Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চুনি-হীরা || Anish Deb

চুনি-হীরা || Anish Deb

ঘরটা মাপে বিশাল। এ-প্রান্তে দাঁড়িয়ে ও-প্রান্তের মানুষকে বোধহয় ঝাপসা দেখায়। কারণ, ঘরের দূরতম কোণে প্রকাণ্ড এক সেক্রেটারিয়্যাট টেবিল সামনে রেখে যে-মানুষটি বসে আছেন তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার পাশে দাঁড়ানো লম্বা-চওড়া জোয়ান লোকটা কর্কশ গলায় বলল, এগিয়ে যান। উনিই মিস্টার মিত্র।

আমি চোখ ফিরিয়ে লম্বা-চওড়া সঙ্গীর দিকে তাকালাম। নাক থ্যাবড়া, চৌকো চোয়াল, কুতকুতে চোখ। গায়ের রং মাঝারি, তবে শুধু ওইটুকুই মাঝারি। বাকি সব কিছুই মাঝারির চেয়ে বাড়াবাড়ি রকমের। যেমন হাতের পেশি, তেমনি দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ। হিন্দি ছবির ফর্মুলামাফিক শেষদিকে এর সঙ্গে আমার মোকাবিলা হওয়া উচিত। আর তাই যদি হয়, তা হলে এখন থেকেই বিষ্টু ঘোষের আখড়ায় গিয়ে আমার ব্যায়াম শুরু করা দরকার।

আসুন, আসুন, মিস্টার শিকদার–।

ঘরের দূরপ্রান্তের সেক্রেটারিয়্যাট টেবিলের পিছন থেকে আপ্যায়নবাণী ভেসে এল অনেকটা দৈববাণীর মতোই। মাখনের মতো মোলায়েম স্বর এবং সুর। কিন্তু পরক্ষণেই রুক্ষ আদেশ শোনা গেল, খুদে, তুই নজরকে ডেকে দে। তারপর দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকবি। দেখবি কেউ যেন আমাদের কথাবার্তায় বাগড়া না দেয়। এবারে গলার স্বর ও সুর শজারুর পিঠের মতো মসৃণ।

আমি খুদের দিকে তাকালাম। এই জিনিস যদি খুদে হয় তা হলে দামড়া কী জিনিস তা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

আসুন, মিস্টার শিকদার। আবার মাখনে ফিরে গেছেন মিত্র সাহেব। পিছনে টুকিটাকি শব্দ পেয়ে বুঝলাম, খুদে চলে গেছে। ঘরে শুধু আমরা দুজন।

টেবিলের এপাশে মিত্ৰসাহেবের মুখোমুখি বসলাম।

কলকাতার নামি মেটাল মার্চেন্ট শরদিন্দু মিত্র। কলকাতার ওপরতলার মানুষরা ওঁকে উঁদে ব্যবসায়ী বলে চেনেন। আর নীচুতলার মানুষরা চেনে তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। সেই কারণেই খুদেকে চিনে নিতে আমার কোনও অসুবিধে হয়নি। ওর শিক্ষাগত যোগ্যতার মধ্যে যে অন্তত গোটাদুয়েক খুন রয়েছে তা রীতিমতো হলফ করে বলা যায়।

সেক্রেটারিয়্যাট টেবিলটা ভারি অদ্ভুত। কুচকুচে কালো কাঠের ওপরে চকচকে পালিশ। এবং তার মাঝে অনেকটা জায়গা জুড়ে বিমূর্ত আকারের একটা স্টেইনলেস স্টিলের পাত বসানো। হঠাৎ দেখলে আয়না বলে ভুল হতে পারে। তারই ওপরে নানান সরঞ্জাম–একজন নামজাদা ব্যবসায়ীর টেবিলে যা যা থাকে। তবে একটা তফাত রয়েছে। প্রায় প্রতিটি বস্তুর সঙ্গেই কোনও না কোনও ধাতু জড়িত। যেমন প্রতিটি কলমে সোনালি পাতের পটি। অ্যাশট্রে কারুকাজ করা তামার তৈরি। কলমদানিটি ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য। পিনকুশন অ্যালুমিনিয়াম আধারে বসানো। ডেট ক্যালেন্ডারও একই ধাতুর তৈরি। এইরকম সবকিছু।

কিন্তু সবচেয়ে অবাক করে দেয় টেবিলে রাখা পেপারওয়েটগুলো। দু-ইঞ্চি ব্যাসের ঝকঝকে কতকগুলো বল। স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। সেগুলো দিয়ে নানান কাগজপত্র চাপা দেওয়া রয়েছে। না, এজন্য আমি অবাক হইনি। অবাক হয়েছি, বলমার্কা পেপারওয়েটগুলো টেবিল থেকে গড়িয়ে পড়ছে না বলে। কারণ, সিলিং ফ্যানের তীব্র বাতাসে পেপারওয়েট চাপা দেওয়া কাগজগুলো উড়তে চাইছে। ফলে বলগুলো ডাইনে-বাঁয়ে দুলছে, কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ছে না।

অবাক হয়েছেন, মিস্টার শিকদার?

মুখ তুলে তাকালাম। মিত্রসাহেবের কথায় সূক্ষ্ম একটা অবাঙালি টান লক্ষ করলাম। আরও লক্ষ করলাম, তার কপালে ছোট্ট চন্দনের টিপ। গায়ের রং কালো হওয়া সত্ত্বেও আগে চোখে পড়েনি।

আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মিত্রসাহেব বললেন, ছোটবেলা থেকেই মেটালের শখ, তাই মেটাল মার্চেন্ট হয়ে সমস্ত শখ মেটাচ্ছি। তা আপনি ওই পেপারওয়েটগুলো দেখে অবাক হয়েছেন…অবাক হবারই কথা। সবাই অবাক হয়। আমি ছাড়া ইন্ডিয়াতে এরকম পেপারওয়েট আর কেউ তৈরি করতে পারে না। ওই বলগুলোর ভেতরে খানিকটা কাঁপা জায়গা আছে। ফঁপা জায়গাটা ওপরদিক ঘেঁষে হওয়ায় বলের নীচটা ভারী হয়ে গেছে, তাই জায়গা ছেড়ে ওগুলো নড়ে না। সেই যে বাচ্চাদের একরকম খেলার পুতুল আছে দেখেননি! যেদিকেই শুইয়ে দিন সবসময় খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। পেপারওয়েটগুলো অনেকটা সেইরকম–।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

মিত্ৰসাহেব ইঙ্গিতটা বুঝলেন। হাসলেন। ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি চোখে পড়ল। আরও চোখে পড়ল ওপরের পাটির শ্ব-দন্ত দুটো রুপোলি। হাসি শেষ হলে বললেন, আপনি বুদ্ধিমান, মিস্টার শিকদার। পেপারওয়েটের ওপরে বক্তৃতা শোনানোর জন্যে আপনাকে ডাকিনি। আপনাকে ডেকেছি হীরাকে খুঁজে দেবার জন্যে–।

হীরা?

হ্যাঁ, হীরা–আমার মেয়ে। একমাত্র মেয়ে।

রহস্য এতক্ষণে পরিষ্কার হল।

শরদিন্দু মিত্র আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বিষধর ঝুমঝুমি সাপের মতো ঠান্ডা স্থির নজর। ধবধবে পাঞ্জাবির ওপরে বেরিয়ে থাকা কষ্টিপাথরে খোদাই করা কালো মুখ বেমানান লাগছে। মাথায় হালকা হয়ে আসা কাঁচা-পাকা চুল তেল জবজবে করে পিছন দিকে টেনে আঁচড়ানো। সাদা পাঞ্জাবির হাতার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা দুটো হাতের পাঁচ-পাঁচ দশটা কালো আঙুল সাপের মতো হিলহিল করে নড়ছে। তাল ঠুকছে টেবিলের ঝকঝকে স্টেইনলেস স্টিলের পাতের ওপরে। আঙুলে চড়ানো একাধিক সোনা ও প্লাটিনামের আংটি।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মিত্রসাহেব আবার বললেন, হীরাকে আমার চাই– কালকের মধ্যেই।

গতকাল রাত দশটা নাগাদ টেলিফোন পেয়েছিলাম। যে ফোন করেছিল নাম বলেনি। তবে এটুকু বলেছে, শরদিন্দু মিত্র আমার সঙ্গে দেখা করতে চান–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কারণ কাজটা ভীষণ জরুরি। তারপরই একটা ঠিকানা শুনিয়ে দিয়ে লাইন কেটে গেছে। জরুরি কাজটা যে কী তা আর জানা যায়নি। এখন জানা গেল।

আমার টেলিফোন নাম্বার সরকারি বইতে থাকে না। তবে যারা আমার সাহায্য চায় তারা ঠিক খোঁজখবর করে অভিজ্ঞ লোকজনের সূত্র ধরে আমার টেলিফোন নাম্বার জোগাড় করে ফেলে। আমাকে খোঁজ করার কারণ, এমন অনেক কাজ আমি করে দিই যা আইনসঙ্গত পথে গেলে চারগুণ সময় ও আটগুণ খরচ লেগে যাবে। সেদিক থেকে আমি হলাম ডিউটি ফ্রি শপ। আমি আইনমাফিক কাজ করি বেআইনি পথে। আইনমাফিক পথে বেআইনি কাজ করি না। নীচু মহলে কেউ-কেউ আমাকে প্রাইভেট আই বলে ডাকে। অবশ্য তাদের অনেকের মতে আমি বড় বেশি প্রাইভেট।

শরদিন্দু মিত্র এমন একজন লোক যার কখনও প্রাইভেট আই দরকার হয় না। বরং দরকার হলে প্রাইভেট আই ব্যাঙ্কে প্রচুর প্রাইভেট আই তিনি জমা দিতে পারেন। সুতরাং টেলিফোনের খবরটা আমাকে চিন্তায় ফেলেছিল। তবে খুশিও কিছুটা হয়েছিলাম। কারণ, এই প্রথম শরদিন্দু মিত্রের সঙ্গে অমিতাভ শিকদারের দেখা হবে। তাই দেরি না করে আজ সকালেই চলে এসেছি।

মিত্ৰসাহেব এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো চাইছেন আমি কিছু বলি। তাই সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রশ্নটাই করলাম। আপনার মতো একজন মেটাল মার্চেন্ট থাকতে হীরাকে খুঁজে দিতে আমার মতো সামান্য মানুষের ডাক পড়ল?

শরদিন্দু মিত্র হাসলেন : শিকদারবাবু, অনেক রকম মেটালের কারবার আমি করি– তারপর দাঁতের পাটি বের করে একটা রূপোলি দাঁতে সশব্দে টোকা মারলেন। বললেন, প্লাটিনাম। পাশে ঝুঁকে পড়ে একটা ড্রয়ার খুলে কী একটা বের করলেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছুঁড়ে দিলেন টেবিলের ওপরে। ইস্পাতের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষ হল। একটি ঋজু ফলার কুৎসিত ধারালো ছুরি। আবার ঝুঁকে পড়লেন। সোজা হলেন। টেবিলে সংঘর্ষের শব্দ। গাঢ় নীল রঙের একটা পিস্তল। বললেন, এসবও মেটাল–।

আমার কথায় মেটাল মার্চেন্ট-এর বাঁকা ইঙ্গিত বুঝতে ভুল করেননি মিত্রসাহেব।

মিস্টার শিকদার, কাজটা সামান্য বলেই আপনার মতো সামান্য লোককে তলব করেছি। আঙুলে তুড়ি বাজালেন শরদিন্দু মিত্র, হীরাকে আমি এখুনি তুলে আনতে পারি। কিন্তু আমি চাই

চুনিকে ওর চোখের সামনে কোতল করা হোক। খুদে, নজর, বা আর কাউকে পাঠালে চুনির মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। সেইজন্যেই আপনার সাহায্য চাইছি। সবরকম খবরাখবর আপনাকে আমি দিয়ে দেব। আপনি শুধু হীরাকে ফেরত নিয়ে আসুন। ওকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে চুনির কী হল না হল তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। তবে হীরার চোখের সামনে কিছু না হলেই হল। একটা গভীর শ্বাস পড়ল, বাচ্চা মেয়ে তো! তা ছাড়া ছোটবেলায় চুনির কোলেপিঠে করেই মানুষ হয়েছে।

ঘটনাগুলো আমার কাছে ঠিক স্পষ্ট হচ্ছে না। এ-পর্যন্ত শরদিন্দু মিত্রের কথাবার্তা শুনে যা অনুমান হয় তাতে হীরা একটি বাচ্চা মেয়ে এবং চুনি মিত্ৰসাহেবের বাড়ির চাকর। কিন্তু আসলে নিশ্চয়ই তা নয়। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ঘটনা ঘটেছে কাল বিকেলে–মিত্রসাহেব বলে চললেন, নজর মহম্মদ আপনাকে সমস্ত খবর-টবর দিয়ে দেবে। কোনওরকম অসুবিধে হলে ওকে বলবেন, ও-ই ব্যবস্থা করবে। বুঝতেই তো পারছেন, আমাকে বিজনেস নিয়ে সবসময় নাজেহাল হতে হয়, কত দিকে আর মাথা দেব।

পিছনের দরজার দিক থেকে শব্দ পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। খুদের সঙ্গে ছিপছিপে চেহারার একটি লোক এসেছে। ধারালো নাক-মুখ-চোখ। নিখুঁত পরিপাটি চাপদাড়ি। পরনে ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি। ওরা দুজন কাছে এগিয়ে আসছে।

ওই তো নজর এসে গেছে। শরদিন্দু মিত্র স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। তারপর আরামি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। তার ধবধবে চওড়া পাড় শৌখিন ধুতি চোখে পড়ল। আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে বললেন তিনি, শিকদারবাবু, পুলিশে আপনার তো চেনাজানা আছে। আশাকরি এ-ব্যাপারটা নিয়ে আমরা অযথা পুলিশি ঝাটে জড়াব না। তা ছাড়া আপনাকে দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ তো আমি করাচ্ছি না। শুধু আমার মেয়েকে ফেরত চাইছি। পুলিশের হাতে দায়িত্ব দিতে চাইনি একটাই কারণে। ওদের গদাইলশকরী তদন্তে চুনিকে হয়তো সাজা দেওয়া যাবে, কিন্তু হীরাকে হয়তো আর কোনওদিনই দেখতে পাব না। আপনার সম্পর্কে অনেক জানি, অনেক শুনেছি। তাই ভরসাও করি অনেক। শরদিন্দু হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমিও হাত বাড়ালাম। পাঁচটা শীতল কালসাপ আমার হাত জড়িয়ে ধরল। রুদ্ধস্বর কানে এল, হেল্প মি, শিকদার। হেল্প আ পুওর ড্যাড!

নজর ও খুদে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ করলাম, নজরের চোখ কটা। কটা নয়, বরং বলা যায় ভীষণ ফ্যাকাশে। হঠাৎ দেখলে চোখের মণি ঠাহর হয় না। চোখের সাদা অংশের সঙ্গে রং মিলিয়ে যেন গা-ঢাকা দিয়েছে।

শরদিন্দু মিত্র বসে পড়লেন। টেবিলের বাঁ দিকে ঝুঁকে পড়ে একটা ড্রয়ার খুললেন। সামান্য খোঁজাখুঁজির পর একটা প্লাস্টিক কভার ফাইল বের করলেন। আমার দিকে এগিয়ে দিলেন সেটা।

এগিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে একটু ইতস্তত ভাব ছিল। ফাইলটা নিয়ে প্লাস্টিকের মলাট ওলটাতেই বোধহয় তার কারণটা বোঝা গেল। ফাইলের সব লেখাই ইংরেজিতে টাইপ করা। সেই ইংরেজি পড়ে তার সঠিক অর্থ বুঝে নেওয়ার ব্যাপারটা আমার বিদ্যেয় কুলোবে কি না সেটাই বোধহয় মিত্রসাহেবকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল।

সুতরাং শরদিন্দু মিত্রের দুশ্চিন্তা দূর করতে হেসে বললাম, চিন্তা করবেন না, মিস্টার মিত্র। বাঙালির লেখা ভুল ইংরেজি আমি মোটামুটি বুঝতে পারি। ওটা না বুঝলে আপনাদের মতো রইস ক্লায়েন্ট জুটবে কোথা থেকে?

শরদিন্দু মিত্র বেশ চেষ্টা করেই নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেন। কিন্তু খুদের বুদ্ধি কম। বোধহয় বিদ্যেও। তাই ফস করে ধমকের সুরে বলে বসল, বসের সঙ্গে মুখ সামলে কথা বলবেন।

আমি শব্দ করে ফাইলটা বন্ধ করে খুদের দিকে তাকালাম। দাঁত বের করে হেসে বললাম, মিস্টার মিত্র, প্রভুভক্তির জন্যে এটার মাইনে এ-মাস থেকে পাঁচসিকে করে বাড়িয়ে দেবেন।

খুদে ওর মোটা বুদ্ধিতেও ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল। তেড়ে আসার ভঙ্গিতে এক পা এগিয়ে এল আমার দিকে। দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠল, আর একটা ফালতু আওয়াজ যদি বেরোয়।

আমি খুদের ঘামের গন্ধ পাচ্ছিলাম। নিশ্বাসের শব্দও। সুতরাং এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সপাটে এক চড় বসিয়ে দিলাম ওর বাঁ গালে।

ঘরে বাজ পড়ার শব্দ হল যেন। খুদের তামাটে গাল লাল হয়ে গেল। ও ধাক্কাটা সামলে নিয়েই হাত চালাতে গেল। কিন্তু ততক্ষণে আমি বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে শরদিন্দু মিত্রের টেবিল থেকে ইস্পাতের ছুরিটা তুলে নিয়েছি এবং তৈরি হয়ে দাঁড়িয়েছি। পিস্তলটা নিইনি, কারণ ওটাতে গুলি ভরা আছে কি না আমার জানা নেই।

খুদে যেন নেতাজির হুকুমে ফ্রিজ শট হয়ে গেল। আমার জীবনে এরকম বহু ফ্রিজ শট আমি দেখেছি। না দেখলে বয়েসটা চল্লিশ পর্যন্ত আর গড়াত না। সেই কোনকালেই নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বসে যেত।

আমার ছুরি ধরে দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে শরদিন্দু মিত্রের কালো মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল পলকের জন্যে। বুঝলাম, মিত্তিরমশাই জাতসাপ দেখলে চিনতে পারেন। চেনেন তার ফণা তোলার ঢঙ।

শুধুমাত্র নজর মহম্মদ নির্বিকার। যেন কটা চোখে অপলকে তাকিয়ে কাশ্মীরের সিনারি দেখছে।

খুদে! শরদিন্দু মিত্র গর্জে উঠলেন ভয়ংকর সুরে।

খুদের টানটান শরীরটা সঙ্গে সঙ্গে ঢিলেঢালা হয়ে গেল। আহত গালে কয়েকবার হাত বুলিয়ে ফোঁস-ফোঁস করে শ্বাস ফেলতে ফেলতে পিছিয়ে দাঁড়াল। তারপর আচমকাই ওর বাবার লেখা বর্ণপরিচয় থেকে শেখা খিস্তির ফুলঝুরির কয়েকটা ফুলকি উপহার দিল। লক্ষ করলাম, রাগে ওর মুখচোখ থমথম করছে এখনও।

আমি ছুরি ছুঁড়ে দিলাম টেবিলের ওপরে। বললাম, মিস্টার মিত্র, আপনার কথা বলা কুকুরকে একটু পিঠ চাপড়ে দিন। ভীষণ খেপে গেছে।

খুদে। আবার ডেকে উঠলেন শরদিন্দু। বুঝতে পারছিলাম, খুদের আচরণ ওঁর ভদ্রতার পোশাক টেনেহিঁচড়ে খুলে দিতে চাইছে।

তুই দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। মুখ দিয়ে যেন কোনও আওয়াজ না বেরোয়। শিকদারবাবু আমাদের গেস্ট–মেহমান। সেটা খেয়াল থাকে যেন।

লেজ গুটিয়ে চলে গেল খুদে। যাওয়ার সময় গজগজ করছিল আর মাথা নাড়ছিল।

নজর মহম্মদ দুটো হাত সামনে জড়ো করে রেখেছে। আঙুলে আঙুলে পাচানো। চোখ আধবোজা। মুখ শান্ত। মাথার চুল দু-এক গাছা কপালে।

নজর! শরদিন্দু গলার স্বর আবার মোলায়েম করে ফেলেছেন? মিস্টার শিকদারকে পাশের ঘরে নিয়ে যাও। নিরিবিলিতে বসে গোটা ব্যাপারটা ওঁকে বুঝিয়ে দাও। যেন কোনও গোলমাল হয়।

জি মিত্ৰসাব। বলে অভিবাদনের ভঙ্গিতে মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়ে আবার সোজা হল নজর। আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল, চলিয়ে শিকদারসাব, আপসমে বাত করতে হয়।

অতএব ফাইলটি বগলদাবা করে নজরকে অনুসরণ করলাম।

মিত্ৰসাহেব পিছন থেকে বললেন, উইশ ইউ বেস্ট অব লাক–।

আমি মুখ না ফিরিয়ে বাঁ হাতটা ওপরে তুলে ওঁর শুভেচ্ছা গ্রহণ করলাম। খুদেকে থাপ্পড় কষিয়ে আমার ডান হাতটা জ্বালা-জ্বালা করছিল। সুতরাং দরজা পার হয়ে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খুদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে ফেললাম, তোমার গাল এত খসখসে কেন গো? গালে কিরিম-টিরিম মালিশ করো না–।

খুদের মুখ থেকে একটা চাপা গরগর শব্দ শোনা গেল।

নজর পিছনে তাকিয়ে বলল, শিকদারবাবু, আমাদের সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে। কাজ হয়ে গেলে ঢের দিল্লাগি করা যাবে, কী বলেন!

আমি মনে-মনে একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ বলতে শুরু করলাম। রাগ কমানোর এ এক অব্যর্থ ওষুধ। ছোটবেলায় বাবার কাছে শিখেছি। এখন শেখানোর কেউ নেই। বাবা-মা দুজনেই বহুবছর ধরে দেওয়ালে ফটো হয়ে ঝুলছে। আমি বছরে দুটো মালা কিনি, ফটোয় লাগাই। আর সেই দিন দুটোয় কোনও খারাপ কাজ করি না। কাউকে দুঃখ দিই না। শুধু নিজে দুঃখ পাই। অন্ধকার নিঃঝুম ঘরে কোলের ওপরে চাঁদের আলো নিয়ে জানলার ধারে বসে থাকি। টেপরেকর্ডারের ক্যাসেটে নীচুস্বরে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান বাজতে থাকে, বুকে বিঁধতে থাকে তীব্রভাবে ও প্রথমত আমি তোমাকে চাই। দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই। তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই। শেষপর্যন্ত তোমাকে চাই…।

কিন্তু কাকে চাই আমি নিজেই জানি না।

.

