Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চক্রপুরের চক্করে || Shirshendu Mukhopadhyay

চক্রপুরের চক্করে || Shirshendu Mukhopadhyay

সকালের আপ ট্রেন

সকালের আপ ট্রেন থেকে একটা লোক যখন লটবহর নিয়ে হুড়মুড়িয়ে চক্ৰপুর রেল স্টেশনে নেমে পড়ল তখন পোটার লাখন আর স্টেশনবাবু সতীশ দত্ত দুজনেই কিছু অবাক হয়েছিল। চক্ৰপুর নিতান্তই ব্রাঞ্চ লাইনের খুদে একটা স্টেশন। এখানে শহর গঞ্জ বলে কিছু এখন আর নেই। লোকজন বিশেষ যায়ও না, আসেও না।

লোকটার সঙ্গে একটা কালো ট্রাঙ্ক, একটা সুটকেস, একটা বেডিং, একটা টিফিন ক্যারিয়ার আর জলের বোতল। লাল মোরামের প্ল্যাটফর্মে জিনিসপত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে লোকটা বোকার মতো ইতিউতি চাইছে দেখে সতীশ একটু এগিয়ে গেল।

“কুলি খুঁজছেন নাকি? এখানে কিন্তু কুলিটুলি পাবেন না। …”

লোকটা দেখতে সরল সোজা ভালমানুষের মতো। রংটি কালো, বেশ মোটাসোটা, মস্ত গোঁফ আছে, পরনে ধুতি আর সাদা শার্ট। সতীশের দিকে করুণ নয়নে চেয়ে লোকটা একটু চাপা গলায় বলল, “এখানে একটু লুকিয়ে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে?”

সতীশ অবাক হয়ে বলে, “লুকিয়ে থাকবেন? লুকিয়ে থাকবেন কেন?”

লোকটা একটা সবুজ রুমালে মুখটা ঘষে-ঘষে মুছতে মুছতে বলল, “আমার বড় বিপদ যাচ্ছে মশাই। একটা খুনের মামলায় সাক্ষী দিয়ে এমন ফেঁসে গেছি যে, আর কহতব্য নয়। তা এখানে একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকার ব্যবস্থা নেই?”

লোকটার ভাবভঙ্গি আর কথা বলার ধরন এমন যে, বিপদের কথা শুনেও সতীশের একটু হাসি পেয়ে গেল। হাসিটা চেপে সে গম্ভীর হয়ে বলল, “লুকিয়ে থাকা তো দূরের কথা, এখানে মাথা গোঁজার জায়গাই নেই। চক্ৰপুরে এসে আপনি ভুল করেছেন।”

লোকটা হতাশ হয়ে ধপ করে ট্রাঙ্কের ওপর বসে পড়ল। তারপর আপন মনে মাথা নেড়ে বলল, “ভুল করাটাই আমার স্বভাব কিনা। যা-ই করতে যাই সেটাতেই গণ্ডগোল। তা এটা ঠিক ঠিক চক্রপুরই বটে তো?”

“আজ্ঞে, এটা ঠিক-ঠিক চক্রপুরই বটে। ওই তো স্টেশনের সাইনবোর্ডে লেখাও আছে।”

লোকটা ঘাড় নেড়ে বলে, “তা হলে জায়গাটা ভুল করিনি বোধ হয়। এইখানেই আমাদের আদি বাড়ি ছিল। যদিও পঞ্চাশ-ষাট বছর হল বসবাস উঠে গেছে। এখানে শুখানালা বলে একটা জায়গা আছে কি?”

সতীশ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “শুখানালা? নামটা শোনা-শোনা মনে হচ্ছে। তবে ঠিক,..”

কখন লাখন এসে পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে বলল, “হ হাঁ, শুখানালা জরুর হ্যাঁয়। হুই দিকে যো শালজঙ্গল আছে, তার ভিতরে। উখানে তো এখুন জঙ্গল ছাড়া কুছু নাই।”

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “এরকমই হওয়ার কথা। কবে

বসত উঠে গেছে, বাড়িঘরও নিশ্চয়ই লোপাট। আমি অবশ্য কখনও আসিনি এখানে। তবে বাপ ঠাকুদার মুখে চক্ৰপুরের কথা শুনেছি।”

সতীশ বলে, “তা এখন আপনি বেন কি? শুখানালায় পৈতৃক বাড়ির সন্ধানে যাবেন নাকি?”

লোকটা দুশ্চিন্তায় তোম্বা মুখোনা নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার যা বিপদ যাচ্ছে সে আপনাদের বোঝাতে পারব না। আচ্ছা, এখানে কোনও সদাশয় সাহসী লোককে কি পাওয়া যাবে, যে প্রয়োজনে একটু-আধটু মিথ্যে কথা বলতে পারে?”

সতীশ এবার আর হাসি চাপতে পারল না। পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বলল, “এরকম লোক দিয়ে কী করবেন?”

লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “সদাশয় না হলে আমাকে আশ্রয় দেবে না, সাহসী না হলে বিপদ-আপদ ঠেকাবে কে, আর মিথ্যে কথা না বললে আমাকে বাঁচানো সহজ হবে না। পানু মল্লিকের দল আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে।”

সতীশ এবার আরও একটু গম্ভীর হয়ে বলে, “তা হলে বলতেই হয়, আপনি এখানে এসে ভুল করেছেন। এখানে মানুষজনের বসতি বিশেষ নেই। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দু-চারঘর মানুষ আছেন বটে, কিন্তু সেখানে সুবিধে হবে না।”

লোকটা মাথা চুলকোতে-চুলকোতে মহা-ভাবিত হয়ে বলল, “তা হলে তো খুব মুশকিল হল মশাই। এ তো দেখছি বেঘরে প্রাণটা যাবে। ভেবেছিলুম পৈতৃক ভিটেয় এসে পড়লে পাড়া-প্রতিবেশীরা ফেলবে না। এ তো দেখছি পাড়াই নেই। এখন কী করা যায় একটু বলতে পারেন?”

সতীশের একটু মায়া হল। লোকটার মুখচোখে বিপন্ন ভাব দেখে সে বলল, “এ-বেলাটা আমার কোয়াটারে বিশ্রাম নিতে পারেন। তারপর ভেবে দেখা যাবে।”

লোকটা বেজার মুখ করে বলে, “স্টেশন বড় উদোম জায়গা। লোকের নজরে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে।”

“তা হলে কী করবেন?”

“আচ্ছা, এখানে কি চোর-ছ্যাঁচড়ের খুব উৎপাত আছে? না থাকলে মালপত্রগুলো স্টেশনেই রেখে আমি বরং বাপ-পিতেমোর ভিটেটাই একটু দেখে আসি। তারপর যা হওয়ার হবে। কী বলেন।”

লাখন এবার এগিয়ে এসে বলে, “আহা-হা, জঙ্গলে গিয়ে হোবেটা কি? দু-চারটো রোটি খেয়ে লিন, একটু চা-পানি ভি পিয়ে লিন, তারপর ঘুমনে যাবেন।”

কিন্তু লোকটার এমনই অবস্থা যে, এসব ভাল প্রস্তাব গ্রহণই করতে পারছে না। মাথা নেড়ে বলে, “না বাবা না, পরের গাড়িতেই পানু মল্লিকের খুনে গুণ্ডারা চলে আসতে পারে। স্টেশন বড় ভয়ের জায়গা।”

সতীশ বলে, “পরের গাড়ি সেই সন্ধের পর। আপনার কোনও ভয় নেই। তা ছাড়া একা-একা জঙ্গলে ঘুরে শুখানালা খুঁজে বের করাও সহজ নয়। এ-বেলাটা কাটিয়ে ও-বেলায় গাঁয়ের লোক বা রাখাল-ছেলে কাউকে সঙ্গে দিয়ে দেবখন।”

অগত্যা লোকটা যেন খানিকটা অনিচ্ছে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেল।

বিপদে পড়লে মানুষের খিদে-তেষ্টা থাকে না। এ-লোকটারও দেখা গেল তাই। স্নানটান করার পর লাখন যখন গরম-গরম রুটি আর আলু-মরিচের তরকারি বেড়ে দিল তখন লোকটা তেমন খেতেই পারল না। অথচ লাখনের রুটি-তরকারি সতীশের জিভে অমৃতের মতো ঠেকে।

“খাচ্ছেন না যে বড়!”

লোকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আর খাওয়া! যখনই কিছু খাই তখনই মনে হয় এই শেষ-খাওয়া খাচ্ছি। মুখের খাবার যেন ছাই হয়ে যায়।”

“ঘটনাটা একটু খুলে বলবেন? আপনাকে দেখে তো ভাল লোক বলেই মনে হয়, খুনের মামলায় জড়ালেন কী করে?”

লোকটা অকপটে বলল, “আজ্ঞে, আপনার অনুমান যথার্থ, আমি সত্যিই বেশ ভাল লোক। এমনকী খুব ভালও বলা যায়। তবে এতটা বললে আবার নিজের মুখে নিজের প্রশংসা হয়ে যায় বলে একটু চেপেই বলছি। আর খুনের মামলার কথা কী আর বলব মশাই। দুনিয়ায় ভাল লোকদেরই আজ দুর্দিন। স্বচক্ষে দেখা খুন। কিন্তু পানু মল্লিকের লোকেরা আমার গলায় গামছা দিয়ে কথা আদায় করেছিল, আদালতে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, ধর্মাবতার আমি খুনটুন কিছু দেখিনি। বলতুমও তাই। কিন্তু বাধ সাধল কী জানেন? মহাত্মা গান্ধীর একখানা ছবি। এজলাসের দেওয়ালে ছবিটা টাঙান, নীচে আবার লেখা সত্যমেব জয়তে। দেখে কেমন যেন হয়ে গেলুম। আমার মনে হল, না, যা থাকে কপালে, আজ বুক ঠুকে সত্যি কথাটাই বলে ফেলি। আর সেটা বলেই তো এই বিপদ।”

সতীশ জিজ্ঞেস করল, “পানু মল্লিক লোকটা কে?”

“ও বাবা, সেই তো পালের গোদা। দিনে-দুপুরে হাতে মাথা কাটে।”

“সাক্ষী দিয়ে আপনি পালালেন কী করে? তার স্যাঙাৎরা ছিল না?”

লোকটা মাথা হেলিয়ে বলল, “খুব ছিল। এজলাসে তাদের চোখ জোড়া-জোড়া টর্চবাতির মতো আমার ওপর ফোকাস হচ্ছিল। আমি সাক্ষী দেওয়ার পরই বুঝলুম, এজলাস থেকে বাড়ি যাওয়ার পথেই আমি খুন হব। তাই একজন পুলিশ অফিসারকে সাপটে ধরে বললুম, সার, আমাকে একটু এগিয়ে দিন। তা লোকটা মন্দ নয়। জিপ গাড়িতে তুলে খানিকদূর এগিয়েও দিল। আমি নেমে চোঁ-চা দৌড়ে সোজা স্টেশনে এসে গাড়ি ধরেছি।”

বিস্মিত সতীশ বলল, “তা হলে এইসব মালপত্র আপনাকে দিয়ে গেল কে?”

লোকটা তোধিক বিস্মিত হয়ে বলে, “মালপত্র! মালপত্র আসবে কোথা থেকে?”

“এই যে ট্রাঙ্ক, সুটকেস, টিফিন ক্যারিয়ার এসব কোথা থেকে এল?”

লোকটা যেন কাঁচা ঘুম থেকে উঠল এমন অবাক চোখে মালপত্রগুলোর দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “তাই “এগুলো কি আপনার নয়?”

লোকটা সবেগে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, “কস্মিনকালেও নয়। এসব কি আমি সঙ্গে করে গাড়ি থেকে নেমেছি?”

“আলবাত। আমরা নিজের চোখে দেখেছি। ওই লাখনকে জিজ্ঞেস করুন না।”

লাখনও সায় দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, জরুর। ইসব তো আপনারই মাল আছে বাবুজি।”

লোকটা জিভ কেটে মাথা নেড়ে বলে, “ইস, বড় ভুল হয়ে গেছে মশাই। মাথাটারও ঠিক নেই। ট্রেন থেকে নামার সময় আনমনে কার মালপত্র যেন নামিয়ে ফেলেছি। ব্যাপারটা কী জানেন? ওরকম একটা কেলে ট্রাঙ্ক, ওরকম একটা বাদামি সুটকেস আর ওই স্টিলের টিফিন ক্যারিয়ার আর জলের বোতল আমারও আছে। যখন যেখানে বেড়াতে যাই তখন ওই চার পিস মাল আমার সঙ্গে থাকেই। অভ্যাস কি না। নামবার সময় ওই চারটে সামনে দেখে মনে হয়েছে বুঝি আমারই জিনিস। এ হে, এ যে ভারী গণ্ডগোল হয়ে গেল!”

সতীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “খুবই গণ্ডগোল। যার মাল সে যদি এখন পুলিশে খবর দেয় তো আপনার বিপদ আছে।”

লোকটা মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলে, “আজ্ঞে আমার বিপদের আর অভাব কি? চারদিকে বিপদের একেবারে ঢেউ খেলছে।”

সতীশ হঠাৎ কি যেন মনে পড়ায় বলল, “ওঃ ভাল কথা, আপনার টিকিটটা কিন্তু এখনও দেননি। রেলের টিকিটটা কোথায়।”

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “নেই। টিকিট কাটার সময় হল কোথায় বলুন! দৌড়ে এসে ট্রেন ধরলুম যে!”

“তা হলে বিনা টিকিটের যাত্রী হিসেবে আপনার আরও কিছু ঝঞ্জাট আছে। ফাইনসহ গাড়িভাড়া দিতে হবে।”

“একেই কি লোকে বিপদের ওপর বিপদ বলে?”

“হ্যাঁ, এটাই হল বিপদের ওপর বিপদ।” লোকটা কাহিল মুখে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলে, “এখানে কি রেল পুলিশ বা থানা আছে?”

“এখানে না থাকলেও পরের স্টেশনে আছে। টরেটক্কা করে দিলেই বেলা দশটার ডাউন গাড়িতে ফোর্স চলে আসবে। এই স্টেশনে আজ অবধি একটি লোকও আমার হাতে পার পায়নি। টিকিট না থাকলে হয় জরিমানা দাও নয়তো স্টেশনের ঘরে বসে থাকো, পুলিশ এসে নিয়ে যাবে।”

লোকটা চারদিকে টালুমালু করে চাইল। তারপর হঠাৎ ফ্যাঁসফাঁসে গলায় বলল, “একটু জল খাব। গলাটা বড় শুকনো লাগছে।”

লাখন তাড়াতাড়ি পেতলের ঘটিটা এগিয়ে দিল। লোকটা ঢকঢক করে ঘটি খালি করে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আচ্ছা একটা কথা আছে না, বিপদ কখনও একা আসে না!”

“আছে।”

লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “ইয়ে, আমি একটু বাথরুমটা ঘুরে আসি। কেমন?”

“আসুন। আমি স্টেশন থেকে টরেটক্কা করে দিয়ে আসছি ততক্ষণ।”

“পুলিশ ডাকবেন তো?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। ফাইনসহ পুরো ভাড়া না দিতে পারলে পুলিশে হ্যান্ডওভার করতেই হবে।”

“আপনি খুব তেজস্বী লোক দেখছি।”

সতীশ মাথা উঁচু করে বেশ অহঙ্কারের সঙ্গে বলল, “তা বলতে পারেন। আমরা তিনপুরুষের রেলের চাকুরে। আমাদের বংশে কেউ কখনও কোনও দুর্নীতির প্রশ্রয় দেয়নি। কর্তব্য যত কঠিন আর নিষ্ঠুরই হোক তা আমরা করবই।”

লোকটা সভয়ে মাথা নেড়ে বলল, “সে বুঝেছি। তেজস্বী লোকদের জন্যই আজ আমার এই বিপদ। ওই যে গান্ধীজি– উনিও এক তেজস্বী লোক। তাঁর ফেরে পড়েই আজ আমার এই দুর্গতি। দুটো মিথ্যে কথা কইলে আজ কত সুখে থাকতে পারতুম। তা মশাই, আমি এখন একটু বাথরুমে যাব কি?”

