চারজন উটওয়ালা ও ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাট
নতুন অফিস নিয়েছি হেস্টিংস-এ। গোছগাছ পুরো হয়নি তাই ছুটিছাটার দিনেও আসতে হচ্ছে। হবে, আরও কিছুদিন।
অশেষবাবুও হেস্টিংসেই থাকেন। অফিস এখানে নেওয়ার পর থেকেই ছুটির দিনে সকালের দিকে একবার ঢু মেরে যান উনি। ঘন্টাখানেক থাকেন বড়োজোর। চা খান। মজার মজার কথা বলেন। কলকাতা হাই কোর্টের একজন বড়ো উকিল অশেষবাবু। আমার ব্যবসা সংক্রান্ত কাজটাও উনিই দেখেন। যখন কোর্টকাছারির দরকার হয়।
গতকাল পাঁচ হাজার টাকা ক্যাশ-শর্টেজ হয়েছে। তাই-ই আমাদের অ্যাকাউন্ট্যান্ট শশধরবাবুকে আজ আসতে বলেছিলাম। মে দিবসের ছুটিতে নিরিবিলিতে বসে হিসেবটা মেলানো যদি যায়।
আমি পৌঁছোবার একটু পরই অশেষবাবু এসে হাজির। হেসে বললেন, কী ব্যাপার মশাই? আজ তো সবই ছুটি। দাদার বাড়ি যাচ্ছিলাম, আপনার গাড়ি দেখে অবাক হলাম। আজ আবার কী কাজ?
প্রাণের দায়েই আসা আর কী! পাঁচ হাজার টাকার হিসেব মিলছে না।
অশেষবাবু হেসে বললেন, এ যে দেখি সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের দেশে-বিদেশের কাবুলি উটওয়ালাদের হিসেব মিলানোর মতোই ব্যাপার হল। চার জন উটওয়ালা, ছত্রিশ টাকা চারটি সমান ভাগে ভাগ করতে গিয়ে চড়া রোদে, টানাটানি করে টাকা প্রায় ছিঁড়ে ফেলেও হিসেব মিলোতে পারছিল না। এমন সময় এক বাঙালির পোকে…
অশেষবাবুর কথা শেষ হবার আগেই দরজার কাছ থেকে দত্ত সাহেবের গলা শুনলাম। কোথায় মশায়? ঘনু বোস? এসেছেন তা হলে! ভাবলাম, ভুলেই গেছেন বুঝি!
দত্ত সাহেব আমার বড়ো সম্বন্ধীর বিশেষ বন্ধু। অতএব আমারও বিশেষ সম্মানের লোক। খুব নামী একটি বিদেশী কোম্পানির সবচেয়ে বড়ো দিশি অফিসার উনি।
এসে ঢুকলেন। পরনে একটি হলুদ-কালো চেক-চেক লুঙ্গি। তার উপরে সস্তা খদ্দরের সাদা পাঞ্জাবি। প্লাস্টিকের বোতাম লাগানো তাতে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম বড়ো সম্বন্ধীকে বড়ো সম্মান দেখাবার জন্যে। অশেষবাবুও উঠে দাঁড়ালেন। আলাপ করিয়ে দিলাম দু-জনের সঙ্গে।
অশেষবাবু বললেন, বাবাঃ আপনি তো একজন বিখ্যাত লোক।
দত্ত সাহেব মুখটি সামান্য বিকৃত করলেন। তাচ্ছিল্যর সঙ্গে।
বললেন, একটু বাথরুমে যাব।
উঠে, বাথরুমের দরজা খুলে দিলাম।
অশেষবাবু বললেন, সত্যি! ভদ্রলোক এত বড়ো কোম্পানির কত বড়ো অফিসার! কোনো চাল চালিয়াতিই নেই। ভারি সিম্পল মানুষ, না? লুঙ্গি পরেই চলে এসেছেন। থাকেন কোথায়?
ক্যামাক স্ট্রীটে। তিন হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। সাদা টুপি-পরা, সাদা টেরিকট-এর উর্দি-পরা ড্রাইভার গাড়ি চালায়।
বাঃ। সত্যিই! একেই বলে মাটির মানুষ!
দত্ত সাহেব ঘরে আসতেই অশেষবাবু বললেন আপনার এই লুঙ্গির ব্যাপারটা খুব ভালো লাগল কিন্তু। আজকাল দক্ষিণ কলকাতায় লুঙ্গি পরাটাও এক ধরনের বর্বরতা বলেই গণ্য হয়।
দত্ত সাহেব অপাঙ্গে একবার অশেষবাবুর দিকে চাইলেন। তারপর আরেকবার মুখবিকৃত করলেন। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে।
আমি বাড়ি করেছি যোধপুর পার্কে। প্যালেস নয়ঞ্জ, তবে ফ্যালনাও নয়। ইলেকট্রিক কানেকশান নিয়ে গোলমাল হচ্ছে। কচি বলল, আপনার সঙ্গে তো সি ই এস সির পি বি ঘোষ সাহেবের জানা আছে। তাঁকে যদি একবার বলেন।
যা ব্যস্ত থাকেন উনি! দেখি! ধরতে হলে ক্লাবে গিয়ে ধরতে হবে। অ্যাপ্লিকেশনের কপি এনেছেন?
সব কিছু কাল আমার পি এ আপনাকে পাঠিয়ে দেবে। এম এস কুলিকুলি। পি এ-র নাম। জেরক্স করে রেখেছে।
আমি বললাম, অশেষবাবুকেঞ্জ, জানেন তো। দত্ত সাহেব পথিবীর সব দেশেই গেছেন। প্রচণ্ড পড়াশুনো। এরকম একজন অ্যাকমপ্লিশড মানুষ দেখাই যায় না।
অশেষবাবু কিছু বলার আগেই দত্ত সাহেব বললেন, ওয়েল। তা অবশ্য সকলেই বলেন আমার সম্বন্ধে। তা বলে, আমার কোনো গর্ব-টর্ব নেই মশাই। কী আছে! চাকরিও যে খুব একটা ছোটোখাটো করি তাও নয়। বাড়িতে একজন বাবুর্চি, দু-জন চাকর, একজন আয়া। একটিমাত্র মেয়ে। পড়াশুনাতে বাবার মতোই হয়েছে। আমি তো খুব একটা খারাপ ছিলাম না। লেখাপড়াতে। ওয়েল, নাথিং টু কমপ্লেন।
আমি বললাম, নিন দত্ত সাহেব, সিগারেট খান।
সিগারেটটা হাতে তুলে নিয়ে যাকে বলে নিরীক্ষণ, তাই-ই করলেন দত্ত সাহেব। মুখবিকৃত করে বললেন, দিশি?
বলেই, ফিরিয়ে দিলেন।
আমার মুখ লাল হয়ে গেল অপমানে। বললাম, বিদেশি ছাড়া খান না বুঝি?
দত্ত সাহেব আবারও মুখবিকৃত করলেন। তাচ্ছিল্যর সঙ্গে।
বললেন, তা নয়। ছেড়ে দিয়েছি। ফর গুড।
আরে! আপনি তো চেইন-স্মোকার ছিলেন। ছাড়লেন কি করে?
ছিলাম। তা বলে ছাড়তে কী আছে! সবই ছেড়ে দিয়েছি আমি। আজকাল ড্রিঙ্কও করি না। যখন করতাম, আই ওজ আ হেভি ড্রিঙ্কার। পদের মোহ, উন্নতির মোহ, বসিং-এর মোহ আমার কিছুই নেই। এই ছাড়া ব্যাপারটার মধ্যে দারুণ একটা মজা আছে। ধরার মজার চেয়ে ছাড়ার মজাটা অনেকই বেশি। আমার তো তাই-ই মনে হয়।
অশেষবাবু স্বগতোক্তি করলেন–বাঃ।
আপনি তো শুনেছি খেতেও খুব ভালোবাসেন একসময়। খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন নাকি? বয়সের তুলনায় আপনার চেহারাটি কিন্তু দারুণ ইয়াং রেখেছেন!