ছিমছামভাবে সাজানো একটা বসবার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। ঘরের সর্বত্র রুচি ও পয়সার ছাপ। ভেলভেট মোড়া নরম যে-সোফায় বসলাম তার মধ্যেও কোমল বিলাসী আমন্ত্রণ।

বিশাল ঘরের তিন দেওয়ালে তিনটে পেইন্টিং। আর চতুর্থ দেওয়ালে সুন্দর ওয়াল ক্যাবিনেট। তার পাল্লা কাচের। তাই তাকে সাজানো কারণবারির বোতলগুলো চোখে পড়ছে। তার নীচে একপাশে ফ্রিজ।

দেখেশুনে মনে হয় এটা বোধহয় শরদিন্দু মিত্রের গোপন ব্যবসায়িক কথাবার্তার আপ্যায়নকক্ষ। যেমন এখন আমি আর নজর মহম্মদ ব্যবসায়িক আলোচনা করতে বসেছি।

আমি আর নজর মুখোমুখি বসে। মাঝের টেবিলে পড়ে আছে প্লাস্টিক কভার ফাইলটা। তার পাশেই কারুকাজ করা এক কাচের ফুলদানিতে রজনীগন্ধাগুচ্ছ।

আমি ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। হঠাৎই নজরের কথায় চমক ভাঙল।

শিকদারসাব, এই হল হীরা।

আমি চোখ ফিরিয়ে তাকালাম।

ফাইলের কোনও আনাচকানাচ থেকে পোস্টকার্ড মাপের একটা রঙিন ফটোগ্রাফ বের করে ফেলেছে নজর।

ছবির মেয়েটাকে দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। এত সুন্দরও কাউকে দেখতে হয়! টানা-টানা নিষ্পাপ চোখ। ধনুকের মতো ভুরু। তার মাঝে সবুজ এক চিলতে টিপ। তার নীচ থেকেই কোমল রেখায় নেমে গেছে নাক। নাকের বাঁ দিকে হীরের নাকছাবি। তারপর স্ফুরিত আমন্ত্রণী ঠোঁট এবং মানানসই চিবুক।

ফটোটা গলার খানিক নীচেই শেষ হয়েছে। কিন্তু কোনও পুরুষকে প্রতিবন্ধী করে দেবার পক্ষে তাই যথেষ্ট। যেমন, আমি এখন বোবা হয়ে গেছি।

আমি বললাম, ফটোটা আমার লাগবে।

নজর হাসল। এই প্রথম ওর শান্তশিষ্ট ভদ্রতার মুখোশ সামান্য সরে গেল যেন। ও বলল, শুধু ফটো কেন, ইচ্ছে করলে এই গোটা ফাইলটাই আপনি নিতে পারেন।

হীরার ফটোটা হাতে নিয়ে দেখতে-দেখতে আমি বললাম, এবারে গোটা গল্পটা আমাকে বলুন। তার পরে ফাইল দেখছি–

নজর বলতে শুরু করল, চুনিবাবু, মানে চুনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের মেটাল কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজার। আজ প্রায় পনেরো বছর ধরে চাকরি করছে। কোম্পানি তখন ছোট ছিল। ডান হাতটা শূন্যে নেড়ে ঘরটাকে দেখিয়ে নজর বলল, এসব ঠাটবাট কিছুই ছিল

আমার চোখ গেল কারণবারিক্যাবিনেটের দিকে। বললাম, নজরসাব, ওগুলো কি শুধু চোখে দেখার জন্যে, না চেখে দেখার জন্যে।

নজর মহম্মদ তৎক্ষণাৎ গুস্তাখি মাফ বলে উঠে পড়েছে সোফা ছেড়ে, এবং এগিয়ে গেছে কাবিনেটের দিকে। সেখান থেকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে আমাকে, আপনার পসন্দ কী আছে বলুন?

আমি ঠোঁট উলটে কাঁধ কঁকালাম। যার অর্থ যা তোক কিছু একটা হলেই চলবে। মদ আর অস্ত্রের ব্যাপারে আমার খুব একটা বাছবিচার নেই।

এরপর সুন্দর কাচের গ্লাসে বরফ ডোবানো মদিরা নিয়ে বসে পড়েছি আমি আর নজর মহম্মদ মুখোমুখি।

নজরের কাছ থেকে গল্পটা যা জানা গেল তা সংক্ষেপে এই

চুনিবাবু হীরাকে ছোটবেলা থেকে দেখছে। আর কোম্পানির প্রায় শুরু থেকেই মিত্ৰসাহেবের ডান হাত হয়ে কাজ করে গেছে। শরদিন্দু মিত্রের বিপদে-আপদে চুনি ব্যানার্জি যা করেছে তা ভোলার নয়। মিত্ৰসাহেবও ওকে খুব স্নেহ করেন–অন্তত করতেন, হীরাকে নিয়ে ভেগে পড়ার আগে। হীরা মিত্রসাহেবের চোখের মণি। তাঁর মেটাল বিজনেসের রাজত্ব আর রাজকন্যা কার হাতে তুলে দেবেন তা ঠিক না করলেও, সেই ভাগ্যবান যে চুনি বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, সেটা বোধহয় তিনি ঠিক করে ফেলেছিলেন। তাই যখন টের পেলেন চুনির সঙ্গে হীরার আশনাই চলছে, তখন বিরক্ত হয়েছিলেন, রেগেও গিয়েছিলেন। তারপর একদিন নজর আর খুদের সামনে চুনিকে একা ডেকে শাসিয়েছিলেন। শরদিন্দু মিত্রের শাসানিকে ভয় পায় না এমন লোক খুব বেশি নেই। চুনি ভয় পেয়েছিল। কিন্তু হীরাকে না পাওয়ার ভয়টা ছিল আরও বেশি। তাই কেঁদেকেটে বলেছিল, আপনার ব্যবসা চাই না, একটা ফুটো পয়সাও চাই না, শুধু হীরাকে চাই। ওকে আমি, আমি…।

শরদিন্দু মিত্র চুনির অনুনয়ে কান দেননি। শক্ত গলায় বলেছিলেন, চুনি, তোমাকে আমি পছন্দ করি। তোমার উপকার আমি ভুলিনি, কখনও ভুলি না। তাই এখনও তুমি দেখতে পাচ্ছ, সূর্য উঠছে, পাখি ডাকছে, চঁদ উঠছে। নইলে এসব কিছু দেখতে পেতে না। আর তোমাকে কোম্পানি থেকে এক্ষুণি তাড়িয়ে দিতেও চাইছি না।

কিন্তু এত সাবধান করা সত্ত্বেও কাজ হয়নি। লায়লা-মজনু, শিরি-ফরহা, হীরা-রাঞ্জার বেলাতেও কোনওরকম হুঁশিয়ারিতে কোনও কাজ হয়নি। তাই গতকাল সকাল থেকে হীরা– মিত্রসাহেবের কলিজা হীরালোপাট। সেই সঙ্গে চুনিবাবুও। ব্যস, দুয়ে দুয়ে চার।

ঘরের কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি পাঁচ কান করতে চান না শরদিন্দু মিত্র। আর চুনিকে খতমও করতে চান না–অন্তত হীরার চোখের সামনে। তাই পুলিশে যাননি। নজর, খুদে, বা ওদের মতো কাউকেও দায়িত্ব দেননি। ডেকেছেন অমিতাভ শিকদারকে। যে-লোকটা রোজ চারটে রিভলভার আর সাতটা স্টিলেটো দিয়ে ব্রেকফাস্ট খায়।

নজর মহম্মদের গল্পটায় কোথায় যেন একটা গোলমাল ছিল। কী একটা যেন ঠিকঠাক খাপ খাচ্ছে না, মিলছে না মোটেই। ব্যাপারটা তখনকার মতো মগজ থেকে সরিয়ে রেখে ফাইলের দিকে মনোযোগ দিলাম।

চুনিবাবুকে আমি দোষ দিই না। হীরার জন্যে যে-কোনও মোকাবিলায় নেমে পড়া যায়। জান কবুল সেই লড়াইতে নেমে কখনও খেয়াল হয় না, জান তো একটাই।

ফাইল থেকে একটার পর একটা কাগজ নিয়ে নজর আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। চুনির একটা ফটোও দেখাল আমাকে।

চুনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বয়েস চল্লিশের ওপারে। তবে দেখে বছর পাঁচ-সাত কম বলেই মনে হয়। ফরসা চেহারা। চোখে রিমলেস-চশমা। চোয়াল শক্ত। খাড়া নাক। চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। ডান গালে চোখে পড়ার মতো একটা তিল।

আশ্চর্য! এই লোকটা ওর আধা বয়েসের একটা ছুকরির জন্যে দিওয়ানা হয়ে গেল! অবশ্য হীরার ছবি দেখলে বোঝা যায় যে-কোনও বয়েসের পুরুষই ওর জন্যে দিওয়ানা হয়ে যেতে পারে।

সব দেখা-টেখা যখন শেষ হল তখন আমি জিগ্যেস করলাম, আমি কোথা থেকে ওদের তুলে নিয়ে আসব?

নজর মহম্মদ বলল, হোটেল রিভারভিউ, ডায়মন্ডহারবার। ওরা ওখানে ঘর ভাড়া নিয়ে আছে। রুম নম্বর দুশো তিন।

আমি অবাক চোখে নজরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক ঢোকে গ্লাসের বাকি মদটা শেষ করে দিয়ে বললাম, নজরসাব এই কাজের জন্যে আমাকে ডেকেছেন! আবার পয়সাও দেবেন। সত্যি, বিশ্বাস হচ্ছে না–।

নজর ওপর দিকে চোখ তুলে হাত নেড়ে বলল, খুদা যব দেতা হ্যায়, ছপ্পড় ফাড় কর দেতা হ্যায়। খুদা মেহেরবান, তো ঢুহা পহেলবান।

আমি কোনও জবাব না দিয়ে হীরা আর চুনির ফটো দুটো তুলে নিলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, এবার মিত্রসাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করব।

অতএব নজর আবার আমাকে নিয়ে চলল শরদিন্দু মিত্রের ঘরে।

ঘরের দরজার মুখে খুদে এখনও দাঁড়িয়ে। দাঁত খুটছে। আমাকে চোখ টেরিয়ে দেখল, কিন্তু কিছু বলল না।

শরদিন্দু মিত্র টেলিফোনে কথা বলছিলেন কার সঙ্গে। টেবিলের ওপরে একটা ফাইল খোলা। আমাকে দেখে সপ্রশ্নে তাকালেন নজরের দিকে। নজর তার হাতের ফাইলটা টেবিলে রেখে বলল, শিকদারবাবু সিরফ ফটো দুটো নিয়েছেন।

শরদিন্দু আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বসতে বললেন চোখের ইশারায়।

আমি বসলাম। টেলিফোনে কথা শুরু হল আবার। শরদিন্দুর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম আমি এবং নজর। উনি ফোনে বলছিলেন, না, না, ব্যাপারটা নিয়ে আমি অকারণে পাঁচকান করতে চাই না। শুধু চাই হীরা আর চুনি মঙ্গলমতো ফিরে আসুক। আমি ওদের দুজনকেই ভালোবাসি, স্নেহ করি। আমি ওদের আশীর্বাদ করার জন্যে অপেক্ষা করছি। কে জানে, কবে ফিরবে ওরা… একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তার একটু পরেই ফোন রেখে দিলেন শরদিন্দু।

আমার চোখে সরাসরি চোখ রেখে বললেন, সব বুঝে নিয়েছেন, মিস্টার শিকদার?

আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম, হ্যাঁ। তারপর হীরা আর চুনির ফটো দুটো ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, এগুলোর পেছনে সই করে তারিখ দিয়ে দিন।

শরদিন্দু হীরার ফটোটা গভীর আবেগমাখা চোখে দেখছিলেন। প্রায় চমকে উঠে বললেন, কেন, সই করব কেন?

আমি হাসলাম। অনেক বুদ্ধিমান মানুষও অনেক সময় ছেলেমানুষের মতো প্রশ্ন করে। ওঁকে বললাম, আপনার সই-ই হচ্ছে হীরা আর চুনির কাছে আমার আইডেন্টিফিকেশান। আমি বেপরোয়া কাজ করি বটে, তবে বুরবাক নই।

ওঁর কালো মুখ কি বেগুনি হল একটু? স্বচ্ছন্দে হোক। শুধু বেগুনি কেন, শরদিন্দু ইচ্ছে করলে বেগুনি থেকে শুরু করে বর্ণালীর বাকি রংগুলোও পরপর ফুটিয়ে তুলতে পারেন ওঁর মুখে, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

হঠাৎই গম্ভীর ভাবটা পালটে ফেললেন শরদিন্দু। হাসলেন। ওঁর প্লাটিনামের দাঁত দেখা গেল। বললেন, মিস্টার শিকদার, মনে হচ্ছে লোক চিনতে আমি ভুল করিনি। হীরাকে আমার চাই। ওকে ছেড়ে আমি একটা মুহূর্তও থাকতে পারছি না।

তারপর খসখস করে সই করে দিলেন। ফটো দুটো এগিয়ে দিলেন আমার দিকে।

এবার টেবিলের বাঁ দিকের ড্রয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়লেন শরদিন্দু। একটু পরেই একশো টাকার নোটের একটা বান্ডিল আলতো করে ছুঁড়ে দিলেন টেবিলের ওপরে। দশহাজার। বললেন, এটা আপনার পারিশ্রমিক নয়, মিস্টার শিকদার, স্রেফ রাহাখরচ। পারিশ্রমিক আপনাকে দেব হীরাকে হাতে পাওয়ার পর। শরদিন্দু মিত্রের কথার নড়চড় হয় না।

আমি ফটো দুটো নিলাম, টাকার বান্ডিলটাও। পকেটে রাখলাম।

আপনার যদি গাড়ির দরকার হয় বলুন, নজর সব ব্যবস্থা করে দেবে–

আমি বললাম, দরকার নেই। আমার একটা ছোট প্রিমিয়ার পদ্মিনী আছে। আপনাদের মতো ক্লায়েন্টদের সহযোগিতায় কেনা। ওটা দিয়েই কাজ চলে যাবে। একটু থেমে আবার বললাম, সত্যিই কি হীরাকে আপনার কালকের মধ্যেই চাই?

কেন, পারবেন না? ভুরু কুঁচকে গেল শরদিন্দুর।

হয়তো পারব, তবুও একটা দিন বেশি চাইছি।

বেশ। এখন সবই আপনার হাতে–। একটু থেমে আরও বললেন, নজর আপনাকে দুটো আনলিস্টেড ফোন নাম্বার দিয়ে দেবে। কোনও জরুরি খবর থাকলে ওই নাম্বারে ফোন করতে পারেন।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। ঘরের দরজার দিকে পা বাড়ালাম।

শরদিন্দু পিছন থেকে ডাকলেন, মিস্টার শিকদার–।

আমি থমকে দাঁড়ালাম। ঘুরে তাকালাম।

শরদিন্দু বললেন, মেটাল মার্চেন্ট হিসেবে আর কোনও সাহায্য করতে পারি?

যথারীতি মেটাল শব্দটার ওপরে জোর দিয়েছেন শরদিন্দু।

আমি হাসলাম। পুরোনো কথাটাই বললাম, ধন্যবাদ, তার দরকার হবে না। আমি রোজ একডজন আর্মস দিয়ে ব্রেকফাস্ট খাই।

বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে। সঙ্গে নজর মহম্মদ। এবং দরজার কাছে আবার সেই খুদে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁত খুঁটছে। দাঁত ছাড়া বোধহয় খোঁটার মতো আর কিছু ওর নেই।

রাস্তায় বেরিয়ে যখন গাড়িতে উঠছি তখন আনলিস্টেড কোনও নাম্বার দুটো নজর মহম্মদ আমাকে দিল। ডান হাত আদাবের ভঙ্গিতে দুবার নেড়ে বলল, ফির মিলেঙ্গে, শুকরিয়া।

আমিও ওকে পালটা অভিবাদন জানিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। চারপাশে যানবাহনের কোলাহলে বোঝা যায় বেলা বেড়েছে। রাস্তায় লোকজনও প্রচুর। যে যার কাজে ব্যস্ত।

গাড়ি চালিয়ে কিছুটা এগোতেই হীরার মুখটা মনে পড়ল। অপরূপ ওই মেয়েটা এখন কী করছে, কেমন অবস্থায় আছে? আর তখনই লক্ষ করলাম, একটা সাদা মারুতি আমার গাড়ির প্রায় ছায়া হয়ে গেছে।

আমার হাসি পেল। এরকম টিকটিকির লেজ হেঁটে ফেলতে আমার বেশ মজা লাগে।

.

ডায়মন্ডহারবার রোডে মিনিট পঁয়তাল্লিশ গাড়ি চালানোর পর তাকালাম রিয়ারভিউ মিরারের দিকে। টিকটিকির লেজ ছেটে ফেলতে রিয়ারভিউ মিরারের উপকারিতার কোনও জবাব নেই।

বর্ষা চলছে। তাই রাস্তার দুপাশে প্রকৃতি সবুজ জামা-প্যান্ট পরে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে টুকরো দু-একটা দোকানপাট অথবা ছন্নছাড়া কঁচা-পাকা বাড়ি।

চায়ের তেষ্টা পাচ্ছিল। তাই রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকানের কাছে গাড়ি দাঁড় করালাম। গাড়ি থেকে নেমে বেঞ্চিতে বসে এক কাপ চায়ের কথা বললাম।

কানটা মাপে বড়সড় হলেও নিতান্ত ঝোঁপড়ি। মালিকের বয়েস দেখে মনে হয় ছশো নিরেনব্বই বছর। চলাফেরার সময় যে কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠকাঠক শব্দ করে যখন-তখন খসে পড়তে পারে। তারই হুকুমে এক ছোকরা এক গ্লাস চা দিয়ে গেল আমাকে।

চায়ে প্রথম চুমুক দিতেই পায়ের কাছে একটা ছায়া দেখতে পেলাম। কে যেন আমার খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কালো প্যান্ট পরা একজোড়া পা। পায়ে স্নিকার।

আকাশ মেঘলা। একটু আগে পথে ঝিরঝিরে বৃষ্টি পেয়েছিলাম, যদিও এখন নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আবছা ছায়াটা আলাদা করে চিনতে পারলাম আমি। চায়ের গ্লাস থেকে মুখ না তুলে, ছায়ার মালিকের দিকে না তাকিয়ে আমি আন্দাজ করতে চেষ্টা করলাম, কে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে।

চায়ের দোকানে দ্বিতীয় খদ্দের বলে কেউ নেই। তবে সামনের পাকা রাস্তায় কদাচিৎ লোকজন চলাফেরা করছে, কয়েকটা গাড়িও ছুটে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে।

প্রায় দশ সেকেন্ড কেটে গেল চুপচাপ। তারপর একটা ভরাট গলা বলে উঠল, মিস্টার শিকদার, কোথায় যাচ্ছেন? হোটেল রিভারভিউ?

আমার দেখা ছায়ার কণ্ঠস্বর। এ-গলা আমি আগে কখনও শুনিনি।

গ্লাসের চা মোটামুটি গরম। সুতরাং প্রথম ধাপ হিসেবে সেটা এই কালো প্যান্টের মুখে ছুঁড়ে দেওয়া যায়। তারপর শরীরের দুর্বলতম জায়গা লক্ষ্য করে কষিয়ে বুটের এক লাথি। ব্যস, ততক্ষণে মক্কেল ভার্টিকাল অবস্থা থেকে হরাইজন্টাল অবস্থায় পৌঁছে যাবে। সুতরাং তারপর ওর শরীরের ওপরে ফ্রি স্টাইল চালানো যেতে পারে।

মানুষ যা ভাবে সবসময় তা করে না। আমিও করলাম না। একবার মনে হল, এটা সেই সাদা মারুতির কেউ নয়তো! তা ছাড়া লোকটা আমার নাম জানল কেমন করে? শরদিন্দু মিত্র কি একে পাঠিয়েছে আমার ওপরে নজর রাখার জন্যে?

অবশেষে মুখ তুলে তাকালাম।

বছর তিরিশের এক যুবক। কিন্তু মাথায় চুল বিরল। চোখ ছোট। তামাটে গালে ছোট মাপের একটা পুরোনো ক্ষতের দাগ। পরনে চেকশার্ট। তাতে লাল আর সবুজ ডোরা।

যুবক হাসছিল। আমি কিছু বলার আগেই বসে পড়ল আমার পাশে। বলল, মিস্টার শিকদার, হীরার খোঁজে আপনি না গেলেই ভালো হয়।

ছেলেটি বোধহয় আমার স্থানীয় অভিভাবক। আমার ভালোমন্দ নিয়ে ভাবছে। চমৎকার!

আমি চায়ের গ্লাস নামিয়ে রাখলাম ভিজে মাটিতে। মুখের ভাব যথাসম্ভব মোলায়েম রেখে জিগ্যেস করলাম, আপনি কে? মিত্তিরের চামচে?

যুবকের মুখ শক্ত হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনিও তো এখন তাই।

আমি নড়েচড়ে বসলাম। এরকম মোকাবিলায় মজা আছে। অমিতাভ শিকদার মোকাবিলায় মজা পায়।

যা বলার চটপট বলে ফেলুন। আমাকে এক্ষুনি রওনা দিতে হবে।

ছেলেটা এবার সিরিয়াস মুখ করে বলল, হীরাকে নিয়ে চলে গিয়ে চুনিদা কোনও অন্যায় করেনি। ওদের মোহাব্বত আছে। শরদিন্দু মিত্তির মোহাব্বতের কী বুঝবে! ও শালা তো বউকে পুড়িয়ে মেরেছিল– ছেলেটার মুখ ঘেন্নায় কুঁচকে গেল।

এই মুহূর্তে শরদিন্দু মিত্রের জীবনী জানার কোনও আগ্রহ নেই আমার। সুতরাং কোনও মন্তব্য না করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ছেলেটা হাতের ঝাপটায় বাতাস কাটার ভঙ্গি করে বলল, আপনি যদি ফিরে না যান তা হলে চুনিদা আপনাকে ছেড়ে দেবে না। চুনিদা বহুত খতরনাক লোক। আপনি এসব ফ্যামিলির ঝামেলায় নাক গলাবেন না। ছেলেটা আঙুলে তুড়ি বাজাল দুবার। বলল, মিত্তিরের ওখানে আমাদের লোক আছে। সব খবরই আমরা পাই। সুতরাং সময় থাকতে থাকতে হাপিস হয়ে যান। ন-দো গিয়ারা। ফুটটুস…।

আমি হঠাৎই হাসতে শুরু করলাম। গলা ফাটানো হাসি।

হাসি দেখে চুনি ব্যানার্জির চামচে এবং আমার লোকাল গার্জেন কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আর চায়ের দোকানের মালিক চমকে নড়েচড়ে বসল। ওর হাড়ে হাড়ে খটাখট শব্দ হল।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। ঢোলা জিসের প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালাম। হাতটা যখন মুঠো করে বের করে নিয়ে এলাম তখন তার সঙ্গে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন মিলিটারি অ্যান্ড পুলিশ মডেলের দুটো রিভলভার বেরিয়ে এল। মাত্র দুইঞ্চি ব্যারেলের এই হ্যান্ডগান ০.৩৮ স্পেশাল কার্ট্রিজ ফায়ার করতে পারে। বন্দুকবাজের সঙ্গে মোকাবিলায় এই খুদে রিভলভার ভীষণ কাজের। এর এক-একটার ওজন মাত্র পাঁচশো গ্রাম। আধুনিক ধাতুবিজ্ঞান এই রিভলভারকে একইসঙ্গে মাপে ছোট এবং ক্ষমতাশালী করে তুলতে পেরেছে।

ছেলেটার মুখের রক্ত পলকে মঙ্গলগ্রহে চলে গেল। ওর চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। আর বাঁ গালের একটা পেশি কেঁপে উঠতে লাগল বারবার।

রিভলভার দুটো আমি বেঞ্চির ওপরেই রাখলাম। তারপর হাসতে হাসতেই প্যান্টের অন্য পকেটে হাত ঢোকালাম।

ছেলেটা এবার স্পষ্ট কেঁপে উঠল থরথর করে। বলল, মিস্টার শিকদার, আমি– আমি–।

আমি হেসে বললাম, আমি রোজ রিভলভার চেটে দেখি, চুষে দেখি, কামড়ে দেখি, চুমু খেয়ে দেখি–।

বলে একটা রিভলভার তুলে নিয়ে চুমু খেলাম। মিষ্টি শব্দ হল। ওকে বললাম, তোকে আজকের মতো ছেড়ে দিলাম। যা, মাঠে গিয়ে হা-ডু-ডু খেল।

ছেলেটা ফ্যাকাশে মুখে দৌড়ে পালাল। আমি ওকে দেখলাম কিছুক্ষণ।

আমার খবর ছেলেটা পেল কেমন করে? কে খবর দিল ওকে? আর চুনি ব্যানার্জি কি সত্যিই ভয়ংকর লোক? কতটা ভয়ংকর? শরদিন্দুর সঙ্গে কি পাল্লা দিতে পারবে সে?

আর হীরা! অষ্টাদশী ওই অপরূপ সুন্দরী কি সত্যিই ভালোবাসে চুনিকে? নাকি জটিল কোনও সমীকরণ লুকিয়ে রয়েছে এর আড়ালে?

রিভলভারগুলো আবার পকেটে রাখলাম।

শরদিন্দু মিত্র ছেলেখেলা করার জন্যে আমাকে ডাকেননি। এখন ছেলেখেলার সময় নয়। আমাকে আরও সাবধান হতে হবে।

চায়ের দোকানির দিকে চোখ পড়তেই দেখি বৃদ্ধ দু-হাঁটুর ফাঁকে মাথা গুঁজে বসে। বোধহয় ঠিক করেছে, একটু আগের দেখা অশ্লীল দৃশ্য জীবনে আর দেখবে না। অবশ্য এর জীবন বলতে আর কয়েকটা দিনও বাকি আছে কি না কে জানে!

চায়ের পয়সা মেটালাম একটা দু-টাকার নোট দিয়ে। বাচ্চা ছেলেটা কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছিল। ছুটে এসে টাকাটা নিল। ওকে জিগ্যেস করলাম টাক মাথা ছেলেটাকে চেনে কি না। কালো বাচ্চাটা মাথা নাড়ল। না, কোনওদিন দ্যাখেনি।

গাড়িতে উঠে স্পিড বাড়ালাম। নাঃ, নাটক মনে হয় জমে উঠেছে। জানি না সামনে এখন কী অপেক্ষা করছে।

.

ডায়মন্ডহারবারের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে বুঝলাম, আমার জন্যে একটা লাশ অপেক্ষা করছিল। এবং সেই লাশের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার হল রীতিমতো নাটকীয়ভাবে।

লাল রঙের মারুতি ওমনিটা ছুটে আসছিল আমাকে লক্ষ করে। আর ছুটে আসার পথে বিপজ্জনকভাবে টলছিল এপাশ ওপাশ।

এক লহমার জন্যে আমার মনে হয়েছিল কোনও সেন্ট পারসেন্ট মাতাল বেলা সাড়ে বারোটায় এই ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালানো প্র্যাকটিস করছে। কিন্তু গাড়িটা আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতেই–অথবা বলা যেতে পারে, আমি কোনওরকমে ওটাকে পাশ কাটিয়ে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়েছি, আর একইসঙ্গে আমার গাড়ির চাকা ভয়ঙ্কর আর্তনাদ তুলে পিচের রাস্তা ছেড়ে পাশের কাদামাটিতে গভীর ছাপ ফেলে টাল খেয়ে আবার উঠে এসেছে রাস্তায়। তবুও যা দেখার তা ওইটুকু সময়ের মধ্যেই দেখে নিয়েছি।

ওমনি গাড়িটা চালাচ্ছে একজন মাঝবয়েসি লোক। মাথায় কঁচাপাকা চুল। জামায় লাল রঙের ছোপ। আর গাড়ির পেছনের কাঁচে কয়েকটা ফুটো, সেগুলোকে ঘিরে মাকড়সার জালের মতো চিড় খাওয়া হিজিবিজি।

আর গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কী ভেবে গাড়ি থামিয়ে দিলাম একেবারে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে লাল ওমনিটা দেখতে লাগলাম।

ফঁকা রাস্তায় এলোমেলোভাবে ছুটে মিলিয়ে যেতে-যেতে গাড়িটার ড্রাইভার বোধহয় মত পালটাল। কারণ গাড়িটা রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে সোজা মুখ থুবড়ে পড়ল পাশের নালায়। সেখানকার ঝোঁপঝাড় আগাছার মধ্যে গাড়িটার শতকরা সত্তরভাগই ঢাকা পড়ে গেল।

না, আর দেরি নয়। আমার একটা স্বভাব হচ্ছে সব সময় পরের ব্যাপারে নাক গলানো। এই স্বভাবটা বোধহয় জন্মগত কিংবা জন্মের আগে থেকেই। আর সেইজন্যেই নাকটাও কি একটু বেশি চোখা?

অতএব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ইউ বাঁক নিয়ে পৌঁছে গেলাম অকুস্থলে। গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গেলাম ওমনির দিকে। অনুভূমিক রেখার সঙ্গে প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণ করে গোঁত্তা খেয়ে থমকে রয়েছে গাড়িটা। গাছপালা আগাছা সরিয়ে চলে গেলাম ড্রাইভারের দরজার কাছে। দরজা খুলতেই লোকটা হেলে পড়ল আমার দিকে। আমি চট করে একহাতে ওর দেহটা ঠেলে ধরলাম। নইলে আমার জামা-প্যান্টের বারোটা বেজে যেত।

একটু আগে জামায় লাল ছোপ নজরে পড়েছিল। এখন দেখলাম বেচারা একেবারে হোলি খেলে উঠেছে। লাল রঙের হোলি। বোধহয় অন্য কোনও রং দোকানে ছিল না।

গাড়ির পেছনের কাছে অন্তত চারটে ফুটো আমার নজরে পড়ল। আর লোকটার পিঠে দুটো, পেটের কাছে একটা। অভিজ্ঞতা বলছে, যে দুটো গুলি ওর গায়ে বিঁধেছে তার মধ্যে অন্তত একটা ওর দেহকে এফেঁড়-ওফেঁড় করে দিয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই ভেবেছি, ভারতের জনসংখ্যা এক কমে গেছে এবং বাকি জনগনের মাথাপিছু জমি ও খাদ্য অনেকটা করে বেড়ে গেছে। কিন্তু আমার রাষ্ট্র-উন্নয়নের চিন্তা ধাক্কা খেল একটা অস্ফুট আর্তনাদে।

আর্তনাদটা বেরিয়ে এসেছে লালুর–মানে, ওই লালজামার মুখ থেকেই। সঙ্গে সঙ্গে আমার কৌতূহল একশো তেরো গুণ বেড়ে গেল। খরচা খাতায় ফেলা লোকটাকে মনে মনে ঝট করে জমার খাতায় ফেলে ঝুঁকে পড়লাম ওর মুখের কাছে। অনেকটা চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলাম, আপনার নাম কী? কী করে এরকম হল?

লালুর ঢলে পড়া মাথা নড়ল সামান্য। ক্লান্ত ঠোঁট ফাঁক হল। বলল, ডাক্তার…হসপিটাল.. আমাকে বাঁচান…।

আমি ওর নাড়ি দেখলাম, নাঃ যা ভেবেছি তাই। ওর এখন ডাক্তার বা হাসপাতালের কোনও প্রয়োজন নেই। শুধু ডোমের প্রয়োজন–পোস্ট মর্টেমের জন্যে।

সুতরাং চিৎকার করে আবার একই প্রশ্ন করলাম। তখন মাথা তোলার চেষ্টা করে বিড়বিড় করে লোকটা বলল, মিত্র..শরদিন্দু মিত্র…।

তারপরই ওর মাথাটা আঁকুনি খেয়ে ঢলে পড়ল।

শরদিন্দু মিত্র? এটা নিশ্চয়ই আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর নয়। তা হলে কি দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর?

লোকটার নাড়ি দেখলাম আবার। নেই। মুনিয়া উড়ে গেছে দুনিয়া ছেড়ে। মনে-মনে একবার বলো হরি, হরিবোল– বলে মৃতদেহটা ঠেলে দিলাম গাড়ির ভেতরে। ওটা সিটের ওপরে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। তখন কী ভেবে খুব সাবধানে লোকটার পকেট হাতড়ালাম। কিছু টাকা-পয়সা আর কাগজপত্র পাওয়া গেল। টাকা মাটি, মাটি টাকা। অতএব কাগজপত্রের ওপরেই নজর বুলিয়ে নিলাম। দু-একটা ক্যাশমেমো আর মিত্রসাহেবের একটা ভিজিটিং কার্ড। কার্ডটা দুমড়ে গেছে। কার্ডের পেছনদিকে দুটো ফোন নাম্বার লেখা। দেখে চিনতে পারলাম। নজর মহম্মদ আমাকে এই দুটো ফোন নাম্বারই দিয়েছিল। অবাক হলাম। অমিতাভ শিকদারের মতো আরও কজনকে একই কাজে লাগিয়েছেন শরদিন্দু মিত্র? নাকি আমার বোঝার ভুল? হতে পারে এই লোকটা হয়তো শরদিন্দু মিত্রের পরিচিত ব্যাবসার সূত্রে চেনা। সে যাই হোক, কার্ডটা আমি পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম। আর তারপরই একটা ক্যাশমেমো আমার নজর টানল। রেস্তরাঁয় খাওয়ার ক্যাশমেমো। ব্লু গার্ডেন রেস্তোরাঁ। কেয়ার অফ হোটেল রিভারভিউ, ডায়মন্ডহারবার। ক্যাশমেমোতে আজকেরই তারিখ। সুতরাং ক্যাশমেমোটাও পকেটে চালান করে দিলাম। তারপর গাড়ির দরজাটা বন্ধ করে উঠে এলাম রাস্তায়। পুলিশে একটা খবর দিতে হবে।

রাস্তার এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে কোনও ভরসা পেলাম না। সুতরাং ঠিক করলাম, হোটেল রিভারভিউ থেকেই ফোন করা যাবে থানায়। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আমি চাকরি করেছিলাম কলকাতা পুলিশে। সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি প্রায় সাড়ে আট বছর। কিন্তু মাথা থেকে পুলিশি কর্তব্যবোধটা এখনও একেবারে মুছে ফেলতে পারিনি।

অতএব গাড়িতে স্টার্ট দিলাম আবার। তারপর গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে সোজা হোটেল রিভারভিউ। হীরাকে খুঁজে আনার সামান্য কাজে এত জটিলতা লুকিয়ে থাকবে একথা কে ভাবতে পেরেছিল!

.

হোটেল রিভারভিউতে রিভার আর ভিউ দুই-ই আছে। ডান দিকে হুগলি নদী। বর্ষায় জল থইথই। সেদিক থেকে ভেসে আসছে জোলো বাতাস। নদীর পাড়ে, কিছুটা দূরে-দূরে, কয়েকটা গাছ। বাতাসে দুলছে। তার সামনে খানিকটা খোলা মাঠ-ঘাসে ছাওয়া। সেখানে কয়েকজন মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে।

বাঁদিকে উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা হোটেল এলাকা। তারই মাঝে বিশাল লোহার দরজা। দরজার দুপাশে আধুনিক স্থাপত্যের কারুকাজে হোটেলের নাম লেখা। সঙ্গে বাতিস্তম্ভ।

দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে মোরাম বিছানো পথ। আর তার খানিকটা দূরেই চারতলা হোটেল বিল্ডিং। সেখানেও আধুনিক ছাঁদ। চেহারাতেই বোঝা যায়, এ-হোটেল আমজনতার জন্যে নয়।

দরজার কাছে গাড়ি নিয়ে যেতেই উর্দি পরা দারোয়ান দরজা খুলে স্যালুট ঠুকল। গোঁফওয়ালা গোবেচারা লোকটার হাতে একটা দশ টাকার নোট তুলে দিয়ে জিগ্যেস করলাম, একটু আগে একটা লাল রঙের মারুতি ওমনি এখান থেকে বেরিয়েছে কি না।

লোকটা ইতস্তত করছিল। হয়তো জরুকে জিগ্যেস না করে ও কারও কথার জবাব দেয় না। আমি আর-একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম। ভারতীয় টাকার ঘন-ঘন অবমূল্যায়নে দশ টাকার এখন তেমন একটা দাম নেই–অন্তত লুব্রিকেশানের কাজে। তবে বিশ টাকায় কাজ হল। লোকটা জরুর আদেশের অপেক্ষা না করেই বলল, হ্যাঁ, একটা লাল মারুতি ওমনি গাড়ি সে বেরোতে দেখেছে। তবে ওইটুকুই, তার বেশি কিছু জানে না।

আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। গাড়ি চালিয়ে মোরামের ওপর দিয়ে কচর-মচর শব্দ করতে করতে সোজা হোটেল বিল্ডিং-এর দিকে এগিয়ে গেলাম।

হোটেলের পেছনদিকে বিরাট খোলা জায়গা। সেখানেই কার পার্ক। কিন্তু এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে কোনও অ্যাটেনড্যান্টকে চোখে পড়ল না। কার পার্কে গাড়ি রেখে এসে প্রকাণ্ড কাচের দরজা ঠেলে হোটেলের অভ্যর্থনাকক্ষে ঢুকলাম। এবং ঢুকেই চমকে গেলাম।

হোটেলের প্রতিটি সাজসজ্জায় বিলাসিতার ছাপ। পাঁচতারা হোটেলে এক-আধবার যে ঢুকিনি তা নয়। তবে এর তারার সংখ্যা পাঁচের অনেক বেশি মনে হয়।

প্রকাণ্ড রিসেপশান হলের মেঝেতে নরম কার্পেট। একপাশে অনেকগুলো সোফা। তার পাশে পাশে ছোট-ছোট টবে ছায়াতরু। একটু দূরে রঙিন টিভি। হলের ডানদিকের শেষ প্রান্তে কাচের দেওয়াল। দেওয়ালের ওপাশে সাঁতার-দিঘি। সেখানে কলির কেষ্ট আর গোপিনীর দল জলকেলি করছে। গা-থেকে-জল-ঝরে-পড়া দু-একজন সুন্দরীকে দেখে বেশ ভালো লাগল। লক্ষ করলাম, সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ার ভান করে তিনজন ভদ্দরলোক সুন্দরীদের বেশ খুঁটিয়ে দেখছে।

ইচ্ছে থাকলেও ওসব দেখার খুব বেশি সময় আমার হাতে নেই। সুতরাং এগিয়ে গেলাম রিসেপশান ক্লার্ক দুজনের কাছে। গাড়ি থেকে আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ব্রিফকেসটা নিয়ে এসেছি। ওটা কার্পেটের ওপরে দাঁড় করিয়ে রেখে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মাথার মধ্যে ঘুরছে রুম নম্বর টু-জিরো-থ্রি।

ক্লার্ক দুজন যেন উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু। একজন বেশ গাঁট্টাগোট্টা, অন্যজন রোগা। একজন ফরসা, অন্যজন কালো। একজনের চশমা, তো আর একজনের চশমা নেই। তবে দুজনেরই পরনে ছাইরঙা টেরিকটনের টিপটপ পোশাক। তার ওপরে হোটেল রিভারভিউর মনোগ্রাম এবং সারি সারি পেতলের বোতাম।

রিসেপশান কাউন্টারটা তিমির মতো লম্বা। আর তামা, পেতল, কাঠের তৈরি। যেখানে যেটা ব্যবহার করা উচিত, তাই ব্যবহার করা হয়েছে। সবটাই ঝকঝকে তকতকে।

আমাকে দেখেই গাঁট্টাগোট্টা এগিয়ে এল। মুখে ফুটিয়ে তুলল যান্ত্রিক হাসি। আমি ওকে বললাম যে, সেকেন্ড ফ্লোরে, মানে বাংলায় তিনতলায়, একটা ঘর চাই। সিঙ্গল বা ডবল, যে কোনও একটা হলেই চলবে।

লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। ঘরের নম্বর লেখা খোপগুলো দেখল। কোনও কোনও খোপে পেতলের বিশাল টিকিট লাগানো চাবি ঝুলছে। আমি আগেই লক্ষ করেছি, দুশো তিন নম্বর খোপে চাবি নেই, আর দুশো সাত নম্বর খোপে চাবি ঝুলছে। ঘরটা খালি হতে পারে, আবার এমনও হতে পারে, দুশো সাতের বোর্ডার চাবি কাউন্টারে জমা দিয়ে হুগলির হাওয়া খেতে বাইরে গেছে।

লোকটা এবার খাতা খুলল। কী সব দেখেটেখে বলল, দুশো সাত নম্বর খালি আছে। সিঙ্গল বেড। ভাড়া নশো পঞ্চাশ টাকা–।

বোধহয় শেষ কথাটা বলল আমার চেহারা ও পোশাক দেখে। আমি পকেট থেকে টাকা বেরে করে গুনে উনিশশো টাকা দিলাম ওর হাতে। বললাম, দু-দিনের ভাড়া। পরে দরকার হলে দু-একদিন বেশি থাকব।

লোকটা টাকা নিয়ে রোগা সঙ্গীকে ডেকে বলল কাগজপত্র তৈরি করতে। তারপর দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন উর্দিপরা বেয়ারার একজনকে ইশারায় কাছে ডাকল। দুশো সাত নম্বরের চাবিটা তাকে দিয়ে বলতে যাচ্ছিল কী কী করতে হবে, আমি হেসে বাধা দিলাম। বললাম, আমি নিজেই পারব। তারপর চাবিটা নিয়ে পকেটে ঢোকালাম। বেয়ারাটা ব্যাজার মুখে চলে গেল। সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মূর্তির মতো। আমি সামনের খোলা খাতায় নাম-ঠিকানা ইত্যাদি লেখার কাজ শেষ করলাম।

এবার আসল কাজ। গাঁট্টাগোট্টা লোকটাকে ইশারায় কাছে ডাকলাম। ও কৌতূহলী মুখে পালিশ করা কাউন্টারের ওপরে ঝুঁকে পড়ে আমার কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করল। জিগ্যেস করলাম, টেলিফোন করা যাবে একটা?

নিশ্চয়ই, স্যার– বলে কাউন্টারের ভেতরের তাক থেকে একটা নীল রঙের হালকা আধুনিক টেলিফোন বের করে কাউন্টারের ওপরে রাখল।

লোকাল থানার ফোন নাম্বার জানা নেই। অতএব লালবাজারে ফোন করে খুনের খবরটা দিলাম। নিজের পরিচয় জানালাম না। বললাম, লাশ গাড়িতে শুয়ে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

টেলিফোন শেষ করে গাঁট্টাগোট্টাকে ধন্যবাদ দিলাম। তারপর পকেট থেকে একটা আইডেনটিটি কার্ড বের করে পলকে ওর নাকের ডগায় খুলে ধরেই বন্ধ করে দিলাম। একইসঙ্গে জিগ্যেস করলাম, দুশোতিন নম্বরে কোন বোর্ডার আছে?

লোকটা বারকয়েক ঢোঁক গিলে খাতা উলটেপালটে দেখল। তারপর বলল, চুনিলাল ব্যানার্জি, স্যার। কাল থেকে এসে উঠেছে।

লক্ষ করলাম, লোকটার গলার স্বর কাঁপছে। একটা আইডেনটিটি কার্ডেই এই অবস্থা! তাও যদি কার্ডটা জেনুইন হত! এই রামছাগলটা ধরতে পারেনি যে, ওটা আমারই তৈরি। একটা আইডেনটিটি কার্ড বাজার থেকে কিনে তার ওপরে আমার পাসপোর্ট ফটো সেঁটে দিয়েছি। আর তার পাশে আমার নাম, বাবার নাম, জন্মতারিখ, সই ইত্যাদি যেমন থাকা উচিত ঠিক তেমনটি রয়েছে। আর সবচেয়ে যেটা জরুরি সেটা হল রাবার স্ট্যাম্প। আমাদের দেশের জনগণের রাবার স্ট্যাম্পে অগাধ বিশ্বাস। সুতরাং সেরকম জাতের একটা পুরোনো রাবার স্ট্যাম্প নিয়ে তার ধ্যাবড়া ছাপ ছেপে দিয়েছি আইডেনটিটি কার্ডের ওপরে। স্ট্যাম্পের মাঝখানে তিন সিংহের মূর্তির ছাপও আছে। নিছকই ভেঁতা আউটলাইন–শুধু সিংহ তিনটের আদলটুকুই বোঝা যায়। তবে রামছাগলকে বশ করতে এটুকুই যথেষ্ট আসল সিংহের কোনও দরকার নেই। সুতরাং কার্ডটা নিশ্চিন্তে পকেটে চালান করে দিলাম।

এবার ওকে পরের প্রশ্নগুলো করলাম।

চুনি ব্যানার্জির সঙ্গে আর কেউ এসে উঠেছে? কোনও মেয়ে?

না, স্যার,

আমার ভুরু কুঁচকে গেল। হীরার খোঁজেই এসেছি। অতএব পকেট থেকে হীরার ফটো বের করে ওকে দেখালাম। হীরাকে কেউ একবার দেখলেই যথেষ্ট, কোনওদিন ভুলবে না। জিগ্যেস করলাম, চুনিবাবুর সঙ্গে এই মেয়েটি ছিল না?

হীরার ছবি দেখে লোকটার চশমা কেঁপে উঠল নাকের ডগায়। চোখজোড়া জুলজুল করে খাইখাই ভঙ্গিতে বলে উঠল, না, স্যার, মিসেস রায় তো তার স্বামীর সঙ্গে এসে উঠেছেন। এই তো, দুশো আঠেরো নম্বর রুমে। বলে খাতার পাতার দিকে আঙুল দেখাল সে।

তার মানে? চুনি ব্যানার্জি একা উঠেছে? আর হীরা মিসেস রায় নাম নিয়ে উঠেছে তার স্বামীর সঙ্গে? উঁহু..ওরে মন, পৃথিবীর গভীরতর অসুখ এখন–।

সুতরাং নোলা ঝরা লোকটাকে আরও এক ডিগ্রি কাহিল করতে বললাম, স্বামী আবার কী! সব বোগাস–।

সত্যি স্যার, তাই?

আমি এক চোখ ছোট করে বললাম, তবে ওর রেটটা বড় হাই। আসলে দেখতে সুন্দর তো–।

কত রেট স্যার, কত? এরকম একজন বিউটি কুইন– লোকটার ডান হাতটা নড়ছিল। বোধহয় নজরের আড়ালে পকেটের খুচরো পয়সা গুনছিল।

আমি পাথরের মতো মুখ করে বললাম, দশ হাজার। পার নাইট।

টগবগে বেলুন চুপসে গেল পলকে। একটা দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুখটাও ব্যাজার হয়ে গেল।

আমি এবার লাল মারুতির প্রসঙ্গে এলাম। জিগ্যেস করলাম, আধঘণ্টাটাক আগে লাল রঙের মারুতি ওনি নিয়ে কোনও কাস্টমার এখানে এসেছিল? ব্লু গার্ডেন রেস্তোরাঁয় বসেছিল খেতে…।

লোকটা হাসল। বলল, সেটা ঠিক বলতে পারব না, স্যার। তবে আমাদের রেস্তোরাঁটা দোতলায়। ওখানে মাইকেল আছে। ও তখন স্টেজে গাইছিল। ও সব লোককে ঠিকঠাক মনে রাখতে পারে। ওকে একটিবার জিগ্যেস করে দেখুন।

আমি হেসে ধন্যবাদ জানালাম। পকেট থেকে লুব্রিকেশান ফি হিসেবে একটা একশো টাকার নোট বের করে লোকটার দিকে এগিয়ে দিলাম।

এর আবার কী দরকার ছিল, স্যার– বলতে-বলতে টাকাটা ও নিল। যতক্ষণ পর্যন্ত পরের টাকা খরচ করছি ততক্ষণ দয়ালু হতে কোনও বাধা নেই। তবে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলাম। আপনমনেই বিড়বিড় করে কী যেন হিসেব কষছে। বোধহয় ভাবছে, বাকি নহাজার নশো টাকা কোত্থেকে জোগাড় করা যায়। আজ রাতে হীরাকে যে ও স্বপ্নে দেখবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গরিব তো স্বপ্ন নিয়েই বাঁচে।

দোতলার সিঁড়ির পাশেই অটোমেটিক এলিভেটর। এলিভেটরে তিনতলায় উঠতে উঠতে ঠিক করলাম, আগে স্নান, তারপর খাওয়া–অবশ্যই ব্লু গার্ডেনে বসে আয়েস করে। তারপর মাইকেল। কিন্তু ওর পদবিটা কী হতে পারে? জ্যাকসন, না মধুসূদন দত্ত?

.

ব্লু গার্ডেনে। নামের মধ্যে যেমন একটা মিষ্টি সুর ও ছবি রয়েছে, চেহারাতেও তাই। বিশাল খোলা-হাওয়া রেস্তরাঁ। ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যানের মতোই এই নীল উদ্যান। হোটেলের সদর দরজার দিকে মুখ করে তৈরি হওয়ার ফলে এখানে বসেই নদী দেখা যায়, টের পাওয়া যায় ছন্নছাড়া বাতাস। রোদ অথবা বৃষ্টি আড়াল করতে মাথার ওপরে উঁচু-নীচু পিরামিডের ঢঙে তৈরি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের আচ্ছাদন। রেস্তোরাঁর শতকরা সত্তর ভাগ খোলা হাওয়ায়, আর বাকি তিরিশ ভাগ অন্দরে। সেই অংশে নাচ-গানের ডায়াস, বার কাউন্টার এবং কিচেন। আর খোলা অংশে টেবিল চেয়ার সাজানো।

রেস্তোরাঁয় ভিড় মাঝারি রকমের। একে বর্ষাকাল, তার ওপরে বেলা প্রায় দুটো। তাই হয়তো খদ্দের বেশি নেই তা ছাড়া এই রেস্তোরাঁয় আকাশছোঁয়া দামও একটা কারণ হতে পারে।

খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম আয়েস করেই। খালি পেটে কখনও রিভলভার চালানো যায় না।

বেয়ারাকে বিল মেটাতেই একটা ক্যাশমেমো হাতে পেলাম। চেহারায় ঠিক লালুর ক্যাশমেমোর মতো। বেয়ারাটাকে ডেকে লালুর ক্যাশমেমোটা দেখিয়ে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। লোকটা কিছুই ঠিকমতো বলতে পারল না। তখন ওকে বললাম, তোমার নাম নিশ্চয়ই মাইকেল নয়?

বেয়ারাটা আমতা-আমতা করে বলল, না, স্যার। মাইকেল গান গায়, গিটার বাজায়। একটু আগেই ওর গান শেষ হয়েছে। আবার সন্ধেবেলা ওর শো শুরু হবে। আঙুল তুলে দূরের কোণের ডায়াসটাকে দেখিয়ে বলল, ওই স্টেজে।

মাইকেল এখন কোথায়? পকেট থেকে কার্ডটা বের করে বেয়ারাটাকে দেখলাম। ছোট্ট করে উচ্চারণ করলাম, লালবাজার।

লোকটা মুখ তালশাঁসের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। নাঃ, আজ দেখছি শুধু রামছাগলদের দিন।

লোকটা রীতিমতো কাঁপা গলায় বলল, মিউজিক রুমে, স্যার।

আমার ভুরু কুঁচকে গেল। জিগ্যেস করলাম, সেটা আবার কোথায়?

ওই যে, স্টেজের পাশের দরজাটা।

আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। লুব্রিকেশান ফি হিসেবে দশ টাকা বের করলাম। লোকটাকে অনেক কষ্টে টাকাটা নিতে রাজি করালাম। টাকাটা বকশিশ হিসেবে দিয়ে কী ভেবে জিগ্যেস করলাম, তোমার নাম কী?

ক্ষুদিরাম, স্যার।

বাঃ! মাইকেল, তারপর ক্ষুদিরাম! আজ কি স্বাধীনতা দিবস না প্রজাতন্ত্র দিবস? কে জানে, নীচের ওই গাঁট্টাগোট্টা চশমাওয়ালার নাম রামমোহন অথবা প্রফুল্ল কি না!

ভেলভেট মোড়া সুদৃশ্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লাম। এবার অপারেশান মাইকেল।

কতকগুলো ব্যাপার আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে। শরদিন্দু মিত্রের কাজের দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর কেউ আমাকে সাদা মারুতি নিয়ে ফলো করছিল। তারপর চুনি ব্যানার্জির লোক আমাকে শাসিয়েছে। আর সবশেষে লাল মারুতি ভ্যান নিয়ে লালুর অপঘাতে মৃত্যু।

লালু কী করতে এসেছিল রিভারভিউতে? এল, ব্লু গার্ডেনে খেল-দেল, তারপর একজোড়া গুলি খেয়ে মরে গেল। যে গুলি ছুঁড়েছে সে নিশ্চয়ই গাড়ির বাইরে থেকে, পিছন থেকে, ফায়ার করেছে। আর তখন গাড়িটা হয়তো ছুটন্ত অবস্থায় ছিল। নইলে চারটে গুলির মধ্যে দুটো গায়ে লাগবে কেন? যারা রিভলভার চালায় তাদের টিপ কি এতই ভেঁতা হয়!

হঠাৎই আমার থিয়োরিতে একটা বড় গলদ চোখে পড়ল। না, লালু যখন গুলি খায় তখন সে মোটেই ড্রাইভ করছিল না। কারণ সিটে বসা অবস্থায় সিটের গদি ফুটো না করে কোনও গুলি ওর বুকে বা পিঠে বিধতে পারে না। সামনের সিটের গদিতে সেরকম কোনও ফুটো আমার নজরে পড়েনি। সুতরাং গুলি খাওয়ার পর লালু কোনওরকমে গাড়িতে উঠে গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে। তখন আরও চারবার কেউ গুলি ছুঁড়েছে ওর গাড়ি লক্ষ্য করে।

গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে এখানেই, এই হোটেলে–এতে আর কোনও সন্দেহ নেই। তা হলে গুলির আওয়াজ কি কেউ শোনেনি? নাকি রিভলভারে সাইলেন্সার লাগানো ছিল?

এইসব উলটোপালটা ভাবতে-ভাবতেই মিউজিক রুমে গিয়ে ঢুকলাম। সঙ্গে-সঙ্গে হুইস্কির গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারল।

ঘরটা ঝিমঝিম অন্ধকার। তারই মধ্যে টুং-টাং করে বাজছে গিটারের সুর। ঘরের একপাশে যন্ত্রসংগীতের নানা যন্ত্রপাতি জ্যাজ, কঙ্গো, পারকাসন, ম্যারাকাস, পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন, আর বড় মাপের ইয়ামাহা ইলেকট্রনিক অরগ্যান। সেগুলো থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দাড়িওয়ালা মোটাসোটা একটা লোক তামাটে শরীরটাকে সামান্য ঝুঁকিয়ে স্প্যানিশ গিটার বাজাচ্ছে। তার কাছে বসে আছে একটি রোগা চেহারায় ছোকরা।

আমি গিটারওয়ালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হুইস্কির গন্ধ গায়ে মেখে জিগ্যেস করলাম, মাইকেল?

দাড়িওয়ালার গিটার বাজতেই থাকল। তারই মধ্যে সুর করে ছড়া কেটে বলল, কী চাই, বলে ফেল ভাই– হুইস্কির গন্ধ আবার ঝাপটা মারল নাকে।

আমি জিগ্যেস করলাম, ঘণ্টাখানেক আগে ব্লু গার্ডেনে বসে খেয়ে গেছে একটা লোক। তারপর এই হোটেলেই গুলি খেয়ে রাস্তায় গিয়ে মরেছে। রেস্তোরাঁর তখন আপনার শো চলছিল। লোকটার চেহারার বর্ণনা দিলে চিনতে পারবেন?

রোগা ছেলেটা তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। এত স্বাভাবিক গলায় কখনও কাউকে খুনের ঘটনা বোধহয় বলতে শোনেনি।

মাইকেল গিটার বাজাতে বাজাতেই হাসিমুখে সঙ্গীর দিকে তাকাল। বলল, ভয় পেলি, তরুণ? তোর অবস্থা বড় করুণ।

তরুণ তখন ভয়ার্ত মুখে যাই-যাই করছে।

মাইকেল এবার আমাকে জিগ্যেস করল, ভাই, সবই তো বুঝলাম। কিন্তু আপনার কী নাম?

গিটার বাজছিল। একবারের জন্যেও থামেনি।

আমি দাঁত বের করে হেসে ছড়া কেটে বললাম, ভালো নাম অমিতাভ শিকদার, ডাকনাম পুলিশ। বলতে পারেন, বুলেট খাওয়া লোকটার হদিস?

ওদের দুজনেরই মুখের ছবি পালটে গেল। গিটারের তারের ওপরে থমকে গেল মাইকেলের আঙুল। কুতকুতে চোখ দ্রুত নড়াচড়া করতে লাগল এদিক-ওদিক। আর তরুণের অবস্থা এখন সত্যিই করুণ।

মাইকেলকে এবার লালুর চেহারার বর্ণনা দিলাম। ও চুপ করে শুনল। তারপর গিটারটায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। বলল, আবছা মনে পড়ছে। ডায়াসের খুব কাছেই বসেছিল। বারবার ঘড়ি দেখছিল। তারপর একসময় ঘড়ি দেখেই জলদি খাওয়া শেষ করে ঝট করে উঠে পড়েছিল। তাড়াহুড়ো করে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গেছে। একটু থেমে আবার বলল, এইজন্যেই লোকটাকে মনে আছে। তবে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছে বলতে পারব না।

মাইকেলের মুখ দেখে মনে হল সত্যি কথাই বলছে।

নাঃ, লালুর গল্প তা হলে এখানেই শেষ! হোটেলের ম্যানেজারকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই না, কারণ, তাতে শোরগোল হবে। আমার কাজ হীরাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, ব্যস।

মাইকেলকে আলগা গোছের ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে। ও তখন আবার গিটার বাগিয়ে ঝংকার তুলতে শুরু করেছে। মাথা ঝুঁকিয়ে আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করে বলল, অলওয়েজ ওয়েলকাম, মাইকেল ডিসুজা আমার নাম।

আমি হাসলাম, বললাম, দরকার পড়লেই আসব আবার, এখন সময় হল যাওয়ার–।

রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে বেরোনোর সময় মনে হল, ছোটবেলা থেকে রিভলভার চর্চা না করে যদি কবিতা চর্চা করতাম তা হলে বড় ভালো হত। আজ আমাকে এভাবে লালুর খোঁজ করে বেড়াতে হত না।

শরীর খুব ক্লান্ত লাগছিল। দুশো সাত নম্বরে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম আরামের বিছানায়। সন্ধেবেলা কারপার্কের অ্যাটেনড্যান্টকে লাল ওনির ব্যাপারে জিগ্যেস করা যাবে। আর হীরা যখন হাতের নাগালে রয়েছে তখন রাতের অন্ধকারে ওকে নিয়ে উড়ে যেতে অসুবিধে কী?

শুধু একটা ব্যাপার মনের মধ্যে খচখচ করছিল। লালু মারা যাওয়ার আগে শরদিন্দু মিত্রের নাম বলে গেল কেন?

.

হোটেল রিভারভিউর যে-কোনও ভিউই চমৎকার। অন্তত সূর্য ডুবে যাওয়ার মুখে কার পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে আমার তাই মনে হল।

সবুজ ঘাসের কিনারায় ঝুলন্ত শিকলের চেন। তারপরই মেটাল রোড এবং কার পার্ক। হোটেলের চৌহদ্দির পাঁচিল প্রায় দেড়মানুষ উঁচু। সুতরাং নদী বা সূর্যাস্ত কোনওটাই সরাসরি দেখা যাচ্ছে না। তবে লালচে আকাশ পরোক্ষভাবে সূর্যের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করছিল। আর হু-হু বাতাসের গায়ে নদীর নাম লেখা ছিল।

কার পার্কের কাছে চৌহদ্দির দেওয়াল ঘেঁষে হাফ ডজন পাম গাছ। তার মাথায়, পাতার ফাঁকে, পাখির বাসা ও সংসারী পাখি। ঘাসের ওপরে দাঁড়িয়ে ওদের নির্লজ্জ দাম্পত্য কলহ শোনা যাচ্ছে।

আমি অ্যাটেনড্যান্টের সঙ্গে কথা বলছিলাম। নেহাতই বিশ-বাইশের ছোকরা। নাম শিবনাথ। কালো মুখ পুরোনো বসন্তের দাগ। সামনের কয়েকটা দাঁত উঁচু। পরনে খাকি পোশাক।

একটু আগেই লুব্রিকেশান ফি জমা দিয়েছি তিরিশ টাকা। তারপরই লালুর গাড়ির খবর এবং বুলেটের ব্যাপারটা জানতে পেরেছি।

লালু দৌড়ে এসে ওর গাড়িতে উঠছিল। সেই সময়ে ওর পিঠে গুলি লাগে। না, গুলির শব্দ শুনতে পায়নি শিবনাথ। তবে হঠাৎই লালুর পিঠে সাদা জামার ওপরে লাল রং ফুটে উঠতে দেখে চমকে উঠেছে।

সময় তখন কটা হবে? এই বারোটা সাড়ে বারোটা। কার পার্কে শিবনাথ একাই ছিল। ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ, মেটাল রোডের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়েছিল লালু। তারপর শিবনাথকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। টলতে টলতে উঠে পড়েছে গাড়িতে। গাড়িটা চলতে শুরু করামাত্রই আবার গুলি। কাচের ওপরে গুলির শব্দ–বেশ কয়েকবার। তখন শিবনাথ আন্দাজে ওপর দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। তখনই একটা লোককে দেখতে পেয়েছে ও।

আমি মনোযোগ দিয়ে শিবনাথের কথা শুনছিলাম। আর একইসঙ্গে চারপাশে নজর রাখছিলাম। কারণ, খনা বলে গেছেন, ন বিশ্বাসন্তি আপনং ছায়া। যার অর্থ, নিজের ছায়াকেও কখনও বিশ্বাস কোরো না।

শিবনাথ হোটেলের তিনতলার জানলায় একজন লোককে দেখতে পায়। না, তাকে ঠিক চিনতে পারেনি। তবে ওই ঘরটায়।

আঙুল তুলে ঘরটা দেখাল শিবনাথ। আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার বুকের ভেতরে একটা হাতি ব্যালে নেচে উঠল। কারণ, ঘরের নম্বরটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছি। দুশো তিন। চুনি ব্যানার্জির ঘর!

শিবনাথ আর কিছু বলতে পারেনি। না, এই দুর্ঘটনার কথা কাউকে জানায়নি সে।

তখন ওকে আইডেনটিটি কার্ডটা দেখিয়ে আশ্বস্ত করলাম এই বলে যে, ওর কোনও ভয় নেই। পুলিশ ওকে বিরক্ত করবে না।

শিবনাথ তিরিশ টাকাটা ফেরত দেওয়ার জন্যে ঝুলোঝুলি করতে লাগল। আমি হেসে বললাম, পুলিশ যেমন সবসময় সার্ভিস চার্জ নেয়, তেমনি মাঝে-মাঝে সার্ভিস চার্জ দেয়। এটা অনেকটা সেইরকম–

শিবনাথের কাছ থেকে সোজা ফিরে গেলাম নিজের ঘরে। সুদৃশ্য ড্রেসিং টেবিলের পাশ থেকে ব্রিফকেসটা নিয়ে রাখলাম। বিছানায় ওপরে। কম্বিনেশান লক ঘোরাতেই ব্রিফকেস খুলে গেল। ভেতরে কাগজপত্র, কলম, টুকিটাকি জিনিস। এ ছাড়া ছোট একটা ডাম্বেল। মাঝের হাতলটা কাঠের। তাতে আঙুলের মুঠোর মাপে খাঁজ কাটা। আর দু-মাথায় দুটো ইস্পাতের বল–বড়জোর দু-সেন্টিমিটার ব্যাসের। ডাম্বেলটা মুঠো করে ধরলে হাতলটা দেখা যায় না, শুধু বল দুটো মুঠোর দু-পাশে উঁকি মেরে থাকে।

ডাম্বেলটা প্যান্টের পকেটে ঢোকালাম। তারপর ব্রিফকেস থেকে তুলে নিলাম চার ইঞ্চি মাপের একটা সাইলেন্সার টিউব। টিউবের গায়ে নানা রঙের স্টিকার লাগানো। যাতে দেখে বোঝা ণা যায় এটার আসল কাজ কী। একটা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভলভারে ওটা প্যাঁচ দিয়ে লাগিয়ে নিলাম। তারপর প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলাম।

অন্য স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটায় হাত দিলাম না। তার বদলে ব্রিফকেস থেকে বের করে নিলাম নল কাটা একটা শটগান। তার বাঁট বলে কিছু নেই। একটা তেকোনা ইস্পাতের ফ্রেম নিয়ে শটগানের সঙ্গে এঁটে দিতেই একটা খাটো বাঁট তৈরি হল। একবার দেখে নিলাম গুলিভরা আছে কিনা। তারপর ওটা শিরদাঁড়ার কাছে প্যান্টের ভেতরে আধাআধি গুঁজে নিলাম। ঢোলা জামাটা টেনে দিলাম ওপর দিয়ে।

ব্রিফকেস বন্ধ করে আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। শরীর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলাম শটগানটা দৃষ্টিকটুভাবে উঁচু হয়ে থেকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে কি না। এ-শটগানের বিজ্ঞাপনের দরকার নেই। একবার ফায়ার করলেই শতকরা দুশো ভাগ কাজ দেয়।

ঘর ছেড়ে যখন বেরোলাম তখন আমি দুনিয়া ছাড়ার জন্যে তৈরি। কিন্তু তার আগে দুশো তিন নম্বর ঘরের রহস্য আমি ভেদ করতে চাই। সেই সঙ্গে লালুর মৃত্যুরহস্য।

করিডরে ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেট। সুতরাং পায়ের শব্দের কোনও ব্যাপার নেই। আর লোকজন কাউকেই চোখে পড়ল না। একবার শুধু একজন বেয়ারাকে দেখলাম। হাতে ট্রে। ট্রে-র ওপরে বোতল ও গ্লাস। আমি বেয়ারাটাকে পাশ কাটিয়ে গেলাম। এবং দুশো তিন নম্বরের দরজাটাও পেরিয়ে গেলাম।

যখন দেখলাম পথ পরিষ্কার তখন দুশো তিনের সামনে এসে নক করলাম ব্যস্তভাবে।

কিছুক্ষণ কোনও উত্তর নেই। তখন আমি কলিংবেলের বোতাম টিপলাম। তারপর আবার নক করলাম।

এবার কেউ ভরাট গলায় প্রশ্ন করল, কে?

ভাবার সময় নেই। অতএব যা মুখে এল বলে দিলাম, দরজা খুলুন, মিস্টার ব্যানার্জি। আমি রিভারভিউর ম্যানেজার।

তারাওয়ালা হোটেলের ম্যানেজাররা নিশ্চয়ই বেয়ারাদের মতো বোর্ডারদের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ায় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কাজ হল। দরজা সামান্য ফাঁক হল। একটা ভয়ার্ত চোখ দেখা গেল সেই ফাঁকে। চুনি ব্যানার্জির চোখ।

আমি দরজায় সপাটে এক লাথি মারলাম। আর একইসঙ্গে পকেট থেকে সাইলেন্সার লাগানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটা বের করে বাগিয়ে ধরলাম। তারপর ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলাম। ছিটকিনিও এঁটে দিলাম।

মেঝেতে পড়ে যাওয়া চুনি তখনও পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি। রিমলেস চশমা চোখ থেকে সরে গিয়ে কাত হয়ে নাকের কাছে আটকে রয়েছে। ব্যাকব্রাশ চুলের পরিপাটি ভাব নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু ডান গালের তিলটা রয়েছে জায়গা মতোইনড়ে যায়নি।

নল কাটা শটগানটার জন্যে পিঠের কাছটায় খচখচ করছিল, কিন্তু সেটা ভ্রূক্ষেপ না করে আমি দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়েই রইলাম। দু-হাতে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের বাঁট চেপে ধরেছি। সাইলেন্সারের নল সরাসরি চুনির কপাল দেখছে।

শক্ত গলায় চুনিকে বললাম, উঠে দাঁড়ান–।

চশমা ঠিক করে সাইলেন্সরের নলের দিকে স্থির নজর রেখে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল চুনিলাল। তারপর অপমানে আহত গলায় বলল, হাত দুটোও কি মাথার ওপরে তুলতে হবে?

আমি হাসলাম ও কোনও দরকার নেই। হাত তুলুন আর না-ই তুলুন, আমার টিপ ফসকাবে না।

চুনিলাল মাথার চুল ঠিক করল, প্যান্ট-শার্ট ঝাড়ল। তারপর খানিকটা শান্ত গলায় বলল, কবে থেকে হোটেল রিভারভিউর ম্যানেজার হয়েছেন?

আপনার ঘরের দরজায় নক করার দু-সেকেন্ড আগে থেকে।

ও– হাত নাড়াল চুনি, বলল, নিন, আর দেরি করছেন কেন? কাজ শেষ করুন।

কাজ? কী কাজ? একটু অবাক লাগল আমার। চুনির কাছে গিয়ে শরীর হাতড়ে দেখলাম ও নিরস্ত্র। তখন রিভলভার পকেটে রাখলাম। ওকে জিগ্যেস করলাম, ঘরে আর কে আছে?

চুনির নজর কেঁপে গেল একতিল। কিন্তু আমি সেটা লক্ষ করলাম। সুতরাং ওকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম ভেতরের ঘরের দিকে।

ভেতরের ঘর বললাম বটে, কিন্তু ঘর আসলে একটাই। একটা ভারী পরদা সেটাকে বসবার ঘর ও শোবার ঘরে ভাগ করেছে। সবুজ পরদাটা অনেকখানি টানা ছিল। কিন্তু পরদার ডানদিকে দরজার মতো সামান্য ফাঁক রয়েছে।

আমি সেই ফাঁক দিয়ে ভেতরের ঘরে যাইনি। চুনিলালের কেঁপে যাওয়া নজর আমাকে সাবধান করে দিয়েছে এক লহমা আগেই। অতএব এক ঝটকায় মেঝে পর্যন্ত লেপটে থাকা পরদার

বাঁ দিকের কোণ দিয়ে ঢুকে পড়েছি ভেতরের ঘরে–চুনির শোবার ঘরে।

চায়ের দোকানের সেই শিক্ষানবিস ছোকরা মাস্তানের কথা মনে পড়ল : চুনিদা বহুত খতরনাক লোক…।

কথাটা যে একেবারে মিথ্যে নয় সেটা এখন বোঝা গেল। কারণ, শোবার ঘরে একটা লোক উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। না, বিছানায় নয়, খাটের নীচে, ঘরের মেঝেতে। তবে মেঝেতে

কার্পেট থাকার জন্যে শুয়ে থাকতে বোধহয় তেমন কষ্ট হচ্ছে না।

লোকটা পরদার শেষপ্রান্তের দরজার দিকে সজাগ চোখে তাকিয়ে বাঘের বাচ্চার মতো ওত পেতে ছিল। বোধহয় আমারই জন্যে। ওর হাতে অস্ত্রশস্ত্র কী আছে ভালো দেখার মতো সময় এবং মনের অবস্থা আমার ছিল না। তা ছাড়া শটগানটা অনেকক্ষণ ধরে পিঠের কাছে খচখচ করছিল। তাই পরদা তুলে ঢোকার সময়েই ওটা হাতে বের করে নিয়েছি এবং ওই হুমড়ি খাওয়া অবস্থাতেই ওর মাথার দিকে তাক করে ট্রিগারে আঙুল শক্ত করে ফেলেছি।

আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে-সঙ্গেই বাঘের বাচ্চা আমার দিকে তাকিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। শটগানের নিশানা নির্ভুল লক্ষ্যে স্থির।

লোকটা নিশ্চয়ই পেশাদার পুরোনো পাপী। কারণ নলকাটা শটগান দেখেই চিনতে পারল। বুঝতে পারল, যদি আমি ওর কপাল তাক করে ফায়ার করি তা হলে মুন্ডুটা খুঁজে পাওয়ার জন্যে খবরের কাগজে হারানো-প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ কলামে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। সুতরাং নিমেষের মধ্যে ওত পেতে থাকা বাঘের বাচ্চাটা শুয়োরের বাচ্চা হয়ে গেল। মুখ ফ্যাকাশে। চোখে ভয়।

আমি নোংরা গলায় বললাম, হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে মাথা নীচু কর–।

লোকটা দণ্ডিকাটার মতো সামনে দু-হাত বাড়িয়ে মুখ নীচু করে শুয়ে পড়ল।

চুনি ব্যানার্জি ইতস্তত পায়ে ঘরে এসে ঢুকল। আমি ওকে বললাম, আপনার বডিগার্ডকে খাটের তলা থেকে টেনে বের করুন–।

খাটের তলায় উঁকি মেরে দেখলাম। নাঃ, ওই একজনই, আর কেউ নেই।

চুনিলাল ওর চ্যালাকে টেনে বের করল খাটের তলা থেকে। লোকটার গায়ে আঁটোসাঁটো গেঞ্জি, তার ওপরে লেখা লাভ, পাশে হৃদয়ের ছবি। আর ওর পায়ে ডেনিমের প্যান্ট–প্যান্টের পকেট উঁচু হয়ে রয়েছে।

চুনিলাল বারবার আমাকে দেখছিল, এবং অর্থপূর্ণ চোখে তাকাচ্ছিল ওর চ্যালার দিকে। চ্যালা এপাশ-ওপাশ ঘাড় নাড়ল–অর্থাৎ, না। আমার মনে হল, চুনিলাল আমার হাতের নলকাটা শটগানের গুরুত্ব বোঝেনি। চ্যালা বুঝেছে। তাই গুরুকে বোঝাতে চাইছে।

আমি চ্যালাকে বললাম, জামা-প্যান্ট খোল–জলদি।

দু-জোড়া চোখ অবাক হয়ে গেল। কিন্তু কথা শুনল চ্যালা। আমার দিকে সাবধানী চোখ রেখে গেঞ্জি-প্যান্ট খুলে ফেলল। লোকটার পাকানো পেটানো চেহারা। মাথার চুল কদমছাঁট। এখন ওকে ভি.আই.পি. জাঙিয়ার বিজ্ঞাপনের মতো দেখাচ্ছে।

চুনিলাল ব্যানার্জি বোধহয় ধীরে-ধীরে সামলে উঠছিল। ঠান্ডা গলায় জিগ্যেস করল আমাকে, আপনি কে? কী চান এখানে?

আমি কয়েক সেকেন্ড ভাবলাম। তারপর বললাম, শুনলে খারাপ লাগবে, কিন্তু আমার কোনও উপায় নেই। আমি হীরাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি–একটু থেমে আবার বললাম, তা ছাড়া এই ঘর থেকে আজ সকালে গুলি চলেছে। একটা লোকের পিঠে গুলি লেগেছে। লোকটা উন্ডেড অবস্থায় লাল রঙের মারুতি ভ্যানে চড়ে রিভারভিউ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। তারপর রাস্তায় মারা যায়।

কথা বলতে বলতে আমি চুনির চ্যালা উলঙ্গনাথনকে পাশ কাটিয়ে জানলার কাছে এগিয়ে গেছি। উঁকি মেরে দেখেছি নীচের কার পার্কের দিকে। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে শিবনাথ। এই জানলা দিয়ে গুলি চালানোটা নেহাত অসম্ভব নয়।

বোধহয় দু-তিন সেকেন্ড অমনোযোগী হয়েছিলাম। এবং সেই অন্যমনস্কতার সুযোগে উলঙ্গ নাথন আমার শটগান লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

ওকে আমি গুলি করতেই পারতাম। কিন্তু শটগানে নয়েজ পলিউশান হয়। দশটা লোক ছুটে আসতে পারে এই ঘরে। তারপর, সন্দেহ নেই, আমার কাজ পণ্ড হবে।

উলঙ্গনাথনকে দেখে যতই মাথামোটা মনে হোক, ও বোধহয় মনে-মনে ঠিক এই হিসেবটাই কষেছিল।

শটগানটা আমার হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল বিছানায়। আর একইসঙ্গে আমি উলঙ্গ নাথনের শরীরের একমাত্র পোশাক ঢাকা অঙ্গ লক্ষ করে তীব্র লাথি চালিয়ে দিয়েছি।

লাথি যে জোরেই লেগেছে সেটা যন্ত্রণার শব্দ শুনে এবং আমার ডান পায়ের ব্যথা অনুভব করে বোঝা গেল, কিন্তু লোকটা একেবারে অকেজো হয়ে পড়ে যায়নি। শুধু সামান্য কাবু হয়ে সামনে হাত চেপে ঝুঁকে পড়েছিল। আমি আর অপেক্ষা করিনি। পকেট থেকে মিনি ডাম্বেল বের করে শক্ত মুঠোয় ধরেছি, এবং পরক্ষণেই বাতাসে এক সুদীর্ঘ বৃত্তচাপ রচনা করে ইস্পাতের বল মারাত্মকভাবে আঘাত করল উলঙ্গনাথনের শক্ত বুকে।

হাড় ভাঙার শব্দ হল বোধহয়। উলঙ্গনাথন হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল কার্পেটের ওপরে। আমি ডাম্বেল ফেলে দিলাম হাত থেকে। খালি হাতের লড়াইয়ের বিখ্যাত বই কিল অর গেট কিড় এর পঞ্চাশ পৃষ্ঠার নির্দেশ অনুযায়ী দু-হাতে প্রচণ্ড চাপড় মারলাম উলঙ্গনাথনের দুকানের ওপরে। বেশ জোরে শব্দ হল। জানি, এই শব্দ উলঙ্গনাথনের কানে বাজ পড়ার শব্দের মতো শুনিয়েছে। এবং ওর দু কানের পরদা নিশ্চয়ই ফেটে গেছে।

উলঙ্গনাথনের চোখ উলটে গেল। ও চিৎ হয়ে পড়ে গেল কাপেৰ্টের ওপরে। ওর তামাটে বুকের মাঝখানে একটা জায়গা কালচে-নীল হয়ে ফুলে উঠেছে।

চুনি ব্যানার্জি ভয়ার্ত চোখে নিথর হয়ে পড়ে থাকা উলঙ্গনাথনকে দেখছিল। আমি ডাম্বেলটা কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখলাম। শটগানটা বিছানা থেকে তুলে নিয়ে এগিয়ে গেলাম চুনির কাছে। উলঙ্গনাথনকে দেখিয়ে বললাম, এটাকে কোত্থেকে জোগাড় করেছেন? যদি গ্যারান্টি পিরিয়ডের মধ্যে থাকে তা হলে সেখানে জমা দিয়ে রিপেয়ার করিয়ে নেবেন।

আমার কথা চুনির মাথায় কতটা ঢুকল কে জানে। ও বড়-বড় চোখে ফ্যালফ্যাল করে আমাকে দেখছিল। বোধহয় ভাবছিল, একটু আগের দেখা ঘটনাগুলো স্বপ্ন, না সত্যি।

আমি আর দেরি করলাম না। চুনির কলার চেপে ধরে শটগানটা ওর মুখের কাছে নিয়ে এলাম। দাঁতে দাঁত চেপে জিগ্যেস করলাম, কে গুলি চালিয়েছে এ-ঘর থেকে?

চুনি ব্যানার্জি হাঁপাতে লাগল। ওর গলা বন্ধ হয়ে এল। কোনওরকমে বলল, সুরিন্দার গুলি করেছে।

কে সুরিন্দার?

মেঝেতে পড়ে থাকা উলঙ্গনাথনকে দেখাল চুনিলাল : ও গুলি করেছে।

আমি জিগ্যেস করলাম, মেশিনটা কোথায়?

ওর প্যান্টের পকেটে আছে।

আমি মেঝেতে পড়ে থাকা প্যান্টটার দিকে তাকালাম। ওর পকেটে বড়জোর একটা রিভলভার থাকা সম্ভব। ওই রিভলভার দিয়ে তিনতলা থেকে লক্ষ্যভেদ করা অসম্ভব। তা ছাড়া রিভলভার থেকে ছোঁড়া গুলি কখনও ওই দূরত্বে লালুর দেহ এফেঁড়-ওফেঁড় করতে পারত না।

আমি চুনিলালকে দেখলাম এক পলক। ওর ঘোট ছটফট করছে। ঠোঁট কাঁপছে। কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু বলতে পারছে না।

চিন্তা করে দেখলাম, নলকাটা শটগানটা যদি ওর মুখের ভেতরে গুঁজে দিয়ে ফায়ার করি তা হলে শব্দ তেমন জোরে শোনা যাবে না।

সে-কথাই বললাম চুনিকে। ও কী একটা বলতে গিয়ে ঠোঁট ফাঁক করল। সঙ্গে-সঙ্গে শটগানটা আমি ওর দাঁতের ফাঁকে গুঁজে দিলাম। একটা গোঁ-গোঁ শব্দ বেরিয়ে এল চুনির মুখ থেকে। চোখ আবার মাপে বড় হয়ে গেল।

আমি হাসতে হাসতে বললাম, শব্দ কম হবে বটে তবে এই ঘরের দামি কার্পেটটা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ, গুলিটা যখন আপনার মাথার পেছন দিয়ে বেরোবে তখন মাথার ঘিলু টিলু, রক্ত, হাড়ের কুচি, সবই ছিটকে বেরোবে তার সঙ্গে। কিন্তু কী করব, উপায় নেই– তারপর হাসি থামিয়ে ধমকের সুরে বললাম, শিগগির বলুন, মেশিনটা কোথায় রিভলভার দিয়ে সুরিন্দার ও কাজ করেনি।

আমি কথা বলতে-বলতে চুনিলালের ফরসা গালে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলাম। তখন টের পেয়েছি ওর গালের পেশি কাঁপছে। সেটা স্বাভাবিক। আমি মোটেই অবাক হইনি। কিন্তু অবাক হলাম ওর তিলটা লেপটে গালে মাখামাখি হয়ে গেছে দেখে। নকল তিল!

আমি স্থির চোখে চুনিলাল ব্যানার্জিকে দেখতে লাগলাম। এখন বুঝতে পারছি, চায়ের দোকানের সেই উঠতি রংবাজ নেহাত মিথ্যে বলেনি। চুনি ব্যানার্জি সত্যিই বহুত খতরনাক লোক।

আমি শটগানটা টেনে বের করে নিলাম ওর মুখ থেকে। টানের হ্যাঁচকায় একটা দাঁত পড়ে গেল মেঝেতে। কিছুটা রক্তও বেরোল।

আমি আবার জিগ্যেস করলাম, মেশিনটা কোথায়?

আগে মেশিন, পরে তিল।

নকল চুনি আঙুল তুলে বিছানাটা দেখাল।

আমি সুরিন্দারের বুকের ওপরে পা দিয়ে ওর দেহ ডিঙিয়ে গেলাম। তারপর একটানে উলটে দিলাম বিছানায় তোশক। সঙ্গে-সঙ্গে দেখতে পেলাম মেশিনটা। থ্রি-নট-থ্রি উইনচেস্টার, টেলিস্কোপ লাগানো। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের খতম করার জন্যে এই ধরনের দূরপাল্লার মেশিন ব্যবহার করা হয়।

মেশিনটা বাঁ-হাতে তুলে নিলাম। ফিরে গেলাম নকল তিলের কাছে। সুরিন্দারকে লাথি কষানোর পর থেকে ডান পা-টা একটু টনটন করছে।

নকল চুনি এখন ভয়ে কাঁপছে। কাঁপারই কথা। আমার ডান হাতে শটগান, বাঁ-হাতে থ্রি নট থ্রি, পকেটে সাইলেন্সার লাগানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন, আর সেই মারাত্মক ডাম্বেল। এসব দেখে এবং জেনে ভয় পাওয়ারই কথা। তা ছাড়া সামনেই পড়ে রয়েছে সুরিন্দারের ড্যামেজড বডি।

তোর নাম কী?

আমার প্রশ্ন করার ভঙ্গিই লোকটাকে জানিয়ে দিল এ-প্রশ্ন দ্বিতীয়বার আমি করব না।

ও চটপট বলল, রমেন হালদার।

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, আমার হাতে সময় বেশি নেই। গোটা গল্পটা তাড়াতাড়ি বল। কথা শেষ করার সময় শটগানটা খানিকটা ওপরে তুললাম।

রমেন আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত তুলে আঁতকে উঠল। বলল, বলছি, সব বলছি–মুখটা ধুয়ে আসি।

বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে এল রমেন। তারপর একরকম টলতে-টলতে বিছানার ওপরে গিয়ে বসে পড়ল। চোখ থেকে চশমাটা খুলে ছুঁড়ে দিল একপাশে। মাথার চুলে দু-বার হাত চালিয়ে বলল, আপনি কে জানি না। তবে মনে হচ্ছে চুনিদা আপনার সঙ্গে এঁটে উঠবে না। আমি চুনিদার কথা মতো এই মেকাপ নিয়ে কাল থেকে এই ঘরে এসে উঠেছি। আর সুরিন্দার বলে এই লোকটা সবসময় আমার সঙ্গে রয়েছে। চুনিদা বলছিল, আমার ওপরে অ্যাটাক হতে পারে। কিন্তু কী করব! দশ হাজার টাকা দিয়েছে আমাকে। মাথা ঝাঁকাল রমেন। তারপর বলল, বিশ্বাস করুন, কাল থেকেই ভয়ে-ভয়ে আছি–।

মারুতি গাড়ির লোকটাকে সুরিন্দার খতম করল কেন?

বলছি, বলছি। একটু দম নিল রমেন : আজ সকালে আমরা ব্রেকফাস্ট খেতে ব্লু গার্ডেনে গিয়েছিলাম। চুনিদা বলেছিল মাঝে-মাঝে ঘরের বাইরে বেরোতে, লোকজনকে দেখা দিতে যাতে সবাই আমাকেই আসল চুনিলাল ব্যানার্জি ভাবে। তো ব্রেকফাস্ট সেরে চলে আসছি–তখন কটা হবে? বড়জোর সাড়ে নটা কি দশটা হঠাৎই মাইকেল ডিসুজা নামে দাড়িওয়ালা একটা লোক সুরিন্দারকে ডেকে নিয়ে কী যেন বলল। তখন সুরিন্দার আমাকে এসে বলল, একটা লেজুড় লেগেছে। ওটাকে খতম করতে হবে। সুরিন্দারকে আমি চিনি না–আগে কখনও দেখিনি। তো আমি ঘরে ফিরে এলাম, কিন্তু সুরিন্দার কীসব খোঁজখবর করতে চলে গেল। অনেকক্ষণ পর ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, রমেনবাবু কেস খারাপ। ওই ফেউটা আপনার মেকাপের ব্যাপারটা কী করে যেন জানতে পেরে গেছে। ও এখন ফিরে গিয়ে মিত্তিরসাহেবকে খবর দিলেই মুসিবত।

আবার দম নিতে থামল রমেন। ওর ভয়ার্ত চোখ-মুখ বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে। এসব ছাপোষা লুড়োখেলা লোককে কেন যে এই খুন-খুন খেলার মধ্যে টেনে আনা কে জানে!

হালদার আবার বলতে শুরু করল, ব্যস, তারপর থেকেই এই জানলায় রাইফেল তাক করে বসে রইল সুরিন্দার। অনেকক্ষণ পর চারবার ফায়ার করল শুনলাম। আমার তখন মাথা ঝিমঝিম করছিল। সুরিন্দার হাসি মুখে আমার কাছে এসে বলল, পাখির গায়ে গুলি লেগেছে। কিন্তু কী করে যে শালা ওই হালতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল কে জানে! চুনিবাবুকে খুশখরিটা জানিয়ে দিন।

রমেন হালদার এখন রীতিমতো কঁপছে। মানুষ খুন করাটা কোনওদিনই ওর সিলেবাসের মধ্যে ছিল না।

আমি প্রশ্ন করলাম, চুনি ব্যানার্জিকে কী করে খবর দেন আপনি?

টেলিফোনে।

কোথায় ফোন করেন?

আমার ঘরের উলটোদিকের দুশো আঠেরো নম্বর ঘরে। চুনিদা ওই ঘরেই আছে কাল থেকে। ভাঙা দাঁতের জায়গাটায় জিভ বুলিয়ে নিল রমেন।

আমার হাসি পেয়ে গেল। কী চমৎকার ব্যবস্থা! শরদিন্দু মিত্র বোধহয় এরকম হিসেবের কথা ভাবেননি। কিন্তু এখন আমার সত্যিকারের চুনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। রিসেপশানের খবর অনুযায়ী দুশো আঠেরো নম্বর ঘরেই রয়েছে হীরা, আর তার সঙ্গে হীরার মাশুক চুনি।

আমার গলা খুসখুস করছিল। একটু ভেজাতে পারলে ভালো হত। সে-কথাই বললাম রমেনকে। ও মাথা নাড়ল–ঘরে স্টক নেই।

থ্রি-নট-থ্রি-টা এতক্ষণ ধরে ঝুলিয়ে রেখে বাঁ-হাতটা টনটন করছিল। ওটা রেখে দিলাম তোশকের নীচে। বিছানাটা আবার ঠিকঠাক করে দিলাম। রমেনকে বললাম সবুজ পরদাটা ঠেলে একপাশে সরিয়ে দিতে। ও চটপট কথা শুনল। এরকম প্রভুভক্ত লাখে একটা পাওয়া যায়।

চুনি ব্যানার্জিকে ফোন করে এ-ঘরে ডেকে নিয়ে এলে কেমন হয়? এবং স্বাভাবিকভাবেই ফোনটা করতে পারে রমেন হালদার। অতএব রমেনকে বললাম ফোন করতে।

ঘরের উত্তরদিকের দেওয়াল ঘেঁষে টেলিফোন। রমেন রিসিভার তুলে ডায়াল ঘোরাল। ইন্টারকম লাইনের ব্যবস্থা। সুতরাং তিনটে সংখ্যা ঘোরালেই কাজ হয়।

আমি টেলিফোনের কাছে এগিয়ে যেতে চাইলাম। কারণ সম্ভব হলে দু-প্রান্তের কথাই আমি শুনতে চাই। কিন্তু আমার অগ্রগতিতে বাধা দিল সুরিন্দার। ওর পড়ে থাকা নিথর দেহটাকে এতক্ষণ কোনও আমল দিইনি আমি। না দিয়ে যে ভুল করেছি সেটা এখন বুঝলাম।

সুরিন্দার পেশাদার। হয়তো ও চোখ খুলেছে কয়েক মিনিট আগেই, এবং বেশ খুঁটিয়ে আমাকে এবং আমার হাতে ধরা অস্ত্রশস্ত্রকে লক্ষ্য করেছে। তাই প্রথম হ্যাঁচকাটা মারল আমার ডান পা ধরে। আর প্রায় একইসঙ্গে আমার হাতের শটগান ধরে টান মারল।

সুরিন্দার জানে না আমিও পেশাদার। ও যে পাঠশালায় পড়েছে সেখানে পড়াশোনা করলে আমি নির্ঘাত ডবল প্রমোশন পেতাম। সুতরাং ওর হ্যাঁচকা টানে টাল খেয়ে পড়ে যেতে-যেতেই শটগানের ট্রিগারে আঙুলের চাপ দিলাম। কারণ নয়েজ পলিউশানের চেয়ে প্রাণের দাম বেশি।

গুলির শব্দ হল। তবে আওয়াজটা যত জোরে শোনাবে ভেবেছিলাম ততটা শোনাল না। সুরিন্দার শটগান ধরে টান মেরেছিল। তবে ও ভাবেনি ওই বেটাল অবস্থাতেও আমি ফায়ার করতে পারব।

না, গুলি সুরিন্দারের গায়ে লাগেনি। গুলি গিয়ে বিঁধেছে কার্পেটে। তবে গুলি ছোঁড়ার পরক্ষণেই শটগানের নল চেপে ধরেছিল সুরিন্দার। তাই ওর হাত পুড়ে গেছে। ও যতটা ক্ষিপ্রভাবে আমাকে আক্রমণ করেছিল তার চেয়েও দ্রুতগতিতে ফিরিয়ে নিল ছ্যাকা খাওয়া হাতটা।

আমি পড়ে গিয়েছিলাম মেঝেতে। শটগানও ছিটকে গেছে হাত থেকে। কিন্তু সুরিন্দারের ছ্যাকা খাওয়ার ব্যাপারটা আমাকে বাড়তি দু-তিন সেকেন্ড সময় দিয়েছে। তাই-ই যথেষ্ট। কোনওরকম চিন্তাভাবনা না করেই পা চালালাম। বোধহয় সুরিন্দারের মাথায় লাগল। কিন্তু ও দমল না। স্বাস্থ্যবান শরীরটাকে বেঁকিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানায় কোণে। ও জানে, তোশক ওলটালেই দূরপাল্লার মেশিনটা ওখান থেকে পাওয়া যাবে।

মেশিনটা সুরিন্দার পেল। কিন্তু ততক্ষণে সাইলেন্সার লাগানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন আমি পকেট থেকে বের করে ফেলেছি, এবং নিশানা নির্ভুল করার ব্যাপারে কোনওরকম চেষ্টা না করেই ট্রিগার টিপেছি।

গুলি সুরিন্দারের উরুতে লাগল। ও কাত হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। যন্ত্রণার দু-একটা টুকরো চিৎকার বেরিয়ে আসতে লাগল ওর মুখ থেকে।

এবার আমি সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ানোর সময় পেলাম। স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন পকেটে ঢুকিয়ে একটু দূরে পড়ে থাকা শটগানটা তুলে নিলাম। মনের ভেতরে একটা ঠান্ডা রাগ কাজ করছিল। এই সুরিন্দার নামের শুয়োরের বাচ্চাটাকে কোথা থেকে তুলোধোনা শুরু করব? মাথা থেকে, না পা থেকে?

আমি সুরিন্দারের কাছে এগিয়ে গেলাম। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, রমেন ফোনে কথা বলা শেষ করে ফোন নামিয়ে রেখে প্রায় দৌড়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে।

ফ্রিজ! আমি চেঁচিয়ে হুকুম দিলাম। আমার শটগান রমেনের বুক দেখছে।

রমেন থেমে গেল মাঝপথে। ভয়ে কেঁপে যাওয়া গলায় বলল, প্লিজ, ওকে ছেড়ে দিন। চুনিদা আসছে এ-ঘরে। প্লিজ…।

আমি সুরিন্দারের বুকে এক লাথি কলাম। অমিতাভ শিকদারের সঙ্গে যারাই মোকাবিলা করে তারা জীবনভর সে কথা ইয়াদ রাখে। ওঁক শব্দ করল সুরিন্দার। আঘাত সামলাতে চিৎ হয়ে গেল। ওর উরু থেকে রক্ত গড়াচ্ছে।

আমি সুরিন্দারের বহু যত্নে বানানো পেশি ও হাড় দেখছিলাম। কী অযত্নেই না আমি এখন এগুলো চুরমার করব! সাপের বাচ্চাকে মাথা না থেতলানো পর্যন্ত বিশ্বাস নেই।

সুতরাং শটগানটাকে উলটো করে বাগিয়ে ধরে সুরিন্দারের পাঁজরের মোক্ষম জায়গায় বসিয়ে দিলাম। সুন্দর শব্দ হল–পাকাটি ভাঙার মতো। সুরিন্দার চেঁচাল প্রাণপণে। আর একইসঙ্গে টুং টাং শব্দে কলিংবেল বেজে উঠল।

আমার চোখেমুখে বোধহয় খুন চেপে গিয়েছিল। কারণ রমেন ছুটে এসে আমাকে একরকম জড়িয়ে ধরল। বলল, চুনিদা এসে গেছে। ওকে এবার ছেড়ে দিন, প্লিজ।

আমি এক ধাক্কায় রমেনকে দরজার দিকে ঠেলে দিলাম। তারপর শটগান বাগিয়ে ধরে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম। জীবনমরণের খেলা আমাকে একধরনের বিকৃত আনন্দ দেয়। স্পষ্ট টের পাচ্ছি, আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছে। কিন্তু মাথা বরফের মতো ঠান্ডা।

রমেন প্রথমে দরজা সামান্য ফাঁক করল। তারপর দরজা খুলে দিয়েই একপাশে সরে দাঁড়াল। আসল চুনিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ঘরে ঢুকেই দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল। ভুরু কুঁচকে চারপাশটা দেখল। পরিস্থিতি আঁচ করল বোধহয়। তারপর রীতিমতো শান্ত গলায় বলল, রমেন, সুরিন্দারকে ফার্স্ট এইড দাও। কোনওরকমে ম্যানেজ করো। আমি এখন আর বাড়তি ঝামেলা চাই না।

চুনি ব্যানার্জির কথায় ব্যক্তিত্বের ছাপ টের পেলাম। এই লোকের পক্ষেই মিত্র সাহেবের ডানহাত হওয়া সম্ভব। কিন্তু সুরিন্দারের এখন হয়তো লাস্ট এইড প্রয়োজন।

চুনিলালের চোখে রিমলেস চশমা নেই। মাথার চুলও ব্যাকব্রাশ করা নয় সামান্য এলোমেলো। বোধহয় আলতো ছদ্মবেশ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ফটোর চেহারার সঙ্গে মিলছে পুরোপুরি।

আমার দিকে, আমার হাতের দিকে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় চুনি বলল, মিস্টার শিকদার, আমার ঘরে চলুন–সেখানে বসে আমরা নিরিবিলি কথা বলতে পারি।

আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে চুনিলাল বলল, কোনও প্রশ্ন নয়–অন্তত এখানে। আমি চাই আমাদের কথাবার্তা নিরিবিলিতে হোক। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তা হলে শটগানটা কি লুকিয়ে ফেলবেন? আমার চোখে বোধহয় দ্বিধা ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করেই চুনি আরও বলল, না, ভয় নেই। আমাকে আপনি সুরিন্দারের মতো মূর্খ ভাববেন না। আপনার নাম যারা জানে তারা অন্তত বোকার মতো ঝুঁকি নেবে না।

আমি এতক্ষণে হাসতে পারলাম। নিজের কোম্পানির জন্য জুতসই ডেপুটি ম্যানেজার বাছতে কোনও ভুল করেননি শরদিন্দু মিত্র। সুতরাং শটগানটা জায়গা মতো গুঁজে নিয়ে চুনি ব্যানার্জির কাছে এগিয়ে গেলাম। বললাম, চলুন, নিরিবিলিতে বসে কথা বলা যাক।

ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম হাসল চুনি। আমার হাতে হাত মেলাল।

আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। এক্ষুনি ভেজানো দরকার। শুকনো গলায় বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। আশা করি দুশো আঠেরো নম্বর ঘরটা মরুভূমি নয়।

দুশো তিন নম্বর থেকে বাইরে বেরিয়ে কোনওরকম শোরগোল বা ভিড় নজরে পড়ল । না, গুলির আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি। তা ছাড়া ব্লু গার্ডেনে মাইকেলের সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তার জম্পেশ ধুমধাম এখান থেকেও শোনা যাচ্ছে। সেই আওয়াজে আমার তৈরি নয়েজ পলিউশান দিব্যি চাপা পড়ে গেছে। দূষণ দিয়েই দূষণকে ঢাকতে হয়।

চাবি ঘুরিয়ে দুশো আঠেরো নম্বর ঘরের দরজা খুলতে খুলতে চুনি প্রশ্ন করল, শরদিন্দু মিত্র আপনাকে পাঠিয়েছে?

আমি বললাম, হ্যাঁ। একটু চুপ করে থেকে যোগ করলাম, হীরাকে আমি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি। আর আপনিও আমার সঙ্গে গেলে ভালো হয়। মিত্র সাহেব আপনাদের দুজনকে আশীর্বাদ করার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

অবাক চোখে আমার দিকে ফিরে তাকাল চুনি। বলল, তাই? তারপর করিডরে দাঁড়িয়েই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। একটা মেয়ে বীভৎস সেজেগুজে আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হাসির শব্দে চোখ ফিরিয়ে দেখল আমাদের দিকে।

আমি বিব্রতভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, মেয়েটা আমাকে লক্ষ্য করে বাঁকা হেসে। চোখ মারল।

নাঃ, হোটেল রিভারভিউর জবাব নেই!

.

চুনি ব্যানার্জির কাছ থেকে গোটা গল্পটা শুনলাম।

দুশো আঠেরোর সঙ্গে দুশো তিনের একমাত্র মাপ ছাড়া সাজসজ্জায় আর কোনও তফাত নেই। ভেড়ার লোমের মতো হালকা বাদামি কার্পেটে মেঝে ঢাকা। ঘরে তিনরকম আলো। তার মধ্যে নৈশবাতির চেহারাটা টেডি বিয়ারের মতো। আসবাবপত্র সবই অভিজাত। সুদৃশ্য ড্রেসিং টেবিল, তার মাথায় প্রসাধন বাতি। চওড়া আধুনিক খাট, তার ওপরে পরিপাটি বিছানা। বিছানার চাদর, দেওয়ালের ডিসটেম্পার ও কার্পেট–এই তিনের রঙে মানানসই মিল।

ঘরে একটিমাত্র ছোট মাপের ফ্লুওরেসেন্ট বাতি জ্বলছিল। সেই কারণেই একটা নিষ্প্রভ ভাব ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। তারই মধ্যে নীচু লয়ে শোনা যাচ্ছে চ্যানেল মিউজিক।

দুটো সোফায় মুখোমুখি বসলাম আমরা। সামনে ছোট টেবিল। টেবিলে গ্লাস। গ্লাসে হুইস্কি। সেই হুইস্কি সঞ্জীবনী ঝরনা হয়ে আমার মরুভূমি-গলা বেয়ে নামছে। কেমন যেন এক স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে বসে আমি চুনি ব্যানার্জির কথা শুনছিলাম।

ঘরে হীরা নেই। সেটা আমাকে অবাক করেছে। কিন্তু এ-বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করিনি। সময়মতো করা যাবে।

চুনি ব্যানার্জি পানীয় নেয়নি। তার বদলে সিগারেট ধরিয়েছে। বোধহয় মাথা ঠিক রাখতে চায়–অন্তত এরকম বিপদের সময়ে।

মিস্টার শিকদার, আপনি হয়তো আমার গল্পের অনেকটাই জানেন– চুনিলাল বলতে শুরু করল।

আমি হীরাকে তখনও খুঁজে চলেছি। নাক টানছি বাতাসে যদি খুঁজে পাই পারফিউম পাউডার কিংবা শ্যাম্পুর গন্ধ।

আমি লোকটা খুব সুবিধের নই– ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চুনিলাল বলল, তবে আপনার মতো অতটা এলেমদার নয়। হীরাকে আমি ভালোবাসি। অনেকদিন ধরেই ভালোবাসি। তাই শেষ পর্যন্ত গতকাল ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি মিত্রভিলা থেকে। বিশ্বাস করুন, এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। শরদিন্দু মিত্রকে আপনি কতটা চেনেন জানি না, কিন্তু আমি চিনি।

সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল চুনি। সিগারেটটা টেবিলের অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে শার্টের পকেট থেকে চশমা বের করে নাকের ওপরে বসাল। হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করল। ওর চেহারাটা এবার নজর মহম্মদের দেওয়া ফটোগ্রাফের মতো হয়ে গেল।

বলুন, আমি শুনছি কান দিয়ে গেলাসে চুমুক দিচ্ছি না।

চুনিলাল হাসল। দুঃখের হাসি। বলল, মিত্রসাহেব তো কান দিয়ে দেখেন–রাজাদের মতো। তাই আমার সঙ্গে হীরার প্রেম মেনে নিতে পারেননি। ওঁর কানে কেউ খবর পৌঁছে দিয়েছে, আমি নাকি খুব বাজে টাইপের লোক। মাতাল, অপদার্থ, দীর্ঘশ্বাস ফেলল চুনি। ঘরের সিলিংয়ের দিকে বারদুয়েক তাকিয়ে পায়চারি করতে করতে বলল, সে যাই হোক, হীরাকে নিয়ে আমি পালিয়ে এসেছি, বিয়েও করে ফেলেছি। ও এখন আমার। ওকে বাঁচানো আমার কর্তব্য। যদি আপনি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান তা হলে আমাকেও সঙ্গে নিতে হবে, মিস্টার শিকদার। আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারব না।

আমার ঠোঁটে বোধহয় সামান্য বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছিল। সেটা লক্ষ করে চুনি বলল, জানি, আমার বয়েসটার কথা ভেবে আপনার হাসি পাচ্ছে। কিন্তু আপনার জানা উচিত, ভালোবাসার সঙ্গে বয়েসের কোনও সম্পর্ক নেই।

আমি কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বলা হয়ে উঠল না আর।

কারণ বাথরুমের ভেজানো দরজাটা খুলে গেল। প্রথমেই একটা বিলিতি সুগন্ধী আমার নাকে এসে ঝাপটা মারল। আর তারপরই হীরার সৌন্দর্য ধাক্কা মারল রীতিমতো।

এরকম এক সুন্দরীকে দেখার জন্যে সাতজন্ম সাগরতীরে বসে অপেক্ষা করা যায়। নজর মহম্মদের দেওয়া ছবিটা যেন লজ্জায় নতজানু হয়ে গেল আমার চোখের সামনে। যেন বলতে লাগল, আমি তো কেবলই ছবি, তুমি তো জীবন–।

চুনিলাল ইশারায় আমার দিকে দেখিয়ে বলল, হীরা, ইনিই অমিতাভ শিকদার। এঁর কথাই তোমাকে বলেছিলাম।

আমার হাতের গ্লাস থেমে গিয়েছিল শূন্যে। এবার সচেতন হয়ে গ্লাস নামিয়ে রাখলাম টেবিলের ওপরে। দেখতে লাগলাম হীরাকে।

পরনে বেগুনি-সাদা নকশাকাটা সালোয়ার কামিজ। মাথায় সাদা তোয়ালে জড়ানো। নাকে নাকছাবি জ্বলছে। সেইসঙ্গে গভীর দু-চোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। হয়তো কাগজের বিয়ে হয়ে গেছে।

জোড়হাতে নমস্কার করে ঘাড় কাত করে দেখল আমাকে। বুকের ভেতরে একটা তরুণ বুলবুলি উড়ে গেল আমার। সুদীর্ঘ একযুগ ধরে মরে হিম হয়ে যাওয়া পাখিটা কী করে আচমকা বেঁচে উঠল কে জানে!

এক মিনিটের মধ্যেই চুলের পরিচর‍্যা সেরে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল হীরা। চুনি ওকে সোফায় বসতে বলল। তারপর আমাকে লক্ষ করে বলল, ওর কাছে লুকোনোর কিছু নেই। ওর সামনেই সব বলছি। আগেই আপনাকে বলেছি, আমি লোক খুব সুবিধের নই। ঢিল ছুড়লে তার বদলে পাটকেল মারতে জানি। তাই হীরাকে নিয়ে মিত্রভিলা ছাড়ার আগে থেকেই আমি লোকজন ঠিক করে রেখেছিলাম। তা ছাড়া মিত্র সাহেবের অনেক গোপন খবরও আমার কানে আসে। সেরকম লোক আছে–যাকে বলে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা।

মিস্টার শিকদার, আপনার খবরটাও লোক মারফতই পেয়েছি। আর তখনই একটু ভয় পেলাম। কারণ, আপনার সম্পর্কে কিছু-কিছু আমি জানি। হীরার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ও অবশ্য কিছু জানে না।

আমার সামনে বসে থাকা মেয়েটা অদ্ভুত মিষ্টি গলায় বলে উঠল, কেন, আপনি কি ডেঞ্জারাস লোক?

প্রশ্নটা আমাকেই করা হয়েছে। বোধহয় জীবনে এই প্রথম আমার জিভ আড়ষ্ট হল, নজর হয়ে গেল বিব্রত। কোনওরকমে বলাম, এসব বাজে কথায় কান দিতে নেই।

চুনি বলল, আমার কিছু চ্যালাচামুণ্ডা আছে। তাদের নিয়ে শরদিন্দু মিত্রকে আমি এতদিন কম সাহায্য করিনি। এখন সাহায্যের দরকার হল আমারই। রমেন হালদারের সঙ্গে আমার চেহারা কিছুটা মেলে। ও লম্বা-চওড়ায় আমারই মতো। তাই ওকে আমার মতো করে সাজিয়ে তুলে দিলাম দুশো তিন নম্বর ঘরে। সঙ্গে সুরিন্দার–বন্দুকবাজ সুরিন্দার। আমি জানতাম কেউ না কেউ আসবে আমাকে খতম করতে। এসেছিল। জনার্দন সামন্ত। ওকে রেস্তোরাঁয় দেখামাত্রই আমি চিনতে পেরেছি। তা ছাড়া মাইকেল ডিসুজারু গার্ডেনে গান গায়…।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, ছড়া কেটে পায় সুখ, দাড়িগোঁফ এক-মুখ–।

চুনি হাসল। বলল, পরিচয় হয়েছে তা হলে? ওই মাইকেল হল সুরিন্দারের পুরোনো চেনা লোক। মাইকেলের কাছ থেকেও সুরিন্দার জানতে পারে জনার্দন সামন্ত আমার খোঁজখবর করছে। তখন ও জনার্দনকে খতম করার ব্যবস্থা নেয়–।

লাল মারুতির লালুর নাম তা হলে জনার্দন সামন্ত।

জনার্দন হল শরদিন্দু মিত্রের পুরোনো ভাড়াটে গুণ্ডা। অনেকবার ওর নাম শুনেছি। যাই হোক, তারপর আমরা আপনার খবর পাই–যে আপনি রিভারভিউতে এসে উঠেছেন। এরপর তো সবই জানেন–।

আমি গ্লাসের তরলটুকু এক ঢোকে গলায় ঢেলে দিলাম। বললাম, চুনিবাবু, আমরা রীতিমতো ভাগ্যবান যে, এ-পর্যন্ত মাত্র একটাই লাশ পড়েছে–শুধু জনার্দন সামন্ত খরচ হয়েছে। আর সুরিন্দার খরচ হয়েছে আধাআধি। এ-ব্যাপারে আর বডি পড়ুক তা আমি চাই না। আপনি টেলিফোন করে মিত্র সাহেবের সঙ্গে মিটমাট করে নিন। তা হলে আমিও একটা অস্বস্তির হাত থেকে বেঁচে যাই। তখন আমি অন্য ক্লায়েন্ট খুঁজব।

অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল। এইবার কথা বলল হীরা।

মিস্টার শিকদার, আমি ওকে অনেক বুঝিয়েছি, কিন্তু ও কিছুতেই আমার কথা শুনছে না। আমি বলেছি, বাপি আমাদের ভালো চায়। আমরা ফিরে গেলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সে কথা কে শোনে।

চুনি অধৈর্যভাবে একটা শব্দ করল।

আমি বললাম, কথাটা বোধহয় ঠিক, চুনিবাবু। কারণ, আবার বলছি, আমি নিজের কানে শুনেছি, মিত্র সাহেব আপনাদের আশীর্বাদ করার জন্যে অপেক্ষা করছেন। উনি টেলিফোনে কাকে যেন বলছিলেন।

চুনিলালের চোখ কপালে উঠল। ভুরুর ওপরে ভাঁজ পড়ল। বলল, সত্যি? আসলে আমি একটা এমন ব্যাপার জেনেছি যেটা কাউকে বলতে পারছি না।

কী ব্যাপার? হীরা আকুল হয়ে জানতে চাইল। সুন্দর চোখে তাকাল স্বামীর দিকে।

তোমাকেও বলা যাবে না। গম্ভীরভাবে জবাব দিল চুনি। তারপর বউকে সাফাই দেবার সুরে বলল, কিছু মনে কোরো না। সময় হলেই সব বলব।

এবারে লাখ টাকার প্রশ্নটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল চুনিলাল ও মিস্টার শিকদার, এখন সবকিছুই আপনার হাতে। বলুন, এখন কী করবেন?

আমার মনে এক অদ্ভুত তোলপাড় চলছিল। কী করব এখন আমি?

এমন সময় দরজায় নক করল কেউ। তারপর কলিংবেল টিপল।

তড়াক করে উঠে দাঁড়াল চুনিলাল। বলল, কে এল? এখন তো কারও আসার কথা নয়!

আমি শটগানটা ঝটিতি বের করে নিলাম। দৌড়ে গিয়ে দরজার পাশে পজিশন নিলাম। চুনিলালও পকেটে হাত ঢোকাল। হীরাকে ইশারা করল বাথরুমে গিয়ে ঢুকতে। তারপর এগিয়ে গেল দরজার কাছে। চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল, কে? কী চাই?

দরজার ওপিঠ থেকে উত্তর এল? আমি, খুদে–।

আমার মাথার ভেতরে যুক্তি-বুদ্ধির একটা ঘুড়ি লাট খেতে শুরু করল। খুদে? এখানে?

চুনিলাল হাসল। আমার দিকে ফিরে বলল, বলেছিলাম না, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! খুদেই আমাকে সব খবর দেয়। ও মিত্র সাহেবের লোক।

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, জানি।

দরজা খুলে দিল চুনি। এবং খুদে ঢুকে পড়ল ঘরে। চাপা গলায় বলল, খবর আছে, চুনিবাবু–বলেই আমার দিকে তাকাল। ওর চোখের নজর দেখেই বোঝা গেল, সকালের থাপ্পড়টা ও ভোলেনি। না ভোলাটাই স্বাভাবিক। আমার শিক্ষা কেউ সহজে ভোলে না।

শটগানটা আমি লুকিয়ে ফেললাম আবার। লক্ষ করলাম, খুদের চোখ ঘরটাকে জরিপ করছে। বোধহয় হীরাকে খুঁজছে।

নজর মহম্মদের কাছ থেকে হীরা ও চুনির গল্প শোনার সময় আমার কেমন যেন খটকা লেগেছিল। এখন চুনিলালের কথা শুনে আর খুদেকে এখানে দেখে সেই খটকা আরও জোরদার হল।

খুদে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ওকে বসতে বলে চুনি আমার কাছে সরে এল। বলল চাপা গলায়, মিস্টার শিকদার, এখন আপনি ভরসা। আমি জানি মিত্র সাহেব এখন আমার ওপরে যেভাবে খুশি যেমন খুশি আক্রমণ চালাবেন। হীরার জন্যে উনি ভাবেন, আমার জন্যে না। আপনি একটু পরে আবার আসবেন। কথা আছে।

আমি বললাম, আপনি কথা বলে নিন। আমি দুশো সাত নম্বরে আমার ঘরে আছি। কথা শেষ হয়ে গেলেই আমাকে একটা ফোন করে দেবেন–।

একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এলাম। হীরার কথাটা কানে ভাসছিল : কেন, আপনি কি ডেঞ্জারাস লোক?

এ-প্রশ্নের উত্তর আমি নিজেই জানি না।

.

টেলিফোন এল মিনিট কুড়ি পরেই। এবং ফোনটা করল হীরা।

চ্যানেল মিউজিক চালিয়ে বিছানায় শুয়ে আয়েস করছিলাম। টেলিফোন ধরার পরই হাত পা কাঁপতে লাগল অদ্ভুতভাবে। কারণ হীরা কথা বলছে অস্বাভাবিক সুরে। একটা ভেজা চড়ুই শীতের রাতে আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।

শিগগির আসুন! শিগগির—প্লিজ–।

এই কণ্ঠস্বর যখন ডাকে তখন হিমালয় থেকে কোনও হঠযোগীও ছুটে আসে। সুতরাং আমিও যে হঠকারী হয়ে ছুটে যাব সে আর বেশি কী!

চোখের পলকে তৈরি হয়ে দুশো আঠেরো নম্বরের দরজায় পৌঁছে দেখি দরজা বন্ধ। কলিংবেল টেপামাত্রই দরজা খুলে দিল হীরা। ওর কান্না-ভেজা ভয়ার্ত মুখ আমাকে বিপন্ন করে তুলল। ভয় পাওয়া মুখও এত মিষ্টি।

ঘরে ঢুকেই পায়ের ধাক্কায় দরজা বন্ধ করে দিলাম। আর একইসঙ্গে চোখে পড়ল ঘরের বাঁ দিকের কোণে চুনি আর খুদে ঘোড়া-ঘোড়া খেলছে। চুনি হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গিতে কার্পেটের ওপরে। আর ওর পিঠের দু-দিকে পা রেখে ঘোড়ায় চড়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে খুদে। খুদের দু-হাতে নীল রঙের নাইলনের দড়ি। দড়ির লাগামটা চুনিলালের গলায় লাগিয়ে খুদে টানছে। চুনির চোখ মুখ টকটকে লাল। মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, হাতে আর সময় নেই।

ওই অবস্থাতেও খুদে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। কিন্তু ওর দড়ির টান এতটুকুও শিথিল হল না।

লক্ষ করলাম, হীরার কপালের একটা পাশ ফুলে উঠেছে। সেখানে রক্তের দাগও রয়েছে। ও আমার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কোনওরকমে বলল, ওকে বাঁচান! প্লিজ!

আমার মাথার মধ্যে অঙ্ক কষার কাজ চলছিল। খুদের ভূমিকাটা আমার মাথার মধ্যে ঠিক পরিষ্কার হচ্ছিল না। ও কার হয়ে কাজ করছে? ওর একটু আগের বেপরোয়া হাসি বলে দিচ্ছে। আমরা একই লোকের হয়ে কাজ করছি। সে লোকটির নাম শরদিন্দু মিত্র। কিন্তু মিত্র সাহেবের কথার সঙ্গে যে এই মুহূর্তের গল্পটা মিলছে না। চুনিকে যদি খতম করারই দরকার ছিল তা হলে আমাকে ডাকা হয়েছে কেন?

হীরা এবার হাউহাউ করে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপরে। বলল, অমিতদা, অমিতদা, ওকে বাঁচান–।

আমার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে গেল।

ঘরের নরম আলো, হালকা চ্যানেল মিউজিক আর সামনের ওই বীভৎস ঘোড়া-ঘোড়া খেলা আমার বুকের ভেতরে ঝড় তুলেছিল। সেই ঝড়ে যখন বনের গাছপালা উথালপাথাল কাঁপছে তখনই মেয়েটার ওই দাদা ডাক তাতে দাবানল জ্বেলে দিয়েছে।

কে দাদা? কার দাদা? আমার জীবনে কেউ নেই। মা-বাবা-ভাই-বোন–কেউ নেই! সব শালা ফটো হয়ে দেওয়ালে ঝুলছে। আর আমি একা–এক জিন্দা লাশ, মরার চেষ্টা করছি।

অমিতদা!

শয়তান সর্বনাশী মেয়েটা আবার ডাকছে ওই নামে।

অমিতদা!

চোখ ঝাপসা হয়ে এল আমার। কিন্তু ওই অবস্থাতেই স্লো মোশনে শটগানটা বের করে খুদের দিকে তাক করলাম। মাংস চিবিয়ে বলার মতো করে বললাম, ছেড়ে দে।

আমার চোখে-মুখে খুদে কী দেখল কে জানে, ছেড়ে দিল চুনিকে। চুনি ধপ করে পড়ে গেল মেঝেতে। আর হীরা ছুটে গিয়ে কেঁদে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর শরীরের ওপরে।

খুদে অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল। তারপর হাসিমুখে এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে। জিগ্যেস করল, কী হল, বস, খেপে গেলে কেন?

কোনও জবাব না দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে শটগানটা ঘুরিয়ে বসিয়ে দিলাম খুদের নাকের ওপরে। শব্দ হল। ওর ভারী দেহটা যেন পাথরে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। কিন্তু আমি থামলাম না। কানে বাজছে বহুযুগ ধরে না-শোনা অলৌকিক ডাক অমিতদা! সুতরাং দ্বিতীয় আঘাতটা করলাম ওর মাথায়।

কিন্তু খুদে সেটা রুখে দিল। ওর গায়ের জোর আমি টের পেলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে ও আবার হাসল। অথচ ওর নাক ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। বলল, এসব কী উলটোপালটা কাজ করছ, বস্? মিত্তিরসাহেব রাগ করবেন।

আমিও হাসলাম। শটগানটা হাত থেকে ফেলে দিলাম মেঝেতে।

আমি জানতাম, এরপর খুদে কী করবে। ও শটগানটা তুলে নেবে মেঝে থেকে। তারপর দাবার চাল উলটে দেবে। ওর মোটা বুদ্ধি ওকে অন্তত এই শিক্ষাই দিয়েছে। আর ও ভুলে গেছে রোজ এক ডজন আর্স দিয়ে আমি ব্রেকফাস্ট খাই।

সুতরাং খুদে যখন শটগানটা কুড়িয়ে নিচ্ছে তখনই আমি পকেট থেকে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটা বের করে ওর কাঁধে এবং কোমরে গুলি করলাম।

খুদের বেলা আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাইনি। ওর প্রতিবন্ধী জীবনের জন্যে অমিতাভ শিকদারের সমবেদনা রইল।

খুদে যখন টলে পড়ছে তখনই ওকে পা দিয়ে ঠেলে দিয়েছি আমি। আর তৎপর হাতে শটগানটা তুলে নিয়েছি। আমার দু-হাতের দুটো মেশিন খুদের বাকি সাহস কেড়ে নিল। খুদে চেঁচায়নি। জানে, চেঁচালে ওরও বিপদ। তাই ও শুধু গোঙাতে লাগল আর বলতে লাগল, তুমি বাঁচবে না, বস্…।

কোন্ শালা বাঁচতে চায়?আমি ওর মুখে থুতু ছিটিয়ে দিলাম। ঘড়ি দেখলাম। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। রিভারভিউ আমাদের কাছে আর কতক্ষণ নিরাপদ কে জানে!

শটগান ও রিভলভার যথাস্থানে রেখে ছুটে গেলাম হীরা আর চুনির কাছে। চুনির চোখ উলটে গেছে। নাইলন দড়িটা কেটে বসে গেছে গলায়। ওর বিবর্ণ ঠোঁট নড়ছে। কী যেন বলতে চাইছে বিড়বিড় করে।

হীরা কাঁদছিল অঝোরে। বারবার বলছিল, অমিতদা, ওকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন– জলদি!

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, হাসপাতাল এখন কিছু করতে পারবে না। চুনিলাল এখন পাতালের পথে।

হীরাকে সরিয়ে দিয়ে আমি ঝুঁকে পড়লাম চুনির মুখের কাছে। ও কী বলছে শুনতে চাইলাম।

চুনির ফুলে ওঠা ঠোঁট থরথর করে কাঁপছিল। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর বুঝতে পারলাম ওর কথাগুলো : শরদিন্দু মিত্র কাউকে…ছাড়বে না। আমরা সবাই দাবার খুঁটি…সবাই। খুদে এরকমভাবে আমাকে ঠকাবে বুঝতে পারিনি। মিস্টার শিকদার…।

আমি আরও ঝুঁকে পড়লাম চুনির ওপরে।

…হীরাকে দেখবেন…ওকে যেন কেউ কিছু না করে…হীরা…হীরা…।

আমি সরে এলাম। হীরাকে ঠেলে দিলাম ওর স্বামীর দিকে। শেষ কথাগুলো অন্তত ও শুনুক। শেষ কথায় ওরই একমাত্র অধিকার।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে চলে এলাম দরজার কাছে। মন বলে উঠল, সময় নেই। হীরাকে নিয়ে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে আমাকে।

খুদের নড়াচড়া থেমে গেছে। তবে খেল খতম ভাবার কোনও কারণ নেই। ওর ক্ষত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে কার্পেটে। হোটেল রিভারভিউর দুটো দামি কার্পেট নষ্ট হল। সুরিন্দার আর খুদে যদি দুশো তিন আর দুশো আঠেরো নম্বরে শহিদ হয় তা হলে এই দুটো ঘর হয়তো বাতিলের খাতায় জমা পড়বে। আর এই হোটেলের নামটা রিভারভিউ থেকে হয়তো মার্ডারভিউ হয়ে যাবে।

হীরার কান্না থামেনি। হঠাৎই কান্নার রেশ জোরালো হয়ে উঠতেই বুঝলাম সব শেষ, এবার এক মিনিট নীরবতা পালন করা দরকার। আমি আর চুনিলাল সেটা করলাম বটে কিন্তু হীরা অবাধ্য হল। ওকে ডেকে বললাম, হীরা, জলদি! আমাদের এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে।

ও উঠতে চাইছিল না। আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে টেনে তুললাম। তারপর বিছানার তোশক সরিয়ে চ্যানেল মিউজিকের সুইচগুলো খুঁজে পেলাম। মিউজিকের ভলিয়ুম বাড়িয়ে দিলাম। স্বর্গীয় কিশোরকুমার গাইছিলেন? হমে তুমসে প্যার কিতনা ইয়ে তুম নহি জানতে, মগর জি নহি সকতে তুমহারে বিনা–।

বিছানার চাদরটা তুলে নিয়ে চুনিলালের মৃতদেহ ঢেকে দিলাম। ওঁ শান্তি।

তারপর হীরাকে ডাকলাম, চলে এসো–।

এখন সামনে কোন বিপদ অপেক্ষা করছে কে জানে!

হোটেলের করিডরে কোনও ঝামেলা টের পেলাম না। হীরাকে বলেছি মুখে ওড়না জড়িয়ে নিতে। ও একটুও তর্ক না করে সাদা ওড়নাটা জড়িয়ে নিয়েছে মাথায়। বেশ বউ-বউ লাগছে। আমার ব্রিফকেস পড়ে আছে বিছানার ওপরে। যদি আজকের রাতটা জানে বেঁচে যাই তা হলে কাল ওটা দরকার হবে। আর যদি কপাল খারাপ হয়, তা হলে ব্রিফকেস স্মৃতি হয়ে যাবে।

সতর্কভাবে পা ফেলে নীচে নেমে এলাম। ইচ্ছে করেই এলিভেটর ব্যবহার করিনি। ওই ছোট্ট জায়গায় আমার কেমন অস্বস্তি হয়।

অবশেষে একতলায় হোটেলের লাউঞ্জ। আমি হীরার অনুমতি নিয়ে ওকে সামান্য কাছে টেনে নিয়েছি। লোকে বোধহয় আমাদের নতুন বর-বউ ভাবছে। ভাবুক। যতক্ষণ শ্বাস পড়ছে ততক্ষণ এসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে ভাবা উচিত নয়। কে জানে জনার্দন সামন্ত কিংবা সুরিন্দারের মতো কেউ কোথাও ওত পেতে আছে কি না!

কার পার্কের কাছে এসে কাউকে দেখতে পেলাম না। উঁহু, ভুল হল। বরং বলা উচিত, সন্দেহজনক কাউকে দেখতে পেলাম না। সারি-সারি গাড়ি পার্ক করা রয়েছে। কয়েকটা গাড়িতে ড্রাইভাররা স্টিয়ারিং-এ মাথা ঝুঁকিয়ে ঝিমোচ্ছে। শিবনাথ অনেকটা দূরে, হোটেলের সীমানাপ্রাচীরের কাছে দাঁড়িয়ে একটা লোকের সঙ্গে গল্প করছে।

আমি হীরাকে নিয়ে উঠে পড়লাম আমার গাড়িতে। শটগান ও স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন বের করে সিটের ওপর রাখলাম। ইঞ্জিন চালু করে এক ঝটকায় গাড়িটা বের করে নিয়ে কাঁচাচ আওয়াজ তুলে দ্রুত বাঁক নিয়েই গতি বাড়িয়ে দিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে লক্ষ করলাম, শিবনাথের সঙ্গে কথায় ব্যস্ত লোকটা দৌড়ে গিয়ে উঠল একটা কালো অ্যামবাসাডর। ও, আমার ধারণা তা হলে ভুল হয়নি। আর একজন জনার্দন সামন্ত তৈরিই ছিল! আমি বাঁ হাতের শক্ত মুঠোয় শটগানের বাঁটটা চেপে ধরলাম। এই বন্দুকটা সকাল থেকে ভুখা দিন কাটাচ্ছে। আর নয়, সময় এসে গেছে। এখন থেকে ভুখ হরতাল বন্ধ।

গাড়ির হেডলাইট জ্বলছে। সামনের রাস্তা গড়িয়ে ছুটে আসছে চাকার তলায় আত্মহত্যা করছে। আমি দুরন্ত গতিতে পৌঁছে গেলাম হোটেলের সিংদরজায়। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীরা ভালোমন্দ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার গাড়ি পিছলে বেরিয়ে পড়েছে বাইরের রাস্তায়।

আর তখনই প্রথম গুলির শব্দ শোনা গেল। বোধহয় পিছনের অ্যামবাসাডর থেকে কেউ গুলি ছুঁড়েছে।

হোটেলের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে কয়েকটা বড় বড় গাছ। হোটেলের লনে লাগানো হ্যালোজেন বাতির আলো সেই গাছের ওপরে পড়েছে। গুলির শব্দে পাখিরা চঞ্চল হয়ে গাছের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে এলোমেলো উড়ে বেড়াতে লাগল। হীরা ওর হাত রাখল আমার হাতের ওপরে। স্পষ্ট টের পেলাম, মেয়েটার কোমল হাত কাঁপছে।

এরপর শুরু হল দুরন্ত ছুট। রাতের হুগলি নদী থেকে ছুটে আসা পাগল বাতাস আমাদের শান্ত করতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু হীরার ফেঁপানো কান্না তাতে থামছিল কই?

চোখের সামনে অন্ধকার নির্জন পিচের রাস্তা। কখনও কখনও ছুটে আসা হেডলাইটের আলো। সেই আলোয় হীরার মুখ দেখা যাচ্ছে : কান্নার জলছবি। আর আমার গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দুপাশের ঝোপেঝাড়ে গাছে চকিতের জন্যে যেন ঝলসে উঠছে ফ্ল্যাশ বা।

টায়ারের বাঁক নেওয়ার শব্দ আহত হায়েনার কান্না। আর ইঞ্জিন চিতাবাঘের গর্জন। তারই মধ্যে আবার শব্দ তুলল ফায়ারিং-এর শব্দ। অ্যামবাসাডর গাড়ির অনুসরণকারী অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

অ্যাকসিলারেটরে আমার পা চেপে বসেছিল, কিন্তু তাতেও আশ মিটছে না কিছুতেই । আরও অনেক কিছু আমাকে দলে পিষে নিকেশ করতে হবে। যুদ্ধের দামামায় আঘাত পড়েছে। কেউ ঘা দিয়েছে প্রাণপণে বুকের ভেতরে ও অমিতদা! এক সদ্যবিধবার সিঁথির সিঁদুর কেন মুছে গেল আমাকে জানতে হবে। জানতেই হবে!

রিয়ারভিউ মিরারে অ্যামবাসাডরের একজোড়া চোখ জ্বলছে। দূরত্ব কমে আসছে ধীরে ধীরে। এখন গুলি চালালে আমাদের গায়ে বিধবে কি না জানি না, তবে গাড়ির বডিতে বা কাঁচে লাগতেই পারে।

হীরা কান্না ভাঙা গলায় জিগ্যেস করল, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি, অমিতাদা?

কী জবাব দেব এই নিষ্পাপ মেয়েটাকে! শর্ত অনুযায়ী এখন ওকে নিয়ে যেতে হবে ওর শোকে মুহ্যমান বাবার কাছে। নিতে হবে আমার পারিশ্রমিক। তারপর জানতে হবে জটিল অঙ্কের উত্তর।

আবার গুলির শব্দ। গাড়ির পেছন ও সামনের দুটো কাঁচই ফুটো হয়ে গেল। হীরা চিৎকার করে মাথা নীচু করল। আমি দাঁতে দাঁত চেপে স্টিয়ারিং এদিক-ওদিক করে সাপের মতো এঁকেবেঁকে পথ চলতে লাগলাম।

কিন্তু একটু পরেই সরু পিচের রাস্তায় গাড়িটা পাশাপাশি এসে গেল। দুটো গাড়ি এলোপাতাড়ি চলতে-চলতে ধাক্কা খেল গায়ে-গায়ে। ধাতুর সঙ্গে ধাতুর সংঘর্ষের শব্দ হল।

হীরা চিৎকার করে উঠল। বসে পড়ল সিটের নীচের অংশে।

আর আমি বাঁ হাতে স্টিয়ারিং ধরে শটগানটা ডান হাতে উঁচিয়ে ধরলাম।

ওই এলোমেলো চলার মধ্যেই দেখতে পেলাম অ্যামবাসাডরের স্টিয়ারিং-এ একটা কালো ছায়া। আর তার পাশেই আর একজন। তার হাতে লম্বা লাঠির মতো কী যেন একটা রয়েছে। বুঝতে অসুবিধে হল না, ওটা প্রকৃতপক্ষে রাইফেলের নল। লোকটা আমাদের গাড়ির দিকেই তাক করার চেষ্টা করছে।

ব্যাপারটা আমার অবাক লাগল। এরা নিশ্চয়ই চুনিলালের দল নয়, শরদিন্দু মিত্রের দল। তাই যদি হয় তা হলে এরা কাকে খতম করতে চাইছে? আমাকে, না হীরাকে? নাকি দুজনকেই? আর কেনই বা খতম করতে চাইছে? কোথাও কি কোনও ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে? নাকি চুনিলালের কথাটাই ঠিক? শরদিন্দু মিত্র কাউকে ছাড়বে না। আমরা সবাই দাবার খুঁটি। আর মিত্র সাহেব দাবা খেলছেন।

কিন্তু মিত্র সাহেব কি জানেন, এখন ওঁর সঙ্গে দাবা খেলছে শয়তানের বাচ্চা অমিতাভ শিকদার?

এতগুলো ভাবনা পলকে খেলে গেল মনের মধ্যে। আর সেই পলকের মধ্যেই চলন্ত গাড়ির দরজা খুলে শটগান ফায়ার করলাম। নিশানায় কোনও গোলমাল ছিল না। তাই রাইফেলওয়ালা ঠিকঠাক করে নল তাক করার আগেই ওর মাথা কিংবা বলা যায় মাথার অবশিষ্ট অংশ ঝুঁকে পড়ল বুকের ওপরে।

অ্যামবাসাডর গাড়িটা পিছলে এগিয়ে যেতে চাইল সামনে। আমি দরজা বন্ধ করে অ্যাকসিলারেটরে চাপ বাড়িয়েছি। দুটো গাড়িতে ধাক্কা লাগল আবার। এবারের ধাক্কাটা বেশ জোরেই। চাকার বিপর্যন্ত শব্দ, হীরার চিৎকার, ধাতুর সংঘর্ষের শব্দ সব মিলিয়ে শব্দের এক ডামাডোল। ঠিক তখনই উলটো দিক থেকে ছুটে আসা ট্রাকটা আমি দেখতে পেলাম।

সরু রাস্তায় বিশেষ জায়গা ছিল না। অতি কষ্টে আমি গাড়িটাকে বাঁ দিকে কাদার ওপরে নিয়ে গেলাম। জায়গাটা অন্ধকার ঢালু নালার মতো। রাস্তার কোনও বাতি জুলছিল না? হয় খারাপ, নয় তো লোডশেডিং। তাই আন্দাজটা জুতসই না হওয়ায় গাড়িটা টাল খেয়ে গেল।

অ্যামবাসাডরটা আমার সামনে চলে গিয়েছিল। তাই বাঁ দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করার আগেই ট্রাকের সঙ্গে ওটার ধাক্কা লাগল।

মুখোমুখি ধাক্কা নয়। ধাক্কাটা লেগেছে ডানদিকে, হেডলাইটের কাছে। ফলে ছুটন্ত ট্রাকটা নিজেকে সামলে নিয়ে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে গেছে। আর অ্যামবাসাডর গাড়িটা লাটুর মতো ঘুরপাক খেয়ে গেল খানিকটা। তারপর প্রায় উলটোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

আর দেরি নয়। শটগানে নতুন টোটা ভরে নিয়ে কাত হয়ে থাকা গাড়ি থেকে পড়লাম আমি। হীরাকে বললাম, জায়গা ছেড়ে একদম নড়বে না। তারপর এক ছুটে কালো অ্যামবাসাডরের কাছে।

স্টিয়ারিং-এ বসে থাকা লোকটা বোধহয় মাথায় সামান্য চোট পেয়ে থাকবে। কারণ, মাথায় হাত বোলাচ্ছে। আমি দরজা খোলার জন্যে হাতলে টান দিলাম, কিন্তু খুলল না। ট্রাকের ধাক্কায় ডানদিকের ফেন্ডার তুবড়ে গেছে, দরজাও সামান্য আহত। তাই পাল্লাটা এঁটে বসে গেছে।

আমার হাতে সময় নেই। ফলে শটগান কোমরে গুঁজে হেড হোল্ড প্রয়োগ করলাম। ওর চিবুকের তলায় একটা হাত, আর মাথার পিছনে অন্য হাত। সামান্য মোচড় দিয়ে টান মারতে শুরু করলাম। লোকটা আমার হাত খামচে ধরল। আঁকড়া-আঁকড়ি করতে লাগল। ওর নখ আমার হাতের নুনছাল তুলে দিচ্ছে। বেচারা জানে না, হাতের মোচড় সামান্য বাড়ালেই ও নিচ থেকে সোজা আকাশে চলে যাবে। তাই সেটা একটু জানান দিলাম। ব্যস, ওর সব লড়াই থেমে গেল। ও মাখনের মতো বেরিয়ে এল জানলা দিয়ে।

লোকটাকে আমি পেড়ে ফেললাম রাস্তায়। কোমর থেকে শটগানটা বের করে তার হাতল দিয়ে সারেগামা বাজিয়ে দিলাম ওর মাথায়। তারপর ওকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে গেলাম আমার গাড়ির কাছে।

আতঙ্ক আর উত্তেজনায় হীরা বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। ওকে বললাম পেছনের দরজা খুলতে। তারপর দুজনে মিলে লোকটাকে তুলে দিলাম পেছনের সিটে। হীরাকে ওর পাশে বসিয়ে শটগানটা ওকে দিলাম। বললাম, ঘড়ি দেখে দশমিনিট অন্তর-অন্তর লোকটার মাথায় শটগানের হাতল দিয়ে মারতে। তা হলে আমি নিশ্চিন্তে বাকি পথ গাড়ি চালাতে পারব।

হীরা জীবনে কখনও একাজ করেনি। সুন্দরীদের এ-কাজ মানায় না। কিন্তু উপায় নেই। এখন শটগানের ট্যাবলেট ছাড়া আর কোনও ওষুধ আমাদের হাতে নেই।

হীরা ভয়েভয়ে বলল, যদি মরে যায়?

আমি ওর কথার জবাব না দিয়ে বললাম, দশমিনিট হতে আর দু-মিনিট বাকি আছে।

সামনের সিট থেকে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনটা তুলে নিলাম। একছুটে চলে গেলাম অ্যামবাসাডরের কাছে। নীচু হয়ে পেট্রল ট্যাঙ্ক লক্ষ করে ফায়ার করলাম পরপর দুবার। সঙ্গে-সঙ্গে আগুন জ্বলে গেল।

গাড়িতে ফিরে এসে তাড়াহুড়ো করে গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে হীরার দিকে তাকিয়ে দেখি আগুনের আলোয় ওর সুন্দর মুখে এক মায়াময় আভা। কিন্তু চোখে ওর প্রতিজ্ঞা।

রাতের বাতাস কেটে হু-হু করে ছুটে চলল আমার গাড়ি। আজ রাতে হীরা আর ওই অজ্ঞান অথবা মৃত লোকটা আমার বাড়িতেই থাকবে। আমি ওদের পাহারা দেব সারারাত। সারারাত বাজবে নীচু স্বরের গান : প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই…।

আমি আবার দেখলাম হীরাকে।

অমিতদা!

শুধু ফটোয় ঘেরা আমার জীবন। হীরা, তুই যেন ফটো হয়ে যাস না। তোকে আমি কিছুতেই ফটো হয়ে যেতে দেব না।

.

ঘরটা মাপে বিশাল। এ-প্রান্তে দাঁড়িয়ে ও-প্রান্তের মানুষকে বোধহয় ঝাপসা দেখায়। কারণ, ঘরের দূরতম কোণে প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়্যাট টেবিল সামনে রেখে যে-মানুষটি বসে আছেন তাকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে তাকে চিনে নিতে কোনও অসুবিধে হল না : শরদিন্দু মিত্র।

আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নজর মহম্মদ। পরনে সাদা ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবি। চুল দাড়ি অভিজাত নবাবের মতো পরিপাটি।

শরদিন্দু হাসলেন। সেই সাপের মতো হাসি। ঠান্ডা হাসি। উনি বোধহয় অন্য কোনওভাবে হাসতে পারেন না। ওঁর প্লাটিনামের দাঁত দেখা গেল।

আসুন, মিস্টার শিকদার। হীরা কোথায়, আমার হীরা? উতলা সাপ তার বাচ্চার জন্যে আকুলভাবে প্রশ্ন করছে। মুখে কাল্পনিক বেদনার ছাপ।

হীরা আছে। একটু থেমে আবার বললাম, আমার কাছে আছে।

হীরার কথা মনে পড়ল আমার।

গতকাল রাতে আমরা কেউই ঘুমোতে পারিনি। একটা অচেনা অচেতন আহত মানুষকে সামনে রেখে দিশেহারার মতো বসে থেকেছি আমরা। তারপর হীরা ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে। আমি কোনও কথা বলিনি। শুধু উঠে গিয়ে টেপরেকর্ডারের সুইচ অন করে দিয়েছি। নিভিয়ে দিয়েছি ঘরের আলো। আর জ্বেলে দিয়েছি অল্প পাওয়ারের রাতের বাতি।

তারপর ফটোগুলোর নীচে জ্বেলে দিয়েছি সুগন্ধী ধূপ। শুরু হয়েছে রাতের পূজা। আমি জানি, আধো-আঁধারেও মা-বাবা-ভাই-বোন আমাকে, হীরাকে, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ভালোবাসছে। ওরা জানে কার ভালোবাসা দরকার।

টেপরেকর্ডারে গান শুরু হয়ে গিয়েছিল । একে একে সব তারা, জেনো নিভে যাবে। একলা আকাশটুকু শুধু পড়ে রবে। তোমার আমার কথা কেউ শুনবে না, আমাদের ফেলে রেখে সব চলে যাবে…।

এই গানটা মায়ের বড় প্রিয় ছিল।

হীরা গান শুনতে-শুনতে কান্না থামাল। ডেকে উঠল, অমিতদা!

আমি চোখ মুছলাম। বললাম, কী?

আমার একটুও ভাল্লাগছে না–।

আমারও না…। কিন্তু তবুও যে বেঁচে থাকতে হয়। আমি যদি বেঁচে না থাকতাম, তা হলে তোমার সঙ্গে দেখা হত না। তুমি যদি বেঁচে থাকে তা হলে তেমন কারও সঙ্গে হয়তো তোমার দেখা হবে। কে বলতে পারে।

হীরা কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবল। তারপর বলল, আমার স্বামীর শেষ কথাগুলো বড় কষ্টের।

আমি সব শুনলাম। সত্যি বড় কষ্টের সেই কথাগুলো। বড় বেদনার।

হীরার কথা ভাবতে-ভাবতেই আমি মিত্র সাহেবের টেবিলের কাছে এগিয়ে গেলাম। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লাম অবহেলায়।

নজর মহম্মদ আমার পিছনে পিছনে এগিয়ে এসেছে। এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে খুব কাছাকাছি। মিত্ৰসাহেবের কাছ থেকে মাইনে নিলেও ও যেন এখন আমারই দেহরক্ষী।

আমি জিগ্যেস করলাম, খুদে কোথায়?

শরদিন্দু মিত্র উত্তর দিতে কোনও সময় নিলেন না। বললেন, বোধহয় শরীর খারাপ, তাই আসেনি।

আমি হাসলাম। বললাম, আপনি অন্তর্যামী, মিস্টার মিত্র। কাঁধে আর কোমরে গুলি খেয়ে খুদে কাল রাত থেকে হোটেল রিভারভিউর দুশো আঠেরো নম্বর ঘরে পড়ে আছে।

মিত্র সাহেবের মুখে সংশয়ের ছাপ পড়ল। বুঝতে পারছিলেন না আমি সত্যি বলছি, না গপ্পো বলছি। চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করলাম, নজর মহম্মদের হাত চলে গেছে পাজামার পকেটে। তাই ওর দিকে ফিরে বললাম, নজরসাব, আমার ধারণা ছিল খুদের চেয়ে আপনার মাথায় বুদ্ধি বেশি আছে। আপনার ওই পকেট থেকে কী বেরোতে পারে? বড়জোর একটা ছুরি কি পিস্তল–।

নজর! কী হচ্ছে? ধমক দিলেন শরদিন্দু, আমি মিস্টার শিকদারের সঙ্গে কথা বলছি।

নজর মহম্মদ হাসল। পকেট থেকে সেন্ট মাখানো রুমাল বের করল একটা। বলল, রুমাল, সাব। সিরফ রুমাল।

শরদিন্দু আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইলেন, খুদের ব্যাপারটা কি সত্যি?

আমি বললাম, গল্পটা গোড়া থেকে আপনাকে বলি। তা হলে আপনার বুঝতে সুবিধে হবে। আপনি হীরাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে আমাকে ভাড়া করেছিলেন। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, অমিতাভ শিকদারকে ভাড়া করা যায়, কিন্তু কেনা যায় না। কাল সকালে আপনার কাছ থেকে বেরোনোর পর একটা সাদা মারুতি আমার পিছু নেয়…।

এইভাবে প্রায় গোটা গল্পটা শুনিয়ে দিলাম শরদিন্দু মিত্রকে। উনি দুহাতে মাথা ঢেকে যেন ভেঙে পড়লেন।

গল্প শেষ করে আমি বললাম, হীরা আমার কাছে আছে। আপনার পাঠানো কালো অ্যামবাসাডরের ড্রাইভারকে পাহারা দিচ্ছে। সে বেচারা এখনও অজ্ঞান হয়ে আছে, তাই ওর নামটা আপনাকে বলতে পারছি না বলে দুঃখিত।

চুনি–চুনি মারা গেছে। খুদে ওকে খুন করেছে! ভাঙা গলায় আর্তনাদ করলেন শরদিন্দু ও কিন্তু কেন? কেন ও একাজ করল?

আমি আর থাকতে পারলাম না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলাম কয়েকবার। হেসে বললাম, উত্তমকুমারের ছেড়ে যাওয়া জায়গাটা এখনও খালি আছে, মিস্টার মিত্র। আপনাকে পেলে বাংলা ফিল্মের বড় উপকার হত।

শরদিন্দু সোজা হয়ে বসলেন। কালো কপালে চন্দনের টিপ কাঁপছে। মুখের চেহারা এখন একেবারে অন্যরকম। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আপনি কী বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন।

আমি চেয়ার সরিয়ে নজর মহম্মদকে পাশ কাটিয়ে খানিকটা দূরে সরে এলাম। কিন্তু চোখের সতর্ক দৃষ্টি সবসময়েই শরদিন্দু মিত্র এবং নজর মহম্মদের দিকে।

কিছুটা সময় নিয়ে বললাম, আপনার ছকটা ছিল এইরকম। হীরা ও চুনিকে খতম করা, তারপর সেই খুনের দায়টা আমার ওপরে চাপিয়ে দেওয়া। কারণ, আমি এককালের পুলিশের লোক হলেও এখন তাদের খুব পছন্দের লোক নই। আসলে আপনি ভাবতেই পারেননি এতগুলো ধাক্কা সামলে আমি হীরাকে সহি-সলামত ফিরিয়ে নিয়ে আসব। আপনি জনার্দন সামন্তকে লাগিয়েছিলেন। সাদা মারুতি লাগিয়েছেন। কালো অ্যামবাসাডরে দুজনকে পাঠিয়েছেন। আর সবার সেরা, খুদেকে ডাবল এজেন্ট তৈরি করে পাঠিয়েছেন চুনি ব্যানার্জিকে বোকা বানানোর জন্যে। চুনি বেচারা ভেবেছে, খুদে ওর হয়ে স্পাইয়ের কাজ করছে। আসলে ব্যাপারটা ছিল ঠিক উলটো। আমি একটু থেমে কাঁধ কঁকালাম ও আপনার আর কী দোষ! আপনি কী করে জানবেন, অমিতাভ শিকদার সহজে খতম হয় না! এই খতমের খেলায় আমি পুরোনো পাপী। তাই আমি বেঁচে ফিরে এসেছি, হীরা বেঁচে ফিরে এসেছে। আপনার পোষা কোনও জনার্দন বা মধুসূদন আমাদের ছুঁতে পারেনি–।

হীরা–আমার মেয়ে হীরাকে আমি মারতে চাইব? একথা আপনি বিশ্বাস করেন, মিস্টার শিকদার!

হ্যাঁ, করি। কারণ হীরা যে আপনার মেয়ে নয়!

শঙ্খচূড় যেন ছোবল বসাল শরদিন্দুর কপালে। মুখ ফ্যাকাসে রক্তশূন্য হয়ে গেল চোখের পলকে। আর নজর মহম্মদের হাত ঝলসে উঠল শূন্যে।

নজর মহম্মদ আমাকে চেনে না, তাই বোকার মতো এ কাজ করতে গেল। আমি শরীরটাকে আধ পাক ঘুরিয়ে ভয়ংকর এক লাথি কলাম ওর শূন্যে তোলা হাতের বগলের নীচে। ওর ছিপছিপে দেহটা টাল খেয়ে পড়ল শরদিন্দুর টেবিলে। লিকলিকে ছুরিটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল মেঝেতে। আমি ঝটিতি নজরের কাছে চলে গেলাম। বাঁ হাতে চেপে ধরলাম ওর চুলের মুঠি। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ও ডান হাতটা চালিয়ে দিল আমার পাঁজরে।

একটা ধাক্কা আর জ্বালা আমাকে শেষ করে দিল যেন। নজর কোথা থেকে একটা দ্বিতীয় ছুরি বের করে বিধিয়ে দিয়েছে আমার পাঁজরে।

ক্ষণিকের জন্যে আমার দেহ স্থির হল। আর তার পরই টেবিল থেকে ইস্পাতের পেপারওয়েট তুলে নিয়ে আমি নৃশংস আক্রোশে বসিয়ে দিয়েছি নজরের রগের ওপরে–একবার, দুবার।

নজর মহম্মদের শরীর অবশ হয়ে গেল। আমি কোনওরকমে ওর চিবুকের নীচে হাত দিয়ে ওর মাথা মুচড়ে দিলাম। একটা শব্দ হল। কী ভাঙল কে জানে! নজর মহম্মদ এবার টেবিল থেকে পড়ে গেল নীচে। বোধহয় আল্লার প্রিয় হয়ে গেল।

না, শরদিন্দু মিত্র এতক্ষণ চুপচাপ বসে থাকেননি। যখনই দেখেছেন লড়াইয়ে পাল্লা আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তখনই হয়তো কোনও কোনো বিপদ সংকেত বাজিয়ে দিয়েছেন। আর দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরে হাজির হয়ে গেছে দুজন সাকরেদ।

ওই দশ সেকেন্ড আমিও বসে থাকিনি। কোমর থেকে নলকাটা শটগানটা বের করে আহত শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেছি শরদিন্দুর কাছে। ওঁর চর্বিঝোলা গলকম্বলে শটগান চেপে ধরে বলেছি পুলিশে টেলিফোন করতে।

ডায়াল করুন–ওয়ান জিরো জিরো!

আমার রক্তে ভেজা শরীর আর যন্ত্রণায় ভাঙাচোরা মুখ দেখে প্রতিবাদের বিশেষ ভরসা পাননি শরদিন্দু। ডায়াল করেছেন। তারপর আমারই কথামতো নিজের ডেরার ঠিকানা দিয়ে পুলিশকে আসতে বলেছেন।

শরদিন্দু ফোন রেখে দেবার পর খেয়াল করেছি, ওঁর সাকরেদ দুজন দরজার কাছে ফ্রিজ শট হয়ে আছে। পুলিশ না আসা পর্যন্ত ওদের ফ্রিজ শট হয়েই থাকতে হবে।

হীরা আপনার মেয়ে নয়। আমি নীচু গলায় বললাম শরদিন্দুকে। আমার শরীরের বাঁ দিকটা ক্রমেই অসাড় হয়ে আসছে। জানি, ছুরিটা টেনে বের করে নিলে যন্ত্রণা কমবে। কিন্তু তারপর যে-রক্তস্রোত শুরু হবে তাকে রুখবে কে!

আপনি হীরার সম্পর্কের কাকা। ছোটবেলায় হীরা অনাথ হয়। আপনি ওকে মানুষ করেন। আপনাকে ও বাবা বলে জানে। এই ব্যাবসা, কারখানা, মিত্রভিলা–কোনও সম্পত্তিই আপনার নয়। সব ছিল আপনার দাদার। কিন্তু তাঁর উইল ছিল। তাতে বলা ছিল, হীরা সাবালিকা হলে বা বিয়ে করলে সবকিছু ওর হয়ে যাবে। আপনার তখন কিছুই থাকবে না। হীরা এসব খবর কিছুই জানত না। এসব খবর জানতে পেরেছিল চুনি ব্যানার্জি। মারা যাবার আগে ও হীরাকে তার কিছু কিছু বলে গেছে। বলে গেছে সেইসব কাগজপত্রের হদিস।

একটু থেমে দম নিয়ে আমি বললাম, সারা জীবনে আপনি কম খারাপ কাজ করেননি। এমনকি নিজের বউকেও পুড়িয়ে মেরেছেন। আর কাল মারতে চেয়েছেন ফুলের মতো একটা মেয়েকে–যে আপনাকে গত ষোলো-সতেরো বছর ধরে বাপি বলে ডেকেছে। আমার বাড়িতে বসে হীরা এখন কাঁদছে। ওর যে আর কেউ নেই–মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই।

না, আমি আছি! হীরার ডাক মনে পড়ে গেল : অমিতদা!

আমার জীবনে সবই ফটো আর ফুলের মালা। কিন্তু হীরা ফটো হয়ে যাক আমি চাই না।

ঠিক তখনই গুলির শব্দ পেলাম। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, তাই ঠিকমতো ঠাহর করতে পারলাম না কে গুলি করল। তবে কোমরের কাছে একটা ধাক্কা টের পেলাম। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুটোর মধ্যে একজনের হাতে কী যেন একটা রয়েছে।

আমার ডান হাতের জোর কমে আসছিল। এরপর আর শটগানের ট্রিগার টিপতে পারব কি না কে জানে!

সুতরাং ট্রিগার টিপে দিলাম। বিশ্রী শব্দ হল। রক্তে আমার ডান হাতের মুঠো ভিজে গেল। আমার সামনের চেয়ারটায় একটা সাপ বসে আছে, কিন্তু তার ফণা নেই, প্লাটিনামের বিষদাঁতও আর নেই। সব ধ্বংস হয়ে গেছে।

হীরার আর কোনও ভয় নেই।

সুমনের গান কানে বাজছে : প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই…কিন্তু কাকে চাই এখনও জানি না। মৃত্যুর চেয়ে বড় আত্মীয় আর কে আছে!

শুধু একটাই তৃপ্তি–আমার মতো অন্ধকার ঘরে বসে চাঁদের আলো কোলে নিয়ে হীরাকে কখনও এ-গান শুনতে হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *