁড়িয়েই রাত্রের বাজি পোড়ানো দেখা যায়।
চক্রবর্তী এতটা আশা করেননি। বললেন, সেখানে বারো জাতের ভিড়, ছোঁয়াছুঁয়ি করে আবার
জীবনকৃষ্ণ হেসে বলে উঠলেন, কেন চান করে নেব, তা হলেই হবে। তার বেশি তো আর কিছু নয়। ছুঁলেই চান, এই তো বিধেন, তা আর ভাবনা কী।
কথায় ও হাসির স্বরে যেন একটু বিদ্রুপের সুর ফুটে উঠছে। চক্রবর্তী শুধু অবাক হলেন না মনে মনে একটু যেন ভয়ও পেলেন। জীবনকৃষ্ণ এমন হয়ে যাচ্ছেন কেন? কী আছে ওঁর মনের ভিতরে।
জীবনকৃষ্ণ আবার বললেন, তুমিও চলো না চক্কোত্তি, দেখে আসি গে ব্যাপারটা। একটু ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ করা বই তো নয়।
চক্রবর্তী সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি করে বললেন, না বড়বাবু, আমার যাওয়া হবে না। কারখানা চললেও দুপুরবেলা ছুটির সময় বেরিয়ে আমাকে দুই যজমানের বাড়ি যেতেই হত। আষাঢ় মাসে নিজে দাঁড়িয়ে তর্পণ করাই সেখানে। সেটাই সারি গিয়ে। কিন্তু আপনি
জীবনকৃষ্ণ বললেন, আমি যাব। অত আর বিধিনিষেধ ভাল লাগে না হে চক্কোত্তি।
তিনি চাবির গোছা হাতে তুলে নিলেন। অফিস বন্ধ করবেন।
.
৪৭.
আজ সবাই ফরাসডাঙায় চলেছে। আজ ফ্যাস্তা। মেয়ে-পুরুষ ছেলে বুড়ো, সবাই ফ্যাস্তা দেখতে চলেছে। গঙ্গায় তাই আজ নৌকার ভিড় বেশি। দিনটি আজ মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। বৃষ্টি নেই। আকাশে মেঘ আছে বটে কিন্তু বাতাসের বেগ উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। তাকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না, থেমে এক জায়গায় ঝরতে দিচ্ছে না। উড়ন্ত মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে রোদ ঝলকে উঠছে, আর গঙ্গার রক্তাভ জল তখন রক্তের মতো চলকে উঠছে। ধরিত্রী এখন সাবালিকা হয়েছে, তার সন্তানধারণের কাল উপস্থিত। অম্বুবাচী হয়ে গিয়েছে, রক্ত ঢলে ঢলঢল গঙ্গা এখন পরিপূর্ণ। জলে দেখা দিয়েছে অজস্র মেকো, নোনা কাঁকড়ার বাচ্চা যাকে বলে। সমুদ্র থেকে ইলিশদের আসার সময় হল, সেই ইঙ্গিত করছে।
সকালবেলাই পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে গভর্নরের প্রাসাদের মাথায়। জগদ্দল সেনপাড়া আতপুরের ছেলে বুড়ো দুদিন ধরে ঘাটে দাঁড়িয়ে দেখেছে, রঙিন কাগজের ঝালর দিয়ে, কেমন করে সাজানো হচ্ছে ওপারে। বড় বড় অক্ষরের রঙিন লেখা, গাছে গাছে লটকে দিয়েছে: ভিভলা ফ্রান্স! ভিভ ব্লাস্তিল ডে!..দুদিন ধরে এপারে দাঁড়িয়ে সাজানো দেখেছে। আজ সব পাড়ি দিয়ে ছুটেছে। বিশেষ করে, মিয়াজী পীরের থান পেরিয়ে, গঞ্জের কাছ থেকে ইতিমধ্যেই গোরার বাদ্যযন্ত্রের শব্দ ভেসে আসছে। সেই শব্দে রক্তের মধ্যে তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। আর স্থির হয়ে থাকা দায়।
.
ভাটপাড়া থেকে বনমালী এল সেনপাড়ায়, মজুমদারদের বাড়িতে। সঙ্গে আট বছরের ছেলে। হাতে একখানি বই। সংবাদ ছিল, কলকাতা থেকে সেজো মজুমদার গ্রামে আসছেন কয়েকদিনের জন্যে। বন্ধু বনমালী যেন অতি অবিশ্যি আসেন। যদিও সেনপাড়ার মজুমদারবাড়ি ভট্টপল্লীর বনমালীর পক্ষে নিষিদ্ধ, তবু প্রেমে কী না হয়। সেজোমজুমদারের নাম হিতেন্দ্রনারায়ণ। লখাইয়ের সেজোকর্তা। বন্ধুরা তাঁকে সেজো বলেই ডাকেন। সেজো প্রায় ডাকনাম হয়ে গিয়েছে তাঁর। বনমালীর আজ এক ঢিলে কয়েক পাখি মারবার আশা। বন্ধুদর্শন, ছেলেকে ফরাসডাঙার ফ্যাস্তা দর্শানো, অর্বাচীন ভক্ত লখাইকে একটু দর্শন দেওয়া, ইত্যাদি। সেই সঙ্গে নিজের একটু ইংরেজি ভাষার জ্ঞানবৃদ্ধি। সেজোর কল্যাণেই বনমালীর একটু-আধটু ইংরেজি শেখা হয়েছে। কাছে থাকলেই নতুন দুটি কথা শেখা যায়। সঙ্গে একটি উপহারও অবশ্য আছে। হাতের বইটি সেই উপহার। উপহার এতই মূল্যবান এবং নতুন যে বইটির নাম না করে সেজের হাতে তুলে দিয়ে তাকে একেবারে অবাক করে দেবার জন্যে মনটা ছটফট করছে।
বনমালী আজ টোল থেকে ছুটি নিয়েছে। শ্যামনগরের টোলে পড়ে সে কাব্যতীর্থ হয়েছে, এবং এখন সেখানেই কাব্যশাস্ত্রের শিক্ষক। যদিচ বনমালীর পিতার নিষেধ আছে, টোলের চৌহদ্দি পেরিয়ে যেন সে কখনও ব্রহ্মময়ী কালীবাড়ির সীমানায় না ঢোকে। শ্যামনগরের ব্রহ্মময়ী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, পাথুরিয়াঘাটার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের মধ্যমপুত্ৰ গোপীমোহন। কালী, সংস্কৃত কলেজ, দাঁতব্য চিকিৎসালয়, সবই তাঁর প্রতিষ্ঠা। কিন্তু পিরিলি যে! পিরিলি ঠাকুরদের প্রতিষ্ঠিত কালী সিদ্ধ নয়। তবে অবৈতনিক টোলে পাঠ, এবং বেতনসহ শিক্ষকতা সেটা আলাদা কথা। তাতে পিতা সম্মতি দিয়েছেন। বনমালী প্রকাশ্যে পিতার নিষেধ অমান্য করেনি, অপ্রকাশ্যে তা সম্ভব হয়নি। নইলে সেনপাড়ার মজুমদারবাড়ির ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, প্রায় তো গোমাংস তুল্য। মজুমদাররা শুধু পিরিলি নয়, ব্রাহ্মও বটে। ইদানীং একটু ভাটা পড়লেও গঙ্গার এপার ওপার আশেপাশের অনেক ব্রাহ্মই সেনপাড়ায় জড়ো হয়, বিশেষ যখন কলকাতা থেকে কোনও আচার্য আসেন। সবাই জানে, তারা খালি ঘরে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ব্রহ্মসংগীতের কীর্তন করে। আচার্য মূল গায়েন, বাকিরা দোহার। মেয়েরাও গান করেন চিকের আড়ালে বসে। সম্প্রতি অনেকেই কলকাতাবাসী হওয়ায়, আচার্যের যাতায়াত কমেছে। কিন্তু সেজো যে কী রকম ব্রাহ্ম, সেটা বনমালী ঠিক আন্দাজ করতে পারে না। বিধি নিষেধ কঠোরতার ধার ধারে না। ঘরের দেওয়ালে কালীঘাটের পটুয়ার পটের দুর্গা কৃষ্ণ আছে। রামায়ণ মহাভারত গীতা চণ্ডী সবই শ্রদ্ধার সঙ্গে পাঠ করেন, সময় পেলে রথের মেলা থেকে পৌষ মাসে শ্যামনগরের কালীবাড়ির মেলায়ও যান। বলির মাংসও খান, কেনা মাংসও খান। এবং তার স্ত্রীর এখনও নীল, চাবড়া, শেতল, দুর্গা, সব ষষ্ঠীর দিনই নাকি শরীর ম্যাজম্যাজ করে, ভাত খেতে পারে না। এখন কেউ যদি সেটাকে ষষ্ঠী পালন করা বলে, তবে নিরুপায়। সেজো বলেন, তা কী করা যাবে, শরীরের ওপর তো হাত নেই। এতে যদি হিন্দুরা মনে করে তুমি শাক ঢাকা দিয়ে মাছ খাচ্ছ, বলুক গে। আমি তো কিছু মনে করছি না গো!
বলে এমনভাবে তাকান, সেজোর স্ত্রীর চোখে স্বভাবতই সন্দেহ ফুটে ওঠে। স্ত্রী ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, আহা, তুমি ঠাট্টা করছ, আমি যেন বুঝতে পারছিনে?
সেজো সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে বলেন, যদি ঈশ্বরের দিব্যি গালতে বলো, তাও–।
–থাক থাক, আর অত করতে হবে না।
স্ত্রী তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে ওঠে, তোমার যা ইচ্ছে হয়, তাই বলো, মোটের ওপর ষষ্ঠীর দিন আমার শরীর খারাপ হয়।
সেজো জবাব দেন, অ্যাই, এর ওপরে তো কথাই নেই, আমি সেই কথাই তো বলছি।
সেজোর মুখ থেকেই বনমালী এ কাহিনী শুনেছে। আবার জামা গায়ে দিয়ে, কুচি দিয়ে শাড়ি পরে, চিকের আড়ালে বসে ব্রহ্মসংগীতও গায় সেজোর স্ত্রী। সবথেকে আশ্চর্য, কলকাতায় থাকলে সেজোর স্ত্রী কালীঘাটে বেড়াতে যেতে যায়। কালীদর্শন করতে নয়, এমনি একটু বেড়াতে। সেজো বলেন, তা বেশ তো চলো। তবে বাপু, একটা কথা বলে দিই, কালীমূর্তি যদি চোখে পড়ে যায়, তবে যেন কপালে হাত ঠেকিয়ো, নইলে ভীষণ অকল্যেণ হবে। হলেমই বা ব্রাহ্ম, তা বলে কালীর কোপ সইতে পারব না।..
সেজো এই সব গল্প বলেন আর প্রাণভরে হাসেন। বনমালীর সন্দেহ হয়, সেজো নিরীশ্বরবাদী কি না। অথচ সেজোর পাণ্ডিত্য অগাধ। রামমোহন রায়কে দেবতা জ্ঞানে ভক্তি করেন, বিদ্যাসাগরকে শ্রদ্ধা করেন, ভাটপাড়ার অব্জমোহন ন্যায়তীর্থকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন, কেশব সেনের নাম শুনলেই গদগদ! বনমালী তার এই বন্ধুটিকে ঠিক চিনে উঠতে পারে না। তার বিশ্বাস, সেজো এত বেশি ইংরাজি ফরাসি পড়ে যে, সে সবই তার মাথাটা ঘুলিয়ে দিয়েছে। কোনও কিছুরই স্থিরতা নেই। যদিও সেজোর ঠোঁটের কোণে হাসিটা দেখলে, মাথা ঘুলিয়ে যাবার কথা মনেই আসে না। বরং তাকে সর্বজ্ঞ বলে বোধ হয়।
কিন্তু সেজো যাই হোক, সে মুক্ত প্রাণ সহৃদয় মানুষ, বন্ধুবৎসল, পরমতসহিষ্ণু। তার কোনও কিছুকেই ভণ্ডামি বলে মনে হয় না। এই সেনপাড়ার চক্রবর্তীদের তারাশঙ্করকে যেমন মনে হয়। চক্রবর্তীরা পিরিলি হলেও সব শরিকেরাই ব্রাহ্ম হয়নি। তারাশঙ্কর হয়েছে। সেও কলকাতার চাকুরে। তার ব্রাহ্মবৃত্তি অতি উগ্র। যেন হিন্দু ছুঁলেই জাত যাবে! হিন্দুয়ানি তার চক্ষুশূল। মুসলমানের কলাপাতা উলটো করে ভাত খাবার মতো। ওটা কোরান শরিয়তে বিধানে না থাকলেও জেদ আর মর্জি বজায় থাকে। তারাশঙ্করের ব্রাহ্মপনা অনেকটা সেইরকমের। পৌত্তলিকতাকে সে ঘৃণা করে বটেই, দেবদেবীর প্রতিমা দেখলে, মাথা নিচু করে, চোখে আড়াল দিয়ে চলে যায়। যেন দর্শনেও পাপ। সেজো-ই বলেন ভাল। তারাশঙ্কর সম্পর্কে সেজো বলেন, তারাশঙ্করের ওটা একটা বিক্ষোভ, একটা প্রতিশোধ?
–কীসের প্রতিশোধ?
–মেলবন্ধনের দায়ে চিরটাকাল পিরিলিদের তোমরা নাক সিঁটকে এলে, আজ ওরাও নাক সিঁটকোচ্ছে।
–কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম তো আর হিন্দুদের নাক সিঁটকোবার জন্যে সৃষ্টি হয়নি।
–তারাশঙ্করদের কাছে তাই। বহু যুগের সোধ তোলার একটা রাস্তা পাওয়া গেছে।
–যাদের ওপর শোধ নিচ্ছে, তাদের তো কিছুই যাচ্ছে আসছে না।
–ভ্যাংচানো তো যাচ্ছে।
–হিন্দুরা হাসে।
–তা যদি বলো, হিন্দুদের সে হাসিটাও নিছক আনন্দের হাসি নয়, তাতে একটু জ্বালা আছে।
কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। কেশব সেনকে নিয়ে ভাটপাড়ার ঠাকুরমশায়েরা, মন্দিরের রকে বসে যে সব কেচ্ছাকাহিনী বলে গুলজার করেন, তার মধ্যে সত্যের অপলাপ আছে। সে মজলিশ একরকম জ্বালা মেটানো বটে। শুধু কেচ্ছাকাহিনী কেন, কিছুদিন আগেই তো; বেশ ফন্দি ফিকির করে, ব্রহ্মানন্দের পিছনে লেগেছিলেন পণ্ডিতেরা। ব্রহ্মানন্দ কেশব সেনকে ভাটপাড়ায় নিমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল ধর্মালোচনার জন্যে। বনমালীর সন্দেহ, তাঁকে একটু জব্দ করার জন্যেই নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। ব্রহ্মানন্দ আসছেন শুনেই মন্দিরের রকে রকে গুলতানি শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারপরে তিনি যখন প্রকাশ্য সভায় ধর্মালোচনা করছিলেন, এবং ঈশ্বরের কোনও মূর্তি নাই, তিনি সর্বভূতে, এই উক্তি করছিলেন, তখন ভাটপাড়ার নিধু ডোম উঠে দাঁড়িয়েছিল। বনমালীর দৃঢ় বিশ্বাস, নিধু ডোমের এত সাহস ছিল না যে, সে সেই সভার মাঝখানে উঠে ব্রহ্মানন্দের মুখের উপর কথা বলবে। আড়াল থেকে পণ্ডিতেরাই তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে এগিয়ে দিয়েছিলেন। নিধু ডোম বলেছিল, কত্তা, একটা কথা বলি। আপনি বলছেন, ভগমান সবখানে, সবকিছুর মধ্যে রয়েছেন, তাই কি না?
স্বভাবতই ওরকম ঘটনায় সভা একটু চকিত হয়ে উঠেছিল। ব্রহ্মানন্দ জবাব না দিয়ে হাসি মুখেই নিধুর দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি যেন অন্তরালবর্তী পণ্ডিতদের প্রতিনিধিটির মনের কথা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন। সভাস্থলের কাছেই বারোয়ারি তলার মণ্ডপে একটি মাটির দেবীপ্রতিমা ছিল। নিধু ডোম সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, উনি যদি সবখানেই আছেন, তালে ওই পিতিমের মধ্যেও রয়েছেন, কেমন কিনা বলেন। তবে আর আপনার, অই কী বলে গে,নেরাকার বেহ্মনা কী বলছিলেন আজ্ঞে, তার কী দরকার। পিতিমে পুজো করলেই হয়।
সভায় একটি হাসির রোল পড়েছিল। বনমালী বেশ বুঝতে পেরেছিল, নিধুর পেটে তালের রস না থাকলেও মাথায় গাঁজার ধোঁয়া ছিল। কোনও কোনও হাস্যমুখর পণ্ডিত, টিকি নেড়ে, অনেকটা স্নেহ করে বলে উঠেছিলেন, দ্যাখ, ডোম ব্যাটার কাণ্ড দ্যাখ। ব্যাটা আর কথা খুঁজে পেলে না।
ব্যাটা ভাটপাড়ার ডোম কিনা!
সে উক্তিও প্রশংসাসূচক। সেনপাড়ার ব্রাহ্ম তারাশঙ্কর ছিল সে সভায়। সে হুংকার দিয়ে উঠেছিল, কী, এত বড় অপমান! ডোমের এত আস্পর্ধা!
তারাশঙ্কর চালে ভুল করেছিল। ডোম বলে হুমকে ওঠা তার ধর্মবিরোধী ছিল। জাতের কথা তার মুখে শোভা পায়নি। সভা যারা ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল, সেই সব পণ্ডিতদের সুবিধে করে দিয়েছিল সে। কারণ তারাশঙ্করের বিশ্বাস, ব্রাহ্ম হলেও, ব্রাহ্মণ ব্রাহ্ম, সে কথাটা ভুললে চলে না। সে পৌত্তলিকতার বিরোধী বটে, তা বলে, চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ হয়ে শূদ্রের ঘরে রান্না ভাত ব্যঞ্জন গ্রহণ করা যায় না। সেজোর কথাই সত্যি, সে পিরিলি বলে ব্রাহ্ম হয়েছে, অন্যথায় সে হিন্দু।
দু-চারজন পণ্ডিত হেঁকে-ডেকে উঠেছিলেন, বেহ্মর মুখে জাত তুলে গালাগাল? বেহ্মদেরও কি তবে বামুন কায়েত আছে?
তারাশঙ্কর সেই আবেগপ্রবণ ও গোঁয়ারের মতো আরও কিছু হয়তো বলত। তার আগেই, অব্জমোহন ন্যায়তীর্থ উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত। নিতান্তই টোলো বা যজমান খোশামুদে ও শোষক নন, শাস্ত্রজ্ঞ জ্ঞানী বোদ্ধা। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ছি ছি ছি, ভাটপাড়ার মুখে এমন করে কালি ছিটোবার বুদ্ধি তোমাদের কে দিলে? ব্রহ্মানন্দ এসেছেন, তাঁর কাছে, তাঁর ধর্ম সম্পর্কে দুটো কথা শুনছি। তিনি তো পাদ্রির মতো তোমাদের ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা দিতে আসেননি। নিজেদের গালে চুনকালি না মাখলে চলত না?
তারপরেই তিনি নিধু ডোমের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন। গর্জন করে উঠেছিলেন, বেরিয়ে যা এখান থেকে বেরো, বেরা, পাপিষ্ঠ কোথাকার।
অব্জমোহন উঠে দাঁড়াতেই নিধু থমকে গিয়েছিল। পণ্ডিতেরা অনেকটা জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতো চুপ করে গিয়েছিলেন, মাথা নামিয়ে নিয়েছিলেন। অব্জমোহনের উপরে কথা বলবার সাহস ভাটপাড়া পণ্ডিতসমাজের বর্তমানে নেই। এখন দেশজোড়া তাঁর খ্যাতি। কাশী নবদ্বীপ কলকাতা সর্বত্রই তিনি আপন পাণ্ডিত্যের দ্বারা খ্যাতি অর্জন করেছেন। ভাটপাড়ার তিনি পণ্ডিত শিরোমণি, সকলের মান্য, শ্রদ্ধেয়। তাঁর ধমক খেয়ে, ওঝার হাতে মার খাওয়া ভূতের মতো পালিয়েছিল নিধু। তারপরে তিনি ব্রহ্মানন্দকে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। অথচ ব্রাহ্মধর্ম তাঁর স্ববিরোধী। তিনি যে তেমন পরমতসহিষ্ণু, তাও নয়, কিন্তু আপন ধর্মে তাঁর বিশ্বাস অবিচলিত। তাই সেখানে তাঁর কোনও বিকার নেই। যদিচ ব্রহ্মানন্দের সভা তারপরে আর তেমন জমেনি।
এ বিষয়েও সেজোর কথাই ঠিক। তিনি বলেন, তারাশঙ্কর যেমন ব্রাহ্ম, তেমন হিঁদু তো আছে।
বনমালী বলে, কিন্তু তুমি তো সেরকম নও।
সেজো হা হা করে হাসেন। বলেন, আমার কথা আর বোলো না। আমি দুয়ের বার। আমি না হিদুর শুয়োর, না মোচলমানের গোরু।
সেজোর নিজের প্রতি এরকম কটু বিদ্রূপ বনমালীকে আহত করে, দুঃখিত করে। সে অনুভব করে, এই আত্মবিদ্রুপের মধ্যে হিতেন্দ্রর একটি ব্যথা লুকিয়ে আছে। যে ব্যথা নিতান্ত ছোটখাটো সাংসারিক বা ব্যক্তিগত ব্যথা নয়। এ ব্যথা, সামাজিক অবনিবনার যাতনা। সেজো বলেন, আমি হলাম সরকারি খাজাঞ্চিখানার এক চাকুরে, আর মজুমদারদের সেজোগিন্নির একটি অতি বশংবদ পত্নীগতপ্রাণ পুরুষ। বাকি যা দেখছ, সব ভুয়া।
বলা বাহুল্য বনমালী জানে হিতেন্দ্রর এ সব কথাও ভুয়া। হাসি ঠাট্টা বিদ্রুপের বাইরেও সেজোর আর এক রূপ আছে। যখন তিনি দেশ কালের কথা বলেন, যখন অ্যারিস্টটল শোপেনহাওয়ার কান্ট-মিল রুশো-ভলতেয়ারের কথা বলেন, তখন আর এক মানুষ। যদিচ, এ সব বিষয়ে মুখ খোলেন কম। কোথায় যেন একটি স্বভাব লাজুক ও সংকুচিত মানুষ লুকিয়ে আছে তাঁর মধ্যে। নিজের জ্ঞানের কথা সচরাচর প্রকাশ করেন না। এবং আপাতদৃষ্টিতে সবকিছুই যেন একটু হালকা বাঁকা ঠাট্টার ভঙ্গিতে দেখেন ও বলেন।
.
মজুমদারবাড়ির খোলা দেউড়ির সামনে একবার দাঁড়াল বনমালী। ভিতরে তাকিয়ে দেখল, সামনের চত্বর পেরিয়ে বৈঠকখানা ঘরের দরজা। সেখানে চিকের পরদা ঝুলছে। দরজা খোলা। ব্রাহ্ম তারাশঙ্করের মতো আপদ এসেনা জুটে থাকলেই ভাল। সেজো তো আবার সবদিকেই সদাশিব। অমন শ্রোতা পাওয়াও দুরূহ। তাতে সেজোর হাসি পাচ্ছে, কিংবা বিরক্ত লাগছে, তা তুমি কোনওক্রমেই বুঝতে পারবে না। ভাটপাড়ার সন্তান হয়েও বনমালীর গ্রহণের ব্যাকুলতা এবং সেজোকে কিছুটা বুঝতে পারে বলেই, এই ব্রাহ্ম ও বৈদিকের বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
বনমালীর কচি রাঙা ডাগর চোখ ছেলেটি, মলমলের ফতুয়া গায়ে ঘেমে উঠেছে। অনেকখানি হেঁটে এসেছে। মজুমদারবাড়ির আকর্ষণ তার কাছে কিছু নেই। তার মন প্রাণ পড়ে আছে ফরাসডাঙায়। সে এসেছে ফ্যাস্তা দেখতে। বলল, বাবা, ফরাসডাঙায় যাবেন না?
বনমালী উৎকর্ণ ছিল বৈঠকখানার দিকে, কথাবার্তার শব্দ কিছু পাওয়া যায় কি না। বলল, যাব বাবা, যাব বইকী। তোমার এই জ্যাঠার সঙ্গে একবারটি দেখা করেই যাব।
ছেলের হাত ধরে, চত্বর পেরিয়ে সে বারান্দায় উঠে গলা খাঁকারি দিল। ডাক দেবার আগেই, ভিতর থেকে জিজ্ঞাসা এল, কে?