সতীশ বলল, “সে যান। কিন্তু পালানোর চেষ্টা করবেন না। লাখন মস্ত কুস্তিগির, সে আপনার ওপর নজর রাখবে। আর পালালেও বিশেষ সুবিধে হবে না। এখানে নানারকম বিপদ। আপনার নামটি কী বলুন তো, নোট করে রাখি।”

“নাম!” বলে লোকটা ঢোক গিলল, “এই রে! নামটা যে ভুলে মেরে দিয়েছি।”

সতীশ চোখ কপালে তুলে বলে, “নিজের নাম ভুলে গেছেন! আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই।”

লোকটা সিলিঙের দিকে তাকিয়ে গলা চুলকোতে-চুলকোতে অত্যন্ত ব্যস্তভাবে ভাবতে লাগল। ঘন-ঘন মাথা নাড়ল। তারপর চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “পেটে আসছে, মুখে আসছে না। এত বিপদে কি মাথার ঠিক থাকে। মাথাটা কেমন যেন ফরসা হয়ে গেছে, একেবারে সাদা। তবে নিজের নামটা ভুরভুরি কাটছে ঠিকই। একটু সময় দিন, ঠিক মনে পড়ে যাবে।”

সতীশ মাথা নেড়ে বলে, “ওসব চালাকি আমার ঢের জানা আছে। যে নিজের নাম চাপা দিতে চায় তার ভালরকম গলদ আছে। আমার সন্দেহ হচ্ছে আপনি কোনও গুরুতর রকমের অপরাধ করে পালিয়ে এসেছেন। হয়তো খুন, হয়তো ডাকাতি। নাঃ, আর দেরি করা ঠিক হবে না। রেল-পুলিশে খবরটা তো আগে দিই, তারপর এখানকার থানাতেও ব্যাপারটা জানাতে হবে।”

একথায় লোকটা খুব অবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল, মুখে বাক্য সরল না। শুধু বারকয়েক শুকনো মুখে ঢোক গিলল। মুখোনা এমন করুণ আর ফ্যাকাসে হয়ে গেল যে, সতীশের মতো দৃঢ়চেতা লোক না হয়ে অন্য কেউ হলে সেই করুণ মুখ দেখে হয়ত করুণায় কেঁদেই ফেলত। কিন্তু সতীশ বজ্রকঠিন মানুষ। অন্যায় সে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। তার সঙ্গী খনও তার মতোই। লাখন কুস্তিগির পালোয়ান এবং পরম রামভক্ত মানুষ। রোজ সে রামচরিতমানস সুর করে পড়ে, রাম-সীতা এবং বজরঙ্গবলীর পুজো না করে জলগ্রহণ করে না। সে-ও অন্যায়-অধর্ম সইতে পারে না। সুতরাং লোকটার মুখ দেখে কারও তেমন করুণার উদ্রেক হল না।

লোকটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাঙা গলায় বলল, “এরেই কয় মাইনকা চিপি।”

সতীশ গলা চড়িয়ে বলল, “কী বললেন? গালমন্দ করছেন নাকি?”

লোকটা মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না। গালমন্দ নয়। কথাটা আমার দাদু প্রায়ই বলতেন।”

“কথাটার মানে কী?”

“আজ্ঞে সেটা আমিও ঠিক জানি না। শুধু জানি মাইনকা চিপি।”

“এটা কি বাঙল ভাষা?”

“তা হতে পারে।” বলে লোকটা চোখ বুজে বড়বড় খাস ফেলতে লাগল। দীর্ঘশ্বাসই।

সতীশ বেরিয়ে গেলে লোকটা করুণ নয়নে লাখনের দিকে চেয়ে বলে, “লাখনদাদা, আমি একটু বাথরুমের দিকে যেতে পারি?”

“হাঁ, হাঁ, কিউ নেহি? লেখিন ভাগবার কোসিস করবেন না। খবরদার। পুলিশ আসবে, বিচার হোবে, তারপর রামজীর যো হিচ্ছা সো হোবে।”

লোকটা বিগলিত হয়ে মাথা নেড়ে উঠে পড়ল। রেলের কোয়াটারের ভেতরদিকে একটা উঠোন। উঠোনের এককোণে স্নানঘর। উঠোনটা বেশ উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। তবে পেছনদিকে জমাদার আসবার একটা দরজা আছে। সেটাতে হুড়কো দেওয়া। লোকটা স্নানঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। তারপর দরজার পাল্লা সামান্য ফাঁক রেখে নজর করে দেখল, লাখন দরজায় দাঁড়িয়ে একবার হাই তুলল, তারপর আড়মোড়া ভেঙে “জয় বজরঙ্গবলী” বলে দু-চারবার ডন-বৈঠক করে নিল। এ সময়ে বাইরে থেকে হঠাৎ হেঁড়ে গলায় কে হাঁক দিল, “এ লাখনভাই, তোর ভৈস কাঁহ ভাগলবা? খোটুয়া উখাড়কে ভাগলবা রে।”

“আয়া রে।” বলে লাখন এক দৌড় মারল।

লোকটা আর দাঁড়াল না। পেছনের দরজার হুড়কো খুলে বেরিয়ে প্রাণপণে দৌড়তে লাগল। কিন্তু মুশকিল হল, লোকটা জীবনে দৌড়ঝাঁপ করেনি, শরীরটাও থলথলে। ফলে দৌড়লেও কোনও লাভ হচ্ছিল না। উপরন্তু লোকটা একটা ছোটখাটো মাঠ পেরোতে গিয়েই ঘেমে, হাঁফিয়ে বেদম হয়ে পড়ল। সারা শরীর ঝনঝন করতে লাগল দৌড়ের ধাক্কায়।

মাঠ পেরিয়েই একটা বাগানওলা পাকাবাড়ি দেখে লোকটা সটান ঢুকে পড়ল। বারান্দায় বসে এক পাকাচুলের বুড়ো মানুষ হুঁকো খাচ্ছেন। লোকটাকে দেখে তিনি হঠাৎ আঁতকে উঠে চেঁচাতে লাগলেন, “ও বাবা, এ যে মস্ত এক কেলে গোর ঢুকে পড়েছে বাগানে! ওরে পন্টু, তাড়া শিগগির গোরুটাকে, সব গাছ খেয়ে ফেলবে?”

লোকটা আতঙ্কিত হয়ে হাতজোড় করে বলে, “আজ্ঞে আমি গোরু নই। বড় বিপদে পড়ে এসেছি, যদি একটু আশ্রয় দেন।”

বৃদ্ধ কোটি রেখে ভ্রূ কুঁচকে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “অ, তা ভাল কথা। কিন্তু বাপু, আমার কোদালখানা কি করলে?”

লোকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলে, “কোদাল! কোদালের কথা উঠছে কেন?”

বুড়ো খ্যাঁক করে উঠলেন, “কোদালের কথা কি আর এমনি ওঠে বাপু! ন্যাকামি কোরো না। পরশুদিন এসে সক্কালবেলায় তুমি আমার কোদালখানা চালাকি করে নিয়ে যাওনি? খুব তো ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছিলে, জ্যাঠামশাই, আমি হরি সামন্ত, কোদালখানা একটু দেবেন, ও-বেলা দিয়ে যাব। তা আমিও হরি সামন্ত মনে করে কোদালখানা দিয়ে দিলুম। পরে হরি এসে বলল, সে পরশুদিন এখানে ছিলই না।”

লোকটা হাতজোড় করেই বলল, “আজ্ঞে আমিও ছিলুম না। আজ সকালেই আমার এখানে প্রথম আগমন হল।”

“বিপদে পড়লে লোকে কত কী বলে, ওসব বিশ্বাস করে আহাম্মকেরা। তোমাকে ঠিকই চিনেছি বাপু, চোখে কম দেখি বলে যে আমার চোখে ধুলো দিয়ে পালাবে তার জো নেই। পরশু কোদাল নিয়েছ, আজ আবার আশ্রয় না কী যেন নিতে এসেছ, তুমি তো মহা ধুরন্ধর হে! ওরে পন্টু, শুনছিস! বল্লমখানা নিয়ে আয়, এই কোদালচোর সাঙ্ঘাতিক লোক।”

ভেতর থেকে কে যেন হেঁড়ে গলায় বলে উঠল, “এই আসছি জ্যাঠামশাই, মুগুরটা আর দশবার ভেজেই আসছি। চোরটাকে ধরে রাখো।”

একথা শুনে লোকটা আর দাঁড়াল না। ফটক পেরিয়ে পাই-পাই করে ছুটতে লাগল। তবে তার কাছে ছোটাটা পাই-পাই মনে হলেও আসলে সে ছুটছিল নিতান্তই থপথপ করে, গজকচ্ছপের মতো। বুকে দম নেই, হাঁটু ভেঙে আসছে, তেষ্টায় কণ্ঠা অবধি শুকনো। তবে ভাগ্য ভাল, মুগুরভাঁজা শেষ করে পন্টু এখনও তার পিছু নেয়নি।

তবু সাবধানের মার নেই। লোকটা পথ ছেড়ে পাশের মাঠে নেমে পড়ল। সেখানে দিব্যি বুকমান উঁচু ধানগাছ। লুকনোর খুব সুবিধে। কোথায় যাবে তারই যখন ঠিক নেই, তখন ধানখেতে ঘুরে বেড়ালেই বা ক্ষতি কী?

এখন শরৎকাল। নীল আকাশে ভোরের সোনার রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। মিঠে হাওয়া দিচ্ছে। পাখি ডাকছে। লোকটার বেশ ভাল লাগতে লাগল। গাঁয়ে-গঞ্জে বড় একটা যায়নি সে। প্রকৃতির শোভা যে এতদূর ভাল তা-ও যেন অজানা ছিল। আহা, কী সুন্দর!

ধানখেতের ভেতরে আলপথ বেয়ে লোকটা খানিকদূর এগোতেই দেখতে পেল দু-চারজন চাষি ধান কাটছে। কাছেই কোনও গ্রাম থেকে কুকুরের ঘেউ-ঘেউ আর গোরুর হাম্বা রব

ভেসে আসছে। লোকটার মন খুব ভাল হয়ে গেল। গাঁয়ের লোক নিশ্চয়ই খারাপ হবে না। গাঁয়ে যারা থাকে তারা হল গে সহজসরল মাটির মানুষ, সাত চড়ে রা কাড়ে না। সেখানে “গেয়ে গান নাচে বাউল, গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।”

তবে সামনে যে ক’জন চাষিকে দেখা যাচ্ছে তারা কেউ গান গাইছিল না। একদম সামনেই যে চাষিটিকে দেখা যাচ্ছিল, তার মুখোনা ভারী তিরিক্ষে। তা হোক, এরা লোক খারাপ হয় না।

লোকটা যথাসাধ্য হাসি-হাসি মুখ করে এগিয়ে গিয়ে বলল, “এই যে ভাই!”

লোকটা ধান কাটতে কাটতে গোমড়া মুখটা তুলে গুরুগম্ভীর গলায় বলে, “কী চাই?”

বলার ধরনটা ভাল ঠেকল না, লোকটা একটু দমে গিয়ে বলে, “আচ্ছা, এদিকে ভাল লোক কি দু-একজনকে পাওয়া যাবে? বেশ নরম দয়ালু মন, অন্যের দুঃখে প্রাণ কাঁদে, দান করার ঝোঁক আছে, অথচ গায়ের জোর-টোর তেমন নেই পাওয়া যায় এমন মানুষ?”

চাষিটি কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে থেকে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে পাশের খেতের লোকটাকে হাঁক মারল, “ওরে নেতাই, এই সেই লোক।”

নেতাই চেঁচিয়ে বলল, “কে তোক রে?”

“আরে, গেল বুধবার কুঞ্জখুড়োর বাড়িতে যে ডাকাতি হল মনে নেই? সেই দলে ছিল। মুখে ভূসোকালি মাখা ছিল, তবু ঠিক চিনেছি। এ সেই দলের লোক।”

লোকটা হাঁ-হাঁ করে উঠল, “না, না, কোথাও খুব ভুল হচ্ছে খুব ভুল করছেন আপনারা ততক্ষণে দুই চাষি কাস্তে হাতে তেড়ে এল। লোকটা ফের পাঁই-পাঁই করে ছুটতে লাগল। সে যা ছুট তাতে যে-কেউ একটু পা চালিয়ে হেঁটেই ধরে ফেলতে পারত তাকে। কিন্তু কপালটা ভালই, মাঝখানে একটা জলের নালা থাকায় তোক দুটো চট করে কাছে চলে আসতে পারল না। নালাটা পেরোতে একটু ঘুরপথে আসতে হল। ততক্ষণে লোকটা ধানখেত পার হয়ে একটা জঙ্গলের ধারে পৌঁছে গেছে।

জঙ্গলে সাপ আছে কি বাঘ আছে সে বিচার করার সময় নেই। লোকটা হাঁফাতে-হাঁফাতে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। বেশ নিবিড় অন্ধকার জঙ্গল। ঘন গাছপালা, লতা, ঝোঁপ সব রয়েছে। গা-ঢাকা দেওয়ার পক্ষে চমকার। লোকটা জঙ্গলে ঢুকে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে-হাঁফাতে কোমরে হাত দিয়ে একটু দাঁড়িয়ে রইল। আর চলবার ক্ষমতা নেই।

জঙ্গলের বাইরে সেই হেঁড়ে গলাটা শোনা গেল, “ওরে নেতাই, ডাকাতটা যে মনসাপোঁতার জঙ্গলে ঢুকে গেল!”

নেতাই খুব আহ্লাদের গলায় বলে, “ভালই হয়েছে রে জগা। ডাকাত ধরলে আমাদেরই ভয় ছিল। ওর দল এসে আমাদের কেটে ফেলত। তার চেয়ে মনসাপোঁতার ব্ৰহ্মদত্যিই নিকেশ করবে ওকে। ই- বাছাধন, এবার যাবে কোথায়?”

জগাও বেশ প্রফুল্ল গলায় বলল, “আর ব্রহ্মদত্যিই বা একা। কেন? শুখানালার বুনন কুকুরগুলোও রয়েছে। দেখতে পেলেই ছিঁড়ে খাবে।”

এইসব বলাবলি করতে করতে দুজনে চলে গেল।

লোকটা সভয়ে নিজের চারদিকটা দেখল ভাল করে। বিশাল বড় বড় গাছ চারদিকে। শাল-সেগুনই হবে। আর তার ফাঁকেফাঁকে ঝোঁপঝাড় আর লতাপাতায় চারদিকটা দুর্ভেদ্য হয়ে আছে।

লোকটা একটা বড় গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে ধুতির খুঁটে মুখের ঘাম মুছল। তারপর নিজের বর্তমান অবস্থাটা গম্ভীর মুখে বিচার করতে লাগল। যা অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে এ-জঙ্গল থেকে চট করে বেরনো ঠিক হবে না। অথচ খিদে-তেষ্টা আছে, ঘুম আছে, স্নানটান করাও আছে, এ-জঙ্গলে কীভাবে সেসবের

ব্যবস্থা হবে সেটাও চিন্তার বিষয়। তার ওপর ব্রহ্মদৈত্য এবং বুনন কুকুরের কথাও শোনা গেল। গতিক মোটেই সুবিধের ঠেকছে না তার কাছে।

হাত চার-পাঁচ দূরে শুকনো পাতায় একটা সরসর শব্দ হল। লোকটা সেদিকে তাকিয়ে যা দেখল তাতে শরীরের রক্ত হিম হয়ে যায়। একটা হাত-তিনেক লম্বা গোখরো সাপ হিলহিল করে একটা গর্তে ঢুকে যাচ্ছে। ওপরেও একটা শব্দ হল। লোকটা তাকিয়ে দেখে, একটা মস্ত বানর ডালে বসে সবেগে পেট চুলকোচ্ছে।

“নাঃ, প্রাণটা দেখছি বেঘোরেই যাবে!” বলে লোকটা শ্রান্ত শরীরে হেদিয়ে বসে রইল। “সত্য জয়তে” কথাটার মানেই হয় না। সত্যি কথা বলার গুনাগার যা দিতে হচ্ছে তা কহতব্য নয়।

বসে থাকতে-থাকতে লোকটার চোখ ঘুমে ঢুলে আসতে লাগল। সারারাত উদ্বেগ-অশান্তিতে তার ঘুম হয়নি। তার ওপর সকাল থেকে বিস্তর দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে। চারদিকে বিপদ জেনেও লোকটা ঢুলতে-দুলতে গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে একসময়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম যখন ভাঙল তখন দুপুর। বেশ চনচনে খিদে পেয়েছে। প্রচণ্ড জলতেষ্টা। জঙ্গলের মধ্যে রোদের চিকডিমিকড়ি এসে পড়েছে। ঝিঝি ডাকছে।

লোকটা চারদিকে চেয়ে ফের নিজের অবস্থাটা বিচার করে দেখল। খুবই খারাপ অবস্থা। নোংরা জামাকাপড় বদলানোর উপায় নেই। খাদ্য পানীয় নেই। বিছানা নেই। জঙ্গলের বাইরে অনেক শক্ত। জঙ্গলের মধ্যেও বন্ধু কেউ নেই।

তবে একটা ভাল ব্যাপার। লোকটার হঠাৎ নিজের নামটা মনে পড়ে গেল। লোকটার নাম অভয় সরকার।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress