Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রবিন জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়েছিল। এখন তার খুব মন খারাপ, যখন তার খুব মন খারাপ হয় তখন সে এভাবে জানালায় গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রবিনের বয়স মাত্র বারো। বারো বছরের বাচ্চার খুব বেশি মন খারাপ হবার কথা না, কিন্তু রবিনের প্রায়ই মন খারাপ হয়। কেন তার মন খারাপ হয় সেটা সে খুব ভালো করে জানে কিন্তু সেটা সে কাউকে বলতে পারবে না। যখন ছোট ছিল তখন বলতো আর তার আব্বু-আম্মু ভয় পেয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। ডাক্তার তাকে কী ওষুধ দিয়েছিল কে জানে, তখন সে সবকিছু ভুলে গিয়ে শুধু ঘুমাতো। তার কিছু মনে থাকতো না, সবকিছু কেমন যেন আবছা দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে যেত। তাই সে এখন কাউকে কিছু বলে না, যেটা ঘটে সেটা সে সহ্য করে নিজের ভেতর চেপে রাখে। রবিন জানে সে অন্যরকম, কেন সে অন্যরকম সেই কথাটাও সে কখনো কাউকে বলতে পারবে না। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে সে নিশ্চয়ই এতদিনে পাগল হয়ে যেত, রবিন পাগল হয়নি। সে সবকিছু সহ্য করে, একা একা সহ্য করতে গিয়ে তার শুধু মন খারাপ হয়।

রবিন অন্যমনস্কভাবে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা ফেরিওয়ালার দিকে তাকিয়েছিল। ঠিক তখন সে শুনতে পেল কেউ যেন স্পষ্ট স্বরে বলল, “কী খোকা? তোমার খুব মন খারাপ?”

রবিন না হয়ে অন্য কেউ হলে চমকে উঠে এদিক-সেদিক তাকাতো, কাউকে না দেখে ভয়ে-আতঙ্কে অস্থির হয়ে যেত। রবিন এদিক-সেদিক তাকাল না শুধু একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এটাই হচ্ছে তার সমস্যা, সে মানুষজনের কথা শুনতে পায়, মাঝে মাঝে মানুষজনকে দেখতেও পায়। ভয়ংকর ভয়ংকর মানুষ ভয়ংকর তাদের কথাবার্তা। কেন সে তাদের দেখে, তাদের কথা শুনে সে বুঝতে পারে না।

“খোকা। কথা বলছ না কেন? তোমার কী মন খারাপ?”

রবিন এবারে একটু অবাক হলো। সে যাদের কথা শুনে তাদের কথা সাধারণত প্রলাপের মতো, ভীত-আতঙ্কিত মানুষের আর্তনাদের মতো। যাদের দেখতে পায় তারাও সেরকম, মাথা থেঁতলে যাওয়া, রক্তে ভেসে যাওয়া, পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া মানুষ। তারা তার সাথে কথা বলে না ভয়ে ছোটাছুটি করে, চিৎকার করে কাঁদে। কিন্তু এখন সে যার কথা শুনছে সে ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করছে না, তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করছে। রবিন একটু অবাক হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, কে তার সাথে কথা বলতে চাইছে তাকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করল। আশেপাশে কেউ নেই, সামনে একটা রাস্তা, রাস্তা দিয়ে লোকজন যাচ্ছে-আসছে। সবাই স্বাভাবিক মানুষ, কোথাও কোনো অস্বাভাবিক মানুষ নেই।

“খোকা! তুমি আমার কথা শুনছ না?”

রবিন বুঝতে পারল না সে প্রশ্নের উত্তর দেবে কী না। এর আগে কেউ তাকে কখনো এভাবে প্রশ্ন করেনি।

“কথা বলো আমার সাথে। তোমার কোনো ভয় নেই।”

রবিন ফিসফিস করে বলল, “কে? কে কথা বলে?”

“আমি। আমাকে তুমি চিনবে না খোকা। আমি ঠিক তোমার মতো একজন!”

“আমার মতো একজন?”

“হ্যাঁ। তোমার মতো একজন। তুমি যে রকম অনেক রকম কথা শোনো অনেক মানুষকে দেখো আমিও সেরকম।”

রবিন এবারে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথায়?”

“এই তো রাস্তায়। একজন বুড়ো ফেরিওয়ালা দেখছ?”

“হ্যাঁ দেখছি।”

“একটা লুঙ্গি আর সবুজ রঙের শার্ট? ঘাড়ে গামছা। আমি সেই মানুষ। আমাকে দেখছ?”

“হ্যাঁ দেখছি। আপনি এখন হাত নাড়ছেন?”

“হ্যাঁ বাবা, আমি হাত নাড়ছি। তুমি কোথায়? আমি জানি তুমি আছ আশেপাশে, কিন্তু আমি তোমায় দেখছি না।”

“আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। লাল বিল্ডিংটার তিন তালায়। আমিও এখন হাত নাড়ছি।”

“হ্যাঁ! হ্যাঁ। এখন তোমাকে দেখছি। অনেক দূর তো, তাই ভালো করে দেখা যায় না, তার ওপর বয়স হয়েছে তো তাই। সবকিছু ঝাপসা দেখি।”

রবিন প্রথমবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে, চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি কেমন করে আমার সাথে কথা বলছেন?”

“আমরা পারি বাবা। দশ লাখ বিশ লাখে আমাদের মতো একজন দুজন মানুষের জন্ম হয় যারা এগুলো পারে। তুমি যে রকম আমি সেরকম। আমরা অনেক কিছু দেখি, অনেক কিছু শুনি যেটা অন্যেরা দেখে না, শুনে না।”

রবিন একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তাহলে পাগল না?”

মানুষটি হাসল, বলল, “ছিঃ বাবা! পাগল কেন হবে! এটা তোমারে দেওয়া আল্লাহর একটা ক্ষমতা।”

“আমি চাই না এই ক্ষমতা। কচু ক্ষমতা!”

“ছিঃ বাবা। এভাবে বলে না। আল্লাহ্র দেয়া ক্ষমতারে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে আল্লাহ্ নারাজ হবেন।”

“কিন্তু আমার যে ভয় করে–”

“তোমার কোনো ভয় নাই বাবা। আমাদের চারপাশে সব সময় এগুলো হচ্ছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ একজন মানুষ এখন আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে-দেখছ?”

“হ্যাঁ দেখছি। রক্তেভেজা–”

“মানুষটা দুই রাস্তা পরে একসিডেন্টে মারা গেছে। মানুষটা জানে না সে মরে গেছে। সে ছুটতে ছুটতে বাড়িতে যাচ্ছে-তার আশেপাশে আরো কয়েকজন মানুষ দেখেছে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। দেখেছ? এই রকম অনেক কিছু হয় চারপাশে। সাধারণ মানুষ এইগুলো দেখে না। এইগুলো বুঝে না। আমরা দেখি, বুঝি। এইটা আমাদের একটা ক্ষমতা।”

“কিন্তু ডাক্তার যে বলে অন্যকথা।”

মানুষটা আবার হাসল, বলল, “ডাক্তারেরা কী জানে? তারা তাদের পরিচিত রোগশোকের কথা জানে। তার বাইরে কিছু জানে তাছাড়া এইটা তো রোগ না বাবা। এইটা ক্ষমতা। রোগের চিকিৎসা হয়, ক্ষমতার চিকিৎসা হয় না।”

রবিন বলল, “আমি এই ক্ষমতা চাই না। এই ক্ষমতা নাই করে দেওয়া যায় না?

“সেইটা তো জানি না, বাবা। চেষ্টা করলে তো সবকিছুই হয়। তুমি যদি খুব চেষ্টা করো তাহলে হয়তো আস্তে আস্তে একসময় ক্ষমতাটা চলে যেতে পারে। মানুষটা সুর পাল্টে বলল, “কিন্তু তুমি কেন এই ক্ষমতাটা দিয়ে দিতে চাও?”

“সবাই ভাবে আমি পাগল। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। তাছাড়া আমার ভয় করে, ভয়ংকর ভয়ংকর মানুষ আসে চিৎকার করে আমারে ভয় দেখায়। আমি পড়তে পারি না ঘুমাতে

পারি না।”

“বাবা তোমারে আমি বলি। তুমি যাদের দেখে তারা হচ্ছে খুব দুঃখী। তারা খুব কষ্টে আছে। তাদের সাহায্যের দরকার, কেউ তাদের সাহায্য করতে পারে না। শুধু তোমার আর আমার মতো মানুষ ইচ্ছা করলে পারে আর কেউ তাদের সাহায্য করতে পারবে তুমি তো এখন ছোট, তোমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই, সেই জন্যে হয়তো কারো সাহায্য করো নাই। যখন আস্তে আস্তে বড় হবে, অভিজ্ঞতা হবে তখন দেখবে তুমিও তাদের সাহায্য করতে পারবে।”

“না-না আমি পারব না। আমি সাহায্য করতে চাই না। আমি কিছু করতে চাই না।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে বাবা। তুমি যদি না চাও, তাহলে তোমার সাহায্য করতে হবে না। কিন্তু দেখবে, একদিন যখন বড় হবে কারো কষ্ট দেখে তুমি নিজে থেকেই সাহায্য করতে যাবে।”

“না! যাব না।” রবিন কাদো কাদো হয়ে বলল, “আমি কিছু করতে চাই না।”

“ঠিক আছে বাবা, তোমারে কিছু করতে হবে না। শুধু তোমারে একটা কথা বলি।”

“কি কথা?”

“তুমি এই ব্যাপারটা নিয়ে ভয় পাবা না। মন খারাপ করবা না। আমি জানি এইটা স্বাভাবিক ব্যাপার না, কিন্তু এইটা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নাই। তুমি মন খারাপ করবা না ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“আমি এখন যাই বাবা? আমার খুব তাড়া আছে। একজন মানুষ খুব বিপদে পড়েছে, তারে সাহায্য করতে যাচ্ছি।”

“কী বিপদ?”

“খুব বড় বিপদ। মানুষ বেঁচে থাকতে যে রকম বিপদ হয়, মরে যাবার পরেও বিপদ হয়। এই কালে যে রকম জন্তু-জানোয়ার আছে, পরকালেও সেই রকম জন্তু-জানোয়ার-দানব আছে। তারা অনেক সমস্যা করে। তারা বেঁচে থাকার সময় বিপদে পড়লে তারে সাহায্য করা যায়। মরে যাবার পরে তারে অন্য কেউ সাহায্য করতে পারে না– শুধু আমরা চাইলে পারি।”

“ও।”

“যাই বাবা?”

“ঠিক আছে।”

“তোমার নামটা তো জিজ্ঞেস করলাম না।”

“আমার নাম রবিন।”

“যাইগো রবিন।”

রবিন দেখল তার দিকে হাত নেড়ে বুড়ো মতোন ফেরিওয়ালাটা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। সে অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটার সাথে তার যে কথাটা হয়েছে সেটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই কী সে শুনেছে নাকি পুরোটা তার কল্পনা? তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আসলে সে পাগল না, সে যেটা দেখে যেটা শুনে সেটা সত্যি, অন্যেরা সেটা শুনতে পায় না দেখতে পায় না সেটা হচ্ছে পার্থক্য। রাত্রিবেলা খাবার টেবিলে আম্মু একটু অবাক হয়ে লক্ষ করলেন রবিন আজ বেশ হাসিখুশি। তার অন্য দুই ছেলেমেয়ে থেকে এই ছেলেটি ভিন্ন, এ বয়সেই সে বড়দের মতো গম্ভীর। কথাবার্তা বলে খুব কম, সব সময়ই মনে হয় কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছে। আজকে তাকে একটু হাসিখুশি দেখে আম্মুরও ভালো লাগল, হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে রবিন? তোর আজকে খুব স্ফুর্তি মনে হচ্ছে?”

রবিন কোনো কথা না বলে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

“কী নিয়ে এত স্মৃর্তি? কিছু হয়েছে নাকি?”

রবিন মাথা নাড়ল, বলল, “না আম্মু কিছু হয় নাই।”

বড় বোন ঈশিতা বলল, “কিছু হলে তোমাকে রবিন বলবে না কি? রবিন যদি লটারিতে দশ লাখ টাকা পায় তাহলেও মুখটা এমন করে রাখবে যেন কিছু হয় নাই।”

ছোট ভাই লিটন বলল, “কেন আপু? কেন মুখটা এরকম রাখবে?”

ঈশিতা বলল, “দেখিস না রবিন গুনে গুনে কথা বলে।” আব্বু বললেন, “কেন আমার ছেলেটাকে জ্বালাতন করছিস?

ঈশিতা বলল, “আমি মোটেও জ্বালাতন করছি না। সত্যি কথা বলছি।”

আম্মু বললেন, “যাক এত সত্যি কথা বলতে হবে না।” ঈশিতা বলল, “আসলে কী হয়েছে জানো?”

“কী?”

“রবিনের বয়স আসলে বাহাত্তর। ভুলে সে দশ বছরের ছেলের শরীরে আটকা পড়ে গেছে। তাই না রে রবিন?”

রবিন দাঁত বের করে হেসে বলল, “আর তোমার বয়স আসলে পাঁচ। ভুল করে ষোলো বছরের মেয়ের শরীরে আটকা পড়ে গেছ।”

রবিনের কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল! ছেলেটা খুব কম কথা বলে, কিছু একটা বলে হাসাহাসি করলে সবাই অল্পতেই খুশি হয়ে ওঠে।

রবিন আর লিটন এক ঘরে ঘুমায়, ঈশিতা অন্য ঘরে। লিটন ঘুমকাতুরে ছেলে, একটু রাত হলেই সে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়। রবিনের বেলায় ঠিক তার উল্টো, যত রাত হতে থাকে ততই সে যেন জেগে ওঠে। সেজন্যে রবিনকে অবিশ্যি দোষ দেয়া যায় না, রাত যত গম্ভীর হতে থাকে সে ততই বিচিত্র কথাবার্তা শুনতে থাকে, মাঝে মাঝে বিচিত্র মানুষকে দেখতে পায়। সে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে, চাদরের নিচে মাথা ঢেকে সে গভীর রাত পর্যন্ত ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

আজ রাতে সে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। আম্মু মশারি খুঁজে দিয়ে লাইট নিভিয়ে চলে যাবার পর রবিন তার বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে লিটনকে ডাকল, লিটন।”

“কী?”

“ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

“না।”

“আচ্ছা লিটন তুই কী কখনো ঘুমের মাঝে কারো কথা শুনতে পাস।”

লিটন মাথা নাড়ল, “নাহ্।”

“তুই কী কখনো ভয়ের স্বপ্ন দেখিস?”

“সব সময় দেখি।”

“কী দেখিস?”

“কালকে দেখেছি একটা বাঘ আমার হাত কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলছে। এই মোটা বাঘ-যা ভয় লেগেছিল।”

রবিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ও।”

রবিন আরো কিছুক্ষণ হাঁটু মুড়ে বসে থেকে লিটনকে ডাকল, “লিটন।”

লিটন কোনো উত্তর দিল না। রবিন আবার ডাকল, “এই লিটন।”

লিটন ঘুম ঘুম গলায় বলল, “না।” তারপর পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল।

রবিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে, লিটনের ওপর তার একটু হিংসে হয়। সেও যদি তার মতো এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারতো তাহলে কী চমৎকারই না হতো।

রবিন হাঁটুতে মাথা রেখে নিঃশব্দে বসে থাকে। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার, জানালা দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে, মেঝেতে সেই আলোটা একটা বিচিত্র নকশার মতো তৈরি করেছে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখে ঘরের ভেতরে কোনো একজন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ংকর আতঙ্কে সে চাদর দিয়ে নিজের মাথা ঢেকে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

রবিন ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকাল, তারপর শুয়ে পড়ল। ঠিক যখন তার চোখে ঘুম নেমে আসছিল তখন সে রক্ত শীতল করে একটা আর্তনাদ শুনতে পেল। রবিন আতঙ্কে চমকে উঠে দুই হাতে নিজের কান বন্ধ করে শুয়ে থাকে। তারপরেও সেই আর্তনাদটি মিলিয়ে যায় না, রবিন স্পষ্ট শুনতে পায় একজন মানুষ গোঙাতে গোঙাতে চিৎকার করছে। রবিন আগে জানতো না সেগুলো কী, এখন সে জানে, এগুলো মৃত মানুষের চিৎকার। কেন তাকে তাদের চিৎকার শুনতে হবে? কেন? রবিন দুই হাত দিয়ে কান বন্ধ করে শুয়ে থেকে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

গভীর রাতে হঠাৎ রবিনের ঘুম ভেঙে গেল। সে শুনতে পেল চাপা স্বরে একজন মহিলা কথা বলছে, “সুমন। আমার সুমন। সুমন কোথায়?”

ঘুম ভেঙে রবিন পুরোপুরি জেগে ওঠে কিন্তু তবুও সে বিছানায় ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে।

“কোথায় সুমন? কোথায় গেলি বাবা?”

রবিনের মনে হয় একজন মা তার ছেলেকে খুঁজছে। এত রাতে তার ঘরে একটা মা কেন ছেলেকে খুঁজে? রবিন খুব সাবধানে চাদর থেকে মাথা বের করে তাকাল, ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটু অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে, আবছা আবছা বোঝা যায় সেটি একজন মহিলা। মহিলাটি ব্যাকুল গলায় বলল, “সুমন। বাবা আমার তুই কোথায়?”

তারপর মহিলাটি লিটনের বিছানার কাছে গিয়ে ডাকল, “ সুমন! বাবা সুমন।”

লিটন ঘুমের মাঝে অস্পষ্ট একটা শব্দ করে পাশ ফিরে শুলো, মহিলাটি তখন রবিনের বিছানার দিকে এগিয়ে আসে। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আসা এক চিলতে আলোতে মুহূর্তের জন্যে রবিন মহিলাটাকে দেখতে পেল, মাথার বাম পাশটি থেঁতলে গেছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মহিলাটি রবিনের বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়, মশারির ভেতরে তার মাথাটা ঢুকিয়ে রবিনের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে। এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে রবিন মহিলাটির নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়, তার সাথে একধরনের কটু গন্ধ। মহিলাটি বলল, “সুমন। বাবা সুমন।”

রবিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে, মহিলাটি কাতর গলায় আবার বলল, “সুমন। তুই কোথায় গেলি? কথা বলিস না কেন?”

রবিন ফিসফিস করে নিজেকে বলল, “আমি ভয় পাব না। কিছুতেই ভয় পাব না। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেই চলে যাবে।”

মহিলাটি কিন্তু চলে গেল না, বলল, “বাবা সুমন। তুই কোথায় গেলি?”

রবিন বিড়বিড় করে বলল, “এখানে নাই।”

“নাই এখানে?”

রবিনের বুক ধক ধক করতে থাকে, চাপা গলায় বলল, “না। এখানে নাই।”

“তাহলে সে কোথায় গেল?”

“আমি জানি না। আপনি-আপনি–”

আমি কী?”

“আপনি অন্য জায়গায় খুঁজেন।”

মহিলাটি একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তো সব জায়গায় খুঁজছি। কোথাও তো পাই না আমার সুমনকে!”

রবিন চোখের কোনা দিয়ে দেখে মহিলাটি ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে, দরজাটা ক্যাচ ক্যাচ করে একটু শব্দ করল তারপর মহিলাটি অদৃশ্য হয়ে গেল। তাকে দেখা না গেলেও রবিন তার গলার স্বর শুনতে পায়, “সুমন। বাবা সুমন। তুই কোথায় গেলি?”

তখন সে আরো কয়েকজন মানুষের গলা শুনতে পায়। কেউ একজন বলল, “রাহেলা তুমি এভাবে সুমনকে পাবে না! তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে তুমি মারা গেছ। তুমি বেঁচে নেই।”

মহিলাটি আবার বলল, “সুমন! আমার সুমন!”

খুব ধীরে ধীরে সবার গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যাবার পরও রবিন ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল। তারপর বুক থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস বের করে সে চাদরটা টেনে নিজেকে ঢেকে পাশ ফিরে শোয়। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সে একজন মৃত মানুষের সাথে কথা বলেছে। রবিন অবাক হয়ে আবিষ্কার করে তার যেটুকু ভয় লাগার কথা তার সেটুকু ভয় লাগছে না। একটা মা তার ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছে না সেটা চিন্তা করে শুধু তার ভেতরে কেমন জানি একটু দুঃখ লাগছে।

ভোরবেলা খাবার টেবিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আব্বু খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলেন, কিছু একটা দেখে হঠাৎ মাথা নেড়ে বললেন, ‘ইশ!”

ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আব্বু?”

“আমাদের বাসার কাছে একটা খারাপ একসিডেন্ট হয়েছে। মা আর ছেলে ছিল। মাটা স্পট ডেড।”

আম্মু বললেন, “আহা রে। ছেলেটা?”

“ছেলেটা বেঁচে গেছে। ক্রিটিক্যালি ইনজুরড। হাসপাতালে আছে।”

রবিনের হঠাৎ কী মনে হলো কে জানে, জিজ্ঞেস করল, “ আব্বু, ছেলেটার নাম কী সুমন?”

আব্বু অবাক হয়ে রবিনের দিকে তাকালেন, “হ্যাঁ। তুই কেমন করে জানিস?”

রবিন থতমত খেয়ে বলল, “নামানে-ইয়ে–”

খাবার টেবিলে সবাই অবাক হয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। রবিন তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে টোস্টটা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি খেতে শুরু করে।

স্কুল থেকে আসার সময় রাস্তার মোড়ে রবিন আর লিটন দাঁড়িয়ে গেল। সামনে অনেক মানুষের ভিড়, ভিড় ঠেলে কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ একটু সরে দাঁড়াতেই মুহূর্তের জন্যে রবিন দেখতে পেল রাস্তায় একজন মানুষ পড়ে আছে, পুরো জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। লিটন ফ্যাকাসে মুখে বলল, “কী হয়েছে ভাইয়া?”

“একসিডেন্ট।”

“চল ভাইয়া যাই, আমার ভয় করছে।”

লিটন ভীতু প্রকৃতির, রাস্তার মাঝে একসিডেন্টের দৃশ্য দেখে ভয় পাবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। সে লিটনের হাত ধরে দুই পা এগিয়ে যেতে যেতে একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল। পুলিশের সাথে একজন মানুষ উত্তেজিত গলায় কথা বলছে, মানুষটির সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, একটা হাত বিচিত্রভাবে শরীর থেকে ঝুলছে, দেখে মনে হচ্ছে না এটা তার শরীরের অংশ। রবিন এক পলক দেখেই বুঝতে পারে এটি একসিডেন্টে মরে যাওয়া মানুষটি, সে ছাড়া আর কেউ তাকে দেখছে না।

লিটন রবিনের হাত ধরে টেনে কঁদো কাদো গলায় বলল, “ চল ভাইয়া।”

“দাঁড়া। তুই এক সেকেন্ড দাঁড়া।”

“তুমি কোথায় যাও?”

“আমি এক্ষুনি আসছি।”

লিটন কিছু একটা বলতে চাইছিল তাকে তার সুযোগ না দিয়ে রবিন ছুটে গেল। পুলিশটার কাছাকাছি এসে শুনতে পায় রক্তে ভেসে যাওয়া মানুষটা বলছে, “লাল রঙের পাজেরো। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেল-শুয়োরের বাচ্চা একবার থামল পর্যন্ত না!”

পুলিশটার হাতে একটা ছোট নোটবই, সেটা অন্যমনস্কভাবে হাত বদল করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকায়। তারপর গলা উঁচিয়ে বলল, “কেউ ভিড় করবেন না। সরে যান।”

মানুষগুলো সরে যাবার কোনো লক্ষণ দেখাল না। পুলিশটা তখন গলা আরেকটু উঁচু করে বলল, “সরে যান সবাই। সরে যান।”

কয়েকজন মানুষ তখন একটু সরে দাঁড়াল।

“কেউ কী দেখেছেন ঘটনাটা? আছে কেউ?”

রক্তাক্ত মৃতদেহটা বলল, “আমি দেখেছি। বললাম তো আমি-লাল পাজেরো। গাড়ির নম্বর ঢাকা গ বারো তারপর চার আট আট–”

“কেউ দেখেছেন?”

রক্তাক্ত মৃতদেহটা বলল, “বললাম তো! আমি দেখেছি। লাল পাজেরো। ড্রাইভারের পাশে একটা মেয়ে বসে আছে-নীল শাড়ি–”

পুলিশটা ভিড়কে সরাতে সরাতে বলল, “না দেখে থাকলে সরে যান। সবাই।”

রবিন এবারে পুলিশটার শার্টের হাতা ধরে একটু টান দিল। পুলিশটা ভুরু কুঁচকে রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে?

“লাল পাজেরো।”

“একসিডেন্ট করেছে?”

রবিন মাথা নাড়ল।

“তুমি দেখেছ?”

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রবিন হড়বড় করে বলল, “ড্রাইভারের পাশে নীল শাড়ি পরা একটা মেয়ে ছিল। গাড়ির নম্বর ঢাকা গ বারো তারপর চার আট আট “

পুলিশ ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি দেখছে?”

রবিন মাথা নাড়ল, বলল, “আরেকজন দেখেছে।”

“সে কোথায়?”

“সে নাই।”

পুলিশটা হাত দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, “ সে নাই তো তুমি ভাগো। যাও।”

রবিন বলল, “বিশ্বাস করেন–”

“যাও যাও ভাগো।”

রবিন একটু সরে দাঁড়াল। রাস্তার পাশে রক্তাক্ত মৃতদেহটি দাঁড়িয়ে ছিল, একটা বিচিত্র দৃষ্টিতে সে রবিনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “কিছু বুঝতে পারছি না। কেউ আমার কথা শুনতে চায় না কেন? ব্যাপারটা কী? শরীরে ব্যথা নাই কেন?”

মানুষটা রবিনের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “কী হয়েছে আমার?”

রবিন ফিসফিস করে বলল, “আপনি মরে গেছেন।”

মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “কেন আমি মরে যাব? আমি মরি নাই। এই দেখো আমি দাঁড়িয়ে আছি।”

রবিন এক পা এক পা করে পেছনে সরে আসে, তারপর লিটনের দিকে ছুটতে থাকে। লিটন ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে। রবিনকে দেখে নাক মুছে বলল, “তুমি কী করো ওইখানে। আমার ভয় করে। বাসায় চলো।”

“চলো। বাসায় চলো।”

হাঁটতে হাঁটতে সে পেছনে ফিরে তাকাল। রক্তাক্ত মৃত মানুষটা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা এখনো জানে না সে মরে গেছে। রবিন দেখতে পায় মৃত মানুষটাকে ঘিরে আরো কয়েকজন মানুষ ভিড় করেছে। তারাও মৃত। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে সে মারা গেছে। মানুষটার জন্যে রবিন নিজের ভেতরে বিচিত্র একধরনের কষ্ট অনুভব করে।

গভীর রাতে মেয়েকণ্ঠে কান্নার একটা শব্দ শুনে রবিন জেগে উঠল। রবিন দুই হাতে কান চেপে ধরে রাখে কিন্তু তবুও শব্দটা চলে গেল না। রবিন কান থেকে তার হাত দুটো সরিয়ে নেয় এবং হঠাৎ তার মনে হয় শব্দটা পাশের ঘর থেকে আসছে। মনে হচ্ছে ঈশিতা যন্ত্রণায় কাঁদছে।

রবিন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল। ঈশিতার ঘরের দরজা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে যায় আর রবিন শুনতে পায় সত্যি সত্যি ঈশিতা যন্ত্রণায় কাঁদছে।

রবিন ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ঈশিতার বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। ঈশিতা কুঁকড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। রবিন ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপু! কী হয়েছে তোমার?”

“ব্যথা! খুব ব্যথা করছে পেটে।” ঈশিতা কোনোমতে বলল, “ আব্বু-আম্মুকে ডাক। তাড়াতাড়ি। মরে যাচ্ছি আমি।”

রবিন আব্বু-আম্মুর ঘরে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে, “ আব্বু-আম্মু, তাড়াতাড়ি উঠো! ঈশিতা আপুর পেটে ব্যথা।”

সাথে সাথেই সবাই ঘুম থেকে উঠে গেল। রবিনদের ছোট চাচা ডাক্তার, তাকে ফোন করা হলো। কিছুক্ষণের মাঝে চাচা এসে গেলেন। পেটে চাপ দিয়ে কিছু পরীক্ষা করে ছোট চাচা মুখ গম্ভীর করে বললেন, “অ্যাপেন্ডিসাইটিস। এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।”

আব্বু-আম্মু আর ছোট চাচা মিলে ঈশিতাকে তখন তখনই হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। রবিন আর লিটন বাসায় রয়ে গিয়েছে। লিটন ফাস ফাস করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ভাইয়া। আপু কী মরে যাবে?”

রবিনের বুকটা ধক করে উঠল কিন্তু সেটা বুঝতে দিল না, লিটনকে ধমক দিয়ে বলল, “ধুর গাধা! মরে যাবে কেন?”

“এখন কী হবে ভাইয়া?”

“অপারেশন করবে। অপারেশন করে অ্যাপেন্ডিসাইটিস ফেলে দেবে।”

“কেন ফেলে দেবে ভাইয়া?”

উত্তরটা রবিনের ভাল করে জানা ছিল না তাই ইতস্তত করে বলল, “ব্যথা করছে যখন ফেলে দিতে হবে না?”

“আমারও তো মাঝে মাঝে হাঁটু ব্যথা করে, তখন কী হাঁটু ফেলে দেয়?”

রবিন একটু রেগে বলল, “বকবক করবি না। এখন ঘুমা।”

“ঘুম আসছে না।”

“তাহলে চুপ করে শুয়ে থাক।”

লিটন চুপ করে শুয়ে রইল। ঘণ্টাখানেক পরে হাসপাতাল থেকে আম্মু ফোন করে বললেন, ঈশিতাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে স্যালাইন আর ওষুধপত্র দিচ্ছে, ব্যথা কমেছে। এখন ঘুমিয়ে আছে। সকালে ডাক্তারেরা এলে অপারেশনের সময় ঠিক করা হবে। কাজেই চিন্তার কোনো কারণ নেই।

চিন্তার কোনো কারণ নেই শুনে লিটন প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে গেল। রবিন দীর্ঘ সময় বিছানায় ছটফট করে ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল।

সকালের দিকে আম্মু হাসপাতাল থেকে এসে কিছু দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে গেলেন। রবিন আর লিটনের কেউই স্কুলে গেল না, বাসায় মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দুপুরবেলা খবর পেল ঈশিতাকে অপারেশন করাতে নিয়ে গেছে। ঘণ্টা দুয়েক পরে খবর পেল অপারেশন ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে, এখন ঘুমাচ্ছে।

সন্ধ্যের দিকে আব্বু এসে রবিন আর লিটনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। রবিনের ধারণা ছিল হাসপাতালে বুঝি হাজার হাজার মানুষ গিজ গিজ করছে, কিন্তু দেখা গেল এটা মোটেও সেরকম না। প্রাইভেট হাসপাতাল, তার ওপর নতুন তৈরি হয়েছে। চারিদিক ঝকঝক-তকতক করছে। মানুষের ভিড় নেই। লিফটে করে তারা দোতলায় উঠে এলো। বেশ বড় একটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে সুন্দর সুন্দর চেয়ার, সামনে টেলিভিশন। কিছু মানুষ সেখানে চুপচাপ বসে আছে। রবিন জিজ্ঞেস করল, “আব্বু। আপু কোথায়?”

আব্বু একটা ঘর দেখিয়ে বললেন, “এইখানে। অপারেশন হবার পর কয়েক ঘণ্টা এখানে রাখে। ঠিকমতোন জ্ঞান ফিরে এলে তখন কেবিনে নিয়ে যায়।

লিটন জিজ্ঞেস করল, “আপুর ঠিকমতোন জ্ঞান ফিরে নাই?”

“ওষুধ দিয়ে রেখেছে তো তাই ঘুমিয়ে আছে।”

রবিন বলল, “আপুকে একটু দেখে আসি?”

আব্বু বললেন, “দাঁড়া। ডাক্তারের সাথে কথা বলে নেই। এটা তো রিকভারি রুম, ডাক্তার-নার্স ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারে না।”

“এদের বেশি বাড়াবাড়ি মহিলার গলা শুনে তারা মাথা ঘুরিয়ে দেখল মাঝবয়সী একজন মহিলা। রাগ রাগ মুখে বললেন, “ আমাকে পর্যন্ত আমার মায়ের কাছে যেতে দিতে চায় না। কত কাজ ফেলে এসেছি–”

আব্বু বললেন, “সার্জারির ব্যাপার। একটু কেয়ারফুল থাকা ভালো।

মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কার কী হয়েছে?”

আব্বু বললেন, ‘আমার মেয়ে। অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন।” একজন কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে তাকে পাল্টাপাল্টি সেটা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ভদ্রতা। তাই আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার?”

“আমার বাবা। গল ব্লাডার অপারেশন।”

“কেমন আছেন আপনার বাবা?”

“ভালো। কেবিনে নেয়ার জন্যে বসে আছি।” ভদ্রমহিলা রাগ রাগ মুখে বিড়বিড় করে আরো কয়েকটা কথা বলে একটু সরে গেলেন।

আব্বু ডাক্তারের সাথে কথা বলে রবিন আর লিটনকে এক মিনিটের জন্যে ভেতরে নিয়ে যাবার অনুমতি নিলেন। প্রথমে লিটন ঈশিতাকে দেখে এলো। তারপর রবিন, ঠিক তখন আব্বুর একটা ফোন চলে এলে বলে রবিন একাই ঢুকে গেল। বেশ বড় একটা ঘর, তার মাঝে দুই পাশে শুধু দুটি বিছানায় দুজন শুয়ে আছে। একটি বিছানাকে ঘিরে অনেক মানুষ কাজেই অন্যজন নিশ্চয়ই ঈশিতা।

রবিন বিছানাটার কাছে এগিয়ে গেল, ঈশিতা চোখ বন্ধ করে শুয়ে। আছে। রবিন আস্তে করে কপালে হাত রেখে ডাকল, “আপু।”

ঈশিতা চোখ খুলে রবিনের দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হাসল।

“আপু, তুমি কেমন আছ?”

ঈশিতা বলল, “ভালো।”

“দেরি নাই। আর দেরি নাই, সময় হয়ে গেছে—” পাশের বিছানায় ঘিরে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করে জোরে জোরে কথা বলতে থাকে। রিকভারি রুমে কোনো মানুষ ঢোকার কথা নয়, এতগুলো মানুষ কেমন করে ঢুকে এত জোরে কথা বলছে? রবিন ভালো করে তাকিয়ে হঠাৎ একেবারে হতচকিত হয়ে গেল। এরা আসলে সত্যিকারের মানুষ না। এরা সব মৃত মানুষ। রিকভারি রুমের বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটা নিশ্চয়ই এখন মারা যাবে, আত্মীয়স্বজন সবাই তাকে নিতে এসেছে।

“কষ্ট হচ্ছে নাকি?”

“একটু তো হচ্ছেই। মৃত্যুর একটা কষ্ট থাকে।”

“এইটা শেষ কষ্ট। এর পরে আর কষ্ট নাই।”

ইশিতা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখিস তুই?”

রবিন বলল, “না কিছু না।”

পাশের বিছানায় ঘিরে থাকা সব মানুষ তখন একসাথে মাথা ঘুরিয়ে রবিনের দিকে তাকাল। চোখের দৃষ্টি কী তীব্র, রবিনের বুকের ভেতরটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।

বুড়ো মতোন একজন মানুষ রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ খোকা তুমি আমাদের দেখতে পাও?

রবিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। পাই।”

“আশ্চর্য!” মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তারপর আবার রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এখন যাও। মানুষের মৃত্যু মুহূর্ত খুব ভয়ানক।”

“যাই। আমি যাই।”

ঈশিতা দুর্বল হাতে রবিনের হাত ধরে নিচু গলায় বলল, “তুই কার সাথে কথা বলিস?”

“কারো সাথে না–”

“তাহলে?”

“আমি এখন যাই আপু। এই রোগীটা এক্ষুনি মারা যাবে।”

“তুই কেমন করে জানিস?”

“পরে বলব আপু-” রবিন কথা শেষ না করেই বাইরে বের হয়ে আসে। রোগীর আত্মীয়স্বজন চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে টেলিভিশনে খবর শুনছে। তারা কেউ জানে না তাদের রোগীটি এক্ষুনি মারা যাবে।

রবিন কানখাড়া করে রেখেছিল, হঠাৎ করে রিকভারি রুমের ভেতর থেকে একটা অ্যালার্মের মতো শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে একজন নার্স তার পরে বেশ কয়েকজন ডাক্তার হঠাৎ ছোটাছুটি করতে শুরু করে।

রবিন নিঃশব্দে বসে থাকে, সে জানে ছোটাছুটি করে কোনো লাভ নেই। এ মানুষটিকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

ঈশিতা তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। বিছানায় তার পায়ের কাছে বসেছে রবিন। কেবিনে এখন আর কেউ নেই। ঈশিতা দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “বল।”

ঈশিতা কী শুনতে চাইছে রবিন খুব ভালো করে জানে তারপরেও সে না বোঝার ভান করল, বলল, “কী বলব?”।

“রিকভারি রুমে তুই কী দেখেছিলি? কার সাথে কথা বলছিলি?”

“আমি কাউকে দেখি নাই, কারো সাথে কথা বলি নাই।”

“মিথ্যে কথা বলবি না, কান ছিঁড়ে ফেলব তাহলে।” রবিন দুর্বল গলায় বলল, “আমি মিথ্যা কথা বলছি না।”

“এইটাও একটা মিথ্যা কথা।” ঈশিতা হাত নেড়ে বলল, “আমি নিজের চোখে দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি–”

“তোমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে রেখেছিল। ঘুমের মাঝে কী দেখতে কী দেখেছ, কী শুনতে কী শুনেছ–”

“আমি মোটেও ঘুমাচ্ছিলাম না রবিন। আমার সাথে ফাজলামো করবি না। কী হয়েছিল বল।”

“কিছু হয় নাই।”

“তুই বললি রোগীটা এক্ষুনি মারা যাবে। সত্যি সত্যি মারা গেল। কেমন করে তুই জেনেছিলি–”

রবিন কোনো কথা না বলে উদাস মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। ঈশিতা এবারে একটু অনুনয় করে বলল, “রবিন। সোনা ভাই, আমাকে বল প্লিজ। আমি কাউকে বলব না।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

রবিন কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?”

“না।”

“কী না?”

“আমি বলতে পারব না।”

ঈশিতা চোখ বড় বড় করে বলল, “কেন বলতে পারবি না?”

“আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আব্বু-আম্মুকে বলেছিলাম। মনে নাই তখন কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে নাই? ওষুধ দিয়ে আমাকে ছাড়াভেড়া করে দিয়েছিল। আমি দিনরাত খালি ঘুমাতাম—”

ঈশিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “তুই সত্যি সত্যি কিছু একটা দেখিস?”

রবিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ।”

“তাদের কথাও শুনিস?”

“হ্যাঁ।”

“দেখতে কী রকম।”

“তোমাদের বললে তোমরা বুঝবে না।”

“কাদেরকে দেখিস?”

রবিন এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, “যারা মরে গেছে তাদের।”

ঈশিতা চমকে উঠল, “সত্যি?”

রবিন মাথা নাড়ল।

“তাদের কথা শুনে তুই বুঝতে পেরেছিলি রোগীটা মারা যাবে?”

রবিন আবার মাথা নাড়ল। ঈশিতা বুক থেকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “‘কী আশ্চর্য! তোর ভয় করে না?”

রবিন মাথা নাড়ল, “করে। অনেক ভয় করে।” এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “

“তুমি কাউকে বলবে না তো?”

“বলব না।”

“খোদার কসম?” ঈশিতা বলল, “খোদার কসম। আয় তুই কাছে আয়।”

রবিন কাছে এলে ঈশিতা তার হাত ধরে বলল, “এই যে তোর গা ছুঁয়ে বলছি, আমি কাউকে বলব না। আর শোন–”

“কী?”

“যদি তোর কখনো ভয় করে, তুই আমাকে বলবি। বুঝলি?”

রবিন মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে চাইছিল ঠিক তখন কেবিনের দরজা খুলে আব্বু এসে ঢুকলেন বলে কথাটা আর বলা হলো না।

অনেকদিন থেকে আব্বুর গ্রামের বাড়িতে যাবার কথা। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল সবাই মিলে কমপক্ষে দশ দিনের জন্যে যাবে। পূজার ছুটিতে যখন পরিকল্পনা পাকাপাকি করা হলো তখন দেখা গেল ঈশিতার পরীক্ষা সে যেতে পারবে না। তাই ঈশিতাকে একেবারে একা না রেখে রবিনকেও রেখে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আব্বু ছুটি নেবার সময় আবিষ্কার করলেন একটানা এতদিন ছুটি নেয়া এত সহজ ব্যাপার নয়, তাই দশ দিনের ভ্রমণকে কমিয়ে পাঁচ দিনে নামিয়ে নিয়ে এলেন।

যাবার আগে আম্মু অনেক ধরনের উপদেশ দিয়ে গেলেন। বাসায় ঈশিতা আর রবিন ছাড়াও ফুলি-খালা থাকবে। ফুলি-খালা তাদের বাসায় অনেকদিন থেকে আছে, আম্মু তার ওপর বিশ্বাস করে আগেও বাচ্চাদের রেখে গেছেন। ফ্রিজে রান্না করে কিছু খাবার রাখা হয়েছে। আলমারিতে শাড়ির নিচে খামের ভেতরে কিছু টাকা রয়েছে। পাঁচ দিন খুব বেশি সময় নয়, তারপরেও কোনোদিন কার কোন জামা-কাপড় পরতে হবে আম্মু সেগুলোও বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন।

আম্মু-আব্বু লিটনকে নিয়ে চলে যাবার পর সন্ধ্যেবেলা ঈশিতা আর রবিন আবিষ্কার করল বাসাটা একটু বেশি নির্জন। ঠিক কী কারণ জানা নেই, তাদের খিদে পেল তাড়াতাড়ি। রাতের খাবার খাওয়ার সময় তারা বেশি কথাবার্তা বলল না। ঈশিতা আবার তার পড়াশোনাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। রবিন টেলিভিশনে আধখানা বাংলা নাটক দেখে বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে টেলিভিশন বন্ধ করে নিজের রুমে ফিরে এলো। খানিকক্ষণ ইংরেজি পড়ার চেষ্টা করে তার ঘুম পেয়ে গেল, ফুলি-খালা মশারি টানিয়ে দিয়ে গেল, রবিনও দাঁত ব্রাশ করে শুয়ে পড়ল।

গভীর রাতে রবিনের ঘুম ভেঙে গেল-ঠিক কী জন্যে ঘুম ভেঙেছে রবিন বুঝতে পারছিল না কিন্তু তারপরেও পাশ ফিরে শুয়ে নিজের অজান্তেই কিছু একটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যিই সে একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেল।

ছোট একটা বাচ্চার কান্না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চাটি কাঁদছে। রবিন দুই হাত দিয়ে নিজের কান ঢেকে শুয়ে রইল কিন্তু শব্দটি চলে গেল না। তখন সে বিছানায় উঠে বসে কে কাঁদছে দেখার চেষ্টা করে। তার ঘরের এক কোনায় জমাট বাঁধা খানিকটা অন্ধকার, মাঝে মাঝে সেটা একটু একটু নড়ছে, সেখান থেকেই কান্নার শব্দটা আসছে। দেখে মনে হয় একটা শিশু। ঘরে আলো জ্বেলে রাখলে অনেক সময় এরা চলে যায়, সেভাবে কিছুক্ষণ ঘরের আলো জ্বেলে শিশুটাকে ঘর থেকে বাইরে বের করে দেবার চেষ্টা করবে কী না ঠিক বুঝতে পারল না। রবিন আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চাপা গলায় শিশুটিকে ডাকল, “এই।”

সাথে সাথে কান্নার শব্দ থেমে গেল। বাচ্চাটি চলে যায়নি, ঘরের কোনায় জমাট বাঁধা অন্ধকারটি এখনো দেখা যাচ্ছে। রবিন আবার ডাকল, “এই, তুমি এখানে আছ?”

রবিন বড় বড় নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় কিন্তু কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। রবিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কাঁদছ কেন?”

এবারে বাচ্চাটি উত্তর দিল, “আমার ভয় করছে।”

রবিন কখনোই এরকম একটি উত্তর আশা করেনি, অবাক হয়ে বলল, “তোমার ভয় করছে?”

“হ্যাঁ।”

“কীসের ভয়?”

“আমি হারিয়ে গেছি। আমি কোথায় যাব জানি না।”

রবিন এত অবাক হলো বলার নয়। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় যাবে জানো না?”

“না।”

“তুমি এখানে এসেছ কীভাবে?”

“আমাকে-আমাকে–”

“তোমাকে কী?”

“আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল, ধরে নিতে চাচ্ছিল তখন দেখলাম এখানে ভয় নাই-তখন এখানে ঢুকে গেছি।”

“কে তোমাকে ধরে নিতে চাচ্ছিল?”

“আমি চিনি না।”

“কেন তোমাকে ধরে নিতে চাচ্ছিল?”

“আমি জানি না।”

“তোমার আম্মু-আব্বু নাই?”

“আছে।”

“তারা কোথায়?”

“জানি না।” তারা বেঁচে আছে না মারা গেছে সেটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রবিন থেমে গেল। একটা ছোট বাচ্চাকে কেমন করে কেউ এই কথা জিজ্ঞেস করে?

বাচ্চাটা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল। রবিন বিছানা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?”

“ওই যে আসছে। আমাকে ধরে নিতে আসছে! কী হবে এখন?”

“কে আসছে? কে?”

রবিন বিছানা থেকে নেমে ছোট বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে যায় আর ঠিক তখন ঘরের ভেতরে একটা ঝাঁজালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। রবিন অবাক হয়ে দেখল, ঘরের মাঝখানে ধোঁয়ার মতো কিছু একটা জমাট বাঁধছে, দেখতে দেখতে সেটা কুৎসিত আধা মানুষ আধা পশুর মতো বিচিত্র একটা প্রাণীর রূপ নিয়ে নিল। খাটো রোমশ দেহ, উঁচু কপাল আর কপালের নিচে দুটি চোখ ধকধক করে জ্বলছে।

এটি মানুষ নয়, মানুষের মতো কোনো একটি প্রাণী। রবিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, প্রাণীটি ছোট বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে একধরনের জান্তব শব্দ করল। রবিন বাচ্চাটার সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে বাচ্চাটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও! তুমি যাও! যাও এখান থেকে।”

প্রাণীটা তার ছোট ছোট চোখ দুটি দিয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। রবিন ফিসফিস করে বলল, “তুমি যাও। যাও এখান থেকে–”

প্রাণীটি তবু চলে গেল না। হাতের কাছে লাইট সুইচটা আছে, হঠাৎ করে লাইট জ্বালিয়ে দিলে প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে যাবে-কিন্তু ছোট বাচ্চাটির কী হবে? তীব্র আলোতে সেটাও তো থাকতে পারবে না–কোথায় যাবে তখন এই বাচ্চাটি?

রবিনের হঠাৎ করে তখন চার্জারের সাথে লাগানো টর্চ লাইটটার কথা মনে পড়ল। এক ছুটে সেটার কাছে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে লাইটটা হাতে নিয়ে সেটা প্রাণীটার মুখের ওপর জ্বালিয়ে দেয়-যন্ত্রণায় একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেল, সাথে সাথে একটা পোড়া গন্ধে ঘরটা ভরে যায়। একটা লুটোপুটির শব্দ হলো তারপর হঠাৎ করে ঘরটা নীরব হয়ে গেল। এত নীরব যে মনে হয় নিঃশ্বাসের শব্দটাও শোনা যাবে। প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

রবিন লাইটটা নিভিয়ে দিল, আবছা অন্ধকারের ঘরটা ঢেকে গেল সাথে সাথে। রবিন নিচু গলায় ডাকল, “এই ছেলে।”

কোনো উত্তর নেই। বাচ্চাটিও কী তাহলে চলে গেছে?

রবিন আবার ডাকল, “এই ছেলে।”

এবারে সে ফুঁপিয়ে কান্নার একটা শব্দ শুনতে পেল। “কোথায় তুমি?”

“এই যে। এখানে।”

রবিন বিছানার কাছে তাকাল। তার বিছানা আর টেবিলটার পাশে ছোট একটা জায়গায় সে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। রবিন বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে যায়। আবছা অন্ধকারে বাচ্চাটা তার দিকে তাকাল, কী সুন্দর মায়াকাড়া চেহারা। বড় বড় দুটি চোখ, কোকড়ানো চুল। এর আগে যখনই কাউকে দেখেছে তাদের শরীর ছিল রক্তাক্ত, মাথা থেঁতলানো, মুখ বিকৃত। শুধু এ ছেলেটির শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নাই। রবিন অবাক হয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের আলো জ্বালিয়ে বাচ্চাটিকে ঠিক করে দেখতে পারলে হতো কিন্তু রবিন তার সাহস করল না। সে জানে তীব্র আলোতে এদের কষ্ট হয়।

“তোমার কী হয়েছিল?”

“আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম।”

“তারপরে।”

তারপর আমি দেখি আমি সিঁড়িতে পড়ে আছি। আমার আম্মু আর আন্ধু আমাকে নিয়ে গাড়ি করে কোথায় জানি নিয়ে গেল

“নিশ্চয়ই হাসপাতালে?”

বাচ্চাটা মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ হাসপাতালে।”

“তখন তুমি কী করলে?”

“আমি চিৎকার করে আমার আম্মু আর আব্বুকে ডাকলাম। তারা আমার কথা শুনল না।”

“তখন?”

“তখন আমি পেছনে পেছনে যেতে চাইলাম, তারপর আমি হারিয়ে গেলাম!” বাচ্চাটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

“কেউ তোমাকে নিতে আসে নাই?”

“না।”

“কেউ না? বয়স্ক মানুষ। সাদা কাপড় পরা মানুষ তোমার কাছে আসে নাই?”

“না।”

“একজনও আসে নাই?”

“না।”

ঠিক এরকম সময় দরজা খুলে ঈশিতা এসে ঢুকল, অবাক হয়ে বলল, “রবিন? কার সাথে কথা বলিস?”

ছোট বাচ্চাটা ভয়ে চিৎকার করে মুখ ঢেকে ফেলে। রবিন ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ঈশিতাকে বলল, “শ-স-স-স–”

ঈশিতা ফিসফিস করে বলল, “কী হয়েছে?”

“বলছি আপু। অনেক সিরিয়াস ব্যাপার।”

ছোট বাচ্চাটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি আম্মুর কাছে যাব। আম্মুর কাছে যাব।”

রবিন নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী ছেলে?”

“জয়।”

“জয় তুমি কেঁদো না।”

“আমার ভয় করে।”

“ভয়ের কিছু নেই জয়। আমরা আছি না।”

তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?”

“না যাব না।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, “তুই কার সাথে কথা বলছিস?”

“বলছি আপু। বাইরে আসো–”

জয় চিৎকার করে বলল, “না, না, আমাকে ছেড়ে বাইরে যেও না। আমার ভয় করে।”

“তোমার কোনো ভয় নেই জয়। আমি যাব না। আমি এখানেই আছি। তুমি চুপ করে বসে থাকো।”

জয়কে বসিয়ে রবিন বাইরে বের হয়ে এলো, ঈশিতা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “তুই কার সাথে কথা বলছিস?”

“একটা ছোট ছেলে, নাম জয়।”

“তুই একটা ছোট ছেলেকে দেখছিস?”

“হ্যাঁ।”

“সে তোর সাথে কথা বলছে?”

“হ্যাঁ আপু।”

“ছেলেটা আসলে মরে গেছে?”

রবিন ইতস্তত করে বলল, “এইটাই হচ্ছে সমস্যা। আমি দেখেছি যখন কেউ মারা যায় তখন তার সব আত্মীয়স্বজন, অন্যান্য মারা যাওয়া মানুষেরা তার কাছে চলে আসে। কিন্তু—”

“কিন্তু কী?”

“এই ছেলেটার বেলায় অন্যরকম। সে একা। সে হারিয়ে গেছে। কেউ তাকে নিতে আসছে না–ভয়ংকর প্রাণী শুধু ভয় দেখাচ্ছে, নিয়ে যেতে চাইছে।”

ঈশিতা বলল, “তার মানে কী?”

“আমি জানি না। শুধু মনে হচ্ছে-”

“কী মনে হচ্ছে?”

রবিন ইতস্তত করে বলল, “মনে হচ্ছে ছেলেটা আসলে মারা যায়নি।

“তাহলে?”

“শুধু তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে।”

“কী বলছিস তুই? সেটা আবার কী”

রবিন মাথা নাড়ল, “সেটা আমি জানি না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সে এখনো পুরোপুরি মারা যায়নি। আমার মনে হচ্ছে যদি আমরা এখন জয়কে তার শরীরের কাছে নিয়ে যেতে পারি তাহলে হয়তো বেঁচে যাবে।”

ঈশিতা অবাক হয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “তুই কেমন করে এটা জানিস?”

“আমি জানি না। আমি আসলে কিছু জানি না। আমার শুধু এটা মনে হচ্ছে।”

“তাহলে? তাহলে এখন কী করবি?”

রবিন কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। ঈশিতা রবিনের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে এখন খুঁজে বের করতে হয়, ছেলেটার শরীর কোথায় আছে।”

“কেমন করে বের করবে?”

“আয় হাসপাতালে হাসপাতালে ফোন করি।”

“ঠিক আছে।” রবিন বলল, “আমি দেখি ছেলেটার সাথে কথা বলে আরো কিছু খবর বের করতে পারি কী না।”

রবিন বাচ্চাটার সাথে কথা বলে নুতন কিছুই বের করতে পারল না। ঈশিতা তখন একটা ডায়েরি খুঁজে বের করল, তার মাঝে সব হাসপাতালের টেলিফোন নম্বর দেয়া আছে। সে একটা একটা নাম্বার বের করে টেলিফোন করতে শুরু করে। এত রাতে কেউ সহজে টেলিফোন ধরতে চায় না, টেলিফোন ধরলেও উত্তর দিতে চায় না, তার মাঝেও ঈশিতা লেগে থাকল। ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করে যখন ঈশিতা প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন হঠাৎ করে একটা হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট ঘুম ঘুম বলল, সন্ধ্যেবেলা তাদের এখানে একটা ছোট বাচ্চাকে আনা হয়েছে। মাথায় ব্যথা পেয়ে অজ্ঞান হয়েছিল সে যতদূর জানে এখনো জ্ঞান ফিরেনি। ঈশিতা বাচ্চাটার নাম জানতে চাইছিল রিসেপশনিস্ট বলতে পারল না। বাচ্চার আত্মীয়স্বজন কেউ আশেপাশে আছে কী না জিজ্ঞেস করল, রিসেপশনিস্ট সেটাও বলতে পারল না। হাসপাতালের নাম প্যারামাউন্ট হাসপাতাল, তাদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

টেলিফোনটা রেখে ঈশিতা রবিনকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করবি?”

রবিন মাথা চুলকে বলল, “ছেলেটাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই।

“এত রাতে যাবি কেমন করে?”

“স্কুটার ক্যাব কিছু একটা পাওয়া যাবে না?”

ঈশিতা বলল, “দেখি চেষ্টা করে।”

রবিন বলল, “না পেলে হেঁটে চলে যাব।”

তাদের অবিশ্যি হেঁটে যেতে হলো না, বাসা থেকে বের হবার পর কিছুক্ষণের মাঝেই একটা রিকশা পেয়ে গেল। এত রাতে রিকশাওয়ালা কী করছে সেটা একটা রহস্য। রাস্তায় দুবার পুলিশ রিকশাকে থামাল, ঈশিতা বলল, “জরুরি কাজে হাসপাতালে যাচ্ছে। এত রাতে এভাবে রিকশা করে যাওয়ার ব্যাপারটা পুলিশ ভালো চোখে দেখল না কিন্তু হাসপাতালে যাচ্ছে শুনে শেষ পর্যন্ত। যেতে দিল।

যে ব্যাপারটি ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা সেটা অবিশ্যি রবিন ছাড়া আর কেউ জানল না। সেটি ছিল ছোট বাচ্চাটাকে রাজি করিয়ে তাদের সাথে আনা। সে কিছুতেই ঘরের বাইরে যেতে চাইছিল না, তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শুনে শেষ পর্যন্ত আসতে রাজি হয়েছে। সত্যিকারের একজন বাচ্চাকে হাত ধরে বা কোলে করে নেয়া যায়। কিন্তু যাকে স্পর্শ করা যায় না দেখা যায় না শোনা যায় না কিন্তু সত্যিকার একটা শিশুর মতো অবুঝ তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া সহজ না। রবিন অনেক কষ্ট করে বাচ্চাটিকে নিজের শরীরের কাছাকাছি রেখে কোনোভাবে তাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এলো।

হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ব্যাপারটি অবিশ্যি সহজ হয়ে গেল। জয়ের মা আইসিইউয়ের বাইরে দুই হাতে মুখ ঢেকে বসেছিলেন, জয় আম্মু আম্মু বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মা কেমন যেন চমকে মুখ তুলে তাকালেন। তারপাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল, বলল, “কী হয়েছে মা?”

মা বললেন, “কী আশ্চর্য! আমার মনে হলো আমার জয় যেন আমাকে আম্মু আম্মু বলে ডাকল।”

কেউ দেখতে পাচ্ছিল না শুধু রবিন দেখল জয় পাগলের মতো তার মায়ের মুখটি ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু ধরতে পারছে না। ব্যাকুল হয়ে সে কাঁদতে শুরু করল, “আম্মু, তুমি আমার দিকে তাকাও না কেন? কথা বলো না কেন?”

রবিন তখন বাচ্চাটিকে ডাকল, “জয়।”

যারা পঁড়িয়ে ছিল তারা সবাই চমকে উঠে রবিনের দিকে তাকাল। রবিনের কিছু করার নেই, সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মাঝেই তাকে বাকি কাজটুকু করতে হবে, সে ফিসফিস করে বলল, “জয়। তোমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না!”

“কেন দেখতে পাচ্ছে না?”

“তুমি তোমার শরীর থেকে বের হয়ে গেছ। তুমি যাও, তোমার শরীরের ভেতরে যাও। তাহলে সবাই তোমাকে দেখবে। যাও।”

“কোথায় আমার শরীর?”

“এই ঘরটার ভেতরে। এসো আমার সাথে—”

আইসিইউতে কারো ঢোকার কথা নয়, কিন্তু কেউ রবিনকে বাধা দিল না। সবাই বিস্ফারিত চোখে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার ভেতরে সে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। সারি সারি বিছানায় মরণাপন্ন রোগীরা শুয়ে আছে, তার মাঝে জয় রবিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। রবিন না তাকিয়েও বুঝতে পারে হাসতালের সব নিয়ম ভেঙে

তারপাশে জয়ের মা বাবা ভাই বোন দাঁড়িয়ে আছে। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে ডাক্তার নার্সও তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন আর এক মুহূর্ত নষ্ট করার সময় নেই। রবিন জয়ের বিছানাটি খুঁজে বের করল, ছোট শিশুটির শরীরে নানারকম যন্ত্রপাতি। লাগানো, সে নিথর হয়ে শুয়ে আছে। রবিন জয়কে দেখাল, “এই যে। এটা তোমার শরীর। তোমার এখানে ঢুকতে হবে।”

“আমি কেমন করে ঢুকব?”

“আমি জানি না। কিন্তু ঢুকতে হবে। যদি না ঢুকো তাহলে তোমার মা কোনোদিন তোমাকে দেখতে পাবে না। যাও দেরি করো না।”

জয় বিভ্রান্তের মতো একবার রবিনের দিকে তাকাল, আরেকবার তার মায়ের দিকে তাকাল। কাদো কাদো হয়ে বলল, “আমার ভয় করে।”

“ভয় করলে হবে না। জয়, যাও দেরি করো না।”

জয়ের নিথর দেহের চারপাশে যারা দাঁড়িয়েছিলেন তারা সবিস্ময়ে দেখলেন তার শরীরটি কেমন জানি কেঁপে উঠল, হাতটা একটু তোলার চেষ্টা করল। মাথাটা একপাশ থেকে অন্যপাশে নাড়াল। সমস্ত শরীরে একটা খিচুনীর মতো হলো তারপর হঠাৎ সে চোখ খুলে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। তার শরীরে লাগানো অনেক যন্ত্রপাতি হঠাৎ করে সচল হয়ে বিপ বিপ শব্দ করতে শুরু করল। জয়ের মা পাগলের মতো তার সন্তানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, দুজন ডাক্তার তাকে ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করতে লাগল।

কে একজন রবিনের কনুই ধরে টান দিচ্ছে, রবিন মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে ঈশিতা। ঈশিতা ফিসফিস করে বলল, “বের হয়ে আয়। কুইক।”

রবিন দ্রুত বের হয়ে আসে। এই মুহূর্তে কেউ তাদের লক্ষ করছে না। এখনই তাদের সরে যেতে হবে। এক্ষুনি। তা না হলে আর কোনোদিন তারা এখান থেকে বের হতে পারবে না। যে ব্যাপারটা ঘটেছে সেটা কাউকে রবিন বোঝাতে পারবে না।

গভীর রাতে রিকশা করে দুই ভাই-বোন বাসায় ফিরে যাচ্ছিল। ঈশিতা গভীর মমতায় তার ছোট ভাইটিকে ধরে রেখেছে। যাকে সে কখনো বুঝতে পারেনি, আজকে সে জেনে গেছে তাকে কখনো সে বুঝতে পারবেও না।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *