ঘোড়া রোগ
সুধাময় ঘোষের কালো রঙের একটি দুধেল গাই ছিল। নাম তার কালী। দিনে ছ- সাত কেজি করে দুধ দিত। সেই দুধ বেচে সুধাময়ের ভালই চলে যেত। একদিন হঠাৎ তাকে ঘোড়া রোগে ধরলো। ‘ঘোড়া রোগে ধরলো’ মানে, গ্রামের জমিদার বিশ্বম্ভর রায়কে একদিন রাজকীয় ভঙ্গিতে ঘোড়ায় চড়ে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে দেখে, তারও খুব ইচ্ছে হল বিশ্বম্ভর বাবুর মতো ঘোড়ায় চড়ে, সারা গ্রাম বেড়াতে। যেমন ইচ্ছে, তেমন কাজ। একদিন সে তার সেই গাইটাকে বেচে দিয়ে, তার দুধ বেচার আরও কিছু টাকা তার সাথে জুড়ে একটা ঘোড়া কিনে ফেলল। ঘোড়াটাকে গরুর গোয়ালেই রাখার ব্যবস্থা করল। গরুর গোয়াল ঘোড়া থাকার ফলে সেটা আস্তাবল হয়ে উঠল।
তারপর কয়েকদিন মনের আনন্দে ঘোড়ায় চড়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ালো বিশ্বম্ভর বাবুর মতো। তারপর তার টান পড়ল অর্থে। নিজের খাবারটা ছাড়াও ঘোড়ার দানাপানি জোগাড় করতে সে নাজেহাল হয়ে পড়ল।
ঘোড়া তো আর দুধ ডিম দেয় না, যে তা বেচে টাকা আসবে। তাই সে খু্ব বিপদে পড়ে গেল। মনে মনে ভাবল কিছু না ভেবে চিন্তে গরুটাকে আবেগের বশে বেচে দিয়ে, ঘোড়া কেনাটা তার ঠিক হয়নি।
সে রাতে সে ঘুমোতে যাবার আগে, ভগবানকে ডেকে বলল, হা ভগবান, এ তুমি কি করালে আমাকে দিয়ে ?
ঘোড়া যদি দুধ ডিম দিত, তাহলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু এবার আমি ঘোড়ার চানা-দান, নিজের খাবার-দাবার কি করে জোগাড় করব? ভগবান তার ঘরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন। সুধাময়ের কথা শুনে তার মনে দয়া হল।
পরদিন সকালে সুধাময় আস্তাবল পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখে, ঘোড়াটা একটা ডিম পেরেছে। গোল, একেবারে দুধে-আলতা রঙের সাদা দেখতে। তা দেখে তার মন খুশিতে ভরে উঠল। ভাবল এই ডিম বাজারে বেচে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। সে ঘরের কাজ-কর্ম সেরে, সেটা নিয়ে বাজারে চলল বিক্রি করতে। পথে একজন সঙ্গে দেখা,সে সেটা সুধাময়ের হাতে দেখতে পেয়ে বলল, ওহে ওটা কি নিয়ে যাচ্ছো?
সুধাময় বলল,ঘোড়ার ডিম। লোকটা তার উত্তর শুনে ভাবল, সুধাময় তার প্রশ্নে বিরক্ত হয়েছে, তাই সে আর কোন কথা না বাড়িয়ে তার নিজের কাজে চলে গেল। পথে তার বন্ধু নিবারণের সঙ্গে দেখা। নিবারণ বলল, কিহে হাতে ওটা কি তোমার?
– ঘোড়ার ডিম।
নিবারণ তার কথা শুনে বঝলো, সুধাময়ের মাথার বিকৃতি দেখা দিয়েছে। তাই সেও আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। বাজারে ঢুকে সুধাময় হাক পাড়ল, ঘোড়ার ডিম নেবেন গো বাবু, কেউ ঘোড়ার ডিম নেবেন?
একজন তার হাক শুনে কাছে এগিয়ে এসে বলল, তুমি কি পাগল হয়েছো, যে বাজারে ঘোড়ার ডিম বেচতে এসেছো। সুধাময় বলল, পাগল হব কেন? এটা সত্যিই ঘোড়ার ডিম, আমার ঘোড়া পেরেছে। সেই সময় রাস্তা দিয়ে এক স্বর্ণকার যাচ্ছিল, তাদের কথা শুনে কাছে এগিয়ে এসে বস্তুটা দেখেই চিনতে পারল, বহু দামী মুক্তো এটা। সচারাচার দেখা যায় না। সে সুধাময়ের কাছে জানতে চাইল, কোথায় পেয়েছো এটা।
– আমার ঘোড়ায় ডিম পেরেছে কাল আস্তাবলে।
– ফাজলামি করার আর জায়গা পাও না। কার থেকে এটা চুরি করেছো বলো। না হলে তোমায় পুলিশে দেব। সুধাময় কিছুতেই তাকে বিশ্বাস করাতে পারল না যে, এটা সত্যি সত্যিই তার ঘোড়ায় ডিম পেরেছে।
লোকটি থানায় ফোন করে পুলিশ ডেকে এনে সুধাময়কে তাদের হাতে তুলে দিলো। পুলিশ সুধাময়কে ধরে নিয়ে এসে চুরির কেস দিয়ে লকআপে পুরে দেয়। আগামী কাল কোর্টে উপস্থিত করবে বলে।
সুধাময় পড়ল বড় বিপদে। মনে মনে ভাবল সত্যি কথাটা সে কাউকেই বিশ্বাস করাতে পারছে না যে তার ঘোড়া এটা পেরেছে কাল রাতে আস্তাবলে। এবার কি হবে তার? জেলেই কাটাতে হবে নাকি বাকী জীবনটা।
এইসব ভাবতে ভাবতে লকআপের ভিতর কম্বলের উপর শুয়ে পড়ল। তারপর শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই।
– হা – ম – বা , হা – ম – বা ডাক শুনে সে কালীর স্বর চিনতে পারল। হঠাৎ সে দেখল কখন এসে কালী লকআপ শিং দিয়ে ভেঙে তার সামনে দাঁড়িয়েছে, তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবার জন্য। ধড়ফড় করে উঠে বসল। ঘুমটা তার ভেঙে গেল।
যাক বাবা সস্থি ফিরে এলো তার মনে, সুধাময় ভাবল, এতক্ষণ ধরে সে তাহলে স্বপ্ন দেখছিল? বিশ্বম্ভর বাবুকে ঘোড়ায় চড়া দেখে তার মনে ঘোড়া কেনার ইচ্ছে জেগেছিল খুব, এটা অবশ্য খুব সত্যি কথা, মিথ্যে নয় মোটেও।