নিজের নাম নিয়ে একটু দুঃখ
নিজের নাম নিয়ে একটু দুঃখ আছে অলঙ্কারের। নামটার মধ্যে কি মেয়ে-মেয়ে গন্ধ? বন্ধুরা তা বলে না অবশ্য, কিন্তু তার কেন যেন মনে হয় নামটা বড় মেয়েলি। নাম ছাড়াও আরও নানারকমের দুঃখ আছে। অলঙ্কারের। যেমন, তার গায়ে তো জোর নেই যাতে সে বুক্কাকে হারিয়ে দিতে পারে। তাকে নপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবের ফুটবল টিমে কিছুতেই কেন যে নেয় না! তার বাবার তো পয়সা নেই যে, চাটুজ্যেবাড়ির ছেলে চঞ্চলের মতো একখানা এয়ারগান তাকে কিনে দেন। চঞ্চল তার এয়ারগানটা, অলঙ্কারকে ছুঁতেও দেয় না। অলঙ্কারের আর-একটা দুঃখ মা বাবার কাছে কিছু চাইলেই সবসময়েই শুনতে হয়, “না, হবে না। আমাদের পয়সা নেই।” নেই-নেই শুনতে-শুনতে অলঙ্কারের কান পচে গেল। আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ বা পরশপাথর পেলে তার একটু সুবিধা হত। সে অবশ্য খুব বেশি কিছু চাইত না। বিশ্বকর্মা পুজোর সময় কয়েকখানা রঙিন ঘুড়ি আর লাটাই, কয়েকটা লাট্ট, কিছু মার্বেল, পুজোয় নতুন জুতো,এইসব।
অলঙ্কারদের বাড়ি পুবপাড়ায়। দোতলা মিষ্টি একটা মাটির বাড়িতে তারা থাকে। বাড়ির সামনে একটু বাগান আর পেছনে ঘন বাঁশঝাড়। দোতলার ছোট্ট একটা কুঠুরিতে অলঙ্কার একা থাকে। সেখানে তার যত বইপত্র আর কিছু খেলার জিনিস। তার বইগুলো সবই পুরনো আর ছেঁড়াখোঁড়া। উঁচু ক্লাসে যারা উঠে যায় তাদের বই শস্তায় কিনে আনেন বাবা। তার খেলার জিনিসও বেশি কিছু নেই। একটা বল, দুটো ফাটা লাটিম, তক্তা দিয়ে বানানো একটা ব্যাট, একটা গুলতি, একটা ধনুক, একটা বাঁশি। ব্যস। তার জন্মদিনও হয় না কখনও। হলে টুকটাক দু-একটা উপহার পাওয়া যেত। দুঃখের বিষয়, তার যেসব বন্ধুর জন্মদিন হয়, তাদের বাড়িতে নেমন্তন্নেও যেতে পারে না অলঙ্কার। কারণ উপহার কেনার পয়সাই যে নেই তাদের।
দুঃখ যেমন আছে তেমনই কিছু সুখও আছে তার। ফুটবল খেলতে, সাঁতার কাটতে তার দারুণ ভাল লাগে। ভাল লাগে বৃষ্টি পড়লে, শীতকালে রোদ উঠলে, আকাশে রামধনু দেখলে। সকালে যখন পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে, তখনও তার খুব আনন্দ হয়। অলঙ্কারের আরও একটা গোপন সুখের ব্যাপার আছে। সে খুব খুঁজতে ভালবাসে। না, কোনও হারানো জিনিস নয়। সে এমনিতেই মাঠেঘাটে, জঙ্গলে, জলায় আপনমনে খোঁজে আর খোঁজে। হয়তো একটা অদ্ভুত পাথর, কখনও বা কারও হারানো পয়সা, অদ্ভুত চেহারার অচেনা গাছের চারা, ভাঙা পুতুল বা এরকম কিছু যখন পেয়ে যায় তখন খুব একটা আনন্দ হয় তার। খুঁজতে খুঁজতে এই গ্রাম আর তার আশপাশের সব অন্ধিসন্ধি তার জানা হয়ে গেছে।
আজ ভোর রাতে ঘুমের মধ্যে একটা আজগুবি ব্যাপার ঘটল। নিজের দোতলা ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল সে। এ-ঘরে জানলার বদলে ছোট ঘুলঘুলি আছে দুটো। মাথার কাছের ঘুলঘুলি দিয়ে কে যেন তাকে বলছিল, “বাঁশঝাড়ের পেছনে যে জঙ্গলটা আছে, সেখানে চলে যাও। সেখানে একটা জিনিস আছে।”
অলঙ্কার পাশ ফিরে ঘুমের মধ্যেই বলল, “কী জিনিস?”
“দেখতেই পাবে।”
“আপনি কে?”
“আমি শিমুলগড়ের পুরনো ভূত। আমার নাম ছায়াময়।”
ভূত শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল অলঙ্কারের। সে উঠে বসল। দেখল, বাইরে ভোর-ভোর হয়ে আসছে। খুব পাখি ডাকছে। ঘুলঘুলি দিয়ে অবশ্য কাউকেই দেখা গেল না। স্বপ্ন স্বপ্নই, তাকে পাত্তা দিতে নেই। অলঙ্কারও দিল না। সে রোজকার মতো সকালে উঠে দাঁত মেজে পড়তে বসল। চাট্টি মুড়ি খেল। তারপর মায়ের অনুমতি নিয়ে বেরোল খেলতে। আজ ইস্কুলের প্রতিষ্ঠাদিবস বলে ছুটি। বেরোবার মুখেই হঠাৎ তার স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল।
বাঁশঝাড়ের পেছনের জঙ্গলে একটা জিনিস আছে! কিন্তু কীই-বা থাকবে? গতকালও ইস্কুল থেকে ফেরার পথে জঙ্গলটা ঘুরে এসেছে। প্রায়ই যায়। ওই জঙ্গলটা তার খুব প্রিয় জায়গা।
আজ পুবপাড়ায় জোর ডাংগুলি খেলা হবে। সেদিকেই মনটা টানছিল অলঙ্কারের। তবু শেষ অবধি ঠিক করল জঙ্গলটায় পাঁচ মিনিটের জন্য ঘুরে আসবে।
বাঁশঝাড়টা বিরাট বড়। একদিন নাকি এই বাঁশঝাড় তাদের বংশেরই সম্পত্তি ছিল। তবে শরিকে-শরিকে বাঁশঝাড়ের মালিকানা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হওয়ায় এখনও এটা বিশেষ কারও সম্পত্তি হয়ে ওঠেনি। কেউ এখানকার বাঁশ কাটে না। ফলে ভেতরটা বেশ জমাট অন্ধকার। বাঁশপাতা পড়ে-পড়ে কার্পেটের মতো নরম একটা আস্তরণ হয়েছে মাটির ওপর। বাঁশঝাড় পেরিয়ে একটা আগাছার জঙ্গল। বড় গাছও বিস্তর আছে। এ হচ্ছে সাহাবাবুদের পোড়োবাড়ির বাগান। জঙ্গলটা অলঙ্কার নিজের হাতের তেলোর মতোই চেনে। সে চারদিকে চোখ রেখে জঙ্গলের এধার থেকে ওধার ঘুরতে লাগল। তারপর হঠাৎ মস্ত মহানিম গাছটার তলায় চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। গাছতলায় খানিকটা পরিষ্কার ঘাসজমি আছে। এখানে বসে অলঙ্কার বাঁশি বাজায় মাঝে-মাঝে। এখন সেখানে একটা লোক শুয়ে আছে। মরে গেছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। তবে কাত হয়ে, ভাঁজ করা হাতের ওপর মাথা রেখে গুটিসুটি হয়ে শোওয়ার ভঙ্গি দেখে মারা গেছে বলে মনে হয় না। লোকটা রোগা চেহারার, লম্বা চুল আছে, গালে অল্প দাড়ি।
অলঙ্কার পায়ে-পায়ে এগিয়ে গিয়ে লোকটার কাছে দাঁড়িয়ে একবার গলাখাকারি দিল। প্রথমে আস্তে। তারপর জোরে। কাজ হল না দেখে নিচু হয়ে বলল, “আপনি কি ঘুমোচ্ছন! এখানে কিন্তু শেয়াল আছে। আর খুব কাঠপিঁপড়ে।”
হঠাৎ লোকটা চোখ চাইল। তাকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বসেই বলল, “আ-আমি কোথায়? আমি এখানে কেন?”
অলঙ্কার একটু হেসে বলে, “আপনি এখানে কী করে এলেন তা আপনি নিজেই ভুলে গেছেন? খুব ভুলো মন তো আপনার!”
লোকটির বয়স কুড়ি বাইশের বেশি হবে না। নিজের ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “মাথাটা বোধ হয় গুলিয়ে গেছে। এখানে যে কী করে এলাম!” বলে লোকটা শুকনো মুখে অলঙ্কারের দিকে চেয়ে ফের বলে, “আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। সাঙ্ঘাতিক খিদে। কিছু খেতে দিতে পারো?”
অলঙ্কার ম্লানমুখে বলল, “তবেই তো মুশকিল। আমাদের বাড়িতে কিছু খাবার থাকে না যে! আমাদের কত খিদে পায়, আমরা তখন জল খাই খুব করে। আমাদের পাতে কিছু ফেলা যায় না বলে আমাদের বাড়িতে কাক কুকুর-বেড়ালরা পর্যন্ত আসে না। আমরা কোনও জিনিসের খোসা ফেলি না, ছিবড়ে ফেলি না। আমার বাবা সজনে ডাঁটা চিবিয়ে অবধি গিলে ফেলেন। আমি চিনেবাদাম পেলে তা ওপরের শক্ত খোসাটাসুদ্ধ চিবিয়ে খেয়ে নিই।”
ছেলেটা অবাক হয়ে চেয়ে ভয়-খাওয়া গলায় বলে, “ও বাবা, ওসব তো আমি পারব না। কিন্তু খিদেটা যে সহ্য করা যাচ্ছে না আর।”
“কেন, আপনার কাছে পয়সা নেই?”
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলে, “ছিল। এখন আর নেই। অনেক ছিল। কেড়ে নিয়েছে।”
“কে কাড়ল? ডাকাত!”
ছেলেটা ঠেটি উলটে বলল, “তাই হবে। ভাল চিনি না। তবে তোমাদের এই অঞ্চলটাই খুব খারাপ জায়গা।”
অলঙ্কার একটু ম্লানমুখ করে বলে, “আমার বাবারও তাই মত। আপনার কি অনেক টাকা ছিল?”
ছেলেটা করুণ হেসে বলে, “হ্যাঁ, অনেক। সে তুমি ভাবতেও পারবে।”
“এখানে একটা কাশীর পেয়ারাগাছ আছে। চমৎকার পেয়ারা হয়। তবে গাঁয়ের ছেলেরা সব পেড়ে খেয়ে যায়। গতকাল দেখেছি, তিনটে অবশিষ্ট আছে। এনে দেব?”
“পেয়ারা! তাই দাও। জল পাওয়া যাবে তো!”
“হ্যাঁ। জল যত চাই। আমাদের বাড়ি ওই বাঁশঝাড়টার ওধারে। কুয়ো আছে। আগে পেয়ারা পেড়ে আনি, তারপর বাড়ি নিয়ে যাব আপনাকে।”
গাছে তিনটে পেয়ারাই ছিল। অলঙ্কার পেড়ে নিয়ে এল। বেশ বড় পাকা হলুদ পেয়ারা। ছেলেটা একটাও কথা না বলে কপকপ করে মুহূর্তের মধ্যে খেয়ে ফেলল তিনটেই। খুব খিদে পেলে খাবে বলে অলঙ্কার পেয়ারা তিনটে গাছ থেকে পাড়েনি। ভাগ্যিস পাড়েনি। খিদের যে কী কষ্ট তা তো সে জানে।
ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে অলঙ্কার যখন বাড়ির দিকে আসছিল তখন তার একটু ভয়-ভয় করছিল। তাদের বাড়িতে একমাত্র পাওনাদারেরা ছাড়া আর কেউ আসে না। তারা বাইরে দাঁড়িয়ে কটু কাটব্য করে যায়। এ ছাড়া, কোনও অতিথি-অভ্যাগত, এমনকী আত্মীয়স্বজন অবধি কেউ আসেনি কখনও। বাইরের কোনও লোক এসে তাদের বাড়িতে খায়ওনি কোনওদিন। নিজের বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে আনতেও ভয় পায় অলঙ্কার। আজ হঠাৎ এই উটকো লোকটাকে দেখলে তার মা বাবা কি খুব রেগে যাবেন তার ওপর? তার মা বাবা খুবই রাগী এবং ভীষণ গম্ভীর। কখনও তাঁদের মুখে হাসি দেখা যায় না। অলঙ্কার তাঁদের একমাত্র ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সেও কখনও মা বা বাবার তেমন আদর বা আশকারা পায় না। তাদের বাড়িতে কোনও আনন্দ নেই, ফুর্তি নেই, হাসি নেই, গান নেই। এরকম বাড়িতে বাইরের কাউকে নিয়ে যেতে ভয় লাগবে না? এখন বাবা বাড়ি নেই, মা আছেন। মা যদি রেগে যান!
মা অবশ্য রাগলেন না। অলঙ্কারের রোগামতো মা কুয়োর ধারে কাপড় কাঁচতে বসেছেন। অলঙ্কারের সঙ্গে ছেলেটাকে আসতে দেখে কাঁচা থামিয়ে অবাক হয়ে চাইলেন।
অলঙ্কার ভয়ে-ভয়ে বলল, “মা, এর সব চুরি হয়ে গেছে। জঙ্গলে পড়ে ছিলেন।”
অলঙ্কারের মা অধরা উঠে মাথায় একটু ঘোমটা টেনে বললেন, “এ তো বড় ঘরের ছেলে মনে হচ্ছে! যাও বাবা, দাওয়ায় গিয়ে বোসো। ওরে অলঙ্কার, চটের আসনটা পেতে দে তো!”
মায়ের এই কথাটুকুতেই অলঙ্কারের বুক আনন্দে ভেসে গেল। মাকে সে যত রাগী আর বদমেজাজি ভাবে ততটা নন তা হলে! সে তাড়াতাড়ি আসন পেতে বসতে দিল ছেলেটাকে। চুপিচুপি জিজ্ঞেস করল, “আপনার নাম কিন্তু বলেননি।”
“আমার নাম ইন্দ্রজিৎ রায়।”
“ইন্দ্ৰদা, আমাদের বাড়িতে কিন্তু আপনার খুব অসুবিধে হবে।”
ইন্দ্র মাথা নেড়ে বলে, “অসুবিধে তোমাদেরই হবে বোধ হয়। তবে আমি এ-গাঁয়ে বেশিক্ষণ থাকব না। একটু জিরিয়ে নিয়েই চলে যাব। আগে একটু জল দাও।”
ইন্দ্র প্রায় আধঘটি জল খেয়ে নিল। অধরা দুটো বাতাসা এনে বললেন, “এ-দুটো খাও বাবা। মনে হচ্ছে খুব খিদে পেয়েছে।”
বাতাসা দুটো কচমচিয়ে খেয়ে ইন্দ্র বলল, “এখন খিদেটা সহ্যের মধ্যে এসে গেছে।”
“তবে আর-একটু সহ্য করো বাবা! আমি কচুসেদ্ধ দিয়ে ভাত বসাচ্ছি। আর হিঞ্চের ঝোল। দুটি গরম ভাত খাও।”
“কিন্তু আমি যে আর বেশিক্ষণ এখানে থাকব না মাসিমা। আমাকে চলে যেতে হবে।”
অধরা করুণ চোখে ছেলেটার দিকে চেয়ে বললেন, “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, খুব দুর্বল। এ-শরীরে কি হাঁটতে পারবে? দুটি খেয়ে নিলে গায়ে একটু জোর পেতে।”
ইন্দ্র সভয়ে মাথা নেড়ে বলে, “না, দেরি হয়ে যাবে। না পালালে আমার রক্ষে নেই।”
“তুমি কি ভয় পেয়েছ বাবা?”
ইন্দ্র নীরবে মাথা নেড়ে জানাল যে, সে ভয় পেয়েছে।
অধরা কী বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক এমন সময়ে বাইরে থেকে একটা ভারী গলার হাঁক শোনা গেল, “বলি ও হরিপদ, বাড়ি আছিস? হরিপদ-ও-ও …”
অলঙ্কার শখ করে জঙ্গল থেকে একটা নতুন ধরনের ফণিমনসা এনে উঠোনের বেড়া হবে বলে লাগিয়েছিল। সেগুলো এখন বুকমান বেড়ে উঠে প্রায় নিচ্ছিদ্র এক আড়াল তৈরি করেছে। বাইরে থেকে উঠোনটা আর কারও নজরে পড়ে না। লোকটাকে দেখা গেল না বটে, কিন্তু গলা শুনে অধরা আর অলঙ্কারের মুখ শুকোল।
ইন্দ্র চকিতে মুখ তুলে বলল, “লোকটা কে বলো তো!”
অলঙ্কার ম্লানমুখে বলে, “ও হচ্ছে হরিশ সামন্ত। গগন সাঁপুইয়ের খাজাঞ্চি। তাগাদায় এসেছে।”
“গগন সাঁপুই!” বলে ইন্দ্র ভু কোঁচকাল। তারপর টপ করে উঠে ঘরে ঢুকে কপাটের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। হরিশ সামন্ত ততক্ষণে ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, পাশে শম্ভু পাইক।
অধরা ইন্দ্রর কাণ্ড নীরবে দেখলেন, কিন্তু কোনও ভাবান্তর হল না। হরিশের দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বললেন, “উনি তো বাড়ি নেই।”
হরিশ একটু খেচিয়ে উঠে বলে, “যখনই আসি তখনই শুনি বাড়ি নেই! সাতসকালে গেল কোন চুলোয়? যাকগে সে এলে বোলো বাবু এত্তেলা দিয়েছেন। এবেলাই গিয়ে যেন একবার হুজুরের কাছে গিয়ে হাজির হয়। সুদে-আসলে তার মেলা টাকা বাকি পড়েছে। বুঝলে?”
“বুঝেছি। এলে বলব’খন।”
“আর-একটা কথা। মন দিয়ে শোনো। আজ আদায় উশুলের জন্য আসা নয়। বাবুর একটা জরুরি কাজ করে দিতে হবে। ভয় খেয়ে যেন আবার গা-ঢাকা না দেয়। বরং কাজটা করে দিলে কিছু পেয়েও যাবে। বুঝলে?”
“বুঝেছি।”
হরিশ সামন্ত চলে যাওয়ার পর ইন্দ্র বেরিয়ে এল। তার মুখে-চোখে আতঙ্কের গভীর ছাপ। সে অলঙ্কারকে জিজ্ঞেস করল, “কী কাজের জন্য তোমার বাবাকে খুঁজছে ওরা?”
ঠোঁট উলটে অলঙ্কার বলে, “কে জানে! তবে বাবার তো সোনার দোকান ছিল, গয়না বানাতেন। এখন আর ব্যবসা ভাল চলে না। গগনজ্যাঠা মাঝে-মাঝে সোনা গলানোর জন্য বাবাকে ডাকেন।”
ইন্দ্রর মুখ থেকে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত যেন সরে গেল। সাদা ফ্যাকাসে মুখে সে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল শুন্য দৃষ্টিতে। তারপর বিড়বিড় করে বলল, “গলিয়ে ফেলবে! গলিয়ে ফেলবে!”
অধরা একদৃষ্টে দেখছিলেন ইন্দ্রকে। হঠাৎ একটু হেসে বললেন, “শোনো বাবা ইন্দ্র, তুমি অত ভয় পেয়ো না। ওপাশে একটা পুকুর আছে। ভাল করে স্নান করে এসো তো। তারপর খেয়ে একটু ঘুমোও। তোমার কোনও ভয় নেই। মাথা ঠাণ্ডা না করলে মাথায় বুদ্ধি আসবে কেমন করে?”
ইন্দ্র মাথা নেড়ে বলল, “কিন্তু ওরা যে আমার সব মোহর গলিয়ে ফেলবে!”
অধরা অবাক হয়ে বলেন, “তোমার মোহর? মোহর তুমি কোথায় পেলে বাবা? আর তা গগনবাবুর কাছেই বা গেল কী করে?”
“সে কথা বলতে অনেক সময় লাগবে।”
“তবে এখন থাক। আগে স্নান-খাওয়া হোক। তারপর কথা।”
“কিন্তু ততক্ষণে…”
অধরা মাথা নেড়ে বললেন, “ভয় নেই। সোনা যাতে না গলে তার ব্যবস্থা হবে। এ-গাঁয়ে স্বর্ণকার মাত্র একজন, সে ওই অলঙ্কারের বাবা। তিনি না গেলে ও সোনা গলবে না।”
ইন্দ্ৰ বেজার মুখে খানিকক্ষণ বসে রইল। অলঙ্কারই তাকে ঠেলে তুলে পুকুর থেকে স্নান করিয়ে আনল। দুশ্চিন্তায়, উদ্বেগে ভাল করে ভাত খেতে পারল না সে। বোধ হয় এসব সামান্য খাবার খাওয়ার অভ্যাসও নেই।
দুপুরে হরিপদ ফিরে ঘরে অতিথি দেখে অবাক। তবে অলঙ্কার যা ভয় করছিল তা কিন্তু হল না। হরিপদ রেগেও গেলেন না, বিরক্তও হলেন না। আবার যে খুশি হলেন, তাও নয়। অধরা বললেন, “ও ছেলেটি সম্পর্কে সব বুঝিয়ে বলছি। তুমি আগে স্নান-খাওয়া করে নাও।”
হরিপদর স্নান-খাওয়া সারা হলে চারজন গোল হয়ে বসল। ইন্দ্র খুব নিচু গলায় বলতে শুরু করল, “আমার নাম ইন্দ্রজিৎ রায়। আমি খুব শিশুকালে আমার মা বাবার সঙ্গে বিদেশে চলে গিয়েছিলাম। এখন আমি লন্ডনের এক মস্ত লাইব্রেরিতে চাকরি করি। আমার কাজ হল পুরনো পুঁথিপত্র সংরক্ষণ এবং সেগুলোর মাইক্রোফিল্ম তুলে রাখা। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে নানা ভাষার পুঁথি,দলিল-দস্তাবেজ বা চিঠিপত্র আমাদের লাইব্রেরি সংগ্রহ করে রাখে। তার মধ্যে বাংলাভাষার পুঁথিও অনেক আছে। একদিন হঠাৎ একটি পুঁথির মাইক্রোফিল্ম করতে গিয়ে আমি একটা মজার জিনিস লক্ষ করি। পুঁথিটা পদ্যে লেখা এক দিশি বাঙালি রাজার জীবনী। মজার জিনিস হচ্ছে রাজার গুণাবলী সম্পর্কে বাড়াবাড়ি সব বিবরণ। রাজা নাকি সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর। তিনি নাকি সশরীরে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে অনায়াসে যাতায়াত করে থাকেন। তাঁর নাকি পক্ষিরাজ ঘোড়া এবং পুষ্পক রথও আছে। তাঁর ওপর মা লক্ষ্মীর নাকি এমনই দয়া যে, রোজ নিশুতরাতে একটা প্যাচা নাকি আকাশ থেকে উড়ে এসে রাজবাড়ির ছাদে একটি করে সোনার টাকা ফেলে যেত, রাজা ভোরবেলা ছাদে গিয়ে সেটা কুড়িয়ে আনতেন। বোধ হয় রাজার কোনও চাটুকার সভাসদ জীবনীটা লেখেন। লেখকের নাম চন্দ্রকুমার। আর রাজার নাম মহেন্দ্রপ্রতাপ। আপনারা কি শুনেছেন এঁর নাম? প্রায় দেড়শো বছর আগে শিমুলগড়ের দক্ষিণে রায়দিঘিতে তাঁর রাজত্ব ছিল।”
হরিপদ সচকিত হয়ে বলেন, “শুনব না কেন? বাপ-পিতামহের কাছে ঢের শুনেছি। ওই সোনার টাকার কথাও এ-অঞ্চলের সবাই জানে। তবে রাজাগজার গল্পে অনেক জল মেশানো থাকে। কেউ বিশ্বাস করে; আবার কেউ করে না।”
ইন্দ্র মাথা নেড়ে বলে, “ঠিকই বলেছেন। আমিও তাই পুঁথিটাকে প্রথমে গুরুত্ব দিইনি। তবে পুঁথির শেষদিকে কয়েকটা অদ্ভুত ধরনের ছড়া ছিল। অনেকটা ধাঁধার মতো। আমার মনে হল, সেগুলো কোনও সঙ্কেতবাক্য। পুরনো পুঁথিপত্র থেকে সঙ্কেতবাক্য উদ্ধার করার একটা নেশা আমার আছে। সেই ছড়াগুলো নাড়াচাড়া করে বুঝলাম, চন্দ্রকুমার চাটুকার হলেও অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক এবং ভাষার ওপর তাঁর দখলও চমৎকার। আমি দু দিন-দু রাত্তির ধরে সেইসব ছড়ার অর্থ উদ্ধার করে দেখলাম, রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের আসল চরিত্র কীরকম সেসব কথা চন্দ্রকুমার খুব সাবধানে প্রকাশ করেছেন। মহেন্দ্রপ্রতাপ অত্যন্ত অত্যাচারী রাজা, ইংরেজের খয়ের খাঁ, প্রজারা তাঁকে মোটেই পছন্দ করে না। রাজা অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতিরও ছিলেন। মহেন্দ্রপ্রতাপের প্রপিতামহ প্রাসাদের নীচে শ’খানেক গুপ্ত প্রকোষ্ঠ তৈরি করিয়ে রেখেছিলেন। এই প্রকোষ্ঠগুলো আসলে ভুলভুলাইয়া বা গোলকধাঁধা। রাজ্য আক্রান্ত হলে লুকিয়ে থাকার জন্য এবং মূল্যবান ধনসম্পত্তি নিরাপদে রাখার জন্যই সেগুলো তৈরি করা হয়েছিল। সে নাকি এমন গোলকধাঁধা যে, একবার সেখানে ঢুকলে বেরিয়ে আসা ছিল সাঙ্ঘাতিক কঠিন। সেই পাতালপুরী কতটা নিরাপদ তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য মহেন্দ্রপ্রতাপ নাকি মাঝেমধ্যে এক-আধজন দাস বা দাসীকে সেখানে নামিয়ে দিতেন। তাদের কেউই শেষ অবধি বেরিয়ে আসতে পারত না। মাটির নীচে বেভুল ঘুরে-ঘুরে ক্লান্ত হয়ে খিদে-তেষ্টায় মরে পড়ে থাকত। সেইসব মৃতদেহ উদ্ধার বা সৎকার করা হত না। সেইসব দাস-দাসীর প্রেতাত্মারা যখ হয়ে গুপ্তধন পাহারা দিত। পুঁথির শেষে গুপ্তধনের হদিসও চন্দ্রকুমার দিয়েছেন। দিয়ে বলেছেন, রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ অত্যন্ত কৃপণ, কুটিল, বায়ুগ্রস্ত ও সন্দেহপ্রবণ। রাজার নির্দেশেই চন্দ্রকুমার গুপ্তধনের নির্দেশ লিখে রাখছেন বটে, কিন্তু তাঁর একটা ভয় হচ্ছে। ভয় হল, রাজা যদি গুপ্তধনের সঠিক নির্দেশই চন্দ্রকুমারকে দিয়ে থাকেন, তা হলে খবরটা যাতে গোপন থাকে তার জন্য তিনি চন্দ্রকুমারকে অবশ্যই হত্যা করবেন। আর যদি ইচ্ছে করেই ভুল নির্দেশ দিয়ে থাকেন তা হলে চন্দ্রকুমার বেঁচে যাবেন। চন্দ্রকুমারের বিবরণ থেকে জানা যায়, রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের মোহর জমানোর নেশা ছিল। পৃথিবীর নানা জায়গার মোহর তিনি সংগ্রহ করতেন। অনেক দুষ্প্রাপ্য মোহরও তার মধ্যে ছিল। সেইসব ঐতিহাসিক মোহরের দাম শুধু সোনার দামে নয়।
ঐতিহাসিক মূল্য ধরলে এক-একটার দামই লাখ-লাখ টাকা। যদি কোনও বোকা লোকের হাতে সেগুলো যায় তবে সে আহাম্মকের মতো তা সোনার দরে ছেড়ে দেবে বা গলিয়ে ফেলবে। সেক্ষেত্রে অনেক মূল্যবান তথ্য আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন। সেই ভয়ে আমি পুঁথিটার শেষ অংশটা কপি করে নিয়ে খুব তাড়াহুড়ো করে ভারতবর্ষে চলে আসি। এদেশ সম্পর্কে আমার তেমন কিছুই জানা নেই।”
হরিপদ, অধরা আর অলঙ্কার সম্মোহিত হয়ে শুনছিল। হঠাৎ হরিপদ একটু গলাখাকারি দিয়ে বললেন, “শুনেছি আমাদের বংশের কে একজন যেন মহেন্দ্রপ্রতাপের দরবারে স্বর্ণকারের কাজ করতেন। নামটা বোধ হয় নকুড়।”
ইন্দ্র একটু অবাক হয়ে বলে, “হ্যাঁ, নকুড় কর্মকার মোহরের ব্যাপারে খুব জানবুঝদার লোক ছিলেন। বণিক বা দালালরা যেসব মোহর নিয়ে আসত তা নকুড় কর্মকার পরীক্ষা করে দেখে কিনতে বললেই রাজা কিনতেন।”
অলঙ্কার একটু ধৈর্য হারিয়ে বলল, “তারপর ইন্দ্রদা?”
ইন্দ্রর চেহারাটা এখন আর তেমন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে না। পেটের কথা খোলসা করে বলতে পেরে তার মুখে একটা রক্তাভা এসেছে। সে একটু চিন্তা করে বলল, “লন্ডন থেকে রওনা হওয়ার আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল। সেটা আপাতত উহ্য থাক। কিন্তু এদেশে পা দিয়েই আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা হচ্ছিল। আমি শুনেছি এদেশের সরকার খুব ঢিলাঢালা, কোনও কাজেই তাদের গা নেই। তাই আমি গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপারে তাদের অনুমতি চাইনি। এসব ব্যাপারে এদেশে বেসরকারি উদ্যোগেই কাজ চটপট হয়। আমি আমার পোর্টেবল তাঁবু আর যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিলাম লন্ডন থেকেই। দু-একজন বিশ্বস্ত সাহায্যকারী খুঁজতে গিয়ে নাজেহাল হতে হয়েছে। একগাদা ফড়ে আর দালাল পেছনে লাগল। যাই হোক, কোনওরকমে তাদের চোখে ধুলো দিয়ে আমি একাই শেষ অবধি রায়দিঘিতে হাজির হই। কিন্তু কলকাতা থেকে রওনা হওয়ার একটু পরেই আমার মনে হচ্ছিল, কেউ যেন আমার পিছু নিয়েছে। সারাক্ষণ নজর রাখছে আমাকে। খুব অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করি। রায়দিঘিতে এসে দেখি, রাজপ্রাসাদ বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা জংলা জায়গা। সাপখোপের বাসা। মাঝখানে একটা ধ্বংসস্তূপ। কাছেপিঠে লোকালয় বলতে এই শিমুলগড়, তা সেটাও দেড় মাইল দূরে। আমি খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে নিয়ে ক্যাম্প খাঁটিয়ে আমার কাজ শুরু করলাম। প্রথম, জায়গাটা মাপজোখ করা এবং নিশানা ঠিক করা। প্রাসাদের যা অবস্থা তাতে মাটির নীচের সব প্রকোষ্ঠই ভেঙে ধসে গেছে। সুতরাং ভুলভুলাইয়ার পথ ধরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু চন্দ্রকুমারের বিবরণে সেই পথের কথাই আছে। ফলে আমার কাজ বহুগুণ বেড়ে গেল। চন্দ্রকুমার একটা জয়স্তম্ভের কথা বলেছেন। তার নীচের প্রকোষ্ঠেই মোহর থাকার কথা। কিন্তু জয়স্তম্ভ যে কোথায় ছিল তা কে জানে। সারাদিন মাপজোখ আর খোঁড়াখুঁড়িতে অমানুষিক পরিশ্রম যাচ্ছে। তার চেয়েও ভয়ের কথা, চন্দ্রকুমারকে যদি রাজা ইচ্ছে করেই ভুল নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তা হলে আমার গোটা পরিশ্রমই পণ্ডশ্রম হবে। জল এবং খাবারের বেশ অভাব হচ্ছিল। কাজ করতে করতে খাওয়ার কথা মনেও থাকত না। অনিয়মে এবং এদেশের জলে আমার পেট খারাপ হল, শরীর ভেঙে যেতে লাগল। আমি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। যে কথাটা এতক্ষণ বলিনি সেটা হল, রায়দিঘিতে ক্যাম্পে থাকার সময় আমার কিন্তু সারাক্ষণই মনে হত, আমি ঠিক একা নই। কেউ যেন আড়াল থেকে আমার ওপর নজর রাখছে। রাত্রিবেলা আমি তাঁবুর আশেপাশে পায়ের শব্দ পেতাম যেন। উঠে টর্চ জ্বেলে, কাউকে দেখতে পেতাম না! যখন অসুস্থ হয়ে পড়লাম তখন একদিন জ্বরের ঘোরের মধ্যে শুনতে পেলাম, কে যেন বলছে, নিমগাছে যে গুলঞ্চ হয়ে আছে সেটা চিবিয়ে খেলে সেরে যাবে।
“আশ্চর্যের বিষয়, পরদিন সত্যিই নিম-গুলঞ্চ খেয়ে শরীর অনেকটা সুস্থ হল। তারপর আরও দু’দিন দু’রকম পাতার নাম শুনলাম, কুলেখাড়া আর থানকুনি। কোথায় আছে তাও বলে দিল। খেয়ে আরও একটু উপকার হল। কিন্তু, কথা হল, লোকটা কে? তার মতলবটাই বা কী। একদিন নিশুতরাতে তার আগমন টের পেয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কে? জবাবে সে বলল, “আমি ছায়াময়।”
অলঙ্কার অবাক হয়ে বলে, “ছায়াময়? আরে, আজ সকালে তো ছায়াময়ই আমাকে বলল, বাঁশঝাড়ের পেছনের জঙ্গলে একটা জিনিস পাবে! আমি গিয়ে আপনাকে দেখতে পেলাম।”
ইন্দ্র মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বলে, “তা হলে বলতেই হবে, সে যদি মানুষ হয়, তবে খুব মহৎ মানুষ, আর যদি ভূত হয়, তবে খুব উপকারী ভূত।”
“তারপর বলুন।”
“দিন কুড়ি দিনরাত খেটে অবশেষে বিজয়স্তম্ভের একটা আভাস পেলাম। পাওয়ার ড্রিল দিয়ে গর্ত করে ভেতরে আলো ফেলে গর্ভগৃহ পাওয়া গেল। সেখানে ধুলোময়লা, রাবিশের ভূপ। কোনওরকমে ফোকটা বড় করে নীচে নেমে বিস্তর ময়লা সরিয়ে তবে পেতলের কলসিটা পাওয়া গেল। মোহর সমেত।”
অধরা কথার মাঝখানে বলে ওঠেন, “বাবা ইন্দ্র তোমার গলা শুকিয়ে গেছে, একটু ঠাণ্ডা জল খেয়ে নাও।”
জল খেয়ে ইন্দ্র বলল, “অনেক মেহনত করে বিকেলে সেই কলসিটা ওপরে তুলে আনলাম। তাঁবুতে এনে মোহর বের করে দেখলাম, সত্যিই অমূল্য সব মোহর। পাঁচ-সাতটা তো খুবই দুষ্প্রাপ্য। মোহরগুলো দেখে আমি এমন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলাম যে, চারদিকে চাইবার মতো অবস্থাও নয়। এক-এক করে গুনে দেখলাম মোট দুশো এগারোখানা আছে। আমার হিসাবে কয়েক কোটি টাকার সম্পদ। গুনে যখন শেষ। করেছি, তখন হঠাৎ তাঁবুর দরজা থেকে একটা মোলায়েম গলা বলে উঠল, “হ্যাঁ, দুশো এগারোখানাই আছে।’ চমকে তাকিয়ে দেখি, শূল হাতে দাড়ি-গোঁফওয়ালা এক বিশাল মূর্তি। চোখ দুখানা জুলজুল করছে, মুখে একখানা বাঁকা হাসি। পরনে টকটকে লাল রঙের একটা পোশাক। তাকে দেখে প্রথমটায় ভীষণ চমকে গেলেও টপ করে সামলেও নিলাম। তা হলে এই লোকটাই ছায়াময়! এইই আড়াল থেকে আমার গতিবিধি নজরে রাখছিল এবং আমার কিছু উপকারও করেছে। কিন্তু আসল সময়ে ঠিক এসে হাজির হয়েছে সশরীরে! আমি যখন মোহরগুলো একটা চামড়ার ব্যাগে পুরছিলাম, লোকটা হাত বাড়িয়ে বলল, “দিয়ে দে, দিয়ে দে, ও মায়ের জিনিস, মায়ের কাছেই থাকবে। তুই কেন পাপের ভাগি হতে যাস? লোকটা যে জালি তাতে সন্দেহ নেই। আমি হঠাৎ উঠে লোকটাকে একটা ঘুসি মারলাম। বিদেশে আমি বকসিং-টসিং করেছি বটে, কিন্তু এখন না খেয়ে অসুখে ভুগে আমার শরীর খুব দুর্বল। কিন্তু এদেশের লোকের সাধারণ স্বাস্থ্য ও সহ্যশক্তি এতই খারাপ যে, আমার সেই দুর্বল ঘুসিতেই লোকটা ঘুরে পড়ে গেল। আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বেরিয়ে দেখি, একটু দূরে আরও একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। বোধ হয় কাপালিকের চেলা।
সে আমাকে দেখে তেড়ে এল। আমি বিপদ বুঝে জঙ্গলে ঢুকে গা-ঢাকা দিলাম। একটু অন্ধকার হতেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে অনেক কষ্টে শিমুলগড় পৌঁছই। গায়ে তখন একরত্তি শক্তি নেই, খিদেয়-তেষ্টায় ভেতরটা কাঠ হয়ে আছে। কারও বাড়িতে আশ্রয় চাইতে আমার সাহস হল না। কে কেমন লোক কে জানে! অত মোহর নিয়ে কোনও বিপদের মধ্যে পা বাড়ানো ঠিক নয়। আমি একটা আমবাগানে ঢুকে সেখানেই রাতটা কাটিয়ে ভোরবেলা আমার কর্তব্য ভেবে দেখব বলে ঠিক করলাম। কিন্তু কপাল খারাপ। যখন একটা গাছতলায় বসে গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছি, তখনই কয়েকটা কুকুর তেড়ে এল। অগত্যা গাছে উঠলাম। পাশেই একটা বাড়ি। গাছের একটা মোটা ডাল বাড়ির দেওয়ালের ওপাশে ঝুঁকে পড়েছে, ভেতরে একটা খড়ের গাদা। ভাবলাম যদি খড়ের গাদায় লাফিয়ে পড়তে পারি, তা হলে আরামে রাতটা কাটানো যাবে। কিন্তু যেদিন ভাগ্য মন্দ হয় সেদিন সব ব্যাপারেই বাধা আসে। খড়ের গাদায় লাফিয়ে নামতেই কুকুর আর দরোয়ানের তাড়া খেয়ে একটা ঘরে ঢুকলাম। একদম ইঁদুরকলে ধরা পড়ে যেতে হল। মোহর গেল, মার খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। আর কিছু মনে নেই। সকালে অলঙ্কার গিয়ে আমাকে নিয়ে আসে।”
হরিপদ মাথা নেড়ে বলেন, “তা হলে এই হল ব্যাপার! গগন সাঁপুই যা রটাচ্ছে তা যে সত্যি নয়, তা আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। চোর নাকি তার যথাসর্বস্ব নিয়ে পালাচ্ছিল। ওবাড়িতে চোরের চৌদ্দ পুরুষের সাধ্যি নেই যে সেঁধোয়। কুকুর, দরোয়ান, তিনটে জোয়ান ছেলে, লোকলস্কর তো আছেই, তার ওপর তার দরজা-জানলা সব কেল্লার মতো মজবুত, এই পুরু ইস্পাতের সিন্দুক। এ-তল্লাটের কোনও চোর ও বাড়িতে নাক গলাবে না। আর আমার যখন ডাক পড়েছে তখন সন্দেহ নেই গগন বাটপাড়ি করা সোনা তাড়াতাড়ি গলিয়ে ফেলতে চাইছে।”
ইন্দ্র ফ্যাকাসে মুখে বলে, “তা হলে সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হয়ে যাবে। যেমন করেই হোক ওই মোহর রক্ষা করা দরকার। পৃথিবীর বহু মিউজিয়াম এবং সংগ্রহশালা ওসব মোহর লুফে নেবে।”
অলঙ্কার বলল, “আচ্ছা, পুলিশে জানালে কেমন হয়?”
ইন্দ্র ম্লানমুখে বলে, “আমি সরকারি অনুমতি ছাড়াই খোঁড়াখুঁড়ি করেছি, তাই আইন বোধ হয় আমার পক্ষে নেই।”
হরিপদও মাথা নেড়ে বলে, “তা ছাড়া পুলিশের সঙ্গেও গগনের সাঁট আছে। মোহরও এতক্ষণে গোপন জায়গায় হাপিস হয়ে গেছে। পুলিশ ইচ্ছে করলেও কিছু করতে পারবে না।”
ইন্দ্ৰ করুণ স্বরে বলে, “তা হলে?”
হরিপদ উঠে গায়ে জামা চড়াতে-চড়াতে বলে, “আমি গগনের বাড়ি যাচ্ছি। একমাত্র আমাকেই সে মোহরগুলো বার করে দেখাবে। চোরাই মোহর যত তাড়াতাড়ি গলিয়ে ফেলা যায় ততই তার পক্ষে নিরাপদ। তবে তুমি ভেবো না ইন্দ্র। মোহর যাতে না গলানো হয় সে-চেষ্টা আমি করব। আর-একটা কথা, তোমাকে কিন্তু একটু গা-ঢাকা দিয়েই থাকতে হবে। গাঁয়ের পাঁচজন যেন দেখতে না পায়। দেখলে একটা শোরগোল হবে। আর গগনের কানে গেলে সে হয়তো তার দুই ভাড়াটে খুনে কালু আর পীতাম্বরকে লেলিয়ে দেবে।”
“তারা কারা?”
“তারা এ-গাঁয়ের লোক নয়। নিকুঞ্জপুরে থাকে। সেখানে গিয়েই গোপন খবরটা পেলুম। এরা পয়সা পেলে নানা কুকর্ম করে দেয়। আগে গগন কখনও তাদের ডাকেনি। আজই হঠাৎ শুনলুম, কালু আর পীতাম্বরকে নাকি ডাকিয়ে এনেছে গগন। কেন কে জানে! তবে তুমি সশরীরে এ-গাঁয়ে আছ জানলে গগন আর ঝুঁকি নেবে না। তার ওপর গাঁয়ের লোকের কাছে তুমি চোর বলে প্রতিপন্ন হয়েই আছ। তোমার এখন চারদিকে বিপদ।”
“তাই দেখছি।” বলে ইন্দ্র বিষণ্ণ মুখে বসে রইল। তারপর শুকনো মুখে বলল, “নিজের বিপদ নিয়ে আমি তো ভাবছি না। মোহরগুলো নষ্ট না হলেই হল।”
হরিপদ একটু হেসে বলে, “ও-মোহরের ওপর আমারও একটু দরদ আছে হে। নকুড় কর্মকারের নামটা যখন জড়িয়ে আছে তখন ওবস্তু নিয়ে হেলাফেলা করার উপায় আমার নেই। তবে কতটা কী করতে পারব তা ভগবান জানেন।”
ইন্দ্র বলে, “মোহরগুলো যে গগনের নয়, ওটা যে আমি রায়দিঘি রাজবাড়ি থেকে উদ্ধার করেছি, তার কিন্তু একজন সাক্ষী আছে। সে ওই কাপালিক।”
হরিপদ একটু হেসে বলে, “সেও মহা ধুরন্ধর লোক। তার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। দুটো টাকা হাতে দিয়ে যদি তাকে বলতে বলো যে, সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠে, তো সে তাই বলবে। ওসব লোকের কথার কোনও দাম নেই।”
“তবু আমি তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।”
“সেটা পরে ভেবে দেখা যাবে।”
হরিপদ বেরিয়ে যাওয়ার পর অধরা বলল, “দুপুরে তো কিছুই খাওনি বাবা। ভাত নিয়ে শুধু নাড়াচাড়া করেছ। একটু সাগু ভিজিয়ে রেখেছি, গাছের পাকা মর্তমান কলা আর মধু দিয়ে খাবে?”
ইন্দ্র একটু হেসে বলল, “দিন।”
সাগুর ফলার তার খুব খারাপ লাগল না।
খাওয়াদাওয়ার পর ইন্দ্র অলঙ্কারকে বলল, “আমাকে একটা ছদ্মবেশের ব্যবস্থা করে দিতে পারো? একটু বেরনো দরকার। হাত গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকা অসম্ভব।”
অলঙ্কার একটু ভেবে বলে, “আপনি তো বাবার একটা লুঙ্গি পরে আছেন। গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে নিলে চাষিবাসির মতো লাগবে। তবে আপনার রংটা তো ফরসা, একটু ভূযো কালি মেখে নিলে হয়ে যাবে।”
“মন্দ বলোনি। সহজ-সরল ছদ্মবেশই ভাল। নকল দাড়ি-গোঁফ লাগালে লোকের সন্দেহ হতে পারে।”
মতলব শুনে অধরা প্রথমটায় বারণ করলেও পরে বললেন, “তা হলে অলঙ্কারকেও সঙ্গে নাও বাবা। ও তো গাঁ চেনে। বিপদ হলে খবরটা দিতে পারবে।”