Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চাঁদ সদাগর || Shamsur Rahman

চাঁদ সদাগর || Shamsur Rahman

আমি কি এখন সত্যি বেঁচে আছি? না কি জীবন্মৃত
পড়ে আছি বিড়ম্বিত মাস্তুলের মতো। বণিকের
খ্যাতি আছে কিছু টিকে, অথচ যাই না বাণিজ্যেতে
কতকাল, কতকাল সপ্তডিঙ্গা ভাসে না তরঙ্গে
সমুদ্রের জ্বলজ্বলে প্রাসাদের মতো হা আমার
মধুকর সেই কবে গেছে ডুবে কালীদহে। শুধু
আমি একা মাঝিমাল্লাহীন নির্বান্ধব খরস্রোতে
ভেসে ভেসে জলচর প্রাণীর লোভের বিভীষিকা
নিয়ত প্রত্যক্ষ করে পৌঁছে গেছি তীরে, কী বিহ্বল
ঠেকিয়ে মাটিতে মাথা ঘুরেছি শ্মশানের কানি পরে।
বিপথে, অচেনা লোকালয়ে সম্বলহীন পথে
একমুঠো তণ্ডুলের জন্যে কাঠুরের সঙ্গে কাঠ
কেটেছি গহন বনে ঝরিয়ে মাথার ঘাম পায়ে,
পথকে করেছি ঘর। কতবার চ্যাঙড়ামুড়ি কানি
নানা ছলে কেড়ে নিয়ে আমার ঘর্মাক্ত দিনান্তের
কষ্টার্জিত অন্ন খলখল ব্যাপক উঠেছে হেসে,
ভেবেছে অভুক্ত আমি ক্ষুধার করাতে চেরা, ভয়
পেয়ে হবো নতজানু, ঘটে তার ঠেকাব আমার।
অবসন্ন মাথা দীন

ভিক্ষুকের মতো। তা হবার
নয় কোনো দিন; সত্য চাঁদ সদাগর যুবা নয়
আর, আগেকার উদ্দামতা শিরায় করে না খেলা
যখন তখন, এখন সে হন্তদীপ্তি, হীনবল,
সেই কবে অস্তমিত মহাজ্ঞান। একটি কি দুটি
নয়, ছয় ছ’টি ছেলে কালবিষে হয়ে গেছে নীল,
আমার সপ্তম পুত্র লখিন্দর, সে-ও সর্পাঘাতে
নেউল, ময়ূরময় সুরক্ষিত সাঁতালি পর্বতে
লোহার বাসর ঘরে কেমন মৃত্যুর মতো স্তব্ধ
হয়ে গেল, গাঙ্গুড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে বেলা অবেলায়
কলার মান্দাসে ভাসে লখিন্দর, বেহুলা বহুড়ী।
জীয়ন মন্ত্রের খোঁজে দয়িতের গলিত শরীর
আঁকড়ে তরঙ্গে নাচে সায়বেণে-নন্দিনী নাচুনি।
রাহুগ্রস্ত ঘর ছেড়ে
উঠোনে বেরিয়ে উন্মাদিনী
সনকা লুটিয়ে পড়ে পথের ধুলায় বারংবার।
‘কোথায় আমার লেখা’ বলে নিজেরই পাঁজরে করে
নির্দয় আঘাত আর নিঃসন্তার হরিণীর মতো
ঘোরে কত জনহীন আদাড়ে বাদাড়ে। আমি নিজে
বিকৃত মস্তিষ্ক এক জেদী, একরোখা লোক বলে
চম্পক নগরে পরিচিত আজ। হায়, দীপ্র, প্রিয়
নগরী আমার, একি দশা দেখি আজকে তোমার।
কেমন আন্ধার এলো নিষ্করুণ দশদিক ব্যেপে
চম্পক নগরে। সূর্যাস্তের পরে গেরস্ত রাখে না।

পা তার নিজস্ব গৃহকোণ ছাড়া অন্য কোনোখানে
আজ, আর পথে পথে বঙ্গদাড়া, বিড়ঙ্গিনী আর
তক্ষক, শঙ্কর আর মহিজঙ্গ সাপের বসতি।
ঘরে ঘরে, এমনকি প্রত্যেকের মগজের কোষে
কোষে দোলে ফণা, নিত্য দিন-দুপুরেই
পথিক লুণ্ঠিত হয় জনাকীর্ণ চৌরাস্তায় আর
প্রহরী নিশ্চল দিকচিহ্ন শুধু। এখন বাছে না
ঠগ কেউ, পাছে গাঁ উজাড় হয়ে যায়, উপরন্তু
নারীর শ্লীলতাহানি করে না অবাক কারুকেই।
সৎ অসতের ভেদাভেদ লুপ্ত, মিথ্যার কিরীট
বড় বেশি ঝলসিত দিকে দিকে, লাঞ্ছিত, উদভ্রান্ত
সত্য গেছে বনবাসে। বিদ্বানেরা ক্লিন্ন ভিক্ষাজীবী,
অতিশয় কৃপালোভী প্রতাপশালীর। নব্য কত
ক্রোড়পতি করে ক্রয় সাফল্যের অন্দর বাগান,
দরিদ্র অধিকতর দরিদ্র হবার ফাঁদে পড়ে
কাঁদে, করে করাঘাত দিনরাত সন্ত্রস্ত কপালে,
নীতির বালাই নেই, ঔদার্য, মহত্ত্ব ইত্যাদির
কানাকড়ি মূল্য নেই আর। আদর্শ বিনষ্ট ফল
যেন, নর্দমায় যাচ্ছে ভেসে; মতিভ্রম স্ফীতোদর
সফল বণিক, নগ্ন ক্ষমতার লড়াই চৌদিকে
উন্মুখের ভয়ংকর উৎসবের মতো আর দ্বৈত
শাসনের খাঁড়া ঝোলে দিনরাত মাথার ওপরে।
আন্ধার প্রথার কাছে আনুগত্য করেছে স্বীকার
স্বেচ্ছায় সবাই প্রায়, অদ্ভুত আচার, কুসংস্কার
মেলেছে অদৃশ্য ছাতা সুবিশাল, শিবিরে শিবিরে
ভীষণ বিভক্ত আজ বিপন্ন মানুষ।

মোদ্দা কথা,
চম্পক নগরে সর্বনাশ পরাক্রান্ত জোতদার
আর আমি ধূলিম্লান পরাস্ত, বিফল ছন্নছাড়া
আন্ধার ভাঁটার টানে সে কোথায় উধাও আমার
সপ্তডিঙ্গা মধুকর, বুকের মানিক লখিন্দর।
আমি একা ডিঙির মতন ভাসি দুঃখের সাগরে,
এই আমি চন্দ্রধর বণিক আমারই রিক্ত ছায়া।
কোথায় নর্তকী আর কোথায় বিদ্যুৎ বাজিকর?
প্রকৃতই পরাভূত আমি? কপালে গ্লানির টিকা
বয়ে নিয়ে সারাক্ষণ কাটাব জীবন অচেতন
কীটপতঙ্গের মতো? যদিও ধ্বংসের পদচ্ছাপ
আমার জীবন জুড়ে রয়েছে করাল, তবু আমি
নিজেকে পরাস্ত বলে ভাবতে পারি না কিছুতেই।
মতিচ্ছন্নতায় অলৌকিক চালচিত্র দেখে ভাবি
জীবন সনকা তবু সনকাও নয়, দরিয়ায়
মধুকর, তবু মধুকরও নয়। তবে কি জীবন
শুধু ধু-ধু সমুদ্দুরে পাড়ি দেওয়া? কালবৈশাখীর
ঝড়ে কাষ্ঠখণ্ড ধরে ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে-যাওয়া?
বুঝি তাই আজও আমি সাঁতালি পর্বতে ঘুরে ঘুরে
মধ্যরাতে পাঁড় মাতালের মতো আরো এক ভাঁড়
মদিরার স্বাদ পেতে চাই খাদের কিনারে ব’সে।
জীবন জটিল এক

অরণ্যের মতো জায়মান,
কখনো ভাবিনি আগে। প্রৌঢ়ত্বের তামাটে প্রহরে
কত কথা মনে পড়ে। স্মৃতিও জটিল বড়, জানি
যা ঘটে এবং যা ঘটবে ভবিষ্যতে, সবকিছু
মানুষের চৈতন্যের অন্তর্গত, অবচেতনের
গোধূলিতে লীলায়িত ক্ষণে ক্ষণে। সেই যে প্রথম
গাঙ্গুড়ের জলে আমি ভাসিয়েছিলাম সপ্তডিঙা,
সনকার আগে যার সঙ্গে গোপনে করেছি কেলি,
তার স্তনচূড়া ত্রিবলির মদির চমক আর
কারুকাজ-খচিত বাসর ঘরে সনকার কালো
চোখের প্রথম চাওয়া, আলিঙ্গন, সলজ্জ চুম্বন,
গৃহকোণে পড়ে থাকা সুবর্ণ চিরুনি, উষাকালে
ভোরের আলোর মতো নবজাতকের আগমনী
চিৎকার এবং কালীদহে সঙ্গীদের বিপন্নতা,
গহিনে তলিয়ে যাওয়া, বিষধর সাপের অব্যর্থ
ছোবলে অকালমৃত পুত্রের শরীর, অবেলায়
গাঙ্গুড়ের জলে ভাসমান ভেলা এবং ভাঁড়ারে
খাদ্যান্বেষী মুষিকের নৈশ চঞ্চলতা, নিষ্ঠাবান,
সেবাপরায়ণ ন্যাড়া, দুঃখের দিনের সহচর,
তার পদ্ধতি, কিংবা বাণিজ্যেতে লভ্য চমৎকার
মুদ্রার ঝংকার, নরসুন্দরের গোঁফ, দূরাগত
ঝঞ্ঝাহত নাবিকের রহস্য-কাহিনী, মধ্যরাতে
শোনা কারো কণ্ঠস্বর-সবই তো আমাতে অন্তর্গূঢ়।
যা দেখি এবং যা দেখি না হয়তোবা অন্তঃস্তলে
করি অনুভব, তার মিশেলে যা গড়ে ওঠে, তাকে,
হ্যাঁ, তাকেই তো স্মৃতি বলে জানি। স্বরণ নাছোড় বড়;
সে তবে কোমল কোনো স্পর্শ লেগেছিল ত্বকে, সেই
সুখ আজও সঞ্চারিত হয় অনিবার্য মাঝে মাঝে
অভিজ্ঞ শিরায় আর যত স্বর শুনেছি একদা,
ওরা বেজে ওঠে শূন্য প্রহরের প্রহরে, সে গুঞ্জন
দেয় না আমাকে একা থাকতে কখনো। কিংবা যত
সুন্দর কুৎসিত দৃশ্য করেছি প্রত্যক্ষ, তার ছায়া
খুব ঘন হয়ে করে বসবাস আমার ভেতরে;
হঠাৎ ঢাকের শব্দ শুনি যেন, নাকি আমি
মদ্যপান-জনিত বিভ্রমে শুনি তীব্র বিস্ফোরণ-
মূলক আওয়াজ শুধু। এই তো সমুদ্র দিল ডাক
বাজিয়ে তরঙ্গশাঁখ; এ কোনো নিপুণ জাদুকর
বানায় নতুন ডিঙা সারি সারি চোখের পলকে?
কী এক আক্রোশে আজ
আমার জীবন অকস্মাৎ
প্রচণ্ড চিৎকার হয়ে ফেটে পড়তে চায়, পুনরায়
কালীদহে যেতে চায় এ জীর্ণ শরীর ভয়াবহ
সর্পকুণ্ডলীর মতো ঘূর্ণিজলে লড়বার খর
আকাঙ্ক্ষায়; জরার তমসা ঘিরে ধরেছে আমাকে;
মাথায় কালোর চেয়ে রৌপ্যবর্ণ কেশই বেশি আর
চক্ষুদ্বয় ছানিগ্রস্ত দীপ যেন, সাগ্রহে তাকাই,
অথচ দেখি না স্পষ্ট কিছু, শুধু দেখি অমঙ্গল
এসেছে ঘনিয়ে চতুর্দিকে এই চম্পক নগরে।
যেন এ নগরী আজ সম্পূর্ণ অচেনা পরদেশ,
যেখানে বিলাপ ছাড়া অন্য কোনো ধ্বনি নেই আর,
যেখানে নাগিনী ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী নেই, আর,
যেখানে বরণযোগ্য বীর নেই, কবির অভীষ্ট
কোনো জয়গাথা নেই, কাকতাড়ুয়ার মূর্তি ছাড়া
অন্য কোনো মূর্তি নেই, প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে প্রেত ছাড়া
অন্য কোনো বাসিন্দার আনাগোনা নেই। তবু আমি
বাঁচার উপায় নেই জেনেও এখনও আছি বেঁচে
হিন্তাল কাঠের কারুকাজ-খচিত লাঠিতে ভর
দিয়ে আর সমুদ্দুরে পাড়ি দেবার দুর্মর স্বপ্নে
সর্বদা বিভোর হয়ে। আর এই শ্মশানের কালো
ভস্মময় মাটিতে উবুড়-হয়ে-থাকা কলসের
মতো থাকব না পড়ে এক কোণে, এই তো আবার
আমাতে প্রত্যক্ষ করি বলিয়ান নবীন উত্থান।
উধাও বাতের ব্যথা, স্বচ্ছ দৃষ্টি, রক্তের ভেতরে
কেমন চাঞ্চল্য জাগে, যেন এক সম্পন্ন তরুণ
সদাগার চকিতে আমার সঙ্গে করেছে বদল
আপন অস্তিত্ব তার। এভাবেই কখনো কখনো
অন্য কেউ, দূরবর্তী কেউ এসে এসে যায় আমাদের
মধ্যে আর আমরা তখন তার মতো আচরণে
কিছুটা অভ্যস্ত হই, তার শক্তি, শৌর্য করে ভর
আমার ওপর পেয়ে যাই ভিন্ন দ্বিতীয় জীবন
বস্তুত অস্থায়ীভাবে। তারপর দক্ষ অভিনেতা
যেমন যাত্রার বেশভূষা ছেড়ে ফিরে আসে ফের
একান্ত আপন অবয়বে, তেমনি আমাদেরও ঘটে
করুণ প্রত্যাবর্তন; রাত্রির রুপালি স্বপ্ন মুছে
যায় অকস্মাৎ রূঢ় দিনে। অপার বিস্ময়, আজও
সাপের স্পর্শের মতো চমকিত অস্তিত্ব আমার।
যতদিন হিন্তাল কাঠের
লাঠি আছে হাতে, আছে
ধমনীতে পৌরুষের কিছু তেজ, যতদিন ঠোঁটে
আমার মুহূর্তগুলি ঈষৎ স্পন্দিত হবে, চোখে
নিমেষে উঠবে ভেসে কোনো শোভাযাত্রার মশাল,
করব না আন্ধারের বশ্যতা স্বীকার ততদিন,
যতই দেখাক ভয় একশীর্ষ, বহুশীর্ষ নাগ,
ভিটায় গজাক পরগাছা বারংবার, পুনরায়
ডিঙার বহর ডোবে ডুবুক ডহরে শতবার,
গাঙ্গুড়ের জলে ফের যাক ভেসে লক্ষ লখিন্দর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *