চণ্ডীমণ্ডপে আজ বেজায় গণ্ডগোল
চণ্ডীমণ্ডপে আজ বেজায় গণ্ডগোল, কাল রাতের চোরটা ফের আজ ধরা পড়েছে। বাজারে নটবর ঘোষের ভাই হলধর ঘোষের মিষ্টির দোকানে ঢুকে জল খেতে চেয়েছিল। তাতে কারও সন্দেহ হয়নি। জল খেয়ে হঠাৎ বলে বসেছে, “থ্যাঙ্ক ইউ!”
চাষাভুষোর মুখে থ্যাঙ্ক ইউ’ শুনেই হলধর ঘোষ উঠে ছোঁকরাকে ধরেছে, “কে রে তুই! সাতজন্মে কেউ কখনও চাষার মুখে ইংরেজি শুনেছে? তুই যে বড় ফটাস করে ইংরেজি ফোঁটালি! বলি সাপের পাঁচ পা দেখেছিস নাকি? আজকাল গাঁয়ে-গঞ্জে স্কুল খোলর এই ফল হচ্ছে। বুঝি! অ্যাঁ!”
ছোঁকরার হাতখানা চেপে ধরেছিল হলধর, তা হাত থেকে খানিকটা ভুষো কালি উঠে এল তার হাতে। আর ছোঁকরার ফরসা রংটাও বেরিয়ে পড়ল একটুখানি। তখনই চেঁচামেচি।”চোর! চোর! সেই চোর!”
ছোঁকরা পালাতে পারল না। সঙ্গে একটা স্যাঙাত ছিল বাচ্চামতে। সে অবশ্য পালাল।
ছোঁকরাকে চণ্ডীমণ্ডপে এনে একটা খুঁটির সঙ্গে কষে বাঁধা হয়েছে। মাতব্বররা সব জাঁকিয়ে বসেছেন।
নটবর ঘোষ গলা তুলে বলে, “চোরকে ছেড়ে দেওয়াটা গগনের মোটই উচিত কাজ হয়নি। ছেড়ে দিল বলেই তো ফের গাঁয়ে ঢুকে মতলব আঁটছিল।”
গৌরগোবিন্দ বললেন, “আহা এ তো অন্য চোরও হতে পারে বাপু! আমি তো শুনেছি কালকের চোরটা খুন হয়েছে।”
বিজয় মল্লিক বললেন, “না ঠাকুরদা, এ সেই চোর। আমরা সাক্ষী আছি। এর বুকের পাটা আছে বাপু। একবার ধরা পড়েও শিক্ষা হয়নি! ওরে ও ছোঁড়া, বলি পেছনে দলবল আছে নাকি? এত সাহস না হলে হয় কী করে তোর!”
খাঁদু বিশ্বাস বলল, “শিমুলগড়ে ফাল হয়ে ঢুকেছ, এবার যে উঁচ হয়ে বেরোতে হবে!”
হলধর হুঙ্কার দিয়ে উঠল, “বেরোতে দিচ্ছে কে? এইখানেই মেরে পুঁতে ফেলব। আজকাল গাঁয়ে-গঞ্জে চোর-ডাকাত ধরা পড়লে পুলিশে দেওয়ারও রেওয়াজ নেই। মেরে পুঁতে ফেলছে সবাই। যাদের মন নরম তারা বরং বাড়ি গিয়ে হরিনাম করুন।”
নটবর বলে, “হলধর কথাটা খারাপ বলেনি। পুলিশে দিয়ে লাভ নেই। ওসব বন্দোবস্ত আছে। হাজত থেকে বেরিয়ে ফের দুষ্কর্মে লেগে পড়বে। আমাদের সকলের ঘরেই খুদকুঁড়ো সোনাদানা আছে। সর্বদা ভয়ে-ভয়ে থাকতে হয়।”
মাতব্বররা অনেকেই মাথা নেড়ে সায় দিল, “তা বটে।”
হরি গাঙ্গুলি বললেন, “সে যা হোক, কিছু একটা করতে হবে। তবে চোরের একটা বিচারও হওয়া দরকার। পাঁচজন মাতব্বর যখন আমরা আছি, একটা বিচার হয়ে যাক।”
প্রাণকৃষ্ণ মণ্ডল বলে উঠল, “কিন্তু সওয়াল-জবাব হবে কী করে! চোরটা যে বড্ড নেতিয়ে পড়েছে, দেখছ না! ঘাড় যে লটরপটর করছে!”
হলধর উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “দুখানা পেল্লায় চড় কষালেই ফের খাড়া হয়ে যাবে ঘাড়। কালকেও তো এরকমই নেতিয়ে পড়ার ভান। করেছিল।”
হলধর গিয়ে ছোঁকরার কাছে দাঁড়িয়ে একটা পেল্লায় চড় তুলে ফেলেছিল। এমন সময় উদভ্রান্তের মতো ছুটে এল কালী কাপালিক।
“ওরে, মারিসনে! মারিসনে! মহাপাতক হয়ে যাবে! এ যে মহেন্দ্রপ্রতাপের বংশধর?”
সভা কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ মেরে গেল।
পটল গাঙ্গুলি বললেন, “তার মানে?”
কালী কাপালিকের চুলদাড়ি সব উড়ছে, সর্বাঙ্গে কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ার দাগ। রক্তাম্বরও ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে। মণ্ডপে উঠে ছোঁকরাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে হাতের শুলটা আপসে নিয়ে বলে, “রায়দিঘির রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের নাম শোনননি নাকি? এ-হল তার অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ। আকাশে এখনও চন্দ্র-সূর্য ওঠে, কালীর সব কথাই মিছে বলে ধোরো না। এ কথাটা বিশ্বাস করো। এ চোর-ছ্যাচড় নয়।”
সবাই একটু হকচকিয়ে গেছে। মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। একটা গুঞ্জনও উঠল নতুন করে।
হলধর থাপ্পড়টা নামিয়ে নিয়ে বলল, “তুই তো গঙ্গাজলের মতো মিথ্যে কথা বলিস! এর সঙ্গে তোর সাঁট আছে।”
পটল গাঙ্গুলি বললেন, “ওরে কালী, এ যে মহেন্দ্রপ্রতাপের বংশধর তার প্রমাণ কী? প্রমাণ নইলে আমার হাতে তোর লাঞ্ছনা আছে।”
“প্রমাণ আছে। রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের ছেলে হল বিজয়প্রতাপ, তস্য পুত্র রাঘবেন্দ্রপ্রতাপ, তস্য পুত্র নরেন্দ্রপ্রতাপ, তস্য পুত্র তপেন্দ্রপ্রতাপ, সত্য পুত্র রবীন্দ্রপ্রতাপ এবং তস্য পুত্র এই ইন্দ্রজিপ্রতাপ। একেবারে ঘোড়ার মুখের খবর। স্বয়ং চন্দ্রকুমারের মুখ থেকে শোনা।”
কে যেন বলে ওঠে, “ব্যাটা গুল ঝাড়ছে।”
ঠিক এই সময়ে ছেলে অলঙ্কারকে নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে উঠে এল হরিপদ। হাতজোড় করে বলল, “মাতব্বররা অপরাধ নেবেন না। কালী কাপালিক মিছে কথা বলছে না। যতদূর জানি, ইনি সত্যিই মহেন্দ্রপ্রতাপের বংশধর। কপালের ফেরে পড়ে নিদোষ লোক আমাদের হাতে অপমান হচ্ছেন।”
হরিপদ গরিব হলেও সৎ মানুষ বলে সবাই জানে। পটল গাঙ্গুলি বললেন, “তুমি যখন বলছ তখন একটা কিন্তু থাকছে। রায়দিঘির রাজা মানে শিমুলগড়ও তাঁর রাজত্বের মধ্যে ছিল। আমরা–মানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন রায়দিঘিরই প্রজা। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ইনি তো মানী লোক। কিন্তু হাওয়াই কথায় তো হবে না, নীরেট প্রমাণ চাই যে। ওরে ও হলধর, ওর বাঁধনটা খুলে দে। বসতে দে। একটু জলটলও দিয়ে নে আগে।”
তাড়াতাড়ি বাঁধন খুলে ইন্দ্রজিৎকে বসানো হল। ছুটে গিয়ে অলঙ্কার একভাঁড় জল নিয়ে এল। সেটা খেয়ে ইন্দ্রজিৎ কিছুক্ষণ চোখ বুজে বসে থেকে জিরিয়ে নিল। তারপর চোখ খুলে বলল, “প্রমাণ আছে। দলিলের কপি আমি সঙ্গেই এনেছি। রায়দিঘির রাজবাড়ির চত্বরে আমার তাঁবুতে রয়েছে। কেউ যদি গিয়ে নিয়ে আসতে পারে তো এখনই দেখাতে পারি।”
গৌরগোবিন্দ খাড়া হয়ে বসে বললেন, “পারবে না মানে! আলবাত পারবে। সাইকেলে চলে গেলে কতটুকু আর রাস্তা! তুমি বাপু একটু জিরোও, আমরা তোক পাঠাচ্ছি।”
সবাই সায় দিয়ে উঠল। কয়েকজন ছেলেছোঁকরা তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে পড়ল সাইকেল নিয়ে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গোটা তাঁবু সহ সব জিনিস এনে ফেলল তারা।
গৌরগোবিন্দ তাঁর বাড়ি থেকে একটু গরম দুধ আনিয়ে দিয়েছেন এর মধ্যে। ইন্দ্রজিৎ সেটা শেষ করে তার হ্যাঁভারস্যাক থেকে কাগজপত্র বের করে বলল, “এই হচ্ছে আমাদের দলিল। বাবার কাছেই ছিল, আমি ফোটোকপি করে এনেছি। আর এই দেখুন, আমার পাশপোর্ট, আমি যথার্থই রবীন্দ্রপ্রতাপের ছেলে ইন্দ্রজিৎপ্রতাপ, মহেন্দ্রপ্রতাপের অধস্তন ষষ্ঠ পুরুষ।”
পটল গাঙ্গুলি শশব্যস্তে বললেন, “তুমি কি বিলেতে থাকো নাকি বাবা?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
বিলেত শুনে সকলেই একটু ভড়কে কেমনধারা হয়ে গেল। পটল গাঙ্গুলি মাথা নেড়ে বললেন, “তা হলে ঠিকই আছে। আমিও শুনেছিলাম, রাজবাড়ির উত্তরপুরুষেরা বিলেতে থাকে।”
গৌরগোবিন্দ বললেন, “আমি তো এর দাদু তপেন্দ্রপ্রতাপ আর তস্য পিতা নরেন্দ্রপ্রতাপের সঙ্গে রীতিমত ওঠাবসা করেছি। রবীন্দ্রপ্রতাপকেও এইটুকু দেখেছি ওদের কলকাতার বাড়িতে। এ তো দেখছি সেই মুখ, সেই চোখ। তবে স্বাস্থ্যটা হয়নি তেমন। তপেন্দ্রপ্রতাপ তো ইয়া জোয়ান ছিল।”
চারদিকে একটা সমীহের ভাব ছড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে একটু অনুশোচনাও। হলধর একটু চুকচুক শব্দ করে বলল, “কাজটা বড় ভুল হয়ে গেছে রাজাবাবু। মাফ করে দেবেন।”
ইন্দ্র মাথা নেড়ে বলে, “আমাকে রাজাগজা বলবেন না। আমি সাধারণ মানুষ, খেটে খাই। আমি যে রাজবংশের ছেলে তাও আমার জানা ছিল না। চন্দ্রকুমারের লেখা একটা পুরনো পুঁথি থেকে লুকনো মোহরের সন্ধান জেনে এদেশে আসার সিদ্ধান্ত নিই। তখনই আমার বাবা আমাকে জানালেন, রায়দিঘির রাজবাড়ির আসল উত্তরাধিকারী আমরাই। ভেবেছিলাম মোহর উদ্ধার করে সেগুলো বিভিন্ন প্রদর্শনীতে পাঠাব। বিক্রি করলে অনেক টাকা পাওয়া যেত ঠিকই, কিন্তু টাকার চেয়েও মোহরগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য অনেক বেশি। বিক্রি না করলেও অবশ্য মোহরগুলো থেকে আমার অনেক আয় হত। ভেবেছিলাম, আমার পূর্বপুরুষ মহেন্দ্রপ্রতাপ তো প্রজাদের বঞ্চিত করেই মোহর জমিয়েছিলেন, সুতরাং আমি এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কিছু করব। অলঙ্কারের মতো বাচ্চা ছেলেরা এখানে ভাল খেতে-পরতে পায় না, গাঁয়ে হাসপাতাল নেই, খাওয়ার জলের ব্যবস্থা ভাল নয়। এগুলোর একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। কিন্তু মোহরগুলো হাতছাড়া হয়ে গেল।”
সবার আগে নটবর ঘোষ লাফিয়ে উঠল, “গেল মানে! আমরা আছি কী করতে?”
সকলেই হাঁ-হাঁ করে সায় দিয়ে উঠল।
ঠিক এই সময়ে বাইরের জমাট অন্ধকার থেকে হঠাৎ যমদূতের মতো দুই মূর্তি চণ্ডীমণ্ডপে উঠে এল। হাতে বিরাট-বিরাট দুটো ছোরা হ্যারিকেনের আলোতেও ঝলসে উঠল।
কে যেন আতঙ্কের গলায় বলে উঠল, “ওরে বাবা! এ যে কালু আর পীতাম্বর!”
সঙ্গে-সঙ্গে গোটা চণ্ডীমণ্ডপে একটা হুলুস্থুল হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। পালানোর জন্য এমন ঠেলাঠেলি যে, এ-ওর ঘাড়ে পড়ছে। যারা নেমে পড়তে পারল তারা তাড়াতাড়িতে ভুল জুতো পরে এবং কেউ-কেউ জুতো ফেলেই চোঁ-চাঁ পালাল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মণ্ডপ একেবারে ফাঁকা। শুধু পটল গাঙ্গুলি, গৌরগোবিন্দ, হরিপদ, অলঙ্কার আর ইন্দ্রজিৎ। তারা কেউ নড়েনি।
পীতাম্বর চেঁচিয়ে উঠল, “এই যে! এই ছোঁকরাটা!”
কালু বলে, “দে ভুকিয়ে। ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
পীতাম্বর ছোরাটা কপালে ঠেকিয়ে বলল, “এই যে দিই। জয় মা…”
কিন্তু মুখের কথা শেষ হওয়ার আগেই গৌরগোবিন্দর পাকা বাঁশের ভারী লাঠি পটাং করে তার মাথায় পড়ল।
“বাপ রে!” বলে বসে পড়ল পীতাম্বর।
কালু অবাক হয়ে বলে, “এরও লেঠেল আছে দেখছি। সকলেরই যদি লেঠেল থাকে তা হলে কাজকর্ম চলে কিসে?”
কিন্তু তাকেও আর কথা বলতে হল না। গৌরগোবিন্দর লাঠি পটাং করে তার কাঁধে পড়ল।
“উরেব্বাস!” বলে বসে পড়ে কাল।
তারপর কিছুক্ষণ শুধু পটাং-পটাং লাঠির শব্দ হল। কালু আর পীতাম্বর ফের অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। একেবারে চিতপটাং।
গৌরগোবিন্দ দুঃখ করে বললেন, “সন্ধেবেলা একবার ভূত ঝেড়ে দিয়েছি। তাতেও দেখছি আক্কেল হয়নি! ওরে তোরা সব কোথায় পালালি? আয় আয়, ভয় নেই। এ দুটি বাঘ নয় রে, শেয়াল।”
কালী কাপালিকের চারদিকে নজর। একটু তফাত হয়েছিল। গুণ্ডা দুটো ঘায়েল হয়েছে দেখে সবার আগে এসে সে পীতাম্বরকে একটু যেন গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “আহা, বড় হ্যাপা গেছে এদের গো। আর লাঞ্ছনাটাও দেখতে হয়..” বলতে বলতেই নজরটা চলে গেল ট্যাকে। জামা উঠে গিয়ে ট্র্যাকের ফোলাটা দেখা যাচ্ছে। পীতাম্বরের টাক থেকে বারো হাজার টাকার বান্ডিলটা বের করে সে চোখের পলকে রক্তাম্বরের ভেতরে চালান দিয়ে দিল, “মায়ের মন্দিরটা এবার তা হলে হচ্ছেই! জয় মা…”
এদিকে গগনের ঘরে গগনের অবস্থা খুবই কাহিল। ইতিমধ্যে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে তার মাথা ফেটে রক্ত পড়ছে, বল্লমের খোঁচায় তার পেট একটু ছ্যাদা হয়েছে। চোখে ঝাঁপসা দেখছে গগন। দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই বলে সে সারা ঘরে হামা দিয়ে বেড়াচ্ছে আর বলছে, “খবর্দার! খবর্দার! একদম জানে মেরে দেব কিন্তু! ভগবানের দেওয়া মোহর। যে ছোঁবে তার অসুখ হবে। খবর্দার…”
খাঁড়াটা হামা দেওয়ার সময়েও হাতছাড়া করেনি গগন, ঘষটে ঘষটে নিয়ে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ কে যেন আলতো হাতে খাঁড়াটা তুলে নিয়ে দেওয়ালের গজালে ঝুলিয়ে রাখল। গগন বলল, “ক্কে?”
তারপরই গগন স্থির হয়ে গেল। সে শুনতে পেল, তার ঘরে দুটো লোক কথা কইছে।
একজন বলল, “বৎস চন্দ্রকুমার, একটা রহস্য ভেদ করে দেবে? আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি বায়ুভূত হয়েও দিব্যি পার্থিব জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে পারছ। এইমাত্র ভারী খঙ্গখানা তুলে ফেললে। কিন্তু আমার হাত-পাগুলো এমনই ধোঁয়াটে যে কই আমি তো তোমার মতো পারছি না!”
“আজ্ঞে মহারাজ, দেড়শো বছর মোহরে ডুবে থেকে আপনার কোনও ব্যায়ামই হয়নি যে। তাই এখনও ধোঁয়াটে মেরে আছেন। আর আমি বাইরের খোলামেলা আলো-হাওয়ায় ঘুরে বেড়াই বলে আমার কিছু পোষ্টাই হয়েছে। তা ছাড়া নিয়মিত অভ্যাস ও অনুশীলনে আমি বায়বীয় শরীরকে যথেষ্ট ঘনীভূত করে তুলতে পারি। সেটা না পারলে আপনার ছ’ নম্বর উত্তরপুরুষকে বাঁচাতে পারতাম না। তাকে ঘাড়ে করে মাইলটাক বইতে হয়েছে কাল রাতে। তারও আগে থেকে তাকে নানারকম সাহায্য করে আসছি। এমনকী বিলেত অবধি ধাওয়া করে আমার পুঁথিটা উদ্ধার করে তার হাতের নাগালে আমিই এগিয়ে দিয়েছিলাম। আমাকে কিন্তু নিমকহারাম বলতে পারবেন না মহারাজ।”
“আরে না, না। তোমার কাজকর্ম যতই দেখছি ততই সন্তুষ্ট হচ্ছি। তা এ-লোকটাকে কি তুমি মেরে ফেলবে?”
“আজ্ঞে না মহারাজ, পৃথিবীতে আর-একটা যখ বাড়াতে চাই না। আপনার ষষ্ঠ উত্তরপুরুষের ওপর অন্যায় হামলা করায় এশাস্তি ওর পাওনাই ছিল।”
“ও, ভাল কথা চন্দ্রকুমার, আমার সেই উত্তরপুরুষটি কোথায়? সে নিরাপদে আছে তো!”
“ব্যস্ত হবেন না মহারাজ। ছোঁকরা একটু বিপদের মধ্যেই আছে।
তবে জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতা, বিপদআপদ ঘটা ভাল। তাতে মানুষ শক্তপোক্ত হয়, আত্মরক্ষা করতে শেখে, বুদ্ধি আর কৌশল বৃদ্ধি পায়, বাস্তববোধ জেগে ওঠে।”
চোখের রক্ত মুছে গগন ভাল করে চেয়ে হাঁ করে রইল। তার সামনে ঘরের মধ্যে দুটো বিশাল মূর্তি দাঁড়িয়ে। দুজনেরই পরনে ঝলমলে রাজাগজার পোশাক। গগন হুঙ্কার দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু গলা দিয়ে চিচি শব্দ বেরোল, “ওরে চোর, তোরা এ-ঘরে ঢুকলি কী করে?”
তার কথায় কেউ ভুক্ষেপ করল না। গগন দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়াল। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে খাঁড়াখানা দেওয়াল থেকে টেনে হঠাৎ আচমকা ঘ্যাচাং করে এককোপে কেটে ফেলল একজনকে।
“আহা হা, চন্দ্রকুমার! তোমাকে যে একেবারে দু-আধখানা করে কেটে ফেলল! সর্বনাশ!”
চন্দ্রকুমার একটু হেসে বলে, “আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, ঘনীভূত অবস্থায় ছিলাম কিনা! তাই কেটে ফেলতে পেরেছে। তবে জুড়ে নিতে দেরি হবে না।”
চন্দ্রকুমারের শরীরের নীচের অংশটি আলাদা হয়ে সারা ঘরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। চন্দ্রকুমার বললেন, “আমার ওই অংশটি কিছু দুষ্ট প্রকৃতির…” বলতে বলতে তিনি গিয়ে ওই অংশটি আবার প্যান্ট পরার মতো সহজেই জুড়ে নিলেন শরীরে।
গগন সাঁপুই খাঁড়াসমেত ফের মেঝের ওপর পড়ে গেছে। বিড়বিড় করে সে বহুঁকাল আগে শোনা কণার্জুন’ নাটকের একখানা সংলাপ বলে যাচ্ছে, “চলে গেলি একবিঘাতিনী, মরণের নামমাত্র করিয়া প্রচার, কিরিটীর কিরিট ভূঁইয়া?”
“ওহে গগন!”
গগন দুখানা হাত জোড় করে বলে, “যে আজ্ঞে।”
“কেমন বুঝছ?”
“আজ্ঞে, আপনাদের সঙ্গে এঁটে উঠব না।”
“মোহরের থলিটা যে এবার বের করতে হবে ভায়া।”
গগন খুব অবাক গলায় বলে, “মোহর! হুজুর, মোহরটা আবার কোথায় দেখলেন? কু-লোকে কুকথা রটায়।”
“তোমার চেয়ে কু-লোক আর কে আছে বাপু? একটু আগে তুমি মহারাজের ষষ্ঠ উত্তরপুরুষকে খুন করতে দুটো খুনিকে পাঠিয়েছ। তুমি অন্যায়ভাবে পরস্পাপহরণ করেছ।”
“আজ্ঞে না হুজুর, আমি পরের অপকার করিনি। আর সেই চোর যে মহারাজের কেউ হন, তাও জানতুম না কিনা!”
“কিন্তু মোহর!”
গগন কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “আজ্ঞে, ভগবান দিয়েছেন। তাই…”
“এই যে মহারাজকে দেখছ, ইনি মোহরের খপ্পরে পড়ে দেড়শো বছর পাতাল-ঘরে মাটিচাপা ছিলেন।”
গগন ডুকরে উঠল, “ওরে বাবা, আমি মোটে বন্ধ জায়গা সইতে পারি না। ছেলেবেলায় একবার পাতকুয়োর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম, সেই থেকে বেজায় ভয়।”
“তা হলে উঠে পড়ো গগন! মোহর বের করে ফ্যালো।”
গগন হাতজোড় করে বলে, “বড্ড লোকসান হয়ে যাবে যে!”
“মোহর তো আলমারি খুলে আমিই বের করতে পারি। কিন্তু তাতে তো তোমার প্রায়শ্চিত্ত হবে না গগন। ওঠো। আর দেরি নয়। তারা আসছে।”
“হুজুর, বড্ড গরিব হয়ে যাব যে। কোটি-কোটি টাকা থেকে একেবারে পপাতধরণীতলে! দু-চারখানা যদি রাখতে দেন।”
“দু’শো এগারোখানা মোহর গুনে দিতে হবে। ওঠো।”
“আজ্ঞে, মাজায় বড় ব্যথা। দাঁড়াতে পারছি না।”
“তা হলে হামাগুড়ি দাও। তুমি দুর্বিনীত, হামাগুড়ি দিলে কিছু বিনয় প্রকাশ পাবে।
গগন মোহরের থলি নিয়ে যখন হামাগুড়ি দিয়ে বেরোল, তখন উঠোনে বহু লোক জমায়েত হয়েছে। অনেক মশাল জ্বলছে। ভিড়ের মাঝখানে রোগা ছেলেটা দাঁড়িয়ে।
গগন সিঁড়িতে হামাগুড়ি দিয়ে নেমে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেল। মোহরের থলিটা উঁচুতে তুলে ধরে বলল, “বড্ড গরিব হয়ে গেলাম, আত্তে।”
লাঠি হাতে একটা লোক দু’পা এগিয়ে এসে বলল, “গগনবাবু, দুটো বা হাতওলা লোক এই এতক্ষণে খুঁজে পেলাম। কথাটা সারাদিন মাথায় চক্কর দিচ্ছিল। আপনারই মশাই, দুটোই রাঁ হাত। ডান হাতেও তো আপনি অশুদ্ধি কাজই করেন। কাজেই ওটাও বাঁ হাতই।” বলে লক্ষ্মণ পাইক চারদিকে একবার চাইল, “আর ন দিয়ে নামের আদ্যক্ষর…”
নটবর ঘোষ টপ করে মাথাটা নামিয়ে ফেলায় লক্ষ্মণ বলে উঠল, “আপনিও খারাপ লোক নটবরবাবু। তবে এ-আদ্যক্ষর আপনার নামে নয়। নামটা আমারই। আমার পিতৃদত্ত নাম নরহরি। নামটা ভুলে গিয়েছিলাম।”
গাঁ-সুদ্ধু লোক হেসে উঠল।