Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চাপরাশ || Buddhadeb Guha » Page 3

চাপরাশ || Buddhadeb Guha

০৫-৬. ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি অবধি

হৃষীকেশে পৌঁছে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি অবধি না গিয়ে দেরাদুন রোডের ত্রিবেণী ঘাটের দিকে এগোল শ্লথ পায়ে। এখানে কত মানুষ, কত রকমের মানুষ, দোকান, বাজার, চোখ-ধাঁধানো আলো, চিৎকার, দর কষাকষি, সারা ভারতের মানুষের ভিড় অথচ এখান থেকে পনের মিনিট দূরেই কী নিস্তব্ধ আশ্চর্য সুন্দর এক পৃথিবী, যে, সেই পৃথিবীর বাসিন্দা হতে চায়, তার জন্যে প্রায় নীরবেই অপেক্ষা করছে যুগযুগান্ত ধরে। মানুষের মতন Paradox সম্ভবত দ্বিতীয় নেই। এমন স্ব-বিরোধী প্রাণী বিধাতা আর সৃষ্টি করেননি।

কেন জানে না চারণ, আজ গাড়ি থেকে নেমে ত্রিবেণী ঘাটের দিকে এগোতে এগোতেই ওর মন ধিয়ানগিরি মহারাজের কাছে যাবার জন্যে উচাটন হয়েছিল। অথচ এতদিন কাছে গিয়েও তাঁকে উপেক্ষা করেছে। এতদিনে কি তার মনের গুমোর কাটল? তার ইগোর আবরণ কি ছিন্ন হল কেদার আর বদ্রীনাথের পথে ভিয়াসি অবধি গিয়েই? ভাবছিল ও।

মানুষের মন বড় দুয়ে। বড় বিচিত্র সৃষ্টি সে বিধাতার। গিয়ে হয়তো পৌঁছেও যেত সোজা ধিয়ানগিরির কাছে আজ কিন্তু বাদ সাধলেন তাঁর চার পাঁচজন সাদা চামড়ার চেলা-চামুণ্ডা। তাঁরা ঘিরে ছিলেন ধিয়ানগিরিকে। বাদ সাধলেন ভীমগিরিও। ভীমগিরিকে দেখতে পায়নি ও প্রথমে। তিনি ভজন গাইছিলেন অন্যদের ভিড়ে মিশে। রামমন্দিরের মস্ত চাতালে বসে। চারণ গিয়ে পৌঁছল আর তখুনি ভজনও শেষ হল তাঁর। অন্যরা গাইছিলেন তখনও। ভীমগিরি হাত তুলে ডাকলেন চারণকে।

এই চাতাল-সংলগ্ন মন্দিরের বিগ্রহ যে রাম তা চারণ জানত না। জানত যে, কোনও বিগ্রহ আছেন ভিতরে এই পর্যন্ত। মন্দিরের অন্ধকার অভ্যন্তরের কোনও বিগ্রহ সম্বন্ধেই ওর কোনও আগ্রহ তো কোনওদিনই ছিল না। বিগ্ৰহর নাম জানার পর থেকে ওর অবাক লাগছিল যে, মন্দিরটি যদিও রামের কিন্তু মন্দিরের চাতাল সকলেরই। সেখানে কালিভক্ত, শিবভক্ত, বিষ্ণুভক্ত, গণেশভক্ত, সরস্বতীর ও লক্ষ্মীর পূজারী সকলেরই সমান অধিকার। হিন্দুদের দেবদেবী নাকি তেত্রিশ কোটি। হয়তো হবে। কিন্তু এই রামমন্দির-সংলগ্ন চাতালে সমবেত ভক্তমণ্ডলীকে দেখে তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে যে কোনও বিরোধ বা উচ্চনীচভেদ নেই তা বুঝতে পারছে।

এক একজন তার আরাধ্য দেবতাকে একেকরকম চোখে দেখেন যে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু All Roads Lead to Rome এই গন্তব্যের একদেশদর্শিতা যদি সর্বধর্মের মধ্যে ঘটানো যেত, তবে অযোধ্যায় সম্ভবত বাবরি মসজিদ আর রামমন্দির নিয়ে এত কাণ্ড ঘটত না।

ভীমগিরি বললেন, কোথা থেকে?

অনেকই জায়গা থেকে।

মানে?

চন্দ্রভাগাতেও গেছিলাম খাওয়ার পরে, আপনারা শোভাযাত্রা করে যাচ্ছেন দেখলাম শব নিয়ে।

তা এলেন না কেন? মানে, যোগ দিলেন না কেন?

আমার কী অধিকার?

শবযাত্রায় যোগ দিতেও যেদিন অধিকার বিচার করা হবে সেদিন হিন্দুধর্মের মৃত্যুঘন্টাটা সত্যিই বাজবে। তারপরে কোথায় গেলেন?

ভিয়াসি।

ভিয়াসি? হঠাৎ? ভিয়াসিতে কি আছে?

কিছু নেই। তবে থাকতে পারত। আচ্ছা আপনি ভোঁদাই বাবা বা গাডুবাবু বলে কোনও সাধুর খোঁজ রাখেন? আশ্রমও আছে শুনেছি।

হো হো করে হেসে উঠলেন ভীমগিরি। বললেন, আপনার সামনে যে বাবা বসে আছেন তিনিই যদি ভোঁদাই বাবা না হন তো আর কে হতে পারেন? আচ্ছা, আপনি ভাবলেন কি করে যে কোনও সন্ত তাঁর নিজের নাম রাখবেন ভোঁদাইবাবা?

সন্তরা নাম কি নিজেরা রাখেন? নাম তো রাখেন হয় গুরু, নয় শিষ্যরা।

তা ঠিক। হয় গুরুরা নয় গরুরা।

ছিঃ ছিঃ।

বলে উঠল চারণ।

.

গুরু-শিষ্যর পরম্পরাতে তার যে এমন ভক্তি জন্মে গেছে তা হৃদয়ঙ্গম করে পুলকিত যেমন হল, তেমন ভয়ার্তও হল। এই বোজ ত্রিবেণীঘাটে আসা আর ভীমগিরির সঙ্গ করাটা বোধ হয় মোটেই ভাল হচ্ছে না।

আজকে আপনার গুরুজির কাছে যাব।

চারণ হঠাৎই অ্যানাউন্স করল।

হাসছিলেন ভীমগিরি। বললেন, মন উচাটন হয়েছে এতদিনে?

তা বলতে পারি না, তবে খুব ইচ্ছে করছে যে, ওঁর সঙ্গে আলাপিত হই। আমি তো আর এখানে মৌরসী-পাট্টা গেড়ে বসার জন্যে আসিনি। কবে যে চলে যাব এখান থেকে তা কে বলতে পারে!

বাঃ।

বাঃ কেন?

এই মানসিকতাটাইত সব। এক জায়গাতে থেবড়ে বসে থাকে শুধু গৃহীরাই। যে ঘর ছেড়েছে তার স্বাধীনতার মূল মন্ত্রই হল এই। আজ মন করল তো এখানে, কাল করল না তো সেখানে। অস্থাবর জঙ্গমের মতন হবে তাঁর মানসিকতা। স্থাবর সম্পত্তির মতন ভারী হল গৃহীর মন। তার শিকড় পৌঁছে যায় অনেকই গভীরে। তার নিজের চোখেরই আড়ালে আবডালে। সে যদি পাততাড়ি গুটোতেও চায় তাহলেও সে পারে না সহজে। মাটি টানে, নারী টানে, স্বার্থ টানে, প্রেম টানে, যশ টানে, মান টানে। এতসব টানের মোহ কাটিয়ে নিজেকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে নিয়ে কোথাওই চলে যাওয়া ভারী কষ্ট আর অসুবিধের বলেই তো পারে না গৃহী ঘর ছাড়তে।

ঘরে থেকেও তো সন্ন্যাসী হওয়া যায়।

অবশ্যই যায়! তবে যাঁরা পারেন, তাঁরা অত্যন্তই উচ্চমার্গের মানুষ। সে বড় কঠিন তপস্যা।

সংসারে থেকেও সন্নিসীর কথা শুনেছি বটে কিন্তু ব্যাপারটা কিরকম ভেবে দেখিনি।

তাঁরা গাছেদের মতন।

গাছেদের মতন?

হ্যাঁ। যদি কখনও গহন বনে বা পাহাড়ে গিয়ে থাকেন চৈত্র-বোশেখ মাসে অথবা ভরা গ্রীষ্মে তাহলে দেখে থাকবেন পর্ণমোচী গাছেদের পাতা সব ঝরে গেছে। গাছেরা উর্ধবাহু নাগা সন্নিসীদের মতন সার সার গায়ে গায়ে লেগে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে, মনে হবে যে, দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তারা হেঁটে চলেছে অবিরতই, দেশে-দেশান্তরে। না হেঁটেই। গৃহী সমিসীরাও ওই পর্ণমোচী গাছেদেরই মতন উধ্ববাহু, বাহুল্যহীন, ঝাড়া হাত-পা, স্থবির অথচ অস্থাবর।

বাঃ। বলল, চারণ।

ভীমগিরি বললেন, গুরুজির সেই শিষ্যরা ফিরে এসেছেন বদ্রীনাথ থেকে। তাঁদের স্ত্রীরা গেছিলেন মুসৌরী, দেরাদুন হয়ে, তাঁরাও এসেছেন। এঁদের বাড়ি শুনেছি অস্ট্রিয়াতে। জায়গাটা কোথায় চারণবাবু? আপনি গেছেন কি কখনও?

জায়গাটা ইউরোপের একটি দেশ। আপনাকে তো বলেইছিলাম একদিন। ভারী সুন্দর দেশ। সে দেশের মানুষেরাও খুব সুন্দর। নারী-পুরুষ সবাই। আমি যে সময়ে গেছিলাম, দেওয়ালির কিছু আগে, তখন ওদের দেশের গ্রামে গ্রামে একটি উৎসব হয় দেখেছিলাম। খুব মজার উৎসব।

কী উৎসব?

গরুদের চরতে পাঠায় ওরা গ্রীষ্মের গোড়াতে, পাহাড়ে। সঙ্গে যায় বড় বড় শেফার্ড-ডগ। মানে সেই কুকুরেরাই গরুদের চরায়, পাহারা দেয়। মানুষ সঙ্গে যে যায় না তা নয়, তবে নগণ্য। অনেক সময়ে যায় না। আমাদের মতো গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলেমেয়ে পয়দা করে না কোনও সভ্য দেশের মানুষেরাই। সে সব দেশে সব কিছুই প্রাচুর্য। শুধু মানুষের সংখ্যাই কম। গরমের শেষে, সে দেশে তো আমাদের মতো বর্ষা নেই, গরমের পরেই হেমন্ত, ওরা বলে ফল…।

কি বলে?

Fall। গাছের পাতারা সব লাল, হলুদ খয়েরি, পাটকিলে, কালো এবং আরও যে কতর হয়ে যায় তা কী বলব! যখন হেমন্ত আসে, তখন গরুদের নামিয়ে আনে ওরা পাহাড় থেকে সমতলে। গরুদের ঘরে ফেরার পরে অস্ট্রিয়ার গ্রামাঞ্চলের গিজাতে গিজাতে উৎসব হয়, তার নাম Dorffest। গরুদের মঙ্গলকামনা করে প্রার্থনা করা হয় গিজাতে। তারপর রাতে দেদার মদ্যপান, নাচ গান আনন্দ করা হয়।

Fest কথাটা ইংরেজি Festivalএর সংক্ষিপ্ত রূপ নয়?

ভীমগিরি বললেন।

আপনি তত বেশ ভালই ইংরেজি জানেন দেখছি। অবাক হয়ে বলল, চারণ।

তারপর বলল, অস্ট্রিয়ান আর জামানরা দুটি Fব্যবহার করে FFEST।

আপনি ঠিক বলেছেন। Festival কেই ওদের ভাষায় বলে Ffest। ওই উৎসবের নাম Dorffest!

বাঃ। তবে যে অনেকের ধারণা আমরা ভারতীয়রাই গরুদের পুজো করি এবং সে জন্যে তো অনেক কটুকাটব্যও অনেকের কাছেই শুনতে হয়। সাহেবরাও যে গরুদের এত ভক্তি করে জানা ছিল না তো! বলব তো সকলকে। কি যেন বললেন নামটা উৎসবের?

আরেকবার বলুন?

Dorffest

হ্যাঁ ডরফফেস্ট। মনে থাকবে এবার।

চারণ বলল, এত দিন আপনার সঙ্গ পাওয়া হল অথচ আপনার দেশের সন্ত তুকারামের সম্বন্ধে কিছুমাত্রও জানা হল না। অনেকদিনই ভেবেছি যে জিজ্ঞেস করব, তা একথা সে কথাতে বেলা গেছে। ধিয়ানগিরি মহারাজের তো ফাঁকা হতে সময় লাগবে ততক্ষণে বলুন না তাঁর কথা, শুনি। উনিও তো আপনারই মতন মারাঠি?

হ্যাঁ। অবশ্যই মারাঠি।

তারপরই বললেন, আজ কি আপনি হোটেলে ফিরে যাবেন না?

নাও যেতে পারি। মানে, গেলেও হয়, না গেলেও হয়।

আটটা তো বাজবে একটু পরেই। কী ব্যাপার?

ব্যাপার আর কী! আপনাদের হাওয়া লাগছে আর কী গায়ে।

ভাল ভাল। খুব ভাল। আজকে তবে গুরুজির সঙ্গে কথা বলে তবেই যাবেন। রাত বাড়লে চাতাল এবং ঘাটও সুনসান হয়ে যাবে। তখন কথা বলে আরাম হবে। চাই কি গুরুজির মুড ভাল থাকলে আপনাকে গানও শোনাতে পারেন। তবে গান উনি করেন গভীর রাতে।

বলেই বললেন, চা খাওয়া হবে না, কি একটু? আর গোটাদুয়েক গাঁজার বিড়ি?

চারণ বলল, হোক।

চাতালের দোকানের ছেলেটা ঘুর ঘুর করে সবসময়েই। তাকে বলে দিল চারণ দুটি চায়ের কথা। ভাঁড়ে করে নিয়ে আসবে সে।

ভীমগিরি বললেন, হাওয়াতে হিম লেগেছে। আনতে আনতে ভাঁড়ের চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। চলুন, আমরা দোকানে গিয়েই খাই।

চলুন। বলল, চারণ।

তারপর বলল, এদিকে উপোস আছেন আর খালি পেটে চা আর গাঁজার বিড়ি খাচ্ছেন আপনার অম্বল হবে না, তো কার হবে?

তো হোক। বেচারা অম্বলেরও তো কোনও আধার চাই। তারও তো ক্রিয়াকর্ম আছে নিজস্ব। আমার মতন মানুষের পেট না পেলে সেই বা বাঁচে কি করে!

হেসে উঠল চারণ ভীমগিরির কথাতে।

ভাঁড়ের চা খেল ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, দোকানের সামনে। তারপর গাঁজা-ভরা বিড়িতে সুখটান লাগিয়ে ফিরে এসে আবার বসল চাতালে।

চারণ বলল, বলুন এবারে তুকারামের কথা।

শুনুন তবে বলি। ভীমগিরি শুরু করলেন।

তুকারামের উপাস্য দেবতা ছিলেন বিঠঠলজি। একুশ বছর বয়সেই উনি বিঠঠলজির দয়া পান। দারিদ্রে, রোগে, শোকে ব্যাতিব্যস্ত তুকারাম বারবার পনটরপুরের বিঠঠলজির মন্দিরে আসেন। এলেই, বিঠঠলজি যেন তাঁর সর্বদুঃখহরণ করতেন। পনটরপুরে ভীমা নদীর পারে প্রভুর মন্দির। একদিন উৎসব শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত তুকারাম নদীর পারে পৌঁছে, চান সেরে এক পুরনো বটের ছায়াতে এসে বসে সূর্যাস্ত বেলাতে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম তো এল না, তন্দ্রা এল। তার ঘোরে তুকারাম হঠাৎ স্বপ্ন দেখলেন যে, এক সুন্দর দিব্যপুরুষ বৈষ্ণব সেই গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হাসিমুখে তুকারামকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

বহুদিন ধরে ভক্ত তুকারাম বিঠঠলজির করুণার জন্যে চাতকের মতন প্রার্থনা করেছিলেন। সেই প্রার্থনা এতদিনে সফল হল।

তুকারাম আনন্দে মূর্চ্ছা গেলেন।

মূর্চ্ছা যখন ভাঙল, তখন তাকিয়ে দেখেন সেই দিব্যপুরুষ অদৃশ্য হয়েছেন। কিন্তু তার দেহমনের মধ্যে চৈতন্যমন্ত্রর ঝড় উঠেছে যেন। চৈতন্যদেবের নাম ও প্রেমের প্রচারই সেদিন থেকে তুকারামের জীবনের মূলমন্ত্র হয়ে উঠল। উনি মারাঠিতে যেসব অভঙ লিখেছিলেন তা আজও লক্ষ লক্ষ মারাঠির মন উদ্বেলিত করে।

সেই অভঙ কেমন? শোনান না একটা? চারণ বলল।

সেই দিব্যপুরুষ দর্শনের পরেই তুকারাম যে অভঙটি লিখেছিলেন সেটি হল :

রাঘবচৈতন্য কেশবচৈতন্য
সাঙ্গি তালি খুন মাড়ি কেচি।
বাবাচী আপনে সাঙ্গিতলে নামাঙ্গ
মন্ত্র দিলা রাম কৃষ্ণ হরি।
মাঘ শুক্লা দশমী পাহুসী গুরুবার
ফেলা অঙ্গীকার তুকা ভনে।

চারণ বলল বাঃ। মারাঠি ভাষার সঙ্গে তো বাংলা ভাষার অনেক মিল আছে।

মানসিকতারও আছে। এই কথা আমাকে পুনের আশ্রমের জ্যামখিণ্ডিকার বাবাজী বলেছিলেন। তিনি বাংলাও জানতেন।

তাই?

হ্যাঁ।

ভীমগিরি মহারাজ বললেন, আসলে সেই যে দিব্যপুরুষ, তিনি কিন্তু অলীক নন। তিনি এক সিদ্ধপুরুষ হিসেবে মহারাষ্ট্রে জন্ম নেন। তাঁর সমাধিও আছে মহারাষ্ট্রের ওতুর গ্রামে। তবে তাঁর পুরো পরিচয় এখনও রহস্যাবৃত। তবে তিনি যে তুকাকে সহজ সরল মারাঠা কথ্য ভাষাতে ওইসব অভঙ লিখতে বলেছিলেন সে জন্যেই তুকারামের পক্ষে অত সহজে নিজের হৃদয়ের সব ভক্তি উজাড় করে অভঙ-এর পর অভঙ লিখে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল।…তবে

এই অবধি বলেই থেমে গেলেন ভীমগিরি।

কী হল?

বলেই, চারণ তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখল অস্ট্রিয়ান শিষ্যর দল ধিয়ানগিরির সামনে থেকে উঠে চলে যাচ্ছেন। ধিয়ানগিরি আবারও একা। সামনে ঈষৎ ঝুঁকে অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রের উপর নিজের মনে আঙুল দিয়ে তাল দিয়ে নিরুচ্চারে কোনও গান গাইছেন।

ভীমগিরি বললেন, চলুন এবারে।

বলেই, তুকারাম প্রসঙ্গ বন্ধ করে চারণকে সঙ্গে করে এগোলেন গুরুর দিকে।

চারণের ভাল লাগছিল না। জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই কখনও দালালের সাহায্য নেয়নি ও। সমস্ত দালালদেরই সে ঘৃণা করে। তা তারা ঘুষের দালালই হোক, কী মেয়ের দালাল, কী যশের দালাল, ক্ষমতার দালাল কী আত্মিক মুক্তির দালাল।

অথচ এখন ভীমগিরির সঙ্গে যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই।

চারণকে দেখেই ধিয়ানগিরির মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। যেমন হাসির আভাস সে দেখেছিল আজ কুঞ্জাপুরী থেকে ফিরেই তাঁর মুখে। সোজা হয়ে বসলেন তিনি পলিথিনের মলিন, সাদা এবং নিচু, চাঁদোয়ার নিচে। সোজা হয়ে বসলে, সেই চাঁদোয়ার যা উচ্চতা, তাতে তাঁর মাথা থেকে ইঞ্চিদুয়েক ব্যবধান থাকে মাত্র।

মহারাজই বটে। মহারাজার যে কত্বরকম হয়!

ধিয়ানগিরি মহারাজ কোনও কথা বললেন না। আবারও হাসলেন। তারপর ম্যান্ডোলিনটি তুলে নিয়ে তা বাঁধতে লাগলেন।

কিউ বেটা? গানে কি শখ হ্যায়? না?

চারণ বলল, শুনতে ভালবাসি।

গাইতেও ভালবাসো।

আমি যা গাই, তাকে গান বলে না। যাই প্রাণ থেকে ওঠে, এবং সুরে ভরপুর হয়ে প্রকাশিত হয়, তাই গান। তবে যদি কারও গলা সুরে না বলে, তার গান গাওয়া কখনওই উচিত নয়। তা অন্যের আনন্দর কারণ না হয়ে পীড়ারই কারণ হয়। বেসুরো গায়ক বা যার গলাতে সুর কম লাগে বা যার স্বর কর্কশ তার গান শোনার মতো শাস্তি সুরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের আর দ্বিতীয় নেই।

তা ঠিক। বলল, চারণ।

তারপর বলল, একবার আলমোড়াতে বেড়াতে গিয়ে সজ্জনবাবু নামের এক অন্ধ এবং ভক্ত গায়কের ভজন শুনেছিলাম। সেই ভজনে যা ভক্তিরস ছিল, যা ভগবত প্রেম, নিজে নয়নহারা বলেই বোধহয় তাঁর নয়ন দিয়ে ঈশ্বরকে দেখার যে নির্মল, নির্ভেজাল আকুতি ছিল, তা আজও আমাকে আলোড়িত করে। কিন্তু ভজনটার প্রথম কলি দুটি শুধুমাত্র মনে আছে। আর কিছুই মনে নেই। মনে যে পড়ে না, সে জন্যে বড় কষ্ট পাই।

গাও না বেটা। গাকে শুনাওতো সাহী, দেখে, কৌনসি গানা? ম্যায় বয়ানকি ইয়াদ ভি দিলা দেনা শকতা তুমকো উও গানা ম্যায় ভি শুনা হোগা তো।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল চারণ। সে তো আর গায়ক নয়।

গাও বেটা গাও। উৎসাহ দিয়ে বললেন ধিয়ানগিরি মহারাজ। ভগয়ানকি ভজন করনেমে শরম কওন চি ক্যা? গাও।

চারণ ধরে দিল ভজনের মুখটা, সাহস করে।

খোঁজে খোঁজে তুমহে কানহাইয়া মুঝে নায়না ধারে..

আর সঙ্গে সঙ্গে ধিয়ানগিরি মহারাজ জলদগম্ভীর কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন,

মোরে মন্দির অবলো নেহি আয়ে
কওনসী ভুল ভয়ি মেয়ো আলি
প্রেম পিয়া বিনা আঁখিয়া তরস রহি
উনবিনে জিয়া ভরমায়ে।
খোঁজে খোঁজে তুমহে কনহাইয়া
মুঝে নায়না ধারে।

এই ভরমায়ে শব্দটির মানে কি?

চারণ, ধিয়ানগিরির গান শুনে মুগ্ধ হয়ে প্রশ্ন করল।

ভরমায়ে মানে জানো না? কী বলব? মানে, মানে, মনে কর, Wory.

ওঃ। চারণ বলল।

এই ভজনটি জয়জয়ন্তীতে বাঁধা। আমি অন্তত তাই শিখেছি। জয়জয়ন্তীতে আরোহীতে শুদ্ধ নিখাদ আর শুদ্ধ গান্ধার লাগে আর অবরোহীতে দুইই কোমল। তবে বক্রভাবে লাগে। এখানে মন্দির শব্দটির মানে হচ্ছে মন-মন্দির।

ধিয়ানগিরি মহারাজ সঙ্গে ম্যান্ডোলিনটি বাজাচ্ছিলেন। ঠিক বাজানো যাকে বলে তা নয়। শুধুই একটু ছেড়ছাড়। সুর যদি উপছে পড়ে এদিক ওদিক হয়ে না যায়, তারই ঘেরাটোপ হিসেবে যেন ব্যবহার করছিলেন যন্ত্রটি। ম্যান্ডোলিনের আওয়াজটা চারণের কানে যেন সরোদের মতনই শোনাল। অবাক হয়ে বাজনাটির দিকে চেয়ে রইল ও।

আমার এক আমেরিকান শিষ্য এনে দিয়েছিল বছর দুয়েক আগে। গান গাইলে, খালি গলাতেই গাই। আমি গাই, তিনি শোনেন। মাঝে অন্য কোনও অনুষঙ্গর দরকারই বা কি?

বলেই বললেন, আচ্ছা বছর কুড়ি আগে প্রয়াগে একবার তোমাদের কলকাতার এক বাঙালি ছোকরার সেতার শুনেছিলাম, ভারী ভাল হাত। সে কি এখনও কলকাতাতেই আছে?

কি নাম?

নিখিল ব্যানার্জি।

নিখিল ব্যানার্জি। তিনি তো বিখ্যাত বাজিয়ে।

আছে কোথায়? দেখা হলে বলো তো বেটা যে ধিয়ানগিরি মহারাজ তার খোঁজ করছিল। একদিন এই রাম মন্দিরের চাতালে তার পক্ষে গভীর রাতে বাজানো কি সম্ভব হবে? যা খুশি ওর, তাই বাজাবে। হাম্বির বা দেশ বা জয়জয়ন্তী বা মালকোষ বা ঝিনঝাটি।

চারণ বলল, তিনি তো গত হয়েছেন।

দেহান্ত হো গ্যয়ে? তাই? কবে?

অবাক হয়ে বললেন ধিয়ানগিরি।

বছর কয়েক হয়ে গেল।

ওঃ, তাহলে তো মিটেই গেল। ও মন্দিরের বিগ্ৰহর সামনে আর কি বাজাবে? স্বয়ং দেবদেবীদেরই শোনাচ্ছে এখন তার বাজনা স্বর্গের বাগানে বসে, পারিজাতের গন্ধের মধ্যে। ক্ষণজন্মা ছেলে। ঈশ্বরের আশীবাদ যার উপরে না থাকে তার পক্ষে অমন কলাকার হওয়া কখনওই সম্ভব নয়। ভাল মানুষদেরই ঈশ্বর তাড়াতাড়ি টেনে নেন নিজের কাছে।

আপনি শুনেছি গান-বাজনা গুলে খেয়েছেন।

চারণ বলল, ধিয়ানগিরি মহারাজকে।

আমি? কে বলেছে?

ভীমগিরি মহারাজ।

গানবাজনা সম্বন্ধে ভীমাব যতটুকু জ্ঞান এবং গুলে খাওয়া সম্বন্ধেও, তারই প্রেক্ষিতে বলেছে। গান তো আর সিদ্ধির গুলি নয়! যে গুলে খাওয়া অত সহজ।

ওঁর নাম কি ভীমা?

নাম ভীমগিরিই কিন্তু সন্ত তুকারামের আরাধ্য দেবতা বিঠঠলজির পনঢরপুরের মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভীমা নদীর নামেই আমি ডাকি ওকে। নামটা ছোটকে ছোটও হয় আর ওরও ওর দেশের সন্ত এর কথা মনে পড়ে যায় প্রতি ডাকে।

তারপর বললেন, নিউটন না কে বলেছিলেন না? জ্ঞান সমুদ্রের বালুকাবেলায় উপলখও কুড়োচ্ছি মাত্র, তেমনই আমিও ওই বালুবেলাতে বালুকণাই কুড়িয়েছি শুধু। হিন্দুস্থানী রাগ-সঙ্গীত এক সমুদ্র বিশেষ। দুঃখ হয়, যখন দেখি যে তোমাদের মতন ছেলেমানুষেরা যা কিছু ভারতীয়, যা কিছু শাশ্বত, সুন্দর তার সব কিছুকেই বর্জন করার মধ্যে একধরনের বাহাদুরি বোধ কর। বাখ, বীটোভেন, মোজাট, মেন্ডহেলসন বা স্ট্রস এর নাম উচ্চারণ করতে শ্রদ্ধাতে তোমাদের মাথা নুয়ে আসে অথচ সদারঙ্গ, বা তিয়াগারাজন বা শাৰ্ধদেব বা হালফিলের বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব, হাফিজ আলি খাঁ সাহেব, পণ্ডিত ওংকারনাথ ঠাকুর, বড়ে গোলাম আলি খা, আমীর খাঁ সাহেব, বিসমিল্লা খাঁ সাহেবদের তোমরা ব্রাত্যজন বলে মনে কর। এতে আমরা যে আত্মবিস্মৃত জাত, পরের অনুকরণ করে আমরা যে নিজেদের বড়াই করি এই কথাই প্রমাণিত হয়।

সবাই করে না। চারণ বলল।

না, তা করে না। খুব উচ্চবিত্ত মহলের কিছু মানুষে কদর করেন। তবে তাঁদের মধ্যেও কজন যে সত্যিই বোঝেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীত মন্মথ ঘোষ বা নাটোরের মহারাজার মতন আর কজন বোদ্ধার ভেক এরে মহার্ঘ্য শাল গায়ে জড়িয়ে মেহফিল-এ উপস্থিত হন, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। আর বোঝেন, সাধারণ মধ্যবিত্তরা, তোমাদের কলকাতার পাঁচুবাচুর মতন।

পাঁচুবাবু কে?

আরে পাঁচুবাবুর নামও শোনোনি? অমিয়নাথ সান্যাল। তাঁর লেখা বইও কি পড়োনি? বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ যে সে বই! আজকাল অবশ্য তোমাদের কলকাতার বাঙালিরা সবাই সাহেব হয়ে গেছে। মাথাতে জোরে টোকা মারলে শুকনো গোবর ঝরে পড়ে যাদের, তারাই প্রত্যেকে তেল সাবান বা খবরের কাগজ কোম্পানির কেউকেটা বা দালাল। সেই হস্তীমূৰ্খা জিনস পরে, হাতে ঢাউস ইংরেজি পেপারব্যাক নিয়ে এরোপ্লেনের সিটে বসে সবজান্তা মনে করে নিজেদের।

অমিয়নাথ সান্যাল মশায়ের বইটির নাম কি? চারণ শুধোল।

স্মৃতির অতলে। সে বই যদি কোনও শিক্ষিত বাঙালি না পড়ে থাকেন, তবে তাঁকে আমি শিক্ষিত বলে আদৌ মানতে রাজি নই। অমন সেন্স অফ হিউমার, ভারতীয় উচ্চাঙ্গ কণ্ঠসঙ্গীতের রথী-মহারথীদের নিয়ে, অমন জিন্দা-দিল, মন-মৌজী লেখা আর হয়েছে বলে তো আমি জানি না। নেহাৎ অমন বই ইংরেজিতে অনুবাদ করা যায় না তাই, নইলে পৃথিবীর সাহিত্যেও ওই বই প্রথম সারিতে স্থান পেত।

কাদের নিয়ে লেখা সে বই?

কেন ফৈয়াজ খাঁ সাহেব, মৈজুদ্দিন মিঞা, কালে খাঁ সাহেব, বাঈজি গহরজান, মালকাজান, চুলবুল্লেওয়ালি আর আগ্রাবালি, আরও কত সব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের নিয়ে লেখা সে বই। একটি বিশেষ যুগ, একটি বিশেষ সাঙ্গীতিক আবহ তাতে নিখুঁতভাবে ধরা আছে।

তাই? তা অনুবাদ করা যায় না কেন? ইংরেজিতে?

যায় না, ওই সাঙ্গীতিক আবহ পুরোপুরিই ভারতীয় বলেই। একজন ভারতীয় ইংরেজি ফুটিয়ে কখনওই বাখ বিঠোভেন কপচিয়ে, কাফকাকা-মার্কেজ আউড়ে কোনওদিনই একজন পশ্চিমী হয়ে উঠতে পারে না। কখনওই না। তাছাড়া, সাদা চামড়ার মানুষেরা, কেউ তা হয়ে উঠতে গেলেও কোনওদিনও তাকে স্বীকারও করবে না। এই সরল সত্যটা তোমরা বুঝলে না বেটা। তাই তো এমন একটা দেশের আজ এই হাল। যে দেশের মানুষ নিজের ধর্ম, নিজের সংস্কৃতি, নিজের শিল্প-সঙ্গীত, সাহিত্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণই অজ্ঞ, স্বেচ্ছায় অজ্ঞ, সেই দেশের ভবিষ্যৎ বলে কি কিছু থাকতে পারে?

চারণ কথা ঘুরিয়ে বলল, স্মৃতির অতলে বইটি আপনি কোন ভাষাতে পড়েছেন? কোন কোন ভাষায় ওটি অনূদিত হয়েছে?

অনূদিত কি কোন ভাষাতেই হয়েছে? কোনও ভারতীয় ভাষাতেও হয়েছে বলে শুনিনি। তবে হিন্দিতে এবং উর্দুতে হওয়া যদিও অবশ্যই উচিত ছিল কিন্তু স্বাধীনতার পরে বাঙালিরই মতন বাংলাভাষারও তো কোনও মর্যাদা নেই আর। বাংলাদেশ যদি না থাকত তবে ভারতবর্ষ থেকে এতদিনে পশ্চিমবঙ্গের মাড়োয়ারি, গুজরাটি, বিহারি, সিন্ধ্রির চাকর ট্যাশ-গরুর মতন ট্যাশ বাঙালিরা বোধহয় বিলোপই করে দিত এই ভাষাকে। বাংলা ভাষাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের নিম্নবিত্ত বাঙালিরাই।

আপনি এত জানলেন কি করে? আপনি কি বাঙালি?

সাময়িকভাবে আত্মবিস্মৃত ও উত্তেজিত ধিয়ানগিরি একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপরই বললেন, পূর্বাশ্রমকি বারেমে কভভি কুছ পুছনা নেহি চাইয়ে কইভি সাধু-সন্তকো। ম্যায় ভারতীয় হঁ। ইস মহান দেশ কি এক সাধারণ নাগরিক। ইসসে বাড়কে ওঁর কুছভি পরিচয় হামারা হ্যায় নেহি বেটা। মগর ইয়ে বাত ভি সাহী, যো ম্যায় বাংলা ভাষা জানতা, বাংলামে লিখা হুয়া বহতই কিতাব পড়ভি চুকে হুঁ।

চারণের মন বলছিল ধিয়ানগিরি মহারাজ নিশ্চয়ই বাঙালি। হয়তো বহুদিন যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে বাংলার সঙ্গে কিন্তু বাঙালি অবশ্যই।

তারপরই ধিয়ানগিরি কথা ঘুরিয়ে বললেন, দ্যাখো, হচ্ছিল গানের কথা, কোথায় চলে এলাম।

এমন সময় ভীমগিরি বললেন, জানেন তো চারণবাবু, গুরুজি একটি নতুন রাগ এর জন্ম দিয়েছেন।

হেসে উঠলেন, ধিয়ানগিরি জোরে।

বললেন, এমন করে বলছে ভীমা যেন আমি চারপাঅলা শিশুই প্রসব করেছি। নতুন রাগ জন্ম দেওয়া কঠিন আর কী। সব উস্তাদ, সব পণ্ডিতই তো আজকাল মূল রাগ এর এদিক ওদিক করে নতুন রাগ এর নামকরণ করছেন। তবে এই স্বাধীনতা শেষপর্যন্ত আমাদের রাগ-সঙ্গীতকে কোথায় নয়ে যাবে তা অবশ্য আমি জানি না। খোদার উপর খোদকারী করার যোগ্যতা কি সকলের থাকে?

আপনি যে নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন? নাম কি?

আরে সৃষ্টি বলে আমাকে উপহাস কোরো না বেটা। সৃষ্টি করতে একজনই পারেন, যিনি সব কিছুরই সৃষ্টিকর্তা।

তবু বলুন।

কোনও রাগ আমি আদৌ সৃষ্টি করিনি। আমার ভীমা ভীম-মুখ বলে ধ্যানতৈধত রাগকে, আমার নাম যেহেতু ধিয়ানগিরি তাই আমারই সৃষ্ট বলে মনে করে নিয়েছে। ধ্যানধৈবত জয়ত রাগের মতন। ধা বাদী, রা সম্বাদী। উত্তরালে দেশ রাগের মতন লাগে কিন্তু স লাগে কোমল। এর জাতি ঔরব মা, না বর্জিত। গাইবার সময় দ্বিতীয় প্রহর।

চারণ জিগ্যেস করল আরোহণটা কেমন ধ্যানধৈবতের?

আরোহণ, সা, স গা, পা, ধা, সা। আর অবরোহণ, সা ধা পা গা ঝ সা।

বাঃ।

চারণ স্বগতোক্তি করল ধিয়ানগিরি মহারাজের সংগীত সম্বন্ধে জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে।

তারপর স্বগতোক্তির মতো বললেন ধিয়ানগিরি, সব রাগের সঙ্গেই সব রাগের অল্পবিস্তর মিল আছে, কিছু রাগ ছাড়া। যেমন ধরো বেহাগ রাগে শংকরার ছায়া আছে। ভুপালি রাগে যদি কেউ দ্রুত খেয়াল গান করেন তবে গায়ক-গায়িকা সাবধানী না হলেই তা দেশকার হয়ে যেতে পারে। তারপরই স্বগতোক্তির মতো স্মৃতিচারণ করে বললেন, আমার মা গাইতেন যোগ রাগে দ্রুত খেয়াল, সজন মোরে ঘর আও। আহা! গান্ধার দুটি যেন পাশাপাশি দুটি গন্ধরাজ ফুলের মতো ফুটে উঠত। মায়ের গান শুনে কিশোর আমিও সজনু মোরে ঘর আও নিজের গলাতে তোলার চেষ্টা করতাম।

মা হেসে বলতেন, ওরে পাগলা ছেলে! তিলং হয়ে যাচ্ছে যে রে।

বলেই, হেসে উঠলেন। তাঁর মুখ স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠল।

তারপরে একটু থেমে যেন অন্য কোনও দেশে চলে গিয়ে বললেন, কোনও ঘনঘোর শ্রাবণ সন্ধ্যাতে আমার মা গাইতেন সুরদাসী মল্লারে গরজত আয়ী বরখা। কী যে দাপটে আ শব্দটির উপরে সোম দেখাতেন তা আজও ভেবে শিহরিত হই।

মা আছেন?

জানি না। এসব প্রশ্ন কোরো না বাবা। আমার শুধু আমি আছি। প্রেজেন্ট টেন্স এর কারবারি আমি। না অতীত আছে আমার না ভবিষ্যৎ। কিছুদিন পরে যদি আবারও এখানে আসো তো দেখবে আমারও দেহান্ত হয়ে গেছে, আজ যেমন বিনসারের সাধুর হল। দেহান্ত অবশ্যই হবে কিন্তু তোমার স্মৃতিতে এই ভীমগিরি, এই ত্রিবেণী ঘাট এমন কি আমিও থাকব অনন্ত কাল। তুমি এখানে শুধুই বেড়াতে আসনি বেটা, যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষে প্রতি মাসে প্রতি বছরে ভেড়চাল এর মতো এখানে বুড়ি ছুঁয়ে যায়। তুমি ভেড়চাল এর মানুষ নও।

ভেড়চাল মানে কি?

ভেড়চাল মানে জানো না? গড্ডালিকা মানে জানো তো? হিন্দিতে গড্ডলিকাকেই আমরা ভেড়চাল বলে থাকি।

চারণের বুকের মধ্যে এক ধুকপুকানি শুরু হল। ধিয়ানগিরি মহারাজ তাঁকে যে অসাধারণত্বে ভূষিত করেছেন, তার পেছনে কি তাঁর কোনও উদ্দেশ্যসাধনের মতলব আছে?

ধিয়ানগিরি বললেন, থাকো কদিন। ভীমার ছায়া হয়ে থাকো। তোমার মনের এবং হয়তো শরীরেরও, সব কলুষই ধীরে ধীরে মুছে যাবে। তখন তোমার মন শরতের আকাশের মতো নির্মল হয়ে উঠবে। পরতের পর পরত সন্দেহ, অবিশ্বাস, দ্বিধা যাই জমেছে, তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়ে নির্মেঘ আকাশের মতো হবে তোমার মন। তখন আর কারওকেই মিছিমিছি সন্দেহ করবে না। তোমার দৃষ্টি স্বচ্ছ হবে। দেখো।

চারণ লজ্জিত এবং অবাক হয়ে বলল, আপনাকে আমি কিন্তু সন্দেহ করিনি।

তোমার বুকের ভেতরটা পর্যন্ত যে আমি দেখতে পাচ্ছি বেটা। এতে দোষের তো কিছু নেই। কলুষ আর সন্দেহমুক্ত হবার জন্যেই না তুমি তোমার সব প্রাপ্তিকে ধুলো মনে করে এমন করে বেরিয়ে আসতে পেরেছ! নিজেকেও ধুলো মনে করতে হবে। ধুলো, নগণ্য, আত্মগরিমারহিত, ঘামণ্ডশূন্য।

পারব?

চারণের মধ্যে থেকে এক অপরিচিত, অসহায় চারণ যেন বলে উঠল।

অবশ্যই পারবে বেটা। ভীমসেন যোশীজির গলাতে সেই ভজনটি শুনেছ কি কখনও? যো ভজে হরিকো সদা।

গত শীতেও তো শুনেছি মহাজাতি সদনে।

শহরের বদ্ধ হলটল-এ নয়, এখানে শুনবে, এইরকম মুক্ত জায়গাতে। গানবাজনা সবসময়ই প্রকৃতির মধ্যে এসে শুনবে। যা কিছুই প্রকৃতি থেকে উদ্ভুত তার সবকিছুই প্রকৃতির কোলেই সবচেয়ে বেশি প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়। এতে কোনওই ভুল নেই।

চারণ চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। কেন জানে না, ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ও কি একজন ইললিটারেট, সুপারস্টিটাস, ইডিয়ট হয়ে গেল? ওর শিক্ষা-দীক্ষা কি সব গোল্লায় গেল? এরা কি গুণ করলেন চারণকে? বাণ মারলেন কি কেউ?

ধিয়ানগিরি বললেন, যা এতদিন শিখেছ, যে শিক্ষা নিয়ে তোমার গুমোর, তা শেখা নয় বেটা। সবকিছুই নতুন করে শিখতে হবে। এ এক অন্য ভাষা, অন্য পাঠ। এই যে ভাষার কথা বলছি, তা শব্দহীন। অগণ্য অক্ষর নেই এ ভাষাতে। বর্ণপরিচয়ের প্রয়োজন নেই। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, ভাওয়েল, কনসোনেন্ট, এসব কিছুই নেই বেটা। সমস্ত শব্দর যোগফল এখানে শুধুই এক পরম নৈঃশব্দ্য। নৈঃশব্দ্যই সবচেয়ে বেশি শব্দময়, সবচেয়ে বেশি অর্থবাহী। যেদিন এই পর্বতমালার বা নদীর বা গহন অরণ্যের বাত্ময় নৈঃশব্দ্যকে বুঝতে পারবে, পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ককে, সেদিন থেকে তুমি এই নতুন পাঠশালার পোডড়া হবে। তুমি পোডড়া, আর প্রকৃতি মাস্টের। আমি কি ভীমা, আমরা সকলেই সেই পাঠশালারই পোডড়া। প্রত্যেকেই পোড়ো। আমরা কেউই তোমার মাস্টের নই হে বাবুসাহেব।

তারপর বললেন, তোমার আধারটি ভাল তা তোমাকে প্রথমবার দেখেই বুঝেছিলাম এবং সে কথা বলেওছিলাম ভীমাকে। যদি ঐকান্তিকভাবে সমনপ্রাণ দিয়ে যা খুঁজতে এসেছ, তা খোঁজ, তবে তাকে পাবে বইকী! ভীমা বা আমিও এখনও পাইনি। কিন্তু এই খোঁজ এক দারুণ খোঁজ। প্রাপ্তি নাই বা যদি ঘটেও এই খোঁজে যে সামিল হতে পেরেছিলে এই কথা বুঝলেই জানবে যে, মানবজনম সার্থক হল।

চারণ অভিভূতের মতো বসে ছিল। তার শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন কোনও অদৃশ্য বিদ্যুততরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছিল। সে স্থির হয়ে বসেছিল। ধিয়ানগিরির দিকে চেয়েছিল পলকহীন চোখে।

ভীমগিরি, ধিয়ানগিরিকে গাঁজা সেজে দিলেন। কলকেটা ধরে উঠলে তিনি প্রচণ্ড জোর এক টান দিয়ে ধুয়োটা ধরে রাখলেন কিছুক্ষণ।

হিমেল হাওয়াতে মহীরুহর নীচের রামমন্দিরের চাতালে বসে চারণের ঘুম ঘুম পাচ্ছিল যেন। ভীমগিরি গাঁজা-ভরা বিড়ি এগিয়ে দিলেন একটি।

ধিয়ানগিরিকে বলল চারণ, আপনি একটি গান শোনাবেন না?

আমার গান গাওয়ার সময় এখনও হয়নি বেটা। রাত গভীর যখন হবে, নদীর জলের শব্দ আর হাওয়ার শব্দর obligato-র পটভূমিতে আমি গান শোনাব তাঁকে, যাঁকে আমার জীবন নিবেদিত করেছি।

বলেই, ব্যোমশঙ্কর ধ্বনি তুলে এমনই এক টান লাগালেন কলকেতে যে, চারণের মনে হল কলকেটা ফেটেই যাবে বুঝি।

ধিয়ানগিরি মহারাজ বললেন, না, আমার গান আজ থাক। বরং তুমিই একটি শোনাও।

চারণ বলল, আমি যে গায়ক নই। কিন্তু ভালবাসি গান।

ধিয়ানগিরি হেসে বসলেন, মেলাই মস্ত মস্ত গায়ক বাদক তোমাকে দেখাতে পারি, বিশ্বজোড়া তাঁদের নাম, কিন্তু তাঁরা গান ভালবাসেন না শুধু নিজেদেরই ভালবাসেন, নিজেদের অর্থ, মান, যশকেই ভালবাসেন শুধু। গান-ভালবাসা গায়কদেরই দরকার আমার। গাও, গাও।

চারণ বলল, সেও তো ওই আধখানাই। সব গানই আমি আধখানা করেই জানি। এই গানটিও আলমোড়ার সেই অন্ধ গায়ক সজ্জনবাবুরই মুখে শোনা। এর শুধু এক লাইনই মনে আছে।

গাও না বেটা, গাও। আমার প্রাণ আজ গান শুইতে চাইছে।

চারণ ধরে দিল,

বসসো মোরে নায়নাননামে নন্দলালা।

ভজনটির ওইটুকু গেয়েই থেমে গেল। সত্যিই তার আর মনে ছিল না। একটি পংক্তিই ছিল মনে। আস্থাই এরই পুরোটা মনে ছিল না, তার অন্তরা!

প্রসন্ন কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল ধিয়ানগিরি মহারাজের মুখে। বললেন, লাগতা হ্যায় কি আজ প্রভুজি কি কৃপাসে সবকুছই পুরা হো যায়েগা, কম্মী না পড়েগী কোঈ চিজকি।

বলেই, তিনি ধরে দিলেন,

বসসো মেরে নায়নানোম নন্দলাল
সুমরি সুরত মাধুরী মুরত
নয়না বনে বিশাল
বসসো মেরে নায়নাননামে নন্দলাল।

পাশে বসা ভীমগিরি বাচ্চা ছেলের মতন আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলেন।

ভীমগিরির হাততালি থামলে ধিয়ানগিরি বললেন, তুমি কি হিন্দিগান মাত্রই এমন আধা-ছেঁড়া জানো? তাহলে বাংলা গানই শোনাও না কেন আস্ত একখানা। নিটোল। এখানে হিন্দি গানই তো গাওয়া হয়, বাংলা গান আর শুনতে পাই কোথায়?

একেবারেই পান না কি?

একেবারেই পাই না বললে মিথ্যে হবে। কিন্তু তার বেশিই কলকাতা থেকে দলবেঁধে আসা হরি-মটর-ভাজা হরে-গড়ে-একদর ট্যুরিস্টদের গাওয়া কিছু চটুল গান নয়তো আধখানা বা সিকিখানা সুর-লাগা রামপ্রসাদী বা কীর্তন কোনও সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসিনীর মুখে। তারপর বললেন, আসলে ব্যাপারটা কি জানো বেটা, গানে যদি সুরই না লাগে, প্রতিটি স্বর যদি সুরে ভরপুরই না থাকে তবে আজকাল আমার এ দুটি কান গান আর শুনতে পারে না। এ দুটি কান অনেকই অত্যাচার সয়েছে অদ্যাবধি গানের নামে। এখন অসহ্য বলেই মনে হয়। দেখি, সুর যদি বা লাগে তবে পুরো সুর লাগে না অধিকাংশ গায়কেরই গলায়। অথচ শুনতে পাই যে, ক্যাসেটের আর সিডির বন্যাতে দেশ ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে নাকি!

আপনি ক্যাসেট এবং সি ডি-র খবর রেখেও বৈরাগ্য বজায় রাখেন কি করে? আমাদেরই তো পাগল হবার অবস্থা।

খবর সবকিছুরই রাখতে হয়। যত Distraction হয় ততই Concentration বাড়ে।

তা নয়, এসব খবর পান কোথা থেকে আপনি।

আমি নিজে অনড় হতে পারি কিন্তু আমার চারধারে সবকিছুই নড়ে। সারা দেশ তো বটেই, পৃথিবীটাই আসে আমার কাছে, আস্ত পৃথিবী। টিয়াপাখির মতন ঠোঁটে বয়ে সব খবর নিয়ে আসে কত দূত।

বাঃ!

চারণ বলল।

ধিয়ানগিরি মহারাজ বললেন, আমরা আমাদের সময়ে কথাটাকে জানতাম গান বাজনা বলে। এখন দেখি, তা হয়ে গেছে বাজনা-গান। বাজনার দাপটে গান মরে ভূত। আগেকার দিনের প্রত্যেক সঙ্গতীয়াদেরই পরিমিতি বোধ ছিল। তাঁদের কোনওরকম হীনম্মন্যতাতেও ভুগতে দেখিনি। তাঁরা যে গায়কদের চেয়ে কোনও অংশে ছোট এমন কথা তাঁরা আদৌ মনে করতেন না। মনে করার কথাও ছিল না কোনওই। এবং করতেন না বলেই কণ্ঠসংগীত শিল্পীর পুরো মর্যাদা দিয়েই সঙ্গত করতেন তাঁরা প্রত্যেকেই।

পরক্ষণেই স্বগতোক্তির মতন বললেন, আভভি আইস্তা আইস্তা সান্নাটা হো যায়েগা গঙ্গাকি তীর। ঠাণ্ডা বাড় রহি হ্যায় না! গানা গানেমে আর শুননেমে অব মজা আয়েগা। বহতে-হয়ে নদীকি আওয়াজ তুমহারা তানপুরাকি কাম করে গা। উস সুরসে গল্পে মিলাকে গাইতে গাহতে তুম-বিলকুল মস্ত হো যায়েগা।

ভীমগিরি, ধিয়ানগিরি মহারাজকে আজ বক্তৃতাতে পেয়েছে দেখে তাড়াতাড়ি বললেন, লিজিয়ে গুরুজি, অব উনোনে শুরু কিজিয়েগা।

তারপর তার দিকে ফিরে বলল, অব গানা শুরু কিজিয়ে চারণবাবু।

ভীমগিরি এই বেশি কথা বলা গুরুজিকে ভয় পায়। ভীমগিরি ভাবছিলেন, কথা, গুরুজি অত্যন্তই। কম বলেন। শিষ্য-শিষ্যাদেরও নির্বাক থাকতে বলেন। অন্যকে নৈঃশব্দ্যর মাহাত্ম্য বোঝান। কিন্তু কালে-ভদ্রে, গঞ্জিকার মাত্রা বেশি হয়ে গেলে তাঁকে কথাতে পায়। কথা অবশ্য গুরুজি বলেন চমৎকার। ভীমগিরির যদি একটি টেপ-রেকডার থাকত, তার ক্যাসেট কেনার পয়সা থাকত, তবে এরকম সময়ে গুরুজির মুখনিঃসৃত ঝরনার মতন স্বচ্ছতোয়া সব কথাকে তিনি ক্যাসেট বন্দি করে রাখতেন।

কিন্তু ক্যাসেট কিংবা টেপ-রেকডার, সে-সবও তো বন্ধনই।

হাঁ বেটা। তুমি যো শোচ রহা হ্যায় উও বাত সাহী হ্যায়।

চারণের রাগ হয়ে গেল হঠাৎ ধিয়ানগিরি ভীমগিরিদের উপরে।

সবতেই অত মনস্তত্ত্বর কি আছে? সাইকো-অ্যানালিস্টদের কাছে চিকিৎসা করাবার জন্যেও আসেনি এখানে যে কথায় কথায় এরা সে কি ভাবছে না ভাবছে তা বুঝে ফেলে তাকে চমকে দিচ্ছেন। এও কী একরকমের বুজরুগী নাকি? যত্ত সব ফোর-টোয়েন্টির দল।

ধিয়ানগিরি মহারাজ ম্যান্ডোলিনটিকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, কোন স্কেল-এ বাঁধব বল এবারে? পুরো গান শোনাবে তো বাবা?

চারণ বলল, ভারী গায়ক আমি! ফটাস করে ধরে দেব। আমি কোন স্কেল বুঝে নিয়ে সুর দেবেন। শ্রুতিতেও ধরে ফেলতে পারি। তখন দু-স্কেলের মাঝে পড়ে আপনাকে আঁকুপাঁকু করতে হতে পারে।

মৃদু হাসি হাসতে হাসতে ধিয়ানগিরি মহারাজ বললেন, দেখেগা। যো হোগা সো হোগা। তুম ডরাও মত মুঝে। অব শুরু তো করো। সি মে বান্ধা হুয়া হ্যায়।

চারণ ছোটমামার কাছে শেখা সেই ব্ৰহ্ম সঙ্গীতটি ধরে দিল।

ছোটমামা বলতেন, নিমাইচরণ মিত্রর লেখা নাকি ঐ গানটি।

কেন ভোলো মনে করো তাঁরে
যে সৃজন পালন করেন এ সংসারে।
সর্বত্র আছে গমন অথচ নাহি চরণ
কর নাহি করে গ্রহণ।
নয়ন বিনা সকল হেরে।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড যাঁর দ্বিতীয় নাহিকো আর
কে পারে বর্ণিতে তাঁরে।

আস্তাই এবং অন্তরাটিও দুবার করে গাইল ও, যেমন করে ছোটমামা শিখিয়েছিলেন। গান যখন মাঝামাঝি পৌঁছেছে তখন ধিয়ানগিরি মহারাজ বাজনা থামিয়ে দিলেন। চারণের মনে হল, তাঁর যেন সমাধি হল। অবশ্য তা ওর গানের গুণে নয়, গঞ্জিকারই গুণে হয়েছে বলে মনে হল ওর।

তার নিজের ভাবনার জাল ছিন্ন করে ধিয়ানগিরি মহারাজ যেন অনেক দূর থেকে বললেন, তুম বহত দূর চলকে আ গ্যায়ে বেটে এক্কেলে এক্কেলে। রাস্তে যো বাকি হ্যায়, উওভি পার হো যায়েগা এক্কেলেই। তুমহারা কোঈ গুরুকি জরুরৎ নহী হ্যায়।

চারণ বুঝল যে, অস্ট্রিয়ান শিষ্যরা গাঁজার কলকেতে ভরে নির্ঘাৎ হাশিস খাইয়ে গেছে আজ ধিয়ানগিরি মহারাজকে। ভীমগিরি মহারাজের দেওয়া গঞ্জিকা বিড়িও সম্ভবত ক্রিয়া করতে শুরু করেছিল চারণেরও ভেতরে ভেতরে। নইলে এমন সব গোলমেলে কাণ্ড ঘটে কি করে।

তারপরেই সভাস্থলে শ্মশানের নীরবতা নেমে এল। ঘাটের শব্দ কমে এসেছে। নদীর শব্দ জোর হয়েছে। তবু ওরা সকলেই নীরব। রামমন্দিরে ভজন পূজন থেমে গেছে। দোকানপাটেও তীর্থযাত্রীরা আর নেই। সামান্য সংখ্যক স্থানীয় মানুষেরাই আছেন শুধু।

নীরবতা ভেঙে ধিয়ানগিরি মহারাজ বললেন, এই গানটি বাংলাতে ভেঙেছেন উনি।

কে? চারণ শুধোল।

যাঁর নাম বললে একটু আগে।

ও। নিমাইচরণ মিত্র মশায়?

হ্যাঁ।

মূল গানটি কি? চারণ শুধোল।

মূল গান নেই। এটি উপনিষদের একটি শ্লোক।

তাই?

অবাক হয়ে বলল চারণ।

হ্যাঁ বেটা।

কোন উপনিষদ? শুনেছি আমাদের অনেক উপনিষদ আর বেদ আছে। আর শ্লোকটা কি আপনি জানেন?

জানি বইকি। নইলে বললাম কি করে যে শ্লোকটা ভাঙা হয়েছে।

ভাঙা কি অন্যায়?

কে বলে অন্যায়? রবীন্দ্রসংগীতে কত অগণ্য ভাঙা-গান আছে না?

তা আছে।

শ্লোকটি কি বলবেন? যদি জানেন।

শ্বেতাশ্বতরোপনিষৎ-এ আছে এই শ্লোকটি।

অপানিপাদো জবননা গ্রহীতা পশ্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্ণঃ
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যান্তি বেত্তা
তমাহুরত্যং পুরুষং মহান্তম।

তৃতীয়পর্বের উনিশ নম্বর শ্লোক।

এর মানে কি হল? মারাঠি ভীমগিরি মহারাজ শুধোলেন।

ধিয়ানগিরি বললেন, যিনি হস্তবিহীন হইয়াও গ্রহণ করিতে পারেন, পাদহীন হইয়াও বেগে গমন করিতে পারেন, চক্ষুহীন হইয়াও দর্শন করিতে পারেন, কর্ণ না থাকিলেও শ্রবণ করিতে পারেন, তিনি সকলেরই জ্ঞাতা, কিন্তু তাঁহাকে কেহই জানিতে পারে না। জ্ঞানীগণ তাঁহাকেই আদি পুরুষ বলিয়া জানেন।

বাক্যটা শেষ করার আগেই ধিয়ানগিরি চারণের পেছন দিকে চোখ তুলে কাকে যেন দেখতে পেলেন। স্মিতহাস্যে বললেন, এতদিনে সময় হল তোর?

চারণ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, হৃষীকেশ পৌঁছনোর পর সেই প্রথম রাতে ত্রিবেণী ঘাটে এসে যে কৃষ্ণা মেয়েটিকে দেখেছিল, ভীমগিরি যার নাম বলেছিলেন, মাত্ৰী, সেই মেয়েটি।

আজ তার পরনে একটি ছাইরঙা শাড়ি। চুলে সাদা ফুল। কোনও পাহাড়ি জংলী ফুল। শহরে চর্চিত ফুল নয় কোনও।

মাদ্রী কাছে এসে দাঁড়াল। তার শরীরে যেন ফুল এবং ধূপ-ধুনোর গন্ধ। শরীরে, না পোশাকে বুঝতে পারল না চারণ। চারণ তার পরিচিত যে সব নারীর কাছাকাছি গেছে তাদের শরীর থেকে চড়া ও হাল্কা বিদিশী পারফুমেরই গন্ধ উড়েছে। সেই সব গন্ধ যে বিজাতীয় গন্ধ, তা মাত্ৰী তার খুব কাছে এসে না দাঁড়ালে ও জানতেই পারত না।

মাদ্রী বলল, যা গেল না কটা দিন! উঃ।

কেন?

জ্ঞানানন্দজী মহারাজ তো পাড়ি দিয়েছিলেন একটু হলে।

হয়েছিল কি তাঁর।

কী হয়নি তাই বলুন।

আমার তো মনে হয় জ্ঞানানন্দ ভাইয়ার তোর নরম হাতের সেবা খাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল, তাই অসুখের ভান করে ছিল। নইলে সন্ন্যাসীর আবার মৃত্যুভয় কিসের জন্যে?

ওঁব মৃত্যুভয় হতে যাবে কিসের জন্যে? ভয় তো আমাদের।

তোদের কিসের ভয়?

বাঃ ওঁকে হারানোর। আপনার কাল দেহান্ত হয়ে গেলে কি আমরা সবাই খুশি হব?

তা তোরাই জানিস।

গুরুজি, আপনি পথের মানুষের মন পড়তে পারেন আর আমার মনের কথা জানেন না। এও কি বিশ্বাস করার?

ওসব কথা থাক।

তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। ওঁর নাম চারণ চ্যাটার্জি। ইসস বেটি। একটু আগে যদি আসতিস তবে এমনই গান শুনতে পেতিস যে তোর চোখ দিয়ে জল ঝরত। ইনিও অবশ্যই একজন সাধক।

চারণ লজ্জা পেয়ে প্রতিবাদ করে উঠল।

ধিয়ানগিরি বললেন, মাদ্রী নিজে সন্ন্যাসিনী। সাধক শব্দটির মানে ও জানে। তোমার বিচলিত হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই বেটা। আমি তো সন্ত বলিনি তোমাকে, সাধকই বলেছি। ভুল বলিনি কোনও। প্রথমত, সাধনা না থাকলে অমন গান তুমি গাইতে পারতে না। দ্বিতীয়ত, ঈশ্বর-বোধ যার মধ্যে নেই তাঁর পক্ষে ঐ ঈশ্বর-ভজনার গানে অমন দরদ থাকতেই পারত না।

ঈশ্বর-বোধ বলতে আপনি কি বোঝেন?

মাদ্রী চারণকে বলল, আপনিও পালাচ্ছেন না, গুরুজিও পালাচ্ছেন না। দিওয়ালির রাতে সারারাত গুরুজি এবং ভীমগিরি ভাই আমার কাছে আসবেন ও থাকবেন। আপনারও নেমন্তন্ন রইল। সেই রাতে রাতভর এই সব আলোচনা ও গানও হবে। এখন আমাকে একখানি গান শোনাতেই হবে। কোনও কথা শুনছি না।

চারণ বলল, বিশ্বাস করুন। একখানাই মাত্র জানি আমি।

সাহী বাত। ভীমগিরি বললেন।

ধিয়ানগিরি হেসে বললেন, পুরো গান একখানি নয়, আধা বা সিকি গান অনেক। তাই না?

মাদ্রীকে বললেন, চারণবাবু এইমাত্র আমাদের এমন ভাল গান শোনালেন আর তুই আমাদের মান রাখতে একটি গানও শুনাবি না ওঁকে।

মাদ্রী বলল, চা খেতে হবে। এই তো নদীতে চান করে, জ্ঞানানন্দজি মহারাজের নামে প্রদীপ ভাসিয়ে এলাম।

চারণ অবাক হয়ে বলল, এই ঠাণ্ডাতে?

ঠাণ্ডা কোথায়? আপনি গঙ্গা নাহান না। রোজ?

নাঃ।

আরে! এদিকে তীর্থ করতে এসেছেন।

আমি তীর্থ করতে আসিনি।

তবে? কী করতে এসেছেন আপনি?

এখনও জানি না।

অজীব আদমি আপনি।

বলেই, বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে তার চিবুক ছুঁল মাদ্রী।

ভীমগিরি বললেন, জ্ঞানানন্দজির আরোগ্য কামনাতে রোজই তাড়-পাতার দোনাতে ফুল আর প্রদীপ ভাসাচ্ছিস। আমার জন্যেও হয়তো ভাসাবি। তবে তা দেহান্ত হয়ে গেলে ভাসাবি এই যা।

মাদ্রী বলল, আপনার শরীরে তো কোনওই অসুখ নেই ভাইয়া। আপনার সব অসুখ তো মনেরই। নদীতে প্রদীপ ভাসালে কি সন্ন্যাসীর মনের অসুখ সারবে? আপনি বরং পূর্বাশ্রমে ফিরে গিয়ে একটি ডবকা মেয়ে দেখে বিয়ে করুন। ঈশ্বর-সাধনা আপনার জন্যে নয় ভাইয়া।

ধিয়ানগিরি মহারাজ জোরে হেসে উঠে বললেন, কেন? নয় কেন? ও তো ঈশ্বরীরই সাধনা করছে।

ছেঃ! ছেঃ! করে উঠলেন ভীমগিরি।

চারণের তার এক মক্কেলের মারাঠি অ্যাকাউন্ট্যান্টের কথা মনে পড়ে গেল। বিরক্তি প্রকাশ করতে মারাঠিরা ছিঃও বলে না, ছেঃও বলে না। বলেছেঃ। ভীমগিরি আগে যদি নাও বলতেন ওঁকে, তবু এই ছেঃ শুনেই সে বুঝতে পারত যে, তিনি মারাঠি।

মাদ্রী বলল, আর পূর্বাশ্রমে ফিরে যেতে না চাও তো কোনও ভোগবাদী-নিবৃত্তিবাদীদের আশ্রমে চলে যাও। প্রবৃত্তি নিবৃত্তি আগে করো, তারপরেই ঈশ্বর-ভজনা।

ধিয়ানগিরি বিরক্ত হলেন।

বললেন, মাদ্রী তুমি রসিকতা করছ, কর, কিন্তু ভীমাকে আহত করাটা তোমার আদৌ উচিত নয়। তুমি ভাল করেই জানো ওর ভালবাসাটা কত পবিত্র। কোথায় তুমি কৃতজ্ঞ থাকবে, না সদ্য-পরিচিত চারণবাবুর সামনে যা নয় তা বলে দিলে।

ভীমগিরি মুখ-বিকৃতি করে আরেকটা টিপিক্যাল মারাঠি অভিব্যক্তি করলেন নস্যাৎ করার। ভাবখানা, পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়।

মাদ্রী ঝিরঝির করে হেসে উঠল।

ভীমগিরি বললেন, তোমার হাসিটা ইউওল নদীর চলার শব্দর মতন।

তাই? বাবাঃ। আজকাল কবিতাও লিখছ না কি তুমি ভাইয়া?

তারপরই বলল, তা ভাল। এক গোছা বরং লিখে রাখ। দিওয়ালির রাতে চন্দ্রবদনী আসছে আমার কাছে, কাজে লাগবে।

চমকে উঠল চারণ।

কুঞ্জাপুরীর কুঁবারসিংজির মুখে একটি পর্বতশৃঙ্গর নাম চন্দ্রবদনী শুনেই ভেবেছিল, কখনও পাগলের মতন প্রেমে যদি পড়তেই হয় তবে ওইরকম কোনও নামের মেয়ের সঙ্গে পড়বে। মাদ্রীর মুখে ঐ নামের কোনও রক্তমাংসর মেয়ের কথা শুনেই বুকের রক্ত তোলপাড় করতে লাগল চারণের।

ওর মন বলল, সন্ন্যাসী হওয়া বোধহয় আর হল না এ জন্মে।

তারপরেই ভাবল, চন্দ্রবদনীর নামের সঙ্গে চেহারার এবং ব্যক্তিত্বর যদি কোনও মিল না থাকে সেই মেয়ের? তবে বড়ই আশাভঙ্গ হবে।

ভীমগিরি শুধোলন, কোথায় আছে এখন? চন্দ্রবদনী?

রুদ্রপ্রয়াগে ওদের বাড়িতে। আবার কোথায়?

রুদ্রপ্রয়াগ!

সেই নাম শুনেও আরেকবার চমকাল চারণ। কোথায় জিম করবেট-এর মানুষখেকো চিতার রুদ্রপ্রয়াগ আর কোথায় রুদ্রপ্রয়াগের চন্দ্রবদনী!

ধিয়ানগিরি বললেন, এবারে পরিষ্কার বাংলাতে, গাও বেটি। কলকাতার চারণবাবু না হয় তোকে শোনাবেন আরও গান। পরে। তুইও শোনা ওকে একটা। চন্দ্রবদনীর কাছ থেকে তো কম রবীন্দ্রসংগীত শিখিস নি।

উনি কি বাঙালি?

চারণ জিজ্ঞেস করল।

কে? আমি? হুঁ।

মাদ্রী বলল।

আর ঐ উনি?

কে উনি?

কণ্ঠাভরা লজ্জাতে চন্দ্রবদনী নামটা উচ্চারণই করতে পারছিল না চারণ।

নিজেই ওর এই ছেলেমানুষিতে অবাক হল।

চন্দ্রবদনীর কথা বলছেন? হ্যাঁ ও-ও বাঙালি। তবে পুরো নয়।

সব গোলমাল হয়ে গেল চারণের। রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতা, ত্রিবেণী ঘাটের মাদ্রী, বাঙালি ধিয়ানগিরি মহারাজ, বাঙালি চন্দ্রবদনী এবং তার উপরে রবীন্দ্রসংগীত। রবীন্দ্রনাথ মংপু অবধি ঠিকঠাকই ছিলেন। কিন্তু রুদ্রপ্রয়াগে? নাঃ। ভাবাই যায় না।

মাদ্রী বলল, এবারে দিওয়ালি তো সিনিবালী।

হুঁ। ভীমগিরি মহারাজ বললেন।

আর কদিন আছে যেন?

নেইই বলতে গেলে।

ধিয়ানগিরি মহারাজ বললেন।

ধিয়ানগিরি মহারাজ বললেন, গা মাদ্রী, একটা অন্তত গান শুনিয়ে দে বেটি।

চন্দ্রবদনীই তো আসছে। গানই যদি শুনবেন তাহলে একেবারে ওঁর গলাতেই শুনবেন। আবার আমি কেন?

অত বাহানা আমার পছন্দের নয়। গুরুর আদেশ। গাও একখানা গান।

ভীমগিরি একটু বিরক্তির গলাতে বললেন।

মাদ্রী চাতালের উপরে উঠে ধিয়ানগিরি মহারাজের পায়ের কাছে আসন পিড়ি হয়ে বসল। বুকের আঁচল টেনে। ভেজা সুগন্ধি চুল ছড়িয়ে, চারণের দিকে পাশ ফিরে। ঠাণ্ডা হাওয়া আসছিল নদী থেকে।

ঠাণ্ডা এখন রোজই বাড়ছে। দিওয়ালির পর থেকেই পুরোপুরি জাঁকিয়ে পড়বে।

ভীমগিরি বললেন।

ঋজু হয়ে বসে, যেন শবাসনেই বসেছে, এমন করে, নাভি থেকে নাদ বের করে মাদ্রী গান ধরল। গলাটা একটু খসখসে কিন্তু সুরেলা। সুরের একটুও খামতি নেই।

বহুর বজাও বংশী।
কাহুর রচক হাঁ হাঁ।
তেরী মুরলী মন মোহ লিয়ো হৈ।
মধুর বাজত যমুনা-তট হাঁ হাঁ ॥
তান শুনত শুধ বুধ সব গয়ে
মনমে লাগত বড় চমক হাঁ হাঁ।
ভানু অরা সলিল জোর উজান বহে
সারি শুক মৌর ভুল গায়ে গাবন। ঠমক হাঁ। হাঁ।

গানের রেশ-এ ভরপুর হয়ে রইল ও। তারপরে স্বগতোক্তি করল চারণ।

বাঃ!

আমার গান আপনার ভাল লেগেছে?

ভালই লাগেনি শুধু, রীতিমতন আবিষ্ট করেছে। এখনও কথা বলার মতন সময় আসেনি। বললে, গানের রেশ কেটে যাবে।

হায়! হায়! আমার গানেই যদি বলেন বাঃ! তবে তো চন্দ্রবদনীর গান শুনে আপনি বলবেন বাঃ! বাঃ! অনবরতই বাঃ!

তাই?

হ্যাঁ। তা

রপরই চারণ বলল, গানটা যেন ভারী চেনা-চেনা ঠেকল। অথচ কেন যে, তা বুঝে উঠতে পারছি না।

ধিয়ানগিরি মহারাজ মিটি মিটি হাসছিলেন।

বললেন, পুরবীতে বাঁধা বলেই কি?

চারণ বলল, না তা নয়। পূরবীতে বাঁধা গান তো হাজার গায়ক-গায়িকার গলাতে হাজারবার শুনেছি। কোথায় যে মিল সেটা ঠিক ধরতে পারছি না। কিন্তু মিল অবশ্যই আছে।

ধিয়ানগিরি এবারে হেসে বললেন, এই গানখানিই ভেঙে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসামান্য বাণী দিয়ে মুড়ে এই গানকে বাঙালির একেবারে নিজস্ব করে দিয়েছেন।

কী রকম?

এখনও ধরতে পারলে না বেটা? চেষ্টা করো, ঠিকই পারবে।

মাদ্ৰীও হাসছিল।

আজি এ আনন্দসন্ধ্যা সুন্দর বিকাশে,
আহা মন্দ পবনে আজি ভাসে আকাশে
বিধুর ব্যাকুল মধুর মাধুরী আহা।

চিনতে পারছো এবারে? ধিয়ানগিরি মহারাজ বললেন। চারণকে চমকে দিয়ে।

চারণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। এই ত্রিবেণী ঘাটে এতটা আশা করেনি।

অ্যালুমিনিয়ামের দুধের পাত্রে চাঁটি মারা, লুঙি আর ময়লা হাতওয়ালা গেঞ্জি পরে কুঁজো হয়ে বসে-থাকা গাঁজার কলকেতে দম-দেওয়া, কালো-কোলো ঐ সন্নিসীর মোড়কের আড়ালে একজন এমন নির্ভেজাল রবীন্দ্রভক্ত বাঙালিকে আবিষ্কার করল বলে।

চারণ শুধোল ধিয়ানগিরি মহরাজকে, গান আপনি শিখেছিলেন কোথায়?

সে সব কথা ছাড়ো বেটা। সে সব তো আজকের কথা নয়। ভীমা আমার সম্বন্ধে তোমাকে কি বলেছে তা আমি জানি না। তবে আমি ওস্তাদ আদৌ নই।

চারণ বুঝতে পারল না, জবাবটা এড়িয়ে গেলেন কি না উনি। তবে ওস্তাদ উনি অবশ্যই।

ধিয়ানগিরি বললেন, শার্ঙ্গদেবের বই পড়েছ?

চারণ বোকার মতন ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইল।

শার্ঙ্গদেবের নাম শুনেছে, যেমন শুনেছে আরও অনেকেরই নাম। বই পড়া তো দূরস্থান, তাঁর লেখা কোনও বইয়ের নামও শোনেনি।

ধিয়ানগিরি বললেন, তাল অংক ম্যাগাজিনটা রাখতে পারো।

কোথা থেকে বেরোয়?

অবাক হয়ে বলল, চারণ।

কেন? উত্তরপ্রদেশের আলিগড় জেলার হাতরাস থেকে।

হাতরাস? সেখানে তো ভারতবিখ্যাত সব বড় বড় মণ্ডী আছে ঘি-এর। আমার এক ঘি কোম্পানি মক্কেলের আড়ৎ ছিল সেখানে।

হবেই তো। ঘি-এর সঙ্গে গানের সহাবস্থান যে আছেই! ঘি না খেলে গলা সুরে বলবে কেন?

ঘি কি গলার লুব্রিকেটর?

নিশ্চয়ই। হেসে বললেন, উনি।

তারপরই স্বগতোক্তির মতন বললেন ধিয়ানগিরি, স্বর ঈশ্বর, তাল ব্ৰহ্ম। গান যে কালান্দরের খুবই প্রিয়।

কালান্দর মানে? কালান্দর কে?

কালান্দর মানেও জানো না?

না তো।

বাঁদর নাচানেওয়ালাকে বলে কালান্দর। যিনি এই জগৎকে, এই কালকে বাঁদরের মতনই নাচান তিনিই কালান্দর। ঈশ্বরেরই আরেক নাম কালান্দর।

তাই?

অবাক হয়ে বলল, চারণ।

একটু বেশি গান-গান হয়ে গেল যেন রাতটা।

.

উঠে পড়ল ও ধিয়ানগিরি মহারাজকে নমস্কার করে।

ভীমগিরি বললেন, এখন যাবেনটা কোথায়? হোটেলে?

চমকে উঠল চারণ। তাই তো। হোটেলে তো আজ ফেরার পথ বন্ধ। ফিরলেও অনেকই রাত করে ফিরতে হবে, যখন মিলিরা নিশ্চিত শুয়ে পড়বে।

যাতে না ফিরতে হয়, সেই জন্যেই তো ভিয়াসিতে গেছিল এবং ভিয়াসি থেকে ফিরে এসে এতক্ষণ এখানে কাটাল!

ভাগ্যিস মিলিরা এদিকে আসেনি।

রাতেও কি সেই দুপুরের হোটেলেই খাবেন? নিরামিষ?

ভীমগিরি শুধোলেন।

আপনি খাবেন না কিছু? রাতে?

নাঃ। আমি তো খাচ্ছি না। আগামীকালও খাব না। বললাম না সকালেই আপনাকে।

ধিয়ানগিরি ভীমগিরির দিকে চেয়েছিলেন।

এমন করাটা কি খুব জরুরি?

চরণ শুধোল। যেন, দুজনকেই। ধিয়ানগিরিও উপোস করছেন কি না তা না জেনেই।

ধিয়ানগিরি বললেন, জরুরি। অবশ্যই জরুরি। তবে অন্য কেউই ভীমাকে উপোস থাকতে বলেনি। আমি তো বলিইনি। ও নিজেই নিজের ইচ্ছাতেই উপোস করছে। তবে এই রেজিমেন্টাশনেরও দাম আছে বৈকি।

মাদ্রী বলল, কালিকমলি বাবার আশ্রমে যাবেন নাকি আপনি আমার সঙ্গে?

কেন?

না, যদি খেতে চান সেখানে।

নাঃ। চারণ বলল, কিছুই খাব না আমি রাতে।

আসলে, যেখানে বিনি পয়সাতে আগন্তুক মাত্রকেই খেতে দেওয়া হয় তেমন জায়গার সঙ্গে লঙ্গরখানার তফাৎ নেই বলেই মনে হয়। বুঝল চারণ যে, তার মনের কোণে এখনও অনেক এবং অনেকইরকম গুমোর বাসা বেঁধে আছে।

জোনাথান লিভিংস্টোন-এর সীগাল বইটির কথা আবারও মনে হল তার। নিজেকে আলগা করে ভাসিয়ে দেওয়াটা শুনতে সহজ হলেও করা হয়তো সোজা কথা নয়। আদৌ নয়।

ভাবল ও।

কী হল?

ভীমগিরি বললেন। একটু চুপ করে থেকে, ভেবে বলল চারণ, কী আবার হবে। আপনিই না বলেছিলেন, ভূখখা মারো। পেট শূন্য না থাকলে, মস্তিষ্ক পূর্ণ হয় না।

বলেছিলাম বুঝি?

বলেননি?

বললেই বা কি? আমি সর্বজ্ঞ? অন্যের কথা শুনবেন কেন আপনি? নিজের বুদ্ধিতেই চলবেন।

বলেই, ধিয়ানগিরির দিকে ফিরে বললেন, শেঠ শাঁওল বাজাজ আসছেন।

চারণ তাকিয়ে দেখল, একজন কালো, মোটা-সোটা অবাঙালি ভদ্রলোক, দিল্লিওয়ালা অথবা মাড়োয়ারি হবেন হয়তো।

পরনে কালো ট্রাউজার আর সাদা বুশ শার্ট, হাফহাতা, খুব মোটা এবং খুব দামি টেরিকট-এর। পায়ে চটি, চোখে অত্যন্ত বেশি পাওয়ারের প্ল্যাস্টিক লেন্সের চশমা, হাতের দশ আঙুলে দশটি আঙটি, বহত রতির। এক একটি পাথরের দামই হবে লাখ দশেক করে। ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমার মধ্যে সিগারেট জ্বলছে। বুক পকেটে ফাইভ ফাইভ ফাইভের প্যাকেট। এবং ঘাটের পথের মোড়ে ঝকঝকে একটি নীল-রঙা মার্সিডিস গাড়ি।

চারণ ভাবল, কোনও কারণে এই ভদ্রলোক আঙুল-হারা যদি হন তবে তৎক্ষণাৎ এক কোটি টাকা খসে যাবে কম করে।

তবে কোটি টাকার দামই বা কি এঁর কাছে?

ধিয়ানগিরির কাছে এসেই শেঠ শাঁওল বাজাজ তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন।

চারণ বলল, আমি আজ আসছি।

ধিয়ানগিরি কিছুক্ষণ চারণের মুখে চেয়ে থাকলেন।

এক দুর্জ্ঞেয় হাসি ফুটে উঠল ওঁর মুখে।

তারপর বললেন, ফিন আনা বেটা। ঠিক হ্যায়। আজ যাও।

মাদ্রীও পায়ে হাত দিয়ে ধিয়ানগিরিকে প্রণাম করে বিদায় নিল।

চারণের একবার মনে হল তারও কি উচিত পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা ধিয়ানগিরিকে?

পরক্ষণেই মনে মনে বলল, দুসস। নিজের মা, বাবা, দাদু ও মামাদের ছাড়া আর কারওই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেনি সে কখনওই।

প্রণামটা তার কাছে ritual নয়, কোনও বিশেষ জনের প্রতি গভীর এবং নির্ভেজাল শ্রদ্ধার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। কে ধিয়ানগিরি!

ভাল লেগেছে ধিয়ানগিরি মহারাজকে ঠিকই কিন্তু কারওকে ভাল লাগলেই এমনকি শ্রদ্ধা করলেই যে, যতবার দেখা হবে ততবারই ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করতেই হবে তার কোনও মানে আছে বলে মানে না ও।

বলল মাদ্রীকে, অন্য একদিন যাব আপনার সঙ্গে, কালিকমলিওয়ালার আশ্রমে খেতে।

যে কোনওদিনই আসতে পারেন। যেদিন ইচ্ছে হয় আসবেন। মন করলেই আসবেন।

বলল, মাদ্রী হেসে।

মাদ্রী খুবই কাছে দাঁড়িয়েছিল চারণের। আবার সেই ফুলের গন্ধটা নাকে এল ওর ধুপের গন্ধের সঙ্গে মেশা।

এই মন করবে কথাটা কানে নুপুরের মতন বাজল চারণের।

সত্যিই হয়ত মনই সব। মন করাটাই আসল। সব ব্যাপারেই।

তারপর চারণকে নমস্কার করে মাদ্রী চলে গেল ঘাটের চাতালের দিকে। যেদিক দিয়ে কালি কমলিবাবার আশ্রমে উঠে যাবার সিঁড়ি আছে।

অন্য পথও আছে।

মাদ্রীর চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে ভাবল, চারণ। এই শেঠ শাঁওল বাজাজ কে?

চারণ ধিয়ানগিরির কোণটি থেকে দূরে গিয়ে চাতালের অন্য প্রান্তে গিয়ে বসে শুধোল ভীমগিরিকে।

ভীমগিরি বললেন, চলুন, আরও সরে বসি। এই শেঠ বড় বেশি কথা বলে।

এই শেঠ কে?

শেঠ, শেঠ।

না, মানে পরিচয় কি? কত কোটি টাকা যে আছে মানুষটার! পরিচয়, টাকা। মুজফফরনগরে আর সাহারানপুরে শেঠের মস্ত মস্ত ফ্যাক্টরি। দিল্লি, বম্বে ম্যাড্রাস, কলকাতা কোথায় অফিস নেই শেঠ-এর! মানুষটা ভাল। প্রতি বছরই এই সময়েই আসেন। মুনি-কা-রেতির এক আশ্রমে ওঠেন বটে কিন্তু সারাটা দিন আর রাতের অর্ধেক সময়ই পড়ে থাকেন এই ত্রিবেণী ঘাটেই। ফিরে যাবেন দেওয়ালীর ঠিক আগের দিন। দিল্লিতে গিয়ে দেওয়ালি মানাবেন। প্রতি বছরই অনেক দান-ধ্যান করেন মানুষটা।

ভীমগিরি বললেন, আপনি যদি এখানেই খেতে চান তাহলে ঐ হোটেল কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবে রাত দশটাতে।

নাঃ। আমিও মিথ্যা বলছি না। সত্যিই খাব না।

বলেই বলল, ভুখখা মারো।

তারপর বলল, গাঁজার বিড়ি আছে?

ভীমগিরি হেসে একটি বিড়ি ওকে দিয়ে নিজে একটি ধরালেন। তারপর আগুন দিলেন তাতে ফসস শব্দ করে দেশলাই জ্বালিয়ে।

চারণ বলল, আপনাকে একটা লাইটার দেব আমি।

একদম না। আমি নেবই না। কত মানুষে এর আগে দিতে চেয়েছিল।

কেন? মুহূর্তে মুহূর্তে দেশলাই ধরাচ্ছেন, বিড়ি খাচ্ছেন, বিড়ি নিভে যাচ্ছে, আর লাইটার নেবেন না কেন?

সঙ্গে দেশলাই থাকলে তবেই ধরাই বিড়ি। নইলে দোকানে দড়িতে আগুন লাগিয়ে রেখে দেয়, সেখানে গিয়েই ধরিয়ে নিই। বন্ধনের কি দরকার?

বন্ধন মানে? একটা সিগারেট লাইটারও বন্ধন? আপনি তো মস্ত সন্ন্যাসী।

ভীমগিরি গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, চারণবাবু, সন্ন্যাসী হয়তো হওয়া হবে না এ জীবনে। কিন্তু গৃহত্যাগী তো নিশ্চয়ই হয়েছি।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, আর বন্ধনের কথাই যদি ওঠালেন, তবে বলব যে, একটি সামান্য সুতোও বন্ধন। যাঁরা ফচকে নন, প্রকৃতই বড় সন্ত, আমার গুরুর মতন, তাঁরা শরীরে উপৰীতের বন্ধনটুকু পর্যন্ত রাখেন না। বন্ধনের সুত্রপাত হয় উপবীত বা সিগারেটলাইটার-এর মতন অতি সামান্য সামান্য জিনিস থেকেই। কিন্তু তার পরিণতি, অনড় পর্বতের মতনও হতে পারে। সবই ছেড়ে যখন আসতে পেরেছি, পথে পথে, শ্মশানে, তীর্থস্থানে, নিজস্ব ঘর, নিজস্ব ছাদ, নিজের আপনজনের পরোয়া না করে যখন এতগুলো বছর কাটিয়েই দিতে পেরেছি, তখন একটি সামান্য সিগারেট-লাইটারের বন্ধনে আমাকে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য নাই বা করলেন চারণবাবু।

চারণ চুপ করে রইল।

ভীমগিরি বললেন, তাছাড়া দেশলাই-এর মতন জিনিস আছে।

কেন? লাইটার তো অনেকই ভাল।

দুর।

দেশলাই ইকে দোস্তকে পেয়ার জানানো যায়, দুশমনকে জাহান্নমে যেতে বলা যায়, এক একটি ঘন ঘর্ষণে পাহাড়প্রমাণ ক্রোধ, কাম, দ্বেষের বারুদে আগুন লাগিয়ে তা ধ্বংস করা যায়। লাইটার কি তা পারে?

চারণ চুপ করেই রইল।

চুপ করে যে!

ভাবছি।

কী ভাবছেন?

আপনি যদি ওকালতি করতেন তবে আপনার প্রত্যেক মক্কেলই মামলা হারত।

যদি করতেন মানে কি? ওকালতিই তো করি।

ওকালতি করেন? কোন কোর্টে?

ভীমগিরি বিড়িতে এক লম্বা টান লাগিয়ে বললেন, আমার বিভিন্ন দিনে বিভিন্ন জজসাহেবের এজলাসে সওয়াল করতে হয় না। কোনও বিশেষ কোর্টেও নয়। প্রতিদিনই একই জজসাহেবের ঘরে মামলা পড়ে আমার।

কোন জজ তিনি?

তাঁর অনেক নাম। কখনও তিনি দিগম্বর, কখনও কৌপিনধারী, কখনও শাড়ি-পরিহিতা, কখনও ক্রশবিদ্ধ, কখনও মুখে সাদা কাপড় আটা, কখনও তিনি মৌনী, কখনও বাঁচাল। তাঁর রূপ অনেক, তাঁর আবাসও অনেক। কিন্তু তিনি একই।

চারণও বিড়িতে এক টান লাগিয়ে চুপ করে রইল। ভীমগিরি যে এমন করে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন তা ও ভাবতেও পারেনি। কিংবা কে জানে! গাঁজার নেশা তাকে পেয়ে বসেছে। আকাশটা নেমে আসছে মনে হচ্ছে, নদী যেন ঘাটের বাঁধানো চাতালের ওপর দিয়ে বইছে। ভীমগিরি যাই বলছেন তাই Fool Proof অথবা Full Proof বলে মনে হচ্ছে। কিছু বা কেউ ভর করেছে মনে হচ্ছে তাঁর ওপরে।

ভীমগিরি বললেন, আপনি তো অনেকই জানেন। তা এই গাঁজা ব্যাপারটা কি বলতে পারেন?

ব্যাপারটা মানে? আমার সব জ্ঞানই গাঁজা বলছেন?

মানে, কী বস্তু আছে এর মধ্যে যে দুটানেই জগৎ-সংসার টলমল করে ওঠে? জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়?

মানেটা আমি বলতে পারব না। তবে রাসায়নিক অ্যানালিসিসে যা বলে, তা বলতে পারি।

ওসব জেনে কী করব।

তাহলে বলব না।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। গঞ্জিকা, প্রভাব বিস্তার করেছে দুজনেরই উপরে সম্ভবত।

হঠাৎই ভীমগিরি বললেন, আচ্ছা তাই বলুন শুনি। অ্যানালিসিস না ফ্যানালিসিস কী বললেন।

চারণ বলল, গাঁজার মূল উপাদান হল T. H. c.।

ভীমগিরি বললেন, T. H. C. মানে কি?

গাঁজা বা মারিজুয়ানা এসবের মূল উপাদানের রাসায়নিক নাম ট্রান্স-ডেল্টা-নাইন-টেট্রা-হাইড্রো ক্যানাবিনল। সংক্ষেপে বলে, T. H. C.

এই ছাড়া-ছাড়া শব্দগুলোর মানে কি?

মানে, আমিও জানি না। আমার এক মামাতো ভাই কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিল। তার কাছেই শুনেছিলাম। মানে দিয়ে কি হবে? গুণাগুণ তো আপনার নখদর্পণে। না, কি? তাছাড়া, থিওরি দিয়ে হবেটা কি? আপনি তো প্র্যাকটিসই তো করছেন।

তা তো অবশ্যই! আপনার নখদর্পণেও আসবে। তবে এই বিড়ি-ফুকে কিছু হবে না। আমার গুরুজির মতন কলকেতে করে না খেলে সিদ্ধি লাভ হবে না।

তাই? বলে, হাসল চারণ।

তেমনই তো বিশ্বাস করেন অনেকে। যার যেমন নজর। তারা গাঁজা খাওয়াটাই দেখে, আর কিছুই দেখবে যে তেমন চোখই তাদের নেই।

তারপরই বললেন, আজকে আপনি এমন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন বলুন তো? হোটেলের ঘরে কি সাপ বিছে ঢুকে রয়েছে? নাকি বাঘই?

হাসল চারণ।

বলল, তার চেয়েও অনেক বেশি খতরনাক জানোয়ার। তবে ভাগ্য ভাল। ঘরে ঢুকতে পারেনি।

কোন লিঙ্গর?

খতরনাকের আবার লিঙ্গভেদ হয় নাকি! অ্যাডজেকটিভ এরও কি লিঙ্গবিচার হয়? তাদের সর্বলিঙ্গর গুণাগুণ একই। খতরনাক মানে, খতরনাক। হোটেলে ফিরলেই বিপদ।

ফিরলে কি এই খেয়ালখুশি জীবনে বাধা পড়বে?

তা হয়ত পড়বে না কিন্তু মনটার দড়াদড়ি যে ক্রমাগত খুলে ফেলে তাকে হালকা করার চেষ্টা করছি এ কদিন হল, সেই চেষ্টাটা ব্যাহত হবে অবশ্যই। আপনি বহু বছর হল ঘর ছেড়ে এসেছেন, ঘর ছাড়া মাত্রই এমন দূরে চলে গেছেন যে, পরিচিত কেউই নাগাল পায়নি আপনার। আজ আপনি ঘরে ফিরতে চাইলে, আপনিই বলেছিলেন, ঘর হয়তো আপনাকে নেবে না। আর আমাকে ঘর ছাড়তেই চাইছে না।

ভীমগিরি কথা না বলে চারণের দুচোখের দিকে চেয়ে রইলেন চুপ করে।

চারণ বলল, মুশকিলটা কি জানেন? এত বছর ধরে মাকড়শারই মতন জালটাকে এতই ছড়িয়ে দিয়েছি যে নিজেই একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছি নিজেরই বিছানো জালে। কলকাতা জায়গাটা যে এত বড়, তার আঙুল যে ভারত কেন, পৃথিবীর বহু জায়গাতেই পৌঁছয় এই কথাটা ক্রমশই বুঝতে পারছি। এই যে আপনাদের শেঠ শাঁওল বাজাজ, ওঁকেও একটু জেরা করলেই হয়তো বেরিয়ে পড়বে যে ইনিও হয়তো আমার চেনা। নিজের পরিচয় যখন মুছে ফেলে আপনাদের এই ভারহীন, অবস্তুবাদী, নির্মোহ, অর্থ, মান, যশ সবকিছুর লোভহীন জগতের চৌকাঠ মাড়িয়ে ঢোকবার চেষ্টা কবছি, তখন পদে পদে এ কী বিপত্তি বলুন দেখি!

বিপত্তি নিয়েই তো আমাদের ঘর করা চারণবাবু। গৃহীর সম্পত্তি। আর আমাদের বিপত্তি।

হাসল চারণ।

বলল, ভালই বলেছেন।

আপনি তাহলে বরং এক কাজ করুন। দেবপ্রয়াগে চলে যান।

সেখানে কি?

সেখানে ভাগীরথী আর অলকানন্দার সঙ্গম। গভীর গিরিখাত দিয়ে বয়ে এসেছে ভাগীরথী বাঁদিক থেকে আর সমকোণ থেকে এসেছে অলকানন্দা। এই অলকানন্দাতে এসে মন্দাকিনী মিশেছে দেবপ্রয়াগের অনেক উপরে। রুদ্রপ্রয়াগে। মিশে যাওয়ার পর রুদ্রপ্রয়াগে মন্দাকিনীর এবং দেবপ্রয়াগে অলকানন্দার আর কোনও অস্তিত্বই থাকেনি।

এ কথার মানে?

মানে এই যে, আপনিও রুদ্রপ্রয়াগের মন্দাকিনী বা দেবপ্রয়াগের অলকানন্দা হয়ে যান। সেই যে গানটি গাইলেন না, সেই যে, গুরুজি বললেন উপনিষদের শ্লোক-নির্ভর যে গানটি, ঈশ্বর-বন্দনার গান? সেই যিনি পা না থাকা সত্ত্বেও সব জায়গাতে যেতে পারেন, চোখ না থাকা সত্ত্বেও সব কিছু দেখতে পারেন, হাত না থাকা সত্ত্বেও তাঁর হাত দিয়েই এই সংসারের সৃজন পালন করতে পারেন, তাঁরই মধ্যে নিজেকে লীন করে দিন। আপনার পূর্ব জীবন, আপনার আমিত্ব, আপনার অহং সব নিয়ে এমন করে এই নিরবধিকাল বহমানা অদৃশ্য নদীতে ঝাঁপ দিন চারণবাবু, যাতে আপনি আপনার আগের সব অস্তিত্বই মন্দাকিনী আর অলকানন্দারই মতন মুছে ফেলতে পারেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে।

চারণ চুপ করে রইল।

ভীমগিরি বললেন, কি? পারবেন না?

একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, নিজের সব কিছু নিজস্বতা বিসর্জন না দিলে, নিজের সব চিহ্ন নিশ্চিহ্ন না করলে, নতুন দলের নিশান হাতে নিয়ে দৌড়বেন কেমন করে? রিলে রেস-এ দৌড়াননি স্কুলে পড়বার সময়ে?

হুঁ।

তবে? আমাদের গৃহী-জীবনের পুরোটাই তো একটা রিলে রেস। ছেলে বাবার নিশান নিয়ে দৌড়চ্ছে, নাতি ছেলের। ছাত্র মাস্টারমশাইয়ের। জুনিয়র উকিল তার সিনিয়রের, সারাটা জীবনই। দৌড়! দৌড়! দৌড়! রিলে রেস নয়তো কি?

তা ঠিক।

ভাবিত চারণ বলল, স্বগতোক্তির মতন।

ভীমগিরি বললেন, অত ভাবার কি আছে? আপনিও তাঁর অদৃশ্য হাতে আপনার সব নিশান তুলে দিয়ে তার মধ্যে হারিয়ে যান। দেখবেন, তখন একটা প্লাস্টিকের সিগারেট-লাইটারের ভারকেও ঐরাবতের মতন ভারী বলে মনে হচ্ছে।

দেবপ্রয়াগ জায়গাটা বুঝি খুব সুন্দর? নানা বইয়েতে পড়েছি। আমাদের বাংলা ভাষার সাহিত্যিকেরা এই পথ এবং এইসব তীর্থস্থান নিয়ে যে কত সুন্দর সুন্দর বইই লিখেছেন। কত সিনেমাও হয়েছে। যখন স্কুলে পড়ি তখন, দেখেছিলাম মহাপ্রস্থানের পথে। এখন সেই বইয়ের লেখক, ছবির পরিচালক, নায়ক নায়িকাদের মধ্যে অনেকেই মরে ভূত বা ভগবান হয়ে গেছেন। এতদিনের আগের ছবি। কিন্তু ছবির কথাটা মনে আছে ঠিকই। তাই নাম শুনলেই মনে হয়, দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ যেন কতবার দেখেছি।

বইয়ে-পড়া দেখা আর নিজ চোখে দেখাতে আকাশ-পাতাল তফাত। দেবপ্রয়াগে একবার গিয়ে পৌঁছলে আপনার বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দিতে চাইবেন। তবে এই পাড়ে, মানে, নদীর বাঁ পাড়ে কিছু নেই। এগিয়ে গিয়ে ব্রিজ পেরিয়ে আবার ডানদিকে ঘুরে ওপারে যেতে হবে। ছোট ছোট হ্যাঁঙ্গিং-ব্রিজও আছে অবশ্য। ওপারেই প্রাচীন দেবপ্রয়াগ। বদ্রীনাথের যাঁরা পূজারী যাঁদের রাওয়াল বলে, তাঁদের বাস ওখানেই।

হ্যাঁ। শুনেছি। কুমার ট্রাভেলস-এর ড্রাইভার বলছিল বটে।

ভীমগিরি হঠাৎ উঠে পড়ে বললেন, আমি একটু ঘুরে আসি। শেঠ চলে গেলে গুরুজির পদসেবা করব, তারপরে ওঁকে একটু দুধ খাইয়ে দিয়ে দিনান্তে নিজের কাজ করব।

নিজের কাজ মানে?

মানে, ধ্যান। নিজস্ব ভাবনা।

ভীমগিরি চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, গুরুজির কাছে শুনেছি যে, আমাদের উপনিষদে একটি শ্লোক আছে

আহার নিদ্রা ভয় মৈথুন সামান্যমেতৎ কাঃ পশুভিনরানাঃ
ধর্মহি তেষাম অধিকোবিশেষোঃ ধর্মোণাহীনা পশুভিসমানাঃ।

চারণ বলল, মানে কি হল এর?

মানে হল, পশু আর মানুষ দুইয়েরই আহার আছে, নিদ্রা আছে, ভয় আছে আর আছে মৈথুন। কিন্তু মানুষকে সৃষ্টিকর্তা ধর্ম দিয়েছেন কিন্তু পশুকে তা দেননি। পশুমাত্রই ধর্মহীন। এই ধর্ম কিন্তু হিন্দু, ইসলাম, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি নয়। এই ধর্ম মানুষের ধর্ম। ভাবনা-চিন্তার ধর্ম, গান গাইবার ধর্ম, ছবি আঁকবার ধর্ম, কবিতা লেখার ধর্ম, ঈশ্বর-ভজনার ধর্ম, যে সব গুণ বিধাতা জন্তু-জানোয়ারকে দেননি।

এই পর্যন্ত বলেই ভীমগিরি পা বাড়ালেন। মুখে বললেন, চললাম আমি।

.

০৬.

ভীমগিরি চলে যেতেই চারণ বড় অসহায় বোধ করতে লাগল। এই কদিনে এই মানুষটা তার উপরে এক অদ্ভুত প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছেন। ইংরেজিতে যাকে বলে SPELL। এই প্রভাব ভাল কী মন্দ সে প্রশ্নে না গিয়েই ও ঠিক করল যে ওকে এই প্রভাবের হাত থেকে মুক্ত হতেই হবে। ও কেন এই গেরুয়াধারীর খপ্পরে পড়ে জীবনটাকে নষ্ট করবে?

একবার ভাবল, ফিরেই যাবে হোটেলে।

তারপর ভাবল, নাঃ। ভীমগিরি ছাড়া কি অন্য সাধু-সন্ত নেই এখানে? তাদের অভাব কি? এই ভীমগিরিকেই এড়িয়ে চলতে হবে শুধু আগামীকাল থেকে।

পরক্ষণেই ওর মনে পড়ল চন্দ্রবদনীর কথা। কবে যেন আসবে সে? দেওয়ালীর দিনে। দেওয়ালী পর্যন্ত তাকে হৃষীকেশ-এ থাকতেই হবে। ভীমগিরিকে সহ্য করতেই হবে। চারণ জানে যে, সাধু হওয়া ওর হবে না। অনেকই চাওয়ার কামড়, অতৃপ্ত ভোগবাসনা তাকে ঘিরে রয়েছে। বড় অসহায় বোধ করে ও। বড় রাগ হয় নিজের উপরে। ঘৃণাও।

নিজেকে যদি বুঝতে পারত পুরোপুরি!

ভীমগিরি চলে গেলেন।

চারণেরই আজ কোথাওই যাবার নেই। গাঁজার বিড়ির প্রভাবে আর ভীমগিরির বুকনিতে মাথাটা ভোঁ-ভোঁ করছিল। ভাবল, গঙ্গা মাঈর মস্ত বাঁধানো ঘাটের চাতালে একটু পায়চারী করবে। ঠাণ্ডা হাওয়াতে মগজ সাফ হয়ে যাবে। সারাটা দিনই আজ হাঁটা-চলা তেমন হয়নি।

ঘাটে এখন লোকজন কমে গেছে। যে সব নারী ও শিশুরা ফুল, প্রদীপ আর তাড়পাতার দোনা সাজিয়ে বসেছিল এতক্ষণ তারাও গায়ের কাঁথা-চাদর টেনেটুনে নিয়ে উঠে পড়ে তাদের সামগ্রী সব উঠিয়ে নিয়ে আজকের মতন বিকিকিনি সেরে যার যার বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে একে একে।

জলের পাশে দাঁড়িয়ে, নদী রেখা ধরে যতদূর চোখ যায়, চেয়েছিল চারণ। যেখানে নদীর ওপরের বারাজের ওপরে আলো জ্বলছে, সেদিকে চোখ পৌঁছুল। কী যেন এক কারখানা হয়েছে ওইদিকে। উজ্জ্বল আলো জ্বলে। চিমনি দিয়ে ধুয়ো উঠে। কারখানা কি অন্যত্র করা যেত না? কুঞ্জাপুরীর উচ্চতা থেকে নীচে তাকিয়ে হৃষীকেশের উপত্যকাকে সত্যিই দেবভূমি বলেই মনে হয়।

চারণের ভাবনার জাল ছিঁড়ে হঠাই কানের কাছে কে যেন বলে উঠল, ব্যোম শংকর।

ব্যোম শব্দটার উপরে এমন করে অ্যাকসেন্ট পড়ল যেন মনে হল তানজানিয়ার সেরেঙ্গেটি প্লেইনস-এ সিংহই ডাকল।

চমকে উঠে, মুখ ঘুরোতেই দেখল ঘাটের মাঝ-সিঁড়িতে একজন ছিপছিপে লোক বসে। তার মাথাতে বাঁদুরে টুপি। গায়ে একটি সুজনি গোছের চৌখুপি পাতলা তুলোর চাদর। তুলোটও নয়। পরনে জিনস-এর প্যান্ট। মোজাহীন দুটি পায়ে, রাবারের হাওয়াইয়ান চটি। বলতে গেলে, চরণযুগল প্রায় খালিই। এই অচেনা মানুষটির পোশাকের স্বল্পতা ওর নিজের পোশাকের আধিক্যজনিত কারণে চারণকে সত্যিই লজ্জিত করল।

ব্যোম শংকর, শংকর দেবতার স্তুতিসূচক একটি উচ্চারণই মাত্র। ব্যোম শংকরতো কোনও সম্ভাষণ নয়! এই নির্জনে এই অপরিচিত বাঁদুরে-টুপি পরিহিত ব্যক্তিটি স্বগতোক্তিরই মতন যেন উচ্চারণ করল শব্দটি। আনন্দে হতে পারে, দুঃখে হতে পারে, ভক্তিতেও হতে পারে। ভাবল, চারণ।

ব্যোম শংকর-এর প্রত্যাভিবাদন হয় না। হয় বলে, অন্তত জানা নেই চারণের।

হঠাৎই সেই কিম্ভুত ব্যক্তি বললেন, কী বুঝলেন স্যার? চ্যাটার্জি সাহেব? দম মারো দম হরে কৃষ্ণ হরে রাম শোনেননি?

চারণ সেই শ্রীমুখে তার নাম উচ্চারিত হতে শুনে আরও চমকে চেয়ে দেখল যে, পাটন।

অবাক হল চারণ পাটনকে দেখে এখানে। তার দুটি হাতই ছিলিমের উপরে। পুরো টান লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই এই উদগীরণ!

ঊষা উত্থুপের গলাতে এই গানটি শোনেননি? মিস করেছেন স্যার কিছু। দম মারো দম, হরে কৃষ্ণ হরে রাম।

তারপরেই বলল, বেচারি জ্যাকিদা। ভাল মানুষ, আদ্দির পাঞ্জাবির হাতা-গোটানো, চুরুট-খাওয়া মদ্য সম্বন্ধে বিদ্বেষহীন, স্পোর্টসম্যান জ্যাকিদাকে এই দম মারো দম-এর গায়িকা কী ল্যাংটাই ন মারলেন বলুন? প্রবল-বিক্রম জ্যাকিদাকে একেবারে আলুর দম করে ছেড়ে দিলে গা। সাধে কি আমার বড় পিসিমা বলতেন খপদ্দার। কনও কোনও মেইয়েছেলের সঙ্গে টকরাতে যাসনি পাটু। ভেনে দেবে এক্কেবারে। আমরা হচ্ছি গিয়ে মা কালীর জাত।

বলেই পাটন বলল, কী হল! আপনাকে যে ব্যোম শংকর বলে উইশ করলাম, আপনি তো আমাকে উইশব্যাক করলেন না। ম্যানার্স জানেন না এতটুকু! এত বড় একজন উকিল।

ব্যোমশংকর যে কোনও সম্ভাষণ, তা দিয়ে কারওকে আদৌ উইশ করা যে যায়, সে কথাই আদৌ জানা ছিল না আমার আগে। পাটন বলল।

জানুন তবে। ধ্বনি উঠলেই প্রতিধ্বনি ওঠা স্বাভাবিক। ধ্বনি যে ওঠাল তার অন্তত খুবই ইচ্ছে করে যে, তার সাঙাত জুটুক এক-দুজন অন্তত। অনেকসময় তো একাধিক সাভাতও জোটে। শোনেননি? মানে এক ধ্বনির একাধিক প্রতিধ্বনি হয়।

তা শুনেছি। কিন্তু…তুমি এখানে কি করছ? এলে কোথা দিয়ে? আমি তো চাতালেই বসেছিলাম তোমাকে তো আসতে দেখলাম না!

ঘাটা-অঘাটাতে আসার পথ কি একটা না কি? কত্ব পথ আছে।

তারপর যেন দয়া করেই বলল, কপিলমুনির আশ্রমে খেয়ে এসে এখানে গাঁজায় দম দিচ্ছি। আজ খাওয়াটা গাণ্ডে-পিণ্ডে হয়েছে।

রাতে থাকবে কোথায় আজ? মানে শোবে কোথায়?

শোব? শোব কোন দুঃখে?

মানে? রাতে শোবে না?

নাঃ।

ভাবল চারণ, এ এক আজব রাজ্যে এসে পড়ল সে। এখানে কেউ বলে, খাব না। কেউ বলে শোব না রাতে। মাথাটাই খারাপ করে দেবে এরা।

তারপর, অত্যন্ত তাচ্ছিল্যর গলাতে পাটন বলল, গাঁজা কি আপনার হুইস্কি নাকি যে পটাপট চার পেগ চড়িয়ে, পেট-মাদিয়ে খেয়ে, বউ অথবা কোলবালিশ জাপটে শুয়ে পড়বেন। না স্যার। গাঁজা তেমন নেশা নয়। গাঁজা খেয়ে এখানেই বসে কাটাব সারা রাত। অহিফেন, গাঁজা এসবের তরিকাই আলাদা।

কী করবে? মানে ঘুমোবে তো না, কিন্তু করবেটা কি?

চিন্তা করব।

চিন্তা?

হ্যাঁ।

চিন্তাটা কিসের তোমার? তোমার বাবা যা রেখে যাবেন তা তত পাঁচপুরুষের পক্ষে রাজার হালে থাকলেও যথেষ্ট।

এই ত! চ্যাটার্জি সাহেব, আপনারা যে টাকার চিন্তা ছাড়া অন্য কোনও চিন্তার কথা ভাবতে পর্যন্ত পারেন না। যেমন আপনি, তেমনই আপনার মক্কেলরা। আপনি কি করতে এসেছেন এখানে? রাঁঢ়ের পাছা বাজাতে?

ছিঃ। ইসস! ল্যাঙ্গোয়েজ! ল্যাঙ্গোয়েজ। কী যা তা ভাষাতে কথা বলছ তুমি।

আমি তো বলিনি। আমি Quote করলাম মাত্র। দেশ পত্রিকাতে কুমারপ্রসাদ মুকুজ্জ্যে লিখেছেন।

কে কুমারপ্রসাদ?

ধূর্জটি মুকুজ্জ্যের ছেলে। তা বলে বাচ্চা ছেলে আদৌ নন। সুপারঅ্যানুয়েটেড ভার্সেটাইল বুড়ো। অনেকে ডাকে ওঁকে আমিময় মুকুজ্যে। উনি Quote করেছেন। মানে, উনি এক কোট মেরেছেন। আমি দুকোট মারলাম। এই আর কী!

এত গাঁজা খেলে হ্যালুসিনেশান হয় না?

হয় বইকি। হওয়ার জন্যেই তো খাওয়া।

তারপর বলল, ভালভাবে গঞ্জিকা সেবন করার পরে মাঝরাতে হয়তো দেখব মাকালি এসে দাঁড়িয়েছেন জিভ বার করে। দেখব, কারা যেন তাঁত বুনছে বহুবর্ণ সুতো দিয়ে। অন্ধকার আকাশ সেই সব রঙিন রেশমি সুতোর সাইকেডিলিক রঙের ছটাতে রামধনুর মতন কর্বুর হয়ে উঠেছে।

কর্বুর শব্দের মানে কি?

লেহ লটকা!

সেটা কি?

মানে?

মানে আবার কি? অভিব্যক্তি। এতটুকু ইংরেজিও জানেন না তো বিলেতে এতগুলো বছর কি করলেন যৌবনে? লেহ লটকা। একটা এক্সপ্রেশান।

কিসের? এক্সপ্রেশানটা কিসের?

মিশ্র অভিব্যক্তি। বিস্ময়ের, আনন্দের, আপনার মতন হস্তীমূর্খ সন্দর্শনের!

তারপরই বলল, কবুর মানে জানেন না অথচ আপনি না কবিতা লিখতেন প্রথম যৌবনে? লিটলম্যাগ করতেন?

তাতে কি? ওটা একটা রোগ?

কোনটা?

ওই লিটলম্যাগ করাটা। বাঙালি মাত্ররই যৌবনে ওই রোগ হয় আবার তিরিশে পৌঁছলেই আপসে ছেড়ে যায়। স্বপ্নদোষ রোগেরই মতন আর কী!

তাঁর সঙ্গে কর্পূরের কি?

চারণ বলল।

আঃ। কপুর নয়, কর্বুর। আপনি না নিজের পয়সা খরচ করে একটি কবিতার বইও বার করেছিলেন? অবশ্যই পরার্থে।

কার স্বার্থে? চারণ শুধোল।

একদল ফোর টোয়েন্টি প্রকাশক আছেন। তাঁরা, মেয়ের দালালেরা যেমন গরীব ঘর থেকে খুঁজে খুঁজে হাফ-গেরস্থ মেয়ে-বৌ প্রকিওর করে আনে তেমনই কবিযশপ্রার্থীদের প্রকিওর করে এনে বৃষ্টির পরে পরেই শালিক যেমন কপাকপ ফড়িং ধরে খায় তেমন করেই গিলে খান কচিকবিদের। বা কপিদের। এঁরা টিপিক্যাল বাঙালি সংস্কৃতিসম্পন্ন এক ধরনের কাব্যিক গাঁটকাটা। প্রতি মাসে কলকাতায় ও নানা মফস্বল শহরে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, যশপ্রার্থী কবিদের কত হাজার কবিতার বই যে এমন করে প্রকাশিত হয় ব্যাঙের ছাতারই মতন আর কিছুদিনের মধ্যেই কাগজ বিক্রিওয়ালাদের মাধ্যমে তেলেভাজার দোকানের উনুনে চলে যায়, তার হিসেব কে রাখে!

এসব আজেবাজে কথা থাক এখন। তুমি এখন তোমার সেই ভোঁদাইবাবা না গাঙ্গুবাবার আশ্রমে যাবে না?

ফিচিক শব্দ করে হাসল পাটন।

বলল, কেন? খুঁজতে গেছিলেন নাকি আমাকে?

চারণ চুপ করে রইল।

পাটন বলল, এই বুদ্ধি নিয়ে যে কী করে এত বড় উকিল হয়েছিলেন তা আপনিই জানেন আপনি একটি গাড়ল-শ্রেষ্ঠ।

চারণ অপমানিত বোধ করল অবশ্যই কিন্তু জবাবে কিছুই বলল না।

পাটন বলল, খবর পেয়েছি ভিয়াসি থেকে যে, আপনি ভোঁদাইবাবা বা গাড্ডুবাবার খোঁজে গিয়েছিলেন ভিয়াসিতে।

বলেই, হাঃ হাঃ করে হেসে উঠিল।

তুমি হাসছ?

চারণ অসহায় এবং বোকার মতন বলল।

হাঃ হাঃ। হাসচি-ই-ই!

বলল, পাটন।

চারণ হাতঘড়িতে দেখল দশটা বাজে। এখনও হোটেলে ফিরে যাওয়াটা বিপজ্জনক। মিলির খপ্পরে পড়লে কি ঘটে বলা যায় না। মিলির রুচি খারাপ, শিক্ষা অসম্পূর্ণ কিন্তু ওর একটি উদগ্র কামনা-জরজর নারী-শরীর আছে। দেহসর্বষী সে।

চারণ, তার পুরুষসুলভ স্বাভাবিক বুদ্ধিতে চিরদিনই বুঝে এসেছে যে, সে ভগবান নয়। ভূতও নয়। ভগবানের ভূত হতে আর ভূতের ভগবান হতে সময় বেশি লাগে না। পুরুষকে বিধাতা বড়ই ভঙ্গুর করে করেছেন। তথাকথিত দুর্বল নারীরা অনেকে জানেনই না যে, যা পুরুষের দুর্বলতা তাই তাঁদের বল। মদমত্তা মিলির শারীরিক সান্নিধ্যর ঝুঁকি চারণ নিতে রাজি নয়। এখানে আসার পর থেকে, যদিও সম্পূর্ণই অপরিচিত, কিন্তু এক সম্পূর্ণ নতুন জগতের স্বাদ পেতে আরম্ভ করেছে ও। এক নতুন নেশার ঘোর ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। ধীরে। সেই নেশাটা, গাঁজার বিড়ির যতখানি, তার চেয়েও অনেকই বেশি এই অনুষঙ্গর। পাটন যদি স্টেটস-এর সহজ সুখের জীবন ছেড়ে এসে এই ঘাটের সিঁড়িতে গাঁজাতে দম দিয়ে রাত কাটিয়ে দিতে পারে তা হলে চারণেরই বা এই জীবনকে একটু চেখে দেখতে দোষ কি?

এই কদিন রোজই থ্রি-স্টার হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালের ব্রেকফাস্ট খাওয়ার পরপরই হাফ-সন্ন্যাসী হওয়ার চেষ্টাটা ওর নিজের কাছেও হাফ-গেরস্থ জনপদবধুদের মতনই না-ঘরকা -না ঘাটকার প্রয়াস বলে মনে হচ্ছিল। জোনাথন লিভিংস্টোনের সী-গাল বইটার কথা আবারও মনে পড়ে গেল ওর। নিজেকে নিজের সব শিকড়বাকড় আলগা করে নতুন স্রোতে ভাসিয়ে না দিতে পারলে কিছুই হবে না। তেমন না করতে পারলে, যা জানতে এসেছে, বুঝতে এসেছে, তার কিছুই জানা বোঝা হবে না যে, সে কথা ও অনুভব করেছে, করছে।

কী ভেবে, চারণ চাটুজ্যে হৃষীকেশে আসার পরে যেন এই প্রথম তার কলকাতাইয়া পরিচয়টা প্রদীপেরই মতন অদৃশ্য দোনাতে করে ভাসিয়ে দিল দ্রুত ধাবমান কুলুকুল ধ্বনি-তোলা গঙ্গার বুকে, অদৃশ্য হাতে। শুধু ও নিজে জানল, আর নদী জানল এই অদৃশ্য নিবেদনের কথা। আর জানল অন্ধকার রাতের অগণ্য তারারা।

বসে পড়ল চারণ ঝুপ করে নদীর ঘাটের লক্ষ-পদ-চর্চিত নোংরা সিঁড়িতে, পাটন নামক ওর দুর্বিনীত, উদ্ধত, অশিক্ষিত ধনী মক্কেল-তনয়ের পাশে।

পাটন কিন্তু কিছুই বলল না। মুখ ঘুরিয়ে দেখল না পর্যন্ত একবার।

বাহাদুরী-প্রবণ, হাততালি-প্রত্যাশী চারণও কিছু বলল না।

দুজনেই নিশ্ৰুপ থাকাতে নদীর শব্দ কানে জোর হল।

ঘাটের চাতাল থেকে অনেকই পায়ে-হাঁটা পাকদণ্ডী পথ উপরে চড়াইয়ে উঠে গেছে নানা মন্দির। আর আশ্রমের দিকে। উপরের কোনও আশ্রম থেকে কোনও সাধু, শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। শুধু তাঁরই গলার স্বর ভেসে আসছিল। নইলে, শীতের রাতের দশটাতে এখন আর বিশেষ সাড়াশব্দ নেই এখানে।

কে যেন জোরে হাই তুললেন। তারপরই অন্য কেউ অথবা হাই-তোলা মানুষটিই বললেন, সিয়ারাম। সিয়ারাম!

নদীর জল সশব্দে বয়ে যেতে লাগল। চারণ সেদিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে চেয়ে রইল। কিন্তু পাটনের মুখে কথা নেই। সে ছোকরা কিছুক্ষণ বাদে বাদে কলকেতে টান মারছে আর ঝিম মেরে থাকছে কিছুক্ষণ। চারণ নিজে অবশ্য কুঁদ হয়ে ছিল নিজেরই চিন্তাতে। মাঝে মাঝে ওর নিজেকে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল। ওর মধ্যে যে এত বিরক্তি, ক্লান্তি, এবং একঘেয়েমির গভীর অবসাদ এমন মারাত্মকরকম ঘনীভূত হয়েছিল এ সত্য সে নিজেও জানত না। একেই বলে স্থান-মাহাত্ম্য। এখানে এক-একটা ঘণ্টা কেটেছে আর জেট-ইঞ্জিনের থ্রাস্ট-এর মতন ও অতীতকে পদাঘাত করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। উৎক্ষিপ্ত, উৎসারিত হাউয়েরই মতন খোলসকে পিছনে ফেলে রেখে আকাশপানে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ছুটেছে। সেই এগিয়ে যাওয়ার গতিজাড্যটা ওর মনের মধ্যে প্রতিমুহূর্তেই তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। একটা UTTERLY INNOCENT BEGINING থেকে এমন এক বিপজ্জনক ও অপরিচিত এবং অনিশ্চিত জীবনে সে প্রবেশ করে যাবে, এবং শুধু যাওয়াই নয়, ক্রমশ তার মধ্যে এমন সেঁধিয়ে যেতে থাকবে, তা ও যেদিন এখানে এসে পৌঁছেছিল সেদিন ঘুণাক্ষরেও জানেনি।

হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভেঙে পাটন বলে উঠল, ব্যোম শংকর। সংক্ষিপ্ত, স্পষ্ট উচ্চারণে।

চারণ কিছু না বুঝেই, না ভেবেই উত্তর দিল, ব্যোম শংকর।

এই তো এই তো!

পাটন ডান হাত তুলে আশীবাদ করার ভঙ্গিতে বলল, চারণকে।

তারপর বলল, গুরু মিলে লাখ লাখ, চেলা মিলে এক। ব্যোম শংকর। চারণ আবারও যন্ত্রচালিতর মতন বলল, ব্যোম শংকর।

বলেই, নিজের মুখামি, ও অপরিণামদর্শিতাতে আঁতকে উঠল। ওর মনে হল ধিয়ানগিরি মহারাজের ভক্ত শাঁওল বাজাজ তখুনি দৌড়ে এসে বলবে, আমার সাড়ভাই-এর কাছে আপনার কথা শুনেছি স্যার। চলুন, চলুন, আমার সঙ্গে। এখানে এই গন্দী জায়গাতে বসে কি করছেন আপনি?

শাঁওল বাজাজ চলে গেছে অনেকক্ষণ যে, তা দেখেছে চারণ। সে অনুপস্থিত শাঁওলকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে বলল, তোমরা ওই দুগ্ধফেননিভ মহামূল্যবান ইস্ত্রি করা পোশাক পরে আস বলেই, এই ধুলোতে নিজেকে অন্যদের সঙ্গে একাসনে বসাতে পারো না বলেই হয়তো, যা খুঁজতে আসো তা পাওনা!

যেন, চারণের মনের ভাবনার খেই ধরেই পাটন বলল, শান্ত লাগছে কি? মন? একটু?

জানি না।

লাগবে। সার-গোবর পড়ছে, জল পড়ছে, আরও অনেকই পড়বে। ফুল তখন ফুটবেই।

এমন সময়ে নদীর দিক থেকে কে একজন ভিজে কাপড়ে উঠে এল কাদা মাড়িয়ে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে। এই ঠাণ্ডাতে রাত দশটাতে চান করল কে? উন্মাদদের আড্ডা এই জায়গা!

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চারণ সেদিকে।

সাধু-সন্তদের চেহারা ও ফিগার দূর থেকে যেন একইরকম দেখায় বলে মনে হয়। মুখ চেনা যায় না। চেনা যায় না, না তাঁরাই চিনতে দেন না, কে জানে!

মানুষটি জল ঝরাতে ঝরাতে পাশ দিয়ে চলে যাবার সময়ে চোস্ত ইংরেজি অ্যাকসেন্টে পাটনকে বলল, গোয়িং ব্যাক?

নোপ।

পাটন বলল।

চারণ দেখল, ব্যক্তি এক বিদেশি। রোদে জলে ধুলো ময়লায় রঙ জ্বলে গেছে। সম্ভবত আমেরিকান।

আই অ্যাম গোয়িং টু ডুঢাহরী ব্যাব্যা টুমরো।

ফাইন।

পাটন বলল।

হাউ বাউট ড্য?

অ্যাম গোয়িং ব্যাক।

ওক্ক্ব।

সী ড্য ইন থ্রী ডেইজ।

ওক্কে।

পাটন বলল, স্বগতোক্তির মতন।

চারণ উৎসুক হয়ে শুধোল, তোমার গুরুভাই?

গরুভাই।

তারপর বলল, আমার গুরুটুরু নেই। একজনের কাছাকাছি থাকি, এই যা। মানুষটি প্রগাঢ় পণ্ডিত। ভীষণই ইন্টারেস্টিং।

কার কথা বলছ?

যার কাছে থাকি, তিনি।

কেন? ইন্টারেস্টিং কেন?

একজন ওরিজিনাল মানুষ। বিন্দুমাত্র ভান-ভড়ং নেই। তাঁকে পছন্দ করি খুবই। কিন্তু পছন করলেই কি কারওকে গুরু বলে মানা যায়? তা ছাড়া উনি দৈত্যকুলে পেল্লাদ।

কী রকম?

উনি গুরু কাল্ট-এ বিশ্বাসই করেন না। জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তির মতন।

যাঁরা ইংরেজি জানেন না কৃষ্ণমূর্তির মতন, তাঁরা কি সম্মানের যোগ্য নন? যেমন ধিয়ানগিরি মহারাজ।

কে ধিয়ানগিরি মহারাজ?

এই ত্রিবেণী ঘাটের।

ওরকম কত মহারাজ পাবেন হরিদ্বার হৃষীকেশ-এর আনাচেকানাচেতে। অগণ্য মহারাজ, জাঁহাবাজ, ধোঁকাবাজ, ধান্দাবাজে ছেয়ে আছে এই সব জায়গা। All that glitters are not gold, আমি চিনি না। তবে, আমি তাঁকে না জেনেই তিনি সম্মানের অযোগ্য এমন বলব কেন?

আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দিলে না পাটন তুমি।

ইংরেজিতে বা ইউরোপের কোনও ভাষাতে নিজেকে সহজে প্রকাশ করতে পারলে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায় তো। ভাষাটা চিরদিনই একটি মস্ত বাধা। দেখেন না! INSTRUMENTAL MUSIC কত সহজে সাতসমুদ্রে পেরিয়ে চলে গেল। পৃথিবী, রবিশংকর আলি আকবর, আমজাদ আলি খাঁ, নিখিল ব্যানার্জি বা বুধাদিত্য মুখার্জিকে শিরোপা দিল আর বাব আলাউদ্দিন খাঁ, আবদুল করিম খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, কালে খাঁ, গহরজান, বড়ে গুলাম আলি খাঁ সাহেব বি হালফিলের রশিদ খাঁও অপরিচিতই রয়ে গেল। দোষ তো তাঁদের নয়, দোষ তত ভাষারই বাধার।

তবে আমি বলব, যিনি প্রকৃত সস্ত তার পশ্চিমের হাততালিতে দরকারই বা কি? তিনি নিজে তো নিজের আনন্দে বুঁদ থাকবেন।

তা ঠিক। কিন্তু জি কৃষ্ণমূর্তির মতন মানুষেরা তো শুধু সম্ভই নন, রাষ্ট্রদূতও বটেন। স্বাম বিবেকানন্দ বস্টনে না গেলে কি অ্যামেরিকার মাধ্যমে সারা পৃথিবী হিন্দুধর্মকে জানত?

তা ঠিক অবশ্য।

জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তির দর্শন ছিল, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচবে। মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে। এদিক দিয়ে ডভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, অবশ্য সেজুয়াল আউটপোরিং অ্যাপার্ট, জিডু কৃষ্ণমূর্তির জীবনদর্শনের সঙ্গে এরিকা জং-এর জীবন-দর্শনের মিল আছে। এরিকা জং-এর বইটা কি পড়েছেন?

না। কি বই?

চারণ পাটনের এই নতুন পড়য়া পরিচয়ে অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।

সেইভ ইওর ওন লাইফ। সিরিয়াস বই নয়। মাঝে মাঝে পর্নোগ্রাফি বলেও মনে হবে কিন্তু সেই FUN-FROLICK-এর মধ্যে দিয়ে এক আশ্চর্য জীবন-দর্শনের কথা বলেছেন মহিলা। SALTY, CRISP, ভাল বেকন ভাজলে যেমন খেতে হয়, তেমন বই।

কৃষ্ণমূর্তি বলতেন, আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই হয় অতীতে বাঁচি, নয় ভবিষ্যতে। অথচ আমাদের প্রত্যেকেরই; বাঁচাটা যে বর্তমানেই, এই মুহূর্তটিতেই সবচেয়ে বেশি দরকার, তা আমাদের মধ্যে কজন মানি? মানা তো দূরস্থান, জানিই বা কজন?

চারণ চুপ করে রইল।

চারণ সেদিন তার অশিক্ষিত ট্রিলিয়নিয়র মক্কেলের ছেলেকে এখানে দেখে তার সম্বন্ধে যা ভেবেছিল, সেই ধারণা যেন দ্রুত পালটে যাচ্ছে ক্রমশ। ভাবছিল, আমরা মনে করি, কারওকে চিনি কিন্তু সত্যিই কি চিনি বেশি জনকে? একজন মানুষের মধ্যে সম্ভবত অনেক মানুষ থাকেন।

চারণ বলল, তুমি হঠাৎ স্টেটস ছেড়ে এখানে চলে এলে কেন? কিসে কামড়াল তোমাকে হঠাৎ?

কামড়াল, ওই অ্যামেরিকানদের ভোগসর্বস্বতা, ওদের বাক্যাড়ম্বর, ওদের অর্থময় ডলার-মগ্ন অপসংস্কৃতি। ওই দেশটাকে সামাল না দিতে পারলে সারা পৃথিবীকে নষ্ট করে দেবে ওরা। দেবে কি, দিয়েছেই ইতিমধ্যে। সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক, আত্মিক জগতে ওরা যা বিপজ্জনক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, পৃথিবীকে সার্বিক সর্বনাশের যতাখানি কাছকাছি এনে ফেলেছে, তা হিরোসিমা-নাগাসাকি উড়িয়ে দেওয়া এক কোটি অ্যাটামবোমা বা দেড় কোটি হিটলারও চেষ্টা করে পারত না। ওদের খুবই কাছ থেকে জানার পরই আমার এই তীব্র বিদ্বেষ জন্মেছে। আমি ইংরেজিতে একটা বই লিখছি। লেখা শেষ হলে সেই বই সারা পৃথিবীতে হই-চই ফেলে দেবে। না, আমি শোভা দের মতন লেখক হতে চাই না। ইচ্ছে করলে, শোভা দে-র চেয়ে অনেক বেশি রগরগে পনো লিখতে পারি আমি। না, অথোপার্জনের জন্যে লিখছি না সেই বই। লিখছি, পৃথিবীর মানুষদের অবধারিত আত্মিক মৃত্যু থেকে বাঁচাবার জন্যেই।

সব অ্যামেরিকানই কি একরকম? আমি তো বহুবারই গেছি সে দেশে, যদিও থাকিনি একটানা তোমার মতন, কিন্তু আমার তো ওদের সরল, উদার, খোলামেলা বলেই মনে হয়েছে।

তারা তাই। তবে তাদের স্বার্থমগ্নতাতে তারা এতটাই আত্মমগ্ন হয়ে গেছে যে, শুভাশুভবোধ, ধর্মবোধ, ন্যায়-অন্যায় বোধ তারা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের আত্মিক উত্তরণের সব পথই প্রায় বন্ধ।

তারপরে বলল, ভাল কি নেই? অবশ্যই আছে। আমার বইয়ের প্রচারতো সেই গভীর মানুষেরাই করবে, যখন বেরোবে।

বাঃ। লেখো। অপেক্ষা করে থাকব। তুমি কি জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তিকে দেখেছিলে?

আমি? না, না। আমি দেখিনি। তবে তাঁর এক শিষ্যাকে দেখেছিলাম রেবেকা ম্যাকগাওয়েন। রেবেকাব পরিবার অরিজিনালি স্কটল্যান্ডের। পঁচাত্তর বছর হল স্টেটসে সেটল করেছেন। রেবেকাকে জানলাম বলেই কৃষ্ণমূর্তিকেও জানলাম।

রেবেকার বয়স কত?

আমারই বয়সী।

তোমার বয়সী সন্ন্যাসিনী!

সন্ন্যাসিনী হতে যাবে কোন দুঃখে।

ও অ্যানথ্রাপলজিতে মাস্টার করে ইয়েল উনিভার্সিটিতে পড়ায়।

তাই?

হ্যাঁ। আমরা খুব বন্ধু। চিঠি লেখে ও নিয়মিত। আসবে বলেছে এখানে একবার। আমিও যাব ভাবছি। এর পরের বছরে Fall-এর সময়ে। ওই টিকিট পাঠাবে। বাবার পয়সাতে যাব না। আমার যা সামান্য নিজস্ব সঞ্চয় ছিল তা প্রায় শেষ হতে চলেছে। কিন্তু এখানে থাকলে তো আমার অর্থর তেমন প্রয়োজনও নেই। অর্থর চেয়ে বড় অনর্থ যে আর নেই এই কথা আমার বাবা এবং আপনার আরও অনেক মক্কেলদের দেখেও কি বোঝেননি চ্যাটার্জি সাহেব আপনি এতদিনেও?

হুঁ।

বলল, চারণ।

তারপর বলল, ওই যে বিদেশি বললেন ডুড্যাহারী ব্যাব্যা, তিনি কোন বাবা?

ওঃ হো।

বলেই, হেসে ফেলল পাটন।

বলল, ডুঢ্যাহারী ব্যাব্যা নন, দুধাহারী বাবা।

তিনি আবার কিনি?

চারণ শুধোল।

ছিলেন একজন সন্ত। হরিদ্বারে তাঁর আশ্রম। বিরাট ব্যাপার। কয়েক শো কোটি টাকার সম্পত্তি। ইনকামট্যাক্সওয়ালারা শুধু খেটে-খাওয়া মানুষদেরই, সে চাকুরিজীবীই হোক বা পেশাদার বা ব্যবসায়ী, ক্যাঁক করে কলার চেপে ধরে পটকান দিতে চায়, আর মা বাবাদের দিকে চেয়েও দেখে না। এমন ব্যবসা আজকাল আর দ্বিতীয় নেই!

বয়স কত ওই বাবার?

তিনি গত হয়েছেন। শুনেছি দু-দুবার কায়াকল্প করেছিলেন।

কায়াকল্প! সেটা আবার কি জিনিস?

ওই পুনমুর্ষিকভবঃর উলটোটা আর কী! জীবন ফুরিয়ে গেলে কিছু ক্রিয়াকর্ম করে আবার ব্যাকগিয়ারে ফিরে গিয়ে ফিনসে শুরু করার ফর্মুলাকে বলে কায়াকল্প।

সত্যি?

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। এখানের অনেকেই বিশ্বাস করেন।

তাহলে এই ফরমূলার পেটেন্ট নিয়ে নেয় না কেন কেউ? আমেরিকানদের তো এত পয়সা কায়াকল্প থাকতেও তারা মরতে যায় কেন বুদ্ধু র মতন? থাকগে, সে কথা। তা সেই বাবার নাম দুধাহারী বাবা কেন?

বললামই তো, যে সেই বাবা দেহ রেখেছেন। আড়াইখানা আস্ত জীবনের বিস্তর গটওয়ালা গাড়ি পার করে দিয়ে। এখন তাঁর এক শিষ্য সেই আশ্রমের মালিক। মানে, তিনিই গুরুর নির্দেশে সেই সাম্রাজ্য ইনহেরিট করেছেন আর কী! বহু জায়গাতেই নাকি আছে দুধাহারীবাবার আশ্রম। শুধু হরিদ্বারেই নয়।

তাই?

হাঁ। আর সেই শিষ্য কিন্তু বাঙালি। কলকাতার এঞ্জিনিয়ার না চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কি না কি ছিলেন তিনি আগে। এখন ঘোর সন্ন্যাসী।

ঘোর সন্ন্যাসী মানে?

আসলে ঘোরতম বলাই উচিত ছিল। ঘোর কথাটা বেশি ব্যবহার করি বলেই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল।

দুধাহারী মানে কি?

ওরিজিন্যাল বাবা দুধ খেয়ে থাকতেন। ওঁদের আশ্রমে গেলেই এখনও জনগণকে ঘোল বা মাঠ খাওয়ান ওঁরা বিনি-পয়সাতে। আর গণ্যমান্যদের দুধ। অনেক গরু আছে আশ্রমের। স আশ্রমেরই গরু আছে।

আশ্রমের মধ্যেই গরু থাকে?

চারণ শুধোল।

পাটন বলল, তা থাকে কিছু। তবে তারা দু-পেয়ে গরু। চারপেয়েদের জন্যে সব বড় আশ্রমের এক বা একাধিক অন্য নির্দিষ্ট জায়গা আছে। সেখান থেকে দুধ দুইয়ে নিয়ে আসা হয়। তবে হরিদ্বারে দুধাহারী বাবার আশ্রমের এলাকা বিরাট। সে আশ্রমের ভিতরেও থাকতে পারে গরু। ঠিক জানি না। মনে হয়, থাকে। গরুদের দেখভাল করার জন্যে বহুত লোকও আছে।

দুগ্ধপায়ী বাবা না হয়ে দুধাহারী নাম কেন?

চারণ শুধোল।

পাটন হেসে বলল, আমি তো নাম শোনা পর্যন্তই সেই কথাই ভাবি। আরও ভাবি, আমি হলে, দুধাহারী না হয়ে স্তন্যপায়ী নাম নিতাম।

চারণ বলল, আমরা সকলেই তো স্তন্যপায়ী। মানুষ মাত্রই তো স্তন্যপায়ী।

পাটন বলল, সে তো মাতৃস্তন্য। আমি আশ্রম করলে মেলা সুন্দরী শিষ্যা জুটাতাম। তারপর স্তন্যপানের অসুবিধা বা অভাব থাকত কি? নিতান্ত মাথা-মোটা না হলে কেউ দূধাহারী হয়?

হেসে উঠল চারণ, পাটনের কথাতে।

বলল, তুমি এক নম্বরের বাঁদর।

বাঁদরের ছেলে কি বাঘ হবে স্যার? আমার পেডিগ্রি তো আপনার জানাই। বাঁদর নাচানোই তো আপনার পেশা ছিল।

তোমার ভোঁদাইবাবা না গাড্ডুবাবা সত্যি কোথায় থাকেন বলো তো?

ওই নামে কোনও বাবা নেই। ও আমারই দেওয়া নাম। তবে তিনি থাকেন দেবপ্রয়াগে।

অনন্তানন্দ নামের এক বাবাও সেখানে থাকেন বলে শুনেছি, অনেকেরই কাছে।

তিনিই কি তোমার শুরু?

অনন্তানন্দও থাকেন। তবে আমি যাঁর কথা বলছি, তিনি থাকেন অন্যদিকে। তাঁকে আমি ভোঁদাইবাবা গাড্ডুবাবা ছাড়াও অন্য একটি নামেও ডাকি। অবশ্যই আড়ালে।

কি নামে?

মুখখিস্ত্যানন্দ বাবা।

মুখখিস্ত্যানন্দ বাবা মানে?

মানে, যিনি মুখ খিস্তি করেন।

সমাস নাকি?

আজ্ঞে না স্যার। সন্ধি। সুধীর চক্রবর্তী মশায়ের বইয়ে পড়েছিলাম। সুধীর চক্রবর্তী মশায় একজন ভার্সেটাইল মানুষ। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর ডিপার্টমেন্টাল হেড ছিলেন। চমৎকার প্রবন্ধ এবং রম্যরচনাকার। সংগীতজ্ঞ। সংগীত সমালোচক। অত্যন্তই গভীরতা গুণসম্পন্ন মানুষ। সুরসিকও বটেন। যদি গল্প উপন্যাস লিখতেন তবে ঔপন্যাসিক বা গল্পকার হিসেবে মোটা মোটা হরফে যাঁদের নাম বেরোয় বড় বড় কাগজের বিজ্ঞাপনে তাঁদের অনেকেই হাপিস হয়ে যেতেন। গুণপনার সঙ্গে এখন তো নাম-যশের কোনও কানেকশান নেই। আপনি জানেন নিশ্চয়ই!

মুখখিস্ত্যানন্দ বাবার কথা ওঁর কোনও বইয়েতে আছে?

সদর-মফস্বল। একটি অসাধারণ বই। আরও অনেক বাবার কথা আছে তাতে।

যেমন?

যেমন কম্বলনানন্দ বাবা। তদ্বিরানন্দ বাবা। অপ্রিয়সত্যানন্দ বাবা। ভ্রমণানন্দ বাবা। গুরু শব্দটির মানেও তো ওই বইয়েতেই প্রথম পড়েছিলাম। গু মানে অন্ধকার আর রু মানে আলো। যিনি অজ্ঞানকে অন্ধকার থেকে আলোর ইশারা দেন তিনিই হচ্ছেন গুরু। আপনি গুরু শব্দের মানে কি জানতেন আগে?

না। তা, সুধীরবাবুর ওই বইয়ের প্রকাশক কে?

প্রজ্ঞা।

পাবলিশারের নাম?

ইয়েস। স্থিতপ্রজ্ঞ যাদের নাম তাঁরা ছাড়া এমন ভাল বই আর কেই বা প্রকাশ করতে পারতেন?

ঠিকানা মনে আছে?

বিলক্ষণ আছে। সুধীর চক্রবর্তীর বই পড়ে কত কী শিখলাম, আর মারলাম আজ পর্যন্ত। আমি কি এমনই নিমকহারাম যে, তাঁর এমন বই-এর একটু প্রচারও করব না? প্রজ্ঞার ঠিকানা হচ্ছে ২০ নং, সুকিয়া স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০৯। আর সুধীরবাবুর ঠিকানা যদি চান, তাও দিতে পারি।

তাও দাও।

কাগজ আছে?

তা আছে।

দৃর্বুদ্ধিজীবী মাত্ররই পকেটে আর কিছু না থাক কাগজ কলম ঠিকই থাকে সর্বক্ষণ। লিখে নিন। আমি চিঠি দিয়েছিলাম ওঁকে তাই ঠিকানা জানি। এই দুনম্বরী দুনিয়াতে এমন পণ্ডিত, গুণী ও রসজ্ঞ ব্যক্তির কদর হয় না আর ব্যাঙ ব্যাঙাচিরা নেচে-কুঁদে বেড়াচ্ছে চড়কের গাজনের বাঘ সেজে। ছিঃ।

পাটনের ছিঃ আর ভীমগিরি মহারাজের ছেঃ রে মধ্যে বিশেষ তফাৎ দেখল না চারণ।

চারণ বলল, সত্যি বলছি পাটন, তোমার সম্বন্ধে আমার ধারণা অন্যরকম ছিল। তোমার মধ্যে যে এই মানুষটিও ছিল তা কল্পনারও বাইরে ছিল আমার।

আমার গুরু বলেন, সব বাঞ্চোতের মধ্যে একজন করে পৃথু ঘোষ থাকে। যার মধ্যে অনেকগুলো মানুষ।

সে আবার কে? পৃথু ঘোষ।

সে এক ফিকশানাল ক্যারেকটার। মাধুকরী উপন্যাসের একটি চরিত্র।

নায়ক নয়?

না। সেই উপন্যাসে কোনও একজন নায়ক নেই। প্রকৃতিই নায়ক। সব চরিত্রই নায়ক এবং নায়িকাও। কোনও একজন মানুষকেই নায়ক অথবা নায়িকা হওয়ার কৃতিত্ব দেননি লেখক। সে বইটিও পড়েননি আপনি নিশ্চয়ই।

নাঃ। বাংলা উপন্যাস-টুপন্যাস আজকাল পড়তে ইচ্ছে যায় না। নাইন্টি পার্সেন্টিই তো ট্র্যাশ।

বলল, চারণ।

বাঃ। যাচাই করার ধৈৰ্যটুকুও নেই। বাতিল করাই আপনার সহজ জয়। এক্স-পার্টে জাজমেন্ট। শোভা দে কি সাহিত্য?

মনে মনে চারণ বলল, কিই-বা পড়েছি আর করেছি। এতগুলো বছর তো তোমার বাবার মতন অশিক্ষিত পয়সাওয়ালাদের চরিয়েই কাটিয়ে দিলাম। বৃথা, বৃথা, বৃথা। তারপর সুধীর চক্রবর্তীর ঠিকানাটি লিখে নিল, রামচন্দ্র মুখার্জি লেন, কৃষ্ণনগর, নদীয়া, পিনকোড ৭৪১১০১, পঃ বঃ।

খুব কি ঘুম পেয়েছে আপনার?

পাটন বলল, একটু পরে।

না তো!

আমি কিন্তু আর কথা বলব না। আমার গাঁজার অমন রমরমে নেশাটাই মাটি হল। সব কনসেনট্রেশনই নষ্ট হল। কিন্তু আপনি হোটেলে ফিরবেন না? রাতে ঘুমাবেন না নাকি?

নাঃ। ভাবছি কাল সকালেই ফিরব একেবারে। একটা রাত কাটিয়েই দেখি না বাইরে। তারপর তোমাদের আশ্রমে যদি নিয়ে যাও তো তোমার সঙ্গেই চলে যাব।

যাবেন? খুবই কষ্ট করে থাকতে হবে কিন্তু। গুহার পাথরের মেঝেতে এক কম্বল বিছিয়ে শোওয়া আর গায়ে আর এক কম্বল। ধুনী জ্বলবে অবশ্য। পারবেন কি স্যার? শীত তো এখনও পড়েইনি। সবে কলির সন্ধে।

তারপর বলল, তার উপরে মুখখিস্ত্যানন্দর খিস্তি? পারবেন তত সহ্য করতে?

তা, তুমি পেরে থাকতে পারলে, আমিও পারব।

গা জ্বালা করবে কিন্তু। অপমানে, মনে হবে, নীচের গঙ্গা বা অলকানন্দাতে ঝাঁপ দিয়ে ইহলীলা ঘোচান। এরকম একটা বদমেজাজি রক্তখেকো মানুষ আমি আর দেখিনি।

এতই যদি অপছন্দ তাহলে থাকো কেন?

সেইটাই তো বুঝি না। মানুষটার অন্তরটা ওয়েসিস আর বাইরেটা কাঁটা-ঝোঁপ, ক্যাকটাস।

বলল পাটন।

ঠিক আছে। এখন আর কথা নয়। ভাবুন। ভাবনাই ধ্যান। নৈশব্দ্যর চেয়ে বড় শব্দময়তা আর কিছুই হয় না। বাইরে থেকে দেখে যখন মনে হবে আপনি নীরব তখন আপনার মাথার মধ্যে যজ্ঞিবাড়ির কড়ায় ফুটন্ত তেলের মতন তরল ভাবনা ফুটবে। আমরা এই জীবনে অপ্রয়োজনীয় কথা বলে বড় বেশি সময় নষ্ট করি। যত কম কথা বলা যায়, মানুষের চিন্তা শক্তি ততই বাড়ে। আমার গুরু বলেন।

তাই?

ইয়েস।

বলেই বলল, চলুন একটু আড়াল খুঁজে বসা যাক। হাওয়াটা বরফের তীরের মতন খোঁচাচ্ছে।

তোমার জামাকাপড়ও তো দেখছি কিছু নেই। শীত করে না?

নাঃ। শরীরের সব অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিতে হবে। এক মারাঠি সন্ত ছিলেন, সন্ত তুকারাম…

শুনেছি।

কার কাছে?

ভীমগিরি মহরাজের কাছে।

তিনি কে?

ধিয়ানগিরি মহারাজের চেলা।

বাবাঃ! আপনি দেখি আসামাত্রই through proper channel হাঁটাহাটি শুরু করেছেন।

তা কী আর করা যাবে! একটা কথা মনে হল। তোমাদের আশ্রমে গেলে আমি খাব কি? আমাকে খেতে দেবে কেন তোমরা?

আবার কেন? মোটা মাল দেবেন তাই। আপনার মতন শাঁসালো হঠাৎ-বৈরাগি পেলে ছেড়ে দেবে এমন নিস্পৃহ সাধু কি আছেন?

সাধু-সন্তদের নিয়ে এরকম ইয়ার্কি মারা তো ঠিক নয়।

সকলেই কি আর ফেরেরবাজ! সাচ্চাও বহুতই আছেন। Exception proves the rule। তবে অধিকাংশই আমার মতন সাধু।

মাধুকরী করে খেতে পারব না? শুনেছি, সাধুরা সবাই মাধুকরী করেই খান।

মাধুকরী শব্দটির মানে জানেন কি?

কে না জানে!

অত সোজা নয় মানেটা। সকলেই ভাবেন যে, জানেন।

বলেই, পাটন সিঁড়ি থেকে উঠে ঐ রামজির চাতালের উলটোদিকে একটি সরু চড়াই-এর দিকেই এগোতে এগোতে বলল, সুধীরবাবুর ওই সদর-মফস্বল বইয়েতে মাধুকরীর কথাও আছে।

কি কথা?

চলুন। ওখানে ধুনীর পাশে বসেই বলব।

সেই চড়াই উঠেই দেখা গেল গাছ নেই বটে কিন্তু একটি পাঁচিলের আড়ালে একটা চাতাল। এখানে রামজির মূর্তি নয়, মহাদেবের মূর্তি আছে ছোট মন্দিরে। ধুনীর চারপাশে নানা ধরনের সাধু সন্ত বসেছিলেন। একজনই শুধু কথা বলছিলেন। খুবই নিচু স্বরে। এক জটাজুটসম্বলিত সাধুর সঙ্গে। সেই সাধুর দাড়িগোঁফের অবস্থাও তাঁর দেহাতি কম্বলটিরই মতন। কতদিন যে ধোওয়া হয়নি, কে জানে। সংসার-বৈরাগ্যের সঙ্গে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিরোধ থাকাটা খুব জরুরি কি? কে জানে? ভাবছিল, চারণ।

অন্যেরা সকলেই হয়তো নিজ নিজ নিজৌষধির গুণেই মৌনী হয়ে আছেন। নিমীলিত অথবা অর্ধনিমীলিত চোখ। যাঁদের চোখ খোেলা আছে সেই সব অধিকারীর চোখ ঘোরতর রক্তবর্ণ। চারণের গা গুলিয়ে উঠল ওই সব দাড়ি-গোঁফ এবং কম্বলে যে কত রোগের অদৃশ্য জীবাণু এবং কত হাজার ছারপোকা আছে তা ঈশ্বরই জানেন। কেন জানে না, হঠাৎই ছারপোকার বৈজ্ঞানিক নামটা মনে পড়ে গেল ওর। হেটোরোপটেরা। তারপরই মনে হল যে, বৈজ্ঞানিক নাম জানলেও ছারপোকার কামড়ে পশ্চাৎদেশ-এ যতখানি জ্বলন হবে, অবশ্য না জানলেও তাইই হবে।

ছিলিমটা পায়ের কাছে নামিয়ে তার হাইওয়াইয়ান চঞ্চল-পরা খালি পা দুটি আগুনের দিকে একটু এগিয়ে দিয়ে পাটন বলল, একটা মজার গল্প বলেছেন সুধীরবাবু তাঁর বইয়ে, মাধুকরী সম্পর্কে।

বলোই না শুনি। চারণ বলল।

সুধীরবাবুর মতে, গিরি একটা পার্সী প্রত্যয়। আপনি যে সন্ন্যাসীগিরি করে মাধুকরী করে খাবেন বলে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তার আগে একটু ভাবনা-চিন্তা করবেন। বাবুগিরি, মিস্ত্রীগিরি, কুলিগিরির সঙ্গে সন্ন্যাসীগিরি শব্দটি কি আদৌ মানানসই? তা ছাড়া, সাচ্চা সাধুও বেশি দেখতে পাবেন না। সাচ্চা যাঁরা, তাঁরা মিরগেল মাছেরই মতন। শান্ত কালো জলের গহিনে তাঁরা কাদার মধ্যে থাকেন। জলের উপরিভাগের স্তরে অথবা আমাদের দৃশ্যমান সমাজে তাঁদের চিহ্নবাহী বুড়বুড়িটুকুই তল থেকে উঠে বুঝিয়ে দেয় যে তাঁরা আছেন।

মাধুকরীর কথা বলছিলে যে!

হ্যাঁ। বলি। গাঁজা আমার জ্ঞান গুলিয়ে দিয়েছে। সদর মফস্বলে সুধীরবাবু বলছেন যে গেরুয়া হল একটা ইন্টারন্যাশানাল পাসপোর্ট আর কমণ্ডলু হল পরজীবী পরিশ্রমহীন জীবনের নিশ্চিন্ত আশ্রয়।

এটা কি তোমারও মত পাটন?

আমি কে এসেছি মাকড়া? আমার মতটা ইরেলিভেন্ট।

কমণ্ডলু অত্যন্তই সর্বনেশে বস্তু।

কেন?

যে একবার কমণ্ডলু থেকে খাওয়ার অভ্যেস করেছে, তাকে আর জীবনে কিছুই করে খেতে হবে। কমল বলতে আমরা বোঝাই পেতলের বা তামার ছোট্ট একটি জিনিস। কিন্তু সাধুদের কমণ্ডলু কাঠের তৈরি হয়। অনেকই বড়। আর সেইটেই হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে সাধুরা মাধুকরীতে বেরোন। তারই মধ্যে নানান খাওয়ার জিনিস তুলে দেন গৃহীরা। মাধুকরী করে খাওয়া আর ভিক্ষা করে খাওয়া এক নয়। সন্ন্যাসীরা ভিক্ষা চান না। ভিক্ষা চাইতে তাদের ইগোতে বাধে।

আহা। তুমি যে দেখি আমাদের অনন্ত বিশ্বাসের মতন বললে। কথা বলতে বলতে দেড় মিনিট বাদে বাদে বলেন, ঘঁা। কী যেন বলছিলুম? মাধুকরীর গল্পটা শেষই করো না।

একদিন এক সাধু, কমণ্ডলু হাতে গ্রীষ্মদুপুরের নির্জন পথ বেয়ে চলেছেন। এক মোটা-সোটা শেঠ গিন্নী শেঠানি…

শেঠানি মাত্রই যে মোটা হন না এটা তোমার জানা উচিত। বহুত শেঠ-শেঠানি দেখেছি আমি। এই সব Wrong notions থেকে জনগণকে মুক্ত কর।

জনগণের মুক্তি তো রাজনৈতিক নেতা আর আমেরিকান এনআরআই-দেরই হাতে। আমার কি শক্তি আছে যে ভুবনের ভার হাতে নেব? যাকগে। শেঠানি তো সাধুকে ডেকে পুরী-হালুয়া ইত্যাদি ইত্যাদিতে কমণ্ডলু ভরে দিলেন। পুণ্যপ্রত্যাশী তিনি বাকিটা সম্ভবত রাখলেন কোনও আনমনা গরু বা একমনা ষাঁড়ের জন্যে।

তারপর?

তারপর সাধুর তো দিল খুশ। ভাবলেন, আজ দুপুরের খাওয়াটা জব্বর হবে। যা গরম! আর-একবার চানটা করেই নেওয়া যাক।

এই মনস্থ করে পথপাশের এক সুন্দর টলটলে দীঘির সামনে দাঁড়ালেন। এদিকে সুস্বাদু খাবার ভর্তি কমণ্ডলু নিয়ে কি করেন? মাটিতে রাখলে কাককুকুরে সাবড়ে দেবে। পাখ-পাখালিও ছোঁ মারতে পারে। তাই তিনি বুদ্ধি করে দীঘির পাশের একটি গাছের ডালে, যত উঁচুতে তাঁর হাত পৌঁছয় আর কী, কমণ্ডলুটি ঝুলিয়ে দিলেন। পাতাপুতার জন্যে পথচারীদের চোখের আড়ালে থাকল আর দ্বিপদ-চতুষ্পদেরও নাগালের বাইরে থাকল।

তারপর?

তারপর ধরাচূড়া খুলে ফেলে নাগা-সন্ন্যাসী হয়ে অনেকক্ষণ জলক্রীড়া করলেন। তারপর ব্রীড়াবনত বধুর মতন সলজ্জ জামাকাপড় পরে নিলেন।

সলজ্জে কেন?

একটা মদনটাকি পাকি চোখ টেইরে দেইকতেচেল তেনাকে দীঘির পাশের পার থেইকি। আঙ্গাপাঙ্গা হয়ে চান করছিলেন তো। লজ্জা পাওয়া স্বাবাবিক।

চারণের চোখের সামনে একজন শালপ্রাংশু দামড়া সন্নিসীর ন্যাংটো রূপ ভেসে উঠতেই গা গুলিয়ে উঠল। নারীরা কোন চোখে দেখেন তা বলতে পারবে না, কিন্তু রোমশ পুরুষের নগ্নরূপ সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম প্রধান কুৎসিৎ দৃশ্য।

ব্যোম শংকর।

হঠাৎ বলে উঠল পাটন।

ব্যোম শংকর।

রিফ্লেক্স অ্যাকশানে বলে উঠল চারণ।

চান সেরে, পরিধেয় পরিধান করে, খুশি-খুশি মনে যখন কমণ্ডলু যে-গাছে ঝোলানো ছিল সে গাছের দিকে ফিরলেন সাধুজী, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল। দেখলেন, একটা উট, চার পা মাটিতে জম্পেস করে গেঁথে, জমিয়ে পুরী-হালুয়া খাচ্ছে। খাচ্ছে মানে, ততক্ষণে খেয়ে সাবড়ে দিয়েছে।

বল কি? উট?

উট কোথা থেকে এল?

চারণ জিগ্যেস করল অবিশ্বাসের গলাতে। গল্পের গরু গাছে চড়ে বলে শুনেছি কিন্তু গল্পের উটও যে না-চড়েও মজা মারে এমন তো শুনিনি।

পারে। বিলক্ষণ পারে।

পাটন বলল।

উটটা কি তোমারই কবি-কল্পনা?

আজ্ঞে না স্যার।

উটটা সুধীরবাবুর বইয়েতেই ছেল। তবে আমি একটু icing দিয়েছি মাত্র। কেক যদি ভাল baked হয় তবে তার উপরে icing না থাকলে কেকেরই বে-ইজ্জৎ। যে কোনও ভাল গল্প পুনবার বলার সময়ে তা যদি পল্লবিত না হয়, তবে গুণী ওরিজিনাল গল্পকারের প্রতি অচ্ছেদ্ধা প্রদর্শন করা হয়।

তারপর?

দাঁড়ান, ছিলিমটা ভরে নিই।

ছিলিম না ভরেই তো দিব্বি চালাচ্ছ।

সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের দেশে বিদেশেতে পড়েছিলাম, স্বপ্নেই যখন পোলাও রাঁধবে (নিশ্চয়ই বিরিয়ানির কথাই বলেছিলেন। আহা কতদিন খাই না গো! কেচ্ছাসাধনে মুক্তি সে মুক্তি আমার লয়।) তখন ঘি ঢালতে কঞ্জুষী করবে কেন? সুধীরবাবুর গল্প মেরেই যখন চালাচ্ছি তখন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশতই সে সব একটু পল্লবিত করছি মাত্র।

তারপর বলল, উটকে আমদানি করলে কোত্থেকে?

আ মলো যা। আমি আনতে যাব কোন দুঃখে। সে তো গল্পতেই চরছিল। উটটা ধোপার। জায়গাটা যে রাজস্থান! সেখানে উটেরা গাধার কাজ করে আর সেখানের মানুষেরা যখন কলকাতাতে বাণিজ্য করতে আসে তখন বাঙালিরা তাদের গাধার কাজ করে। অর্থাৎ ভার বয়। তা উটের মালিক তো কাপড় শুকুতে-দেওয়া বাঁশের খোটা হাতে করে দৌড়ে এসে উটকে দে-দমাদম। দে-দমাদ্দম। সন্ন্যাসীর খাবার খেয়ে ফেলে এমন অধার্মিক উট!

তারপর?

তারপর সাধুজি ঐ নৃশংস প্রহার দেখে দৌড়ে এসে বললেন, করো কি হে, করো কি? অবোলা জীব, না হয় না জেনে অপরাধ করেই ফেলেছে, তাই বলে, তুমি কি তাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলবে? আমার মাধুকরীর খাবারও না হয় ও খেলেই। কেষ্টর জীবই তো৷

ধোপা কাঁদতে কাঁদতে বলল, মারছি আমি সে জন্যে নয় বাবাজি।

তবে কি জন্যে মারছ?

মারছি, কারণ আমি গরীব মানুষ, খেটে খাই। এই রোদের মধ্যে শীতে, গ্রীষ্মে ডাই-ডাই কাপড় কাচি। ওকে তো কিনেছিলাম আমার মোট বইবারই জন্যে। কিন্তু আজ যে ব্যাটা কমণ্ডলু থেকে খাওয়ার অভ্যেসটি রপ্ত করে ফেলল, আর কি কোনওদিন সে খেটে খাবে? কেষ্টর এই জীবটিও সাধুদেরই মতন আরামি, হারামি হয়ে গেল। আমার কি হবে এখন? হায়! হায়! হায়।

চারণ জোরে হেসে উঠল।

নিমীলিত ও অর্ধনিমীলিত কিছু রক্তবর্ণ আধ-ফোঁটা চোখ চারণের বিব্রত মুখে ল্যাসার বিম-এর মতন ঝলক -ঝলক আলো ফেলেই আবারও মুদিত হয়ে গেল।

পাটন আবারও কলকে ভরে নিয়ে টিকেতে আগুন দিয়ে এক জোর টান লাগাল তাতে।

মুখে বলল, ব্যোম শংকর।

চারণও আবার রিফ্লেক্স অ্যাকশানে বলে ফেলল, ব্যোওওম শংকর।

ধ্বনি হলে প্রতিধ্বনি তো হতেই হয়! সাবাবিক।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress