Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চিত্রচোর – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 5

চিত্রচোর – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

পরদিন প্রভাতে প্রাতরাশের সময় লক্ষ্য করিলাম দাম্পত্য কলহ কেবল বাড়ির উপরতলায় আবদ্ধ নাই, নীচের তলায় নামিয়া আসিয়াছে। সত্যবতীর মুখ ভারী, ব্যোমকেশের অধরে বঙ্কিম কঠিনতা। দাম্পত্য কলহ বোধ করি সর্দিকাশির মতই ছোঁয়াচে রোগ।

কি করিয়া দাম্পত্য কলহের উৎপত্তি হয়, কেমন করিয়া তাহার নিবৃত্তি হয়, এসব গূঢ় রহস্য কিছু জানি না। কিন্তু জিনিসটা নূতন নয়, ইতিপূর্বে দেখিয়াছি। ঋষি-শ্রাদ্ধের ন্যায় মহা ধুমধামের সহিত আরম্ভ হইয়া অচিরাৎ প্রভাতের মেঘ-ডম্বরবৎ শূন্যে মিলাইয়া যাইবে তাহাতে সন্দেহ নাই।

আহার শেষ হইলে ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত, চল আজ সকালবেলা একটু বেরুনো যাক।’

বলিলাম, ‘বেশ, চল। সত্যবতী তৈরি হয়ে নিক।’

সত্যবতী বিরসমুখে বলিল, ‘আমার বাড়িতে কাজ আছে। সকাল বিকাল টো টো করে বেড়ালে চলে না।’

ব্যোমকেশ উঠিয়া শালটা গায়ে জড়াইতে জড়াইতে বলিল, ‘আমরা দু’জনে যাব এই প্রস্তাবই আমি করেছিলাম। চল, মিছে বাড়িতে বসে থেকে লাভ নেই।’

সত্যবতী ব্যোমকেশের পায়ের দিকে একটা কটাক্ষপাত করিয়া তীক্ষ্ণ স্বরে বলিল, ‘যার রোগা শরীর তার মোজা পায়ে দিয়ে বাইরে যাওয়া উচিত।’ বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

আমি হাসি চাপিতে না পারিয়া বারান্দায় গিয়া দাঁড়াইলাম। কয়েক মিনিট পরে ব্যোমকেশ বাহির হইয়া আসিল। তাহার ললাটে গভীর ভ্রূকুটি, কিন্তু পায়ে মোজা।

রাস্তায় বাহির হইলাম। ব্যোমকেশের যে কোনও বিশেষ গন্তব্য স্থান আছে তাহা বুঝিতে পারি নাই! ভাবিয়াছিলাম হাওয়া বদলকারীর স্বাভাবিক পরিব্রজনস্পৃহা তাহাকে চাপিয়া ধরিয়াছে। কিন্তু কিছু দূর যাইবার পর একটা খালি রিক্‌শা দেখিয়া সে তাহাতে উঠিয়া বসিল। আমিও উঠিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ডেপুটি ঊষানাথবাবুকা মোকাম চলো।’

রিক্‌শা চলিতে আরম্ভ করিলে আমি বলিলাম, ‘হঠাৎ ঊষানাথবাবু?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ রবিবার, তিনি বাড়ি থাকবেন। তাঁকে দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করবার আছে।’

আধ মাইল পথ চলিবার পর আমি বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ, তুমি ছবি চুরির ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ মনে হচ্ছে। সত্যিই কি ওতে গুরুতর কিছু আছে?’

সে বলিল, ‘সেইটেই আবিষ্কারের চেষ্টা করছি।’

আরও আধ মাইল পথ উত্তীর্ণ হইয়া ঊষানাথবাবুর বাড়িতে পৌঁছান গেল। হাকিম পাড়ায় বাড়ি, পাঁচিল দিয়া ঘেরা। ফটকের কাছে রিক্‌শাওয়ালাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া আমরা ভিতরে প্রবেশ করিলাম।

প্রথমেই চমক লাগিল, বাড়ির সদরে কয়েকজন পুলিসের লোক দাঁড়াইয়া আছে। তারপর দেখিলাম ডি.এস.পি. পুরন্দর পাণ্ডের মোটর-বাইক রহিয়াছে।

ঊষানাথ ও পাণ্ডে সদর বারান্দায় ছিলেন। আমাদের দেখিয়া পাণ্ডে সবিস্ময়ে বলিলেন, ‘একি, আপনারা!’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ রবিবার, তাই বেড়াতে এসেছিলাম।’

ঊষানাথ হিমশীতল হাসিয়া বলিলেন, ‘আসুন। কাল রাত্রে বাড়িতে চুরি হয়ে গেছে।

‘তাই নাকি? কি চুরি গেছে?’

পাণ্ডে বলিলেন, ‘সেটা এখনও জানা যায়নি। রাত্রে এঁরা দোতলায় শোন্, নীচে কেউ থাকে না। ঘর বন্ধ থাকে। কাল রাত্রে আপিস-ঘরে চোর ঢুকে আলমারি খোলবার চেষ্টা করেছিল। একটা পর-চাবি তালায় ঢুকিয়েছিল, কিন্তু সেটা বের করতে পারেনি।’

‘বটে! আলমারিতে কি ছিল?’

ঊষানাথবাবু বলিলেন, ‘সরকারী দলিলপত্র ছিল, আর আমার স্ত্রীর গয়নার বাক্স ছিল। স্টিলের আলমারি। লোহার সিন্দুক বলতে পারেন।’

ঊষানাথবাবুর চোখে কালো চশমা, চোখ দেখা যাইতেছে না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাঁহার মুখ দেখিয়া মনে হয়, তিনি ভয় পাইয়াছেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাহলে চোর কিছু নিয়ে যেতে পারেনি?’

পাণ্ডে বলিলেন, ‘সেটা আলমারি না খোলা পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না। একটা চাবিওয়ালা ডাকতে পাঠিয়েছি।’

‘হুঁ। চোর ঘরে ঢুকল কি করে?’

‘কাচের জানালার একটা কাচ ভেঙে হাত ঢুকিয়ে ছিটকিনি খুলেছে। আসুন না দেখবেন।’

ঊষানাথবাবুর আপিস-ঘরে প্রবেশ করিলাম। মাঝারি আয়তনের ঘর, একটা টেবিল, কয়েকটা চেয়ার, স্টিলের আলমারি, দেওয়ালে ভারত-সম্রাটের ছবি—এছাড়া আর কিছু নাই। ব্যোমকেশ কাচ-ভাঙা জানালা পরীক্ষা করিল; আলমারির চাবি ঘুরাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু চাবি ঘুরিল না। এই চাবিটা ছাড়া চোর নিজের আগমনের আর কোনও নিদর্শন রাখিয়া যায় নাই। আপিস-ঘরের পাশেই ড্রয়িং-রুম, মাঝে দরজা। আমরা সেখানে গিয়া বসিলাম। আলমারিটা খোলা না হওয়া পর্যন্ত কিছু চুরি গিয়াছে কিনা জানা যাইবে না। ঊষানাথবাবু চায়ের প্রস্তাব করিলেন, আমরা মাথা নাড়িয়া প্রত্যাখ্যান করিলাম।

ড্রয়িং-রুমটি মামুলিভাবে সাজানো গোছানো। এখানেও দেওয়ালে ভারত-সম্রাটের ছবি। এক কোণে একটি রেডিও যন্ত্র। চেয়ারগুলির পাশে ছোট ছোট নীচু টেবিল; তাহাদের কোনটার উপর পিতলের ফুলদানী, কোনটার উপর ছবির অ্যাল্‌বাম; দামী জিনিস কিছু নাই।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘চোর বোধ হয় এ ঘরে ঢোকেনি।’

ঊষানাথবাবু বলিলেন, ‘এ ঘরে চুরি করবার মত কিছু নেই।’ বলিয়াই তিনি লাফাইয়া উঠিলেন। চোখের কালো চশমা ক্ষণেকের জন্য তুলিয়া কোণের রেডিও-যন্ত্রটার দিকে চাহিয়া রহিলেন, তারপর চশমা নামাইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘আমার পরী! পরী কোথায় গেল!’

আমরা সমস্বরে বলিলাম, ‘পরী!’

ঊষানাথবাবু রেডিওর কাছে গিয়া এদিক-ওদিক দেখিতে দেখিতে বলিলেন, ‘একটা রূপোলী গিল্‌টি-করা ছোট্ট পরী—ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের স্ত্রী আমাকে উপহার দিয়েছিলেন— সেটা রেডিওর ওপর রাখা থাকত। নিশ্চয় চোরে নিয়ে গেছে।’ আমরাও উঠিয়া গিয়া দেখিলাম। রেডিও যন্ত্রের উপর আধুলির মত একটা স্থান সম্পূর্ণ শূন্য। পরী ঐ স্থানে অবস্থান করিতেন সন্দেহ নাই।

ব্যোমকেশ বলিল, ‘চোর হয়তো নেয়নি। আপনার ছেলে খেলা করবার জন্যে নিয়ে থাকতে পারে। একবার খোঁজ করে দেখুন না।’

ঊষানাথবাবু ভ্রূ-কুঞ্চন করিয়া বলিলেন, ‘খোকা সভ্য ছেলে, সে কখনও কোনও জিনিসে হাত দেয় না। যা হোক, আমি খোঁজ নিচ্ছি।’

তিনি উপরে উঠিয়া গেলেন। ব্যোমকেশ পাণ্ডেকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কাউকে সন্দেহ করেন নাকি?’

পাণ্ডে বলিলেন, ‘সন্দেহ—না, সে রকম কিছু নয়। তবে একটা আরদালি বলছে, কাল রাত্রি আন্দাজ সাড়ে সাতটার সময় একটা পাগলাটে গোছের লোক ডেপুটিবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ডেপুটিবাবু দেখা করেননি, আরদালি বাইরে থেকেই তাকে হাঁকিয়ে দিয়েছে। আরদালি লোকটার যে-রকম বর্ণনা দিলে তাতে তো মনে হয়—’

‘ফাল্গুনী পাল?’

‘হ্যাঁ। একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছি।’

ঊষানাথবাবু উপর হইতে নামিয়া আসিয়া জানাইলেন তাঁহার স্ত্রী-পুত্র পরীর কোনও খবরই রাখেন না। নিশ্চয় চোর আর কিছু না পাইয়া রৌপ্যভ্রমে পরীকে লইয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশ ভ্রূ কুঁচকাইয়া বসিয়া ছিল, মুখ তুলিয়া বলিল, ‘ভাল কথা, সেই ছবিটা আছে কিনা দেখেছিলেন কি?’

‘কোন্‌ ছবি?’

‘সেই যে একটা গ্রুপ-ফটোর কথা মহীধরবাবুর বাড়িতে হয়েছিল?’

‘ও—না, দেখা হয়নি। ঐ যে আপনার পাশে অ্যাল্‌বাম রয়েছে, দেখুন না ওতেই আছে।’

ব্যোমকেশ অ্যাল্‌বাম লইয়া পাতা উল্টাইয়া দেখিতে লাগিল। তাহাতে ঊষানাথবাবুর পিতা মাতা, ভাই ভগিনী, স্ত্রী পুত্র সকলের ছবি আছে, এমন কি মহীধরবাবু ও রজনীর ছবিও আছে, কেবল উদ্দিষ্ট গ্রুপ-ফটোখানি নাই!

ব্যোমকেশ বলিল, ‘কৈ, দেখছি না তো?’

‘নেই।’ ঊষানাথবাবু উঠিয়া আসিয়া নিজে অ্যাল্‌বাম দেখিলেন, কিন্তু ফটো পাওয়া গেল না। তিনি তখন বলিলেন, ‘কি জানি কোথায় গেল। কিন্তু এটা এমন কিছু দামী জিনিস নয়। আলমারি থেকে যদি দলিলপত্র কিংবা গয়নার বাক্স চুরি গিয়া থাকে—’

ব্যোমকেশ গাত্রোখান করিয়া বলিল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, চোর কিছুই চুরি করতে পারেনি। গয়নার বাক্স নিরাপদে আছে, এমন কি, আপনার পরীও একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে। আজ তাহলে আমরা উঠি। মিস্টার পাণ্ডে, চোরের যদি সন্ধান পান আমাকে বঞ্চিত করবেন না।’

পাণ্ডে হাসিয়া ঘাড় নাড়িলেন। আমরা বাহিরে আসিলাম; ঊষানাথবাবুও সঙ্গে সঙ্গে আসিলেন। ব্যোমকেশ ঊষানাথবাবুকে ইশারা করিয়া বারান্দার এক কোণে লইয়া গিয়া চুপিচুপি কিছুক্ষণ কথা বলিল। তারপর ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘চল।’

রিক্‌শাওয়ালা অপেক্ষা করিতেছিল, আমরা ফিরিয়া চলিলাম। ব্যোমকেশ চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল, তারপর এক সময় বলিল, ‘অজিত, ঊষানাথবাবু এক সময় চোখের চশমা তুলেছিলেন, তখন কিছু লক্ষ্য করেছিলে?’

‘কৈ না। কি লক্ষ্য করব?’

‘ঊষানাথবাবুর বাঁ চোখটা পাথরের।’

‘তাই নাকি? কালো চশমার এই অর্থ?’

‘হ্যাঁ। বছর তিনেক আগে ওঁর চোখের ভেতরে ফোড়া হয়, অস্ত্র করে চোখটা বাদ দিতে হয়েছিল। ওঁর সর্বদা ভয় সাহেবরা জানতে পারলেই ওঁর চাকরি যাবে।’

‘আচ্ছা ভীতু লোক তো! এই কথাই বুঝি আড়ালে গিয়ে হচ্ছিল?’

‘হ্যাঁ।’

এই তথ্যের গুরুত্ব কতখানি তাহা নির্ণয় করিতে পারিলাম না। ঊষানাথবাবু যদি কানা-ই হন তাহাতে পৃথিবীর কি ক্ষতিবৃদ্ধি?

রিক্‌শা ক্রমে বাড়ির নিকটবর্তী হইতে লাগিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত, যাবার সময় তুমি প্রশ্ন করেছিলে, ছবি চুরির ব্যাপার গুরুতর কি না। সে প্রশ্নের উত্তর এখন দেওয়া যেতে পারে। ব্যাপার গুরুতর।’

‘সত্যি? কি করে বুঝলে?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিল না, একটু মুচকি হাসিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *