Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চাঁদের জানালা || Ashapurna Devi » Page 3

চাঁদের জানালা || Ashapurna Devi

অথচ সেই অপরাধিনী তখন কোনওমতে একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি ফিরে গিয়ে বিছানায় পড়ে কেঁদে ভাসছে।

গৌতম যে এত নির্মম হতে পারে এটা কি স্বপ্নেও কোনওদিন ভেবেছে টুনু?

শুধুই কি নির্মম? কুটিল নয়?

কুটিল না হলে কী করে ভাবতে পারল সে, টুনু টাকাটা করায়ত্ত করতে

টুনু আর ভাবতে পারে না। কেঁদে কেঁদে সর্দি হয়ে যায় টুনুর।

প্রসেনজিৎ হা হা করে হেসে ওঠে, তুমি একটি পাগল! তোমার বদলে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে সে?

গৌতম গম্ভীর হিংস্র গলায় বলে, কেন চাইবে না? তার তো দরকার একটা পাত্র, যাতে সে

তা হলে আমিই বা কেন? অজস্র পাত্র আছে জগতে। বিশেষ করে ধনবতী কন্যের জন্যে। একটি বিজ্ঞাপন ঝাড়লেই ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ঘেঁকে ধরবে।

তা জানি! তবু গৌতমের রাগে শিরা ফুলে ওঠে। গৌতম চড়া গলায় বলে, হঠাৎ এই মুহূর্তে তোকে দেখে মনে হল, এরকম একটা লাভের ব্যাপার, যে কেউ এসে লুঠে নেবে, তুই বা নয় কেন?

প্রসেনজিৎ বলে, আমার মনে হয়, তুই কোথাও একটু ভুল করছিস।

কোথাও কোনও ভুল নেই, গৌতম কটু গলায় বলে, জলের মতো পরিষ্কার। বললাম তো সবই। বিয়ে না করলে টাকাটি হাতে পাচ্ছে না, অথচ বাপের চাড় নেই মেয়ের বিয়ে দেবার। তাই সাবালিকা হওয়া মাত্রই উঠেপড়ে লেগে গেছে।

প্রসেনজিৎ হতাশ গলায় বলে, জানি না বাবা! বরাবর জানি মেয়েগুলো একটু মহৎ আর নির্বোধ হয়, তারাও যদি এরকম মতলববাজ হয়ে ওঠে

মেয়েগুলো মহৎও নয়, নির্বোধও নয়, ওরাই হচ্ছে সব থেকে বিচ্ছিরি গৌতম বলে, আমি ওদের চিনে ফেলেছি। জাতটাই বাজে।

প্রসেনজিৎ আহত গলায় বলে, ওভাবে বলতে হয় না গৌতম! মেয়েদের মধ্যে আমাদের মা আছেন।

গৌতম প্রসেনজিতের দিকে তাকায়।

প্রসেনজিতের মুখে চোখে পরিচ্ছন্ন একটি শ্রদ্ধা আর সারল্য। যেন যেখানে মা আছেন, সেখানে আর কোনও কথা পৌঁছতে পারে না। বিরূপতার নয়, নিন্দার নয়, সমালোচনার নয়।

কারণ প্রসেনজিতের সত্যকার মা আছেন।

সত্য ধ্রুব, অচঞ্চল নিশ্চিত।

প্রসেনজিৎকে স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উঠে শূন্যতার গহ্বরে পা ফেলে শিউরে উঠতে হয় না।

একটু আগেই প্রসেনজিৎ বলেছে, একটু পরেই দমদমে চলে যাচ্ছি। আর দুদিন মাত্র আছি, মার কাছে না খেয়ে যদি এখানে-ওখানে খেয়ে বেড়াই, মা আস্ত রাখবে না।

মা আস্ত রাখবে না।

অবলীলায় বলল কথাটা প্রসেনজিৎ।

যেন পকেট থেকে পাঁচটা খুচরো কাগজের সঙ্গে ব্যাঙ্কের পাশ বইটাও বার করে টেবিলে ফেলে রাখল। যে পাশ বইটায় ওর সম্পত্তির প্রমাণপত্র রয়েছে।

গৌতম কি তা হলে প্রসেনজিৎকেও ঈর্ষা করবে? যেমন করেছিল টুনুকে। না কি গৌতম নিজের অকিঞ্চিৎকরতায় মাথা হেঁট করবে?

গৌতম মাথাই হেঁট করল।

আপন মন্তব্যের লজ্জায় নয়। আপন ভাঁড়ারের শূন্যতায়।

প্রসেনজিৎ বলল, আমি বলছি তুই একবার যা মেয়েটার কাছে।

আমি? অসম্ভব। এই ঠিকানা দিচ্ছি, তুমিই চলে যাও। দেখবে তুমি যদি কালই বিয়ে করতে রাজি থাকো, ও কালই বিয়ে করে ফেলবে। জানিস, ও আমার বয়েসের ঘাটতির জন্যে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে ঘুষ দেবার প্রস্তাব করছিল।

তাই নাকি? তা হলে কি তোর থেকে বয়সে বড়?

সে যৎসামান্য।

ওই যৎসামান্যই আমাদের চোখে অসামান্য। বাঙালি গেরস্ত ঘরের ছেলে, জানি ছাঁদনাতলায় দাঁড়িয়ে বর বড় না কনে বড় বলে সবাই মিলে ধরেটরে কনেটাকে উঁচু করে বড় বড় খেলা করতে হয়। তা নয়, কোথাকার কোন এক চুনবালি খসা ভ্যাপসা দেয়াল ঘরে, পচা টেবিলের ধারে বসে নিজের থেকে বয়সে বড় একটা মেয়ের সঙ্গে একসঙ্গে একটা শুকনো কাগজে সই করে বললাম, এবার চলো আমরা একটা হোটেলের ঘর খুঁজে বাসর করি গে। ছিঃ। এ আবার বিয়ে নাকি?

গৌতম প্রতিবাদের সুরে বলে, তা যে হতভাগ্যদের ছাঁদনাতলা পাতবার অথবা বাসর সাজিয়ে দেবার লোক নেই, তারা কী করবে?

তারা? তারা ওই মধুর অভাবে গুড় নাকি বলে, তাই করবে আর কী।…কথাটা মা যখন-তখন বলে, বুঝলি? আগে মানে বুঝতাম না, এখন বেশ বুঝি। শিবপুরে চান্স না পেয়ে যখন খগপুরে চলে যেতে হল, মনে হল–

প্রসেনজিতের কথার ধরনটা বরাবরই এইরকম, যখন-তখন মা কী বলে–তার উদাহরণ দেয়।

ছেলেবেলা থেকেই প্রসেনজিতের এটা অভ্যাস। কিন্তু এখন গৌতমের মনে হল ও যেন ইচ্ছে করে মার কথা তুলছে।

তার মানে নিজের ঐশ্বর্য মেলে ধরে দেখাচ্ছে। গৌতমের রাগ এসে গেল।

গৌতম গম্ভীরভাবে পকেট থেকে একটা নোটবই বার করে তার একটা পাতা ছিঁড়ে ওর হাতে দিল।

গৌতম ইচ্ছে করলেই ওটা টুকে দিতে পারত, তবু ছিঁড়েই দিল। যেন নিজের বুক পকেট থেকে নয়, বুক থেকেই টুনু নামের ঘুঘু মেয়েটার ঠিকানাটা ছিঁড়ে ফেলে দিল।

কী এটা? বললে প্রসেনজিৎ।

ঠিকানাটা! যেখানে পাত্র চাই।

দুর! ও আমি নিয়ে কী করব? বলে প্রসেনজিৎ কাগজটার দিকে তাকিয়ে দেখে বলে, আরে এ তো দেখছি আমার ছোটমাসির বাড়ির পাড়ায়। ছোটমাসির সঙ্গে একবার দেখা না করে গেলে মা রসাতল করবে।…তবে দে, তোর সেই মহিলাটিকে একবার দেখেই আসি। দেখলে বুঝতে পারব তোর ধারণা ভুল না ঠিক।

একদিন দেখলেই চিনে ফেলতে পারবি? নিজের প্রতি এত আস্থা? গৌতম তীব্র গলায় বলে, আমি তিন বছর ধরে দেখছিলাম–

তুমি অন্ধ চোখে দেখছিলে–বলে নোটবুকের ভেঁড়া পাতাটুকু সাবধানে ভাঁজ করে সযত্নে পকেটে পুরে প্রসেনজিৎ বলে, আচ্ছা চলি।

তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোয়।

প্রসেনজিতের ওই স্বভাব, সব কিছুতেই যত্ন, সাবধানতা, পরিপাটি। কিন্তু গৌতমের এখন হঠাৎ ওইটা দেখে খুব হাসি পেল। ওঃ, তবে নাকি তুমি উড়িয়ে দিচ্ছিলে! তবে নাকি তোমার লোভ নেই! এই তো বাবা, ঠিকানাটি পেলে, আর দরকারি দলিলের মতো সাবধানে

প্রসেনজিতের উপর খুব একটা আক্রোশ আসে গৌতমের। ইচ্ছে হয় ছুটে ওর পিছন পিছন গিয়ে শার্টের কলার চেপে ধরে ওই কাগজটা কেড়ে নিয়ে বলে, খুব যে উদারতা দেখাচ্ছিলি রে শুয়ার!…আমি নিয়ে কী করব? আর যেই পেলি, চিলের মতো ছোঁ দিয়ে নিয়ে নিলি! খবরদার বলছি সেই রাস্তার মুখো হবি না তুই। এই ছিঁড়ে ফেলে দিলাম তোর সামনে। এবার কী করে যাস দেখি? না কি ইতিমধ্যেই মুখস্থ করে ফেলেছিস? তা তুই পারিস। তুইও একটি ঘুঘু।

হঠাৎ চটিটা পায়ে দিয়ে প্রসেনজিতের কাকার বাড়ির দিকে এগোতে থাকে গৌতম। বাড়িটা চেনা।

ওদের সেই পুরনো বাড়িটারই তো একাংশ।

প্রসেনজিতের খুড়তুতো বোন বলে, ওমা! এইমাত্র তো চলে গেল মেজদা। তাড়াতাড়ি গেলে বাসস্ট্যান্ডে ধরতে পারবেন। আপনাদের বাড়িতেই তো গিয়েছিল সকালে…ওকী, অমন করে ছুটছেন কেন? বাস তো কত দেরি করে আসে।

হি হি করে পিছনে হাসতে থাকে ফ্রক-পরা বেড়া-বিনুনি বাঁধা মেয়েটা। সময় হাতে থাকলে ঠাশ করে বড় একটা চড় ওর গালে বসিয়ে আসত গৌতম।

কিন্তু এত ছুটেও কিছু হল না।

হয়তো দেরি করেই আসে বাস, কিন্তু সেই দেরি-শেষের মহামুহূর্তটিই প্রসেনজিতের ভোগে এসে গেছে। গৌতম দেখল, মোড়ের ওখানে একটা বাস ঘুরে চলে গেল। তার মানে গৌতমের বিশ্বাসঘাতক বন্ধুটাকে বুকে করে নিয়ে গেল। যে পাজিটা গৌতমের একটু অসতর্কতার সুযোগে গৌতমের সবকিছু। চুরি করে নিয়ে পালাতে চায়।

গৌতম যদি এখনও পর্যন্ত তার মা-বাপের সঙ্গে সেই তেজপুরের বাড়িতে থাকত, গৌতম হয়তো বালকই থেকে যেত। কিন্তু গৌতম তা থাকতে পায়নি। গৌতমের বিধাতা তাকে খোলা মাঠে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। গৌতমের মন কেবল গভীরে শিকড় নামিয়েছে। তাই গৌতম কুড়ি বছর বয়েসেই অনেক বড় হয়ে গেছে।

গৌতম প্রেম, প্রতিহিংসা, ঘৃণা, অবিশ্বাস সবকিছুর মানে শিখে ফেলেছে।

গৌতম অতএব ভেবে অস্থির হয়ে যাচ্ছে, লোভী প্রসেনজিৎটা তার লোভার্ত হাত দুটো দিয়ে টুনুদের বাড়ির সেই ভারী লোহার গেটটা ঠেলে ঢুকছে।

তারপর ওই হাত দুটো টুনুকে বাড়িয়ে নেবে। আর নির্বোধ গৌতমের আহাম্মকির কথা ভেবে মনে মনে হাসবে।…নিশ্চয়ই হতভাগাটা নিজের পরিচয় দেবার জন্যে গৌতমের নাম করবে। বলবে, গৌতম আমায় পাঠিয়ে দিয়েছে। শুনলাম এখানে একটা ভেকেন্সি আছে–

হ্যাঁ, এইভাবে গুছিয়ে কায়দা করে পাড়বে কথাটা। চালাকের রাজা তো!

আমি নির্বোধ, আমি আহাম্মক! আমি মুখ্যু!

ক্রমশই প্রসেনজিৎকে সেই গেটটা দিয়ে ঢুকে এগোতে দেখতে পায় গৌতম।

বাগান থেকে ঘরে, ঘর থেকে সিঁড়িতে, সিঁড়ি থেকে দোতলায়।

প্রসেনজিতের কুকুরে ভয় নেই, তাই কুকুরটাকে আর বাঁধতে হচ্ছে না টুনুকে। টুনুর সঙ্গে কুকুরটাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। টুনু টেবিলের ধারে এসে বলছে, এই দেখো আমার মা।

মার ছবি বলে না টুনু, বলে, আমার মা।

ওই ছবিটাও ওর কাছে মার মতোই সত্য।

ছবির কথা ভাবতে টুনুর সেই জল টলটলে চোখটা মনে পড়ে যায় গৌতমের। টুনুর সেই হতাশ-উদাস কথাটা মনে পড়ে যায়, মা না থাকা যেন কিছুই না থাকা। স্বার্থপরের মতো মনে হয় কী জানো গৌতম, মা যদি চিরদিন বিছানাতেও পড়ে থাকতেন।

হঠাৎ সারা শরীরে প্রবল একটা আলোড়ন ওঠে গৌতমের। হঠাৎ টুনুর জন্যে ভয়ানক মন কেমন করে যায়।

যেন টুনু নামের একটা পুতুলকে আক্রোশে আছড়ে ভেঙে ফেলে ভাঙা টুকরোগুলো আর একজনকে বিলিয়ে দিয়েছে গৌতম।

অথচ ভারী সুন্দর ছিল পুতুলটা।

আমি তার কথায় কান দিইনি।

আমি তাকে নিষ্ঠুরের মতো কথা বলেছি। আমি টুনুকে অমন কড়া কথা বললাম কী করে?

টুনু কেন মতলববাজ হবে?

টুনু শুধু নিজের মনের মতো জীবনের স্বপ্ন দেখছিল। স্বপ্ন দেখবার সামর্থ্য টুনুর রয়েছে বলেই দেখছিল। এটা স্বাভাবিক। টুনুর অত ব্যস্ততার কারণ, হয়তো ওর বাবা ওর জন্যে অন্যত্র পাত্র খুঁজছে, হয়তো বিয়ের ঠিক করে বসে আছে। তাই টুনু অমন পাগলের মতো..ঠিক ঠিক।

আশ্চর্য, এই সহজ সরল কথাটা বুঝতে না পেরে আমি

ছি ছি। টুনু আমায় কত নীচ, কত ইতর ভাবল!

এরপর আবার যখন প্রসেনজিৎ গিয়ে বলবে, গৌতম আমায় পাঠিয়ে দিয়েছে, বলেছে এখানে ভেকেন্সি আছে।–তখন টুনু আরও কত নীচ নিষ্ঠুর ভাববে গৌতমকে!

প্রসেনটা গিয়ে পড়বার আগেই আমায় ওর কাছে পৌঁছে যেতে হবে। ওর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে আমায়।

দেরি করলে প্রসেনটা গিয়ে পড়বে।

লোভের দৃষ্টিতে টুনুর দিকে তাকিয়ে টুনুকে অপবিত্র করে ফেলবে।

আমি এক্ষুনি চলে যাব।

বলব, টুনু, আমরা আর দিন গুনব না, আমরা এখুনি দিনটা কিনে নেব। সেই একটা দেয়ালের বালি খসা ভ্যাপসা ঘরে ময়লা টেবিলের ধারে বসে চুক্তিপত্রে সই করা বিয়ের ধার ধারব না আমরা। আমাদের বিয়েতে শাঁখ বাজবে, কলাগাছ বসানো হবে, দুধের পাথর-টাথর সাজানো হবে।

এ সব আমি করতে পারব পিসিকে বলে। করবই! বলব, দেখ পিসি, কত ভাল মেয়ে টুনু। ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মায়নি বলেই কি অবহেলা করবে তাকে? তার মার ছবি দেখবে চলো তা হলে। দেবীর মতো মুখ।…টুনু কালো, হয়তো ওর বাবার মতো। দেখিনি ওর বাবাকে। কিন্তু সুন্দর বউ কী দরকার তোমাদের? দাদু তো একদা এনেছিলেন সুন্দর বউ, কী স্বর্গলাভ হয়েছে তাতে তোমাদের?

গৌতম একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসেছিল, গৌতমের পকেটে আজ কলেজে মাইনে দেবার টাকা ছিল।

ট্যাক্সির গদিতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে এ সব ভাবছিল গৌতম। গৌতম জানে, পিসি যতই পিতৃভক্ত হোক, সে ভক্তি ভয়ের ভক্তি। সে ভক্তি ক্রীতদাসদের অন্ধ আনুগত্য। দাদুর ওই কঠোরতার সঙ্গে পিসির হৃদয়ের যোগ নেই। পিসি গৌতমকে সমর্থন করবে। পিসি একটু শিথিল হতে পেলে বাঁচবে।

তা ছাড়া এও জানে, সুন্দর বউ না এনে কালো বউ এনেই খুশি হবে পিসি। কারণ, ওঁরা তো সেদিন বুঝেই ফেলেছেন, ভাবলে গৌতম। তাই সব শুনলে অবাক হয়ে যাবেন না।

শুধু আমাকে সাহস করে বলতে হবে।

বলতে হবে, তোমরা আমাকে চাও, না তোমাদের আচার-আচরণের খোলসটাকেই আঁকড়ে রাখতে চাও?

হয়ে যাবে। সব সোজা হয়ে যাবে।

শুধু যদি টুনু ইতিমধ্যে না কিছু করে বসে থাকে।

টুনু যা আবেগ-চালিত মেয়ে, ভয়ংকর কিছু একটা করে বসাও আশ্চর্য নয়। গৌতম মাথার চুলগুলো টেনে টেনে মাথায় ব্যথা ধরিয়ে ফেলে।

তা যদি হয়, নিজেকে আমি খুনি ছাড়া ভাবতে পারব না।

যখন হঠাৎ টুনুকে মতলববাজ ঘুঘু মেয়ে বলে মনে হয়েছিল গৌতমের, তখন যেন গৌতমের ভালবাসার ঘরটায় ছিটকিনি পড়ে গিয়েছিল, হঠাৎই আবার খুলে গেল সে ঘর। গৌতম মুঠো মুঠো করে ভালবাসা বার করে ফেলল টুনুর জন্যে।

টুনুকে আমি কোনওদিন আদর করিনি, আজ করব।

বীরের মতো প্রতিজ্ঞা করে ফেলল গৌতম। টুনু কতদিন ভীরু বলে হেসেছে। গৌতম সাহস সঞ্চয় করতে পারেনি।

হয়তো সেটাই দেবেন্দ্রনারায়ণের কঠোর নীতির একটু সার্থক ফল। সংস্কার শেকড় গেড়ে বসে আছে।

কিন্তু আজ গৌতম বড় একটা কিছু ত্যাগ করতে চায় টুনুর জন্যে। তাই ওই সংস্কারটাই ত্যাগ করবে। সেই ত্যাগের বিরাটত্ব কম নয়।

গাড়ি থেকে নেমেই গেটের দিকে তাকাল গৌতম।

একটু আগেই কি কেউ এই গেট ঠেলে ঢুকে গেছে ঘরে? কোথাও কি তার জুতো জোড়াটা ছাড়া আছে?

কোথাও কিছু দেখতে পেল না গৌতম।

তবে আসেনি।

তবে এখনও টুনু আরও এক নতুন অপমানের জ্বালায় ছটফট করছে না। গৌতম গিয়ে বলতে পারবে, টুনু, সেদিন তোমায় বোকার মতো কতকগুলো যা-তা কথা বলেছি। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ বিশ্রি রকমের একটা ভুল ধারণার বশেই অমন কাণ্ড করেছি। তুমি কিন্তু

.

খোকা চাকরটা গিয়ে খবর দিয়েছিল, বামুনদি নেমে এল। বলল, ভালই হল দাদাবাবু, আপনি এলেন। টুনু দিদি তো–

একটু আগে কেউ এসেছিল বামুনদি? আমার মতো বয়েস?

কই না তো? বামুনদি মাথা নাড়ে, আমি তো বরং কাল থেকে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি আপনারা যদি কেউ এসে পড়েন। নইলে মেয়েটাকে তো ওঠাতেও পারছি না, খাওয়াতেও পারছি না। কী যে হয়েছে, কাল সন্ধে থেকে সেই যে কান্না জুড়েছে, এখনও থামা নেই। কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছে।

কেঁদে কেঁদে! টুনু কাল থেকে শুধু কেঁদে কেঁদে সারা হচ্ছে!

তার মানে গৌতম খুনির থেকে কিছু কম নয়!

গৌতমের নীচতা, গৌতমের ক্ষুদ্রতা, গৌতমের নিষ্ঠুরতা দীর্ণ বিদীর্ণ করে ফেলেছে টুনুকে। গৌতমের ইচ্ছে করল নিজেকে ধরে ওই পাথর বাঁধানো উঠোনটায় আছাড় মারে।

তবু গৌতমকে নিজেকে সামলে নিতেই হয়। বলতেই হয়, কেন বলুন তো? কেউ মারা-টারা যাবার খবর এসেছে না কি?

অবোধ তো সাজতেই হবে।

বাইরের লোকের সামনে তো প্রকাশিত হওয়া চলবে না। বলে ওঠা তো যাবে না, বামুনদি, টুনুর এই কষ্টের জন্যে আমিই দায়ী।

অতএব অবোধ সাজা।

বামুনদি ওই সাজটাই দেখে। তাই অতিথিকে কোনও সন্দেহ করে না। বরং চুপি চুপি তার সামনে নিজের সন্দেহ ব্যক্ত করে।

মাথা নেড়ে আস্তে আস্তে বলে, না, সে সব কিছু না। বোধ হয় বাপের কীর্তি টের পেয়েছে।

ঠিক। ঠিক যা ভেবেছিল গৌতম।

জোর করে কোথাও বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছে বোধ হয় ওর বাবা। যাক, গৌতম তার আগেই একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলবে। গৌতম কিছু না পারে, টুনুকে নিয়ে গিয়ে পিসির হাতে ধরে দিয়ে বলবে, পিসি, আগে থেকেই এর ভার নাও। নইলে মেয়েটার দুঃখের শেষ থাকবে না।

গৌতম মনে মনে রিহার্সাল দিচ্ছে।

কিন্তু বামুনদি তো থেমে যায়নি।

বামুনদি যে গলা আরও নামিয়ে বলে চলেছে, মনিব তিনি, আমরা মাইনে করা লোক, কিছু বলা শোভা পায় না, কিন্তু আমি বুড়ি যে সেই দেবী প্রতিমাকে বলতে গেলে হাতে করে মানুষ করেছি। তার পরে তার সব শেষও করলাম। তাই প্রাণ পোড়ে। তা কর্তার কি আর এখন উচিত হচ্ছে অত বড় মেয়ে ঘরে বসিয়ে রেখে নিজে ঘরে বউ আনা।

গৌতমের রিহার্সাল ঝাপসা হয়ে যায়।

গৌতমের নির্ভুল কষা অঙ্ক উলটোপালটা হয়ে যায়।

মেয়ে ঘরে বসিয়ে রেখে নিজে ঘরে বউ আনা!

কে করতে বসেছে এমন কাজ? টুনুর বাবা?

টুনুর সমস্যা তা হলে আপাতত এই। তাই টুনু এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে চায়।

টুনুর জন্যে আরও একঘর মমতা জমা হল। আহা বেচারি টুনু, মনের মধ্যে দুঃখের পাহাড় নিয়ে হাসে, গল্প করে।

তারপর ভাবে, যেমন আমি।

আর সঙ্গে সঙ্গেই ভাবে, এই আবার একটা বাড়তি কষ্ট টুনুর।

টুনুর টেবিলে রাখা টুনুর মায়ের সেই দেবীপ্রতিমার মতো মুখটি মনে পড়ল গৌতমের।

গৌতম আস্তে বলল, ওকে একবার ডেকে দেবেন?

বামুনদি নিশ্বাস ফেলে বলে, দেখি কাল থেকে তো ডেকে ওঠাতে পারিনি। বাপ দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে করে, সম্মা ঘরে আসে, এ ঘটনা অবিশ্যি জগতে নতুন নয়। কিন্তু এ যে বড় লজ্জার।…কোথাকার কোন এক ফ্যাশানি বিধবা মাগীকে নাকি বিয়ে করবার জন্যে ক্ষেপেছে! ঘরে-পরে মুখ থাকবে?…এই লজ্জাতেই বোধহয় বাছা–

বামুনদি চলে যায়।

গৌতমকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে রেখে যায়।

গৌতম এখন কী করবে? ক্ষমা চাইবে, না সান্ত্বনা দিতে বসবে? নিজেকে ধিক্কার দেবে, না টুনুর বাপকে?

মনের বীণায় একটিমাত্র তার বেঁধে এনেছিল গৌতম, একটি মাত্র সুর। সে সুর শুধু ভালবাসার সুর, অনুতাপের সুর।

এখন যেন জড়িয়ে গেল সরু মোটা দুটো তারে।

অতএব গৌতমের এখন আর শুধুই অনুতপ্ত প্রেমিকের ভূমিকায় মগ্ন থাকলে চলবে না, এখন হিত পরামর্শদাতা বিচক্ষণ অভিভাবকের ভূমিকাও নিতে হবে। টুনুকে তার কষ্টের ঘর থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উদ্ধার করে নিয়ে যেতে হবে বিজয়ী রাজপুত্রের মতো। পিসি রাজি না হলে, কেবলমাত্র নিজের চেষ্টাতেই।

হয়তো বাধ্য হয়ে এখন আমাকে টুনুর টাকার উপরই ভরসা করতে হবে, কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে উঠব আমি।

টুনু এসে ঘরে ঢুকল।

এইমাত্র চোখমুখে জল দিয়েছে বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু কী রোগা, কী ছোট্ট, কী বেচারি, কী অসহায় অসহায় দেখাচ্ছে টুনুকে।

সত্যি বুঝি কেঁদে কেঁদে আধখানা হয়ে গেছে টুনু।

এই টুনুকে কি গৌতমের থেকে বয়েসে বড় একটা মেয়ে দেখাচ্ছে?

স্রেফ একটা রোগা চড়াই পাখি।

যেন গৌতম নামের একটা দীর্ঘ বৃক্ষে আশ্রয় নিতে এসেছে।

অনেক কথা রিহার্সাল দিয়ে এসেছিল গৌতম, কিছুই বলতে পারল না। শুধু ওর একটা হাত দুহাতে চেপে ধরে বলল, টুনু!

কতক্ষণ পরে যেন বলল, টুনু, আজ আমি তোমায় আদর করব। অনেক আদর করব।

টুনুর শুকনো মুখে হঠাৎ একটুকরো দুষ্ট হাসি ফুটে উঠল।

টুনু সেই হাসিমাখা মুখটা নিচু করে বলে, বলে কয়ে? হয় না।

টুনু, আমরা আর দিন গুনে গুনে দিনের অপেক্ষায় বসে থাকব না।

তবে কী করবে শুনি?

আমরা বিয়ের মতো বিয়ে করব টুনু! আমাদের বিয়েতে শাঁখ বাজবে, হোমের আগুন জ্বলবে, আলপনা আঁকা হবে। এইমাত্র মনে মনে সব ঠিক করে ফেললাম টুনু। আমার এক বন্ধুর মাকে ভার দেব তোমাকে বরণ করবার। আমার খুব বন্ধু।

বিয়ের কথা থেকে ক্রমশ নতুন পাতা সংসারের ছবি আঁকায় চলে যায় ওরা।

টুনু বলে, ঘরের মাঝখানে খাট পাতা আমার দুচক্ষের বিষ, খাট থাকবে জানলার ধারে।

গৌতম বলে, আর কী, বৃষ্টি এলে ভিজে যাক!

ইস, ভিজে অমনি গেলেই হল। আমি মরে যাব নাকি? তারপর টুনু বলে, আমি কিন্তু বারান্দায় একটা নীল খাঁচা ঝুলিয়ে ছোট্ট ছোট্ট মুনিয়া পাখি পুষব।

গৌতম গলা তুলে বলে, খাঁচায় পাখি পুষবে তুমি? আহ্লাদ! যক্ষুনি কিনে আনবে, তক্ষুনি খাঁচা খুলে উড়িয়ে দেব।

তা হলে তোমার সব বইখাতা ছিঁড়ে দেব।

দিও। লেখাপড়া ছেড়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াব। আর তোমার টাকাগুলো ওড়াব।

উড়িও পুড়িও যা খুশি কোরো, কিন্তু চাঁদের আলোয় বসে তোমায় গান শোনাবার জন্যে ছাদে আমার একটা শ্বেতপাথরের বেদি চাই।

আরে দূর দূর, এখনও চাঁদের আলোয় কবিত্ব?হাজার হাজার বছর ধরে চাঁদ এই পৃথিবীর প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্যে যে একটি আলোর জানলা খুলে রেখেছিল, মানুষ অনেক উযুগ আয়োজন করে নিজে হাতে সেই জানলা বন্ধ করে দিয়ে এসেছে।

বন্ধ করলেই কি বন্ধ হয়? দেখো–সব ঠিক থাকবে।

তোমার মতো মুখদের কাছেই থাকবে শুধু।

মুখ্যু হওয়াই সুখের।

তা বটে!

গৌতম হাসে, তা হলে বলছ, আমরা দুজনে একটি মূর্খের স্বর্গ সৃষ্টি করব? যেখানে চাঁদ যথাবিধি চাঁদমুখে হাসির আলো ছড়াবে, তারারা হারিয়ে যাওয়া মানুষের আত্মা হয়ে ঝিকঝিকে চোখে তাকিয়ে থাকবে, পাখিরা গান গাইবে, ফুলেরা কথা বলবে।

ঠিক ঠিক। টুনু উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে।

চোখের জল কখন শুকিয়ে গিয়ে হাসির ঝরনা ঝরতে শুরু হয়েছে। মনের পাথর গলে গিয়ে হালকা স্রোত বইছে।

বাবার বিয়েটাকেও টুনু যেন এখন আর মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। বলছে, যাক গে যাক, আহা দুর্বলচিত্ত বেচারি বলে ক্ষমাই করে ফেলছি। শুধু আমার মার সব ছবিগুলো আমাদের বাড়িতে নিয়ে চলে যাব।

টুনু এই বাড়ি থেকে উদ্ধার হবার আশ্বাস পেয়ে ওর সেই ভাবী সৎমাকেও পরিহাস করতে পারছে।

বলছে, বিধবা ভদ্রমহিলা শেষ অবধি একটি সেকেন্ডহ্যান্ডই পেলেন। যাক, এটা মন্দ হচ্ছে না। দুজনের একটা করে অতীত রইল, কারও মনে ক্ষোভ জমবেনা। তুমি হাসছ? এখন আর কারও উপর বিদ্বেষ রাখতে ইচ্ছে করছে না গৌতম।

বামুনদি একবার চা খাবার খাইয়ে-টাইয়ে গেছে, আর একবার বলতে আসে, এখানেই দুটো খেয়ে যাও না দাদাবাবু!

টুনু হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বামুনদির গলা ধরে বলে ওঠে, না, ভাতটাত খাবে না, ও এখন চলে যাচ্ছে। কিন্তু আর ওকে দাদাবাবু বলবে না বুড়ি, বলতে হবে জামাইবাবু।

বেঁচে থাকো, রাজা হও, এই গোছের কিছু একটা বলে বুড়ি পালায়।

গৌতম চোখ কুঁচকে বলে, এটা কীরকম অসভ্যতা হল!

ভীষণ ইচ্ছে করল একটু অসভ্যতা করতে।

বাঁশির মতো বাজতে বাজতে বাড়ি ফিরল গৌতম।

নাঃ, ভয়-টয় নয়।

ভিক্ষুকের প্রার্থনাও নয়, দাবির গলায় বলতে হবে, নিজে নিজেই একটা বিয়ে ঠিক করে ফেললাম পিসি! এখন বলল সে বউকে বাড়িতে তুলবে, না ছেলেটাকে সুষ্ঠু বিসর্জন দেবে।

বেলা অনেক হয়ে গেছে, ছায়া এখন দীর্ঘ হয়ে পাশে পাশে চলছে না, পায়ের নীচে গোল হয়ে হয়ে চলেছে। ঘড়ি নেই হাতে, কে জানে কতটা বেলা। একটা? দুটো? তিনটে? কে জানে!

পিসি হয়তো ভাবছে, ভুলে ভুলে ভাত না খেয়ে কলেজ চলে গেছি। ছেলেবেলার মতো।

উঃ, ছেলেবেলায় সেই না নেয়ে না খেয়ে ভুলভাল স্কুলে চলে গেলে কী রাগই করত পিসি! আর গৌতম অবাক হয়ে বলত, ওঃ, তাই ভাবছিলাম, আজ টিফিন আনতে ভুলে গেছি বলেই কি যত রাজ্যের খিদে এসে জুটেছে! যাচ্চলে, খেয়েই যাইনি?

আচ্ছা ওই কথাটা বলেই পিসিকে খ্যাপাব আজ?

বলব, যাচ্চলে, খেয়েই যাইনি? তাই ভাবছি এত খিদে পাচ্ছিল কেন?

তারপর আস্তে আস্তে সব কথা ভাঙব।

কিন্তু কই, পিসি তো ছুটে তেড়ে এল না।

গৌতম দোতলায় উঠল, জুতো খুলল, ঘামের জামা খুলে টাঙিয়ে রেখে নিজমনে বলে উঠল, উঃ, কী দারুণ খিদে পেয়ে গেছে।

তবু পিসির সাড়া নেই।

ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? অথবা ঘুমের ভান?

পিসির ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলল।

ঘরে কেউ নেই। কী ব্যাপার! দাদুর অসুখ-টসুখ নয় তো?

একটু আতঙ্ক, একটু অস্বস্তি।

আস্তে দাদুর ঘরে এসে ঢুকল।

দাদু বসে আছেন খাটের উপর। মাটিতে পিসি। দুটো পাথরের পুতুলের মতো।

কী হয়েছে? কোথাও থেকে কোনও শোক সংবাদ এসেছে নাকি?

কিন্তু ত্রিভুবনে কে এমন আত্মীয় আছে গৌতমদের যে, তার মৃত্যু সংবাদে দু-দুটো মানুষ একযোগে পাথর হয়ে যাবে!

তবু গৌতমও পাথরের মতোই দাঁড়িয়ে রইল।

ব্যাপারটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করল।

অনেকক্ষণ কেউ তাকাল না। তারপর দাদু হঠাৎ অদ্ভুত একটা ব্যঙ্গের গলায় বলে উঠলেন, এই যে তুমি এসেছ? ভাবলাম বুঝি বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্নে গেছ।…যাক, যাওনি তা হলে। বিভা, চিঠিটা দাও ওকে।

গৌতম এই অসংলগ্ন কথার মানে বুঝতে পারল না। গৌতম পিসির দিকে তাকাল।

দাদুর কি হঠাৎ বুদ্ধিবৈকল্য ঘটল!

নইলে বিভা তো কই উঠলও না, কোনও চিঠিও দিল না।

দাদু একটু অপেক্ষা করলেন।

তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকারে ধমকে উঠলেন, কই, দিলে না? ওর মার বিয়ে আর ও জানবে না? আহা বাপ-মরা ছেলে, আবার নতুন বাবা পেল, কত আমোদ!

দাদু! আরও জোরে ধমক দিয়ে ওঠে গৌতম, এই সহসা বিকৃতমস্তিষ্ক হয়ে যাওয়া বৃদ্ধকে।

কিন্তু গৌতমের ধমক কাজে লাগে না। দাদু ভয় খায় না।

যেন ছুরি নিয়ে বিধিয়ে বিধিয়ে কেক কাটেন-ইনিয়ে-বিনিয়ে দুঃখের কাঁদুনি গেয়ে চিঠি দিয়েছে যে দিদিমা, মেয়ে আমার গালে মুখে কালি মাখিয়েছে, মেয়ে আমাকে লুকিয়ে এই কাজ করেছে! কই দে চিঠিটা।

বিভা সন্তর্পণে নিতান্ত অনিচ্ছায় একটা চিঠি এগিয়ে ধরে।

গৌতম সেদিকে দৃকপাত করে না, গৌতম শুধু নিজেকে নিয়ে কোথাও ফেলতে যাবার জন্যে সরে আসবার চেষ্টা করে।

ফেলার আগে যেন পড়ে না যায়, এইটুকুই শুধু চেতনায় ছিল তার।

কিন্তু নির্মম বৃদ্ধের নির্মমতার আশা বুঝি তখনও মেটেনি, তাই শেষবারের মতো ছুরিটা আমূল বিধিয়ে দেন। যাতে আর নড়বার ক্ষমতা থাকবে না তার।

আরে চলেই যাচ্ছ যে! নতুন বাবার নামটাও শুনে গেলে না? ওঃ, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস মজুমদারের জন্যে প্রেজেনটেশান কিনতে যাচ্ছ বুঝি? দামি দেখে কিনো, বনেদি বড়লোক মানুষ, তার উপর আবার বিজনেসম্যান।

গৌতম জেগে জেগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই স্বপ্নটা দেখতে পায়, সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদের দরজা খুলেই একটা শূন্য গহ্বরে পা ফেলেছে। এ ছাদে জ্যোৎস্না নেই, এ ছাদের উপরে আকাশও নেই। আশেপাশে উপরে নীচে শুধু একটা জমাট বাঁধা কালো। চাপ চাপ ঘন।

না, চাঁদের জানালা আর কোনওদিন খুলবে না। মানুষ তাকে রূঢ় হাতে বন্ধ করে দিয়েছে।

.

.

পালঙ্কশায়িনী

সাবেক বাড়ির গড়নই আলাদা।

চকমিলানো যদি নাও হয়, দালান একখানা থাকবেই, দরদালান।

জীবনবল্লভ রায়ের এই বাড়িটাও যা একখানা দরদালান বুকে করে বসে আছে, তাকে দালান না বলে মাঠ বললেই ভাল হয়। জিনিসপত্রে বোঝাই না থাকলে ফুটবল খেলা যেত। কিন্তু অত বড় দালানখানাও জিনিসপত্রে ভর্তি। সাবেককালের বাড়িও যেমন, সাবেককালের আসবাবপত্রও তেমন। সবই বড় বড় ঢাউস ঢাউস, আজকের দিনে যা প্রীতিকর নয়, ভীতিকর। কিন্তু করা যাবে কী? ওসব তো ফেলবারও নয়, গেলবারও নয়, শুধু অস্বস্তি বাড়াবার।

ওই যে চার হাত চওড়া পাঁচ হাত উঁচু সেগুন কাঠের আলনাটা? ওতে বাড়িসুষ্ঠু লোকের কাপড় চোপড় ঝুলিয়ে রাখার জায়গা থাকলেও রাখছে কি কেউ? যে যার নিজের নিজের ঘরেই ছোটখাটো ব্যবস্থা করে নিয়েছে।

অবিশ্যি নতুন আসবাব কেনার মতো অবস্থা বাড়ির বর্তমান মালিকদের নেই, হয়তো ঘরের কোণে দড়ি টাঙিয়েই কাজ চালাচ্ছে–তবু আগের আমলের মতো বাড়িসুদ্ধ সকলের কাঁচা কাপড় কুঁচিয়ে কুঁচিয়ে একটা আলনায় ঝুলিয়ে রেখে, যে যার খুঁজে নিয়ে পরার কথা কেউ ভাবতেই পারে না।

আলনাটা এখন প্রকৃতপক্ষে ঘরশোভা দেবীরই অধিকৃত। ওঁর কাঁচা থান, মটকার থান ব্যতীতও কাঁচা কাঁথা, কাঁচা গায়ের কাপড়, কাঁচা বিছানার চাদর ইত্যাদিতে বোঝাই আছে ওই দিগগজ আলনাটা।

শোভা সৌষ্ঠবহীন ওই আসবাবটির পাশে কড়িকাঠে মাথা ঠেকু-ঠেকু জগদ্দল একখানা দেরাজ আলমারি। নীচের দিকে দেরাজ, উপরে কাঁচ বসানো আলমারি। এক সময় বোধহয় মেহগিনি পালিশ ছিল, এখন কালো চিটচিটে। চিটচিটে তো হবেই, তেলচিটেই। দেখ তোর না দেখ মোর–সকলেই যে ওই দেরাজটার গায়ে হাত মোছে। ভিজে হাত, চুলবাঁধা হাত, ঘি-তেলের হাত।

হ্যাঁ, ঘি-তেলের হাত তো ওরই কাছাকাছি, গেরস্তর ঘিয়ের টিন, তেলের টিন, চিনির বোয়েম, সব কিছুই তো ওই দেরাজের পাশের বিরাট র‍্যাকটায়। র‍্যাকটাও আড়ে দৈর্ঘ্যে বিশাল। মজবুত কাঁঠাল কাঠের।

সাবেকি ভাঁড়ার ঘরের মাল কিন্তু এখন এই দোতলার দালানে আশ্রয় পেয়েছে। আশ্রয় পেয়েছে দুটো কারণে প্রথমত জীবনবল্লভ রায়ের মৃত্যুর পরে, তাঁর তিন তিনটি কর্তা ছেলে থাকতেও সংসারে সহসা এমন টালমাটাল দেখা গেল, বাধ্য হয়েই একতলাটা ভাড়া দিতে হল।

অতএব রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, খাবার ঘর, বৈঠকখানা ঘর, চাকরদের ঘর, অতিথি-সজ্জনের ঘর এবং এই দালানের নীচের বিরাট দালানখানির যাবতীয় মাল দোতলায় উঠিয়ে আনতে হল, সরাতে হল যেমন-তেমন করে। বউদের শোয়ার ঘরগুলিও বোঝাই বোঝাই, তবে ঘরগুলো এতই বড় বড় যে তা সত্ত্বেও চলে যাচ্ছে। বাক্স তোরঙ্গগুলোকে অবশ্য বৃহৎ পালঙ্কের নীচে চালান করা গেছে, কারণ ওই পালঙ্কগুলিও মাঠ সদৃশ, এবং ওর উপর উঠতে হলে চৌকি লাগে।

ভাড়া দেবার প্রাক্কালে কথা হয়েছিল, ছাদে দুখানা চালা তুলে রান্না ভাঁড়ারের কাজ চালানো হবে। শুধু সদ্য বৈধব্যপ্রাপ্ত ঘরশোভা দেবীর নিরামিষ রান্নাটা দোতলায় দালানের এককোণে–

ঘরশোভা দেবীই তীব্র প্রতিবাদ তুললেন।

ছাতে রান্না-ভাঁড়ার? তোদের মায়ের কোমরের বল বেড়েছে, কেমন? চোদ্দবার সিঁড়ি ভাঙব আমি?

ছেলেরা ব্যস্ত সন্ত্রস্ত হয়ে বলল, কেন, কেন, তুমি কেন? তুমি এখানে বসে হুকুম করবে, বউরা চালাবে। তুমি কি চিরকাল খাটবে?

ঘরশোভা হরিনামের মালা কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ওঃ তার মানে কর্তা যেতে যেতেই আমাকে তোরা বাতিলের দলে ফেলতে চাস? বউরা গিন্নি হবে, আর গিন্নিত্ব থেকে নাম খারিজ হয়ে যাওয়া আমি জুলজুল করে সবকিছু তাকিয়ে দেখব বসে বসে?

ছেলেরা জিভ কাটল, কপালে হাত ঠেকাল, ব্যস্ত সন্ত্রস্ততর হয়ে বলল, এ কী বলছ মা? ওরা তোমার দাসীর মতো খাটবে–

তোরা আর আমায় ছেলে-ভোলাতে আসিসনি বাছা! তোদের মতলব আমার বোঝা হয়ে গেছে। এ সব বউদের পরামর্শ, তাও অনুমান করেছি। নচেৎ তোদের ঘটে এত বুদ্ধি হবে না। আমি আগে মরি, তবে বউরা গিন্নি হবে, এই বলে দিস তাদের। ভাঁড়ার এই দালানে থাকবে, আমার চোখের সামনে, যা লাগবে আমিই বার করে দেব।

ছেলেরা বলল, তবে তাই হোক। তোমার যা ইচ্ছে।

ইচ্ছে মানে? এ কী আমার শখ-সাধ? বউদের হাতে সংসার পড়লে কদিন ভেসে থাকতে পারবি? সপুরী এক গাড়ে ডুবতে হবে না?

বউরা আড়ালে বলল, কথা কইবার তো আইন নেই, নইলে বলতে পারতাম দরাজ হাতটা মারই। কমে তো মোটেই পারেন না। আমাদের হাতে হলে এ সংসার এর অর্ধেকে চলত।

কিন্তু সে তো আড়ালে।

ছেলেমেয়েদের বিয়েটিয়ে হয়ে গেছে, নাতি-নাতনির ঠাকুমা দিদিমা, তবু সামনাসামনি কিছু বলার সাহস নেই মহিলাদের। কোমরে বাত শ্ৰীমতী ঘরশোভা দেবীর এমনই দাপট! এই দাপটের মূল অবশ্য ছেলেদের মাতৃভক্তি। আবার ছেলেদের মাতৃভক্তির মূল রহস্য খুঁজতে গেলে হয়তো বাড়ির দলিল পর্যন্ত পৌঁছে যেতে হয়, কারণ বাড়ির ট্যাক্সদাতা হচ্ছেন শ্রীমতী ঘরশোভা দেবী। সাবেককালের লোক হয়েও জীবনবল্লভ বাড়িখানি তলে তলে শ্রীমতীর নামে করে রেখেছিলেন। অবশ্য এটা ঠিক স্ত্রৈণতার বশে নয়, গিন্নিকে চুপি চুপি জানিয়েছিলেন, আমার নামে থাকলে আমি মরতে মরতেই ব্যাটারা পার্টিশন স্যুট ফেঁদে বসবে, আর যথাসর্বস্ব উকিলের পেটে দিয়ে ইট কাঠ পর্যন্ত বেচে খাবে। এ বাবা স্ত্রীধন, দাঁতটি ফোঁটাবার ক্ষ্যামতা হবে না।

ছেলেরা ভবিষ্যতে আমার উপরে গোঁসা করবে–বলেছিলেন ঘরশোভা দেবী, বলবে, মা বেটিই কুমন্ত্রণা দিয়ে বাবাকে এই কর্মটি করিয়েছে। অছেদ্দা করবে আমাকে।

জীবনবল্লভ ঝুনো হাসি হেসে বলেছিলেন, ঠিক উলটো। বরং সবাই মিলে তোয়াজই করবে তোমায়। দান বিক্রির অধিকার পর্যন্ত রইল যে। কখন কার উপর চটে গিয়ে তাকে বঞ্চিত করা, অথবা কখন কার প্রতি সদয় হয়ে তাকেই দিয়ে বসো, এই চিন্তার দোলায় দুলে তোমাকে চটাতে তো সাহস করবেই না, সুয়ো হবারই চেষ্টা করবে।

জীবনবল্লভ তাঁর ছেলে বউ সম্পর্কে যতটা ভেবেছিলেন, তারা ঠিক ততটা খারাপ কিনা বলা শক্ত। মাকে ভয় করাটা ঘরশোভার ছেলেদের একটা মজ্জাগত অভ্যাসই বলা চলে। মাকে যে অমান্য করা সম্ভব, কিংবা মার কথায় প্রতিবাদ করা সম্ভব, এটা তারা জানে না। অতএব বউদের স্বর নেই। অতএব এই দালানেই ভাঁড়ার। চালডাল থেকে শুরু করে বড়ি আচার, শুকনো কুল তেঁতুল পর্যন্ত।

কিন্তু নিজে হাতে বার করে দেবার ক্ষমতা কি আর আছে ঘরশোভা দেবীর?

সে ক্ষমতা তো অনেকদিনই গেছে।

বউরাই বার করে নেয় পালা করে, ঘরশোভা জুলজুল করে নয় কটকট তাকিয়ে দেখেন। এতটুকু এদিক ওদিক হলে রক্ষে নেই।

হাতে করে ওসব জিনিস ছোঁননি ঘরশোভা কত কত দিন, তবু সব কিছু তাঁর নখদর্পণে।

এখনও তিনি ছেলেদের কাউকে কাছে বসিয়ে মাসকাবারি ফর্দ লেখান। এখনও কোনওখানে নেমন্তন্ন হলে, লৌকিকতার দরদাম ধার্য করে দেন। বউদের বাপের বাড়ির দিকে কাজকর্ম হলে, বউরা যদি অধিক কিছু দিতে চায়, তো সেই চাওয়াটা লুকিয়ে মেটায়। ঘুণাক্ষরে যাতে প্রকাশ হয়ে না পড়ে তার জন্যে আটঘাট কম বাঁধতে হয় না তাদের, মিথ্যা কথাও কম বলতে হয় না।

ভাঁড়ারের ওই র‍্যাকের একেবারে উঁচুটায় থাকে তরকারির ঝুড়ি চুপড়ি। কারণ নীচের দিকে থাকলে ইঁদুরের ভয় আছে। পুরনো বাড়ি, ওসবের উপদ্রব যথেষ্ট। সকাল হলে যে বউ আগে চান করে আসে, সে ওইসব ঝুড়ি চুপড়ি নামায়, বঁটি বাসন সব এনে জড় করে, তারপর শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে বালিকা বধূর মতো প্রশ্ন করে, বলুন মা, কী কুটব!

পর্বটি অবশ্য কম নয়, নতুন নাতবউ দুটিও তৎপরে এসে যোগ দেয়। হয়তো শাক বাছে, হয়তো কড়াইশুটি ছাড়ায়, হয়তো আলু পটল ছাড়িয়ে দেয়। তোক তো অনেক।

.

তিন কর্তা তিন গিন্নি, তাদের জনে জনে পাঁচ-সাতটি করে, আবার তাদের মধ্যেও দুজন বিবাহিত, সেই নাতবউরা, এবং আছে তাদের শিশুপুত্ররা। এছাড়া ঠাকুর আছে, চাকর আছে, ঝি আছে।

সংসারের আয় কমে গেছে, হাল বেহাল হয়ে গেছে, কিন্তু ওরা আছে। থাকবেও। কারণ ওরা কর্তার আমল থেকে আছে। ওদের ছাড়িয়ে ব্যয় সংকোচ করার কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। বলতে গেলে বাড়িরই লোক ওরা।

তা ছাড়া এই বৃহৎ সংসারের হ্যাপাও তো কম নয়। বড় গিন্নি তো নিরামিষ রান্না নিয়ে থাকেন। সেও এই দালানেরই একপাশে। তবে সেখানে আয়োজন আড়ম্বরের কমতি নেই কিছু। যাবতীয় দেশি রান্নাগুলি এখানেই হয়। হয় দুধ, জলখাবার, ক্ষীর ছানা ইত্যাদি।

ওদিকে মা লক্ষ্মী শুকনো হয়ে এলেও ঘরশোভার সকালে ক্ষীর, সন্ধ্যায় ছানার নড়চড় হয় না। তিনি নিজে বারণ করেন না, অতএব ওটার নড়চড় করার কথা ওঠে না।

এই দালানে বসেই ঘরশোভার ছেলেদের আর নাতিদের খেতে হয়। মেয়েমানুষরা রান্নাঘরে খায় খাক, এদের খাওয়া-দাওয়া চোখের আড়ালে করতে দিতে রাজি নন ঘরশোভা।

ফলে টেবিলে খাবার বাসনা আর ইহজীবনে ব্যক্ত করতে পারল না কেউ। সেই সাবেককালের কাঁঠাল পিড়ি, সরপোস-ঢাকা ভারী কাঁসার গ্লাস, বড় কাঞ্চননগরী থালা, গোটা চার-পাঁচ সরফুলে বাটি আর টক চাটনি দই পাথরবাটিতে। কাচের বাসনের কথা ওঠে না।

মেয়ে বউদের দিকে কাঁচ ঢুকেছে, এনামেল ঢুকেছে, এদিকে তাদের আসবার জো নেই।

নাতবউরা কে কবে শখ করে পাতলা কাচের বাটি কিনেছিল, এবং অধিকতর শখ করে শ্বশুরের পাতের গোড়ায় রেখেছিল ইলিশমাছের টক দিতে, ঘরশোভা তাঁর পালঙ্ক থেকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি মেলে বলেছিলেন, পাথরবাটিগুলো কি সব ভেঙে গেছে বড় বউমা? গিয়ে থাকে তো, এই চাবি নাও, আমার সিন্দুক থেকে বার করে দাও।

বড় বউমা জানিয়েছিলেন, পাথরবাটি সবই আস্ত আছে। ওটা আপনার নাতবউয়ের শখ!

শখ?

ঘরশোভা বলে উঠেছিলেন, কী ছিরির শখ রে! হ্যাঁ, বুঝতাম শ্বশুরদের জন্যে রুপোর বাটি গড়িয়ে পাতের পাশে বসিয়ে দিতে পেরেছেন ঠাকরুনেরা, তাকে বলি শখ। কাঁচও যা মাটিও তা। কাচের বাটি মাটির খুরির শামিল। শকড়ি হলেই অশুদ্ধু।

অতএব ঘরশোভার ছেলেরা এবং নাতিরা পাথরবাটির আওতা থেকে মুক্ত হতে পারল না। বাসনের সিন্দুকে এখনও বহু বাসন ভোলা আছে ঘরশোভার, কাঁসার পিতলের পাথরের। মাঝে মাঝে এক আধটা বার করা হয়। এই চাবি-টাবি সবই ঘরশোভার আয়ত্তে। এখনও তিনি আঁচল থেকে খুলে এগিয়ে দেন, বউরা কি নাতনিরা কি নাতবউয়েরা নির্দেশমতো বার করে দেয়, আবার চাবি বন্ধ করে ওঁকে চাবি ফেরত দেয়।

বড় নাতবউ নিজের শাশুড়ির কাছে বলে, এখন আর কাঁসার বাসনে কেউ খায় না বাবা! যা সব ভারী ভারী বাসন আছে আপনাদের, বদল দিয়ে সব স্টেনলেস স্টিলের করা যায়। দই খান, নেবু খান, টক খান, ওই এক জিনিসেই চলবে। ওই ভারী ভারী কাঁসারগুলো রাখার কোনও মানে আছে?

শাশুড়ি মলিনা মলিন হাসি হেসে বলেছে, তোমাদের দিদিশাশুড়ি বেঁচে থাকতে এ সংসারের একচুল এদিক ওদিক হবে না বাছা, বলা বৃথা।

তবে আর কী করা– কৌতুকপ্রিয় বউমা উত্তর দিয়েছে, দিদি শাশুড়ির তত অমর বর পাওয়া হয়ে গেছে। কত হল? একশো ছাপিয়েছে?

তা ওটা হয়তো ঘরশোভার নাতবউয়ের অত্যুক্তি।

একশো ছাপাতে এখনও ন বছর বাকি আছে ঘরশোভার, মাত্র একানব্বই বছর বয়েস তাঁর। তবে মেয়েমানুষের প্রাণ তো, সবাই বলে, একশো বছর হয়ে গেছে বোধহয়।বলে, গাছ পাথর নেই বুড়ির বয়েসের, গাছ পাথর নেই। বলে, এই এক অমর বর পাওয়া মানুষ দেখছি বাবা! জ্ঞানাবধিই ওনার পাকা চুল দেখছি।

যেন খেলার সব খুঁটি পাকিয়ে নিয়ে আত্মস্থ হয়ে বসে একটিমাত্র খুঁটি চেলে চেলে খেলার সঙ্গে যোগ রেখেছেন ঘরশোভা।

অথচ আজ কত বছর উনি বিছানায়! কবে যে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছেন, ভুলেই গেছে । লোকে। তবে পড়ে আছেন বললে ঠিকটি বলা হয় না।

অধিষ্ঠিত আছেন বললেই ঠিক বলা হয়।

অধিষ্ঠিত আছেন ওঁর দাপটের সিংহাসনে, ওঁর বাবার দেওয়া ময়ূরপঙ্খী পালঙ্কে।

পালঙ্কটা সত্যিই ময়ূরপঙ্খী।

তার একদিকের বাজুটা ময়ূরের গলা, আর অপরদিকের বাজুটা ময়ূরের পেখম। সেই মেলে দেওয়া পেখমের দিকেই মাথা করে রাতে শোন ঘরশোভা, আর সারাদিন মোটা মোটা তাকিয়া ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকেন। কোমর থেকে নীচেটা সব পড়ে গেছে।

যবে থেকে পড়েছে, তদবধি ঘর ছেড়ে দালানে আশ্রয় নিয়েছেন ঘরশোভা। কারণ? কারণটা প্রাঞ্জল। পুব দক্ষিণ খোলা যে অতি প্রশস্ত ঘরখানিতে জীবনবল্লভ সগৃহিণী বিরাজ করতেন, সে ঘরটা একটা কোণের দিকে। কোণের দিকে বলেই দুদিক যত, খোলামেলাই হোক, সেখানে পড়ে থাকলে সমগ্র সংসারটাই তো চোখের আড়ালে থেকে গেল। দৈনন্দিন জীবনলীলার সব স্বাদ থেকে বঞ্চিত হলেন ঘরশোভা। তিনি শুধু হাততোলায় পড়ে থাকবেন, কে কখন মুখ ধুইয়ে দিয়ে যাবে, কে কখন চান করিয়ে দিয়ে যাবে, আর কে কখন ভাত খাওয়াতে আসবে।

কে বলতে পারে, বউরা ঘরশোভার চোখের আড়ালে বিছানা ছোঁয়া কি মাছের হেঁসেল ছোঁয়া কাপড়ে বেঁধে, উপর উপর দেখিয়ে তসর শাড়ি পরে ভাত বেড়ে নিয়ে খাওয়াতে আসবে কি না!

কে বলতে পারে, ঘরশোভার ছেলেদের একখানা করে মাছ দিয়ে তারা নাতিপুতি কুচোকাঁচাঁদের বেশি করে খাওয়াবে কিনা, হয়তো যেমন-তেমন করে ভাত বাড়বে ঘরশোভার রাজু, জগু, আর পানুর। পোশাকি নামে যারা রাজবল্লভ, জগৎবল্লভ, আর প্রাণবল্লভ।

দুই বড় নাতি, যাদের বিয়ে হয়ে গেছে সত্যবল্লভ আর নিত্যবল্লভ, অর্থাৎ সতু আর নিতু, তাদের সম্পর্কেও ঘরশোভার আলাদা একটি বিশেষ মূল্যবোধ। বিয়ের আগে থেকেই, বড় হয়ে ওঠা ইস্তক। যেন ওদের মায়েরা ওদের দাম বোঝে না, তাই হয়তো অন্য সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এক দরে ফেলে ছোট বগিথালায় ভাত দেবে, পাতের পাশে নুন লেবু ঘি দই দিতে ভুলে যাবে।

ঘরশোভার কখনও ঘরে পড়ে থাকলে চলে? কোমরই গেছে, চোখ কান তো যায়নি। মাথাভরা বুদ্ধির মাথাও খাননি। এই তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসে বসেই রাজ্য পরিচালনার ক্ষমতা রাখেন।

তাই কোমর পড়ে যাবার পর, যখন টের পাওয়া গেল ওটা আর ফিরবে না, ঘরশোভা ছেলেদের হুকুম করলেন, আমাকে একবার নামিয়ে ছুতোর ডেকে পাঠিয়ে পালঙ্ক খুলিয়ে দালানে পাতাও।

ছেলেরা তো শুনে হাঁ।

বলল, দালানে পাবে? কেন?

কেন আবার? তোরা যে একেবারে এইমাত্তর পৃথিবীতে পড়লি মনে হচ্ছে। এখন থেকে দালানেই থাকব আমি।

দালানে থাকবে তুমি? রাত্তিরেও?

হ্যাঁ রে বাবা! আমার আবার দিনরাত্তির! ভগবান যখন বিছানাই সার করে দিল, তখন বিছানাটাকেই সংসারের মাঝখানে এনে বসাই। নইলে ওই কোণের ঘরে পড়ে থাকা তো? জেলখানার আসামির মতোই। যে যা খুশি করবে–টেরও পাব না। তোরা দৈনিক দুবার মা, এবেলা কেমন আছ? বলে কর্তব্য সারতে ঘরে ঢুকবি, আর বউমারা আমায় পালা করে ভাত খাইয়ে আর পালা করে সেবা করে কর্তব্য করবে। ব্যস, বাকি মানুষগুলোকে চোখে দেখতেই পাব না।

একথা কেন ভাবছ মা, বলেছিল বড় ছেলে রাজু, তোমাকে ভিন্ন সংসার চলে? সবই তোমার সামনে হবে তোমায় জিজ্ঞেস করে করে

হ্যাঁ জিজ্ঞেস করবে!

ঘরশোভা একটু তিক্ত হাসি হেসে বলেছিলেন, কিন্তু জিজ্ঞেস মতো কাজ করবে এ গ্যারান্টি দেবে কে আমায়? এই জগৎটাই তো ফাঁকিবাজ বাবা!

অতএব জগতের ফাঁকির উপর তদারকি করতে ঘরশোভা ঘর ছেড়ে দালানে এলেন।

দাপুটে শাশুড়ি আছেন, তাই তিন জায়ে ভাব আছে–মলিনা, সরস্বতী আর পঙ্কজিনী–তিন জা। কারণ তারা একই দুঃখে দুঃখী, একই শাসনের ছত্ৰতলে শাসিত।

ময়ূরপঙ্খী পালঙ্ককে বাইরে আনতে যখন মুটে এল, আর স্ক্রু খোলবার জন্যে ছুতোর এল, তিন জায়ে বলাবলি করল, ভেবেছিলাম রুগী হয়ে পড়লেন, বিছানাই সার হল, এবার আমাদের একটু রেহাই হল, তা এ বেশ ভাল বুদ্ধিই করেছেন।

কিন্তু সামনে অন্য কথাই বলল, ভালই হল বাবা! এ তবু মার চোখের সামনে সব হবে, আমরা যেমন নিশ্চিন্দি ছিলাম তেমনি নিশ্চিন্দিই রইলাম।

ঘরশোভা মৃদু হাসলেন।

ঘরশোভা অতঃপর দালানশোভা হয়ে বসলেন।

তা, সত্যি কথা বললে, শোভাই বটে, এখনও এই বয়েসেও বুড়ি যেন পাকা আমটি। রঙের কী জেল্লা, গায়ের মাংস কী তুলতুলে। আর মুখের কাটুনি কী, যেন ছুরি দিয়ে কেটে বানিয়েছে। রূপের জন্যেই নাম। দশ বছর বয়েসে এ সংসারে এসেছিলেন, আর এখন এই একানব্বই বছর বয়েসে স্থির অবিচল হয়ে বিরাজ করছেন। কখনও বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে দেখেনি কেউ, কখনও হইহই করে তীর্থ করতে যেতেও দেখেনি। গিয়েছেন কাশী, পুরী, বৃন্দাবন, হরিদ্বার, কিন্তু সে যাওয়া সমগ্র সংসার নিয়ে। জীবনবল্লভের তখন অনেক বোলবোলাও, সপরিবারে তো গিয়েইছেন, সঙ্গে বামুনঠাকুর ভক্তিনাথ গেছে, ঝি সুহাসিনী গেছে। শুধু চাকর অনন্তটাই বঞ্চিত হয়েছে, সে গেলে বাড়ি দেখবে কে?

তা এসব অল্পবয়েসের ব্যাপার।

ছেলেদের তখনও বিয়ে হয়নি।

রাজু, জগু, পানু ইস্কুলের ছেলে। তিন মেয়ে পুণ্যময়ী, আলোময়ী আর দিব্যময়ীর মধ্যে শুধু পুণ্যর বিয়ে হয়েছে। তবে তাকেও আনিয়ে নিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি থেকে।

ছেলেদের বিয়েটিয়ে দেবার পর আর সংসারের চৌকাঠ থেকে পা বাড়াননি ঘরশোভা। প্রাণমন ঢেলে সংসারই করেছেন, তার শোভা সৌষ্ঠব (অবশ্য তাঁর নিজের রুচিমত) দেখেছেন, লোক লৌকিকতা, এসোজনবসোজন, কুটুমকাটুম, বারব্রত, পুজো-পাঠ, লক্ষ্মীষষ্ঠী, মনসা মাকাল, শনি সত্যনারায়ণ, এইসব নিয়েই থেকেছেন।

ঘরে বাইরে সবাই বলেছে, হ্যাঁ, একখানা মানুষ বটে। ঘরেও বলেছে বইকী! দাপটের জন্যে ভয় করুক, শাসনের পীড়া বোধ করুক, ব্যক্তিত্বকে সমীহ না করে উপায় কী? পক্ষঘাতগ্রস্ত অশক্ত মানুষটাকেও ওই সমীহর পূজা না দিয়ে পারেনা কেউ। কারণ একটা জিনিস জানে সবাই, ঘরশোভাকে দিয়ে কখনও নীচতা ক্ষুদ্রতা শঠতা ছলনা কি অন্যায় মিথ্যাচার সংঘটিত হবে না। ঘরশোভা ন্যায় আর সত্যের একটি জ্যোতির্বলয়ের মধ্যে দীপ্যমান।

অনেকদিন আগে দাসী সুহাসিনী একবার মেজবউ সরস্বতীর ঘর থেকে একখানা চিরুনি চুরি করেছিল, অথবা না বলে কয়ে নিয়েছিল, সোনার চিরুনি নয়, এমনি চুল বাঁধবার মোটা চিরুনি, ঘরশোভা সেটি জানতে পেরে তাকে সকলের সামনে মেপে একশো হাত নাকে খত দিইয়েছিলেন।

বলেছিলেন, ও চিরুনি তুই নে, তোর মাথা আঁচড়ানো চিরুনিতে আমার বউ মাথা আঁচড়াবে না, তবে যখনই অপরের জিনিসে লোভ আসবে, নাকের ঘসটানিটা মনে আনিস।

আর একবার চাকর অনন্ত ঘরশোভার ঘরের মেঝে থেকে একখানা একশো টাকার নোট কুড়িয়ে পেয়ে, হঠাৎ লোভের বশে সেখানা গাপ করে ফেলেছিল, তাকেও যা নয় তাই করেছিলেন।

এমনিতে ঘর মোছার সময় সিকিটা আধুলিটা আনি দুয়ানিটা যখন তখনই কুড়িয়ে পেয়েছে অনন্ত, এবং সঙ্গে সঙ্গে দিয়েও দিয়েছে, একবার একখানা দশ টাকার নোট পর্যন্ত, এবং হাসি হাসি মুখে বলেছে, মায়ের বজ্জর আঁটুনি ফস্কা গেরো। ইদিকে বাজারের বেলায় আধলাটির পর্যন্ত হিসেব নেবে। অথচ ঘরের মেজেয় টাকা-পয়সার হরির লুঠ।

কিন্তু একশো টাকার লোভটা সামলাতে পারেনি বেচারা। নিয়ে গেঁজেয় রেখে দিয়েছিল।

সকালের কাজকর্ম-ঘর মোছা কাপড় কাঁচা মিটলে বিকেলে অনন্তকে ডাকলেন ঘরশোভা। এবং বিনা ভূমিকায় বললেন, একশো টাকার লোভটা আর সামলাতে পারলি না, কেমন?

অনন্তর মুখটা অবশ্যই সাদা হয়ে গেল, থতমত খেয়ে বলল, কী বলছেন মা?

যা বলছি, খুবই বুঝতে পারছিস। চুলে তো পাক ধরে এল, এই সংসারে কাজ করছিস সেই বয়েসকাল থেকে, বলি চুরি করতে ঘেন্না এল না? লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু–একথাটা শুনিসনি বুঝি কখনও?

বলা বাহুল্য, ঘরশোভা দেবীর তীব্রকণ্ঠে আকৃষ্ট হয়ে বাড়ির সকলেই ততক্ষণে এসে হাজির হয়েছে ঘরশোভার ঘরে। (হ্যাঁ, তখনও তো ঘরেই। ঘরের কর্তাও তখন বেঁচে।) ঘরশোভা সেই সমবেতর সামনে আরও জোর দিয়ে বললেন, এখন তোমরাই বলল অনন্তকে রাখা উচিত, না ছাড়ানো উচিত? ঘরে যদি তোমরা বউমায়েরা সোনাদানাই খুলে রাখো, পুরনো লোক সেটা কুড়িয়ে না দিয়ে ট্যাঁকে পুরবে? ও যে কেমন বিশ্বাসী তা পরীক্ষা করবার জন্যে আমি ঘর মোছর আগে টাকাটা সিকিটা আধুলিটা পয়সাটা ঘরের মেজেয় ফেলে রাখি, তখন অনন্তবাবু আমাদের খুব পরীক্ষায় পাশ। আর যেই একটু বেশি মাল হাতে পড়েছে, ব্যস, পরীক্ষায় ঝেড়ে ফেল!…পুরনো লোকের হাতে যে লোকে লোহার সিন্দুকের চাবি পর্যন্ত তুলে দেয় রে অনন্ত।

অনন্তর আর অবোধ সাজা চলল না, হাউমাউ করে কেঁদে নানান উলটোপালটা কথা বলতে শুরু করল। একবার বলল, পরে দেব ভেবে ভুলে গিয়েছিলাম, একবার বলল, আপনি ঘরের মেজেয় ফেলে রাখেন তাই জব্দ করবার জন্যে লুকিয়ে রেখেছি, আবার বলল, আর কখনও এমন কাজ করব না–

ঘরশোভা বললেন, আর কখনও পাচ্ছিস কোথায়? আবার রাখব নাকি? সবাই ভাবত মার এত হিসেব, আর মা এত অসাবধান! আমি কথাটি কইনি। দেখি কার কত বুদ্ধির দৌড়।

সে যাত্রা হাতেপায়ে ধরে অনন্ত টিকে গেল। আর ঘরশোভার পরিজনদেরও একটা জটিল অঙ্ক মিলে গেল! সত্যিই ভেবে পেত না তারা, মা এত হুঁশিয়ার অথচ আঁচল খুলে টাকা পয়সা পড়ে যায়– টের পান না?

এভাবে পরীক্ষার কবলে তিনি তাঁর বউদেরও ফেলেছেন আগে আগে। এখনইনা হয়গিন্নিবান্নি হয়ে গেছে তারা। একদা তো বালিকা ছিল? খপ করে বলে বসতেন বউমা, শাড়ি তো পালটাচ্ছ, বলি ভিতরের শেমিজ বডিসগুলো পালটেছ?

ভয়ে শাকমূর্তি হয়ে ওরা হয়তো বলত পালটেছি, কিন্তু ঘরশোভা দেবী অত অল্পে সন্তুষ্ট হতেন না, বলতেন, কই, সেই কাচা ভিজেগুলো দেখি?

কাঁচ হয়নি?

কলঘরে পড়ে আছে? ঘরশোভা জোর গলায় ডাকতেন, অ সুহাসিনী, বউদিদির শেমিজ বডিস কি সব চানের ঘরে পড়ে আছে, কেচে আন দিকিনি।

বউ যদি বলত, আমি গিয়ে বলছি, ঘরশোভা তাকে থামিয়ে দিনে। থাক থাক, তোমায় আর যেতে হবে না, আমার গলা চিড়িয়ার মোড় অবধি যায়। ঠিক শুনতে পাবে।

সুহাসিনী বলত, কই? কোথায়?

ঘরশোভা বলতেন, জানি থাকবে না।

এইভাবেই বউদের শায়েস্তা করতেন ঘরশোভা দেবী। বলতেন, এখনও বলেন, সব সইতে পারি, মিছে কথা সইতে পারি নে।

শুচিবাই বললে হয়তো একটু অবিচার করা হবে, ঘরশোভার ঠিক শুচিবাই নয়, বরং বলা যায় শুচিতা বাই। বাড়ির সকলকেই উনি শুচি রাখতে চানকায়ে মনে বাক্যে।

কর্তা কর্তা ছেলেরা আর গিন্নি গিন্নি বউরা থেকে শুরু করে নাতির যে ছোট্ট ফুলতুল্য ছেলেটা ঘরশোভাকে কর্তামা বলে ডাকতে শিখেছে, তাকে পর্যন্ত সকালবেলা বাসি জামাকাপড় থেকে মুক্ত হতেই হবে।

দৈবাৎ ওই বাচ্চাটা যদি রাতে ঘুমনো জামা পরে সকালে ঘুরে বেড়ায়, ঘরশোভার শ্যেনদৃষ্টি মুহূর্তে ধরে ফেলে সেটা।

অমনি তারস্বরে হাঁক পাড়েন তিনি, নাতবউ, বলি অ বড় গিন্নি ঠাকরুন, ছেলে রাতের জামা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে বড়?

বড় নাতবউ চম্পাকলি, যদি অপরাধ স্বীকার করে বলে, এই রে ভুলে গেছি ঠাকুমা, এক্ষুনি সুহাসপিসিকে দিয়ে ছাড়িয়ে কাঁচা জামা পরিয়ে দিচ্ছি-তা হলে অল্পের উপর দিয়ে গেল।

শুধু এইটুকু বলেই ক্ষান্ত ঘরশোভা, এত ভুলই বা হয় কেন?

কিন্তু দৈবাৎ যদি চম্পাকলি ফট করে বলে বসে, ছাড়িয়েছি তো ঠাকুমা,তা হলেই আর রক্ষে নেই।

নাতবউ বলে রেয়া করবেন না ঘরশোভা, ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করে ছাড়বেন। এবং ভাল ঘরের মেয়ে হয়েও মিথ্যাচারের অভ্যাসটা কী করে হল চম্পাকলির, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করবেন। আর বলবেন, অজ্ঞানের দশটা বছরও যদি বাদ দাও, এই আশি বছর ধরে মানুষ চরাচ্ছি নাতবউ, আমার কাছে চালাকি দেখাতে এসো না। আমার চোখে ধূলো দেওয়া তোমার বাপের তো দূরের কথা, ঠাকুর্দারও নেই। ওই জামাটা পরে ও কাল সারা বিকেল এইখানে খেলেছে, আমি নিরীক্ষণ করে দেখেছি। আর তুমি স্বচ্ছন্দে বললে, এটা তো সে জামাটা নয় ঠাকুমা, অন্য জামা।..ঘাসের বিচি খাই না গো বাছা, ধানের চালের ভাত খাই, মিথ্যে ধরার ক্ষমতা আমার আছে। আর যদি আশা করা বুড়ির চৈতন্য লোপ পেয়েছে, তা হলে এইরকম প্রতি পদে পদে বাক্যি খেতে হবে তা বলে রাখছি, তাতে তোমার ওই গাছতলায় বসা উকিল বরটা যদি আমার নামে কে করে তো করুক।

সত্যিই ঘরশোভার বড় নাতি সত্যবল্লভ প্রায় গাছতলায় বসা উকিলই। প্র্যাকটিসের খাতায় নাম লিখিয়েছে কতদিন, কিন্তু এখনও পসারের নামগন্ধ নেই। যায় আসে এই পর্যন্ত।

ঘরশোভা যেন অনুমানেই সব বুঝতে পারেন, তাই বলেন–গাছতলায় বসা বরটা।

চম্পাকলি নামটি কিন্তু ঘরশোভারই দেওয়া। সেদিকে রুচি পছন্দ বেশ আছে। বউয়ের নাম ছিল শুধু চাঁপা। ঘরশোভা নাক সিঁটকে বললেন, নাম শুধু চাঁপা? নামটা ভাল নয়, যেন ঝি ঝি গন্ধ। বস্তির ঘরেই অমন ঠ্যাংঠেঙে নাম রাখে। আমি নাতবউয়ের নাম দিলাম চম্পাকলি। পছন্দ হবে? সতে যা তো–জিজ্ঞেস করে আয়। অপছন্দ হলে–চম্পকলতা, নাম থেকে একেবারে ছেড়ে চলে যাওয়া চলবে না। মা-বাপের দেওয়া নাম।

তা প্রথমটাই পছন্দ হয়ে গেল, কাজেই দ্বিতীয়টায় আর হাত দিতে হল না।

সত্যবল্লভ বলল, যাক, বুড়ির পছন্দটা খারাপ নয়।

চম্পাকলি বলল, ভাল একখানা নাম নিয়েই বা কী? ডাকার মধ্যে তো বউমা আর নাতবউ।

বাঃ, আমি ডাকব চম্পাকলি বলে।

কোথায় ডাকবে? রাত্তিরে যখন বালিশে কান চেপে শোব, তখন তো? তোমাদের এই সনাতনি বাড়িতে কি আর আমাকে নাম ধরে ডেকে কথা বলার সাহস হবে তোমার?

তা সত্যবল্লভকে এ ধিক্কার মাথা পেতে নিতেই হয়। সত্যিই সে সাহস নেই ওর।

এ বাড়িতে এখনও পঞ্চাশ বছর আগের হাওয়া বিরাজমান। চম্পাকলি যখন রাগে অপমানে চোখের জল চেপে ছেলেকে কাঁচা জামা পরাতে বসে, সত্য ঘরে থাকলে বলে, বুড়িকে খেপাও কেন?

উনি তো সর্বদাই খেপে আছেন।

চম্পাকলি বলে, এ সংসারে খ্যাপা সবাই। এক খ্যাপার তালে তাল দিয়ে একটা বৃহৎ সংসার চলছে, এ খ্যাপামির হিসেব কষেছ কোনওদিন? এইটুকু একটা বাচ্চাকেও যে সকালবেলা কাঁচা-জামা পরে বিশুদ্ধ হতে হয়, এমন পাগুলে কাণ্ড জন্মেও দেখিনি।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাটা ওঁর মজ্জাগত বুঝলে, সতু বলে, আসলে নিজে খুব খাঁটি তো, অন্য ধরনের কথা একেবারে বরদাস্ত করতে পারেন না। খাঁটি আর স্পষ্টবক্তা।

আসলে ওই গুণটির জন্যেই ঘরশোভা দেবীর এত ক্ষমতা। সবাই শ্রদ্ধা সমীহ করে। নাতিরা আড়ালে বুড়ি ভিন্ন বলে না, তবুও সমীহ করে।

যদিও নাতবউ বলে, এতটা স্পষ্টবক্তা হবারও আবার মানে থাকে না। মানুষ মানুষের সঙ্গে ভদ্রতা সৌজন্যটুকুও রাখবেন না?

মেকি সৌজন্য রাখবেন না।

বলে ওর উকিল বর।

মেজ নাতবউ গৌরী অতি ধূর্ত মেয়ে, তাকে কখনও এসব বিপাকে পড়তে হয় না, সে ঠাকুমার সর্বাপেক্ষা সুয়ো। কাজেই স্পষ্টকথা শোনবার সুযোগ তার বড় আসে না।

তবে সব থেকে স্পষ্ট কথা শুনতে হয় ঘরশোভা দেবীর রাজু, জগু আর পানুকে। না হোক, হক কথা শুনিয়ে দেন ওদের ঘরশোভা।

অনেকদিন আগে, যখন সরকারি সার্কুলার জারি হল, হাজার টাকার নোট অচল হয়ে যাবে, তখন ছেলেরা ভেবে দেখলকথাটা মাকে বলা দরকার।

কারণ পরে মা বলতে পারেন, আমায় কেন বলিসনি?

কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? তিনজনেই বাঁধুক তবে।

ঘরশোভা সেইদিনই ঘর থেকে নাম কাটিয়ে দালানে আশ্রয় নিয়েছেন। ময়ূরপঙ্খী পালঙ্কে বসে আছেন তখন, গোটা পাঁচ ছয় ছোট বড় মেজ সেজ নানান মাপের তাকিয়া আশেপাশে ঠেসে।

ঘরশোভার পরনে ফরসা ধবধবে থান, গলায় মোটা বিচেহার, মুখ ভর্তি পান দোক্তা, হাতে একটা পিকদানি। সর্বদাই এটি লাগে বলে একমুহূর্তও কাছছাড়া করেন না ঘরশোভা এটিকে।

ঘরশোভার শনের নুড়ি চুলটি পরিপাটি করে আঁচড়ে বাঁধা। তাতে দুটি সোনার কাঁটা গোঁজা।

ছেলেদের দিকে একবার তাকিয়ে একটু নড়েচড়ে বসলেন ঘরশোভা দেবী, কোনও উক্তি করলেন না।

নিজে থেকে কথা বলে সুবিধা করে দেবার পাত্রী ঘরশোভা নন। হোক না কেন ছেলে, বড় আদরের আর বড় স্নেহের–যাদের একটু মাথা ধরলে হরির লুট মেনে বসেন ঘরশোভা দেবী, আর জ্বর ধরলে সত্যনারায়ণ।

মা তাঁর ঝকমকে মাজা পিতলের ডাবরটি মুখের কাছে তুলে পিক ফেললেন, পালঙ্কের পাশে রাখা টুলটায় রেখে দিলেন, বালিশের তলার চ্যাপটা শিশি থেকে গঙ্গাজল এক ফোঁটা নিয়ে হাত ধুলেন, তারপর পায়ের ঢাকাটা আর একটু টেনে দিলেন।

তিন তিনটে আধবুড়ো ছেলে যে গরুড় পক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে যেন খেয়ালই নেই।

অতএব খেয়াল করিয়ে দিতে হল।

রাজু গলা ঝেড়ে বলল, এখানে এসে শুলে বটে, তোমার অসুবিধে হবে।

আমার কিছু অসুবিধে হবে না, হলে হবে বউমাদের।

বলে ঘরশোভা আবার ডাবর মুখে তুললেন।

তা নয়, মানে চানটানের অসুবিধে তো

চানটান অর্থাৎ ঘরশোভাকে তো এখন সব কিছুই বিছানায় সারতে হচ্ছে।

কিন্তু তাতে উনি হেলেন দোলেন না।

বড় বউ এবং সুহাসিনী–এই দুজনের সাহায্যে সর্ববিধ শুদ্ধতা বজায় রেখে উনি সব সারেন। দালান তা কী? পালঙ্কের লাগোয়া চাদর টাঙিয়ে অস্থায়ী স্নানের ঘর বানিয়ে নেওয়া যায় না? আর সেই সময়টুকু ছেলেপুলেকে ঘরে আটকে রাখা যায় না?

কাজেই ঘরশোভা বললেন, অসুবিধে আমার কিছুই নয়। অসুবিধে বউদের।

তাদের জন্যে ভাবছি না, জগু বলল, রাত্রে এই দালানে—

তা ঘরের থেকে দালানে তফাতটা কী? চোর যদি দোর-জানলা ভেঙে ঢোকে তো, ঘরেও তা পারে।

সে সত্যি। সুহাসিনী শোবে তো?

শোবে! ও তো শোয় এখানেই বরাবর। আর কোন চুলোয় যাবে? তবে মাগী যা নাক ডাকায়, হয়তো দূর করে সিঁড়িতে চালান করে দিতে হবে।

এবার সাহসে ভর করে পানু।

বলে ফেলে এক ঝোঁকে, মা, ইয়ে বলছিলাম কী, শুনেছ বোধহয় হঠাৎ অর্ডার হয়ে গেছে হাজার টাকার নোট আর চলবে না।

ঘরশোভা ফরসা ধবধবে কপালটায় রেখা টেনে বললেন, কী চলবে না?

হাজার টাকার নোট গো! আর পনেরো দিনের মধ্যে জমা না দিলে ও নোট ছেঁড়া কাগজের শামিল হয়ে যাবে। শোনোনি?

কোথা থেকে শুনব?

ঘরশোভা তাকিয়ায় কনুই দিয়ে টিসিয়ে যাওয়া শরীরটাকে একটু খাড়া করে বলেন, আমি খবর কাগজ পড়ি? না পার্কে বেড়াতে যাই যে শুনব? তোমরা যা শোনাবে তাই শুনব, যা বোঝাবে তাই বুঝব। তা তাই যদি হয়ে থাকে, তোমাদের বক্তব্যটা কী?

এবার রাজু, না, মানে, তোমার তো আগে আগে নোট বাঁধিয়ে বড় নোট করা একটা শখ ছিল? তেমন যদি থাকে দুএকখানা, তা দিয়ে দিলে ভাঙিয়ে এনে দিতাম।

এই বক্তব্য? ঘরশোভা নিজস্ব ধারালো গলায় বলেন, এরই জন্যে তিন ভাইয়ে মিলে সেজেগুজে এসে এত ভনিতে! মা তোমার অসুবিধে হচ্ছে–মা তোমার কষ্ট হচ্ছে! ওই কী হুজুগ উঠেছে, আর তিন ভাইয়ে সলা পরামর্শ করছিস ওই ছুতো করে মা বুড়ির কাছ থেকে কী আছে না আছে বার করে নিই, কেমন? নোট অমনি বাতিল হয়ে যাবে, মগের মুলুক কিনা?

ওমা, এখন তো মগের মুলুকই হয়েছে। লোকে ঝপাঝপ জমা দিয়ে দিচ্ছে।

ঘরশোভা অম্লান বদনে বলেন, শুধু তোরা বললেই তো আর হল না, তোদের প্রতিপক্ষের কেউ বললে তবে মানব

ঘরশোভার ছেলেরা মায়ের কথায় অপমান বোধ করবার কথা চিন্তা করে না। তাই ব্যাকুল গলায় বলে, আমাদের প্রতিপক্ষ আবার কোথায় পাবে তুমি?

কেন? তোমাদের ভাগ্নেরা, তারা তো তোদের হিংসেয় মরে। ওরা আসুক একদিন, জিজ্ঞেসবাদ করি–

ততদিনে আর দিন থাকবে না মা, আর পনেরো দিন মাত্র সময় আছে যে—

তা তোদর হাতে যে বিশ্বাস করে তুলে দেব, তোরা যদি ভাঙিয়ে এনে আমায় না দিস?

অনায়াসেই এই কথা বলেন ঘরশোভা।

এই সবই যেন কৌতুকের কথা ঘরশোভার।

যেন ছোটখাট ছেলেদের নিয়ে মজা করছেন। ছেলেরাও কি সেই আলোয় নিচ্ছে? নইলে উঠে যায় না কেন আরক্ত মুখে? চলে যায় না কেন?

জগু আবার বলে, শেষকালে কিন্তু আমাদর দোষ দিও না মা? হাজার টাকার নোট থাকলে কিন্তু তোমার পচে যাবে তা বলে দিচ্ছি।

যাবে পচে! ঘরশোভা আবার পিক ফেলে বলেন, গাছের পাতা কিনা!

গাছের পাতারও অধম হয়ে যাবে মা! তুমি বিশ্বাস করো।

বলেছি তো আজ বিশ্বাস করব না, অন্যের মুখে শুনব, তবে বিশ্বাস করব।

ছুরিকাটা মুখে, ছুরির আগার মতো একটু হাসলেন ঘরশোভা দেবী। যেন ছেলেদের চাতুরি ধরে ফেলে মজা দেখছেন।

ওরা ম্লানমুখে উঠে গেল।

আশা করেছিল, এই সুযোগে অন্তত জেনে ফেলবে মার কাছে নগদ কত আছে-টাছে। তখনই ঘরশোভার প্রায় আশির কাছাকাছি বয়েস, কাজেই খুব সংকোচের সঙ্গে হলেও ভেবেছে, মা আর কদিন?

অভাব তো খুবই, এতবড় সংসারের উপযুক্ত আয় কোথায়? তেমন মোটা মাইনের চাকরি কেউ করে না, বাবাই এতাবৎকাল সংসার চালিয়েছেন, ছেলেরা যা পেরেছে এনে মায়ের হাতে তুলে দিয়েছে, ব্য। বাবা যে কোন উপায়ে উপায় করছেন ভেবে দেখেনি। পরে চোখে অন্ধকার দেখছে। কোনও কিছুতে এতটুকু ঘাটতি হলেই তো ঘরশোভা রসাতল করে ছাড়বেন।

আশা করেছিল ওই নোটের বাতিলত্ব প্রাপ্তির হুজুগে মার ভিতরের খবর জানা যাবে। হল না। এদিকে–

বউদের গায়ের গহনা বন্ধক দেওয়া শুরু হয়েছে তখন। তোলা গয়না-টয়নাগুলোর উপর দিয়েই যাচ্ছিল, ক্রমশ বারোমেসেয় টান পড়ছে। ছেলেমেয়ের ইস্কুল-কলেজ আছে, বাজার ক্রমেই অগ্নিমূল্য হচ্ছে।

ঘরশোভার তীক্ষ্ণদৃষ্টি গিয়ে পৌঁছয় মেজবউমার গলায়।

বলে ওঠেন, মেজবউমা, তোমার গলা ন্যাড়া যে—

মেজবউমা বোধ করি উত্তর প্রস্তুত করেই রেখেছিল, বলল, বড় ঘামাচি হয়েছে মা, তাই খুলে রেখেছি।

ঘরশোভা বললেন, অবাক করলে বাছা, এই শ্রাবণ মাসে তোমার এত ঘামাচি যে, ছেলের মা গলাটা ন্যাড়া করে বসে রয়েছ? যাও পরে এসো।

পরব মা, আগে আপনাকে চানটা করিয়ে নিই—

উঁহু, এখনি যাও।

মেজবউ আরও অমায়িক গলায় বলে, চাবিটা আপনার ছেলের কাছে আছে মা!

চাবি আমার ছেলের কাছে? তুমি যে আমায় তাজ্জব করলে বাছা! জগু আবার কবে চাবি রাখে?

ওই মানে তখন আমার হাত জোড়া ছিল–

হু বুঝেছি।

.

পরদিন ঘরশোভা জগুকে ডেকে বললেন, আমার ঘর থেকে লোহার সিন্দুক বার করিয়ে আমার মাথার কাছে দে।

সে কী মা! জগু অবাক গলায় বলে, দালানের মাঝখানে লোহার সিন্দুক?

তা দালানের মাঝখানে তো তোদের মা-ও রইল। আমায় না মেরে তো আর চোর ডাকাতে কিছু করতে পারবে না। ও ঘরে পড়ে থাকলে কখন কোন ফাঁকে ভেন্ন চাবি গড়িয়ে বউদের গয়নাগুলোর মতো আমার গয়নাগুলোও বেচে খাবি তোরা, তাতে ঠিক কী?

জগু চমকে উঠল। জগু মাথা হেঁট করল।

তারপর অন্য ছেলেরা বোঝতে এল, যতই হোক তোমার বয়েস হয়েছে তোমার পক্ষাঘাত হয়েছে একথা বলল না, বলল বয়েস হয়েছে, তুমি কী সামলাবে? সামনে বসে সিন্দুক ভাঙলেও কিছু করতে পারবে না তো?

সামনে বসে ভাঙলে, তবু তো টের পাব যে ভাঙল, গেল।

ঘরশোভা তেমনি কড়া হাসি হেসে বলেন, আড়ালে বসে ভাঙলে তো সেটুকুও হবে না।

অতএব মুটে ডেকে সেকেলে সেই বিশ-পঁচিশ মন ওজনের লোহার সিন্দুককে বার করে ঘরশোভার মাথার কাছে রাখা হল। ঘরশোভা ছেলেদের ডেকে একটা চাবি দিয়ে বললেন, খোল!

ছোট ছেলে পানু খুলল।

ঘরশোভা মুচকি হেসে বললেন, খুব তরস্থ যে? ওতে একটা চ্যাপটা কাঠের বাক্স আছে, দে আমার হাতে।

নির্দেশমতো কাজ করল পানু।

ঘরশোভা অনায়াসে বললেন, সমুখ থেকে একটু সর দিকি, সব দেখে ফেলতে হবে না।

যেন পাঁচ-সাত বছরের ছেলেকে বলছেন। ছেলে চলে গেল।

একটু পরে আবার হাঁক পাড়লেন, এই নাও এই একখানা হাজার টাকার নোট, দ্যাখো গিয়ে পচে গেছে না আছে। দাদাকে, মেজদাকে একটু পাঠিয়ে দিও।

আরও দুখানা নোট দুই ছেলের হাতে দিলেন ঘরশোভা একই মন্তব্যে।

তখন সময় যায় যায়।

ছেলেরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে টাকা উদ্ধার করে এনে মার হাতে দিল।

ঘরশোভা বললেন, ও আর আমাকে ফেরত দিতে হবে না, বউদের গায়ের গয়না কোথায় বাঁধা টাঁধা দিয়েছিস ছাড়িয়ে আনগে যা। এত অকালকুষ্মণ্ডও গর্ভে ধরেছিলাম গো! একখানা সোনাদানা বউকে দেবার মুরোদ নেই, বেচে খাবার ইল্লুতেপনা।

এক হাজার করে টাকা নিয়ে অনেক কিছু করা যেত, তবু বউদের গয়নাই ছাড়াতে হল। নইলে মা আস্ত রাখবেন না।

এইভাবেই ঘরশোভা চালিয়ে চলেছেন!

পা পড়ে গেছে, নব্বই বছর বয়েস, তবু জীবনীশক্তির কিছু কমতি নেই। এখনও সমগ্ৰ সংসার হাতের মুঠোয়। এখনও সকালে অনন্তকে এসে দাঁড়াতে হয়, মা, কী বাজার আসবে?

আজও এল।

ঘরশোভা বলতে শুরু করলেন আঙুল গুনে গুনে।

তার সঙ্গে মন্তব্য, বলি ওরে অ মুখপোড়া, আলু বুঝি আর নামবে না?

একমাথা সাদাচুল অনন্ত, এ গালি গায়ে মাখল না, বলল

এ সময় নামবে কি গো মা,অনন্ত তারস্বরে প্রতিবাদ করে, এখন তো আরও বাড়বে চড়চড় করে।

হু, তোরও পকেটে পয়সা বাড়বে চড়চড় করে। যা বোঝবি তাই বুঝতে হবে আমায়। এখনও মরিনি রে, ঢ্যাঁড়স এক টাকা করে সের এই কথা বিশ্বাস করব আমি!

যদিও ঘরশোভা এখন কিলোগ্রামের যুগেই বাস করছেন, তবু প্রাণ গেলেও সের পোয়া ছটাক এসব ছাড়া কিছু বলবেন না।

অনন্ত যত প্রতিবাদ করে, ঘরশোভা ততই যেন মজা দেখেন, এক মাছেই তো দিনে দশ বারো আনা পয়সা মারিস অনন্ত! আবার ঘোড় মোচা কচু কুমড়োয় চাপান দিসনি।

চিরটাকাল আপনি বাজার নিয়ে আমাকে অবিশ্বাস করলেন, অনন্ত থলি ঝুলি গোছাতে গোছাতে বলে, তা দাদাবাবুকে বললেই পারেন সঙ্গে যেতে

দাদাবাবু অবশ্য প্রৌঢ় তিন কর্তা।

কিন্তু অনন্তও তো এই বাড়িতে থেকেই প্রৌঢ়ত্ব অর্জন করেছে।

ঘরশোভা পিক ফেলে বলেন, দাদাবাবুরা নইলে আর কে তোমায় পাহারা দেবে! বলে ওদের নিজের নিজের কাছা সামলালেই বর্তে যাই আমি। তুমি একটু কম খেও, এই হচ্ছে কথা।

অনন্ত নেমে যায়, সিঁড়িতে নেমে যেতেই পঙ্কজিনী ধরে, কী ফর্দ দিলেন, দেখি।

ফর্দ আমার মাথার মধ্যে ঠুসলেন, আলু বেগুন কুমড়ো ঢ্যাঁড়স থোড় কচু আমড়া, পাটশাক।

পঙ্কজিনী মুখ বাঁকায়, সেই রাজ্যের আলাই বালাই? রোজই এসব খেতে ইচ্ছে করে? মাছ কি বললেন?

এই তো দাদাবাবু আর খোকাবাবুদের জন্যে কাটা পোনা, বাকি গেরস্তর জন্যে মৌরলা আর ট্যাংরা, আর কুচো খোকার জন্যে সিঙি।

চিংড়ি ইলিশ এসব কিছু বলেননি?

নাঃ।

যতসব আগডুম বাগডুম– বলে পঙ্কজিনী মুখ বাঁকিয়ে সরে আসে। আজকের কুটনোর পালা। তার, তাই এত বেজার সে।

ঘরশোভা দেবী দালানে পড়ে থাকলেও এসব জানতে পারেন, তাই ভুরু কুঁচকে ছোটবউমাকেই ডাকান, ভয় খেও না, পা টেপাতে ডাকিনি। তবে বলে রাখি, চাকর দাসীর সঙ্গে গুজগুজ ফুসফুস করতে নেই, ওতে মান থাকে না। ছেলেরা আমায় এত এত এনে দিলেই আমি এত এত খাওয়াতাম তোমাদের, শ্বশুরের আমলে কি চুনো-পুঁটি খেয়েছ কোনওদিন? তবু তো কর্তার আমলের এই বাড়িটি, আর বাড়িভাড়াটি আছে, তাই রামরাজত্ব চলছে।

পঙ্কজিনী অস্ফুটে বলে, গৌরী বাজে মাছ খেতে পারে না, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম কী মাছ আসবে?

গৌরী? ভাশুরপো বউ?

ঘরশোভা যেন আমোদে কুলকুলিয়ে ওঠেন, তার জন্যে এত দরদ? গৌরী তোমার বাপের কুলের দিকের মেয়ে নয় তো ছোট বউমা? …গৌরী পারে না, হুঁ। গৌরীর খুড়শাশুড়িও পারে না তা জানি। তবে নয় ওই ট্যাংরা মৌরলা ব্যাটা-ছেলেদের পাতে ধরে দিয়ে তোমরা শাশুড়ি বউতে কাটা পোনা খেও।

কথা বলে ঘরশোভা বাজারের পয়সা গুনে গুনে মিলিয়ে বালিশের তলায় রাখেন। এই বালিশের তলাতেই তাঁর সব। ছেলেরা মাসকাবারে যে টাকা ধরে দেয়, নাতিরা মাসকাবারি না বলে যা পারে তোমার হাতখরচ ঠাকুরমা বলে দেয়, আর বাড়িভাড়ার মোটা টাকাটি, সবই ওই বালিশের তলায়। লোহার সিন্দুকের চাবি পর্যন্ত। নিজে অশক্ত বলে চিন্তার বালাই মাত্র নেই।

নাতবউরা যখন বিশুদ্ধ বস্ত্রে দিদিশাশুড়ির পায়ে হাত বুলোতে আসে, তখন হাসিঠাট্টাও চলে।

বলে, আচ্ছা ঠাকুমা, আপনার তো কোমরের জোর অষ্টরম্ভা, এত সাহস আসে কোথা থেকে?

ঘরশোভা হেসে হেসে বলেন, জোর কি কোমরে থাকে নাতবউ? থাকে মনে আর মগজে।

তা বললে হবে কেন? এই যে এখনি যদি আমি চম্পাকলি হেসে বলে, আপনার বালিশের তলায় যা আছে ফট করে টেনে নিয়ে দে ছুট দিই, কী করবেন, ধরতে তো আর পারবেন না?

ঘরশোভা আত্মস্থ গলায় বলেন, নে দিকিনি টেনে, দে দিকিনি ছুট!

আহা সে না হয় আমরা ভাল মেয়ে তাই নিলাম না, নিলে তো আপনি কিছু করতে পারেন না!

পারি কিনা দেখিস।

বলে হাসতে থাকেন ঘরশোভা মুখ টিপে টিপে।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress