চমক
পুরাতন বাপের বাড়ি ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট হবে।মায়ের তলব তোমার যা পুরাতন স্মৃতি আছে শীঘ্র এসে নিয়ে যাও।আসন্ন বর্ষা।এই বর্ষায় বাড়িতে আর বাস করা যাবে না।ছাদ ভেঙে বিপদ আসবে। তাছাড়া আগের বর্ষায় ঘরে ঘরে জল থৈ থৈ ছিল।আর কদম গাছটা বাড়ির তিলতলা পর্যন্ত লম্বা হয়ে গেছে।সব সময় কদমের গন্ধ মনটা অস্হির করে।ওই গাছটা কেটে ফেলতে হবে।জানিস মা বাড়িটা ফ্ল্যাট হবে ভাবলেই কষ্ট হয়।বাগানে হাস্নাহেনার গন্ধ মন আমোদিত করত। সব কেটে বিরাট অট্টালিকা হবে।
আমি মা কে বলি–
ঠিক আছে মা সব পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হবে। তাহলে তোমার বর্ধমানের বাপের বাড়ি !! সেটা নিশ্চয় মনে পড়ে। আমার তো মামার বাড়ি পছন্দের ছিল। হিজলের ছায়ায় অনুভূত হত টুংটাং শব্দে জলের তরঙ্গ।
দেখতে পাচ্ছি যেন সেই বর্ষার আগমন উপলক্ষে মামাতো ভাই বোনের সাথে “বর্ষামঙ্গল” নাটক করা। শুনতে পাচ্ছি যেন আঁধার করা উড়ন্ত কালো মেঘের গুরু গম্ভীর রব।
দাদুর সেই উদাত্ত কণ্ঠ–
“নীল নবঘনে তুষার গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে
ওরে আজ তোরা যাস না রে
ঘরের বাহিরে”।
ময়ূর ময়ূরীর কেকা ধ্বনি।
তাল দাদরার মিশ্রিত মেঘ রাগ
ডমরুর আওয়াজ ও ভৈরবী নৃত্য
“হৃদয় আমার নাচে রে ময়ূরের মতো নাচে”
ঠিক ধরেছেন প্রচণ্ড তাপদাহ থেকে মুক্তি “বর্ষা বরণ “করতে ব্যস্ত।
বর্ষার আগমনে বুকের মধ্যে গুরু গুরু রবে যেন ঢাক বাজে।
কৃষকেরা আনন্দে উৎফুল্লিত।আউস ধান তোলা, পুকুর,খাল বিল সব জলে টইটম্বুর অবস্থা। মামার বাড়ি দালানে, আঙিনায় মাছ কিলবিল। শুকনো ডাঙা থাকত না। সব জলে জলময়। আমরা ঘর থেকে কাগজের নৌকা ছাড়তাম। তাহলে এত স্মৃতি বুকে চেপে তুমি বাবার সাথে সংসার করলে। জীবন তো পরিবর্তনশীল।
গ্রীষ্মের তাপদাহে জর্জরিত হলেও মাঝে মাঝে বর্ষা সুন্দরীর হঠাৎ হঠাৎ আগমন ঘটে। বাপের বাড়ি গিয়ে স্মৃতি ঘাটতে গিয়ে একটা ডায়েরী চোখে পড়ল। আমার বিয়ের আগে দৈনিক ঘটনাবলি লেখা ।ডায়েরীর পাতায় একটি ছবি। বুকটা হু হু করে ওঠে। আমার দাদার ছবি। এক বর্ষায় সাইকেল নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়েছিল একটা গাছ বৈদ্যুতিক তারে এসে পড়ে।ওই তার ছিঁড়ে জলে পড়েছিল। দাদা সাইকেল থেকে জলে নামতেই বিদ্যৎ স্পৃষ্ট হয়ে তৎক্ষণাৎ মা’রা যায়।
মায়ের অনেক স্মৃতি বিস্মৃত হয়েছে। দাদার মৃত্যুর পর মা কোমায় চলে গেছিল।তারপর কোমা থেকে বার হয় , কিন্তু আগের কথা কিছু মনে নেই। আমার নিজের পরিচয় দিতে হয়েছিল মা আমি তোমার মেয়ে। মাধ্যমিক দেব।
তারপর মা মেনে নেয় তার স্বামী ও কন্যাকে। বাবা হয়তো আগের স্ত্রীয়ের মত মন পেত না। ছেলের কথা বলতে পারত না । গুমড়ে থাকতে থাকতে শেষ।এখন মা সব তদারক করে। ভগবান শক্তি দিয়েছেন।।না হলে একাই প্রোমোটারের সাথে কথা বলে ফ্ল্যাট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য কাকু ও সাহায্য করে। বাপের বাড়ি থেকে ফেরবার সময় মা বলল শুধু ডায়েরীটা নিবি মা।ওই ছেলেদের মতো কটা জামা আছে।ওগুলো নিয়ে যা না মা।টুটুল খুশি হবে।
আমি চমকে উঠি। মার তাহলে দাদা কে মনে ছিল! হঠাৎ মা বলে ওগুলো ভাড়া বাড়িতে নিয়ে গেলে ছেলেটা কষ্ট পাবে! আর শোন মা তোর কাছে বর্ষা মানে ভয়ংকর।সাদরে “বর্ষা বরণ” কর। যে যাবার সে তো যাবেই।তোর দাদার আয়ু অতটুকু ছিল।