দশম অংক
অঘোরময়ী, উপেন্দ্র, দিবাকর, কিরণময়ী
উপেন– বৌঠান….. মাসিমা …
কি ব্যাপার, বাড়িতে কেউ নেই নাকি, দিবাকর? কোথায় গেল সব, ও বৌঠান।
মাসিমা কি অসুস্থ।
অঘোরময়ী— কে কে ডাকে। ও উপিন…
হায় হায় হায়। ও উপিন সব্বোনাশ হয়ে গেছে গো। সব্বোনাশ হয়ে গেছে,
( কান্না )
উপেন– কি হয়েছে, মাসিমা। কাঁদছেন কেন?
অঘোরময়ী— বাবা উপিন, কি বলব, তারা নেই।
আমার কুলটা বউ, ছি ছি ছি…..
বোসো বাবা বোসো উপিন, আমি এখন কি করি। ছি ছি ছি।
উপেন– কি,কি বলছেন। দিবাকর কোথায়?
অঘোরময়ী– কি করে বলবো বাবা। আজ একটু বেলা হয়েছে ঘুম থেকে উঠতে। ঝিও আসে নি। ও এলে ওদের না দেখে ওকেও জিজ্ঞেস করলাম।
বিপিন — কোথায় গেলো এতো সকালে।
অঘোরময়ী– তুমি বসো বাবা, ঘরে গিয়ে দেখি, আবাগীর বেটির গহনাপত্তর কিছুই নেই। সব নিয়ে পালিয়েছে।
ছি ছি ছি
এতক্ষণ চুপ করে আছো বিপিন, জানি তুমি কি না কি ভাবছ।
দুটিতে মিলে পালিয়েছে…..এমন অসতী কুলটা বউ —
আমার কপালে ছিল, হায় হায় হায় আমি কি করি , ও বিপিন…..
বিপিন — আমি একটু পরে আবার আসছি। এখন যাই।
…………………………………………..
(জাহাজের ভেঁপু। জলের শব্দ……)
কিরণময়ী– কেবিনের ভেতরে এসে বসো, ঠাকুরপো, রাত গভীর হচ্ছে জাহাজ মোহনা থেকে সাগরে পাড়ি দিয়েছে।
কথা শুনতে পাচ্ছ না। এসো, বলছি।
এসো।
দিবাকর– হু,
কিরণময়ী– হু কি? সেই ভোর রাতে জাহাজে ওঠার পর থেকে সারাদিন আমাকে এড়িয়ে ডেকে পাটাতনে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছ। একবারও আমার কাছে বা কেবিনে আসো নি। খাবারও খাও নি। কি হলো?
দিবাকর– হু
কিরণময়ী– হাত ধরে টেনে আনব নাকি, ডেক পাটাতনে দ্যাখো…অনেকেই চলাফেরা করছে। সবাই দেখছে, চলে এসো।
দিবাকর– আসছি
কিরণময়ী– এই নাও, খিদে ত পেয়েছে, এই মিষ্টিগুলো খাও।
দিবাকর– আমার খিদে নেই ,আমরা কোথায় যাচ্ছি।
রেঙ্গুন?
কিরণময়ী– না , আরাকান, মগের মুলুক।
দিবাকর– এমন কেন করলে বৌঠান?
কিরণময়ী– ওকি, কাঁদছ, ছিঃ। তুমি না পুরুষ মানুষ। আমায় ত ভালবেসেছ। তাই না।
দিবাকর– সকালে নিশ্চয়ই ছোড়দাদা এসেছিলেন, আমায় নিয়ে যাবার কথা ছিল।
কিরণময়ী– জানি, হা, হা, হা, হা,
দিবাকর– তুমি হাসছ? তুমি কি বৌঠান?
কিরণময়ী– আমি? হা, হা, হা, হা….
ভাবতে পারো পিশাচী, ভাবতে পারো পেত্নী, বা দানবী বা দেবী কিছুই না, আমি রক্তমাংসের একজন মানবী।
দিবাকর– এ অন্যায়, এ পাপ!!!
কিরণময়ী–পাপ? কেন। আমি একজন বিধবা, আমার উপর কারোর ন্যায়সঙ্গত দাবী নেই আর তুমিও অবিবাহিত সাবালক একজন পুরুষ।
দিবাকর– তাই বলে এমন….
কিরণময়ী —তোমার হৃদয়ের উপরেও কারো অধিকার নেই আমরা দুজনের সম্মতিক্রমে এসেছি এ আচরণে বাঁধা কোথায়?
পাপের কথাই বা কেন?
দিবাকর– সেকি বৌঠান, অবৈধ – প্রণয় যদি অন্যায় নয়, তবে সংসারে আর অন্যায় আছে কোথায়?