আমি বললাম।
দত্ত সাহেব মুখবিকৃত করলেন।
এই-ই ওঁর অ্যাপ্রিসিয়েশন দেখানোর রকম। এতক্ষণে বুঝলাম। এই মুদ্রাদোষটি আগে যখন। দেখা হয়েছে, তখন লক্ষ করিনি। হয়তো নতুন ধরেছেন। অনেক কিছু ছেড়ে দেওয়ার খেসারত হিসেবে।
শুনুন মশাই! আমি রোজ সকালে পাঁচটাতে উঠি। আমার খাস-চাকর চিরতার রস দেয়। খেয়ে বাথরুম সেরে বেরিয়ে পড়ি, স্পিৎজ কুকুর দুটোকে নিয়ে। পাক্কা পাঁচ মাইল। ফিরে এসে চান করেঞ্জ, এক কাপ কফি। একটু সিজনাল ফল। দু-টি শুকনো টোস্ট। লাঞ্চে আপনি তো অনুমান করতে পারেন। কেমন ঢালাও ব্যবস্থা আমাদের কোম্পানিরঞ্জ, কিন্তু আমি? শুধু একটি স্যুপ। উইথ আ ড্যাশ অফ টাবাসকো সস। দ্যাটস ওল। বিকেল চারটেতে এক কাপ চা। সঙ্গে দুটি বিস্কিট। রাতে একমুঠো ভাত। একটু লীন হোয়াইট মিট। নইলে দু-টুকরো মাছ, এই দু-শো গ্রাম মতো। ঘুমুবার সময়, গরম দুধের সঙ্গে ইসাবগোলের ভূষি।
বাঃ। অশেষবাবু আবারও স্বগোতোক্তি করলেন।
হ্যাঁ মশাই।
দত্ত সাহেব অশেষবাবুর দিকে এই প্রথমবার চোখ তুলে তাকালেন। আবার মুখবিকৃত করলেন।
তারপর স্বগতোক্তির মতো, জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে, আমাদের উপস্থিতি একেবারে ভুলে গিয়েই বলে চললেনঞ্জ, হ্যাঁ। সবই ছেড়ে দিয়েছি এখন। একসময় বেস্ট ইম্পোর্টেড কাপড়ের স্যুট পরেছি। প্রচণ্ড এক্সপেন্সিভ টাই। খেয়েছি, বেস্ট অফ স্কচ হুইস্কিজ। অ্যান্টিকুয়ারিয়ানঞ্জ, রয়্যাল স্যালুট। বেস্ট অফ কন্টিনেন্টাল ওয়াইন্স। হাবানা সিগারস। উইথ লিকুওরস, ড্রাম্বুই, কন্তু…
অশেষবাবু শুধোলেন আপনার ছেলে-মেয়ে কী দত্ত সাহেব?
দত্ত সাহেব মুখবিকৃত করলেন। এবার বিরক্তির সঙ্গে। বললেন, বললামই তো একটু আগে। একমাত্র মেয়ে। একটি পাত্র দেখে দিন না। রাজকন্যা এবং রাজত্ব দুই-ই পাবে। আই অ্যাম ভেরি ফন্ড অফ মাই ডটার। ঘর-জামাই-ই চাই। বাকি জীবন আমিও ঘরেই থাকব। অনেক ঘুরেছি মশাই। পৃথিবীটাঞ্জ, বুঝলেন, এখন ছোট্ট হয়ে গেছে।
বলেই, তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে নিজের চোখের সামনে এমন একটি মুদ্রা করলেন যে তাতে পৃথিবীর ছোটোত্ব এবং গোলত্ব দুই-ই একই সঙ্গে বোঝা গেল।
চাকরির শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছি এখন। সবচেয়ে উঁচু সিঁড়িতেও। কিন্তু এই-ই হচ্ছে ছেড়ে দেওয়ার সময়। সব কিছু এই সময়েই ছাড়তে হয়। পাহাড়ের চুড়োতে পৌঁছেই নেমে আসতে হয়। চূড়োয় থাকতে নেই। পাহাড়-চূড়ো ম্যাদামারা লোকেদের থেবড়ে বসে থাকার জায়গা নয়। চুড়োয় পৌঁছোনোর তাগিদের মধ্যেই চুড়োর সব সার্থকতা।
বাঃ। স্বগতোক্তি করলেন অশেষবাবু।
একটু থেমে, মুখবিকৃতি করলেন। দত্ত সাহেব।
বললেন, আমার এই সব কথা বোঝে বা বোঝার চেষ্টা করে এমন মানুষও সংসারে বেশি দেখি না আজকাল। আমার মেন্টাল লেভেলটা এতই উঁচু যে…
অশেষবাবু বললেন, বাঃ। সত্যি! কী সুন্দর কথা বলেন আপনি। সময় যে কী করে কেটে যায়, তা বোঝাই গেল না।
হ্যাঁ। সকলেই তাই-ই বলে বটে! কথা আমি ভালোই বলি।
বলেই, আবার মুখবিকৃতি করলেন। উঠে পড়ে বললেন, এবার যাই। আমার স্ত্রীকে গাড়িতে বসিয়ে এসেছি।
সে কী? এই গরমের মধ্যে? এতক্ষণ? গরমে যে মারা যাবেন।
দত্ত সাহেব মুখবিকৃতি করলেন। বললেন, ওয়েল। গেলে, যাবেন। বললাম নামো। বলল, নামব না। আই কুডনট কেয়ার লেস। মারা গেলে মারা যাবে।
আমি এবং অশেষবাবু, দত্ত সাহেব উঠে দাঁড়াতেই উঠে দাঁড়ালাম। অশেষবাবুর দিকে চেয়ে চোখ ছোটো করে উনি বললেনঞ্জ, আপনার নামটা যেন কী বললেন? অঘোর সেন?
লজ্জিত হয়ে আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না, না। অশেষ ব্যানার্জি।
ওঃ। আই সি!
কয়েক পা গিয়ে আমাকে বললেন, তাহলে ঘনুবাবু, ঘোষ সাহেবকে আমার ব্যাপারটা সম্বন্ধে বলবেন একটু। আমিও ক্লাবে দেখেছি ওঁকে। হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক। আলাপ হয়নি ফর্ম্যালি।
আমার আবার নিজের জন্যে কাউকে কিছু বলতে বড়ো ছোটো লাগে নিজেকে।
অশেষবাবুর দিকে চেয়ে বললেন, আচ্ছা অসীমবাবু। চলি তাহলে।
প্রতিবাদ করার আগেই উনি গাড়ির দিকে চলে গেলেন। ওঁকে গাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে ফিরে এসে দেখি অশেষবাবু লম্বা লম্বা টান দিচ্ছেন সিগারেটে আর হাসছেন মৃদু মৃদু।
শুধোলাম, ব্যাপার কী? হাসছেন যে? লুঙ্গির জন্যে? উর্দিপরা টুপিওয়ালা ড্রাইভারের চালানো গাড়িতে কেউ লুঙ্গি পরে যায়?
সব কিছুই ছেড়ে দিলেন দত্ত সাহেব! সত্যি! ভাবা যায় না!
না। সে জন্যে নয়।
তাহলে?
স্যুট-টাই, মদ-সিগারেট সবই তো ছেড়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক। অশেষবাবু বললেন। এমন চাকরি, এমনকী এমন সাধের লুঙ্গিও হয়তো ছেড়ে দেবেন কোনোদিন ভবিষ্যতে, কিন্তু…
কিন্তু কী?
লুঙ্গি, ধুতি, ট্রাউজার, শার্ট, পাঞ্জাবি এসবের নীচেও মানুষ আরও কিছু পরে থাকে। কী? থাকে না পরে?
মানে? গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার ইত্যাদি…? হ্যাঁ। তা পরে তো কী?
তারও নীচে এক অদৃশ্য পোশাক থাকে। আমাদের গায়ের চামড়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে তা। আঁটোসাঁটো। এই অদৃশ্য পোশাকটি এখনও বড়ো টাইট হয়েই এঁটে আছে দত্ত সাহেবের সমস্ত সত্তাতে। সেইটাকেই না ছাড়তে পারলে অন্য কিছু ছাড়া-না-ছাড়াতে যায় না কিছুই।
কী সেটা?
একটা সিগারেট অশেষবাবুর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে শুধোলাম আমি। আদিমতম, ঘৃণ্যতম পোশাক আমাদের ঘনুবাবু!
সেটা কী?
আমিত্ব!