ঠিক দুপুরবেলা গড়িয়াহাটার মোড়
ঠিক দুপুরবেলা গড়িয়াহাটার মোড় থেকে একটা লোকের পিছু নিল শ্যামা অকারণে। লোকটা কালো, হাড়গিলে রোগা চেহারা, অত্যন্ত কর্কশ তার মুখ, সেই মুখে মোটা গোঁফ, চোখে গগলস; পরনে টেরিকটনের গাঢ় রঙের চাপা চোঙা প্যান্ট, গায়ে ঝকঝকে ক্রিম রঙের সিল্ক শার্ট, হাতে ফোলিও ব্যাগ। চমৎকার ঝকমকে পোশাকের ভিতরে কালো হাড়গিলে লোকটাকে বেমানান এবং আরও কুচ্ছিত দেখাচ্ছিল যেন কারও জামাকাপড় চুরি করে এনে পরেছে।
লোকটা বাটার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ জুতো দেখল, তারপর শ্লথ গতিতে হেঁটে গেল মোড় পর্যন্ত, সিগারেটের দোকান থেকে কিনে নিল এক প্যাকেট সস্তা সিগারেট, কাপড়ের দোকানের ডামির দিকে চেয়ে একটু হাসল আপনমনে, একটা কান ভিখিরিকে তাড়া দিল,দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ করল একটি সুন্দরী মেয়ের চলে যাওয়া। তারপর ধীর গতিতে রাস্তা পার হয়ে ট্রামস্টপের দিকে চলে যাচ্ছিল লোকটা।
আগাগোড়া লোকটাকে লক্ষ করছিল শ্যাম। মনে হয় খুব সহজ শান্ত ও ভদ্র জীবন যাপন করে না লোকটা। চার দিকে ওর সতর্ক চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে ওরনের লোকই ভদ্রলোকদের পকেট হাতড়ে দেখে, কিংবা নিদেন সবার অলক্ষ্যে মেয়েদের নরম বুক ছুঁয়ে সরে যায়। একটা কিছু এধরনের কাজ করবেই লোকটা। শ্যাম নিশ্চিত। সামান্য উত্তেজনা বোধ করে শ্যাম, লোকটাকে চোখে চোখে রাখে, পিছু নিয়ে এসে ট্রাম-স্টপে দাঁড়ায়। লোকটা সবুজ রুমাল বের করে অকারণে ঘাড় গলা মোছে, স্টপে দাঁড়ানো মেয়েদের লক্ষ করে চোখেমুখে চিকমিক করে ওঠে কামনা-বাসনা। কিন্তু কিছুই করে না লোকটা।
ট্রামে উঠেও লোকটা খুবই ভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েদের কাছে ঘেঁষে না, ভদ্রলোকদের পকেটের দিকে তাকায় না।
এন্ডির চাদরের ভিতরে শ্যামের হাত মুঠো পাকিয়ে যায়, সে মনে মনে বলে, এবার একটা কিছু করো হে, আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। ভয় কী! ওই যে মোটা মতো লোকটা, পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, ঘাড়ের চুল পুলিশদের মতো করে ছাঁটা, লক্ষ করে দ্যাখো লোকটা ঢুলছে। ওর বুক-পকেট থেকে মুখ বের করে আছে একটা খাম। ওটা তুলে নাও। কিংবা ওই যে মেয়েটা উঠে দাঁড়াল, পরনে মভ রঙের শাড়ি, মাথায় বিড়ে-খোঁপা, ওর চোখ-মুখ দ্যাখো– সুন্দর নয়, কিন্তু বাঘিনীর মতো কামুকা— জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটা ওর স্বভাব— ওর গায়ে তুমি নিশ্চিন্তে হাত দিতে পারো কিছুই হবে না। ভয় কী?
কিন্তু লোকটা খুব ভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে থেকে একটু কুঁজো হয়ে জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তাঘাট দেখবার চেষ্টা করে। শ্যাম হতাশ হতে থাকে। এমন পাকা বদমাশের মতো চেহারা তোমার!–শ্যাম বলতে থাকে, তুমি শুধু চোখ দিয়ে যে-কোনও মেয়েকে গর্ভবতী করে দিতে পারো, শুধু চোখের ইশারায় তুমি তুলে নিতে পারো আমাদের পকেটের মনিব্যাগ। দেখাও। সেই ম্যাজিক দেখাও। ভয় কী হে! বাক আপ! চিয়ারিও!
তবুও লোকটা দাঁড়িয়েই থাকে। তার অন্যমনস্ক চোখেমুখে নরম এক ধরনের কবিত্বের ভাব ফুটে ওঠে। খুব হতাশ হয়ে শ্যাম লক্ষ করে যায়।
তবু শ্যাম পিছু ছাড়ল না।
লোকটা গ্র্যান্ড হোটেলের উলটো দিকে নেমে পড়ে। তারপর রাস্তা পার হয়ে বড় রাস্তা ধরেই অনেক দূর হেঁটে যায়। সুরেন ব্যানার্জি রোডে ঢুকে পড়ে। একটু দূরে থেকে শ্যাম হটতে থাকে। লোকটা একবার ঘাড় ঘোরাতেই তার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মৃদু হাসির চেষ্টা করে শ্যাম, হাসি দিয়েই বোঝাতে চায়–ভয় পেয়ো না, আমি শুধু দেখতে চাই যে, তুমি একটা কিছু করো। তুমি করিতকর্মা লোক–কিছু করো হে! বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ধরব না বা ধরিয়ে দেব না। নিশ্চিন্ত থাকতে পারো তুমি।
লোকটার ভ্রূ সামান্য কুঁচকে ওঠে। তারপর মুখ ফিরিয়ে সে হাঁটতে থাকে। এলোমলো রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে হেঁটে যায়। মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে শ্যামকে লক্ষ করে। খুবই উত্তেজনা বোধ করে শ্যাম। তারপর অবশেষে লোকটা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের কাছে এসে একটা বড় বাড়ির মধ্যে সোজা গট গট করে হেঁটে গেল। লোকটা ভয় পেয়ে গেছে-ভাবে শ্যাম। আবার তার শরীরে শীতভাব ফিরে আসে। হতাশ বোধ হয়।
শূন্য মনে খানিকটা ঘুরে বেড়ায় শ্যাম। তারপর একটা ফাঁকা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে। শান্তভাবে চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে থাকে। তার সামনে এক কাপ গরম চা জুড়িয়ে জল হয়ে যায়।
পাশের টেবিল থেকে একজোড়া সিন্ধি ব্যবসায়ি উঠে গেল, অন্য ধারে এসে বসল চর্বির পাহাড় গলায় থাক থাক গলকম্বলওয়ালা এক পাঞ্জাবি। ঘুম ঘুম চোখে একবার শ্যামকে চেয়ে দেখল।
বাইরে ছায়াহীন বোদ গড়িয়ে যাচ্ছে রাস্তায়, ওধারের বাড়ির আলসে থেকে পিছলে পড়ে পাখা মেলে দিল একটা পায়রা, ঠক ঠক করে হেঁটে গেল দুটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে।
উঠে পড়ে শ্যাম। কাউন্টারে দাম দিয়ে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল, ঠিক সে সময়ে দরজার চৌকাঠে তার মুখের ওপর একটা ছায়া এসে পড়ে। বিদ্যুৎবেগে লাফিয়ে ওঠে শ্যামের হৃৎপিণ্ড— সেই লোকটা! পিছনে ঝকমক করছে রোদ, লোকটার মুখ তাই অন্ধকার দেখায়। হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে শ্যাম এক পা পিছু হটে আসে। লোকটা এক পা এগিয়ে আসে, শ্যাম।
না, সে লোকটা নয়। পরনে নেভি ব্লু সুট, গলায় বো, সুন্দর চেহারার ফরসা একটা লোক শ্যামের সামনে দাঁড়ায়।
অরুণ! যেন ড়ুবে যাচ্ছিল শ্যাম, এমন ব্যগ্র হাত বাড়িয়ে অরুণের একখানা হাত চেপে ধরে সে, আঃ, অরুণ!
ইসস! তোকে চেনাই যায় না!
তুই! শ্যাম অরুণকে ভাল করে দেখে, তুই খুব সুন্দর হয়ে গেছিস।
দূর! মৃদু হাসে অরুণ, অ্যালকোহলিক ফ্যাট। তোর কী খবর?
ভাল। শ্যাম মাথা নাড়ে।
কিন্তু তোকে ভাল দেখাচ্ছে না। দাড়ি-ফাড়ি দিয়ে চেহারাটা কী যে বানিয়েছিস! বলতে বলতে শ্যামের হাত ধরে টেনে নেয় অরুণ। দু’জনে মুখোমুখি বসে। বসেই অরুণ বলে, শুনেছি ঝগড়া করে চাকরি ছেড়েছিস!
শ্যাম নিঃশব্দে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।
অথচ তুই কী ভীষণ ড্যাশিং পুশিং ছিলি! কত ওপরে উঠে যাওয়ার কথা ছিল তোর। আর কী দশা করেছিস নিজের।
শ্যাম চুপ করে থাকে।
শালার বস আমারও ছিল তেরিয়া, তাই বাঁচার জন্য একদিন তার কালো কুচ্ছিত মেয়েটাকে নিয়ে লম্বা দিলুম। লোকটা চেঁচামেচি করল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনেও নিল।…দুটো লিফট পেলুম পর পর।…একটা দুঃখ ভাই, ছেলেবেলা থেকেই একটা সুন্দর বউয়ের শখ ছিল আমার। সেটা হল না। বলতে বলতে মৃদু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে অরুণ, তবে পুষিয়ে নেব, দেখিস। ফেব্রুয়ারিতে চললুম আমেরিকা…বউকে রেখে যাচ্ছি তার বাপের বাড়িতে…।
চেয়ে থাকে শ্যাম। অরুণকে খুব ফরসা দেখাচ্ছে। সাহেবি পোশাকের জন্য নয়, রং ফরসা বলেও নয়, শ্যাম লক্ষ করে দেখে, চোখে-মুখে কেমন এক ধরনের বিদেশি ছায়া পড়েছে অরুণের। হঠাৎ তাকে খুব দূর বিদেশের অচেনা লোক বলে মনে হয়।
চা শেষ করে উঠে পড়ে দু’জনে।
কোথায় যাবি? রাস্তায় এসে অরুণ জিজ্ঞেস করে।
শ্যাম মাথা নাড়ে, জানি না।
দূর শালা! অরুণ হাসে, তুই কেমন ম্যান্দা মেরে গেছিস! আমার সঙ্গে চ…
কোথায়? খুব নিস্তেজভাবে বলে শ্যাম।
চোখ নাচিয়ে অরুণ হাসে, ভাল জায়গা। সাহেবের অফিস। সুন্দরী রিসেপশনিস্টের মুখোমুখি বসে থাকবি। ভিসার ব্যাপারে এক মার্কিন সাহেবকে ধরা-করার ব্যাপার আছে—আধঘণ্টার কাজ। চ–
রাস্তায় একটা ছোকরা জুতো-পালিশওয়ালাকে দিয়ে জুতো পালিশ করিয়ে নিল অরুণ। ঝুঁকে পালিশওয়ালাকে বলল, দ্যাখ জুতোয় তোর মুখ দেখা যাচ্ছে?
ছেলেটা ঝুঁকে মুখ তুলে হাসল, জি হাঁ।
তব ঠিক হ্যায়। বলে অরুণ পয়সা দিয়ে দেয়। হাঁটতে থাকে।
নিজের ভিতরে এক অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করে শ্যাম। যেন সব কাজ, আনন্দ এবং উৎসাহ থেকে অবসর নেওয়া হয়ে গেছে। এখন চলেছে তার অবসরের ধীরগতি জীবন। শরীরের মধ্যে যেন বিকেল হয়ে এল। এখন সেই সময়, যখন তার অফুরান ছুটি, আর সে তার ব্যালকনিতে ইজিচেয়ারে বসে রাস্তার চলমান দৃশ্য দেখে যাবে, কোনও দৃশ্যের মধ্যে আর রাখবে না নিজেকে। চটপটে অরুণের সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে তাই তার কষ্ট হচ্ছিল, হাঁফ ধরে গেলে সে বলল, আঃ অরুণ, আস্তে হাট।
কয়েক পা এগিয়ে-থাকা অরুণ পিছু ফিরে চায়, তুই শালা মেদিয়ে গেছিস। কোথায় সেই চটপটে লেফট আউট! কোথায় তোর কুইক রিফ্লেক্স! হা হা করে খোলা রাস্তাতেই হাসে অরুণ, তুই কি বুড়ো?
না। মাথা নাড়ে শ্যাম, আমার কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই। মনে মনে সে গুনগুন করে, থেমে গেলেই তুমি দুয়ো…থেমে গেলেই তুমি বুড়ো… থেমে গেলেই তুমি মাটির ঢেলা…কাকে কবে কোথায় যেন বলেছিল শ্যাম!
চমৎকার সাজানো-গোছানো রিসেপশন রুমে তাকে বসিয়ে রেখে ভিতরে চলে গেল অরুণ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেই ঘরে গদির সোফায় বসে রইল শ্যাম, তার আশেপাশে আরও কয়েকজন লোক, রিসেপশন কাউন্টারের ওধারে একটি মেয়ে টেলিফোন আর ভিজিটর নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। ঠিকই বলেছিল অরুণ মেয়েটি বড় সুন্দর। কাঁধ থেকে দীর্ঘ দু’খানা শূন্য সাদা হাত মদরঙের কাঠের পালিশে ছায়া ফেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে—টেলিফোনের চাবির বোর্ড থেকে খোলা কাগজে, নোট-বইয়ে। গাঢ় বেগুনি রঙের ব্লাউজ, গাঢ় বেগুনি তার শাড়ি, ফাঁপানো চুল ঘাড়ের নীচে আলগা একটা ফিতের গিট দিয়ে বাঁধা। মুখের ধাঁচ গোল, কপাল-ঢাকা চুল, ছোট্ট একটু সিথি। ফুটফুট করছে তার মুখ-চোখ।-সেই মুখ-চোখ কথা বলছে নিঃশব্দে–আমি খুব বেঁচে আছি। দেখো, রাতে আমি নিঃসাড় ঘুমিয়েছি। জানো, আমার এখনও বয়স হয়নি। আমার কোনও অসুখ নেই। আমি ভোরে স্নান করি, ড়ুব দিয়ে! আমি তোমাদের অচেনা।
আর তার একটু অনিশ্চিত চোখ আর নগ্ন দুটি হাত ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্লান্তিহীন টেলিফোনের চাবি থেকে নোট-বই, খোলা কাগজ এবং আবার টেলিফোনে। দু’টি কাজের হাত তার স্বয়ংক্রিয়। তবু শ্যাম দেখে, যেন পিয়ানোর চাবি ছুঁয়ে যাচ্ছে।
শ্যামের আশেপাশে যারা বসে ছিল, তারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও কাজে এসেছে, তাই একটু পরে পরে প্রত্যেকেরই ডাক এল। ভিতর থেকে, এবং এইভাবে আস্তে আস্তে তার আশপাশ খালি হয়ে গেল। একসময়ে দেখল *ম যে, সে একা বসে আছে। আর রিসেপশনের মেয়েটি তার অত ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝে তাকে লক্ষ করছে।
খুব অবাক হয়ে শ্যাম টের পায়, তার বুকের মধ্যে রেলগাড়ির সেই স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার শব্দ–ধীর থেকে দ্রুত হয়ে যাচ্ছে। সামান্য তেষ্টা পাচ্ছিল তার। পকেটে হাত দিয়ে দেখল সিগারেট নেই। কাচের দরজা ঠেলে দু’টি চটপটে মার্কিন ভদ্রলোক ঘরে আসে, কাউন্টারের সামনে দাঁড়ায়, নিচু স্বরে কী একটু রসিকতা করে। মেয়েটি হেসে তার সপ্রতিভ চোখেমুখে জবাব দিয়ে দেয়। আবার শূন্য হয়ে যায় ঘর। কিছু একটা লিখে রাখতে গিয়ে কোনও ভুল ধরা পড়ায় মেয়েটি জিভ কেটে পরিষ্কার বাংলায় বলে এঃ মা! চকিতে একপলক শ্যামকে লক্ষ করে চোখ নামিয়ে নেয়। টেলিফোন শব্দ করে উঠলে অবলীলায় টেলিফোন তুলে নিয়ে তুখোড় ইংরিজিতে বলে ও, বোস…মিস্টার বোস!…ইয়েস মিস্টার বোস…হিয়ার হি ইজ… থ্যাঙ্ক ইউ। আবার চকিতে চোখাচোখি হয়ে যায়।
আস্তে আস্তে অস্বস্তি পেয়ে বসে শ্যামকে। সে এই প্রথম টের পায় অনেক দিন হয়ে গেল সে আর নিজেকে সাজায় না। অযত্নের বাগানের মতো বন্য হয়ে গেছে তার শরীর, পুরনো পুথিপত্রের মতো ঝুরঝরে হয়ে গেছে চোখের চাউনি। এন্ডির চাদরের তলায় তার স্খলিত হাত আর পেট থেকে বুক পর্যন্ত সন্তর্পণে নিজেকে পরীক্ষা করে দেখে না, কোনওখানে নেই সেই পুরনো শ্যাম। বস্তুত তার মনে হয় এই-যে লোকটা সে–এন্ডির চাদর গায়ে গালে দাড়ি, ভিতরে অস্থির এক রেলগাড়ির পুল পেরিয়ে যাওয়ার গুম গুম শব্দ একে কোনওকালে কখনও চিনত না শ্যাম। ওই মেয়েটির সামনে ধরা-পড়া অসহায় এক অচেনা লোক বসে আছে।
কী ভাবছ তুমি? আমি বাইরের দুপুরের রোদ এড়াতে কৌশলে তোমাদের এই ঠান্ডা সুন্দর ঘরে ঢুকে বে-আইনিভাবে বসে আছি? কিংবা আমি বদমাশ, তোমাকে সুন্দর দেখে তোমার মুখোমুখি বসে আছি, সময়মতো হয়তো বা পিছু নেব? কিংবা আমি যে চোর-জোচ্চোর মতলববাজ নই, সে-সম্বন্ধে তুমি নিশ্চিত হতে পারছ না? শ্যাম মনে মনে এইসব কথা বলে মেয়েটিকে। যেন বা একা একটি ঘরে সুন্দরী মেয়েটির মুখোমুখি তাকে বসিয়ে রেখে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।
সে সহ্য করতে পারে না। সামনের টেবিলে রাখা এক তূপ পত্রপত্রিকা থেকে একটা ছবির কাগজ তুলে নিয়ে তার ওপর মুখ নিচু করে রাখে। সিগারেট নেই–সেকথা ভুলে গিয়ে পকেটের দিকে হাত বাড়াতেই চটাস করে শব্দে হাত পা কেঁপে ওঠে তার।
এইসব ছোটখাটো অথচ গুরুতর ঘটনা ঘটে যেতে থাকলে শ্যাম প্রাণপণে চেষ্টা করে মেয়েটার দিকে আর না-কানোর। কিন্তু তারপর একটা সময় এল যখন আর ভিজিটর আসছিল না, টেলিফোনেও আর কোনও শব্দ নেই, শূন্য ঘরে মেয়েটি ও সে দুরন্ত নিস্তব্ধতার মধ্যে বসে ছিল।
তারপর টেলিফোনের ক্র্যাডল থেকে রিসিভার তোলার শব্দ, তারপর দ্রুত ডায়াল করবার মিষ্টি শব্দ হচ্ছিল। তখন মেয়েটি ব্যস্ত আছে ভেবে সন্তর্পণে একবার চোখ তুলেই ভয়ংকর চমকে উঠল শ্যাম। মেয়েটি বাঁ হাতে টেলিফোনটা কানের কাছে ধরে রেখেছে, ডান হাতে সামনের রিসেপশন কাউন্টারে একটা হলুদ পেনসিল ধরে আছে, কিন্তু সে একদৃষ্টে চেয়ে আছে শ্যামের দিকে। চোখে পড়তেই সে পেনসিলটা রেখে দ্রুত তার ডান হাত তুলে মাউথপিসটা চাপা দিল, পরমূহুর্তে সে পাখির মতো তীক্ষ্ণ মিষ্টি গলায় সোজা তাকে প্রশ্ন করল, হুম ড়ু ইউ ওয়ান্ট, প্লিজ?
মাথার ভিতরে হঠাৎ ঘোলা জল টলমল করে ওঠে। কাকে চাই! আমি কাকে চাই! তীব্র আবেগে থরথর করে শ্যামের হাত-পা কেঁপে ওঠে। মুহূর্তেই ভুলে পেয়ে বসে তাকে। মনে পড়ে না কাকে চাই, কিছুতেই তার মনে পড়ে না। শুধু মনে হয় এতক্ষণ এইখানে—এই সুন্দর সাজানো-গোছানো ঘরে সুন্দর মেয়েটির মুখোমুখি বেমানান বসে থেকে সে এদের শৌখিন সুন্দর কোনও আবহাওয়াকে নষ্ট করে দিচ্ছিল–বাস্তবিক সে কেন এখানে বসে আছে? কেন বসে আছে?
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল শ্যাম। তার গলা আটকে আসছিল। শুধু মাথা নেড়ে জানাল, না, সে কাউকেই চায় না। সে কারও জন্য বসে নেই। এখানে তার কোনও কাজ নেই।
দরজার দিকে কয়েক পা হেঁটে যায় শ্যাম। দাঁড়িয়ে পড়ে। ভয়ে শিউরে ওঠে তার গা। লক্ষ করে, হাঁটবার সময়ে দরজাটা সরে যাচ্ছে। বাঁ থেকে ডাইনে। আবার বাঁয়ে। বড় অদ্ভুত! শ্যাম দ্রুত চোখ বুজে ফেলে। আবার হেঁটে যায় কয়েক পা। চোখ খুলে দেখে সে কাউন্টারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি ভ্রূ সামান্য তুলে তাকে দেখছে। যেন প্রশ্ন করতে চায় তুমি কে?
আমি কে! স্মৃতিহীন নির্বোধ শিশুর মতো শ্যাম অবাক চোখে অচেনা চার দিকে চেয়ে দেখে। বড় অসহায়ের মতো হাত বাড়িয়ে একটা চেয়ারের হাতল কিংবা একটা টেবিলের কিনারা খোঁজে সে। তার ঠোঁট নড়ে ওঠে, সে বিড়বিড় করে বলে, প্রশ্ন কোরো না আমি কে! আমি জানি না। বৃষ্টির জলের মতো দুঃখে তার বুক ভরে ওঠে—আমি জানি না আমি কেন গাছ হয়ে জন্মাইনি! জানি না আমি মাছ হয়ে জন্মালেই বা কী ক্ষতি ছিল।
চেয়ার থেকে ধীরে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি, লে’ মি হেলপ ইউ!
বুকের ভিতরে আর্তস্বরে কথা বলে শ্যাম, না। আমাকে ছুঁয়ো না। মুখে কথা ফোটে না, তাই সে কেবল মাথা নাড়ে না। তারপর এক-পা এক-পা করে পিছু হেঁটে যায় শ্যাম। কাচের পাল্লায় হাত রাখে। সাদা মুখে ঘাবড়ে যাওয়া মেয়েটি তার দিকে চেয়ে থাকে।
পাল্লা ঠেলে বোদ আর লোকজনের ভিতরে বেরিয়ে আসে শ্যাম। ফুটপাথে দাঁড়িয়েও সে বিড়বিড় করে বলে, প্রশ্ন কোরো না আমি কে! আমি জানি না।
তারপর শ্যাম হঠাৎ ‘ইয়াঃ’ বলে হেসে ওঠে। মাথা নাড়ে–না, কোনওখানেই নেই লুকিয়ে থাকবার নিরাপদ জায়গা, কিংবা পালিয়ে যাওয়ার সহজ পথ। সব জায়গাতেই তার জন্য অপেক্ষা করছে ওই প্রশ্ন, তুমি কে!
না, শ্যাম জানে না। শ্যাম সত্যিই জানে না।
.
অনেকক্ষণ বাদে তার ফেরানো পিঠে হাত রাখল অরুণ, কী ব্যাপার! বাইরে কেন?
এমনিতেই! শ্যাম ম্লান হাসে।
ভিতরে তোকে খুঁজে না পেয়ে চমকে গিয়েছিলুম। শেষে রিসেপশনের মেয়েটি দেখিয়ে দিল যে, তুই বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস। বলে সুন্দর ঠোঁটের কোনায় একটু হাসি সঁতে কামড়ে ধরল অরুণ, দেখলি!
কী?
অরুণ বড় চোখে তাকায়, তোমাকে আমি চিনি না শালা! আমি ইচ্ছে করেই দেরি করছিলুম, ঠিক জানতুম তোর এক্স-রে আই, এ-ফেঁড় ও-ফেঁড় করে দেখে নিবি! তবে এটা তেমন নয়, বুঝলি! মিস দত্ত আরও হট! এ নতুন। বলতে বলতে চিকমিক করে ওঠে অরুণ, আলাপ করবি? আমার সঙ্গে কয়েকদিনের যাতায়াতেই খুব খাতির। নাম— লীলা ভট্টাচার্য। কবি আলাপ?
না। শ্যাম মৃদু হেসে মাথা নাড়েনা।
শ্যাম ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দরজার কাচের পাল্লা দিয়ে রাস্তা থেকেও মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটির কৌতুহলী চোখ আবার তার চোখে পড়ল। শ্যাম ঘাড় ফিরিয়ে নেয়।
কী হল তোর শ্যাম! জিভ দিয়ে চিকচিক একটা শব্দ করে অরুণ।
কী জানি! হাঁটতে হাঁটতে শ্যাম বলল, কোনওখানে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে আমার।
ভ্রূ কুঁচকে অরুণ বলে, কী রকম?
হাইস্কুলে পড়ার সময় মেয়ে দেখলে যেমন হত, অনেকটা সেরকম নার্ভাস বোধ করছিলুম। মেয়েটি জিজ্ঞেস করল আমি কাউকে চাই কি না। অমনি মনে হল ওখানে বসে থেকে আমি অন্যায় করছি, চোরের মতো উঠে এলুম। অথচ এর চেয়েও কত তুখোড় কেওয়ালা জায়গায় আমি অনায়াসে গেছি সেদিনও, কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে এরকম মেয়েদের বলেছি ‘হেল্লো’…
জিজ্ঞাসার চোখে শ্যামের দিকে তাকায় অরুণ।
গোলমাল হয়ে গেছে। শ্যাম মাথা নাড়ে, অনেক দিন বাদে আমি টের পেলুম যে, আমি প্রেমে পড়ে যেতে পারি।
লীলার?
না। লীলা বলে নয়। যে-কোনও মেয়ের। আশ্চর্য! এতকাল যখন বৃন্দা মাধবী কিংবা ইতুর সঙ্গে ঘুরেছি, শুয়েছি এক বিছানায়, আগাপাশতলা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি ভাল লাগার মতো কিছু পাওয়া যায় কি না, তখনও আমার বুকের মধ্যে রেলগাড়ির শব্দ হয়নি কখনও। মনে হয়নি যে, এর মধ্যে কোনও রহস্য আছে আর। মনে হয়, কোনও কিছুই বাকি রাখিনি বলে আমার ঠিক তৃপ্তি কখনও হয়নি। বুকের কাছে কোথাও একটা দুঃখ চাপ বেঁধে আছে।
কী-সব বলছিস রে?
ঠিক বলছি। শ্যাম মাথা নিচু রেখে বলে, কে যেন বলেছিল, ঈশ্বরজ্ঞান না হলে মেয়েদের ঠিকমতো চেনা যায় না! কে বলেছিল বল তো!
কী জানি! ঠোঁট ওলটায় অরুণ, রামকৃষ্ণ-কৃষ্ণ কেউ হবে!
হবে।
একটু চিন্তিতভাবে মৃদু হাসে অরুণ, এক লীলা ভটচাযই তোকে ঈশ্বরজ্ঞান দিয়ে দিল আধ ঘণ্টায়!
না। শ্যাম হাসে, আমি শুধু এটুকু বুঝলুম যে, আমার ভিতরে এখনও এত আশ্চর্য রেলগাড়ির শব্দ আছে, আর আছে অতৃপ্তি। মনে হয় মেয়েরাই আমাকে ঠকিয়েছে সবচেয়ে বেশি। সবকিছু নিয়েও আসল রহস্যটুকু আঁচলে বেঁধে নিয়ে গেছে। কিবা কী জানি, হয়তো সে-রহস্যও আমার সামনে খোলা চিঠির মতো মেলে-ধরা ছিল। আমি ধরতে পারিনি। তাই মেয়েটা যখন প্রশ্ন করল আমি কাউকে চাই কি না তখন হঠাৎ নিজেকে ভিখিরি বলে মনে হল, মনে হল আমার নাম-পরিচয় নেই। আমি এত তুচ্ছ ইনসিগনিফিক্যান্ট যে, আমার জন্ম না-হলেও কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না। আমি বুঝতে পারছিলুম না, আমি গাছ হয়ে কেন জন্মাইনি, আমি কেন হইনি জলের মাছ?
ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে পড়ল অরুণ, শ্যাম!
কথা বলিস না অরুণ। শ্যাম আস্তে বলল, আমি নিজেকে এতকাল ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট ভেবে এসেছি। আমার সবকিছুই খুব সহজে পাওয়ার কথা–আমি ভেবেছিলুম। শ্যাম মৃদু হেসে মাথা নাড়ে, যা পেয়েছিলুম তা ভুল। আমাকে এতকাল সবাই ঠকিয়ে এসেছে। নইলে কেন আমার বুকের ভিতরে এখনও রেলগাড়ির শব্দ? আমি কেন মাঝে মাঝে দরজা খুঁজে পাই না? গাছের ছায়া খুঁজে পাই না? কোথায় ভুল হচ্ছে? এতকাল তো আমার সব দরজাই ছিল চেনা, সহজে খুলেছি…হঠাৎ ভালবাসার জন্য আবার আমার হাঁটু গেড়ে বসতে ইচ্ছে করছে।
চোখ কপালে তোলে অরুণ, কী ব্যাপার বল তো!
ক্লান্তভাবে হাসে শ্যাম, কিছু না।
ধুস শালা! অরুণ হো হো করে হাসে, হাসতে হাসতে নিজের পেটের দিকে আঙুল দেখায়, সবকিছুর মূলে ওই পেট! বায়ু থেকেই তোর সবকিছু হচ্ছে। রোজ রাতে ইসবগুলের ভূষি খাবি, সকালে উঠে গরমজলে লেবুর রস। আমি যখন ব্যাচেলর ছিলুম তখন আমার পেটের কমপ্লেনই ছিল এগারো রকমের…লীলা ভটচাযকে আমি বলে রাখব যে, তুই সেইন্ট অ্যান্ড মিলারের এক্স-ছোটসাহেব। ভাল খেলোয়াড়— উভয়ার্থে। বলে রাখব যে, তুই দাড়ি না কামিয়ে এভির চাদর গায়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিস, ভুল করে যেন তোকে ছেড়ে না দেয়।…
.
এসপ্ল্যানেডে ফুটপাথে সঁডিয়ে হাত তুলে ‘হেঃ ট্যাক্সি…’ বলে ট্যাক্সি দাড় করায় অরুণ। শ্যামকে বলে, চ তোকে পৌঁছে দি।
হাই তোলে শ্যাম, বলে, না। বাসায় ফেরার তাড়া নেই। আমি একটু ঘুরে-ফিরে যাব। তুই যা।
ট্যাক্সির দরজা বন্ধ করার আগে অরুণ নিচু গলায় বলল, যদি মনে ধরে থাকে তো লেগে যা। আমি দেখব।…চাকরির জন্য ভাবিস না শ্যাম, আমার শ্বশুরের ফার্ম, আমি যাওয়ার আগে বুড়োকে পগিয়ে যাব, তোর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বলতে বলতে ভীষণ বদমাশের মতো হাসে অরুণ, শরীরটা কেমন দেখছিস আমার? ভাল না?
আঃ ফাইন! শ্যাম হাসে।
ফর অ্যামেরিকা, দি ল্যান্ড অব ফ্রি সেক্স! দেখিস, ষাট বছর বয়সেও আমি শরীর রেখে দেব। চিয়ারিও…
চলন্ত ট্যাক্সি থেকে হাত দেখায় অরুণ। বিদেশি এক অরুণ, যাকে ঠিক ঠিক চেনে না শ্যাম, অথচ চেনা বলে মনে হয়!
শূন্য মনে হেঁটে যায় শ্যাম। তার মাথার মধ্যে ভ্রমরের শব্দের মতো দূরাগত এক মোটর-সাইকেলের আওয়াজ ঘুরে বেড়ায়। অস্থির বোধ করে সে। খ্রিসমাসের জন্য সাজানো দোকানপাট, রঙিন কাগজের শেকল, বুড়ো সান্টা ক্লস আর নকল পাইন গাছ চোখের পাশ দিয়ে সরে যায়। হ্যান্ডবিলে বিজ্ঞাপন বিলি করছে একটা লোক, শ্যামের হাতেও সে একটা কাগজ গুঁজে দেয়। তাতে ইংরিজিতে বড় হরফে লেখা, আপনার বিপদ কেটে গেছে…তারপর একটা ওষুধের গুণ-বর্ণনা। মৃদু হেসে কাগজটা দুমড়ে ফেলে দেয় শ্যাম। মনে মনে গুনগুন করে শাম, আঃ আমার বিপদ কেটে গেছে! বিপদ আর নেই!