কিরণময়ী– অবৈধ -প্রণয় ? অবৈধ- প্রণয় ত নয়।
এ তোমার সংস্কার। যুক্তি নয়।
দিবাকর– বিবাহের দ্বারা যা সুপবিত্র নয়– যাকে সমাজ স্বীকার করে না।
আত্মীয়- স্বজন ঘৃণার সাথে দেখবে। তাই অবৈধ।
কিরণময়ী– এ নিয়ম ত মানুষের বিধি।
দিবাকর– সমাজ- শাসনে ত এ প্রয়োজন বৌঠান।
কিরণময়ী– হ্যাঁ ঐ জন্যই তা সংস্কার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতিহাস পুরাণ পড়ে দেখো, এই সংসারেই, স্ত্রী-পুরুষের এমন অনেক মিলন হয়ে গেছে যাকে কোনোমতেই পবিত্র বলা যাবে না।
দিবাকর–আমি আজ কোনমতেই তোমার সাথে এক ঘরে থাকতে পারব না।
কিরণময়ী– তা বললে কি হয়, জাহাজের অনেক যাত্রীরা জেনে গেছে, আমরা স্বামী স্ত্রী।
দিবাকর — সে তো দেখলাম কি ভয়ানক মিথ্যেকথা তুমি মনগড়া সব বলে গেলে।
কিরণময়ী– সবই ত দায়ে পড়ে।
ঐ যে বাড়িওয়ালি মহিলা কিছুতেই ছাড়ছিল না।
বলছিল শাঁখা- সিঁদুর পড়ি নি কেন?
দিবাকর– কি কারণ বললে?
কিরণময়ী– বললাম, তোমার ভারী অসুখ হয়েছিল, তাই একবছর মা-কালীর পায়ে বাঁধা রেখেছি। আর তাইত তোমায় ফিরে পেয়েছি।
দিবাকর– কেন? কি দরকার এতো মিথ্যে কথা বানিয়ে বলবার?
কিরণময়ী– বাঃ, বিদেশ বিভুই, কোথায় থাকব, এই আরাকানে….
থাকবার জায়গা আর তোমার চাকরী কেমন পাকা করে নিয়েছি, বলো ।
দিবাকর– আবারও বলি, কেন করলে এমন আমাকে নিয়ে। দুপুরে ছোড়দার সাথে কি কথা হয়েছিল , জানি না, তারপর রাতে ছোড়দাদা না খেয়ে চলে যাবার পর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে তুমিও আমায় নিয়ে এই আরাকান পাড়ির জাহাজ ধরলে। কেন কেন বৌঠান?
কিরণময়ী– তুমি এলে কেন?
দিবাকর– আমি ত কিছু বুঝতেই পারছিলাম না, কেমন সম্মোহিত হয়ে ছিলাম।
কিরণময়ী–আমি কি বশীকরণ মন্ত্র জানি,আসলে তোমারও আমার প্রতি এক দুর্বলতা আছে। বলো
আমাকে ভালবাসো , না?
দিবাকর– জানি না। কিছু,জানি না আমি তুমিও ত বলতে একজনকে ভালোবাসো, সে কে ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না।
কিরণময়ী— বুঝেচি, হ্যাঁ সেই আমার সব। সে না চাইলেও আমি শুধু তাকেই ভালবাসি।
দিবাকর– বলো বলো বৌঠান, সে কে?
তুমি ত অনেক বই পুস্তক পড়েছ। কত জানো, কেন এমন করলে? আমি যে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না।
কিরণময়ী– হ্যাঁ, তাকে ভালোবাসি। আজ কিছু আর গোপন করবো না। যেদিন তোমাকে তোমার ছোড়দাদা আমার হাতে তুলে দিয়ে গেলেন সেদিন থেকেই তোমাকে ছোট্ট ভাইয়ের চোখে দেখেছি।
দিবাকর—ভাই এর মতো!!! অথচ আজ তার এই পরিণতি?
কিরণময়ী– হ্যাঁ, ইচ্ছা হলে তুমি ফিরে যেতে পারো, তোমার ছোড়দাদা উপিনবাবুর পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে। সব দোষ আমাকে দেবে। তিনি মাপ করে দেবেন। তুমি পুরুষ মানুষ ।
কোন কলঙ্ক লাগবে না।
দিবাকর– এ কি খেলা? আর তুমি কি
করবে?
কিরণময়ী– আমি এখানেই থাকব। ঐ বাড়িয়ালী মহিলা আমাকে পথ দেখাবে। ওর ব্যবসা আমি বুঝতে পেরেছি।
দিবাকর– ছিঃ ছিঃ , বৌঠান, কার প্রতি এ প্রতিশোধ?
কিরণময়ী– হ্যাঁ। প্রতিশোধ। ধরো নিজের উপর।
দিবাকর– নিজের উপর!!!
কিরণময়ী– আমি ভগবান মানি নে, আত্মা মানি নে, পরজন্ম মানি নে ,স্বর্গ নরক ওসব কিছুই মানি নে, ও সমস্ত আমার কাছে ভুয়ো, মিথ্যে। মানি শুধু ইহকাল আর আমার এই সুন্দর দেহটাকে, তার রক্ষকও আমিই।
দিবাকর– যাকে ভালবেসেছিলে, তার প্রতি একি অভিমান।
কিরণময়ী– না অভিমান নয়, সিদ্ধান্ত। আর ভালোবেসেছিলাম শুধু নয়। তাকে এখনও ভালোবাসি। কায়মনোবাক্যে তাকে এখনও চাই। মৃত্যু অবধি ভালোবাসব।
দিবাকর– বুঝতে পেরেছি, তিনি আর কেউ নন, তিনি কি তোমার উপিন ঠাকুরপো।
কিরণময়ী– বড় দেরীতে বুঝলে। তবে বুঝতেই যখন পেরেছ তাহলে এখন চুপচাপ কথা শুনে চলো।
দিবাকর– আর এর পরিণাম?
কিরণময়ী– অবশ্যই তুমি পরে ফেরার জাহাজে ফিরে যেতে পারো।
দিবাকর– আমি কিছুতেই তোমার সাথে এক ঘরে থাকতে পারব না।
কিরণময়ী– পারতে তোমাকে হবেই। সমূদ্রে ঝড় উঠেছে, শুনতে পাচ্ছ না। এ সময়ে কেউ বাইরে থাকে।
দিবাকর– মরি মরব, আমি বেঁচে থাকতে চাই না।
কিরণময়ী– এত অল্পেই
দিবাকর– এ অল্প?
কিরণময়ী– তা নয়ত কি? আর কেন ভয় পাচ্ছ?
ভয় নেই।
আমায় স্পর্শ করবে এমন পুরুষ জন্মায় নি।
দিবাকর– সে কি। তোমার স্বামী!!!
কিরণময়ী– তিনি ভালবাসতেন বই।
প্রচুর বই, তাতেই ডুবে থাকতেন।
ছিলেন জীবন নীরস।
তারপর পড়লেন অসুখে…..
দিবাকর–কিন্তু, তিনি তোমাকে বিবাহ করেছিলেন যে।
কিরণময়ী– হু, মায়ের কথায়, আর আমার ভাগ্য।
আমিও আমার স্বামীকে ভালবাসি নি, কোনদিন।
ধীরে আমারও বই পড়া অভ্যেস হলো
দিবাকর– সতীশদা বলতেন তোমার স্বামী সেবার নাকি কোন তুলনা নেই।
কিরণময়ী– সে কথা ত সর্বাঙ্গীন সত্য, তাতে কি। আর্তকে সেবা করাই ত ধর্ম ভাই।
দিবাকর— কিন্তু বৌঠান, তুমি যে বলতে তুমি তোমার স্বামীকেই শুধু ভালবাস। আমি তোমার কথা যে কিছুই বুঝতে পারছি না, বৌঠান।
কিরণময়ী– কি করে পারবে ভাই।
আমার স্বামী ত জীবিত
দিবাকর– কি বলছ, বৌঠান?
বিবাহ ত হয় নি তার তোমার সাথে? স্বামী কেমন’
কিরণময়ী– হ্যাঁ, যাকে ভালবেসে আমার জীবন আজ ধন্য। তিনিই আমার স্বামী। স্বামী অর্থ জানো ত? তার প্রকৃত অর্থ প্রভু। আর বিবাহ ত এক নিয়ম। কিন্তু, তিনি, আমার প্রভু ত আমায় চান না ।
দিবাকর– বৌঠান, তুমি কি বলছ ?
তোমার কথা আমি বুঝে উঠতে পারছি না।
কিরণময়ী– নির্ভয়ে থাকো ভাই। এখন থেকে আমার কথামতো চলবে, আর নয়ত কলকাতা ফিরে যাও।
দিবাকর– এ সর্বনাশের খেলা কেন খেললে, আমার সাথে ?
আমি যে তোমায়….
কিরণময়ী— ভালবেসেছ, তাইত? এ ভালবাসা নয় এ সাময়িক এক মোহ মাত্র। আবারো বলছি, তোমার পথ কিন্তু খোলা আছে, তোমার ছোড়দাদা, তোমার বৌঠান তোমায় ক্ষমা করে নেবেন। দেখো। তুমি চলে যাও।