আমি ভাটপাড়া থেকে এসেছি, বনমালী।
জিজ্ঞাসু গম্ভীর গলা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, আরে এসো এসো ভাই বনমালী, তোমারই পথ চেয়ে হিতের কুঞ্জগলি।
ঘরের ভিতরে কাগজপত্রের শব্দ হল। বনমালী চিক তুলে, ছেলের হাত ধরে ভিতরে ঢুকল। সেনপাড়ার মজুমদারবাড়ি এখন আর তেমন সাজানো গোছানো নয়। সবই গিয়ে কলকাতায় আপনাকে মেলে ধরছে। যত সাজসজ্জা সেখানেই। এখানে নিতান্ত কাজচলা গোছের ব্যবস্থা। তক্তপোশ আর খানকয়েক চেয়ার ছাড়া বৈঠকখানা ঘরে আর কিছু নেই।
বনমালীর ছেলেকে দেখে, হিতেন্দ্র লাফ দিয়ে উঠলেন। বললেন, সপুত্র দেখছি। এসো বাবা এসো।
হিতেন্দ্র ছেলেকে বুকের কাছে ধরে, তার গাল টিপে দিলেন। ছেলে দেখল, খালি গা হিতেন্ত্রের গলায় পৈতা নেই। সেটাই তার প্রথম লক্ষ্য, কারণ বাবার এই বন্ধু বামুন কিন্তু বেহ্ম এ কথা সে জানে। আর আশ্চর্য, বনমালী ছেলেকে কখনও হিতেন্দ্রকে প্রণাম করতে বলে না। এইনা বলতে পারার জন্যে, বনমালী মনে মনে কষ্ট পায়। কিন্তু তার কষ্ট কখনও বৈদিক সংস্কারকে জয় করতে পারে না। তা ছাড়া ছেলে বাড়ি গিয়ে তার মায়ের কাছে সবই বলবে। সেটাও এক বিভ্রাট। তার স্ত্রী একেবারে ঘোর বৈদিক গিন্নি। অথচ বনমালীর কী গভীর শ্রদ্ধা সেজোর উপরে।
বনমালী জিজ্ঞেস করল, তোমার হাতে ওটা কী কাগজ?
সেজো উৎসাহিত হয়ে বললেন, বঙ্গসিন্ধু। রামবাড়ুজ্জে বড় জবর লিখেছে হে। অপূর্ব লিখেছে।
–কী লিখল?
–ফ্যাস্তা, ফরাসডাঙার ফ্যাস্তা ব্যাখ্যা করেছে। এটার দরকার ছিল। লেখাটা পড়ো।
–নিশ্চয় পড়ব।
–তার আগে দাঁড়াও, একবার সেজোগিন্নিকে তলব করি। তুমি যখন আছ, তখন তাঁর আসতে বাধা নেই।
–কিন্তু আসতে না আসতেই তাঁকে তলব কেন?
–কেন আবার, ব্যাটার মুখখানি দেখেছ? সেই ভাটপাড়া থেকে হাঁটিয়ে তো নিয়ে এসেছ। একটু জলটল তত খাবে। না কি বলল হে ভটচায্যি মশাই!
সেজো ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলে অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকাল। বনমালী হেসে বলল, তা জ্যাঠার বাড়িতে বাধা কীসের। কিন্তু কথা হচ্ছে, আমরা বাপ ব্যাটায় খেয়েই বেরিয়েছি, তাড়াহুড়ো করবার দরকার নেই।
সেজো হেসে বললেন, তা ছাড়াও আর একটা তাড়াহুড়ো আছে যে। সেটা ভুলে গেলে চলবে কেন। তোমরা বাপ ব্যাটায় খেয়ে বেরিয়েছ, কিন্তু তোমার বন্ধুপত্নীর আর একটা ভিন্ন ক্ষুধা তো আছে। বাবাজিকে তার হাতে এখুনি তুলে না দিলে, তারপরের ঠ্যালা সামলানো দায় হবে।
বনমালী লজ্জিত হল। সেজোর মুখের হাসিতে ও গলার স্বরে করুণ ছায়া ও সুর বিদ্যমান। মনে থাকে না, হিতে নিঃসন্তান। চাকরির বৈভব বিত্ত, ঘর জুড়ে শত শত বইয়ের মাঝেখানে, একান্নবর্তী পরিবারের, গৃহস্থালির নানান কাজ কলরবের মধ্যেও, তাদের স্বামী স্ত্রীর শূন্যতা ঘোচে না। যে শূন্যতা, একান্তই তাদের দুজনের মাঝখানে, তৃতীয়ের উদ্ভবের পূর্ণতার অপেক্ষায় ছিল। দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবনের প্রতিটি দিনই একটি প্রত্যাশায় কেটেছে। এখন নৈরাশ্য আর হতাশা। জোয়ারের কোটাল এখন ভাটার পলি ছড়িয়ে, তীরের বুক শূন্য করে নামছে। এক ব্যক্তিজীবনের আর কী আশা! তাই বোধহয় সেজোর ব্রাহ্মগিন্নির, হিন্দু পার্বণে এত উপবাস, এত ষষ্ঠীপালন, এত পৌত্তলিক দেবদেবীর প্রতি আগ্রহ। জন্মগত সংস্কারের সব অসহায় আশা এখন সেখানে গিয়ে পৌঁছেছে। অনেক গোপন মানতের মাথা কোটাকুটি সেখানে। সেজো করুণ চোখে হাসেন, ঠোঁটের বক্রতাকে সরল রাখতে পারেন না।
বনমালী বলল, তা বটে। সেই ভাল, বনবিহারী এখন তার জ্যাঠাইমার কাছে গিয়েই একটু থাকুক। ততক্ষণ আমরা একটু কথা বলে নিই।
বাপের নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে, বনবিহারী। সে সংশয়ভরা গলায় বলে উঠল, আর ফরেসডাঙায় ফ্যাস্তা দেখব না?
সেজো বললেন, দেখবে বইকী বাবা। শুধু কি তুমি আমি আর তোমার বাবা? তোমার জ্যাঠাইমায়েরাও দল বেঁধে যাবেন ভাউলেয় করে।
বনমালী জিজ্ঞেস করল, তাই নাকি?
–হ্যাঁ তোমার বন্ধুপত্নী আর তাঁর দলবল আগের থেকেই ব্যবস্থা পাকা করেছেন। অবিশ্যি, ফরাসডাঙায় তাঁরা নামবেন না, ভাউলে থেকেই যতটুকু হয়। তারপরে
বলতে বলতে সেজো কপট ভয়ে চোখ বড় করে, গলার স্বর নামিয়ে বললেন, তারপরে বলতে পারিনে, হয়তো ডাঙাতেও নামবেন। যা এক বোসজায়া জুটেছে।
বনমালী অবাক হয়ে বলল, সেটি আবার কে?
সেজো বললেন, আমাদের গগমের বউ, গগন বোস। এখন ওই ফোর্ট গ্লাস্টারের তেসুতিকলে বাবুর কাজ করছে।
–সে তো খুব কেতার ছেলে শুনেছি।
–তা বইকী, খুবই কেতার। সত্যি বলতে কী, আমাদের অনেকের থেকে গগনের পড়াশুনো ভাল, বোঝে ভাল। কিন্তু কোথায় একটা গোলমাল আছে।
বনমালী কৌতূহলিত হল। বলল, হ্যাঁ, সে কথাও শুনেছি। লোকে বলে, বড্ড বেশি বই কেতাব ঘেঁটে-ঘেঁটেই নাকি, মাথায় গোলমাল হয়ে গেছে।
ভ্রুকুটি কুঞ্চিত চোখেও, হিতেন্দ্রর ভিতরের পরিহাসপরায়ণ মানুষটি চাপা থাকেন না। ধমকে বললেন, ওই তোমার দোষ বনমালী, লোকে যা বলল, তাই অমনি জেনে বসে রইলে। লোকে যা বলে, তার ওপরে একটু নিজের কিছু জানা না থাকলে চলে না। বই কেতাব ঘাঁটলেই কি মাথার গোলমাল হয়? তা হলে তো পৃথিবীর অনেক বড় বড় মানুষ বদ্ধ উন্মাদ।
বনমালী সংকুচিত হল। সেজো আবার বললেন, অবিশ্যি গুণী মানুষেরা এক রকমের পাগল বটেন। যেমন ধর, তোমাদের ওই দক্ষিণেশ্বরের রামকেষ্ট ঠাকুর, শুনেছি উনি নাকি মা কালীর সঙ্গে কথা বলেন। সত্যি মিথ্যে জানিনে বাপু। যদি মেনে নিই, তা হলে বুঝতে হবে, আমাদের জন্ম আহার মৈথুনের জগৎটার বাইরে, আর এক জগৎ আছে তাঁর। জ্ঞানী গুণীদের সেইরকম, তাঁরা চলেন ফেরেন হাসেন বলেন সেই জগতে বসে। আমাদের সঙ্গে তাঁর কোনও কিছুতেই মেলে না। তাই বলি পাগল। অমন পাগল যত বাড়ে, ততই মঙ্গল। তাই বলছিলুম, তোমাদের লোকেরা যা বলে, তা নয়, গগনের মাথায় গোলমাল নেই, তবে সে পাগল। সে পাগলামিটা বোঝবার ব্যাপার, বুঝলে?
বনমালী অবাক হয়েছিল। বলল, তা বুঝলুম, কিন্তু গগনের পাগলামিও বুঝতে হবে, এতটা তো ভাবিনি সেজো।
তার কারণ, ওই যে লোকে বলেছে, বই কেতাব পড়ে লোকটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আরে লোক তো তোমার ওই ভাটপাড়ার কেষ্টঠাকুর, সেনপাড়ার তারাশঙ্কর, নয় তো ভূতো বোস। কিন্তু পাগলামির কারণ যদি খোঁজ করতে হয়, তবে ওই গগনদের মতো পাগলের পাগলামিই খোঁজ করতে হবে। ওর জন্যে আমার বড় কষ্ট হয়।
বলতে বলতে সেজোর গলায় গাম্ভীর্য নেমে এল। বনমালীর ঠোঁটের কোণে লুকোনো বিদ্রূপ তিরোহিত হল। তার বিস্ময় অধিকতর হল। বলল, কষ্ট হয় তোমার?
সেজো বললেন, হ্যাঁ, হয়। আমরা কলকাতায় থাকি, ভাল চাকরি করি, গগনের পক্ষেও সেটাই হওয়া উচিত ছিল। তার মতো ছেলে যে আজ সেনপাড়ায় পড়ে থাকবে, ভাবতেও কষ্ট হয়। ও যেমন ভাবতে পারে, তা নিয়ে যদি কলকাতায় থাকত, মিশত, তবে অন্যরকম হত।
থাকে না কেন?
গোলমালটা সেখানেই। দেশজোড়া লোক বলে, কলকাতায় যাব, কলকাতায় থাকব। গগন সেই কলকাতা থেকেই পালিয়ে এল।
–পালিয়ে এল? সে কলকাতায় ছিল নাকি?
–ছিল বইকী। কিছুদিন সুরেন বাঁড়ুজ্জের সঙ্গে ঘুরে বেড়াল, বাগবাজারের অমৃতবাজার পত্রিকার আপিসে কদিন যাতায়াত করল। শুনেছিলুম, প্রেস-অ্যাক্ট নিয়ে, এক প্রবন্ধ লিখেছিল। মেটকাফ সাহেবকে ধুইয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে আগ্রার সেই ফুলার সাহেবের ঘটনাও ঢুকিয়ে দিয়েছিল। জান তো ফুলারের ঘটনা, বছর কয়েক আগে যে-সাহেব চার্চে যাবার পথে হঠাৎ সহিসের ওপর রেগে গিয়ে, লাথি মেরে, মেরে ফেলেছিল, আর আগ্রার ম্যাজিস্ট্রেট লিডস সাহেব তার বিচার করে দণ্ড দিয়েছিল মাত্র তিরিশ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে পনেরো দিন বিনা পরিশ্রমের জেল বাস। সে একেবারে মরিজান লেখা, গায়ে আগুন লেগে যায়, আমি পড়েছিলুম। অবিশ্যি অমৃতবাজার ওটা ছাপতে সাহস করেনি। এমনিতেই তো বছর নয়েক আগে, প্রেস অ্যাক্টের ঠ্যালায়, বাংলা অমৃতবাজার রাতারাতি ইংরেজি কাগজ হয়ে গেছল। সে লেখা ছাপা হয়নি। পরে আমাদের রাম বাঁড়ুজ্জে অনুবাদ করে, বঙ্গসিন্ধুতে ছেপেছিল। সেই জায়গাটা আমি কোনওদিন ভুলব না। যেখানে সে লিখেছিল। হায় যিশু। তোমার ভক্ত মন্দিরে যখন তোমার প্রার্থনা করিতে যায়, তখন তাহার পায়ে ভারতীয়ের রক্ত লাগিয়া থাকে, তুমি দেখিতে পাও না।
সেজোর মুখে রক্তাভা ফুটে ওঠে। তার ভারী গম্ভীর গলা উত্তেজনায় তীব্র। বনমালীও বিস্মিত, তার কৌতূহলের অন্ত নেই। গগন সম্পর্কে এত কথা তার জানা ছিল না। এই সেনপাড়া, ভাটপাড়া বা কাঁটালপাড়ার অনেকেরই জানা ছিল না। গগনের মেলামেশার পরিধি সীমাবদ্ধ। অধিকাংশ লোক তাকে উদ্ভট গোছের মানুষ ভেবেই নিশ্চিন্ত। তার বাড়ির আত্মীয়স্বজন, তার কর্মস্থলের সহকর্মী, সকলেই তাকে তাই ভাবে। না জানাটা বনমালীর দোষ নয়। সেজোও তাকে কোনওদিন বলেননি।
বনবিহারী বেচারি! সে বাবা ও বাবার বন্ধুর আলোচনাকে কোনও দিক থেকেই অনুধাবনে অক্ষম। অসহায় হয়ে সে বাবার একটি হাত ধরে দুজনের মুখের দিকে দেখছে। তবে, এই দুজনে দেখা হলে যে, আর সব ভুলে যান, তার ছোট প্রাণে সে অভিজ্ঞতা আছে। এখন বাবার হাত টিপে, আঙুল টেনে, এমনকী বাবার ফতুয়ার ভিতরে হাত গলিয়ে, তাঁর পেটে হাত বুলিয়েও, মনোযোগ আকর্ষণ অসম্ভব।
বনমালী বলল, সত্যি, এত কথা তো জানতুম না সেজো, তোমার মুখেও কখনও শুনিনি।
সেজো বললেন, হয়তো সুযোগ আসেনি।
–কিন্তু সে কলকাতায় থাকল না কেন?
–সেটাই বুঝতে পারিনে। আমি নিজেও তো অনেকবার বলেছি, গগন মফস্বল তোমার জায়গা নয় বাপু, কলকাতায় এসো। তার এক জবাব, কলকাতা আমার ভাল লাগে না সেজোদা। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখ, কোথায় অ্যাডাম স্মিথের ভারতবর্ষের ওপরে লেখা বই, ওয়েলথ অব নেশনস, জে. আর. সিলি সাহেবের লেখা এইচ.এইচ. উইলসনের হিস্টরি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, কে কোথায় কী লিখেছে, কত মাল আমদানি হয়েছে, সব খবর তার নখদর্পণে। এমন লোক জগদ্দলের এক কারখানায় পড়ে থাকবে, ভাবতে কষ্ট হয়। অবিশ্যি, আমার একটা সন্দেহ হয়, যাঁদের সঙ্গে সে মিশতে চেয়েছিল, কলকাতার যে সব নামী জ্ঞানী লোকদের সে কাগজ পড়ে ঈশ্বরের তুল্য মনে করেছিল, তাঁদের খুব কাছে গিয়ে, গগনের কিছু মোহভঙ্গ হয়েছে। সে যা চেয়েছিল, তা অসম্ভব দেখে, একটা হতাশা নিয়ে ফিরে এসেছে। যদিও আমি মনে করি, সেটা গগনের ভুল। মিথ্যে মোহ যদি কিছু থাকে তা ভাঙাই ভাল। কিন্তু কলকাতায় কারুর কাছেই আর যাব না, সেটা ঠিক নয়। গগনের ইমোশন বেশি, ধৈর্য কম। এ সব লোক বোধ হয় নিজের একরোখামির জন্যে, নিজেকে একঘরে করে রাখে। অবিশ্যি আর একটা কথা আছে–
সেজোর চিন্তিত স্বর বিলম্বিত টানে এসে থামল। বনমালী জিজ্ঞেস করল, আর কী কথা?
সেজো বললেন, গগনের বিয়েটাও বোধহয় তাকে একটু গোলমাল করেছে। কলকাতায় থাকতে এক নাম করা কায়স্থ ঘোষ পরিবারে তার যাতায়াত ছিল। ঘোষেরা ব্রাহ্ম। তাদের বাড়ির নবীন ঘোষের নাম শুনেছ নিশ্চয়, লেখাপড়া বলা কওয়ার খুব চৌকস ছেলে, ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে পারে অনর্গল। কলকাতায় খুব নামকরা ছেলে, গগনদেরই বয়সি, গগনের সঙ্গে তার জমেছিলও জবর। নবীনেরই এক ভাগনি, কোনও এক মিত্তির বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করেছে সে। সেই মিত্তিরেরাও শুনেছি, একসময়ে ব্রাহ্ম হয়েছিল, আবার কেঁচেগষ করে হিন্দু হয়েছে। বিয়ের বয়সের তুলনায়, মেয়েটি ডাগর হয়েছিল বেশি। কী করে যে যোগাযোগ হল! আর কেন গগন সাত তাড়াতাড়ি সেখানেই বিয়ে করবে বলে কথা দিয়েছিল, তা জানিনে। গগন তো কারুর কথা শোনবার পাত্র নয়, করব তো করবই। এদিকে পিতৃ-মাতৃহীন, ভায়েদের সংসার, কারুর ওজর আপত্তি শুনল না। বিয়ে করে, বউ নিয়ে এসে উঠল এখানে। এ সব ক্ষেত্রে হাঁড়ি ভিন্ন হবে, এ তো জানাই কথা। ঝগড়া বিবাদ গালমন্দ অপমান, ভাই পরিজন জ্ঞাতি গোষ্ঠী থাকলে তাও বাদ থাকে না।
সেজো একটু থামলেন, একটু ভাবলেন, ভ্রুকুটি করে আপন মনেই একটু হাসলেন। আবার বললেন, তা যেন হল, ও সবে গগনের বউ টোল খাবার পাত্রী নয়। বছর চারেক ধরে ও সব তার গা সওয়া হয়ে গেছে। তবু মানুষ তো, তাই পালিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসে। গগন তো প্রায় সারাদিনই বাইরে বাইরে, গগন না থাকলেই তার বউ মজুমদার বাড়িতে। দুর্নামের তো অন্ত নেই, আর সে সব কেচ্ছাকাহিনী এমন নিটোল নিখুঁত, দু দণ্ড শুনলেও বেড়ে সুড়সুড়ি লাগে। আমাদের বাড়ি আসা নিয়ে যে সব কেচ্ছা হয়, সে সবের সত্যি-মিথ্যে অবিশ্যি বিচার্য, আর বাকি যা বলে লোকে, তার মধ্যে সত্যের নামগন্ধও নেই। কিন্তু কথাটা তাও নয়, ঠিক কী যে বলি।
চিন্তিত সেজো যেন ঠিক কথাটি খুঁজে পাচ্ছেন না। আপন বক্তব্যটা মনের মধ্যে হাতড়ে ফিরছেন। এদিকে বনমালীর কৌতূহল সীমাহীন উচ্চতায় তীক্ষ্ণাগ্র। বলল, তুমি যে নভেলের গল্প শোনাচ্ছ। তারপর? গুরুতর ব্যাপার কিছু নাকি?
সেজো ঘাড় দুলিয়ে বললেন, তা গুরুতর বলতে পার। আমি কী বলছি জান? আমি বলছি, গগন যে অমন হুটপাট করে, কারুর কথা না শুনে, জানা নেই, শুনো নেই, এক মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এল, তার তো একটা প্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু কই, গগন তো শুনি নিরাসক্ত, বিয়ের আগে যেমন ছিল, এখনও নাকি তেমনি আছে। কেউ তো নাকি কোনও দিন দুজনকে এক দণ্ড কাছাকাছি বসে কথা বলতেও দেখেনি, একটু সখ সাধ আহ্লাদ করে, হইচই মাতামাতিও করতে দেখেনি। এমনকী গগন বাড়ি থাকলেও শুনি, তার গিন্নি এসে এ বাড়ির অন্দরমহলে আড্ডা মারছে। বিয়ে করা বউ। এমন না কি যে, গগনকে ডুবে ডুবে জল খেতে হবে শিবের বাবাও টের পাবে না। আসলে এদের দুজনের সংসারটা যে অদ্ভুত ব্যাপার, এটা আর চাপা নেই। গগনও সেই একইরকম। স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া-বিবাদ হলেও, তার তো শেষ আছে। এ তো শুনি, চার বছর ধরে একইরকম।
সেজো খানিকটা অসহায় জিজ্ঞাসু চোখে বনমালীর দিকে তাকালেন। বনমালীরও তদ্রূপ অবস্থা। সে ভাবিত বিস্মিত গলায় বলল, কী জানি, আমিও তো এর কিছু বুঝলাম না। আছে হয়তো কোনও গোলমাল। তা অন্দরমহলে সেটা জানাজানি হয়নি?
সেজো ঠোঁট উলটে, ঘাড় নেড়ে বললেন, শুনিনি তো কখনও কিছু। কলকাতা থেকে মাঝে মধ্যে এলে যা একটু-আধটু শুনতে পাই। বউ বউঠানের মুখেই যা একটু শুনি। তাঁকে জিজ্ঞেস করে দেখেছি। তিনি বলেন, ঘুড়ির (গগনের বউ) কথার কিছু মাথামুণ্ডু বুঝিনে ভাই ঠাকুরপো। একে কলকাতার বিদ্যেধরী, তায় দুবার ধর্ম বদলেছে। যদি জিজ্ঞেস করি, হ্যাঁ গো গগনের বউ, তোর সঙ্গে কি গগনের ঝগড়া হয়েছে? চোখ বড় বড় করে জবাব দেয়, কই না তো। তোদের কি কথাবার্তা নেই? থাকবে না কেন? তবে যে শুনি তোদের সংসার বেদের ডেরা, তোদের গলার আওয়াজ পাওয়া যায় না, রান্না ভাত তরকারি পড়ে থাকে। কোনওদিন খাওয়া হয়, কোনওদিন হয় না, ও আবার কী? বলে, বড় বউঠান, সংসারে সব মানুষ কি একরকম, সব সংসার কি সমান হয়? তা হলে আর লোকে কাদের নিয়েই বা কথা বলবে, মজলিশ করবে। এমনি কথা ভাই ঠাকুরপো। স্পষ্ট করে কিছু বলে না। গগনটাও তো এক রকমের ধ্যাতাং ত্যাতাং গোছের, কাছা খোলা মতন। ওদের কিছু বুঝিনে ছাই। তবে মেয়েটা খুব কাজের, সেলাই ফোঁড়াই জানে খুব ভাল, মেমসাহেবদের মতন সেলাই জানে। মেমেদের মতনই চুল বাঁধতে পারে, পেটে বিদ্যেও আছে বেশ। আর হাসতে পারে, বাবারে বাবা! হাসি একবার শুরু হলে হয়। তবে কি না, একটু বেহায়া গোছের আছে। বয়সটা তো ভাল নয়, ইদিকে আবার চোখে মুখে গায়ে গতরে একটু রূপের ছিটেফোঁটাও আছে। তোর কি সাজে বাপু, যার তার সঙ্গে হ্যাঁ হ্যাঁ করে কথা বলা?
সেজো একটু থেমে বললেন, বড় বউঠানের রিপোর্ট হল এইরকম। তিনিই তো বারোমাস এখানে থাকেন। কিন্তু
সেজো হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, কিন্তু এ সব কথা যাক, পাঁচালি খুব হয়েছে। আগে সেজোগিন্নিকে খবর করি।
বনমালী বাধা দিয়ে বলল, আরে রোসো রোসো, আসল কথাটাই তো হল না। যা নিয়ে কথাটা উঠল, অর্থাৎ বোসজায়া–
সেজো বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আসল কথা হল, মেয়েদের দল বেঁধে ফ্যাস্তা দেখতে যাওয়ার সেই হল পালের গোদা। আর এও দেখেছি, গগনের বউয়ের ব্যাপারের নিন্দেতে সবাই পঞ্চমুখ হলেও, ওর ব্যবহারের কাছে সবাই হার মেনেছে। সে যেখানে, সেখানেই মেয়ে বউদের আড্ডা। সে যা বলবে, তাতেই সবাই রাজি। ইস্তক সেজোগিন্নি পর্যন্ত। আর গগনের বউ মানে, ডাকিনী। মাতাল দাঁতাল মানে না। বউ-ঝিদের ফ্যাস্তা দেখতে যাবার নৌকাবিহার যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কে জানে।
বনমালীর কুঞ্চিত চোখের কোণে জিজ্ঞাসার রেখাঁটি ঘুচল না। বলল, কিন্তু তার চেয়েও একটা আসল কথা বাকি রেখে দিলে যে?
–সেটা আবার কী?
–অই যে বললে, গগনের বউয়ের তোমাদের বাড়ি আসা নিয়ে যে সব কেচ্ছা হয়। সে সবের সত্যি মিথ্যে অবিশ্যি বিচার্য, সবই মিথ্যে। তোমাদের বাড়ির ব্যাপারটা বিচার্য কেন?
সেজো ঠোঁট টিপে হাসলেন। ভ্রুকুটি করে তাকালেন বন্ধুর দিকে। বললেন, হুম, জাত কাটে কোনও এদিক ওদিক হবার জো নেই। ভাটপাড়ার কান তো, ঠিক জায়গায় আড়ি পেতে রেখেছে।
বনমালী একটু বেচারি গোছের হেসে বলল, তুমি বলছিলে তাই।
সেজোও হাসলেন। বললেন, কথাটা তোমাকে বলব বলেই, ওভাবে বলছিলুম। কথাটা হল–
সেজো চকিতে একবার বালক বনবিহারীকে দেখে নিলেন। বনবিহারী তখন অসহায় আলস্যে ও অন্যমনস্কতায় দেওয়ালের ছবি দেখছিল। সেজো বললেন, আমাদের বাড়ির ব্যাপারটা বিচার্য এই জন্যে বলেছি যে, এখানে একটু সত্যের গন্ধ রয়েছে।
–সত্যের গন্ধ?
–হ্যাঁ। তার চেয়ে বেশি, অর্থাৎ সত্য রয়েছে।
–অর্থাৎ গগনের বউকে নিয়ে?
-হ্যাঁ। তুমি তো জান, আমাদের বড়বাবু আর ছোটবাবু, দুজনে এখানে থাকেন। মেজ সেজো ন এই তিনজনে কলকাতায় থাকি।
-তা তো জানি। জমিজমা ইত্যাদি, বড়কে দেখাশোনা করতে হয়। ছোট
বনমালী কথাটা শেষ করল না। সেজোই বললেন, হ্যাঁ, আমাদের ছোট আবার একটু রসিক মানুষ। চুচড়োর আদালতে চাকরি করতে যান, কিন্তু গান বাজনার দিকেই একটু ঝোঁক বেশি। তাতে অবিশ্যি আপত্তি ছিল না, ছোট-র ঝোঁকটা আবার নানান দিকে। মন মেজাজটা একটু আমিরি আমিরি, চাল চলনে একটু বাদশাহি ধরন। বাইরের টানটা বরাবরই একটু বেশি, তার মধ্যে ফরাসডাঙার টানটাই মোক্ষম। আতপুর সেনপাড়ার গুটিকয় ন-চ্যাংড়া শাগরেদ জুটেছে। এ সব থাকলে ঘরের বউয়ে দুদিন মন মজে, মন টেনে রাখতে পারে না। আমরা যখন সব ভায়েরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত, ঘোট ভাইটি তখন নিজেকে একরকমভাবে গড়ে তুলেছে। বাবা মারা যাবার পর বাড়াবাড়ি হয়েছিল, বড় দাদা মনে করেছিলেন, বিয়ে দিলেই সব গোল চুকে যাবে। লেখাপড়া যদ্র করেছে, তাতে চাকরিটা পেতে অসুবিধে হয়নি। অবিশ্যি চাকরি পাবার বিষয়ে ওর শ্বশুরের হাত ছিল, শ্রীমানের শ্বশুরালয়ও তো অপর উঁচড়োতেই। বছর দুয়েক হল বিয়ে হয়েছে, তাতে বাইরের হাতছানি থামেনি। এখন খোদ গোলমাল ঘরে। আমাদের দীনেন্দ্রবাবু গগনের বউকে নিয়ে উন্মাদ হয়েছেন।
-কী রকম?
–সেই রকমটাই ঠিক ধরতে পারছিনে। বড় বউঠানের রিপোর্ট হচ্ছে, বউটির নাকি কোনও দোষ নেই, দীনেনই পেছু লেগেছে। অথচ, ঘোটর ঘরে গগনের বউয়ের যাতায়াতও আছে। সেখানে ছোট ছোটর বউ আর গগনের বউয়ের মজলিশও বসে, তবে মাঝে মধ্যে শান্তিভঙ্গ হচ্ছে। গত এক বছরের মধ্যে ছোটর বউ তিনবার বাপের বাড়ি গেছে, এবং যাবার কারণ নাকি গগনের বউ।
–কিন্তু দীনেন আর গগনের বউ তো খুব ছোট বড় নয়?
–বিশেষ নয়, দু-এক বছরের এদিক ওদিক। কিন্তু তাতে কী হল। তুমি শেষটায় বয়সের কথা বললে?
বনমালী একটু যেন বিব্রত হল। বলল, তা হলে গগনের বউকে এ বাড়িতে আসতে বারণ করলেই হয়?
–কে বলবে? বড় বউঠানের চোখে যে তার কোনও দোষই নেই।
–না-ই বা থাকল, ছোট দেওরের মঙ্গলের জন্যেই না হয় বারণ করবে?
গাই বাছুরে ভাব থাকলে, বনে গিয়ে দুধ দেয়, সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন? অবিশ্যি বড় বউঠানের কথা হচ্ছে, গগনের বউকে ছোট কখনওই কাবু করতে পারবে না কারণ ছোট নাকি গগনের বউয়ের কড়ে আঙুলের যুগ্যি নয়। নাচন কোঁদনই সার হবে। তা ছাড়া, বাড়িটা তো আর হেঁজিপেঁজি বাড়ি নয় যে, একটা গুণের মেয়ে আসে, তাকে আসতে বারণ করে দেওয়া হবে। মুখের কথা খসাতে আর কষ্ট কী।
–তা বেশ। তোমাদের ছোট বউ কি খ্যাংরা হাতে করেন না?
করেন, কিন্তু সেটা নেহাত বঙ্কিমি নবেলের ঢং হয়ে যাবে না?
–তা হলে তো দেবেন ঠাকুরের পুরনো তত্ত্ববোধিনী ছুঁড়ে বিধেন আনতে হয়।
সেজো হা হা করে হাসলেন। বনমালী হাসল না, বরং কিঞ্চিৎ উত্তেজিত। বলল, না না, ব্যাপারটাকে তুমি যেন কেমন হালকা করে দিতে চাইছ। নিজের ভাই ভাদ্দরবউয়ের আখেরটা দেখবে না?
সেজো তবু হাসেন। বললেন, নাঃ, তোমাকে কিছু বোঝানো যায় না দেখছি। পানপুরের দুলন জোলার গান শোননি, ও ভোলা মন, সহজ বোঝা নয়রে সহজ, অসহজের বাওড় (ঘূর্ণিস্রোত) দেখিস। বড় বউঠানের কথাগুলো তোমাকে আর তা হলে বললুম কেন? বড় বউঠান যখন কিছু বলছেন না, তখন বুঝতে হবে, তেমন কিছু ভাববার নেই। থাকলে তিনি নিজেই বলতেন। তুমি যা বলছ, সেটা তো আমাদের কালো দুলের বুড়িও বলতে পারত। আমাদের ছোট বউমাটি নেহাত ছেলেমানুষ। সে যে ঈর্ষা করছে, ভয় পাচ্ছে, জ্ঞান বুদ্ধি পাকলে সেটা আর তার হবে না, তখন সেও বড়বউঠানের মতোই আড়ালে হাসবে, অবিশ্যি স্বামীর ছিঁচকেমি আর মাতামাতি দেখে মন খারাপ তো হবেই। এই জ্ঞানটা আমাকে দিয়েছেন সেজোগিন্নি। আর আসল কথাটাও সেজোগিন্নির কাছেই শুনেছি।
–সেটা আবার কী?
সেজো গলা নামিয়ে চুপি চুপি বললেন, মোক্ষম। গগনের বউ মদ খায়।
কী যা তা বলছ?
–যা তা নয় হে, খাঁটি খাঁটি। কথাটা সেজোগিন্নি আদায় করেছেন ছোট বউয়ের কাছ থেকে। তারপরে চেপে ধরেছিলেন গগনের বউকে। গিন্নির কাছ থেকে যা জানতে পেলুম, তা হল, গগনের বউ স্বীকার করেছে। বলেছে, কী করব বলুন সেজো বউঠান, একটা কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে, তাই নেশা করাই শিখেছি। তা, যা আপনাদের দেশ, এখানে তো কারুর কাছে মুখ খোলবার উপায় নেই। অনেক ভেবেচিন্তে আপনার ছোট দেওরের ওপরেই ভর করেছি। ভেবে দেখলুম, মেলামেশা করা চলে, আপনাদের বাড়িটা সেইরকম, আর আপনাদের ছোট দেওরের ও সব চলে, ঘরেও থাকে। একটু চোখমুখ ঘোরালে যদি কৃতার্থ হয়ে, জোগান দিয়ে যায়, মন্দ কী! সেজোগিন্নি বলেছেন, ছোটকে তোর ভয় হয় না? শুনে নাকি গগনের বউ হেসে মরেছে। বলেছে, ওকে ভয় পাব কেন মিছিমিছি, ওর জারিজুরি আমার সব জানা আছে। কষ্ট হয় ছোট-র (ছোট বউ) কথা ভেবে, সে ভাবে আমি বুঝি তার বর ভাগিয়ে নিচ্ছি। সেজোগিন্নি বলেছেন, তা একরকম ভাগানোই তো। ছোটঠাকুরপো তোর মদের জোগান দেয়, তার সঙ্গে তুই হেসে ঢলে কথা বলিস, ঘরে বসে খাস…
সেজো হঠাৎ থামলেন। বনমালীর মুখের দিকে চোখ পড়ে সহসা তার কথা জোগাল না। বললেন, কী হল, তুমি অমন করে তাকিয়ে আছ যে?
বনমালীর চোখেমুখে তীব্র সংশয় অবিশ্বাস ও বিস্ময়। বলল, তুমি কি এ সব সত্যি বলছ নাকি?
সেজো খানিকটা হতাশ হেসে বললেন, নাঃ, ভাটপাড়ার বুদ্ধি মাঝে মাঝে সত্যি ঘুলিয়ে যায় দেখছি। সেজোগিন্নির নাম করে তোমাকে আমি মিছে কথা বলব?
বনমালী যেন একরকম নিঝুম ও কাতর হয়ে পড়ল। উচ্চারণ করল, ও বাবা!
পরমুহূর্তেই সচকিত বিস্ময়ে কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল, তারপর? সেজোগিন্নিকে কী জবাব দিলে।
–জবাব দিলে, আপনার ছোটঠাকুরপোটি ভাগাবার মতো পুরুষ নয়। ওকেই যদি ভাগাব, তা হলে গলায় দড়ি দিতে কী আছে? সেজোগিন্নি বলেছেন, তোর গলায় দড়ির বাকি কী আছে? ছি ছি ছি, ঘরের বউ, মদ ধরেছিস, তোর মুখ দেখলে পাপ, তোর সঙ্গে কথা বললে নরকবাস।
বনমালী বলে উঠল, মরে যাই! এই না হলে সেজোগিন্নি? তারপরে?
-গগনের বউ বলেছে, তা মরেছি সেজো বউঠান। যে মরেছে, তার আর পাপপূণ্যি কী আছে? আমি মরেছি অনেককাল। সেজোগিন্নি জিজ্ঞেস করেছেন, গগন ঠাকুরপো যদি কোনওদিন টের পান? গগনের কথা শুনে নাকি বউ জোরে হেসে উঠেছে, বলেছে, সেজোবউঠান, লোকে কত কী করছে, তাতে আপনার আমার কী যায় আসে? আমি কী করি না করি, টের পেলেই বা আপনাদের আকাশ (গগন) ঠাকুরপোর কী যায় আসে। তিনি যে অন্তরীক্ষ, আকাশ! কত বড়, কত উঁচু… এই পর্যন্ত বলেই নাকি গগনের বউয়ের চোখ ফেটে জল এসে পড়েছিল। সেই কান্না দেখে, সেজোগিন্নিরও নাকি বুকটা টাটিয়ে উঠেছিল, তিনি গগনের বউকে চেপে ধরে বলেছিলেন, উঁচু আর বড়, তাতে কীরে গগনের বউ, সে তোর স্বামী। তুই কাঁদিস কেন বউ? তোদের কী ব্যাপার আমাকে ভেঙে বল দিকিনি। গগনের বউ তখন বলেছে, আমায় আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না সেজোবউঠান, আর আমি কিছু বলতে পারব না। তবে নেশা করতে আমার ভাল লাগে, মন যেন সুখের পায়রা হয়, ঝুঁদ হয়ে পড়ে থাকা যায়। আপনাদের ছোটঠাকুরপোর জন্যে ভাববেন না। শত হলেও ভদ্রঘরের বউ, অমন জোগাড়ে আর কোথায় পাব। ছোটকে (ছোট বউ) আমি ভালবাসি, ওর ক্ষতি আমি করব না। আর মাথা খান সেজোবউঠান, নেশার কথা কাউকে বলবেন না। যদিও সেজোগিন্নি গগনের বউয়ের মাথা খেয়ে আমাকে সবই বলেছেন। কিন্তু যার মুখ দেখলে পাপ, কথা বললে নরকবাস, তার জন্যে সেজোগিন্নির নাকি প্রাণ পোড়ে। বলেন, বউটার চালচলন দেখলে নষ্ট বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু রাগ করতে পারিনে, বরং ওর হাসি দেখলে হাসি পায়, কষ্টও হয়। বউটা বড় দুঃখী।
সেজো চুপ করলেন। বনমালীর ভ্রুকুটি কৌতূহল মুছল না। তার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে, সেজো ঠোঁট উলটে হতাশ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন। বললেন, দেবা ন জানন্তি।
বনমালী বলল, রহস্যপূর্ণ।
সেজো বললেন, আমাদের দ্বারা উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই। মনে হয় সরষের মধ্যেই ভূত আছে।
-কী রকম?
–ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই ব্যাপারটা চাপা আছে।
-কী থাকতে পারে?
–বুঝলে তো বলতামই। এখন একমাত্র বঙ্কিমবাবুকে জানালে, তিনি একটা ইস্তাম করতে পারেন।
বনমালী উদ্দীপিত হল। যদিও ভ্রুকুটি সন্দেহে একবার সেজোর মুখ দেখে নিল সে। কারণ, ঠাট্টা কিনা, বুঝতে চাইল। সেজোর মুখে ঠাট্টার কোনও আভাস ছিল না।
বনমালী বলল, মন্দ বলনি। কিন্তু বলবে কে?
-তুমি?
–ভয় হয়।
–অবিশ্যি অনেক জেরা করবেন। তবে আমার ধারণা, কিছুই লিখবেন না।–
—কেন?
–লিখলেও, গগনের বউ হয়তো কোনও সহানুভূতি পাবে না। ভদ্রলোকের বউ মদ খায় শুনলেই হয়তো রেগে যাবেন।
–তবে কি পুজো করতে হবে?
–না, কার্যকারণটা বুঝে বিচার করতে হবে।
–সেটাও কি বঙ্কিমবাবু জানেন না?
-জানেন, সে জন্যে গগনের বউ হয়তো ওঁর উপন্যাসে কোনও নবাব বাদশার বদরুন্নিসা বেগম হয়ে দেখা দেবে। বাংলাদেশের গৃহস্থঘরের বউয়ের মুখে মদ ছোঁয়ানো কি এত সহজ? কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট ভিতঁনো হয়েছে, আর নয়।
বলেই সেজো বাড়ির ভিতরের দরজার কাছে গিয়ে, শিকল ধরে ঝনঝনিয়ে হাঁক দিলেন, ওরে ভোলা, ওরে হারু, তোরা কে আছিস, শিগগির একবার সেজোগিন্নিকে আসতে বল।
ভিতর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল, যাই।
চিৎকারটা এগিয়ে আসতে আসতে আবার মিলিয়ে গেল। বনমালী তখন হাসছিল সেজোর দিকে চেয়ে। সে জানে, এ তল্লাটেই শুধুনয়, সেজোর মতো বঙ্কিম-ভক্ত গোটা বাংলাদেশেই কম। কিন্তু অপর বঙ্কিম-ভক্তের কাছে উনি খুঁত কাড়বেনই। ভক্তের এ আর এক রূপ। নিজের মুখে নিন্দা করে, পরের মুখের প্রশংসায় তার আত্মা আনন্দ বোধ করে। অনেক ভক্তের থেকে সেজো বঙ্কিমকে বোঝেন বেশি, যদি কখনও তাকে কলম ধরানো যায়নি। তার কথা বনমালী সসংকোচে দু-একবার বলেছে বঙ্কিমবাবুকে। বঙ্কিমবাবু তাকে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। সেজোকে রাজি করানো যায়নি। এ ক্ষেত্রে নতুন কনের চেয়েও তার জড়তা যেন বেশি। সঞ্জীববাবুর সঙ্গে কোনওক্রমে একবার আলাপ করানো গিয়েছিল। বন্ধুর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে, বনমালী তার হাতের বইয়ের দিকে একবার তাকাল। সে তাকানোর মধ্যেও তার চোখে প্রেম-গর্বিত হাসি। সেজো তখনও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, স্ত্রীর অপেক্ষায়। শ্রীমান বনবিহারী কুরসি আশ্রয় করে বঙ্গসিন্ধুতে মনোনিবেশ করেছে। নিরুপায় বেচারির আর কী-ই বা উপায় ছিল?
ওদিকে চুড়ির ঝনাৎকার শোনা যেতেই, সেজো চিক তুলে ধরলেন। সেজোগিন্নির গলা শোনা গেল, বাবা রে বাবা, বৈঠকখানা থেকে এত হাঁকডাক কীসের?
সেজো বললেন, এখন থেকে নাকি? কখন থেকে হাঁক পাড়ছি।
–ইস, কখন থেকে না আর কিছু। কিছুক্ষণ আগেই তো ।
সেজোগিন্নির কথা শেষ হল না। বৈঠকখানা ঘরে ঢুকতে গিয়ে, অন্যলোক দেখেই, সংকুচিত লজ্জায় অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল। তাড়াতাড়ি ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে বলে উঠল, ওমা! ছি ছি!
বলেই ফিরে যেতে উদ্যত হল। বৈঠকখানা ঘরে স্বামীর কাছে আসাটা বেআদবি নয়। অপরিচিত পুরুষের সামনে সম্পূর্ণ নিষেধ।
সেজো তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ওগো, এ আমাদের বনমালী ঠাকুর, তোমার বনমালী ঠাকুরপো।
সেজোগিন্নি তখনও কাপড় সংযত করতেই ব্যস্ত, যদিও ভিতরে ছুটে গেল না। বলল, তা বলবে তো। একটু আগে দেখে গেছি, কী একটা কাগজ পড়ছ, ভাবলুম একলা রয়েছ।
সেজো হেসে বললেন, দোকলা হলেও, চেনা মানুষ তো গো! বনমালী ঠাকুর বলেই তো ভেতরে ডেকেছি।
বনমালী কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, নমস্কার বউঠান। আপনাদের আসার খবর পেয়েই ছুটে এসেছি।
ইতিমধ্যে সেজোগিন্নির অবগুণ্ঠন মুখ থেকে সরেছে। কপাল পর্যন্ত ঢাকা থাকলেও মুখখানি দেখা যায়। মধ্য তিরিশের ঘরে বয়স হলেও, মুখখানি এখনও কাঁচা ঢলোঢ়লো। ঠোঁটে পানের রক্তিমা, নাকে ছোট্ট চিড়িতনের নাকছাবি। বলল, আপনাদের বলে আর বউঠানকে টানা কেন? বলুন, বন্ধুর জন্যে।
সেজো আর বনমালীর চোখাচোখিতে, হাসি বিচ্ছুরিত হল। সেজো বললেন, ওগো, তাও নন, উনি এসেছেন আসলে ফ্যাস্তা দেখতে। তুমি, আমি কেউ নই।বনমালী তাড়াতাড়ি বলল, না বউঠান, বিশ্বাস করুন, ফ্যাস্তা আছে ঠিকই, তবু আপনাদের দর্শন।
সেজোগিন্নি হেসে বলল, বুঝেছি, রথ দেখা কলা ব্যাচা, দুই কাজই হাসিল করতে এসেছেন।
সেজো সচকিত হয়ে বললেন, আমরা দোকলা নই, তেকলা। আর এক ঠাকুরকে তুমি দেখিতেই পাওনি এখনও।
বলেই তিনি শ্রীমান বনবিহারীকে হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে এলেন। তৎক্ষণাৎ সেজোগিন্নি হাত বাড়িয়ে বনবিহারীকে টেনে বুকের কাছে নিয়ে নিলেন। বললেন, ও মা, বলতে হয়! এক পাশটিতে চুপ করে বসে আছে, দেখতেই পাইনি।
বলেই বুকের কাছে চেপে, বনবিহারীর কপালে চুমো খেল। সেজো বললেন, বেচারি অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আছে।
–আহা! তোমরা ওইরকমই।
সেজো বললেন, কী করব বলল। আমি তোমাকে আগেই ডাকতে যাচ্ছিলুম, বনমালী গগনের বউয়ের গপ্পো শুনতে চাইলে।
বনমালী চোখ কপালে তুলে বলল, আমি! তুমিই তো।
কথা না শেষ করেই সে থেমে গেল। সেজোর স্ত্রীর সামনে তাকে বিব্রত ও অপরাধী মনে হল। ততক্ষণে সেজো হা হা করে হেসে উঠেছেন।
সেজোগিন্নি ঘোমটা আর একটু সরিয়ে স্বামীর মুখের দিকে বাঁকিয়ে তাকাল। ঠোঁট টিপে হেসে বলল আপনি শুনতে চাননি ঠাকুরপো, আমি জানি! গগনের বউয়ের গপ্পো এখন আপনার বন্ধুর মুখেই সব সময়েই ভিয়োঁচ্ছে। ভাল লেগেছে কি না!
বলে আবার একটু কটাক্ষ করল স্বামীর প্রতি। সেজো বললেন, সে কী গো, আজ অবধি যে তাকে চোখেও দেখিনি।
স্ত্রী বলল, না দেখেই এত, দেখলে কী হত, কে জানে।
সহসা থেমে গেল সে, বনবিহারীর প্রতি ইঙ্গিত করে জিভ কাটল। অর্থাৎ, ছেলেমানুষের সামনে এ সব কথা বলা, সেজোগিন্নির কাছে নীতিবিগতি। তাড়াতাড়ি বলল, যাই হোক, এ সব কথা এখন থাক। মোট কথা, আপনার বন্ধুর খুবই উৎসাহ দেখছি, একটু সামলান।
সেজো আর একবার হা হা করে হাসলেন। বললেন, ও বাবা! তোমার মুখ যে অমন ফোটে, তা তো জানতুম না।
স্ত্রী বনমালীর দিকে তাকিয়ে, নিষ্কলুষ হেসে বলল, ফোঁটালেই ফোটে।
বনবিহারীকে চিবুকে হাত দিয়ে বলল, চলো বাবা, আমরা ভেতরে যাই। বনবিহারী এর আগেও দুবার দেখেছে সেজোগিন্নিকে। তার ভাল লাগে, সেই ভাল লাগার মধ্যে কোথায় একটা অচেনার আড়ষ্টতা থাকে। প্রথম কারণ, পোশাক। বাড়ির মধ্যে এত সাজগোজ করে কাউকে থাকতে দেখেনি সে ভাটপাড়ায়। তার উপরে জামা গায়ে দেওয়া আরও আশ্চর্যের। তার মাকে সে কালেভদ্রে জামা গায়ে দিতে দেখেছে। ভাটপাড়ায় সম্ভবত জামা গায়ে দেওয়ার রেওয়াজটা এমনিতেই কম। তাও আবার বাড়ির ভিতরে। দ্বিতীয় কারণ, গন্ধ। সেজোগিন্নির এই ধোপদুরস্ত নীল সোনালি পাড়ের তাঁতের শাড়ি ও জামার সঙ্গে, একটা আশ্চর্য গন্ধ মাখানো আছে। যে গন্ধটা তার একেবারে অচেনা, যদিও ভাল লাগে, একটি বিচিত্র কৌতূহল হয়। তৃতীয় কারণ, কথা। সেজোগিন্নির কথার উচ্চারণের মধ্যে কেমন একটা স্পষ্টতা আছে, অন্য সুর আছে, যেটা মায়ের বা অন্যদের নেই। শুধু একটি বিষয়েই বনবিহারীর আপত্তি। এ জ্যাঠাইমার আদরের ঘটা। এত আদর ও খাওয়ানো, তার নিশ্বাস রুদ্ধ করে তোলে।
বনবিহারী বলল, ফ্যাস্তা দেখব।
গিন্নি বনবিহারীর গাল টিপে বলল, আমরাও দেখব। তুমি আমার সঙ্গে দেখবে, তারপর বাবার দিকে তাকাল। বনমালী বলল, সেই ভাল।
-এবার চলল, তোমার মায়ের কথা শুনিগে। ওঁরা ওঁদের কথা বলুন।
গিন্নি যেতে উদ্যত হয়ে, দুই বন্ধুর প্রতিই একবার কটাক্ষ করল। বনমালী ইঙ্গিত বুঝে অসহায় স্বরে বলল, আমার কোনও দোষ নেই বউঠান।
সেজো বললেন, কেবল একটু বেশি কৌতূহল, এই যা।
বলে হাসলেন। সেজোগিন্নি দরজার কাছ থেকে বললেন, সে মুখপুড়ি একটু আগেই এসেছে এ বাড়িতে। এখানে পাঠিয়ে দেব নাকি?
সেজো চোখ বড় করে বললেন, রক্ষে করো। যা শুনেছি, বলা যায় না, এসে হাজির হলেই হল। গিন্নি বলল, ভালই তো, কাব্যি করতে পারবে। সে মুখপুড়ি তো ইংরেজি কবিতাও বলতে পারে। তোমাদের ছোট ভায়ের মাথায় তো সে রস ঢোকে না।
সেজো তার ঈষৎ ধূসর কপালের চুল দেখিয়ে বললেন, এ বয়সে আর ও রস সইবে না।
গিন্নি চিকের পরদা তুলে বলল, তবে যাই বলি গে, বৈঠকখানা তোর কথাতেই মশগুল।
সেজো হেঁকে বললেন, খবরদার, মান যাবে।
গিন্নি ফিরে বলল, তবে যাতে মান না যায়, তাই করি গে। এ বাড়ির বউয়েরা সবাই মিলে, ওকে জাঁতায় পিষে মারি গে।
সেজো বললেন, খুব ভাল, সর্বোত্তম।
গিন্নি ততক্ষণে বনবিহারীসহ চিকের ওপারে। এ ঘরে দুই বন্ধুর হাসি উচ্চ রোলে বাজল। বনমালী বলল, খাঁটি কথা বলেছেন।
সেজো বললেন, খাঁটি বঙ্কিমি।
বনমালী এবার তার হাতের বইখানি তুলে দেখিয়ে বলল, হাতে করে নিয়েও এসেছি তা-ই।
–কী ওটা?
বলেই সেজো নিজের হাতে তুলে নিলেন। পাতা খুলেই, খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন, রাজসিংহ?
বনমালী বলল, খাঁটি বঙ্কিমি।
সেজো বললেন, কবে বেরিয়েছে, খবর পাইনি তো?
বনমালী বলল, বোধহয় আজকালের মধ্যেই বেরোবে, এখনও বাজারে বেরোয়নি।
সেজো এক মুহূর্ত অবাক হলেন। পরমুহূর্তেই হেসে বন্ধুর কাঁধে হাত দিয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে বললেন, কাঁটালপাড়ায় এসেছেন বুঝি? তোমাকে দিয়ে গেছেন?
-নইলে আর পাব কোথায় বলো?
সেজো ততক্ষণে পাতা খুলে দেখতে আরম্ভ করেছেন, বঙ্কিমবাবু নিজের হাতে সই করে স্নেহাস্পদ বনমালীকে রাজসিংহের প্রথম সংস্করণ উপহার দিয়েছেন। বললেন, এই একটা ব্যাপারে, তোমাকে বড় ঈর্ষা করি।
বনমালী বলল, তাও তোমার নিজের দোষে। তুমি কোনওদিনই গেলে না। কলকাতায় থাক, তোমার দেখা করার আলাপ করার কত সুবিধে। তোমার লজ্জাই ঘোচে না। এদিকে তো ঘোমটার নীচে খ্যামটা নাচে।
সেজো হাসলেন, হাসতে হাসতেই ভূমিকাপ পড়তে আরম্ভ করলেন। পড়তে পড়তেই চোখ তুলে বললেন, তোমার পড়া হয়েছে তো?
–আমি কাল রাত্রেই শেষ করেছি। জানি, কলকাতায় বসেও, বঙ্গদর্শনের পাতা উলটে তোমার পড়া হয়নি, তাই তোমার জন্যেই নিয়ে এসেছি।
সেজোর খুশির হাসি উপছে পড়লেও, আবার ভূমিকাতেই মনোনিবেশ করলেন, এবং ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন, এই সব দেখলেই আমার খারাপ লাগে। মানিকলের চরিত্রের জন্যে এই কৈফিয়তটা উনি কেন দিতে গেছেন? কোন রামে শামে কী বলেছে, অমনি তাদের গণ্য করতে হবে? বনমালী বলল, গণ্য তো করেননি, তাদের রাজসিংহ পড়তে বারণ করেছেন। সাহিত্যিকেরা আবার একটু বেশি বিনয়ী হন তো। অথচ সত্যি বলতে কী, মানিকলের চরিত্রটি আমার সবথেকে ভাল লেগেছে, সেই বাস্তব, আমাদের পরিচিত। সে ছিল ডাকাত, অথচ তার মধ্যে ছিল সততা, মহত্ত্ব, বীরত্ব…।
সেজো বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, উ হুঁ হুঁ, ভাঁড় আর খুলো না, রস গড়িয়ে পড়ে যাবে। উনি কবে কাঁটালপাড়ায় এসেছেন বলল।
বনমালী হেসে বলল, এসেছেন কী, এসেছিলেন, কলকাতায় চলেও গেছেন। উড়িষ্যার জাজপুরে বদলি হয়েছেন, চলে যাবেন শিগগিরই, তাই কয়েকদিন কাঁটালপাড়ায় কাটিয়ে গেলেন। কলকাতা থেকেই চিঠি দিয়েছিলেন, অমুকদিন যাব, দেখা কোরো।
এমন সময়ে ভৃত্যের আবির্ভাব। বলল, সেজো মা বললেন, আপনাকে খেতে দেওয়া হয়েছে। আর বললেন ওয়াকে ভেতরে নে যাবেন, না এখেনে খাবার পাঠাবেন।
ওঁয়াকে অর্থাৎ বনমালীকে। বনমালী নিজেই বলল, বলোগে, যখন বেরুব, তার আগে যা দেবেন, তাই খেয়ে যাব, এখন কিছুই নয়।
ভৃত্য চলে গেল। সেজো বললেন, সাহস খুব বেড়েছে দেখছি, ব্রেহ্মবাড়িতে যা দেবে তাই খাবে। দাঁড়াও, অজ ঠাকুরকে ভাটপাড়ায় খবর দিচ্ছি।
বনমালী বলল, সংবাদ পুরনো। কিন্তু তুমি এবার খেয়ে এসো, অনেক বেলা হয়েছে।
হ্যাঁ যাই, খেয়ে এসে দুজনে একটু বিশ্রাম করব, তারপরে ফ্যাস্তা। তুমি ততক্ষণ রামবাঁড়ুজ্জের বঙ্গসিন্ধুর ফ্যাস্তাটা পড়ে নাও। তবে লেখাটা পড়ে বুঝলাম, মালমশলা সবই গগনের দেওয়া।
বলে সেজো যেতে উদ্যত হয়ে, আবার কাছে এসে নিচু স্বরে বললেন, হ্যাঁ শোনো, চারটের গাড়িতে দু-একজন কলকাতার বন্ধু আসছে। আমি চুনুরিপাড়ার কালী মাঝিকে বলে রেখেছি, সে তার ভাউলে নিয়ে আসবে। কলকাতার বন্ধুরা বলেছে, তারা ইংলিশ শাম্পেন আনবে কলকাতা থেকে, ফ্রেঞ্চ শাস্পেন নেবে ফরাসডাঙা থেকে। তোমার আবার তাতে বায়ু কুপিত হবে না তো?
বনমালীর মুখে হাসি চাপা দেবার জন্যে ভুরুতে কুঞ্চন। বলল, কথাটা নতুন মনে হচ্ছে?
–কী রকম?
–এই বায়ু কুপিত হবে কি না। ও বিষয়ে হাতে খড়ি তোমার কাছে, কুপিত হলেও তোমার দৌলতেই হবে।
সেজো হা হা করে হেসে বললেন, কুপিত হলে আমার জন্যে হবে কেন?
বনমালী বলল, কুপিত হবার মতো যদি কিছু কর বা বলো। আজ পর্যন্ত তো সেরকম কিছু হয়নি, গুরু যেমন বলেছেন, সেইরকমই করেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, ছেলে?
সে তো জ্যাঠাইমাদের সঙ্গে থাকবে।
–ভাটপাড়ায় ফিরব যখন? শাম্পেনের কি গন্ধ নেই?
–তা আছে
–শাম্পেনে কি পা টলে না?
তাও টলে।
–তবে?
–তবে আবার কী, তোমাকে কালী মাঝি ভাউলে করে পৌঁছে দেবে ভাটপাড়ার ঘাটে, সেখান থেকে কয়েক পা গেলেই তো বাড়ি। আর পা টলবার মতো খাবেই বা কেন?
আমি না খেলেও, তুমিই খাওয়াবে তখন। আর না খেলেই তোমার মুখে ইংরেজি ফরাসি বুকনি শুরু হয়ে যাবে। শত হলেও টোলো পণ্ডিত। জানাজানি হলে তখন তোমাদের পাথুরেঘাটার পিরিলিঠাকুরেরা তাদের শ্যামনগরের টোল থেকে হয়তো বিদেয় করে দেবেন।
–এই নাও, তুমি যে একেবারে সাতকাণ্ড রামায়ণ শুরু করলে, খাবে তো বাপু একটু শাস্পেন। মোটের ওপর, খবরটা তোমাকে আগেই জানিয়ে রাখলুম।
বলতে বলতে সেজো হেসে উঠে আবার বললেন, অবিশ্যি রাম বাঁড়ুজ্জের প্রবন্ধ আর শাম্পেনে কোনও মিল নেই, তবে ওই আর কী, একটু ফ্যাস্তা করতে তো দোষ নেই।
সেজো আর না দাঁড়িয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। আর বনমালী খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শাম্পেন না হোক, ব্রান্ডি বা স্কচ হুইস্কি যে ইতিপূর্বে চলেনি, তা নয়। দীক্ষা সেজোর কাছেই, এবং যতবার খাওয়া হয়েছে, ততবার তার সঙ্গেই। কিন্তু সে জন্যে আগে থেকেই, একটা প্রস্তুতি থাকত। যদিচ প্রত্যেক বারেই ব্রাহ্মণীর অশ্রু দর্শন করতে হয়েছে, এবং একটা অলৌকিক ভয়ে প্রায় মৃতবৎ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে, ও তারপরে আদরে সোহাগে তাকে আয়ত্ত করতে হয়েছে, তথাপি মজুরি পোষায় না। কান্নাকাটি, ভয় ভাঙানো, তারপরে যখন গৃহিণীর প্রাণের দরজা খুলল, বনমালীর তখন ব্রান্ডি হুইস্কির সকল উত্তাপ নিভে ছাই হয়ে গিয়েছে, ক্লান্তি ও বিরক্তি তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। তখন হয়তো আর একজনের গরজ, কারণ তখন তার মন ও দেহ সবদিক থেকেই প্রস্তুত।
অবিশ্যি এতসব সত্ত্বেও মনটা খুশিতে দুলে উঠল। কারণ, ইচ্ছে তো করে বটেই। নেহাত নানান ভয় ও বাধা এসে দাঁড়ায় বলেই যত দ্বিধা। প্রত্যহের ব্যাপার নয়, মাঝে মাঝেও নয়, কালেভদ্রে সেজোর কল্যাণে একটু খাওয়া হয়ে থাকে। আজও তাই হবে। মন্দ কী, না হয় গৃহিণীকে নিয়ে একটু বিপাকে পড়তে হবে। তবু সকলের সঙ্গে নৌকোয় করে একটু হইচই তো করা হবে। বনমালীর দীর্ঘশ্বাস পড়ে। জীবনের যে গণ্ডিতে তার বাস, হাতছানিটা বার বার তার বাইরের জগৎ থেকেই এসেছে। সে চায়নি, তাই গ্রহণ করতে হয়েছে। এ আক্ষেপ ব্রাহ্মণীর জন্যে নয়, নতুন শতাব্দীর বৃহত্তর জগতের প্রতি তৃষ্ণা। সে বঙ্গসিন্ধুতে মনোনিবেশ করল।
কয়েকদিন বর্ষণের পর আষাঢ়ের শেষাশেষি এই দিনটি আজ যেন অকাল শরতেরই রূপ নিয়েছে। হুগলি চব্বিশ পরগনার মানুষের সৌভাগ্য, ফ্যাস্তার দিনটি বর্ষায় ভাসেনি। নীল আকাশের গায়ে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। রোদ ও ছায়া যেন পরস্পরের পিছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। মজুমদারবাড়ির বৈঠকখানা চত্বরে সেই রৌদ্র মেঘের খেলা চলেছে। দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে আলস্য আলাপে রত দুই বন্ধুর মনকেও এই অকাল শরতের আবহাওয়া আমেজে ভরে তুলেছে। ইতিমধ্যে তৃতীয়বার কলকে বদলানো হয়েছে গড়গড়ার। চিৎপুরের মুসলমানি নল, নীচের গড়গড়া থেকে, তক্তপোশের উপর আধশোয়া দুই বন্ধুর হাতে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিষ্টুপুরের তামাকের গন্ধ ঘরে। বনমালী বারে বারেই কাশছে, তামাকে তার অভ্যাস নেই, নস্যিতেই সে অভ্যস্ত।
সেজো মজুমদার হিতেন্দ্ৰই কথা বলছিলেন, বনমালী শ্রোতা। বিদেশি সাহিত্য দর্শন, জীবনের ভাবনা চিন্তা, দেশের কথা, স্থানীয় অঞ্চলের বিষয়। সেজো সেনবাড়ির কথা বলছিলেন, ক্রমবর্ধমান কলকারখানার কথা। ভাটপাড়ার কাছে অস্ট্রিয়ানদের জমি, কাঁকিনাড়ার জার্ডিন-স্কিনারদের বিরাট কারখানা, সেনপাড়ায় বেগ-ডানলপের জমি ক্রয়। সেজো বলছিলেন, ইংলন্ডের শিল্পবিপ্লব বুঝতে পারি, সেই পরিবর্তন তাদের কোথায় টেনে নিয়ে চলেছে, তাদেরই কথা থেকে বুঝতে পারি। এক বিরাট উত্থান শুরু হয়েছে প্রায় একশো বছর ধরে, আমরা তার কী ধরনের শরিক, বুঝতে পারি না। অন্ধকে তুমি যে কোনও রাস্তায় টেনে নিয়ে যেতে পার, চালিয়ে দিতে পার, সে না জেনে না বুঝে সেই পথেই চলে যাবে, গিয়ে হয়তো গর্তে পড়ে মারা যাবে। বিপথে গিয়ে হাহাকার করবে। অন্ধ বলেই সে অসহায়, পরের উপর নির্ভরশীল, তার অবস্থা বুঝতে পারি। কিন্তু ইংরাজরা আমাদের লেখাপড়া শেখানোটা কেন বন্ধ করে রাখতে পারল না। বাইরের পৃথিবীর দরজাটা তারা কেন চিরদিন আমাদের মুখের উপর বন্ধ করে রেখে দিল না। তা হলে অন্ধ বলে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতে পারতুম। কিন্তু সেই জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার হাল আমাদের। দৃষ্টি আছে, দেখতে পাই, দেখার কথা বলতে পারি না। প্রাণ আছে সুখ দুঃখ আছে, বলতে পারি না। ইজ্জত আছে, তবু মান সম্মানের কথা বলতে পারি না। দেশ জুড়ে বিরাট পরিবর্তনের পালা চলেছে, কিন্তু আমরা কে?…এমনি সব নানানরকমের কথা বলছিলেন। স্কটল্যান্ডের কবি টোবিয়াসের দি টিয়ার্স অব স্কটল্যান্ডের সপ্ত স্তবক আবৃত্তি করতে গিয়ে তার এই সব আরও বলতে ইচ্ছে করছিল। দাই সনস্ ফর ভ্যাল্যোর লঙ রিনৌ, লাই স্লটার্ড অন দেয়ার নেটিভ গ্রাউন্ড।…কথা বলতে বলতে একসময়ে ঘরোয়া বিষয়ে এসে পৌঁছলেন। সে সময় বাইরে থেকে একটি ভারী ক্লান্ত বিনীত গলা শোনা গেল, তারা কেউ আছেন নাকি?
সেজো জিজ্ঞেস করলেন, কে?
-আমি লখীন্দর। সেজোকত্তার কাছে একবারটি এয়েছিলুম।
লখাইয়ের কথা শেষ হবার আগেই সেজো ডাক দিলেন, ওহে লখাই এসো এসো।
লখাই চিকের পরদা তুলে ঢুকল। সেজো ও বনমালী, দুজনকে দেখেই তার বিমর্ষ অন্ধকার চোখে একটু আলো ফুটল। বলল, কী ভাগ্যি আমার, আপনারা দুজনেই রয়েছেন।
বনমালীও ডাকল, এসো লখীন্দর, কেমন আছ?
লখাই তখন দুজনকেই মাটিতে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করছিল। মাথা তুলে বলল, আছি ঠাকুরমশায়, ভগমান যেমন রেখেছেন। মনটা ভাল না, ভাবলুম একবার সেজোকৰ্ত্তাকে দর্শন করে আসি। শুনিচি এয়েছেন। তা অনেকদিন বাদে দুজনকার দেখাই একসঙ্গে পেলুম।
সেজো বললেন, বসো লখাই।
—বসি আজ্ঞে।
মেঝেতে বসতে বসতে বলল, আপনাদের ধেয়ান নষ্ট হল না তো?
ধেয়ান আবার কী, আমরা গল্প করছিলুম। তোমার খবর বলো, সব ভাল তো?
–না সেজোকত্তা। শ্যামদাদার অবস্থা ভাল না। একভাবে পড়ে আছে। অনেককাল ধরেই তো শয্যে নিয়েছে, আজ তিন দিন ধরে দাঁতে কুটো কাটছে না, শুধু জলের ওপর আছে। এক এক সময় মনে নিচ্ছে কী, এই বুঝি দম বন্ধ হয়ে গেল। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে আর বউঠানের নাম ধরে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে। এ যাত্রা বোধহয় আর টেকানো গেল না।
শ্যামের অবস্থার বিবরণ দিয়ে, মধুর দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি, কালীর দুর্গতি, একলা হতে চাষবাসের দুবস্থা, সবই বলল লখাই। কিন্তু এ সে লখাই নয়। সেই খাড়া জোয়ান, গলার স্বরে যার তেজ ফুটে উঠত। মুখে দাড়ি গজিয়েছে, শরীরটা ভেঙে পড়েছে, গলার স্বর নিচু বিষণ্ণ। চোখ দুটি গভীর অন্ধকার পরিখায় ডুবে রয়েছে। কথায় কথায়, নতুন, তৈরি হতে যাওয়া কারখানার বিষয় বলতে গিয়ে, অস্তিস্ক দেওয়ানদের কাছ থেকে পাওয়া জমি কী ভাবে গোমস্তারা তার টিপসই নিয়ে কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছে, সে কথা জানাল। কিন্তু গোমস্তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলতে গিয়ে, তার গলায় ক্রোধ বা বিক্ষোভ ফুটে উঠল না। লখাইয়ের পক্ষে যেটা অবিশ্বাস্য। সেজোর মুখে তো আশঙ্কাই ফুটে উঠল, গোমস্তাদের কাউকে সে পিটিয়ে ঘাড় ভেঙেছে কি না। কিন্তু লখাই সেরকম কিছুই করেনি। এমনকী, বৃদ্ধা দেওয়ানগিন্নির কাছে দরবার করতে পর্যন্ত যায়নি। সে কি ইচ্ছা করলে, ওই কাছারিবাড়ির ভূত দুটোকে গঙ্গার পলির পাঁকে ডুবিয়ে মারতে পারত না? তাতে কী লাভ। গোঁসাইদের নায়েব বা কোম্পানির গায়ে তো আঁচড়টিও লাগবে না। লখাইয়ের জমিও ফিরে আসবে না। কোম্পানির জেলে গিয়ে কেবল ঘানি টানতে হবে। গোমস্তাদেরই বা কী দোষ দেওয়া যায়। সারা হিন্দুস্তানেই তো আজ অনাচারের লীলা।
বনমালী বলল, আগে তো মাঝে মধ্যে ভাটপাড়ায় যেতে, আজকাল তো একেবারেই দেখিনে।
লখাই অদ্ভুতভাবে হাসল একটু। বলল, সে এক মজার বিত্তান্ত ঠাকুর, আপনাকে বলা হয়নি। একদিন সকালবেলা আপনার কাছে যাব বলে গেছলুম। মনটা ভাল ছেল না, হীরাটা ভুগছিল। কয়েকদিন জীবনকেষ্ট ঠাকুরমশায়ের কাছে তাঁর ঠাকুরের চন্নামেত্তোর জন্যে গেছলুম। আপনার কাছে একদিনও যাওয়া হচ্ছিল না। তা ছেলেটা ত্যাখন একটু ভাল, একদিন ভোর ভোর উঠে, আপনাকে দর্শন করবার জন্যে বেরিয়ে পড়লুম। আপনার বাড়ি যাবার আগেই, কী যেন সেই ঠাকুরমশায়ের নাম, আমি জানি না। পেকাণ্ড কোঠা দালান তাঁদের, তার গায়ে মন্দির। ওঁয়াদের বাড়ির পাশ দিয়েই তো যেতে হবে। জানেন তো রাস্তাটা যেমন সরু, তেমনি দুপাশে বেড়া, কোথাও ইদিক উদিক করবার উপায় নেই। যাচ্ছিলুম, এমন সময় কোঠাদালানের ঠাকুর, বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন, হাতে তাঁর শালোগেরামশেলাই ছিলেন বোধকরি। তা কী বলব ঠাকুর, আমাকে দেখেই তাঁর মুখখানি লাল টকটকে হয়ে উঠল। চোখ দিয়ে আগুন বেরতে লাগল, মনে হল, সত্যি ভস্ম হয়ে যাব। গুমাখা শুয়োর দেখলেও মানুষ অমন মুখ করে না, এমন ঘেন্না তাঁর সারা মুখে। কী দোষ করেছিলুম জানি না, আমি দাঁইড়ে পড়লুম, উনিও দাঁইড়ে আমার গায়ে আগুন ছিটোতে লাগলেন। কিন্তু মুখে কথাটি নাই। কী করব, বুঝতে পারি না। তখন কি জানতুম, ওই সাত সকালে পুজো করতে যাবার মুখে, আমাকে দেখেই ওঁয়ার পাপ হয়ে গেছে। তার উপরে যদি আবার ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায়। আর তখন নাকি ওঁয়ার মৌনী, কথা বলবেন না। বুঝতে না পেরে তাই দাঁইড়েই রইলুম। উনি রেগে হাত নাড়লেন। ভাবলুম বুঝি, বেড়া ঘেঁষে দাঁড়াতে বলছেন, তাই দাঁড়ালাম। তা, উনি আঙুল দিয়ে রাস্তার উপরে আমার ছায়াটা দেখালেন। সত্যি, রাস্তার উপরে আমার ছায়াটা পড়েছিল, সুয্যিঠাকুরও এমন হেলে রয়েছেন, তায় সকালবেলার রোদ, ছায়া ছোট হয় না, তার উপরে কী বলব ঠাকুর, ভগমান আমার গতরখানিও তেমনি করেছেন। ইদিক উদিক করেও, রাস্তার উপর থেকে ছায়া নড়াতে পারি না। ওদিকে সেই ঠাকুরমশায়ের রাগ একেবারে সপ্তমে। খেপে গিয়ে, হাতের ঠাকুর সামনের মন্দিরের বারান্দায় রেখে, পায়ের কাছে যে গোবরের দলা পড়েছিল, তাই ছুঁড়ে ছুঁড়ে আমাকে মারতে লাগলেন, আর হাত দিয়ে, উলটো দিকে যাবার নিশেনা দিতে লাগলেন। গায়ে গোবর নিয়ে আমি তাড়াতাড়ি ফিরে চলতে লাগলাম। তা মনটায় এত দুঃখু হল ঠাকুর, আর ফিরতে ইচ্ছে করল না। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে খিরপাড়ায় চলে গেলুম। ছিরিশ মোড়লের ঘরের কাছে গিয়ে, একটা বাঁশঝাড়ের তলায় অনেকক্ষণ বসে রইলুম। তারপর আর ছিরিশ দাদার সঙ্গেও দেখা করতে মন চাইল না, ঘরে ফিরে গেলুম। যাবার আগে পদ্মপুকুরে ডুব দিয়ে নেয়ে গেলুম। আর যাওয়া হয়নি ভাটপাড়ায়।
এই মজার বৃত্তান্ত বলতে গিয়ে, যে অদ্ভুত হাসিটি দিয়ে শুরু করেছিল লখাই, সেই হাসিটি আরও ব্যাপ্ত হয়ে পড়ল তার মুখে। কিন্তু সেটা হাসি বলে মনে হল না। আকাটা দাড়ি ভর্তি মুখখানি যেন কান্না মাখানো প্রায়।
সেজোর হাতে গড়গড়ায় চিৎপুরি নল ধরাই ছিল, টানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি মেঝের দিকে তাকিয়েছিলেন, তাঁর মুখ থমথম করছিল। বনমালীও গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। সে বলল, এ সেই আমাদের কলির ঋষি আদু ভাজ নিশ্চয়। উনি পুজো না করে কথা বলেন না।
সেজো লখাইকে বললেন, তবু লখাই তুমি ভাব, তোমার দেশ কেন বিদেশিরা শাসন করবে, বিদেশের রানি কেন তোমার দেশের রানি হবে।
লখাই বলল, তা ভাবি সেজোকত্তা। তারা যে বিদেশি।
সেজো বললেন, আর এই পাপেই বিদেশি তোমার দেশের রাজা। তোমার দেশের লোকেরা একদিন এই পাপে দলে দলে মুসলমান হয়েছিল। নইলে তাদের পরিত্রাণের আর কোনও উপায় ছিল না। এবার দলে দলে সাহেব ভক্ত হচ্ছে।
লখাই চুপ করে রইল। মেঝেতে আঙুল ঘষল খানিকটা, তারপরে মাথাটা নাড়ল। না, সে সেজোকর্তার কথা মেনে নিতে পারছে না। হিতেন্দ্রও সে কথা জানতেন। জানতেন, লখাই এ সব বিষয়কে নিজেদের ঘরের বিবাদ বলে মনে করে। তিনি জানেন, লখাই ভাবছে, আমার ঘরে পাপ; ইংরেজ কোন পুণ্যের বলে এ দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। নিজের পাপ সে নিজেই স্খলন করবে, তবু বিদেশের শাসন সে মানতে চায় না। অন্য সময় হলে হয়তো সে উত্তেজিত হয়ে কথা বলত। কিন্তু লখাই নিষ্প্রভ, তার ব্যবহারে সেই উদ্দীপনা নেই।
সেজো আবার বললেন, তোমার মনের কথা আমি জানি হে লখাই। কিন্তু তুমি পাপের সাজাটাকে মানতে চাও না। পাপ করলে তার শাস্তি পেতে হয়। তা দেখ, তুমি তো বিদেশির শাসনে মন গুমরে মর, আদু ভটচাজ বহাল তবিয়তে শালগ্রামশিলায় জল ঢেলে যাচ্ছে, মানুষকে শুয়োরের মতো তাড়া দিচ্ছে। তার বিদেশি বলো দেশি বলল, কোনও শাসনেই কিছু যায় আসে না। তার ঠাকুরেরও কিছু যায় আসে না। তার আচারবিচার নিয়ে সে দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে। অবিশ্যি এমন দিন চিরকাল থাকবে না। একদিন এদেশ স্বাধীন হবে হয়তো, তবে এ পাপ শেষ না হলে নয়, এইটে জেনে রেখ।
লখাই কয়েক মুহূর্ত বোবার মতো তাকিয়ে রইল। তারপরে যেন অনেক চেষ্টায় উচ্চারণ করতে পারল, কী কষ্ট বলেন তো সেজোকত্তা।
সে যে ঠিক কী বলতে চাইল, পরিষ্কার বোঝা না গেলেও, তার গলার স্বরে একটা সামগ্রিক অসহায়তা যেন ফুটে উঠল। একটা নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ বলল, কদ্দিন থাকবেন?
সেজো বললেন, কোথায় আর থাকা, দু-একদিন বাদেই চলে যাব।
বনমালী বলল, ফ্যাস্তা দেখতে যাবে নাকি?
লখাই বলল, না ঠাকুর, কোনও দিন যাই না। ফি বছরই তো হয়, ভাল লাগে না। যাদের আনন্দ, তাদের আনন্দ, আমাদের কী বলেন।
বনমালী তখন সদ্য বঙ্গসিন্ধু পড়েছে। সে ফ্যাস্তার বিষয় তাকে বোঝাতে চাইল। দু-এক কথা বলতেই লখাই বলল, সে কথা আমি রামঠাকুরের কাছে শুনেছি। তাই বলি, একটা কথা বলতে পারেন ঠাকুর, যাদের নিজেদের দেশে এমন ঘটে, তবু তারা পরের দেশে থাবা বসিয়ে থাকে কেমন করে?
বনমালী সহসা উত্তর দিতে পারল না। সেজোও চুপ করে রইলেন। হয়তো, তাঁর যা বলতে ইচ্ছে করছিল, সে কথা বলে লখাইকে বোঝানো যেত না। লখাই উঠে দাঁড়াল। বলল, যাই, দুজনারই দেখা পেলুম, কিন্তু বসবার উপায় নেই। শ্যামদার জন্যে মনটা খারাপ।
নিচু হয়ে নমস্কার করে সে বিদায় নিল। সেজো বললেন, সময় পেলে কাল পরশু আবার এসো
–আজ্ঞে আচ্ছা।
লখাই বেরিয়ে এল। রাস্তায় লোকজনের ভিড়। মেয়ে পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ, সকলেই ফ্যাস্তা দেখতে চলেছে। সকলের গতি ঘাটের দিকে, তার মাঝখানে লখাই তার উজানের মাঝি। এখন, এই মুহূর্তে তাই সেজোকর্তা বা বনমালী, কারুর কথাই আর মনে পড়ছে না। ইদানীং তার নিজেরই এক এক সময় সন্দেহ হয়, তার অবস্থাও শ্যামের মতো হচ্ছে কি না। কী একটা ঘোরের মধ্যে সে থাকে, কখন কী কথা ভাবে, হঠাৎ মনে করতে পারে না। সব যেন এলোমেলো হয়ে যায়। একদা জীবনের পিছনের দিকে ফিরে তাকালে, তার বুকের রক্ত চলকে উঠত, অনেক কিছু সে দেখতে পেত। এখন, যতই দিন চলে যাচ্ছে, ততই সেই পিছনটা যেন একেবারে নিঃশেষে হারিয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে নয়, একেবারেই হারিয়ে গিয়েছে। অথচ এই বর্তমানও অর্থহীন বোধহয়। জীবনের পিছন দিকটা থেকে কতগুলি কার্যকারণ তাকে ভবিষ্যতের দিকে চালিয়ে নিয়ে চলেছিল। সেই চলার গতি এখন স্থির হয়ে এসেছে। টান নেই, স্রোত নেই, বদ্ধ জলাশয়ের মতো আবর্তিত হচ্ছে।
এই একটু আগেই সেজো ও বনমালীর সঙ্গে সে যে সব কথা বলছিল, সে সব কথার মধ্যে যে অন্তর্নিহিত বেগ বিক্ষোভ ও আশা আছে, যে কারণে সে কখনও ফরাসডাঙার ফ্যাস্তা দেখতে যায়নি, সেই কারণের মধ্যে যে আবর্তিত একটি মন ছিল, সে সবের মধ্যেই তার বাঁচার অর্থ ছিল। এখন ক্রমে সবই অর্থহীনতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। কেবলমাত্র চাষবাস, কাপড় বোনা, কাঠ কাটা, নৌকা বাওয়া, তার চার পাশে যে জীবন নিয়ে সবাই জীবন কাটাচ্ছে, সেটাই তার কাছে একমাত্র জীবনধারণের কারণ নয়। তার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। সে ছিল দেশপ্রেমিক সৈনিক, কেবলমাত্র খেয়েপরে নিরুদ্বেগ জীবনধারণ তার কাছে কোনও উদ্দেশ্য বলে গণ্য নয়।
সে-উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ, সে পরাভূত সৈনিক। সে সঙ্গীহীন, একাকী। যৌবন যখন উত্তাল ছিল, সে তখন নারীর আশ্রয় খুঁজেছে, খুঁজে পেয়েছে। এখন নারীর আশ্রয় আর মনকে তেমন করে ব্যস্ত ব্যাকুল উদ্দীপ্ত করে না। জীবনের উদ্দেশ্য প্রতিহত বলেই, মাঠের কাজে নিরুৎসাহ। এই যুগের স্রোতের টান ও প্রবণতা দেখে তার চিন্তার আধারও শূন্য। এখন চিরশূন্যতাই তার চারপাশে। তবু সেজোকার একটা কথা শূন্যতার মধ্যে প্রায় অর্থহীন সুরেই বাজছে, একদিন এ দেশ স্বাধীন হবে হয়তো। অর্থহীন সুরে বাজছে, কারণ, কোনও আশা ভরসা বা বিশ্বাস তার নেই। যার বিশ্বাস হারিয়েছে, তার আর কী আছে।
ফ্যাস্তাগামী মানুষের স্রোত কাটিয়ে সে বাড়ির দিকেই চলেছে। সারদা এসেছে হীরাকে নিয়ে। হীরাকে নিয়ে সে আখড়ায় চলে গিয়েছিল। হীরার স্বাস্থ্যটি এখন বেশ ভাল হয়েছে আবার। সারদা যেমন করে তার যুগলকিশোরের সেবা করে, তেমনি করেই হীরাকে নতুন রক্তেমাংসে সাজিয়ে তুলেছে। তবে হীরাটা যেন অসুখের পর থেকে সত্যি বদলে গিয়েছে। সেই ছুটোছুটি নেই, দাপাদাপি দস্যিবৃত্তি নেই। স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে, দেখতে সুন্দর হয়েছে, ওর মাকে আরও বেশি করে মনে করিয়ে দেয়। ছেলেটার ডাগর চোখ দুটি সেই যে তুফানি ঘোড়ার মতো ছিল, অস্থির চঞ্চল কৌতূহলিত, এখন শান্ত। এখন নাকি সারদার সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান করে, গলাটিও নাকি বেশ মিঠে। লখাইয়ের অবাক লাগে হীরার এই রূপ দেখে। কেন যেন একটা কষ্টও হয়। এ যেন ঠিক আসল হীরা নয়। এ হীরাকে দেখলে বুক টাটায়! কেন? লখাই তা বুঝতে পারে না।
সারদা এখানেই থাকবে মনস্থ করেছিল। কিন্তু দেখেছিল, এখানে থেকে তার কোনও লাভ হয় না। যুগলকিশোরের সেবা তো হয়-ইনা, এদের সেবাতেও সে লাগতে পারে না। শ্যামকে নিয়ে কালী পড়ে থাকে, হীরার দিকে নজর দিতে গেলে তার চলে না। আর কান্ত, তার স্বামী, সে যেনসবকিছুর বাইরে চলে গিয়েছে। সেনবাড়ির দলিলে কারচুপি হবার পর থেকে, মানুষটি একেবারে বদলে গিয়েছে। তাই সে হীরাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল। আজ যখন দেখল, সবাই ফরাসডাঙার ফ্যাস্তা দেখতে ছুটেছে, হীরাকে নিয়ে সেও না এসে পারেনি। সারদার নিজেরও ইচ্ছে করে, মাঝে মধ্যে একটু লোকজনের ভিড়, একটু উৎসব কলরব যেখানে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
লখাই বলেছিল, তুমিও ফ্যাস্তা দেখতে এলে?
সারদা একটু বিব্রত হয়ে, সলজ্জ হেসে বলেছিল, ছেলেটার জন্যে এলুম।
-শ্যামদাদার অবস্থা ভাল নয়, ফ্যাস্তা দেখতে কি ভাল লাগবে?
সারদা জানে, লখাই এ সব ভালবাসে না। এই ভাল না লাগা লখাইয়ের সবটুকু নিয়ে কি চলা যায়? লখাই অবিশ্যি কোনওদিন তা বলেনি। তবে শ্যামের অসুখের বাড়াবাড়ি দেখে, সে আরও লজ্জিত হয়ে পড়েছিল। বলেছিল, ফরাসডাঙায় যাব না, এপারে দাঁড়িয়েই একটু বাজি পোড়ানো দেখব। লোকজন সবাই আসছে, চুপ করে চেয়ে দেখা যায় না।
কিন্তু যার মুখ চেয়ে সারদা বলেছিল, সেই হীরার তেমন উৎসাহ দেখা যায়নি। সে বাড়ি এসেই, ঘরে ঢুকে, কালীর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। কালী তার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল, নিঃশব্দেই গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। হীরা তাকিয়ে দেখেছিল শ্যামের দিকে। তারপরে বাইরে এসে, বাড়ির চারপাশে ঘুরেছিল। বাবাকে আর সারদাকে দেখেছিল, উঠোনের এক পাশে, গোয়ালের ছায়ায় বসে কথা বলছিল। তবু হীরা বাড়ির প্রতিটি কোণ যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল। তারপরে রাস্তার দিকে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল, তার বুক ভেদ করে একটি দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল। না, মধুদাদা আসেনি। মধুদাদার কোনও চিহ্ন, সে সারা বাড়ির কোথাও দেখতে পায়নি। তার জামাকাপড়, অলটার সাহেবের দেওয়া পাতলুন, গোয়ালের মধ্যে লুকোনো হুঁকো, কিছুই নেই। রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে, অধরার বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিল, সেখানে কেউ নেই। নিশ্চয় মোহও ফিরে আসেনি। ওরা দুজন তো একসঙ্গেই আছে। হীরা ঠোঁটে ঠোঁট টিপে শক্ত করে রইল। তবু চোখ দুটি শুকনো রইল না। এ হীরা মেয়ের মতোই বিরহকাতরা। মধুদাদার সঙ্গে তার জীবনের একটা ভিন্ন জন্মই যেন চলে গিয়েছে। এখন তার নতুন জন্ম হয়েছে, এখন আর সে হীরা নেই। অথচ,বরতীবিলের ধারে, উচ্ছেগড়ের দিগন্তবিস্তৃত মাঠের মাঝখানেও তার জীবন যে প্রাণের আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে তা নয়। কিন্তু এখানে সে আসবে না। যে সেনপাড়ায় মধুদাদা নেই, সে সেনপাড়ায় হীরার কোনও টান নেই। আর ফ্যাস্তা? মধুদাদা নেই, হীরা কার সঙ্গে ফ্যাস্তা দেখবে? ফ্যাস্তা, তবু যে আজ ফ্যাস্তা! হীরার বুকের ভিতরটা যেন গলায় ফাঁস বাঁধা ঘোড়ার মতো ছটফট করে উঠল। গত বছরের ফ্যাস্তার দিনটা তার মনে পড়ছে। নাওয়া খাওয়া মাথায় উঠে গিয়েছিল। মধুদাদা, গোলাম, বেষ্টা দুলে, সকলের সঙ্গে সেও নৌকায় করে ওপারে গিয়েছিল। সে যে কী বিরাট মেলা, রকমারি খেলা, কত খাওয়া। মনে করতেই হীরার দুই চোখ অন্ধ করে, জল উপছে পড়েছিল। সে রাস্তার ধার থেকে, বাড়ির পিছনে নিরালা জঙ্গলের দিকে ছুটে গিয়েছিল। আজ আবার সেই ফ্যাস্তা, মধুদাদা নেই। কেন আসতে গেল হীরা। জঙ্গলের কাছে গিয়ে, অশ্বথের তলায় মুখ ঢেকে বসে পড়েছিল সে, ফোঁপাতে আরম্ভ করেছিল। আর ঠিক তখনই, দুম দুম শব্দে চারবার বোম ফাটার শব্দ উঠেছিল। ফরাসডাঙায় প্রতিযোগিতার খেলা শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওপারের কলরবের ধ্বনি, এপারেও শোনা গিয়েছিল।
.
হৃদয়নাথ দাঁড়িয়েছিলেন গঙ্গার ধারের অলিন্দে। ওপারে ফরাসডাঙায় জনতার ভিড়, এপারেও জনতার ভিড়। মাঝখানে, গঙ্গার বুক জুড়ে ভাউলে থেকে জেলে নৌকা, সবাই পারাপার করছে। কোনও কোনও নৌকা মাঝ গঙ্গায় শুধু ভেসে বেড়াচ্ছে। আজ ফ্যাস্তা। একসময়ে নাকি, ফরাসডাঙায়, গভর্নর, দেওয়ানবাড়িতে নিমন্ত্রণ পাঠাত ফ্যাস্তা উৎসবে যোগদান করবার জন্যে। এখন আর পাঠায় না। তবু উঁচড়োর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে, আজ একটু ফরাসডাঙায় যাবার কথা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, বকুলের মুখ অন্ধকার। মুখের উপর আপত্তি সে করেনি, তেমন মেয়ে সেনয়, সে অধিকারও তার নেই। বকুলের কাছে এসে তিনি যখন বলেছিলেন, বন্ধুবান্ধবেরা ধরেছে তাদের সঙ্গে যাবার জন্যে, তৎক্ষণাৎ স্ত্রীর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল, এবং সেই গাম্ভীর্যের মধ্যে যেন একটি ভয়ের ছায়া ফুটে উঠেছিল। হৃদয়নাথ জানতেন, কীসের গাম্ভীর্য, কেন ভয়। তার বন্ধুদের উপর বকুলের বিশ্বাস নেই। বকুলের ভয়, তাদের সঙ্গে মিশে, হৃদয়নাথের মদ ও অন্যান্য বিষয়ে আসক্তি হবে। এ বিষয়ে অনেকবার কথা হয়েছে। বকুল একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, ঠাকমাকে বলে যেয়ো।
হৃদয়নাথ ভ্রুকুটি করেছিলেন। বলেছিলেন, কেন, ঠামাকে বলার কী আছে। বন্ধুদের সঙ্গে ফ্যাস্তা দেখতে যাব, তার জন্যে ঠাকমার অনুমতি নিতে হবে?
গলার স্বরে ক্ষোভ ও বিদ্রূপ চাপা থাকেনি। বকুল বলেছিল, না, তা বলিনি, আমাকে বলছ, তাই বললাম, ঠাকমাকে বলল।
তোমাকে বলা মানে, তোমার অনুমতি চাওয়া নয়।
বকুল বলেছিল, ছি ছি, আমার অনুমতি চাইতে যাবে কেন। তুমি যা করো, ঠামাকে তো সবই বলল, তাই বলেছি।
এই পর্যন্ত বলে, শরীর খারাপের অছিলায়, বকুল সামনে থেকে চলে গিয়েছিল। অছিলায় ঠিক নয় হয়তো, বকুলের শরীরগতিক সত্যি ভাল নয়। সে সন্তানসম্ভবা। ক্লান্তি ও মাথা ঘোরা প্রায় সবসময় লেগেই আছে। বকুলের চলে যাওয়া দেখেই, হৃদয়নাথ বুঝেছিলেন, বন্ধুদের সঙ্গে ফ্যাস্তায় যাওয়া তার হবে না। বকুলের এক রকম ভয়, ঠাকমার আর এক রকম ভয়। ঠাকমার মতামত না জেনেও, বলা যায়, তিনি অনুমতি দিতেন না। ঠাকমার ভয় ইজ্জতের। যে উৎসবে তুমি নিমন্ত্রিত নও, সে উৎসবে তুমি যেতে পার না। তোমার বাপ ঠাকুরদা একদা যে সম্মান ভোগ করে গিয়েছেন, তোমার ভাগ্যে যদি তা না জোটে, তুমি নিজে তার জন্যে হাত বাড়াতে পার না।
তাকে নিয়ে সকলেরই ভয়। হৃদয়নাথ নিজেও কি ভয় পান না? ভয় পান বলেই তো তো তিনি দুর্বল, দুর্বল বলেই, এ বাড়ির বৃদ্ধা সেনগিন্নি ও তাঁর নাতবউয়ের সামনে সব সময়েই নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা ব্যক্ত করে ফেলেন। কারণ, তাঁর নিজের ভিতরে অনেক হাতছানি। যে হাতছানিকে তিনি নিজেই ভয় পান, চোখ ফিরিয়ে রাখতে চান। কলেজের পড়ো বন্ধুদের আড্ডা তাকে নিশির মতো টানে। যে আজ্ঞা উঁচড়ো চন্দননগর শ্রীরামপুরে আছে। এতকাল সে সব হাতছানি তিনি এড়িয়ে এসেছেন। কিন্তু বকুল গর্ভবতী হবার পর থেকে, কয়েকবার সে আড্ডায় যেন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে চলে গিয়েছেন। বকুলের চতুর্থ মাস অতিক্রম করে চলেছে। মাস দুয়েকের মধ্যেই এ ঘটনা ঘটেছে। বকুলের কাছে মুখে মদের গন্ধ লুকোতে পারেননি। এই ঘটনায় বকুলের ক্লান্ত চোখের কোল বসা চেহারা আরও ভেঙে পড়েছে। মৃত্যু শোকের থেকেও মর্মন্তুদভাবে লেগেছে বকুলের। কেঁদে বলেছে, এই আশঙ্কাই সে বরাবর করে এসেছে, এই ভয়ই তাকে ভিতরে ভিতরে দিবানিশি কাঁপিয়েছে। সে হৃদয়নাথের বুকে পড়ে, পায়ে মাথা রেখে কেঁদেছে, বারণ করেছে, প্রতিজ্ঞা করিয়েছে। কিন্তু যে বকুলকে হৃদয়নাথ এত ভালবাসেন তার কান্নায় তিনি বিরক্ত হয়েছেন। ভিতরে ভিতরে একটা সংকোচে তিনি আড়ষ্ট হয়ে উঠেছেন, এবং সাময়িকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে, প্রতিজ্ঞাও করেছেন। অথচ তা রক্ষা করতে পারেননি। দূরে সরে যেতে ইচ্ছে করেছে, বিরক্তি ও অস্বস্তি গোপন করেছেন। হৃদয়নাথের মন চেয়েছে, বকুল উফুল্ল হোক, বকুল তাকে আনন্দের সঙ্গে হেসে গ্রহণ করুক, সুখ উপছে পড়ুক দুজনকে ঘিরে।
তা হয়নি। বারকয়েক প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হবার পরেই, দুজনের মাঝখানে একটা দেওয়াল দাঁড়াতে আরম্ভ করেছে। হৃদয়নাথ কলেজ থেকে ফিরে এলেই, বকুল দুর অদৃশ্য থেকে স্বামীর চোখের দিকে লক্ষ করে। নাসারন্ধ্র স্ফীত করে গন্ধ পাবার চেষ্টা করে। অধিকাংশ দিনই তিনি সৎ সুস্থভাবে ফেরেন। বকুল তখন স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্যে নিজেকে অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যস্ত করে তোলে। অথচ হৃদয়নাথ গম্ভীর হয়ে থাকেন। তিনিও জানেন, বকুল কেন এত বেশি সেবাপরায়ণা, এত উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। মনে মনে ভাবেন, আর যদি একটু মদ খেয়ে আসি, আমার বুকের অভর তৃষ্ণা নিয়ে যখন তাকে দুহাত বাড়িয়ে ধরতে যাই, তার একটু হাসি মুখ দেখবার জন্যে পাগল হয়ে উঠি, পায়ে ধরে অনুরোধ করি, তবু তখন সে গম্ভীর নিরেট কালো মুখ নত করে থাকে।
আরও আছে, হাতছানি আরও আছে, মজলিশ ঘরের। ভাবেন মিরজা ওস্তাদ না-ই থাকল, ভাটপাড়ায় নরসুন্দর হরিনাথের কালোয়াতি গানেরও আজকাল খুব নাম হয়েছে। লখনউ-এর বাইজি না হয় নাই আনা গেল, ফরাসডাঙার ইয়াতুন বিবি এসে যদি এক-আধ রাত নেচে যায়, ক্ষতি কী। ইয়ার বন্ধুদের একটু নিমন্ত্রণ করা যায়। মজুমদারদের ছোট ছেলেকে ডাকা যায়। হাসতে হাসতে এ ইচ্ছাটাও একসময়ে ব্যক্ত করেছিলেন বকুলের কাছে। বলেছিলেন, সব থাকতেও একেবারে নিপাট করে লাভ কী।
বকুলের চোখে সেই এক ভয়। হৃদয়নাথের বুকে মুখ রেখে সে বলেছিল, না, মজলিশ ঘরের আসর নয়। তোমার গান শুনতে ইচ্ছে করে, হরি নাপতেকে ডেকে গান শোনো। নীচের ঘরে বসিয়ে গান করাও, পাশের ঘর থেকে আমিও শুনব। হরিকে পেট পুরে খাওয়াব আমি। তোমার বন্ধুবান্ধবদের ভোজ দেব। মজুমদারদের ছোট ছেলেটা বখাটে, তাকে ডেকো না। বকুল বলেছে, যা আর নেই, তা করে লাভ কী। নামে মাত্র দেওয়ান, কাজে যখন কিছুই নেই। সেই দিনকাল যখন নেই, তখন আর উপদ্রব বাড়িয়ে কী দরকার।
কিন্তু উপদ্রব যে হৃদয়নাথের অভ্যন্তরে। পিতৃপিতামহের তৃষ্ণা যে তার বুকে। সেই তৃষ্ণা যে তাকে স্থির হতে দেয় না। তিনি নিজে সেটা জানেন না, তার কেবল মনে হয়, একদিকে নাতবউ আর এক দিকে সেনগিন্নি, এই দুয়ে মিলে তাকে কোথাও মাথা তুলতে দিতে চায় না। একজন আভিজাত্যের দোহাই পাড়ে, আর একজন স্বামীর উঞ্ছ হয়ে ওঠার ভয়ে মরে। অথচ পড়াশুনোয় তিনি খারাপ নন। গত পরীক্ষায় কলেজে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। সামনের শীতেই শেষ পরীক্ষা। আশা আছে ভালভাবেই কৃতকার্য হবেন।
এখন তাই এ সংসারে সুখ নেই। কারুর সঙ্গে কারুর মনের মিল নেই। এমনকী ঠাকমার সঙ্গেও নাতবউয়ের মিল নেই। আসলে এ দুজনের দৃষ্টিও দুই বিপরীত দিকে। একজনের পিছনে, আর একজনের সামনে। হৃদয়নাথ কেবল বর্তমানের আবর্তে পাক খাচ্ছেন। তিনি সেন পরিবারের অন্যান্য শরিকদের মতো বহমান স্রোতের সঙ্গে মিশে যেতে পারেননি, তিনি প্রতাপশালী দেওয়ানও হতে পারেননি। অথচ বকুলকে নিয়ে, সকল আকাঙ্ক্ষা মিটতে চায় না। প্রাণের এই নির্জীবতাকে কাটাবার জন্যে হাতের সামনে একমাত্র মূলধন যৌবনকেই তার সামনে উপস্থিত দেখতে পান। তাই নতুন নতুন উপকূলের ডাক, নতুন তরঙ্গের আহ্বান তার রক্তে।
হৃদয়নাথ সরে এলেন অলিন্দ থেকে। লক্ষ করলেন না, পিছনে আর একজন অলিন্দের দরজা থেকে নিঃশব্দে সরে গেল। বিরস মুখে সরে এলেন তিনি। তোপধ্বনি, পটকার দুম দাম, লোকজনের হাসি হল্লা চিৎকার, এ সবই তাকে অধিকতর হতাশায় বিক্ষুব্ধ করে তুলল। বিশেষ করে এই সেনবাড়িরই অন্যান্য শরিকেরা যখন হই-হট্টগোল করতে করতে তার চোখের সামনে দিয়েই ওপারে চলেছে। তাদের বাধা নেই, যত দেওয়ানি রশি তারই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তিনি সরে এলেন, অলিন্দ পেরিয়ে নীচে চলে গেলেন। এসে উঠলেন একেবারে কাছারি বাড়ির উঠোনে। কোথায় যাবেন? চুঁচড়োয়? ভাটপাড়া নৈহাটি গরিফায়? না কি মূলাজোড়ে? বন্ধুবান্ধবদের কাউকে কি পাবেন আজ? সেনপাড়াতেই চেনাপরিচিত কাউকে পাবেন কিনা সন্দেহ।
বকুলও নেমে এল। নীচের ঘরের যেখান থেকে কাছারিবাড়ির উঠোন দেখা যায়, সেখান থেকে উঁকি দিল। হাঁপাচ্ছে সে। এত তাড়াতাড়ি এখন চলতে পারে না। শরীরটা বড় দুর্বল বোধহয়। মাথাটা আপনি ঘুরে যায়। তবু জানালার পাশ থেকে দেখল, হৃদয়নাথ উঠোনে দাঁড়িয়ে খোলা দেউড়ি দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। বেরিয়ে যাবেন নাকি? বন্ধুদের সঙ্গে ফরাসডাঙায় চলে যাবেন? মদ খেয়ে ফিরবেন? শুধু কি মদেই তৃপ্ত থাকবেন, না কি দেহে আরও স্পর্শ মেখে ফিরবেন? না না, ছি, বকুল এ সব ভাবছে কেন। উনি কি ততটা নীচে নামতে পারেন? এই সমগ্র অঞ্চলে ওঁকে সবাই কত শ্রদ্ধা করে, ওঁর চরিত্রের প্রতি সকলের কত বিশ্বাস। এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে থেকে আমিই কি সব থেকে বেশি জানি ওঁকে? বাইরে যারা রয়েছে, তারা কি ওঁকে চেনে না, জানে না? তাদের বিশ্বাসের কি কোনও মূল্য নেই? বকুল ভাবে, তবু এত ভয় কেন? পিয়ারপুরের পিত্রালয়ের অভিজ্ঞতাই কি কেবল তাকে ভয় পাওয়ায়? কিন্তু ওঁর পরিবর্তন? যিনি বকুলের কৈশোর থেকে যৌবনের সকল দরজা খুলেছেন, সকল মুক্ত করেছেন, তার প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে আপনাকে ও বকুলকে বিকশিত করেছেন, যিনি বকুলের দেহ ও প্রাণস্বরূপ, তাঁর পরিবর্তন কি বকুল অনুভব করেনি? বকুল কি দেখেনি, ওঁর শান্ত চোখের তারায় চঞ্চলতা, দূরান্তের হাতছানি। ওঁর ভিতরে যে এক বিচিত্র অস্থিরতা। অতৃপ্তি প্রতি মুহূর্তে আবর্তিত হচ্ছে, তা কি বকুল আবিষ্কার করেনি। এবং তাতে ওঁর আনন্দের ভাগের চেয়ে, নিরানন্দের গ্লানি বেশি, তাও বকুল টের পেয়েছে। উনি অসুখী।
বকুলের বুক মোচড় দিয়ে ওঠে, কালিপড়া চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। এই অসুখের কার্যকারণ জেনে, কেমন করে ওঁকে সুখী করবে সে। এই অসুখ কীসের? কোথা থেকে এর জন্ম? যাঁকে সে প্রতিটি মুহূর্তে সুখী করতে চেয়েছে, তাঁকে অসুখী বুঝতে একটুও বিলম্ব হয়নি তার। আহা ওই যে দাঁড়িয়ে আছেন, কী করবেন বুঝতে পারছেন না, এই অসুখী মূর্তি দেখলে কার না কষ্ট হয়? বকুল কি কাছে যাবে, গিয়ে বলবে, তুমি যেখানে যেতে চাও, যাও।না। না, না, সে কথা বলতে পারবে না। সে জানে, ওঁর ভিতরটা বড় দুর্বল। বকুল নিজে থেকে ওঁকে পতনের দরজা খুলে দিতে পারবে না। যদি যান, ওঁকে নিজের সিদ্ধান্তেই যেতে হবে, ফিরতে হলেও তাই। সেটাই ঠিক। যদি যান, ফিরে না আসা পর্যন্ত বকুলের থাকবে অন্তহীন প্রতীক্ষা।
হৃদয়নাথ আর ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। বাইরে যাবার জন্যে একবার দেউড়ির দিকে অগ্রসর হলেন। কয়েক পা গিয়ে আবার দাঁড়ালেন। কীসের শব্দ বাজছে তার কানে? ঝনঝন্ করে বাজছে। ঠুনঠুন করে বাজছে। কয়েদখানার শিকল নাকি? কার গলার গোঙানি শুনতে পাচ্ছেন? কার ভারী পায়ের এমন দুপ দাপ শব্দ আসছে। ফিরে দাঁড়ালেন, কয়েদখানার দিকে এগিয়ে চললেন। ভাঙা কয়েদখানা, পাল্লাবিহীন দরজামুখ খোলা, হা হা করছে। দূরের পাঁচিল ভেঙে গিয়েছে। এখানেই কি কেউ গোঙাচ্ছিল? সামনেই একটা বড় পুকুর। একদিকে বাড়ির ভিতর থেকে ঝি-চাকরেরা বাসন মাজতে আসত। আর একদিকে আমলা কর্মচারী কয়েদি সবাই চান করত। তারপরে কয়েক বিঘা জমি ছাড়িয়ে, দক্ষিণ পশ্চিম কোণে মজলিশ ঘর। একটা পাঁচিলের আড়াল ছিল, ভেঙে পড়েছে। সেইদিকে গেলেন হৃদয়নাথ। আর সেখানে গিয়ে পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই, ফরাসডাঙার জনারণ্য ভেসে উঠল তাঁর চোখে। কলরব তীব্র হয়ে বাজল। খেয়াল ছিল না, গঙ্গার ধারে এসে পড়েছেন। মজলিশ ঘর গঙ্গার ধার ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে।
তাড়াতাড়ি ফিরতে যাবেন, দেখলেন সামনে বেদো এসে দাঁড়িয়েছে। বলল, বউদিদিঠাকরুন আপনাকে বাড়ির ভেতরে একবারটি আসতে বললেন।
কেন? মনে মনে ভাবলেন হৃদয়নাথ। বিদ্রুপে ঠোঁট বেঁকে উঠল। এদিকে এসেছেন বলেও তার ভয় হয়েছে নাকি? বললেন, যা, যাচ্ছি।
বেদো দৌডুল। বিরক্তির কুটি হৃদয়নাথের মুখে। তিনি আস্তে আস্তে বাড়ির মধ্যে এসে ঢুকলেন। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে দেখলেন, দোতলার সিঁড়ির মুখেই বকুল দাঁড়িয়ে আছে। তার ক্লান্ত মুখে একটু হাসি লেগে আছে। ঘোমটা আর একটু টানবার চেষ্টা করে, ফিরে যেতে যেতে বলল, ঘরে এসো।
হৃদয়নাথ ঘরে গেলেন। বকুল ঘোমটা একটু সরিয়ে কাছে এসে বলল, আমাকে একটু বেড়াতে নিয়ে যাবে?
অভিনব কথা। সেনবাড়ির বউ এখানে কোথায় বেড়াতে যেতে চায়? হৃদয়নাথ কথা না বলে, ভ্রুকুটি জিজ্ঞাসু মুখে তাকিয়ে রইলেন।
বকুল বলল, দেওয়ান বাড়িতে আগে বজরা ছিল। এখন তো ভেঙে পড়ে আছে। ভাউলের তো আবরু আছে, তাতেই না হয় যাব। ঠাকমার হুকুম নিয়েছি। বলেছি ফরাসডাঙায় যাব না, শ্যামনগরের কালীবাড়ির দিকে যাব।
হৃদয়নাথ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন তখনও। ভ্রুকুটি মুখ শান্ত ও উদাস হল। বললেন, সত্যি তাই যাবে নাকি?
এখন তোমার যেখানে ইচ্ছে।
হৃদয়নাথ এক মুহূর্ত ভাবলেন, বললেন, না, তোমাকে নিয়ে আজকের দিনে ফরাসডাঙায় যেতে পারিনে।
–তা হলে নৌকায় বেড়াব? নিয়ে যাবে?
হৃদয়নাথ বকুলের মুখের দিকে তাকালেন। গভীর আগ্রহ নিয়ে বকুলও তাকিয়ে আছে। মনটা একবার বিরূপ হল হৃদয়নাথের। আবার অস্বস্তি হতে লাগল। এমন তো কখনও যেতে চায় না বকুল। হৃদয়নাথ বন্দি হয়ে আছেন বলে?
বকুল আবার বলল, তা হলে, আজ সেটাও নিয়ে চলো।
-কী?
জবাব না দিয়ে, বকুল একটা আলমারির কাছে গিয়ে চাবি দিয়ে খুলল, হাতে তুলে নিয়ে এল একটি বোতল, বিলিতি ব্রান্ডির বোতল। হৃদয়নাথই নিয়ে এসেছিলেন, এবং এই নিয়ে বকুলের সঙ্গে কয়েকমাস আগে ভীষণ বিবাদ হয়েছিল। হৃদয়নাথ চেয়েছিলেন, মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হলে একটু-আধটু খাবেন। বকুল বলেছিল, না।
-কেন?
–সংসারে এত জিনিস থাকতে ওটাই তোমার মাঝে মধ্যে দরকার হবে কেন?
বকুলের সঙ্গে কথার যুক্তিতে এঁটে ওঠা দায় ছিল হৃদয়নাথের পক্ষে, যত বড় কলেজে পড়োই হন। তিনি রেগে উঠেছিলেন, বলেছিলেন, এটা মানুষেরই পানীয়, পশুর নয়।
বকুল বলেছিল, পশু হওয়ার জন্যেই মানুষ এই জিনিস খায়।
–তাই যদি হয়, হলে বলতে চাও, তোমার শ্বশুরকুল পিতৃকুলের লোকেরা সবাই পশু ছিলেন? বকুল এক মুহূর্ত থতিয়ে গিয়েছিল, সহসা জবাব দিতে পারেনি। এবং কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, মাঝে মধ্যে নয়, তুমি রোজই খেয়ো, আমাকে পিয়ারপুরে পাঠিয়ে দাও কিছুদিনের জন্যে।
হৃদয়নাথ সে কথা শুনে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, বলেছিলেন, কেন, নিজের ভাই ভাজদের খাওয়া দেখতে কি ভাল লাগবে বুঝি?
বকুল জবাব দিয়েছিল, হ্যাঁ লাগবে।
-কেন, তাদের কোনও বিশেষ বাহার আছে নাকি?
-না, খারাপ জিনিস, খারাপদেরই মানায়, তাই খারাপ যখন দেখতে হবে, সেখানে যাওয়াই ভাল।
সে কথার জবাব হঠাৎ জোগায়নি হৃদয়নাথের মুখে। বকুলের চোখে তখন জল এসে পড়েছিল। তবু সে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল, আমি জানি, সে তুমি আর তুমি নেই, নতুন কিছু চাই তোমার। কিন্তু সবই তো দুদিন বাদেই পুরনো হবে, তখন কী করবে? তাও আমি জানি, তখন সবকিছুই বিস্বাদ লাগবে, আর অষ্টপ্রহর এই সব নিয়ে থাকবে, অন্য কোনও পথ পাবে না। তবে তাই করো, আমাকে পাঠিয়ে দাও, আর আমাকে মিছিমিছি এ সব বলতে আসা কেন? সবকিছুই তোমার, তুমি যা খুশি তাই করবে, আমাকে বলাতে কিছু যায় আসে না।
হৃদয়নাথ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন, তার কারণ, বকুল উদ্বেগে যতটা অধঃপতনের কল্পনা করেছিল, তিনি নিজে তা করেননি, বিশ্বাসও করেননি। আর বকুলকে তিনি মিছিমিছি বলেননি, জানতেন, বকুলের অনিচ্ছায় সবই হয়তো করা যায়, তা হলে বকুলকে নিয়ে থাকা যায় না। কারণ সে অবস্থা আরও ভয়াবহ। উপবাস ও অসহযোগের চাপে, সবকিছুই রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠবে। তাই তিনি বলেছিলেন, সেটাই আমার ভুল হয়েছে, আমার যা ইচ্ছে হবে, আমি তাই করব, তোমাকে বলার কোনও দরকার নেই, তোমারও কিছু বলবার দরকার নেই।
হৃদয়নাথ বেরিয়ে গিয়েছিলেন ঘর থেকে। বকুল অনেকক্ষণ কেঁদে, বোতলটা তুলে রেখেছিল আলমারিতে। তারপরে কয়েকদিন পরে দুজনের মধ্যে আবার যখন ভাব হয়েছিল, তখন বোতলটা যে আলমারিতে আছে, সে কথা বকুল জানিয়েছিল। হৃদয়নাথ কয়েকদিন পর নতুন ভাবের আবেশে আর খোঁজ করেননি।
আজ সহসা বকুলের হাতে সেই বোতল দেখে, হৃদয়নাথ জিজ্ঞাসু বিস্ময়ে থমকে গেলেন। বকুল ভাউলেয় করে বেড়াতে যেতে চায়, আবার এই ফ্যাস্তার দিনে, ব্র্যান্ডির বোতলও সঙ্গে নিয়ে যেতে বলে! কয়েক মুহূর্ত যেন কিছুই বুঝতে পারলেন না। এমন অভাবিত ঘটনা দেওয়ানবাড়িতে কখনও ঘটেছে বলে শোনেননি। আজ বাইরে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে থাকলে, নৌকা বেড়ানো, মদ্যপান, আনুষঙ্গিক দু-একজন সহচরী, যা কিছু ঘটতে পারত, বকুলের কথায় ও ব্যবস্থায় তারই ইঙ্গিত।
বকুলের দিকে তাকিয়ে, হৃদয়নাথের ভ্রুকুটি বিস্ময়, আর একবার বিরূপ হয়ে উঠতে চাইল, পরমুহূর্তেই একটা সংকুচিত লজ্জায় বিব্রত হয়ে পড়লেন। শুধু বিব্রত নয়, বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে, বুকের ভিতরটা যেন কেমন ব্যথা করে উঠল। হৃদয়নাথকে তুষ্ট করার জন্যে, একটু খুশি করার জন্যেই, এই বিচিত্র প্রস্তাবের সামনে আপাত শান্ত ও সরল হাসির পিছনে যে একটি দুঃসহ কান্নার বেগকে জোর করে চেপে রাখা হয়েছে, তিনি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন। প্রথম গর্ভবতী বকুলের, ক্লান্ত, চোখের কোল বসা, অথচ একটি উজ্জ্বল ঢলঢল লক্ষণ মূর্তির দিকে চেয়ে, সহসা যেন নতুন কিছু আবিষ্কারের বিস্মিত ব্যথায় ব্যাকুলতা অনুভব করলেন।
বকুল বোতলটি তুলে দেখিয়ে বলল, নিয়ে যাবে তো?
হৃদয়নাথ পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে, বকুলের সামনে দাঁড়ালেন। তার একটি হাত ধরে চিবুকে হাত দিয়ে মুখটি তুলে ধরে দেখলেন। বললেন, কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না বকুলফুল।
বকুলের চোখের পাতা নত হল, একবার নিশ্বাস রুদ্ধ হল বা। বলল, কেন?
হৃদয়নাথ বললেন, তার চেয়ে আমি একটা কথা বলি, শুনবে?
–বলো।
–চলো, আমরা দুজনে ছাদে গিয়ে বসি, সেখানে বসে আমরা ফ্যাস্তা দেখব।
—ভাউলেয় যাবে না?
–গঙ্গায় বড় ভিড় আজ।
–কিন্তু
হৃদয়নাথ মুখ নামিয়ে, বকুলের ঠোঁটে মুখ ডুবিয়ে, তাকে নীরব করে দিলেন। তারপরে মুখ তুলে, নিজে কথা বললেন, কিন্তু নয়, বেদোকে আমি বলে দিচ্ছি ও পশ্চিমের আলসের কাছে দুটো চেয়ার রেখে আসুক। বেদোকে বলে আসতে আসতে যেন তোমার চোখে আর জল না দেখি সই।
সম্ভবত হৃদয়নাথ নিজেও গলায় ও চোখে ভিজে উঠছিলেন, তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। কিন্তু এ ঘটনার পরে, বকুলের পক্ষে সেই মুহূর্তেই চোখের জল শুকিয়ে ফেলা সম্ভব ছিল না। অনেকদিন পরে সই ডাক শুনে, চোখের প্রস্রবণ দ্বিগুণ হল।
কিন্তু যখন ছাদে এসে হৃদয়নাথ বসলেন, তখন বকুলের একটা কথা কিছুতেই ফিরিয়ে দেওয়া গেল না। ছাদের দরজা বন্ধ করে দিয়ে, সে নিজের হাতে ব্র্যান্ডির গেলাস তুলে দিল হৃদয়নাথের হাতে। বলল, এটা আজ কিছুতেই না বলতে পারবে না, আমি নিজে তোমাকে দিচ্ছি। খালি একটা কথা, আমাকে যেন কোনওদিন খেতে বোলো না।
-কেন?
–দাদাদের দেখেছি, বউদিদের তারা কী সর্বনাশ করেছে।
হৃদয়নাথ একটু চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু মুখে গন্ধ হবে।
বকুল বলল, হোক, আজ আমার খারাপ লাগবে না।
হৃদয়নাথ বকুলের গলা জড়িয়ে ধরে, আবার চুম্বন করলেন। বকুলও প্রতিদানের প্রত্যাশা পূর্ণ করে হৃদয়নাথকে নিঃসংশয় করল। ফরাসডাঙায়, আসন্ন সন্ধ্যার বাজি ফাটল দুম দুম করে, শরৎকালের মতো দিনের আকাশেই, নীলচে ফুলের স্ফুলিঙ্গ ফুটে উঠল শিসের শব্দ করে।
বকুল বলল, ফরাসি বিপ্লবের গল্প বলবে বলছিলে?
হৃদয়নাথ ব্র্যান্ডিতে চুমুক দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এইবার বলব। তুমি বসো।
নিজে হাত ধরে বকুলকে বসালেন পাশের চেয়ারে, তারপরে অনেকটা রূপকথার মতোই, ফরাসি দেশে এক রাজা, তার নাম লুই, এক ছিল রানি, তার নাম আঁতোনিয়েত বলতে আরম্ভ করলেন।
.
ফরাসডাঙা ফরাসিদের কলোনি। দেশান্তরের লোকেরা আজ এখানে এসেছে, বেজায় ধূমধাম সরগরম তার পথে বাজারে গঞ্জে। আজ ফ্যাস্তা। গভর্নরের কুঠিতে উড়ছে নতুন তিন রঙের পতাকা, ফরাসিদের পতাকা। আর গঙ্গার ধারের বাঁধানো চওড়া রাস্তার উপরে, রাস্তার এপাশ ওপাশ জুড়ে তোরণ তৈরি হয়েছে, যে তোরণের মাথায় মাথায় রঙিন কাগজে লেখা রয়েছে, ভিভূ লা ফ্রাঁস ভিভ লা বাস্তিল ডে ন্যাশনেল দ্য ফেত। লাটবাড়ি আর সরকারি দপ্তরখানার মাঝখান দিয়ে, যে রাস্তা গিয়েছে বড় গির্জার দিকে, তার মোড়ের মাথায়, সেনাপতি ডুপ্লের পাথরের মূর্তি, সেখানেও একটি ছোট তোরণ হয়েছে, লেখা রয়েছে ভিভূ লা ফ্রাঁস। লাটবাড়ির পশ্চিমে খোলা মাঠ, সেখানে রোদের জন্যে ও বৃষ্টির আশঙ্কায়, তাঁবু পড়েছে অতিথি অভ্যাগতদের জন্যে। সেখানে সাহেব মেমদের পান ভোজন নাচ গান চলেছে। দেশীয় ভদ্রলোকেরা, যাঁরা নিমন্ত্রিত, তাঁরা বউ আনেন না, নাচেন না, কেউ কেউ মদ্যপান করেন মাত্র, লাটভবনের খাদ্য খান না। মদ বোধহয়, স্ত্রীলোকের মতোই দুঙ্কুলাদপি, যেখানকারই হোক, ওটা গ্রহণ করা যায়।
আজ সব মানুষের সর্বত্র অবাধ গতি, যদিচ লাটভবনের সামনে, গির্জার আশেপাশে সরকারি দপ্তরখানা, জেলখানা ইত্যাদির সামনে গঙ্গার ধারে কোনও দোকান পসার করবার অনুমতি নেই। কিন্তু দলে দলে দেখে বেড়াবার অনুমতি আছে। লাভবনের সাজগোেজ, তোরণ, ইস্ট্যান্ডের (স্ট্র্যান্ড, গঙ্গার ধারের বাঁধানো সড়ক, রাজকীয় ঘাট ইত্যাদি) শোভা, মেয়ে পুরুষ দল বেঁধে ঘুরে দেখছে। এ সব দেখছে দুর দুরান্তের মানুষেরা। আজ ফ্যাস্তা, ফ্যাস্তা দেখতে এসেছে সব।
কিন্তু আসল ফ্যাস্তা এখানে নয়, তার জায়গা হল মীয়াজী পীরের দরগার কাছে, সেখান থেকে যে রাস্তা পশ্চিমে গিয়েছে, সেই রাস্তার ধারের খোলা মাঠের সামনে। মাঠ নয়, মুসলমান পাড়ার পিছনে, যেখানে ফরাসডাঙার কেল্লা ছিল, সেখানে। কেল্লার নাম ছিল আলোঁ, ইংরেজরা ভেঙে দিয়েছে অনেক কাল আগে। তার কোনও চিহ্ন রাখেনি। চুঁচুড়ার ওলন্দাজদের গাস্টাভাস দুর্গ যেমন ভিতসুদ্ধ উপড়ে ফেলেছিল, ফরাসিদের কেল্লারও সমান অবস্থা করেছিল। ফ্যাস্তা জমেছে সেই কেল্লা লোপাট খোলা ভূঁইয়ের বুকে, ওদিকে গঞ্জ থেকে মীয়াজী পীরের দহ ছাড়িয়ে, সীমান্তের সেপাইরা যেখানে ঘাট পাহারা দেয়। আরও উত্তরে, গঞ্জের চারপাশে, নটী বেশ্যাদের ঘরে তিল ঠাঁই নেই। বাবুদের টাঁক আজ বড্ড ভারী।
আজ এ শহরে কোনও কাজ নয়, কেবল উৎসব। খাও দাও ফুর্তি করো। যত খুশি জুয়া খেলো, যত খুশি মদ খাও, বেলেল্লাপনার বেহদ্দ করো, তবে কারুর মেয়েছেলে নিয়ে টানাটানি করো না, লোপাট করো না, মারামারি বাধিও না। খেলা শুরু করে দাও পথে পথে। পাঞ্জা লড়ো, লাঠি খেলো, সাপ খেলাও, লড়িয়ে দাও বুলবুলি। নটী যত আছে রাজ্যে, নাচিয়ে দাও সবাইকে। আজ কোনও বাধা নেই। আজ ফ্যাস্তা, আজ ফ্যাস্তা।
সকলেই মত্ত, ব্যস্ত, খুশি, ছোটখাটো ছুটকো কয়েদিরা বেবাক খালাস পেয়ে গিয়েছে। মাতলামি করে যে জেলখানায় খোয়ারি কাটাচ্ছিল, তাদেরও ছুটি। তারাও অংশ নিয়েছে ফ্যাস্তায়।
গগনের হাত শক্ত করে ধরে আছেন জীবনকৃষ্ণ, চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছেন। বেশ খুশি হয়েছেন বোঝা যাচ্ছে। ভয় খালি মাতালদের। এত মাতাল কোথাও দেখেননি। মেয়ে-মন্দ সবাই মাতাল। তবু নানান প্রতিযোগিতার খেলা, ভিড়, হাসি ঠাট্টা গান, খাবারের দোকানের সামনে সারি দিয়ে খাওয়া, বোতল তুলে ঢকঢকিয়ে গলায় ঢালা, সব মিলিয়ে বেশ একটা কৌতূহল আর উত্তেজনা বোধ করছেন তিনি। ভিড়ের মধ্যে প্রথমে এসেই, একবারের জন্যে তাঁর গৌর শরীর শিউরে উঠেছিল। বারো জাতের স্পর্শ! পরমুহূর্তেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে উঠেছেন, আবার সেই অহংকার! স্নান করে উঠলেই তো সব ধুয়ে যাবে, ও সব তো কেবল গায়ে। যেন নিজেকে বিদ্রূপ করেই হেসেছিলেন একটু। তবু রক্তে যে জন্ম জন্মান্তরের ঋণ, শত শত বছরের দেনা, তা সহজে মেটে না। শিহরনের ভিতর দিয়ে, তাঁর অবচেতন একবার সে কথা স্মরণ না করিয়ে দিয়ে পারে না। তারপর দিব্যি জমে গিয়েছেন। অন্তর্যামী ব্যতীত মনের কথা কেউ জানতে পারে না। এমনকী, এ কথাও ভেবেছেন, কী গেলে লোকগুলো ঢক ঢক করে, কী আছে ওর মধ্যে যে, যেন স্বর্গ হাতে পেয়ে দাপাদাপি করছে। ইচ্ছে করে একটু খেয়ে দেখি, একটু দাপাদাপি করি। ভেবেছেন, আর হেসেছেন মনে মনে। পটল ভটচাযের কথা মনে পড়ে গিয়েছে। ওর ভয়ে, সাঁঝবেলায় পাড়ার মেয়েরা পথে বেরোয় না। বেজায় মাতাল, যেমন কালো কিস্কিন্ধে চেহারা, তেমনি হাঁকোড়। ও বস্তুতে ভক্তি আসে কেমন করে। কিন্তু ফরাসডাঙার ফ্যাস্তায়, এ মাতালদের পটলের মতো মনে হচ্ছে না।
এরা অনেকটা শিশুর মতো, অস্থির চঞ্চল, যেন হারিয়ে যাবার, ফুরিয়ে যাবার, ঘরে ধরে নিয়ে যাবার ভয়ে, সব খেলাটুকু লুটে নিতে চাইছে। ওদের কি ঈশ্বরের চিন্তা নেই? যেন ওরা ঈশ্বরকে ডেকে কিছুই বলতে চায় না, তাঁকে ওদের বলার কিছু নেই, শিশু ভাবনার মতোই। ঈশ্বর তাঁর আপন মহিমায় যেটুকু দেখবেন, সেটুকুনই সার। এমন ভাবনা বৈদিক জীবনকৃষ্ণের কাছে অসম্ভব। ঈশ্বরকে তুমিই স্মরণ করবে, ঈশ্বর তোমাকে স্মরণ করবেন না, মানবের এই প্রকৃত ভাবনা, তিনি তাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই সব মানুষকে দেখ, মনে হবে, সকলেই আপন আবর্তে পাক খেয়ে ফিরছে। যেন, আমি আছি আপনাতে, ঈশ্বর আছেন ঈশ্বরে। ঈশ্বর যে আছেন, সে তো ওদের কথাতেই বোঝা যাচ্ছে, কথায় কথায়, দোহাই ভগবানের, বা মা কালীর দিব্যি কিংবা প্রতিযোগিতার সময় সমস্বরে, জয় মা ভবানী অনবরত বলেই চলেছে। সময় হলে মা আপনি স্মরণ করবে, ছেলের কি সে খেয়াল থাকে, এমনি ওদের ভাবখানা। না, রাগ আসে না মনে, নাক সিঁটকে ওঠে না এদের দেখে। বেশ ভালই লাগে জীবনকৃষ্ণের।
এতখানি বয়স হয়েছে, কোনওদিন মুরগির লড়াই দেখেননি, আজ ভারী মজা পেয়েছেন দেখে। দেখবার সুযোগ যে কোনওদিন হয়নি, তা নয়, উৎসাহ বোধ করেননি। আজ রীতিমতো উত্তেজনা বোধ করছেন। একটা লাল সাদা মোরগে লড়াই হচ্ছিল এক জায়গায়, তিনি যেন কেমন করে সাদা মোরগটার পক্ষ নিয়ে ফেললেন। দোহাই ভগবান, সাদা মোরগটা যেন জেতে। বোধহয়, সাদা মোরগটার নিষ্কলঙ্ক শুভ্রতার জন্যেই, তার সঙ্গে যেমন লাল টকটকে মাথার ঝুঁটি, তেমনি লাল গলার ঝুটি। যেন চিবুকে দাড়ি, মাথায় কিরীট। মোরগওয়ালা তার নামটিও দিয়েছে বেশ, রাজা। বলে, এই আমার রাজা লড়ে, রাজা লড়ে। রাজা আমার দিগ্বজয়ী (দিগ্বিজয়ী) রাজা, ধরবে আর ছিঁড়বে, রাজার আমি রুপোর ঘুংগুর গড়াব, মার মার মারর…
লাল মোরগওয়ালা তার মোরগকে বলছিল, বাদশা, মার কোপ, উরররর…দে কোপ, দে দে দে।
সে এক রাজা বাদশার লড়াই বটে। দেখতে দেখতে রক্ত ছিটকে পড়ল। লাল মোরগটার গায়ে রক্তের দাগ তেমন টের পাওয়া যাচ্ছিল না, সাদাটার গায়ে সামান্য রক্তের দাগও বেশি দেখাচ্ছিল। লড়াই চলছিল মোরগওয়ালাদের, তাদের তো বাজি ছিলই, যারা দেখছিল, তারাও নিজেদের মধ্যে বাজি ফেলছিল। কেউ রাজার দলে, কেউ বাদশার দলে। জীবনকৃষ্ণ রীতিমতো ঔৎসুক্য নিয়ে গগনের দিকে তাকিয়েছিলেন। গগন যদি রাজি থাকে, তবে তিনিও বাজি লড়বেন।
কিন্তু গগন আসলে অত্যন্ত বিরক্তি বোধ করছিল। বিরক্তির সঙ্গে বিস্ময় এবং অবিশ্বাস। জীবনকৃষ্ণ কি কেবল এ সবই দেখতে এসেছেন? বঙ্গসিন্ধুর প্রবন্ধপাঠের এত যে উত্তেজনা, ফরাসি বিপ্লব ও ফায়স্তার এত যে কৌতূহল, সে কি কেবল, এই সব দেখে বেড়াবার জন্যে? বঙ্গসিন্ধুর কথা কেউ-ই গায়ে মাখেনি। গগন দেখতে পাচ্ছে, ফায়স্তার উদ্দেশ্য জানবার থেকেও, সকলে খেলাধুলা জুয়া মদ বাজি পোড়ানো বুলবুলির লড়াই নিয়েই বেশি ব্যস্ত। কিন্তু এরা সবাই অবুঝ, লেখাপড়া জানে না, বোধশক্তি কম, এদের সে দোষ দিতে পারে না। জীবনকৃষ্ণ এরকম করছেন কেন? তিনি যেন ভুলেই গিয়েছেন, রামদাস বাঁড়ুজ্জের ওখানে যেতে হবে। রামদাস প্রেসে বসে আছেন, সেখানে আরও লোকজন রয়েছে। জীবনকৃষ্ণ এই ইতরজনের মেলা ও মাতলামি দেখতে আসেননি, এসেছেন রামদাসের সঙ্গে দেখা করতে, প্রবন্ধ পাঠ করে খুশি হয়ে কথা বলতে। কৌতূহলিত শিশুর মতো একী খেলা তাঁর! গগনের সন্দেহ হয়, গোড়া থেকেই জীবনকৃষ্ণ তার সঙ্গে মশকরা করছেন কি না। অথচ উনি এমনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, রাগ করে কিছু বলাও যাচ্ছে না। তার নিজের কর্তব্যও আগে গিয়ে রামদাসের সঙ্গে দেখা করা। সেখানে বন্ধুরা সবাই বসে আছে। ছুটির দিনের আজ্ঞা আলোচনা সবই সেখানে। ফায়স্তা সে তার জীবনে অনেকবার দেখেছে, ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে। এখন আর কোনও কৌতূহল নেই। ফায়স্তা এখন তার জীবনে অন্য মূল্য বহন করছে। গভীর তার অর্থ। ভারতবর্ষের ইংরেজশাসনের পটভূমিকায়, ফরাসি বিপ্লবের কথা চিন্তা করে সে। এই চৌদ্দই জুলাই, পবিত্রতম, প্রায় আত্মাহুতি দেবার মতো দিন। অনেক বিশ্বাস হারিয়ে, সে ফরাসি বিপ্লবের মধ্যে ভারতের মুক্তির ছবি দেখতে পায়। তাই এই মেলার দিকে, জনতার এই হুল্লোড় উল্লাস দেখে, একটা বিক্ষুব্ধ হতাশায় ভারী হয়ে উঠছে তার মন। বিক্ষোভ ও হতাশার মূল কারণ এটাই, একেই কেন্দ্র করছে। জীবনকৃষ্ণের ব্যবহার, তিনি নিমিত্ত হয়ে উঠছেন।
গগন দেখেছে, বঙ্গসিন্ধুর ছেঁড়া কাগজে খাবার বিক্রি হচ্ছে। নতুন কাগজে, যে কাগজে ফায়স্তার প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। নতুন বঙ্গসিন্ধু রাস্তার ধুলায় উড়ছে, আর জীবনকৃষ্ণ যেখানে দৌড় প্রতিযোগিতা, সেখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছেন, নড়বার নামটি নেই, এদিকে বিকেল গড়িয়ে এল। সন্ধ্যার আর বাকি নেই।
গগন বিক্ষুব্ধ বিস্ময়ে ভাবে, মানুষ কত ভিন্ন। জীবনকৃষ্ণের কাছে, ফায়স্তার প্রবন্ধেই শুধু ফরাসি বিপ্লব সীমাবদ্ধ, বড় ভাল লিখেছে হে। আর এই সাধারণ মানুষেরা, এরা কি কোনওদিনই আপন অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে না? ইতিমধ্যেই কলকাতার সংস্কারবাদী পণ্ডিতদের প্রতি তার বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের রূপ ধরে, গণমানসের যে ছবি ফুটে ওঠে তার চোখের সামনে, এই জনতার মাঝখানে যেন তাও খুঁজে পায় না সে। তবে কি রামদাস যা বলেন, সেই পথেই যেতে হবে, সশস্ত্র যুদ্ধ!
বাঃ বাহবা বাহবা, দেখ দেখ গগন;কী সুন্দর, একে কি দুধ গোখরো বলে?
জীবনকৃষ্ণ দাঁড়িয়ে পড়লেন এক জায়গায়, সেখানে সাপের ঝাঁপি খোলা হয়েছে। এক সঙ্গে কয়েকটা সাপ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সাপগুলো কিলবিল করে এদিকে ওদিকে ছোটে, আর সাপুড়ের ঘরনি বা মেয়ে, কালো কুচকুচে স্বাস্থ্যবতী যুবতীটি লেজ টেনে ধরছে, আর গান ধরে দিয়েছে মনসার পাঁচালি সাপুড়ে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে এক হাতে, আর এক হাতে ডুগডুগি।
গগন জীবনকৃষ্ণের দিকে তাকায়। কিন্তু উনি সাপ খেলা দেখতেই ব্যস্ত। গগন কী বলছে, ভাবছে, তা নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। অনেকটা অর্থহীন শূন্যতায় গগন সাপগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। যদিচ, সাপগুলোর কোনও চিন্তাই তার মাথার মধ্যে নেই। কেবল কতগুলো চলন্ত কিলবিলে ছবি, যাদের রং কারুর সাদা, কালো, যার গায়ে ফুল ফুল দাগ, আর কৃষ্ণ নীল সাপ, শিরদাঁড়ায় অস্পষ্ট হলুদ রেখা। আর এক অর্থহীন পাঁচালির গান, আপাতত যার কোনও কিছুই তার কানে যাচ্ছে না, এবং তালপাতার তৈরি বাঁশির কয়েকটি সুরের একঘেয়ে ওঠা নামা।
.
এদিকে দৌড় প্রতিযোগিতা চলেছে সমানে। নানান বয়সের, নানান লোকের। শুধু গঞ্জের ধারে মাঠে নয়, পথে পথে দৌড় প্রতিযোগিতা। ব্যবস্থাপকেরা, লোকজনকে সরিয়ে রেখেছে রাস্তার দুপাশে। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় জনতা দৌড় দেখছে। স্বয়ং বড় সাহেব যে পুরস্কার দেবেন আজ। অর্থাৎ ফরাসডাঙার গভর্নর।
কেল্লার কাছ থেকে, মিয়াজী পীরের ধার পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায়, গর্ত করে পুঁতে দেওয়া হয়েছে গোল পালিশ করা কাঠের খুঁটি। দশ থেকে পনেরো হাত উঁচু। গায়ে তার মাখিয়ে দেওয়া তৈলাক্ত পদার্থ। উঠে যাও খুঁটি বেয়ে? খুঁটির মাথায় আছে টাকা আর খাবারের ডালি। যে উঠতে পারবে, তারই পুরস্কার ওই ডালি। কিন্তু হাতে ধুলো মাখাতে পারবে না, মাটিতে ঘষতে পারবে না। খুঁটির নীচে লোক আছে, হাত মুছিয়ে দেবে ভাল করে।
দু হাত ওঠে, আর হড়কে পড়ে যায়। খুঁটির সর্বাঙ্গে তেল মাখানো। লোক হাততালি দিয়ে হাসে। দলের লোক চেঁচায় উত্তেজিত হয়ে।
একটা নয় কয়েকটা খুঁটি। একই খুঁটি আছে গঙ্গার উঁচু পাড়ে পুঁতে, হেলিয়ে দেওয়া। একটু কম শক্তিধরদের জন্যে। কোনও রকমে তেলের হড়কানিতে একটু ঝুলে থাকতে পারলেই হয়। ডগায় আছে পুরস্কার।
গঙ্গার দূর স্রোতে ছুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে পাতিহাঁস। প্রতিযোগীরা পড়ে ঝাঁপিয়ে। হাঁসই পুরস্কার, যে যতগুলি নিতে পার সাঁতার কেটে।
টাকা হাঁস খাবার মদ। উৎসবের মহা কলরোল শুরু হয়েছে দুপুর থেকেই। রাত্রি পর্যন্ত চলবে।
আজ ফ্যাস্তা। খেলা, জুয়া, ফরাসডাঙায় অঢেল মদ, গঞ্জে অগঞ্জে মেয়েমানুষ। কতটুকু জীবন। লুটে নাও, লুটে নাও।
অনেক সাহেব মেম নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছে লাটসাহেবের কুঠিতে। অনিমন্ত্রিত সাহেবরা যায়, দাইয়া মেমসাহেবের নাচঘরে। ব্যাগাডেলি তীর ছোঁড়া জুয়া, হরিচরণের বাজনা। মেমসাহেব আর দেশি মেয়ের নাচ।
আজ ফ্যাস্তা। কে জানে খাস ফরাসিদের দেশে এ দিন কেমন যায়। লোকে ভাবে, এই সামান্য চন্দননগরের মতো উপনিবেশেই যখন এত ফুর্তি তখন খাস মুলুকে না জানি আরও কী ঘটে।
অনেকদিন পরে মধুকে দেখা গেল, সঙ্গে তার মোহ। না, মধু সেনপাড়ার বাড়ি থেকে আসেনি। সে আর বাড়ি যায়নি। সেই যে মোহর সন্ধানে পৌষসংক্রান্তির আগে ঘর ছেড়েছিল, সে-ই শেষ। কে জানে, পৌষের অশুভ ছায়া তাকে অন্ধ করে রেখেছে কি না। পৌষে যে ঘর ছাড়তে নেই, আসতেও নেই। এমনকী, কুকুর বিড়ালকে লোকে পৌষমাসে ঘর থেকে তাড়ায় না। সেই পৌষেই মধু ঘর ছেড়েছিল আর সে ঘরে ফিরে যায়নি।
ঘোষপাড়ার দোল মেলা পর্যন্ত সে নারায়ণ খুড়া আর বিমলিদের সঙ্গেই ছিল। টাকা কড়ি, যা কিছু বিমলির আঁচলেই ছিল। চাষবাস, গোয়াল গোরু, ঘর গৃহস্থ, সে সবের কোনও চিন্তা-ভাবনা ছিল না সেখানে। এ সেই বেদের টোল। ফাল্গুনের শেষাশেষি দোল পূর্ণিমা পর্যন্ত কেটেছে কেবল মেলায় মেলায়। সাখোরের ভাঙা পৌষ সংক্রান্তির মেলা থেকে, উল্লারহাট কাজীপাড়ার ভাঙা রাসের মেলা, পিঠাপুকুরের পীরের মেলা, কামারপুকুরের শীতলা মেলা ঘুরতে ঘুরতে, বারাসত বসিরহাটের শেষ মেলার দিনগুলো কেটেছে হাড়োয়ার হাটের পীর গোরাচাঁদ সাহেবের মেলায়। ওই তল্লাটের সবথেকে বড় মেলা, সবথেকে জমজমাট। আঁড়িকুড়ি ডেয়ো ঢাকনা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরেছে, মেলায় মেলায় রান্নাবান্ন হয়েছে। আশ্রয়ের অভাব হয়নি। রাতে যখন দোকানপাট বন্ধ হয়েছে, তারই কোনও চালাঘরে আশ্রয় জুটেছে। বিমলি থাকতে সে সব ভাবনা ছিল না। লোক বশ করতে জানে সে। তা ছাড়া, মোহর চাঁদ মুখখানি ছিল, তাতেও অনেকে বশ হয়েছে। বিপদ আপদও এসেছে। চাঁদ মুখ দেখে তো সকলের প্রাণ ঠাণ্ডা হয় না, চাঁদে হাত বাড়াতে চায় অনেকে। তবে খুড়া-ভাইপোর সেটুকু বল ছিল। তা ছাড়া, যে সব মেলা হাটে বাজারে হয়েছে, সে সব জায়গায় আশ্রয়ের অভাব কখনই হয়নি। মাঘ ফারুন, দুটি মাস-ই কেটেছে যেন কেবল চড়ুইভাতি করে। কখনও নদীর ধারে, কখনও গ্রামে হাটেবাজারে। কত লোক দেখা হয়েছে, কত চেনাশোনা হয়েছে, কত পথ ঘোরা হয়েছে। কখনও হেঁটে, কখনও গোরুর গাড়িতে, কখনও নৌকোয়। নোনা গাঙের তল্লাটে, ডাঙা কোথায়, শুধু তো জলই। ভেড়ির বাঁধ আর জল। অমন মিঠে বাতাস আর কোথাও মধু পায়নি। মাঘের শীত কাটিয়ে যখন ফাল্গুন এল প্রথমে, মধুর তখন মনে হয়েছিল, আরও দক্ষিণে চলে যাবে সে। মাঘের শীতের দিনগুলো, রাত্রিগুলো, একদিনের তরেও শীত বোধ হয়নি। তার যে শীত গ্রীষ্ম বোধ ছিল না। মোহকে নিয়ে সেই যে প্রথম স্বাধীন জীবনযাত্রা। পথে পথে হাটে হাটে মেলায় মেলায়। প্রথম প্রথম দু-চার দিন মোহর আড়ষ্টতা ছিল। কিন্তু, রাতের অন্ধকারে, বিমলির দেওয়া কাঁথার তলায় যখন মধু টেনে নিয়েছে, তখন সব আড়ষ্টতা কেটে গিয়েছে। শাসন কষন বাদ, মধুকে নিয়ে অবাধ জীবন, তারও যে সেই প্রথম।
বিমলির আশ্রয়ে মাছ দুধ ছিল না,নুন ভাত ছিল। কিন্তু ক্ষুধার কথাই কি মনে ছিল। মধুআর মোহর পেটের ক্ষুধা কি সত্যিই হারিয়ে যায়নি। কে, কীসে সেই পেটের ক্ষুধা হরণ করে নিয়েছিল, কে জানে। পেটের ক্ষুধা চির অভর সত্যি, তবু এমন দিনও আসে, যখন রক্ত খাদ্যের কথা ভুলে যায়। বিমলি ঠাট্টা করে হেসে বলত, লোকে যে বলে, যৌবন কুরকুরোয় না ভাত কুরকুরোয়, তা তোমাদের মতন ডাগর ডাগরি দেখেই বলে। দুটির ঘোর যে আর কাটে না। একে নেশায় পেয়েছে, তায় নতুন।
হ্যাঁ, সে যেন এক কেমন ধারা, মধু ভাবত। গ্রামে, গঙ্গার ধারে, বাঁশঝাড়ে জঙ্গলে ছিল একরকম। তখন মনের ছটফটানি ছিল বেশি। একটু দেখতে পেলেই হত, হাত ধরে একটু কাছে বসতে পেলেই হত। কিন্তু সাগরের দারুণ শীতের রাতে পাতার বেড়ার চালায়, বিচুলির গাদায়, দুটিতে একত্র রাত্রিবাস করতে গিয়ে সবকিছু অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল। লোকে যে বলে, নতুন বিয়ে হলে, ছোঁড়াদের গলার স্বর বদলে যায়, তা মিথ্যে নয়। অনেকটা স্বরভঙ্গের মতো। সত্যি কি আর তাই হয়। আসলে জিভ গলা কেমন যেন শুকিয়ে থাকে, আঠার মতো চটচটে হয়ে থাকে। থাকত, সারাদিন থাকত, মোহকে দেখে দেখে রক্তে কেমন তোলপাড় করত, এক ভাবনায় ছাতি ফাটত, আগুন জ্বলত যেন। ভাতে জলে সেই তৃষ্ণা ও ক্ষুধা মিটত না। রাত্রে মোহকে কাছে পেলে অনেকটা তৃষ্ণা মিটত। কিন্তু তৃষ্ণা কি মেটবার। মদ যতক্ষণ ঢেকে ঢেকে পেটে যায়, ততক্ষণ ভেজা, তারপরেই আবার শুকিয়ে কাঠ, চোখে কেবল বিভ্রম লেগে থাকে। নারাণ খুড়ো আর বিমলিকে দেখে মনে হয় ওকেই খোয়ারি বলে। বিমলি যে বলে, নেশার খোয়ারি নেশা করেই কাটাতে হয়। সেও তেমনি।
এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে নদিয়ার ঘোষপাড়ার দোল মেলা। আউল বাউল বোষ্টম-বোষ্টমির মেলা। হিমসাগরে ডুবে ডুবে স্নান। বিমলি বলেছে মোহকে, হিমসাগরে নাইবি ডালিম গাছের ডালে ঢিল লটকাবি মানত করবি, আমরা নাতির মুখ দেখব।
মধু বলেছে ঠাট্টা করে, ভগমানের এমনি যন্তর মন্তর।
ও সবে মধুর বিশ্বাস নেই। লোকেরা যে বলে, হিমসাগর পুকুরে ডুব দিলে, ডালিমের ডালে ঢিল বাঁধলে, কানার নজর ফিরে আসে, বোবায় কথা কয়, লুলা আতুর খোঁড়া, ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে ছোটে, ও সবে তার বিশ্বাস নেই। কেন অমন হবে, তা বলবে তো। ঠাকুরের থানে হত্যে দেওয়া, ভর হওয়া, ও সব অনেক দেখেছে মধু। সব বুজরুকি। মনে মনে বলে, ন্যাকামো দেখলে গা জ্বলে যায়। আবডালে মোহকে গাল টিপে দিয়ে বলেছে, হিমসাগরে ডুব দিতে চাস, দি গে যা, কিন্তু হিমসাগর ছেলে দেবে না, আমিই দেব।
মোহ মধুর বুকে চাঁটি মেরে বলেছে, আমি কি তা বলেছি নাকি?
মধু অবিশ্যি বিমলিকে ছাড়েনি, বলেছে, খুড়ি, তুমি একটা ডুব দিয়ে মানত কর, আমরা ভাই পাব। বিমলি খলখল করে হেসে উঠেছে, বলেছে, আ মরণ, আমার পেটে কি আর নাড়ি আছে? ও বস্তু অনেক দিন জ্বলে গেছে বাবা। ভাজা মদের নেশা করি, নেশাখোর মাগিদের পেটে ফল ধরে না।
না, বিমলির গলায় কোনও আক্ষেপের সুর ছিল না। তার মেয়েমানুষের প্রাণ কিনা কে জানে। তাকে সবাই ডাকাতে বিমলি বলে, সে চারটে তাঁত একলা চালায়, হাতের ধারালো ছুরি দিয়ে চটের থান থেকে প্রতিটি ফুপড়ি সে নিপাটে কাটে, সকলের সামনেই বোতল তুলে মদ খায়, পুরুষদের সঙ্গে হাতাহাতিতেও পেছপা নয়। শরীরে তার বয়সের ছাপ পড়েছে বটে, কিন্তু পাথরের মতো শক্ত। কেউ কখনও তার ছেলেপিলে দেখেনি, হয়েছে বলে শোনেনি। তবে যাকে বলে ঢলানো, সে বৃত্তান্ত তার নামে অনেক আছে। সে কথা আলাদা, তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করলে, অপযশ না গাইলে সে কাউকে আপনা থেকে ত্যাগ করেনি। কলের যত মেয়েরা তার বাড়িতে থাকে, সবাইকেই সে ভালবাসে। সে কারুর ঘাড়ে পুরুষ গছিয়ে দেয় না, তুমি যেমন বুঝবে, তেমন করে এসে ভাড়া দিয়ে থাক, খাটো খাও। কেউ জ্বালাতন করলে, বিমলিকে বলল, ঝেটিয়ে বিষ ছেড়ে দেবে। বুকে হাত দিয়ে বলে, আঁতের কারবার করো। ঠোঁটে হাত দিয়ে বলে, দাঁতের কারবার করো না।অর্থাৎ ভালবাস মন থেকে, মুখের কথায় নয়। আঁতের পুরুষ নারাণের সেবা করে সে, খাওয়াপরা সব নিজে দেখাশোনা করে। তবু আঁটকুড়ি হওয়াতে তার দুঃখ নেই। সে যে নিজেই বলে, ঘুম থেকে উঠে আমার মুখ দেখিস না লো কেউ। দিন ভাল যাবে না। আঁটকুড়ো আঁটকুড়িদের মুখ দেখতে নেই। কিন্তু সে নিজের মুখে বলে বলেই, সবাইকে ভালবাসে বলেই, তেমন চোখে কেউ তাকে দেখে না। পরের ছেলের উপর বিদ্বেষ নেই। তার যেমন জীবনযাপনের ধারা, যেমন বাউণ্ডুলে স্বাধীন হয়ে ফেরে, সে জানে, এমন অবস্থায় ছেলেপিলে পাপের মতো। যে সব মেয়েরা তেমন গৃহস্থ হতে পারেনি, কলে কারখানায় এসেছে, এদিকে কাঁড়িখানেক ছেলে, তাদের সবাইকে সে বলে, তোরা পেটে ধরিস কোন লজ্জায়, ভেবে পাই না। সব পেটপোড়া খেয়ে মর গে যা। ফল পচিয়ে মারিস কেন?তবু মনের পোড়াকপাল, যখন সত্যি সত্যি সকালবেলা কেউ কেউ তার দিক থেকে তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন রাগে ও বিদ্বেষে বুক জ্বলে যায়। তারপরে একটা অসহায় কষ্টে সারাদিনই মনটা ভার হয়ে থাকে। কেবল মদ খায় আর নারাণের সঙ্গে আড়ি করে থাকে।
তবে, বিমলি খলখল করে হাসুক আর যাই করুক, ঘোষপাড়ার হিমসাগরে সে ডুব দিয়েছিল, সঙ্গে নারাণকেও ডুব দিইয়েছিল। নারাণকে সে কোনও মানত করতে শিখিয়ে দিয়েছিল বা নিজে কোনও মানত করছিল কি না, সে কথা কেউ জানে না। বিমলি শুধু ডুব দেয়নি, ডালিম তলায় মাথা পেতে অনেকক্ষণ মাটিতে বুক চেপে শুয়েছিল। ওরকম করেই লোকে হত্যে দেয়। বিমলি বলেছিল, হত্যে মত্যে দিতে জানি না বাপু। একটু সতী মায়ের ধ্যান করতে ইচ্ছে হয়েছিল, মাটিতে পড়ে ধ্যান করে নিলুম।
ঘোষপাড়ার লিচু বাগানের ছায়ায়, বেদের সংসার কয়েকদিন জমেছিল ভালই। যারা ফুর্তি তামাশা করতে এসেছিল, তারা আসর করেছিল অন্য দিকে। সেখানে হারমোনিয়ম ডুগি তবলার বাজনা, ঝুমুর ও খ্যামটার ঘুংগুরের তাল, নাচুনিদের কোমরের হ্যাঁচকায় আর চোখের ইশারায়, লোকদের যেন বাই জন্মানো আওয়াজ বেরুচ্ছিল বুকের ভিতর থেকে। সেখানে বড় হইহই রইরই, রমরমা। আসর থেকে দূরে গাছতলায়, ঝোপ ঝাড়ের মাঝে মাঝে, গতর বেচুনিরা, ছোট ছোট বেড়ার ঘরে, সারি দেওয়া লোকদের হাত থেকে পয়সা নিয়েছে। মধু সব ঘুরে ঘুরে দেখেছিল, মন্দ লাগেনি, বেশ একটা আমেজ লেগেছিল। শরীরে গরমের আমেজ। রাত্রে, লিচু তলার জ্যোৎস্নার আলো অন্ধকারের নিরালা আস্তানায়, মোহকে বুকের কাছে টেনে নিলে, ওই সব কথা মনে পড়ত। সেই ঝুমুর খ্যামটার পরিবেশ, গাছ তলার ঝোপঝাড়ের সেই সব মেয়েদের, যাদের দেখলে মধুর মনে হত, ওরা যেন পণ করে লড়াইয়ে নেমেছে। ওদের মুখের হাসি যেন হাসি নয়। যেন ভিতরে ভিতরে একটা রাগ আর জেদ পুষে রেখেছে, উপরে উপরে হাসছে। লোকদের হাত থেকে পয়সা নিয়ে যখন আঁচলে বাঁধত তখন ঠোঁট টিপে, মাথা ঝাঁকিয়ে এমন জোরে গিঠ দিত আঁচলে, ভাবখানা যেন, নে মরণ, এবার কী করবি কর। কেন ওদের কি সুখ নেই? অথচ হাসেও।
আর একদিকে ছিল যত আউল বাউল ফকিরদের আসর। সেখানে ডারা ডুপকি খঞ্জনি পেমজুরির বাজনা, একতারার বং বং-আ। জয়গুরু জয়গুরু রব, আর কেবল গান। সে গানও খুব মজার। প্রায় সব গানের কলিতেই, মন সে আমার নয় তো অ ভোলা মন কথাগুলি ছিলই। খ্যামটার আসরে যেমন
অবলার বল দেখে মনমথ থ গানের কলিটি শেষ করেই, একটু থেমে তারপর কোমর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচ শুরু হত। আর চারদিক থেকে হাততালি পড়ত, সেরকম নয়। তবে বাউল ফকিরেরাও পায়ে ঘুংগুর বেঁধে নাচত, কিন্তু তাদের গানের কথা আলাদা। তাতেও বেশ শরীরে একটা দোলানি লেগে যেত। কৃষ্ণ রাধা এক ভাণ্ডে, কাণ্ডে কাণ্ডে জড়াজড়ি। ফল তো ফলে না, অমন মরি মরি হরি হরি ॥ ওদের শ্রী ছাঁদ যেমন পাগলা পাগলা, গানের কথাগুলিও তেমনি। শুনতে ভাল লাগত, অর্থ বোঝা যেত না। মধুর ধারণা, অর্থ কিছু ছিল না। তবু ওরকম গানের কথা শুনে, অন্য বাউল ফকিরেরা, ডাক ছেড়ে চিৎকার করে উঠত, মূর্ছা যেত।
মেলা বলতে ঘোষপাড়াতেই জমেছিল ভাল। প্রায় সাতদিন কেটেছিল সেখানে। সতীমায়ের মন্দির থেকে দূরে, লিচু আর আম বাগানে যখন জ্যোৎস্না ফুটত, রাত্রি গম্ভীর হত, কোকিল ডাকত সারা রাত, তখন মোহ বলত, মন করে, এখেনে যাবোত জীবন থাকি।
ঘোষপাড়ার বাগানে যাবজ্জীবন থাকবার আকাঙ্ক্ষা মধুর মনে জাগেনি। জীবনের ভাবনাটা তার সেরকম নয়। তবু মোহ যখন বলত, বিশেষ সেই সব জ্যোস্না রাত্রে, যখন সারারাত্রির মধ্যে ঘুম পলকের জন্য চোখের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেত মাত্র, জেগেই কাটত বেশি, তখন মনে হত, হ্যাঁ, গোটা জীবনটা যদি এমনি করেই কাটে, ভাল হয়। সেই বিমলির কথা, যৌবন কুরকুরোয়, না ভাত কুরকুরোয়। চাঁদের আলোকে তাদের দিনের আলো বলে ভুল হত না, তবু তারাও যখন ছিল, রাতের কোকিল। তাদের ভিতরে নিঃশব্দ ডাকাডাকির স্বর সপ্তমে বাজত, গাছের বাসাহীন ডালপালাতে পাখিরা মিলিত হত। বাইরে ঘুরতে ঘুরতে মোহ কেবল এক কথাই বলত, এমনি করে এখেনে চিরটাকাল যদি কাটত। যেখানেই ভাল লেগেছে, মোহ সেখানেই চিরদিন থাকতে চেয়েছে। থিতু হয়ে থাকবার ইচ্ছা ওর। স্থিতি চায়। জীবন বড় সুখের বলে মনে হয়েছে, কিন্তু ছুটে বেড়িয়ে পথে পথে, সেই সুখ বেশ গোটা হয়ে ওঠে না, কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
ঘোষপাড়ায়, আতপুর সেনপাড়া জগদ্দল কাঁকিনাড়ায় অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়েছিল। তারা মোহ মধুকে একসঙ্গেই দেখেছে। বিমলি নারাণকেও দেখেছে। অনেকে জিজ্ঞেস করেছে, মধু কোথায় থাকে, কী করে। কেউ বলেছে, মধু এবার গ্রামে ফিরে গেলেই তো পারে। ঘরদোর রয়েছে, অল্পবিস্তর যাই হোক জমি চাষ-আবাদ রয়েছে, রুগ্ন বাপ ঘরে, মায়ের মনটা খালি, ছেলের পথ চেয়ে আছে। মোহকে নিয়ে কথা। তা না হয়, মোহকে নিয়েই যাবে। চিরদিন গাঁ ঘর ছেড়ে থাকা তো কোনও কাজের কথা নয়।
মধু সে সব কথার কোনও স্পষ্ট জবাব দেয়নি। সে যেন অনেকটা দৈব নির্দেশের নিষ্ঠুর অন্ধ বেগে চলেছে। অথচ তার ভিতরটা একেবারেই নির্বাক ও নির্বিকার থেকেছে, তা নয়। বাবা মা হীরা লখাই খুড়া, সকলের কথাই তার মনে পড়ে। কিন্তু সেই মনে পড়া কখনও স্থায়ী হয় না, নিতান্ত ক্ষণিকের। আগে, হীরার জন্যে মনটা খুবই ব্যস্ত হত। এখন আর তেমন হয় না। জন্মের পর থেকেই হীরা কোলে কোলে ঘুরেছে, পিছনে পিছনে ছুটেছে, যাকে বলে, ন্যাওটা, তাই হয়ে পড়েছিল। হীরার সান্নিধ্য একটা অভ্যাস হয়ে উঠেছিল। সে অভ্যাস এখন আর তেমন মনকে চকিত করে না। এ সব কোনও কিছুরই কার্যকারণ হেতু মধু জানে না। বাড়ির কথা মনে হলে, তার ভিতরটা কেবল বলে ওঠে, না ভাল নাগে না। এই বিমুখতার কারণ হিসাবে, এইটুকু মাত্র মনে হয়, জীবনকে সেখানে বড় স্তিমিত, বেগহীন মনে হয়। কিছুতেই যেন বাড়ির মতো করে, বাড়ির সঙ্গে বাঁচা যায় না। যদি বলো, সকলেই তো করে, তুমি কেন পার না। মধু তখন নিজেকে জবাব দেয়, সত্যিই তো, আমি কেন পারি না, তা বুঝি না। এমনকী গোলামও পারে। বিষ্টুদের কথা না হয় বাদই রইল। সে কেন পারে না।
মানুষ নিজের কাছে সবথেকে বেশি অপরিচিত। মধু নিজেকে এত বেশি চেনে না যে, নিজের জীবনের গতি প্রকৃতির বিষয় সে বুঝতে পারে। সে যে ভাবে চলেছে, আপাতত তা বাঁচারই অঙ্গ। স্পষ্ট জবাব দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ঘোষপাড়ার আর একজন পুরনো মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মধুর সঙ্গে নয়, নারাণখুড়োর সঙ্গে। শ্রীনাথ কাঠুরের জোড়া বউয়ের, এক বউয়ের সঙ্গে, যাকে মধু ঠিক চিনত না। জঙ্গলপীরের শ্রীনাথ কাঠুরে, যার ছিল একজোড়া নিঃসন্তান বউ। ছেলেপিলে না হবার জন্যে, শ্রীনাথ যাদের মনে করত, মাগিরা পেটে কোনও তুক পুষে রেখেছে আর খুঁটির সঙ্গে বেঁধে যাদের বেদম পিটত, যে বউয়েরা পালিয়ে গিয়েছিল চাপদানির নয়া চটকলে। সেখানে গিয়ে, দুটি বউয়েরই পেটে বাচ্চা এসেছিল। শ্রীনাথ কাঠুরের কাছে যখন সংবাদ গিয়েছিল, সে বলত, যন্তরের এমনি গুণ, বাঁজা মেয়েমানষের ছেলে হয়? সে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি। চাপদানিতে সে নিজের চোখে দেখতে গিয়েছিল। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে, সেনপাড়া ছাড়বার আগেও মধু শ্রীনাথকে দেখেছে। ছেলেবেলায় দেখেছে, সবসময়েই কুড়োল আর দড়ি কাঁধে নিয়ে ঘোরে। মুখে সাদা কালো দাড়ি, মাথায় বড় বড় চুল, পেটা শক্ত শরীর, সারা গায়ে বড় বড় পাকাটে লোম। বড় বড় গাছ কাটবার দরকার হলে, যখন লোকের কাঠের দরকার হয়, দরজা জানালা সিন্দুক ঘর গৃহস্থালির জিনিসপত্র বা কেউ মরলে চিতা জ্বালাবার প্রয়োজনে, তখন শ্রীনাথকেই সবাই স্মরণ করে।
কাঠুরের বউদের কখনও দেখেছে বলে, মধু পুরোপুরি মনে করতে পারত না। শুনেছিল, বউয়েরা পালিয়ে গিয়েছে। শ্রীনাথকে বরাবর মধুর পাগল বলে মনে হত। বনে জঙ্গলে, বা জঙ্গলপীরের দলে, যেখানে কাঠুরের বাড়ি, শ্রীনাথকে দেখলে মধুর ভয় করত। সে বলত, কীরে ছোঁড়ারা জঙ্গলে কী করছিস? ভূতে ধরবে, পালা। সে খুব হাসত, শব্দ করে নয়, ফুলে ফুলে হাসত, যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, তাতে তার দাড়ি ভরতি মুখটা ফুলে উঠত, চোখ দুটি লাল দেখাত। অনেকটা যেন মনে মনে হাসার মতো। হাসত আর ঘাড় নাড়ত। লোকের কাছে শ্রীনাথকে সে বলতে শুনেছে, খোঁজাখুজি চলছে, পেলেই বউ আনব ঘরে। আরও বিয়ে করার শখ ছিল তার। কিন্তু আর কখনও তার বউ জোটেনি। আঁটকুড়ো নাম সে ঘোচাতে পারেনি। মূলাজোড়, আতপুর, সেনপাড়া, জগদ্দলের অধিবাসীদের ধারণা, শ্রীনাথ অনেকবার ব্রহ্মহত্যার পাপ করেছে, সে নারকেল গাছ কেটেছে, তাই তার বংশরক্ষা হয়নি। নারকেল গাছ ব্রাহ্মণ, তার গায়ে কুড়োল বসাতে নেই। বয়স হলে, নারকেল গাছ আপনি মরে যায়, বা বজ্রপাতে মরে, কিংবা ঝড়ে ভেঙে যায়। মানুষ নিজের হাতে তাকে কখনও কাটে না। কিন্তু লোকেরা সাক্ষী আছে, পয়সার লোভে, নারকেল গাছ কেটেছে শ্রীনাথ। প্রথম যখন শুনেছিল মধু, তখন সে নারকেল গাছকে সত্যি বামুন ভাবত। বিশ্বাস করত, সত্যি, ছিনাথ বেহ্মহত্যা করেছে। এখন আর সে সব বিশ্বাস করে না। বামুন না হাতি। তেসুতিকলের পাগলা সাহেবের হুকুমে, মুসলমানেরা কবার নারকেল গাছ কেটেছে। মুসলমান পাড়ার গাছ ঝাড়ানো বস্ত্রা (বসীর) কত নারকেল গাছ কুড়োল দিয়ে নামিয়ে দিয়েছে। চক্রবর্তীদের বাগানেই কতবার নারকেল গাছ কাটানো হয়েছে, বস্তা কেটে দিয়েছে। না কেটে উপায় ছিল না। বংশ বাড়লে ঘর বাড়াতে হয়, উপায় কী। বস্ত্রা না হয় মুসলমান, ব্রহ্মহত্যাতে ওর পাপ নেই। যারা হুকুম দেয়, তাদের পাপ নেই? কোর্ট কাছারির আইন নাকি যে, কে খুন করতে বলেছে, তা যখন সাবুদ করা গেল না, যে হাতে মেরেছে, তাকেই ফাঁসিতে লটকাও। আর বরা তো মোচলমান, বামুন মারলে ওর নরকবাস হবে না।
হাসি পায় মধুর। আসলে, ব্যাটাছেলেও বাঁজা হয়। শ্রীনাথ কাঠুরেকে দিয়ে, এই সত্যটা জেনেছে সে। ঘোষপাড়ায় যে বউটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তার দুই মেয়ে নিয়ে সে এসেছিল। একটা কাঁখে, আর একটা, বছর পাঁচেকের, শাড়ির ভোট জড়িয়ে হাঁটত। সব থেকে বড়টা নাকি, কোম্পানির কোনও সাহেবের ঔরসজাত। তার এখন বছর দশ বারো বয়স। সাত-আট বছর বয়সে, ফরাসডাঙায় কোন যাত্রার দলের লোকেরা নাকি তাকে নিয়ে গিয়েছে। যাত্রা পালাতে সে মেয়েমানুষ সাজে। যেমন তার রূপ, তেমনি নাকি তার গলার স্বর। আসরে উঠে নাচলে, সকলের প্রাণ তুরীয় হয়ে ওঠে।
কাঠুরে বউ এখন যার ঘর করে, তার নাম তেলোচন। ত্রিলোচন যার নাম। দুজনেই কাজ করে চাপদানির কলে। তারা দুজনেই শুধু ঘোষপাড়ায় আসেনি, বড় খুটনি নৌকায়, চাপদানি কারখানার বেশ বড় দলই এসেছিল। নারাণখুড়ো সকলের সঙ্গেই দেখা করেছিল, তারাও এসে সবাই দেখা করেছিল। পুরনো দিনের কথা তারা বলাবলি করেছিল। সবই চটকলের গল্প।
সেই সব গল্পের মধ্যে, পবনের কথা উঠেছিল। ঘোষপাড়ায় লিচুবাগানে, জ্যোৎস্নার আলো অন্ধকারে, বাতাসের সাঁইসাঁই শব্দে, কোকিলের ডাকে, মধু আর মোহ তাদের কথা গল্প শুনেছিল। তেলিনিপাড়ায় কুরুসেন, (আসলে চাপদানি কোম্পানির ক্রুকশন সাহেব। তখন চাপদানির মিলকে, সেনপাড়ার লোকেরা তেলিনিপাড়ার কল বলত। বোধহয়, তেলিনিপাড়ার কাছে চাপদানি, কিন্তু নামডাক তেলিনিপাড়ার বেশি।) জোয়ান ডাগরি মেয়েমানুষ দেখলেই কেমন, শ্মশানের মড়াখেকো কুকুরের মতো হন্যে হয়ে উঠত। দিনক্ষণ সময় অসময় লোজন বোধাবোধ ছিল না, ঝাঁপিয়ে পড়ত। মিলের কাছে কোম্পানির পাড়ার দিনের বেলাও দরজা খোলা শোবার উপায় ছিল না। কিছু না হোক, ক্রুকশনের হাতের ছড়ি, তোমাকে বেআবরু করে দিয়ে, হেসে হেসে মজা দেখত।
সেই ক্রুকশনের জন্যেই তো, পবনের বউ তারা জলে ডুবেছিল। অনেকবার শোনা কাহিনী, আবার একবার। ঘোষপাড়ায় লিচুবাগানে, পুরনো মানুষদের মুখে শুনেছিল মধু। ডাকাত পবন, যে আইন মানত না, সমাজ লোকভয় ছিল না, সেনপাড়ার দেওয়ানদের ভয় না করে, ছাঁদনাতলা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল তারাকে। তারা তো তখনই দামড়া মাগি, চাঁড়ালের ঘরে, আইবুড়ো মেয়ে প্রায় চৌদ্দয় পড়েছিল। পবন নাকি বলত, আমার দশ বছর বয়সে তারা হয়েছিল, তখন ওকে কোলে করে বেড়াতাম। ওর মা ঘাটে যেত কাঁথাকাপড় বাসন ধুতে, রান্না করতে, বাবা করত ঘরামির কাজ, মেয়েটা কেঁদে মরত। আমি কোলে করতাম বলে, ওর মা আমার হাত ভরে গুড় দিত, কোঁচড় ভরে মুড়ি। আর সেই ছুঁড়ি কিনা, আটে পা না দিতে দিতে, নোক দুলিয়ে আমাকে জিভ ভ্যাংচায়!..তবেই বোঝা যায়, ওদের পিরিত কতদিনের। কিন্তু তারার সঙ্গে পবনের বিয়ে দিতে চায়নি তার বাবা মা। বিয়ে ঠিক করেছিল অন্য জায়গায়। পবন ছাঁদনাতলা থেকে, তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল। কেউ তাকে রুখতে পারেনি। তারাকে নিয়ে সে চলে গিয়েছিল চাপদানির কলে। কারণ জানত, মিল কলে না গেলে, কোনও গ্রামে গিয়ে উঠলে, কেউ তাকে ক্ষমা করত না। চাষবাস ঘরামির কাজ দিত না, গাঁয়ে ঠাঁই দিত না। কিন্তু মিলে গিয়েও রেহাই পায়নি, কুকশনের নজর পড়েছিল তারার ওপর। পবনকে একটু ভয় পেত ত্রুকশন, তাই তক্কে তক্কে থেকে, একদিন সে ভর দুপুরে, পবন যখন কারখানায়, তখন ঘরে গিয়ে উঠেছিল। তারাও একটু ডাকাবুকো ছিল, সাহেব-সুবো মানত না। সবার সামনেই হেসে কথা বলত। পবন বারণ করত, শুনত না। সেইদিন দুপুরে, ক্রুকশন গিয়ে যেমনি তারার ঘুম ভাঙিয়েছে, পবনও গিয়ে তখন উপস্থিত। তাকে দেখেই সাহেব ছুট, কিন্তু তারার কী হল, পবনের রক্তবর্ণ চোখ দেখে, সে ভাবল, পবন বুঝি তাকে অবিশ্বাস করেছে, তাকে বুঝি খুন করবে। সে ভয় পেয়ে ঘর থেকে দৌড় দিল। দৌড় দিয়ে একেবারে, জোয়ারের ভরা গঙ্গায়। পবনের কত ডাক, তারা, ও তারি শোন। কে শোনে। পড়েছিল গিয়ে আওড়ে, ঘূর্ণি যাকে বলে। পবনও জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল। কিন্তু আর খুঁজে পায়নি।…
সবাই প্রত্যক্ষ দেখেছিল, নারাণ খুড়ো, কাঠুরে বউ, ত্রিলোচন। তবে পবনও সেই যে জলে ভেসেছিল, সেও আর ফেরেনি। অন্ধকার হওয়া ইস্তক, গঙ্গার জোয়ারে রাত্রি অবধি ভাসতে দেখেনি বটে, পরের দিন কাঁকিনাড়ায় তেঁতুল গাছের ডালে, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখেছিল। এখন যেখানে জার্ডিন-স্কিনারদের কারখানা উঠছে, লোকে যাকে গলায় দড়ের কল বলে। সবাই ভেবে নিয়েছিল, চাপদানি থেকে ভাসতে ভাসতে, তারার খোঁজে সে কাঁকিনাড়ায় গিয়ে ঠেকেছিল। কে জানে, মৃত তারাকে সে আর ভাটার টানে খুঁজে পেয়েছিল কি না। কিন্তু সে আর ফেরেনি।
নারাণ খুড়োরা নিজেদের মধ্যে এই সব বলাবলি করেছিল। কাঠুরে বউ বলেছিল, পবন বলত, তারা আমার জমমো পিরিতের বউ।
বিমলি বলেছিল, তা বটে কথা বইকী। যাকে কোলে করে মানুষ করেছে, তাকে বুকে নিয়ে বউ করেছে, একে জমো পিরিতের বউ-ই বলে। আহা, অমন সুখের বরাত সইল না। তা সে মুখপোড়া কুরুসেনটাকে পবন ঘাড় ভেঙে দিয়ে গেল না কেন?
কাঠুরে বউ বলেছিল, ঘাড় ভাঙেনি, তবে সে যমের আধিব্যাধির অন্ত ছিল না। তাকে জাহাজে তুলে, সায়েবদের দেশে পাটুটে দিয়েছে অনেককাল।
কাঠুরে বউয়ের পতি বলো, উপপতি বলো, এখন সবই ত্রিলোচন। লোকটি ভাল মিস্তিরি, মনে মনে একটু ধর্মের টান আছে। সে বলেছিল, অধর ধরার ফাঁদ পেতেছে চিন্তামণি, বিল্বমঙ্গল না ভেসে করে কী। পবন-তারার কথা আমি, বুঝলে নারাণদা, কখনও ভুলতে পারি না।
সকলের নিশ্বাস পড়েছিল। মধু দেখেছিল, বিমলি খুড়ির পাশে বসে, মোহ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।