পর্ব – ৪
ঘরশোভা দেবীর তিন মেয়ের মধ্যে আলোময়ী আর দিব্যময়ী থাকে দুরে, একজন জলপাইগুড়িতে, আর একজন কাটিহারে, পুণ্যময়ীই কাছে থাকে, সে আসে মাঝে-মাঝে।
এল সে দিন।
ভাজেরা ব্যস্ত হল, ভাইপোবউরা তটস্থ হল, পুণ্যময়ী বলল, একখানা তসর মটকা কিছু দে দিকি কেউ, মার বিছানায় বসি একটু।
ঘরশোভা অনায়াসেই বললেন, থাক, থাক, আর মার বিছানায় বসতে হবে না, ওইখানেই আলগোছে বসো। তোমার বাড়িতে যা মেলেচ্ছয়ানা, চান না করলে শুন্ধু হওয়া দায়, হেঁসেলে মুরগি ওঠে, ছি ছি!
মেয়ে এতটুকু হয়ে বলে, কী করব বলল মা, নানা মুনির নানা মত, যৌথ সংসারে আমার কলম চলে না।
চালাতে জানলেই চলে পুণ্যি, ঘরশোভা দেবী তাঁর নিজস্ব মাজাঘষা খনখনে গলায় বলেন, কলমের জোর থাকা চাই। এই অ্যাতখানি বয়েস পর্যন্ত তুই শুধু ভূতের ব্যাগার খেটে মরলি, কলম চালাতে শিখলি না, ধিক তোকে। তার মানে কলমটা পাকাটির। যাক ওকথা যাক, কতদিন পরে এলি, এখন আর বসে বসে মায়ের পদসেবা করতে হবে না, ওইখানে টুলে বসে দুটো গপপো কর। আমার জামাই আছেন কেমন? তোর মেয়ে-জামাই ছেলেবউ নাতি-নাতনির খবর কী?
তা সে খবর দেয় পুণ্য, অনেকক্ষণ ধরেই দেয়। ঘরশোভার জামাইয়ের শরীরে এখন যে এক ডজন রোগ এসে আশ্রয় নিয়েছে, তার ফিরিস্তি দেয়, তার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কত জ্বালা, কীভাবে খাটতে খাটতে প্রাণ যায় তার, সে খবর দেয়, এবং ছেলের বউ কী পরিমাণ গতর কুঁড়ে আর বাপের বাড়ি ঘেঁষা, সে কথা বলে, সর্বশেষে নিজের বাত, অম্লশূল, রক্ত আমাশার খবরও দেয় বিশদ ভাবে।
ঘরশোভা বলেন, তোদের দুজনের তা হলে কিছুদিন হাওয়া বদল করা উচিত।
হাওয়া বদল?
পুণ্যময়ী ক্ষুব্ধ হাসি হাসে।
আমার হাওয়া বদল হবে সেই একেবারে সেখানে গিয়ে।
ঘরশোভা হাসেন, তবে আর কী, তাই ভাল, তাতে পয়সা খরচও নেই।…বউমারা সবাই মিলে এখানে বসে গুলতানি করছ কেন? বড় ননদ এসেছে, তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করো?
বউরা ঝটপট উঠে যায়।
পুণ্যময়ী কেমন যেন ঈর্ষার গলায় বলে, এত বড় বড় বউদের তুমি এইভাবে বললে মা? ভয় করল না তোমার?
ভয়?
ঘরশোভা বোতল ঝাঁকানোর মতো করে শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে একটু খাড়া করে নিয়ে বলেন, তুই যে অবাক করলি পুণ্যি, রেজো জগা পেনোর বউদের আমি ভয় করতে যাব? গলায় দিতে দড়ি জুটবে না আমার?
পুণ্যময়ী হতাশ গলায় বলে, কী জানি মা, আমার তো ছোট ঘোট জায়েদেরও ভয়, ওই পুঁচকে বউকেও ভয়!
ভয়টা কীসের? মারবে?
হাতে না মারুক, বাকিতে মারবে। ভয় অপমানের।
ঘরশোভা অক্লেশে নিজের পেটের মেয়েকেই বলেন, গলায় দড়ি তোমারই দেওয়া উচিত মা!
মেয়ে গভীরতর হতাশার নিশ্বাস ফেলে বলে, তুমি তো মা এই দালান সার করেছ, চুপিচুপি যে দুটো মনপ্রাণের কথা বলব, তার জো নেই। সব কথা বললে বুঝতে
ঘরশোভা দেবী আবার পানের কৌটো খুলে একটি পান গালে দিয়ে বলেন, দালান সার করেছি তো আমি বারো বচ্ছর, হঠাৎ নতুন করে শোক উথলে উঠল কেন? তুই যা বলবি, তা না বলতেই বুঝেছি আমি।
মেয়ে মাকে জানে, তার কথার ধরনও জানে, তবু মার ছেলেদের মতো একেবারে অভিমানশূন্য হতে পারে না।
ধরা গলায় বলে, আমার কথা বুঝতে তোমার দায় পড়েছে। মেয়েদের তো তুমি কোনওদিন দামি জিনিস মনে করো না। তোমার কাছে শুধু ছেলেরাই দামি।
শুধু আমার কাছে কেন? ঘরশোভা আত্মস্থভাবে বলেন, সমগ্র পৃথিবীর কাছেই। আইনের জোর দেখালে আর গলা তুলে ডাক ছেড়ে বললেই কি আর ভগবানের নিয়ম পালটে যাবে? তবে শুধু শুধু দালান তুলে আক্ষেপ করলি, তাই বলছি নতুন করে শোক উথলোন কেন?
পুণ্য কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, আমার আবার উথলোন! কোন জন্মে বিদেয় করে দিয়েছ, কদাচ আসি কুটুমের মতন
মেয়ে সন্তান তো কুটুমই, ঘরশোভা আবার ডাবর মুখে তুলে বলেন, কুটুমের ঘরের বউ তো বটেই।
তা জানি, কুটুম হয়েই আছি, তবে তোমার জামাই মাঝে মাঝে বলে, একটা কথা মাকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করো তো, তাই বলছি চুপিচুপি বলব কখন?
কী শুধোতে বলে জামাই? বুড়ির কত টাকা আছে?
মুচকি হেসে চাদর টেনে টেনে পা ঢাকেন ঘরশোভা।
টাকার কথা জানতে যাবার তার দরকার কী? পুণ্যময়ী আরও অভিমানভরে বলে, বলছিল বাবা যে তেজারতির কারবার করতেন, তার যা কিছু পাওনা-গণ্ডা সব শোধবোধ হয়েছিল? ভাইরা তো জানেও না বাবার এ ব্যবসা ছিল।
জামাই বা জানল কী করে তা তো জানি না, ঘরশোভা সেই তাঁর নিজস্ব ধারালো হাসিটুকু হেসে বলেন, শুনে তো অবাক হয়ে যাচ্ছি, যে কথা কাকপক্ষীতে জানত না, সে কথা জামাই জানে কোথা থেকে? সে যাক, জামাইকে বোলো, জামাই মানুষের ও নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। তোদের বাপ একটা বুদ্ধিমন্ত পুরুষ ছিলেন, দরকার হলে কি আর ছেলেদের বলে যেতেন না?
জামাইকে মাথা ঘামাতে বারণ করায় পুণ্যময়ীর কান ঝা ঝাঁ করে ওঠে। তবু কষ্টে আত্মসংবরণ করে বলে, বাবা আর বলে যেতে সময় পেলেন কখন মা?
কথাটা সত্যি, সময় একেবারেই পাননি জীবনবল্লভ, বাইরে থেকে ঘুরে এসেই একগ্লাস জল চাইলেন, সে জল আর খেতে তর সইল না, অজ্ঞান হয়ে পড়লেন, দিন তিনেক সেই অজ্ঞান অবস্থার মধ্যেই কাটিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।
পুণ্যময়ী সেটাই উল্লেখ করল।
ঘরশোভা কিন্তু তার জন্যে খুব কিছু একটা বিষণ্ণ হলেন না, বয়েসের শান পাথরে ঘষাই হতে হতে বোধ করি অনুভূতির সব ধারগুলো ক্ষয়ে যায়।
ঘরশোভা তাই কর্তার কথা উঠলেও মনমরা হন না। সমান তেজের সঙ্গে বললেন, তা তোমার বক্তব্যটা কী তাই বলো?
বক্তব্যটা আর কিছুই নয়, ও বলেছিল, মা যদি যেখানে যত কাগজপত্র মার আছে, সব একবার আমাকে দেখতে দেন, তা হলে বুঝতে পারি কোথাও কোনও পাওনা-গণ্ডা আছে কিনা।
ঘরশোভা শেষ পর্যন্ত সবটি শুনে তারপর পানের পিক ফেলে বলেন, তা জামাই এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন? তাঁর তো এতে কানাকড়িও লাভ নেই। টাকা উদ্ধার হলেই কি তিনি সে টাকার ভাগ পাবেন?
ভাগ পেয়ে আমাদের দরকার নেই মা, তোমার ভালর জন্যেই বলছি। নচেৎ বলবার তো ছিলই অনেক, এখন তো মেয়ে-ছেলে সমানভাবে বাপের বিষয় পায়, বলেছি কোনওদিন সে কথা? এ শুধু তোমার ভালর জন্যেই বলা।
আমার ভাল?
ঘরশোভা খনখনিয়ে হেসে ওঠেন, সেই রামপেসাদী গানে আছে না, ঢের ভাল করেছিস কালী, আর ভালতে কাজ নাই। এখন ভালয় ভালয় বিদায় দে মা, আলোয় আলোয় চলে যাই। তোর কথা শুনে সেই গানটা আমার মনে পড়ে গেল পুণ্য! জামাইকে বলিস আমি এখন ভালমন্দর বাইরে।
কিন্তু ঘরশোভা দেবী ভালমন্দর বাইরে চলে গেছেন বলে যে, সবাই তাই যাবে তা তো হয় না। পুণ্য আজ এসেছে তার স্বামীপুত্রের প্রেরণায়। ঘরশোভা দেবীর হাতে যে অনেক টাকা আছে, এবং বাক্সভর্তি গয়নাও আছে, তা সকলেরই জানা। নাতি-নাতনির বিয়েটিয়ের সময় একটু একটু দিয়েছেন বটে, কিন্তু প্রাণ খুলে নয়। দিয়েছেন আংটিটা, মাকড়িটা, তাবিজের ঝুমকোটা, আর গলার চিক, মাথার চিরুনি, এই পর্যন্ত। ভারী গয়না সব ভোলা আছে।
ঘরশোভা দেবীর ছেলেদের প্রতিপক্ষ ওদের ওই ভাগ্নেরা মাকে বলেছে, টের দিন তো সময় দিল বুড়ি, কিছুই করে উঠতে পারলে না মা, এখনও দেখো চেষ্টা করে। নইলে হঠাৎ কোনদিন বুড়ি ফুট করে পটল তুলবে আর তোমার ভাইয়েরা চাবি হাতিয়ে সব সরিয়ে ফেলে তবে তোমাদের খবর দেবে। তখন দেখবে সব ফকিকার!
তাই আজ পুণ্যময়ী চেষ্টা করতেই এসেছে।
তাই জামাইকে ঘরশোভার ঘোষণা বলে দেবার নির্দেশের পরও পুণ্যময়ী বলে, বুঝলাম তো সে কথা, কিন্তু তোমার সন্তানের ভালমন্দটুকু তো দেখবে তুমি? এই যে আমার ফুলটুসির বিয়ে আসছে, তোমার জামাইয়ের অবস্থাও জানো, তোমার কাছে তো কিছু ও আশা করে?
ঘরশোভা কিন্তু মেয়ের এই কাতরোক্তিতেও বিচলিত হন না, অবিচলিত গলাতেই বলেন, আমার অদেষ্টটাই এমনি তেঁতুলগোলা রে পুণ্য যে, আমার দিকের যে যেখানে আছে সবাইয়ের অবস্থা দুরবস্থা। জামাইকে বলিস, মেয়ের বিয়ে আপন অবস্থা মতোই দিতে হয়, শাশুড়ির ক্যাশবাক্সের দিকে তাক করে থাকায় পুরুষত্ব নেই।
এরপরও পুণ্যময়ীর মুখ থমথমে হয়ে উঠবে না এ কথা ভাবা উচিত নয়। হয়ে ওঠে থমথমে, পুণ্যময়ী বলে, তাক করে কেউ নেই মা, তবে সর্বস্ব ছেলে বউ পাবে, মেয়েরা কিছু পাবে না এ তো আর আইন নেই? তোমার অত গহনার মধ্যে একখানা করেও ভারী গয়না তোমার তিন মেয়ে পাবে, এটা কি অন্যায় আশা?
মরে গেলে নিস।
বলে আর একটা পান বার করেন ঘরশোভা।
পুণ্যময়ী একেবারে টুলটা ঠেলে সরে গিয়ে ভারী গলায় বলেন, কে আগে মরে, কে পরে মরে তার কি ঠিক আছে মা? তোমার মতো পরমায়ু সবাই পাবে, একথাও ভাববার কিছু নেই।
ছোট শিশুর রাগ দেখলে বড়রা যেমন কৌতুকে হেসে ওঠে, ঘরশোভা তেমনি হেসে উঠে বলেন, সাধে কি আর তোকে পায়ে হাত বুলোতে বারণ করেছিলাম রে পুণ্য? মেজাজ তো জানি। জানি হঠাৎ পাটাকে আছড়ে ঠিকরে উঠবি। তোর ভাইদের মেজাজ দেখছিস? ধরে শানে আছড়ে দিলেও রাগতে জানে না।
হবে না কেন মা? ভাইরা জানে মা গেলেই চাবিকাঠিটি ওদের
ওদের বলে কি ওরা সব নেবে? ঘরশোভা নির্লিপ্ত গলায় বলেন, এমন ছেলে পেটে ধরিনি, বুঝলি? বোনেদের যা দেবার ঠিকই দেবে।
পুণ্যময়ী ক্রুদ্ধ গলায় বলে, তা ছোটভাইদের হাত তোলাতেই বা রেখে দেবে কেন মেয়েদের? যা দেবার নিজের হাতে তুলে দিলেই পার? নগদ টাকাও বাবার ঢের ছিল।
আ গেল! এ হুঁড়ি যে দেখি আজ ঝগড়া করতেই কোমর বেঁধে এসেছে। ঘরশোভা সহজ গলায় বলেন, চা জল খা, মেজাজের গরম কাটবে। বলি গিন্নিরা সব গেলেন কোথায়? একবাটি চা দিতে এত দেরি? অ বড়মানুষের বেটিরা, কী গো চপ কাটলেট ভাজছ নাকি ননদের জন্যে?
তটস্থ হয়ে সরস্বতী এল জলখাবারের রেকাবি হাতে, গৌরী এল চা নিয়ে।
কী এনেছ মেজবউমা? বাজারের শিঙাড়া নিমকি? বলি ঘরে দুখানা কিছু করে দিতে পারলে না? গতরে এত আগুন ধরেছে? ব্যাসম গুলে দুখানা বেগুনি করে দিলেও হত, সময়সাপেক্ষ ব্যাপার নয়। অমন ঠ্যালা-মারা আত্মীয়তা আমার দু চোখের বিষ।
পুণ্য অপ্রতিভ না হয়ে পারে না।
ব্যস্ত হয়ে বলে, আহা ওকথা বলছ কেন মা? আমি এ পাড়ার দোকানের খাবার ভালবাসি, তা ওরা জানে বলেই।
নে, কর সুয়োগিরি ভাজেদের।
ঘরশোভা টুকটুকে ঠোঁটে একটু কুটকুটে হাসি হাসেন, তা বলে মনে করিসনি, আমি মলে ভাজেরা একদিনের জন্যেও এসে দাঁড়াতে দেবে। যতক্ষণ আমি আছি, ততক্ষণই আদর।
হ্যাঁ, এইরকম অবলীলাতেই এইরকম টক ঝাল নোনতা বলতে পারেন ঘরশোভা দেবী।
তবে ওঁর মুখের উপর কথা বলতে গৌরী পারে। গৌরী নিজের শাশুড়ির এহেন অপমানে, অবস্থাকে একটু মোলায়েম করার চেষ্টায় বলে, ঠাকুমার তো বেদবেদান্ত, নোক চরিত্র, সমাজ চরিত্র সবই জানা, কিন্তু এটাও তো ভাবতে হয়, আপনার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও সবাই এত খারাপ হবে কেন?
শিক্ষা নিলে তো? ঘরশোভা হেসে হেসেই বলেন, নিলে উদ্ধার হয়ে যেত, তা তো নয়, যা করে ভয়ে, ভক্তিতে নয়।
আমি আপনাকে ভয়-টয় করি না।
বলে ওঠে গৌরী।
আশ্চর্য, এতবড় দুঃসাহসেও রেগে ওঠেন না ঘরশোভা, তেমনি হেসেই বলেন, তা করবি কেন, আমার নাতির সোহাগে যে ধরাকে সরা জ্ঞান করিস।…যা দেখগে দিকিনি তোর শ্বশুররা এসেছে কিনা।
এলে তো আগেই এখানে আসতেন, বলে হাসে গৌরী।
তখন আসেনি, একটু পরে এল গৌরীর শ্বশুররা।
এসেই একবার দিদিকে প্রণাম আর মাকে কুশল প্রশ্ন করে চলে গেল হাতমুখ ধুতে।
বয়সে মাত্র বছর দুয়েকের বড় হলেও ঘরশোভার ছেলেরা দিদিকে প্রণাম করে, তুমি করে কথা বলে।
ওদের হাতমুখ ধোওয়ার অবকাশে দুই নাতবউ এসে দালানের কোণ থেকে টেনে টেনে এনে তিন-তিনখানা ভারী টুল ঘরশোভার বিছানার কাছ বরাবর রাখল, আর তার সামনে সামনে একটা করে চৌকি বসাল। টেবিলের বিকল্প। যদিও তিনটে চৌকির তিন রকম মাপ। পুরনো বাড়িতে এখানে সেখানে যা সব ছড়ানো ছিটানো ছিল, তাই থেকে বেছে নিয়ে চম্পাকলি আর গৌরী এই বিকল্পটি আবিষ্কার করেছে। নচেৎ আগে অফিস থেকে ফিরে জলখাবারও খেত ছেলেরা মাটিতে আসন পেতে, সরপোস ঢাকা গ্লাসে জল নিয়ে।
আসনগুলো অবশ্য ফুলতোলা কার্পেটের, তবে বিবর্ণ হয়ে গেছে।
ঘরশোভা যখন খুব বুনতে-টুনতে পারতেন তখনকার তৈরি।
তবে এখনও ঘরশোভা শুয়ে শুয়েই মাঝে মাঝে বোনেন। দুটো কাঠি নিয়ে প্রপৌত্রের মোজা সোয়েটার বুনে দিয়েছেন তিনি চম্পাকলির কাছে শিখে। কুরুশের বোনা জানতেন, কাঠি বোনা জানতেন না। একদিন বললেন, কী যে দুটো কাঠি নিয়ে ঘুরিস নাতবউ। দেখে মনে হয় ওর মধ্যে কতই যেন রস।
আছেই তো রস, বড় নাতবউ হেসেছিল, শিখলে বুঝতেন।
তবে শেখা
বলে হেসেছিলেন ঘরশোভা।
শেখাব কী, আপনাকে তো আবার ছোঁয়া বারণ।
আলগোছেই শেখাবি। একলব্য যে চোখের আড়ালে বসে ওস্তাদ হয়েছিল।
রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী-টাহিনী সমস্তই মুখস্থ ঘরশোভার। অথচ নাম সই করতে জানেন না, দলিলে দস্তাবেজে বাড়িভাড়ার রসিদে টিপসই দেন।
তা সেই খেলার ছলেই শিখে নিলেন ঘরশোভা কাঠি বোনা। শুয়ে শুয়ে এই কাজটা দিব্যি করা যায়-বলে কী খুশি!
.
টুলের ব্যবস্থা হয়ে পর্যন্ত ঘরশোভার ছেলেরাও খুশি। মার চোখের সামনে কাছাকাছি বসা যায়।
আসন পেতে খেলে, দালানের ও প্রান্তে বসতে হত। নইলে ঘরশোভা দেখতে পাবেন কী করে?
হাতমুখ ধুয়ে বসল ছেলেরা। তাদের বউমারা এল চা জলখাবার নিয়ে।
ঘরশোভা ভুরু কুঁচকে বললেন, তোদেরও বুঝি আজ বাজারের খাবার গেলাচ্ছে? ওসব খেলে শূল বেদনা হয়।
আসল কথা, আজ পুণ্যময়ী এসে পড়ায় বউরা তেমন সময় পায়নি, তাই কেনা খাবারেই কাজ চালাল, নইলে ঘরশোভা দু চক্ষের বিষ দেখেন বলে বাজারের খাবারের দিকে যাবার সাহস নেই বউদের। বলতে গেলে গিন্নিদের।
পানু তাড়াতাড়ি বলে, না মা, অসুখ করবে কেন? বেশ গরম আছে।
তোমরা নরম, তাই শিঙাড়া গরম।বলে হাসেন ঘরশোভা, খেয়ে নে, কথা আছে।
কী কথা!
বললাম যে খেয়ে নে।
কী বাবা, কোনও জ্ঞাতি-গুষ্টির মৃত্যুখবর নাকি। তেমন হলেই ঘরশোভা ছেলেদের পরিপাটি করে খাইয়ে-দাইয়ে তবে সংবাদটি পরিবেশন করেন।
ছেলেদের খাওয়া ভাল হল না- এই চিন্তায় ঘুম থাকে না ঘরশোভার।
রাজপুত্তুররা ফিরবেন কখন?
মার এই তীব্র প্রশ্নে সচকিত হয় ছেলেরা। রাজপুত্তুর অর্থে যে তাদের ছেলেরাই, সে কথা জানে তারা। কিন্তু ছেলেরা কখন ফিরবে সে কথাটি জানে না। অফিসের ছেলে দুটি যদি বা খানিকটা দেরি করে ফেরে, কলেজের ছেলেটি (যেটি নাকি প্রাণবল্লভের) ফেরে অনেক রাত কাটিয়ে।
ঘরশোভার সামনে পড়তে চায় না সে সহজে, কিন্তু মূল দরজাটা তো এই দালানে। যার জন্যে ঘরশোভার ছেলেদের চোর-ডাকাতের ভয়। সিঁড়ি থেকে উঠেই তো দালান। ঢুকলেই দেখা।
তবে ঘরশোভা খুব একটা রাগও করেন না, মুচকি হেসে বলেন, কী গো নটবর, বান্ধবীর সঙ্গে ভাবসাব করে, চায়ের দোকানে চা খেয়ে, সিনেমা দেখে, তবে ফেরা হল?
আঃ ঠাকুমা, তুমি যে কী করো? চিত্তবল্লভ বলে, এমন চেঁচিয়ে যা-তা বলল।
অপ্রতিভ হওয়া ঘরশোভার জন্যে নয়, তাই তিনি সপ্রতিভ গলাতেই বলেন, হ্যাঁ, এখন তো চুপিচুপি, আর যখন হাত ধরাধরি করে এসে বলবিঠাকুমা, বিয়ে করে এলাম! তখন?
হাসতে হাসতেই বলেন ঘরশোভা দেবী।
ঘরশোভার রাগ হয় নিজের ছেলেরা দেরিতে এলে। অথবা এসে কোনও দরকারে আগেই নিজের নিজের ঘরে ঢুকলে।
প্রৌঢ় তিন ভাই একসঙ্গে বসে খাবে, বেশ কিছুক্ষণ মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। তবে ছুটি তাদের।
কথা আছে শুনে তোলপাড় মনে খেলে ছেলেরা, তারপর ঘরশোভা কথা পাড়লেন, তোদের বড়দির কত বয়েস হল রে?
ওরা অবাক হয়ে তাকাল।
জগু বলল, সে কথা আমাদের জিজ্ঞেস করছ?
করছি তোদের অবহিত করতে। পুণ্যি এই যেটের কোলে তেয়াত্তরে পড়ল। তা বাহাত্তুরে ধরে বসার টাইম হয়ে গেছে কী বল? তা ধরেছে যখন, তখন তেমনি কথাই তো কইবে। তা সামনাসামনিই বলি। আমি মরলে তোরা দিদিদের ফাঁকি দিবি, এই ভয় ঢুকেছে ওর মাথায়। এই তিন ভাই সাক্ষী, বলে রাখি, কান দিয়ে শোনো
আমার যে বাইশ ভরির গোটটা আছে, সেটা তোদের বড়দি পাবে। আঠারো ভরির অমৃতি বালা জোড়া পাবে মেজদি, আর উনিশ ভরির টালি বরকি চুড়ি জোড়াটা ছোড়দি। আলো আর দিবুর পুণ্যের চেয়ে যেটুকু কম হল তা নিয়ে যেন ফ্যাচফ্যাচ করে না। পুণ্য বড়। জ্যেষ্ঠের শ্রেষ্ঠ ভাগ। আর বাকি যা গয়না আছে, তোমরা তিন ভাই সমান সমান ভাগে ভাগ করে নিয়ে নিজ নিজ বউ, মেয়ে আর বউমাদের ভাগ করে দেবে। শুধু সতুর খোকার বউয়ের জন্যে আমার গিনির মালাখানা থাকবে। ওটা কারুর সঙ্গে তুল্যমূল্য করার দরকার নেই। ও আমায় নাতির বেটার মুখ দেখিয়েছে, ওর দামই আলাদা।
ছেলেরা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। মার অনেক গয়না-টয়না আছে। তা তারা জানে, কিন্তু সেই থাকাটা যে এত, তা জানত না। ওরা দরকারে পড়ে বিয়েতে পাওয়া আংটি বোতাম পর্যন্ত বেচে দিয়েছে, কারণ মেয়েছেলের বিয়ে তো দিতে হয়েছে। আর ছেলের বিয়েতে পণ নেওয়াও সম্ভব হয়নি, ঘরশোভার ওতে বড় ঘৃণা।
উনি বলেন, মেয়ের বিয়েতে বাবা যা পারবে দেবে, তবে গলায় গামছা মোড়া দিয়ে নগদ নেওয়া কী? ছিঃ, অমানুষের কাজ!!
ঘরশোভার ছেলেরা অমানুষ নয়।
যদিও তাদের মা হরবখতই বলেন, অমনিষ্যি।
স্তব্ধতা ঘুচলে রাজু অস্ফুটে বলে, ওইসব ছাড়া আর কী আছে?
আছে তো ঢের, সব কি আর আমি মুখস্থ করে রেখেছি? আরও একজোড়া চুড়ি আছে পালিশ পাতের, গলায় বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি দুজায়গা মিলিয়ে আছে সীতাহার, পুষ্পহার, ডাম্বাল বিছে, তেঁতুল পাতা, উপর হাতের তাগা, তাবিজ, বাজু, যশম, নীচের হাতের চুড়ি বালা বাদেও বেরেসলেট, মানতাসা, রুলি।
একটু ভেবে আবার বলেন, এছাড়া রতনচূড় কান ঝাঁপটা, সিথি, মাকড়ি, বেলকুঁড়ি, পাশা, আংটি ফাংটি। রুপোর মধ্যে–চন্দ্রহার, পাঁইজোর, চরণ পদ্ম। সবই ভারী, তোদের একালের মতো নয়।
ঘরশোভার যে কত গয়না আছে এই প্রথম সমাজে উচ্চারিত হল, সব সময় চেপেই রাখেন ঘরশোভা, বাক্স খোলার সময় কাউকে ধারে কাছে থাকতে দেন না।
ছেলেরা বউরা কেউই ঠিকমতো জানতেন না, বরং মেয়েরা কিছু জানে। ছেলেবেলায় মাকে সাজতে দেখেছে, পরে নেমন্তন্ন বাড়ি যেতে দেখেছে। তবু এ যুগে যখন একটা আংটি গড়াতে পেরে ওঠা যায় না, তখন এই ফর্দটা যেন অলৌকিক লাগল।
ছেলেরা স্তব্ধ, বউরা ক্ষুব্ধ।
শুধু নাতবউরা চঞ্চল।
চম্পাকলি শ্বশুরের সামনে যতটুকু সম্ভব ততটুকু ঢেউ তুলে বলে, তা যাকে যা দেবার আপনিই হাতে করে দিয়ে দিন না ঠাকুরমা। পরে আপনাকে দেখাই। গিনির মালাটা খোকার বউ এসে পরার আগে আমিই না হয় পরে নিই বেশ কিছুদিন। দিয়ে দিন, দিয়ে দিন। সিন্দুকের চাবিটা দিন না, বাক্সটা বার করে দিই।
ওরে আমার কে রে?
ঘরশোভা খনখনে গলায় আবার বলে ওঠেন, এখন থেকে দিয়ে দিই, তারপর তোরা বুড়িকে টেনে ভাগাড়ে ফেলে দে! এই একশো বছরের বুড়িকে যে ময়ূরপালঙ্কে শুইয়ে রেখেছিস, সে কি শুধু ভক্তিতে?
চম্পাকলি থতমত খায়; তুখোড় গৌরী বলে ওঠে, আপনার ছেলেরা বুঝি এত খারাপ ঠাকুমা?
শুধু আমার ছেলে বলে নয় নাতবউ, পৃথিবীর ধর্ম যা, তাই তো হবে?
তবে আর কী!
পৃথিবীর ধর্মের উপর তো আর কথা চলে না?
শুধু রাজুরা আর তাদের বউরা ভাবতে থাকে, পৃথিবীর কী অদ্ভুত খেলা! বাড়িতে এত সোনা, আর আমরা
ঘরশোভা আবার একটু হাঁপ ফেলে বলেন, দেখো বাছা, যেন আমার কথার এতটুকু এদিক ওদিক না হয়?
পুণ্যময়ী এতক্ষণ গুম হয়ে বসেই ছিল, এখন হঠাৎ বলে ওঠে, তা তুমি তো একটু লিখে রাখলেই পারো মা, কে কখন ভুলে যায়।
ভুলে যাবে? ভুলে যাবে মানে? আমার কথা ভুলে যাবে? তিন ভাইয়ে একসঙ্গে শুনলি তো? নড়চড় না হয়। অবিশ্যি বাজারে যা খুচরো-খাচরা ধার আছে, সে সব শুধে তবে মরব। ধারে কর্জে ডুবিয়ে তোদের রাখব না আমি। যা পুণ্যি, এবার ভাজেদের সঙ্গে গপপো করগে যা। গপপো আর কী, মা শাশুড়ির নিন্দে। এখন ননদ ভাজে মায়ের মুণ্ডপাত করছে।
আমরা ননদ ভাজে তোমার নিন্দে করি মা? আহত চোখ তুলে তাকায় পুণ্য।
ঘরশোভা নির্লিপ্ত গলায় বলেন, বুকে হাত দিয়ে বল, করিস কিনা। জমিয়ে বসে বলিস কিনা– মার এই অন্যায়, মার এই দোষ, মার এত জেদ।
বউমারা এবং মেয়ে, যাকে বলে পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। আশ্চর্য হয়ে ভাবে, ঘরশোভা এসব জানলেন কী করে? ঘরশোভার কানের কাছে তো বলতে যায়নি? আর উনিও কিছু উঠে গিয়ে আড়ি পাতেননি, তবে?
ঘরশোভা কি হাত গোনেন?
ঘরশোভা কি থট-রিডার?
মাঝে মাঝে তাই মনে হয় যেন। যেন অপরের মনের মধ্যে টর্চ ফেলে সব দেখে ফেলেছেন।
অনেকক্ষণ পরে জগু সাহস করে বলে, কিন্তু নগদ টাকা কি কিছুই নেই মা?
ঘরশোভা তিনটে পান একে একে ছেলেদের হাতে আলগোছে ফেলে দিয়ে নিজে আর একটা খেয়ে হেসে বলেন, সব কথা প্রকাশ করব কেন রে? মরে যাবার পরে তা হলে মায়ের বদলে নতুন কী পাবি? বুঝি, তোদের এখন খুব অভাব, কিন্তু কলসির জল তো? ঢাললে কতক্ষণ? যা আছে সব যদি এখনই তোদের হাতে তুলে দিই, তা হলে মরার পর লোকে বলবে কী, এতবড় একটা মান্যিগন্যি লোকের পরিবার ছিলাম, সে মান-মর্যাদাটা তো রাখতে হবে? পাঁচজনে যখন শুধোবে মা কী রেখে গেছে? তখন কী জবাব দিবি? আমি মলে তখন তো সবই তোদের।
সব কথায় ওই কথাটিই বলেন ঘরশোভা, আমি মলে তখন সুখ কোরো! শখ সাধ কোরো। মলে তো সবই তোদের।
বউরা এতে ভীষণ চটে যায়, কিন্তু কী করবে? স্পষ্টবক্তা ঘরশোভা যা বলবার তা বলবেনই।
নগদ টাকা তোমার দৌতুর সন্তানরা কিছুই পাবে না মা?
না বলে পারে না পুণ্য।
ঘরশোভা মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেন, হক কথা বলছি বাবা, দৌত্ত্বরদের উপর আমার চিত্ত চটা। ছোঁড়ারা তো দুবেলা মনে মনে বুড়িকে গঙ্গাযাত্রা করাচ্ছে। সাতজন্মে একবার দেখতে আসে না। কীসে চিত্ত থাকবে?
পুণ্যময়ী কেঁপে ওঠে।
সত্যিই কি মা অন্তর্যামী নাকি?
তার ছেলেরা তো বলেই ও কথা। যখন তখনই বলে, তোমার মা কি সত্যি অমর বর পেয়েছে মা! মরার নামটি নেই? মলে একবার দেখি তোমার বাবা বুড়ো কী রেখে গিয়েছিল।
আর যদি কখনও পুণ্য ছেলেদের বলে, যা না একবার মাকে দেখে আয় না?
ছেলেরা করজোড়ে বলে, রক্ষে দাও মা, গিয়ে তো সেই অনন্তকালের দৃশ্যটিই দেখতে হবে? তিন হাত উঁচু ময়ূরপঙ্খী পালঙ্কে ধবধবে বিছানায় পা জড়িয়ে শুয়ে আছেন গিন্নি, পান জর্দা খাচ্ছেন আর ডাবর নিয়ে নিয়ে পিক ফেলছেন। অসহ্য! যেদিন শুনব তোমার মা মরেছে, সেদিন যাব।
অথচ ঘরশোভা কিছু আর ঘরশোভার দৌহিত্রদের জীবনযাত্রায় কোনও কিছু ঘটাচ্ছেন না। তাদের কানাকড়ি খরচাও করাচ্ছেন না।
তবু এমনিই হয়, কেউ যদি একটু বেশিদিন পৃথিবীর অন্নজলের উপস্বত্বে ভাগ বসায়, তা হলে অন্য পাঁচজনের চোখ টাটায়, কেবলই বিস্ময় প্রকাশ করে বলে, বাবাঃ, এখনও মরেনি?বলে, কী আশ্চর্য! কবে মরবে?
যেন ওই মৃত্যুটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পৃথিবীটা হালকা হয়ে যাবে।
কিন্তু ঘরশোভা কি মরবেন?
ক্রমশ ওঁর বাড়ির লোকেদেরও সন্দেহ হচ্ছে, উনি বোধহয় অলৌকিক কোনও শক্তি পেয়েছেন। তাই এখনও বাঁধানো দাঁতে জগতের যাবতীয় বস্তুতে দাঁত বসাচ্ছেন, সব কিছু হজম করছেন, বহাল তবিয়তে বিরাজ করছেন।
এখনও পাকাচুলের নুড়ি খোঁপায় কর্তার আদর করে গড়িয়ে দেওয়া ছোট ছোট দুটি সোনার কাঁটা গুঁজছেন, বিছানায় শুয়ে শুয়েই আধ ঘন্টা ধরে তেল মেখে চান করছেন, বাজারের বেলায় অনন্তকে ডেকে বলছেন, মেথি শাক ওঠেনি রে অনন্ত? আর কচি কড়াইশুটিং কচি কচি কড়াইশুটি দিয়ে মেথি শাক চচ্চড়ি রাঁধতে পারলে, টাকায় তোলা।..বলেন, আর শোন, মোচা আসেনি কতকাল? খেয়াল করে আনবি।
মলিনাকে ডেকে বলেন, দুটি ছোলার ডাল দিয়ে দাও তো বড়বউমা, ওবেলা আর লুচি পরোটা খাব না, দুধ-মিষ্টি খাব, তার সঙ্গে খানকতক ওই ধোঁকাভাজা।…ভিজোবে তত বেশি করেই চারটি ভিজিও বরং, তোমাদের দিকে ধোঁকার ডালনা কোরো। জগু ভালবাসে।
আবার শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠের পানে তাকিয়ে তাকিয়ে বলেন, কত ঝুল জমেছে। অনন্তকে ডেকে একবার সঙ্গে করে করিয়ে নাও না বউমা, ঝুলকালি নোংরা বাড়তে দিলে মা-লক্ষ্মী ছেড়ে যান।…কোনও সময় বা স্বগতোক্তি করেন, কর্তা গিয়ে পর্যন্ত আর বাড়ির গায়ে মিস্তিরির হাত পড়ল না। কোনও ক্ষমতা নেইগা! কী ছেলেই গর্ভে ধরেছি, মেয়েমানুষের অধম। কেবল মুখ শুকিয়ে বসে থাকতে জানে, পয়সা কোথায় ছড়ানো আছে খুঁজে দেখতে জানে না।
কোনও কোনও সময় আবার তীব্র চিৎকারে সবাইকে সচকিত করে তোলেন, ওগো বউমারা। কাল না চন্দর গেরোন গেল? তোমাদের ওই জলের জালা অঙ্গ নিয়ে বসে রয়েছে যে? গেরোন লাগলে হাঁড়িকুঁড়ি কলসি কুঁজো ফেলে দিতে হয়, তাও জানোনা? তিরিশ বত্রিশ বছর তোএসেছ এ সংসারে, এখনও রপ্ত হল না?
দালানের এক কোণে শ্যাওলাধরা একটা ভারী টুলের উপর মাঝারি সাইজের একটা জলের জালা বসানো থাকে। সেটা হল ইতর সাধারণের জন্যে, ছেলেপুলেরা রাতদিন জল চায়, কে কত দেবে ভাঁড়ারের কলসি কুঁজো থেকে? ওটা থেকে ওরা গ্লাস ডুবিয়ে ডুবিয়ে খায়।
কিন্তু বছরে তো–দুএকবার গ্রহণ লাগছেই, তা ছাড়া সাতপুরুষের এদিক ওদিক জ্ঞাতিও আছে বিস্তর, যারা মরলে কুঁজো কলসি ফেলতে হয়। কত আর ফেলতে পারা যায়? একটি ওই মাঝারি জালারও তো দাম কম নয়?
মেজ বউ সরস্বতী একটু তার্কিক আছে, সে এসে বলে, আচ্ছা মা, আকাশের চাঁদে গ্রহণ লাগল তো ঘরের মধ্যে জলের পাত্র কী দোষ করল?
ঘরশোভা বিরক্ত গলায় বলেন, আমি তোমার সঙ্গে শান্তর আলোচনা করতে বসতে পারব না মেজ বউমা, যা করে এসেছি, তাই করব। যা হয়ে এসেছে, তাই হবে। আমি যতক্ষণ আছি কিছু রদবদল হবে না, ব্যস।
যারা সামনে থাকে, তাদের মুখে আসে, তুমি তো চিরকালই আছ। আমাদেরই বারোটা বেজে আসছে।
মুখে এনেও বলে না।
আস্ত জালাটা ফেলে দেবার অর্ডার দেয়।
পাঁজিপুঁথি দেখেন না ঘুরশোভা, তবু কেমন করেই যেন জানতে পারেন, চন্দ্র সূর্য কখন কোনখানে অবস্থান করে। বউদের ডেকে ডেকে বলেন, আসছে কাল থেকে ইতুপুজো, মনে আছে তো বউমা? মেয়েদের সব্বাইয়ের নামে নামে ঘট দিয়ো।
বলেন, বোশেখ মাসের তো আজ সংক্রান্তি, কাল সকালে যেন আবার তোমাদের ঝিবউরা সাত-সকালে চা খেতে বসে যায় না, জয়মঙ্গলবারের কথা শুনে তবে জল খাবে।
ষষ্ঠী, মনসা, মঙ্গলচণ্ডী, ইতু, সব কিছু করানো চাই সবাইকে। নিজেও অবশ্য আছেন সে দলে।
মুখরুচি করে ব্রতের পারুনির ব্যবস্থা চলে।
আশ্চর্য! যা ইচ্ছে খেয়েও অসুখ করে না ঘরশোভার। ওমা ওসব থাক, আপনার অসুখ করবে। ওকথা বলার উপায় নেই বউদের।
তাই নিজ নিজে স্বামীপুত্রের কাছে বলে, আমাদের এখুনি জগতের অর্ধেক খাদ্য হজম হয় না, মা যে কী করে সব খেয়েদেয়ে হজম করেন?
পুরুষমানুষরা অবশ্য এ ধরনের আলোচনা পছন্দ করে না। কেউ বলে, ওইটুকুই ভগবানের আশীর্বাদ। কেউ বলে, যার যা সইবে, খাবে, এর মধ্যে কথা কী আছে?
কিন্তু কথা আছে বইকী!
যেটাকে মনে হয় বাড়তি, অবান্তর, অহেতুক, সেটা জোগান দিতে বিরক্তি না এসে পারে না যে। একটা মানুষ নব্বই বছর ধরে খেয়ে আসছে, তবু খাওয়ার আকর্ষণ কমে না, এ কী রকম!
ঘরশোভার ছেলেমেয়েরা ক্রমশ বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, নাতিরা কর্তাব্যক্তি হয়ে উঠছে, নাতনিরা একে এসে শ্বশুরবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
ঘরশোভার কোনও তারতম্য নেই।
সেই পাকা আমটির মতো চেহারা, সেই পরিপাটি করে চুলটি আঁচড়ানো, সেই ফরসা ধবধবে থান শেমিজ। পা থেকে কোমর পর্যন্ত একখানা কাঁথায় ঢেকে রাখেন, সে কাঁথার কাজের কাছে ঢাকাই শাড়ি হার মানে।
কাঁথা ঘরশোভার নিজের হাতের তৈরি। তিন ছেলের আর কর্তার জন্যে চারখানা অতি উত্তম কাঁথা তিনি বানিয়েছিলেন একদা। কর্তা গেলে নিজেই ব্যবহার করছেন সেটা। দে, ওটাই আমার গায়ে দিয়ে দে। কর্তার গায়ের হাওয়া লেগে আছে ওতে।
তখন নাতিদের বিয়ে হয়নি, বড় নাতনি ছিল বাড়িতে। মুচকি হেসে বলেছিল, তোমাদের দুজনের খুব ভালবাসাবাসি ছিল, না ঠাকুরমা?
ঘরশোভাও হেসেছিলেন, তোমাদের আমলের মতন ভালবাসাবাসি নয় গো সুন্দরী, সে অন্য বস্তু। দশ বছর বয়েসে এ সংসারে এসে ঢুকেছিলাম, তখন বরের নামে ভয় পেতাম, ঘরে শুতে পাঠালে কেঁদেকেটে পালিয়ে আসতাম, শেষে আবার সেই মানুষই ঠাকুর দেবতার মতো হয়ে গেল। ভালবাসা দেখানো-টেখানো জানতাম না, গায়ে গা দিয়ে বসতেও দেখেনি কেউ জন্ম-জীবনে, সমুখে কখনও খেতে বসিনি, তবু দুজনে দুজনের কাছে যেন আয়নার মতো। একের মধ্যে অপরের মনপ্রাণ সব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। সে তোরা বুঝবি না দিদি। তোরা জানিস, বায়োস্কোপ না দেখালে ভালবাসা প্রকাশ হয় না, রাতদিন গলাগলি না হলে ভালবাসা জাহির হয় না।
আর তোমারও জানতে, গয়না না দিলে ভালবাসা জানানো যায় না। বলছিল নাতনি।
ওলো সে আলাদা। প্রাণপাত করে দিতে পারার সুখে দিয়েছে। ভালবাসার মানুষকে সাজিয়ে সুখ।
.
এখন নাতবউরা বলে, আপনার একশো বছরের ইতিহাস জমা আছে ঠাকুমা, খাতা কলম নিয়ে বসব? আপনি বলবেন আর আমরা লিখে নেব।
নিয়ে কী করবি?
কাগজে ছাপাব!
শোন কথা–, ঘরশোভা হাসেন। আমি আবার কে একটা দশমান্যি মানুষ যে কাগজ ছাপবে। হ্যাঁ, বিদ্যাসাগরের মতন ছেলে পেটে ধরতাম, তা হলে সে দাবি-দাওয়া থাকত।
ওরা বলে, তা হোক, তখনকার নিয়মকানুন, আগের ব্যবহার, সে সব তো আজ আর আমরা কেউ জানিই না, শুনব।
দুর দুর! সে কোন জন্মের কথা, ভুলেই গেছি।
এ আসরে প্রায়শই নিত্যবল্লভ থাকে, সে হেসে বলে, তুমি আবার ভুলে গেছ বুড়ি! তোমার কখানা গয়না আছে, কটা আংটি আছে, তা ভোলনি, মুখস্থ করে রেখেছ–
ঘরশোভা একটু অন্যমনস্ক গলায় বলেন, ওসব কি শুধুই গয়না রে নিতু, ওর এক একটির অঙ্গে এক একটি ঘটনা জড়ানো আছে। ওই যে অমৃতিবালার কথা বললাম সেদিন? ওটা আমার প্রথমবার সাথে পাওয়া, বাবা গড়িয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর ওই পাটি হার, তোদের ঠাকুরদার প্রথম উপহার।
নাতবউরা বলে, কেবল গয়নার গল্পই শুনি ঠাকুমা, চোখে তো দেখলাম না কোনওদিন।
দেখবি, দেখবি, আমি মরি আগে।
ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে হাসে। ভাবটা হচ্ছে তুমি আর মরছ বুড়ি!
সত্যি, প্রপৌত্রটা পর্যন্ত স্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠে পড়ল।
ঘরশোভা অমর, অজর, অক্ষয়।
বউ বউ মলিনা, বাতে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়েছে, সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না, সরস্বতীরও ঘুষঘুষে জ্বর ধরেছে, ওর সকালে স্নান বারণ, পঙ্কজিনী একা পড়ে গেছে, তাই সকাল থেকেই তাকে রান্নাঘরে গিয়ে লাগতে হয়। বামুন ঠাকুর ভক্তিনাথটাও তো বুড়ো থপথপে হয়ে গেছে। কাজ করে যত, চেঁচায় তার তিন গুণ। কাজেই ওকে সাহায্য না করলে চলে না।
অতএব এখন সকালবেলা বঁটি আর কুটনোর ঝুড়ি নিয়ে বসার ভার চম্পাকলি আর গৌরীর।
বঁটি, বারকোশ, জলের গামলা সব নিয়ে বসে ওরা হাঁক দেয়, ও ঠাকুমা, বলুন কী কুটব?
ঘরশোভা মাথাটা এগিয়ে নিয়ে বলেন, তরকারি আনাজ কী আছে দেখি
দেখে আজকাল আর কিছুতেই মনঃপূত হয় না ঘরশোভার, তেতো গলায় বলেন, বাজার কে করেছে রে? কী ছিরির বাজার। এই নিয়ে যেঠের এই সমগ্ৰ সংসারের দুবেলা সম্পত্যি হবে?..বলি দিন দিন সবাই এত কেপ্পন হয়ে যাচ্ছে কেন বল দিকি? কেপ্পনি আমার দুচক্ষের বিষ খাওয়া-দাওয়াটা ভাল না হলে শরীরে গত্তি লাগবে কীসে?
অভাবের দাঁত ক্রমশই ধারালো হয়ে উঠেছে, তাই বউদের কথাও ধারালো হয়ে উঠেছে। পঙ্কজিনী কোথা থেকে যেন শুনতে পেয়ে বলে, বেশি গত্তি লেগে আর কী হবে মা? আপনার মতন অখণ্ড পরমায়ু পাব? অতিবড় শত্তুরেরও যেন এমন না হয়।
ঘরশোভা কটু গলায় বলেন,কেন? কেন, শুনি? আমার কীসের কষ্ট যে, অতিবড় শত্তুরের জন্যেও আমার অবস্থা কামনা করো না? দীর্ঘ আয়ু তো প্রার্থনার কথা। আশীর্বাদ করতে লোকে বলে–দীর্ঘায়ু হও!
মেয়েমানুষকে বলে না বোধ হয়।
কেন, মেয়েমানুষের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা কেন? ঘরশোভা রেগে বলেন, এদিকে তো মুখে বলিস–আমাদের কাছে মেয়ে-ছেলে দুই-ই সমান।–পেটে এক মুখে এক তোদের। আমি অত মরি মরি করি না। মরলেই তো আবার মাতৃজঠরে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। তার চেয়ে এ ভাল। হরিনাম শুনছি, ক্ষীর ছানা মাখন মিছরি খাচ্ছি, পালঙ্কে অঙ্গ ঢেলে পড়ে আছি। মন্দটা কী আছি?
পঙ্কজিনী কটকটিয়ে বলে, আপনি কোন দুঃখে মন্দ থাকতে যাবেন মা? সে থাকব আমরা।
ঘরশোভা অম্লান বদনে বলেন, তা যার যেমন কর্ম করা আছে, সেইমতো তো ফল পাবে? ভাগ্যে থাকলে তোমরা ওই মুখ-সুখ্য স্বামী নিয়েই গাড়ি পালকি চড়তে, সোনাদানা গায়ে দিতে, মণ্ডা-মেঠাই খেতে। আমি কী মানুষের হাতে পড়েছিলাম! বিদ্যের মধ্যে তিনটি ক্লাশের পড়া, তারপর থেকেই তো বাপের গদি দেখছে।
পঙ্গজিনীও ছেড়ে কথা কয় না, বলে, তা সেই গদিওলা শ্বশুরেরই বা কী পেলাম আমরা?
ঘরশোভা এবার রেগে যান, বলেন, বেইমানের মতন কথা বোল না ছোট বউমা, এখনও তাঁর তৈরি বাড়িতে নাতি-পুতি নিয়ে ঘর করছ।..ও কীরকম ঝোলের কুটনো হচ্ছে নাতবউ! গুটি গুটি আলু, সরু সরু পটল? লম্বা লম্বা নৈনিতাল আলু, ফালাফালা করে না দিলে কখনও ঝোলের সোয়াদ হয়?
গৌরী বলে, এ তো মাছের ঝোল ঠাকুমা! এতে সোয়াদ না এলে আপনার কী? আপনার ঝালের ঝোলে আলু কুটব ফালাফালা করে।
আ মলো হুঁড়ি, মাছের ঝোল আমার ছেলেরা খাবে না? নাতি-পুতিরা খাবে না?
তা কুলোনো তো চাই?
গৌরী আবার বলে, আর ও সব লম্বা লম্বা চলবে না ঠাকুমা। এখন সব ঘোটর যুগ।
ঘরশোভা বেজার গলায় বলেন, তা যা বলেছিস, জিনিস ছোট, মন ছোট, নজর ছোট, বুদ্ধি ছোট। তোদের এই কালকে দেখলে ঘেন্না আসে।
পঙ্কজিনী শুনতে পেলে হয়তো বলত, চার কাল বেঁচে থাকলে অনেক রকমই দেখতে হয় মা।
শুনতে পায়নি তাই।
মলিনা কখনও কখনও বলে, মাকে অমন কটকট করে বলিস কেন ছোটবউ! যতই তোক গুরুজন।
পঙ্কজিনী বলে, আর পারা যায় না দিদি। পৃথিবীতে যে আর কোনও দৃশ্য আছে তা ভুলে গেছি। দিনেরাতে ওই এক দৃশ্য দেখতে দেখতে আমারও ঘেন্না ধরে গেছে। মার ছেলেদের বলে আবার ওঁকে ঘরে ঢোকালে বাঁচা যেত।
আর ঘরে!
মলিনা বলে, সত্যিই তো আর আরও দশ বছর বাঁচবেন না!
বিশ্বাস কী, আমাদের সবাইকে খেয়ে তবে উনি যাবেন।
পঙ্কজিনীর স্বামী প্রাণবল্লভের হাই ব্লাডপ্রেসার, একবার হার্ট অ্যাটাকও হয়ে গেছে, মনে-প্রাণে তার সর্বদাই জ্বালা।
এর মাঝখানে আবার ঘরশোভা সেই ছেলেকেই ডেকে বলেন, তোর ওই ছোট মেয়েটাও তো হাতি হয়ে উঠল পানু। পাত্তর দেখছিস!
পানুর মধ্যেও আজকাল একটু অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছে। তাই সে বলে ওঠে, দেখে কী করব! পয়সা থাকলে তো মেয়ের বিয়ে দেব।
ঘরশোভা গম্ভীর হয়ে যান, বলেন, তোমার পয়সা নেই সেটা তোমার অক্ষমতা, তাতে তোমার সাত খুন মাপ হবে, এমন আশা কেন! মেয়েকে বিয়ের বয়েসে বিয়ে দিবি না!আমার পয়সা নেই দেব কোথা থেকে বলে বসে থাকবি?
পানু গম্ভীরভাবে বলে, তবে কী করব বলল, চুরি-ডাকাতি করব?
দরকার পড়লে তাও করতে হয় পানু, বাপ হওয়া অমনি না। নচেৎ পাত্তরের বাবার হাতে-পায়ে পড়গে।
ছেলে মাথা নিচু করে, বউ অগ্নিদৃষ্টি হানে, ঘরশোভা দেবী নির্লিপ্ত গলায় ডাক দেন, সুহাস, অ সুহাস, আজ আমায় কটা পান দিয়েছিলি? এক্ষুনি কেন পান ফুরোল।
পাকা চুলে নুড়ি বাঁধা সুহাস মাজায় হাত দিয়ে এসে দাঁড়ায়, বলে, যা ছিল তাই সেজেছি মা, আট আনা করে পানের গোছ হয়েছে
তবে কাল থেকে আর পান সাজিসনি, ঘরশোভা বলেন, কেপ্পনির মধ্যে আমি নেই, হয় খাব নয় খাব না। বউদিদিদের বলিস, মায়ের বরাদ্দয় কাঁচি চালালে লক্ষ্মী ছেড়ে যায়, এই কথাটা যেন চিন্তা করে।
যে পানু এই মাত্র মাথা হেঁট করে বসে ছিল, সে উঠে গিয়ে ক্রুদ্ধ গলায় বলে, মায়ের পানের পয়সা ছাঁটবার দুর্মতি কার হয়েছে? সংসারের–আর যার যা হোক, মার যেন এদিক ওদিক না হয়, তা বলে রাখছি।
পানুর বউ কেমন একরকম ঈর্ষার দৃষ্টিতে অদূরবর্তিনীর দিকে তাকায়, তারাও ছেলের মা। তারাও প্রাণ ঢেলে ছেলে মানুষ করছে, তাদের ছেলেদের মধ্যে এই আনুগত্য, এই ভক্তি, এই ভালবাসা কোথায়?
বরং তারা কথায় কথায় মাকে ডাউন করতে পেলে ছাড়ে না। এই অভাবগ্রস্ত সংসারে ছেলেদের সদাই অসন্তোষ।
বাড়িটা ক্রমশই জীর্ণ হয়ে আসছে, অতি পরিচিত শ্রীহীন বর্ণহীন আসবাবপত্রগুলো যেন সর্বদা বুকের উপর পাষাণভার চাপিয়ে রেখেছে, মনের মতো জামা জুতো হচ্ছে না। খাওয়া-দাওয়া ক্রমেই খারাপ হয়ে আসেছে, কমবয়েসী ছেলেমেয়েদের এই অবস্থাটায় ভাল লাগবার কথাও নয়। মায়ের প্রাণ বোঝে সেটা, তাই আড়ালে ওদের একমাত্র কথা, সংসারের সব সারটুকু একজনের ভাগেই যাচ্ছে, কী করব বল বাবা!
সত্যি, একটা মানুষকে রাজার আদরে ময়ূরপঙ্খী পালঙ্কে শুইয়ে রাখতে হলে যে কত লাগে, তা সে যাদের রাখতে হয় তারাই জানে। সংসারের আর সকলের ভাগেই টান পড়ে।
তা ছাড়া–এই বাজারে তিনটে মানুষ পোষা।
একথা বারবার ওঠে।
তিনটেই তো বুড়ো হয়ে গেছে, কাজই বা পাওয়া যায় কতটুকু?
পঙ্কজিনী রেগে রেগে বলে, বামুন ঠাকুরের পিছনে আমাকে যা খাটতে হয়, তার থেকে রান্না করা ভাল। শুধু একটা বোঝা টানা। আর অভ্যেসগুলিকে মা করে দিয়েছেন নবাবি। পান সুপুরি চাই, চারবার করে চা চাই, রাতে ভাত চাই। বামুন ঠাকুর না ভাশুর ঠাকুর। আর ওই সুহাসটি, এখন তো মার কাজটুকু ছাড়া গেরস্তর কিছুই করে উঠতে পারে না। ঠিকে-ঝি সুবর্ণর মাকে ক্রমান্বয়েই কাজ বাড়িয়ে দিতে হচ্ছে। আর মাইনে বাড়াতে হচ্ছে।
অনন্তর মুরুব্বিয়ানাও অসহ্য লাগে ওদের। সিঁড়ির তলাটা তো ওর দখলে, বিছানা মাদুর ময়লা চিট গামছা, হুঁকো কলকে, এইসব নিয়ে নরককুণ্ডু করে রেখেছে বুড়ো। ছেলেপুলেদের উপর কী শাসন চালাতে আসে। যেন বাড়ির লোক!
কার ভাল লাগে?
এই তিন-তিনটে অকালকুষ্মণ্ডকে পোষা শুধু ঘরশোভা দেবীর জন্যেই তো! ওদের ছাড়ানোর কথা তো ওঁর সামনে তোলবার জো নেই।
অবিশ্যি সুহাসিনীকে ছাড়ানো চলে না, ভাঙা কোমর নিয়ে সব কিছু করছে। সেটা আর কে করবে? ঘরশোভা তো আর মরবেন না!
তবু নিত্য একদিন মনের জোর করে গিয়ে বলে বসল, ও বুড়ি, দিনকাল তো দেখছ, তিন-তিনটে লোককে আর কতদিন পোষা যাবে? ঠাকুর আর অনন্ত তো প্রায় কোনও কর্মেই লাগে না। প্র্যাকটিক্যালি রান্নাটান্না তো ছোট কাকি আর তোমার নাতবউরাই করে। আর বাজার করা? সে আমরা অনায়াসেই করে দিতে পারি। বরং অনন্তর মতো পয়সা মারব না। বুড়ো হয়ে গেল তবু ওই রোগটি তো গেল না।
ঘরশোভা কনুইয়ের চাপ দিয়ে খাড়া হয়ে উঠে বসে বললেন, কাদের ছাড়ানোর কথা বলছিস?
কাদের আর, ওই ঠাকুর-চাকরের কথাই বলছি
ঘরশোভা অবাক হয়ে বলেন, ওদের ছাড়ানোর কথা বলছিস? তোর জন্মের আগে থেকে ওরা আছে তা শুনিসনি কোনওদিন?
শুনব না কেন? কিন্তু এখন আর ওদের কাছ থেকে কী কাজ পাওয়া যাচ্ছে?
ঘরশোভা আবার শুয়ে পড়ে বলেন, আমাকে দিয়েও তো কোনও কাজ পাওয়া যায় না। তবে আমায় টেনে ফেলে দে।
সেটা তো আর একটা কথা হল না, ওরা মাইনে করা লোক–
ঘরশোভা তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠেন, ওরা যে মাইনে করা লোক, সে কথা তোদের এখনও মনে আছে? ধন্যবাদ! কিন্তু সে মাইনে তোরা কেউ কোনওদিন দিয়েছিস? বাড়ি ভাড়ার টাকা থেকে হচ্ছে না?
মাইনে ছাড়াও খরচ হচ্ছে তো বুড়ি! দেখছ তো বাজার?
ঘরশোভা তীব্র স্বরে বলেন, দেখছি বইকী! সবই দেখছি। একটা পুরুষের ক্ষ্যামতায় তিনটে লোক পুষে, তিন-তিনটে মেয়ের বিয়ে আর ওই বৃহৎ সংসারকে রাজার হালে রেখেও কোঠাবালাখানা বানানো হয়েছে, আর তোদের বাপ-বেটাতে মিলে দুটা বেটাছেলের মুরোদে ভাতের ওপর মাছ জোটে না। ওদের ছাড়াবার কথা আর কোনওদিন আমার সামনে বলিসনি বলে দিচ্ছি।
অপমানে চোখমুখ লাল হয়ে গেলেও সেই অপমানটাই ঝেড়ে ফেলবার জন্যে নিত্য একটু কড়া হাসি হেসে বলে, ঠিক আছে, তবে কিন্তু বলে রাখছি তোমার চিতায় ওই তিনটেকে তুলে দেব।
দিবি তা জানি। মা-বাপ বুড়ো হলেও আপদ বালাই ভাববি তোরা। তবে জগতের সার কথা, শুনে রাখ–ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে। গোবর, তোমারও এদিন আছে।
ঘরশোভার মেয়ে বউরা ভেবে পায় না, যাকে যা-খুশি বলার সাহস মা পান কোথায়!
কাটিহার থেকে দিব্যময়ী এল একবার কলকাতার ভাগ্নের বিয়েতে। এসে মাকে দেখে ছলছল চোখে বলল, সাত বছর আগে যে অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি, ঠিক তেমনি দেখছি, অহরহ ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি মা, তিনি যেন তাড়াতাড়ি তোমায় কোলে তুলে নেন।
ঘরশোভা তাঁর সেই ছুরিকাটা মুখটা কুঁচকে বলেন, কেন? ভগবানের কাছে আর কোনও প্রার্থনা নেই তোমার? স্বামী-পুত্তুরের আয় উন্নতির প্রার্থনা করগে বাছা, মায়ের জন্যে আর প্রার্থনা করতে হবে না।
মেয়ে অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে যায়।
ঘরশোভা হাঁক ছাড়েন, নাতবউ, অ নাতবউ, বাজারে আজ ইলিশ মাছ আনতে দে। ছোট পিসশাউড়ি ইলিশ ভালবাসে।
এইভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন ঘরশোভা।
দিব্যও যাবার আগে একবার কথাটা তুলল, দিদি বলছিল, তুমি নাকি তোমার গয়না টয়না ভাগ করে দিচ্ছ, তা আমাকে যেটা দেবে, দিয়েই দাও না-হয়। আমার তো এই পাঁচ-সাত বছরে আসা
ঘরশোভা হঠাৎ ঝংকার দিয়ে ওঠেন, সব শেয়ালের এক রা। গয়নাগাঁটি কিছু নেই আমার যাঃ।
চলে যাবার সময় দিব্য ভাইদের কাছে বলে, মায়ের কপালে এখনও অশেষ ভোগান্তি আছে মনে হচ্ছে। একশো বছরই পার করবেন উনি।
তারপর হিসেব হয়, আর কত বাকি আছে তার?
আর চারটে বছর পার করলেই নাকি
কিন্তু সেই চারটে বছর আর পার করলেন না ঘরশোভা। দিব্য যেদিন চলে গেল তার পরদিনই হঠাৎ মাঝরাত্রে একটা তীব্র চিৎকার করে উঠলেন ঘরশোভা, নিয়ে গেল, নিয়ে গেল, সব নিয়ে গেল।
ধড়মড় করে উঠে এল সবাই, মাকে দেখার আগে দরজাগুলো দেখল, লোহার সিন্দুকের দরজা দেখল, তারপর বলল, মা, স্বপ্ন দেখছিলে?
স্বপ্ন?
ঘরশোভা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, তাই বল! ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল।
সত্য বলল, এখনও তুমি বিষয়-চিন্তা কর কেন ঠাকুমা? ভগবানের নাম করে ঘুমোবে।
ঘরশোভা বড় নাতির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, করি বইকী! রোজই তাঁকে জিজ্ঞেস করে শুই, কবে এদের ছুটি দেবে?
শুনে সবাই চমকে উঠল।
ঘরশোভার মুখে এ ধরনের কথা এই প্রথম।
তবে কি সত্যিই এবার দিন ফুরোবার আশা হবেই?
সত্য একটু কাছাকাছি গিয়ে বলে, আমাদের ছুটির কথা কে বলছে গো বুড়ি? তোমার কথাই হচ্ছে।
আমার কথা?
ঘরশোভা হাত দুটো একটু জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলেন, সে চাওয়া আমি চাইব কোন মুখে? আমার তো তিনি কোনও খাটুনি দিচ্ছেন না, তাই ছুটি চাইব!
ভাল যুক্তি, বলে সত্য শুতে চলে যায়। একে একে ছেলে বউরাও চলে যায়। সকলেরই শ্রান্ত ক্লান্ত শরীর। হাই উঠছে।
তবু রাজু সুহাসকে সতর্ক করে দিয়ে যায়, দেখো যেন আবার স্বপ্ন-টপ্ন দেখে ভয় না পান। খাট থেকে পড়ে না যান।
মাজা-ভাঙা সুহাসিনী আশ্বাস দেয়, দেখব, দেখব, তোমরা শোওগে তো দাদাবাবুরা!
স্বপ্ন অবিশ্যি আর সে রাত্রে দেখলেন না ঘরশোভা, তবে সকালবেলা একটু বৈলক্ষণ্য দেখা গেল।
নাতবউরা যখন কী কুটনো হবে ঠাকুমা? বলে হাঁক পাড়ল, ঘরশোভা বললেন, যা আছে দেখেশুনে কুটে নাও ভাই!
বাঃ, আমরা কী করব? আমাদের বাবা ওসব মাথায় আসে না।
মাথায় তো নিতে হবে? বুড়ি কি চিরকাল থাকবে?
আমরা তো তাই ধরে নিয়েছিবলে ওরা হাসতে হাসতে আলু ছাড়াতে থাকে।
ঘরশোভা আর রোজের মতন ওদের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকেন না, বলে ওঠেন না, ও কী ছিরির সুক্ত কোটা হচ্ছে নাতবউ? আনাজ অত কুচোলে ঘন্ট হয়ে যাবে যে!
সারাদিনই কেমন যেন একটা ছটফটে ভাবে কাটালেন ঘরশোভা, তারপর সন্ধের দিকে তিন ছেলেকে ডাকলেন।
বললেন, এ ঘরে কাউকে আসতে বারণ করো, নির্জনে দুটো কথা বলতে চাই তোমাদের। এ তোমাদের বাপের কলঙ্কের কথা, এ তোমাদের কাছে বলার ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু না বলেও পারছি না, বলা দরকার।
বাপের কলঙ্ক শুনেই তো ছেলেদের টাকে ঘাম ফুটে উঠেছে। জগু তাড়াতাড়ি বলে, থাক থাক, ওসব কথায় কাজ কী? বাবা স্বর্গে গেছেন।
তা জানি!
ঘরশোভা আস্তে বলেন, কিন্তু ভেবে দেখছি প্রকাশ না করলে তোমাদের প্রতি অবিচার করা হবে। আমার মরণের পর পরস্পর পরস্পরকে সন্দেহ করবে তোমরা, তাই প্রকাশ করাই ঠিক করলাম। শোনো, আরও কাছে এস
প্রায় গায়ে কাঁটা দেওয়া অবস্থায় মায়ের বিছানার কাছে সরে এল ওরা।
ঘরশোভা গলা নামিয়ে বললেন, চিরদিন তোমরা জেনে এসেছ, আমার বাক্স-ভর্তি সোনাদানা আছে। আমিও সেই কথাই জানিয়ে এসেছি, আজ সত্যি কথা বলি বাক্সয় কিছু নেই।
কিছু নেই।
একটা যেন আর্তনাদ ওঠে।
ঘরশোভা চুপি চুপি বলেন, না, কিছু নেই, সব ভোঁ ভোঁ ফাঁকা।
কিন্তু মা! বাবার কথা কী বলছ?
সেই কথাই বলছি–
ঘরশোভা একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলেন, শেষ বয়েসে তেজারতির কারবারে নেশা লেগে গিয়েছিল মানুষটার, লাভও হচ্ছিল যথেষ্ট, ওই লাভ থেকেই এল লোভ। একদিন গভীর রাত্তিরে আমায় ঘুমন্ত ভেবে আস্তে আস্তে লোহার সিন্দুক খুলে বাক্সে উপুড় করে যাবতীয় গয়না ঢেলে নিয়ে পুঁটলি বেঁধে থলিতে তুলে রেখে আবার বাক্সে পুরে ফেলে ভাল মানুষের মতন বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। …জেগেই ছিলাম, কিন্তু পাথরের মতন হয়ে গিয়েছিলাম। গলা বুজে গিয়েছিল, নিশ্বাসও যেন পড়ছিল না। মনে হল মানুষটা যেন একটা খুন করে হাতের রক্ত মুছে ফের শুল। উনি ভাবলেন, আমি গভীর ঘুম ঘুমোচ্ছি। আমিও তাই ভান করলাম। শুধু সেই রাত্তিরটুকুই নয়, যাবৎকাল তিনি ছিলেন, ওই ঘুমের ভান করেই কাটিয়েছি। কখনও বলিনি, আমার গয়না! খুলে বার করে দাও তো–
ঘরশোভা একটু থেমে আবার বললেন, শুনতে তোদের কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি, চিরকাল একরকম জেনে এসেছিস, কিন্তু মারা কিছু যাবে না তোদের, কাগজপত্রে সব আছে। এতটুকু এদিক-ওদিক করিনি, ওনার সুদি কারবারের যত হ্যান্ডনোট, পোদ্দারের দোকানের কাগজ, বুঝি না বুঝি–কিছু ফেলিনি। এতাবৎ যত্ন করে রেখে দিয়েছি। এবার সে সব নিয়ে দেখেশুনে যা করার কর। তবে একটা কথা বলে রাখি, গয়নাগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে, যাকে যেমন দেবার কথা বলেছি, দিবি, আমার কথার খেলাপ যেন না হয়।
রাজু ব্যাকুল গলায় বলে, এতদিন পরে সে সব কোথা থেকে পাব মা?
ঘরশোভা স্বভাবগত তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে বলে ওঠেন, কোথা থেকে আবার? যেখানে আছে, সেখান থেকেই। নাম ঠিকানা সমস্ত সবই তো লেখা আছে।
কিন্তু সে কি আজকের কথা মা? এখন কি আর দেবে–কেউ?
দেবে না মানে? ঘরশোভা রেগে বলেন, লেখার কড়ি বাঘে খায় না, বুঝেছিস? যার দেবার তার ঘাড় দেবে। আর নগদ টাকাও আছে ঢের, কর্জর টাকা উদ্ধার করতে যদি দেরি হয়, ওই টাকা থেকেই সোনাগুলো ছাড়িয়ে নিবি, বিলম্ব করিসনি। ঝিবউ সবাই প্রত্যাশা করে বসে আছে!
মার এই কথায় ছেলেরা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না, রুদ্ধকণ্ঠে বলে, কিন্তু কোথায় সে সব কাগজ?
আছে, সব আছে।
আছে বইকী, ঘরশোভার বিশ্বাসের মধ্যে আছে, চৈতন্যের মধ্যে আছে, নিশ্চিন্ততার মধ্যে আছে।
কিন্তু এদের জন্যে হতাশ নিশ্বাস ছাড়া আর কী রইল?
সেই নিশ্বাস ফেলে জগু বলে, একটা কথা তোমায় বলি মা, কারুর টাকা তার অবর্তমানে ব্যাঙ্ক থেকে তোলার অনেক ঝকমারি। তুমি যদি সময় সুবিধেমতো টিপছাপ দিয়ে ওটা তোলার ব্যবস্থা করে দাও
সময় সুবিধেই বলে জগু। মার সময় অফুরন্ত, এটাই যে জানা হয়ে গেছে তাদের।
কিন্তু ঘরশোভা ছেলেদের তাণ্ডব করে বললেন, ব্যাঙ্কে ট্যাঙ্কে কিছু নেই বাবা, বাড়িতেই আছে। মরণের দিনই তো নিয়ে এসে আমার হাতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যেতে বসেছি পুন্যির মা, এই যত যা পারি উদ্ধার করে এনে দিলাম। ব্যাঙ্কে আর কে রাখতে গেছে?
ব্যাঙ্কে নেই! বাড়িতেই আছে।
তিনটে হাপর থেকে যেন তিন ঝলক আগুনের ঝলক বেরোল। এত কষ্ট যাচ্ছে তাদের, ক্রমশই দিন চলা ভার হয়ে উঠেছে, সে দৈন্য দারিদ্র্য দেখতেও পাচ্ছেন ঘরশোভা, অথচ অনেক টাকা বাড়িতেই আছে। কোথায় আছে সে বস্তু? লেপের চালিতে দেয়ালের গহ্বরে? না কি ওই লোহার সিন্দুকটার মধ্যেই? যার চাবিটা একদিনের জন্যেও ঘরশোভা কোমরের ঘুনসিছাড়া করেননি।
সেই অনেকটা কতখানি?
কাণ্ডজ্ঞানহীন অবোধ ঘরশোভা কতটুকুকে অনেক বলছেন?
ছেলেরা কষ্টে বলে, কত সময় কত অভাব অসুবিধে গেছে
জানি বাবা, ঘরশোভা সস্নেহে বলেন।
অনেক সময়ই মনে হয়েছে, দিই বার করে, কিন্তু মনের জোর করে চেপে রেখেছি, ভেবেছি, অভাব বস্তুটা তো কুম্ভকর্ণের হাঁ-এর মতো, খেয়েই বলে, আর কই? তবে এমন সময় দেব যাতে মায়ের অভাবটার একটু লাঘব হবে।একটু হাসলেন ঘরশোভা,তোরা যখন ছোট ছিলি, তোদের ফেলে রেখে কোথাও বেড়াতে গেলে যেমন খেলনাপাতি দিয়ে ভুলিয়ে রেখে যেতাম।
রাজু একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, একটা রূপকথার গল্প শোনালে মা। কিন্তু একবারও যদি সে সব কাগজপত্র দেখাতে
ঘরশোভা আস্তে বলেন, বলি বলি করেও পারিনি বাবা, কথায় বলে–পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম–সেই পিতাকে তোদের সামনে ছোট করে দিয়ে, আমি কোন মুখে আবার বড় মুখ করে দাঁড়াব তোদের সামনে? আমার সমুখে বসে তোরা যে ভাববি, আমাদের বাবা সুদখোর ছিল, চোর ছিল, সে আমার সইত না।
ক্লান্তিতে চোখ বুজলেন ঘরশোভা, তারপর আস্তে বললেন, এখন বলছি, তার কারণ, টের পাচ্ছি আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে–হঠাৎ মরে গেলে, তোরা জানতে পারবি না কোথায় কী! সিন্দুক খুলে যখন দেখবি সব ফাঁকা–তখন অবাক হয়ে একে অপরকে সন্দেহ করবি। ভাইয়ে ভাইয়ে মনোমালিন্য আসবে। আর কাউকে বলার দরকার নেই, শুধু তোমরা তিন ভাই জানলে
কথা বলতে বলতে হঠাৎ যেন ঘুমিয়ে পড়লেন ঘরশোভা।
তিন চেলেই ব্যস্ত হয়ে ডাকল, মা মা! টাকাটা কোথায় বললে?
ঘরশোভা আর উত্তর দিলেন না। শুধু একবার ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। আবার চোখ বুজলেন।
শেষরাত্রে মারা গেলেন ঘরশোভা দেবী। ছিয়ানব্বই বছরে পা দিয়ে।
দাহটাহ করে এসে তিন ভাইয়ে যখন ঘরে প্রদীপ জ্বেলে নিয়ে বসেছে, রাজু বলল, কিন্তু মা চিরকাল ওই গয়নাগুলোর গল্প করলেন কেন তাই ভাবছি।
জগু বলল, প্রাণ থেকে তো তাদের হারাননি, ভেবেছেন সব আছে।
পানুই শুধু বলল, তা মনে হয় না। মনে হচ্ছে ওই গয়নার বাক্সটাকেই পায়ের তলার মাটি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন মা।
ও কথা থাক…একটা কথা–রাজু বলে, মা চিরদিন বাবার দোষের কথা চেপে থাকলেন। আমরা যেন আমাদের মার এই কথা ব্যক্ত করে না বসি। লোকে জানুক কবে কখন সিন্দুক থেকে চুরি গেছে!
পানু বলে ওঠে, দিদিরা বলবে, আমরাই চুরি করেছি, আর বউরা ভাববে—
যে যা ভাবে ভাবুক।
ঘরশোভার বড় ছেলে বলে, মায়ের নামে বদনাম সইব না।
কিন্তু নগদ টাকাটা?
সেটা কোথায় খোঁজা হবে? বাড়ি তো এখন লোকে লোকারণ্য।
ঘরশোভার তিন মেয়েই এসে গেছে, এসেছে তাদের স্বামী-পুত্তুর নাতি-নাতনি। ঘরশোভার ছেলেদের বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েরাও এসেছে। আর সকলেই এখন উলটো গাইছে পালঙ্কটার দিকে তাকানো যাচ্ছে না।…নামে রূপে এক ছিলেন তো, এই একশো বছরের কাছে এসে, তবু রং যেন জ্বলত।
পুণ্য আবার একথাও বলল, এই তো দু দিন আগে গেছি, কত তোয়াজ করে ভাত খাচ্ছেন, এত শিগগির চলে যাবেন, তা ভাবিনি।
সবাই তো এই দালানেই, কোন ফাঁকে তবে খোঁজাখুঁজি করা যাবে?
তা ছাড়া–যারা এসেছে সবাই তো ঘরশোভার সিন্দুক খোলার অপেক্ষায় উৎসুক, কী বলা হবে তাদের?
জগু বলল, বলার কী আছে? সবাইয়ের সামনে খোলা হোক, দেখুক!
হল খোলা।
কিন্তু সবাই তো আর ঘাসের বিচি খায় না? আর ভাগীদারের আড়ালে ভরা বাক্সখানি হাট করে রেখে, তাদের সামনে খালি বাক্স দেখানোর ঘটনাও জগৎ-সংসারে কিছু নতুন নয়।
শ্রাদ্ধ পর্যন্ত আর এ বাড়িতে রইল না মেয়েরা। পুণ্য বলে গেল, খুব দেখালি যা হোক তোরা! তবে তোরা যে এত ছোটলোক হতে পারবি, তা ভাবিনি।
আলো বলে গেল, ভগবান আমার কিছু অভাব রাখেনি, মার একখানা গয়না–পেয়ে রাজা হয়ে যেতাম না, তবে মার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রাখতাম।
আর দিব্য বলে গেল, ছেলেদের ফাঁকি দিয়ে যদি বড়লোক হতে পারিস তোরা, তবে হ।
কিন্তু ঘরশোভার নাতিরাও যে তাদের বাপ কাকাকে সন্দেহ করছে। নাতবউরা শাশুড়িদের।
কে যে নাটের গুরু, তা বুঝতে পারছে না কেউ।
একটি মিথ্যার জাল দিয়ে সমস্ত সংসারকে বেঁধে রেখেছিলেন ঘরশোভা, সেই জালটা ছিঁড়ে পড়েছে।
সেদিন সন্ধেবেলা দরজা বন্ধ করে ওই কর্মই হয়েছে বোধ হয়–সত্য আর নিত্য বলে, পাছে কাউকে ভাগটাগ দিতে হয়, তাই রাতারাতি সরানো হয়ে গেছে আর কি!
কী এত কথা হল মার সঙ্গে? সেদিনই এ প্রশ্ন করতে মলিনা, সরস্বতী আর পঙ্কজিনীর মুখ ব্যথা হয়ে গেছে, জবাব আদায় করতে পারেনি তারা নিজ নিজ স্বামীর কাছে–তারপর কথা বন্ধ করেছে। ভাইয়ে ভাইয়ে এত ভাব? স্ত্রীর থেকে ভাই বেশি আপনার হল?
কিন্তু ঘরশোভার ছেলেরা অটল।
শুধু নিজেরা নিজেরা নিভৃতে বলাবলি করে, নগদ টাকাটার কথা ভুলের কথা বলেই মনে হচ্ছে। মৃত্যুকালে কিছুটা ভুলভাল তো হবেই। সিন্দুকের গোপন ঘরদোর সবই তো দেখা হল।
কিন্তু একটা জায়গা দেখা হয়নি, সেটা হচ্ছে ঘরশোভার সেই তিন হাত উঁচু পালঙ্কের খান চার-পাঁচ গদির সব নীচের গদিটার তলা।
অশৌচান্তের সময় উপরকার গদি তোশক সব ধধাওয়া কাঁচা হয়েছিল, তলার সেই বীরভদ্রটা আর তোলা হয়নি। হল–যেদিন আবার খাট খোলাতে ছুতোর এল।
আর তো দালান জোড়া করে এই ময়ূরপঙ্খী পালঙ্ক রাখার মানে হয় না।
গদি তোলার সঙ্গে সঙ্গে মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল গোছ গোছ হাজার টাকার নোট, আর জীবনবল্লভের তেজারতি কারবারের গোছ গোছ হাত-চিঠ, হয়তো বা পোদ্দারের দোকানের কাগজও।
কুড়িয়ে কুড়িয়ে এনে দিচ্ছিল নিত্য; পানু হাত নেড়ে বলল, ফেলে দাওগে। ওসব আর কাজে লাগবে না, ভেঁড়া কাগজ হয়ে গেছে।
হাত-চিটগুলো?
তামাদি হয়ে গেছে।
কম দিনের ব্যাপার তো নয়!
মা চলে গেলে, মার বদলে ছেলেরা ভাল কিছু পাবে এই আশায় এ সব মন্ত্র-গুপ্তি করে রেখে দিয়েছিলেন ঘরশোভা।
তা ছাড়া টাকা-পয়সার ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস নেই এই ধারণাটা কবে কোনদিন বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল ঘরশোভার ভিতরে, কে জানে?
সেই একটা রাত্রিরে কি?
যে রাত্তিরে ঘরশোভার মনে হয়েছিল, পাশের মানুষটা চুপিচুপি বিছানা থেকে উঠে, যেন একটা খুন করে এসে হাতের রক্ত মুছে আবার শুয়ে পড়ল!
আশ্চর্য, অথচ তার উপর ভক্তি কমেনি, ভালবাসা কমেনি। এ একটা রহস্য!
শুধু মানুষের প্রতি অবিশ্বাসের ওই বদ্ধমূল ধারণাটা বসে রইল জীবনের শিকড়ে। কিন্তু একবারের জন্যেও যদি আপন বুদ্ধির উপর অবিশ্বাস আনতেন ঘরশোভা!
তা হলে একেবারে মূল্যহীন হয়ে যাওয়া ওই ভয়ংকর মূল্যবান জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জোরে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করত না ঘরশোভার ছেলেদের। যে দেহটাকে কিছুদিন আগে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে এসেছে, তার পায়ে মাথা খুঁড়ে বলতে ইচ্ছে করতনা মাগো, এ তুমি কী করেছ বসে বসে?
নাতিরা জনে জনে এক একবার করে জিনিসগুলো উলটেপালটে দেখে বুঝতে চেষ্টা করে, কোনওখানে কিছু আশা আছে কি না।
নাঃ! আশা নেই।
চম্পাকলির গাছতলায় বসা উকিল বর ভাল করেই বুঝে নিয়েছে একথা। বুঝিয়েও দিয়েছে সবাইকে।
মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে, তবু স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে ঘরশোভার তিনটি প্রৌঢ় পুত্র। কতকাল যারা ভাল করে টাকা চোখে দেখেনি, আর যাদের মা মনে মনে ভেবে রেখেছে-দেখাব, আমি মরে গেলে দেখাব।
সেই টাকাগুলো গড়াগড়ি যাচ্ছে সামনে।
কিন্তু ওই অসম্ভব জায়গাটায় গেল কী করে জিনিসগুলো? রাখল কে? ঘরশোভার তো কোমর তোলবারও ক্ষমতা ছিল না। সুহাসের মুখটা অমন ল্যাপাপোঁছা কেন? যেন এই অদ্ভুত ঘটনাটা দেখেও দেখছে না সে। কিন্তু মাইনেকরা ঝিকে কি ডেকে ঘরের কথা জিজ্ঞেস করা যায়? মান নেই সম্ভ্রম নেই?
হঠাৎ পঙ্কজিনীর বড় ছেলে মুখ বাঁকিয়ে বলে ওঠে, সেই যে কী বলে, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী না কী! এইজন্যেই বলে। বিদ্যেবুদ্ধিহীন স্বেচ্ছাচারী একজন মেয়েমানুষের হাতে অর্থ আর ক্ষমতা এলে যে কী হয়, এটা তার প্রমাণ।
হঠাৎ যেন একসঙ্গে তিন তিনটে বাঘ গর্জে উঠল, খবরদার!
উপস্থিত সবাই চমকে উঠল।
আর ওই বাঘেদের মধ্যে থেকে একজনের কণ্ঠে উচ্চারিত হল, আমাদের মায়ের সম্পর্কে আর একটা কথা উচ্চারণ করলে জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব।
ঘরশোভার ছেলেদের মুখে এমন কটু গালি কেউ কোনওদিন শোনেনি।
ঘরশোভার নাতিরা বাপেদের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে চলে যায়, আর ঘরশোভার ছেলের বউরা ক্ষুব্ধ জ্বলন্ত ঈর্ষাকাতর একটা দৃষ্টি মেলে দালানের কোণের একটা প্রকাণ্ড শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেখানে প্রায় বিশ বছর ধরে একটা জগদ্দল পালঙ্ক একটি অশক্ত দেহকে অঙ্কে নিয়ে বিরাজ করেছে।
কোন শক্তির বলে এই বিরাট ঐশ্বর্য অর্জন করেছিলেন ওই পালঙ্কশায়িনী?