Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

এইবারে হিন্দুমেলার গল্প বলি শোনো

এইবারে হিন্দুমেলার গল্প বলি শোনো। একটা ন্যাশনাল স্পিরিট কী করে তখন জেগেছিল জানি নে, কিন্তু চার দিকেই ন্যাশনাল ভাবের ঢেউ উঠেছিল। এটা হচ্ছে আমার জ্যাঠামশায়দের আমলের, বাবামশায় তখন ছোটো। নবগোপাল মিত্তির আসতেন, সবাই বলতেন ন্যাশনাল নবগোপাল, তিনিই সর্বপ্রথম ন্যাশনাল কথাটার প্রচলন করেন। তিনিই চাঁদা তুলে হিন্দুমেলা শুরু করেন। তখনো ন্যাশনাল কথাটার চল হয় নি। হিন্দুমেলা হবে, মেজোজ্যাঠামশায় গান তৈরি করলেন—

মিলে সবে ভারতসন্তান
একতান মনপ্রাণ,
গাও ভারতের যশোগান।

এই হল তখনকার জাতীয় সংগীত। আর-একটা গান গাওয়া হত, সে গানটি তৈরি করেছিলেন বড়োজ্যাঠামশায়—

মলিন মুখচন্দ্রমা ভারত, তোমারি—
রাত্রিদিবা ঝরে লোচনবারি।

এই গানটি বোধ হয় রবিকাকাই গেয়েছিলেন হিন্দুমেলাতে। এই হল আমাদের আমলের সকাল হবার পূর্বেকার স্বর; যেন সূর্যোদয় হবার আগে ভোরের পাখি ডেকে উঠল। আমরাও ছেলেবেলায় এই-সব গান খুব গাইতুম।

বড়োজ্যাঠামশায়ের তখনকার দিনের লেখা চিঠিতে দেখেছি, এই নবগোপাল মিত্তিরের কথা। তিনিই উদ্যোগ করে হিন্দুমেলা করেন। গুপ্তবৃন্দাবনের বাগানে হিন্দুমেলা হত। নামটা অদ্ভুত, শুনে খোঁজ করে জানলুম, বাগানটার নামে একটা মজার গল্প চলিত আছে।

পূর্বকালে পাথুরেঘাটার ঠাকুর বংশেরই একজন কেউ ছিলেন বাগানের মালিক। প্রায় শতাধিক বছর আগেকার কথা। মা তাঁর বুড়ি হয়ে গেছেন, বুড়ি মার শখ হল, একদিন ছেলেকে বললেন, বাবা, বৃন্দাবন দেখব। আমাকে বৃন্দাবন দেখালি নে!

ছেলে পড়লেন মহা ফাঁপরে—এই বুড়ি মা, বৃন্দাবনে যাওয়া তো কম কথা নয়, যেতে যেতে পথেই তো কেষ্ট পাবেন। তখনকার দিনে লোকে উইল করে বৃন্দাবনে যেত। আর যাওয়া আসা, ও কি কম সময় আর হাঙ্গামার কথা, যেতে আসতে দু-তিন মাসের ধাক্কা। তা, ছেলে আর কী করেন, মার শখ হয়েছে বৃন্দাবন দেখবার; বললেন, আচ্ছা মা, হবে। বৃন্দাবন তুমি দেখবে।

ছেলে করলেন কী এখন, লোকজন পাঠিয়ে পাণ্ডা পুরুত আনিয়ে সেই বাগানটিকে বৃন্দাবন সাজালেন। এক-একটা পুকুরকে এক-একটা কুণ্ড বানালেন, কোনোটা রাধাকুণ্ড, কোনোটা শ্যামকুণ্ড, কদমগাছের নীচে বেদী বাঁধলেন। পাণ্ডা বোষ্টম বোষ্টমী দ্বারপাল, মায় শুকশারী, নানা রকম হরবোলা পাখি সব ছাড়া গাছে গাছে, ও দিকে আড়াল থেকে বহুরূপী নানা পাখির ডাক ডাকছে, সব যেখানে যা দরকার। যেন একটা স্টেজ সাজানো হল তেমনি করে সব সাজিয়ে, বৃন্দাবন বানিয়ে, মাকে তো নিয়ে এলেন সেখানে পাল্কি বেহারা দিয়ে।

বুড়ি মা তো খুব খুশি বৃন্দাবন দেখে। সব কুণ্ডে স্নান করলেন, কদমগাছ দেখিয়ে ছেলে মাকে বললেন, এই সেই কেলিকদম্ব যে-গাছের নীচে কৃষ্ণ বাঁশি বাজাতেন। এই গিরিগোবর্ধন। এই কেশীঘাট। রাখাল-বালক সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, তাদের দেখিয়ে বললেন, ঐ সব রাখাল-বালক গোরু চরাচ্ছে। এটা ঐ, ওটা ঐ। বোষ্টম-বোষ্টমীদের গান, ঠাকুরদেবতার মূর্তি, এসব দেখে বুড়ির তো আনন্দ আর ধরে না। টাকাকড়ি দিয়ে জায়গায় জায়গায় পেন্নাম করছেন, ওঁদেরই লোকজন সব সেজেগুজে বসে ছিল, তাদেরই লাভ।

 বৃন্দাবন দেখা হল, যাবার সময় হল। বুড়ি বললেন, আচ্ছা বাবা, শুনেছি বৃন্দাবন এক মাস যেতে লাগে, এক মাস আসতে লাগে, তবে আমাকে তোমরা এত তাড়াতাড়ি কী করে নিয়ে এলে।

ছেলে বললেন, ও-সব ব্যবস্থা করা ছিল মা, সব ব্যবস্থা করা ছিল। পঁচিশ-পঁচিশটে বেয়ারা লাগিয়ে দিলুম পাল্কিতে, হু-হু করে নিয়ে এল তোমাকে! এ কী আর যে-সে লোকের আসা!

বুড়ি বললেন, তা বাবা, বেশ। তবে বৃন্দাবনে তো শুনেছি এ-রকম বাড়ি ঝাড়লণ্ঠন নেই। এ-বাড়ি তো আমাদের বাড়ির মতো।

ছেলে বললেন, এ হচ্ছে মা, গুপ্তবৃন্দাবন। সে ছিল পুরোনো কালের কথা, সে বৃন্দাবন কী আর এখন আছে, সে লুকিয়েছে।

বুড়ি তো খুশিতে ফেটে পড়েন, ছেলেকে দু-হাত তুলে আশীৰ্বাদ করতে করতে বাড়ি ফিরে এসে কেষ্ট পেলেন। সেই থেকে সেই বাগানের নামকরণ হল গুপ্তবৃন্দাবন।

সেই গুপ্তবৃন্দাবনে হিন্দুমেলা, আমরা তখন খুব ছোটো। ফি বছরে বসন্তকালে মেলা হয়। যাবতীয় দেশী জিনিস তাতে থাকত। শেষ যেবার আমরা দেখতে গিয়েছিলুম এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে—বাগানময় মাটির মূর্তি সাজিয়ে রাখত; এক-একটি ছোট্ট চাঁদোয়া টাঙিয়ে বড়ে বড়ো মাটির পুতুল তৈরি করে কোনোটাতে দশরথের মৃত্যু, কৌশল্যা বসে কাঁদছেন, এই-রকম পৌরাণিক নানা গল্প মাটির পুতুল দিয়ে গড়ে বাগানময় সাজানো হত। কী সুন্দর তাদের সাজাত, মনে হত যেন জীবন্ত। পুকুরেও নানা রকম ব্যাপার। কোনো পুকুরে শ্ৰীমন্ত সওদাগরের নৌকো, সওদাগর চলেছেন বাণিজ্যে ময়ূরপঙ্খি নৌকো করে, মাঝিমাল্লা নিয়ে। নৌকোটা আবার চলতও মাঝে মাঝে। কোনো পুকুরে কালীয়দমন। একটা পুকুরে ছিল—সে যে কী করে সম্ভব হল ভেবেও পাই নে—জল থেকে কমলেকামিনী উঠছে, একটা হাতি গিলছে আর ওগরাচ্ছে। সে ভারি মজার ব্যাপার। পুতুল-হাতির ঐ ওঠানামা দেখে সকলে অবাক। তা ছাড়া কুস্তি হত, রায়বেঁশে নাচ হত, বাঁশবাজি খেলা, আরো কত কী। তাদের আবার প্রাইজ দেওয়া হত।

এই তো গেল বাইরের ব্যাপার। ঘরের ভিতরেও নানা দেশের নানা জিনিসের এক্‌জিবিশন—ছবি, খেলনা, শোলার কাজ, শাড়ি, গয়না। মোট কথা, দেশের যা-কিছু জিনিস সবই সেখানে দেখানো হত। সন্ধেবেলা লানা রকম বৈঠক বসত—কথকতা নাচগান আমোদআহ্লাদ সবই চলত। রামলাল চাকর আমাদের ঘরে ঘরে দেখিয়ে নিয়ে বেড়াত। একটা দিল্লির মিনিয়েচার ছিল গোল কাঁচের মধ্যে, এত লোভ হয়েছিল আমার সেটার জন্য। বেশি দাম বলে কেউ দিলে না কিনে, দু-চারটা খেলনা দিয়েই ভুলিয়ে দিলে। কিন্তু আমি কি আর ভুলি। কী সুন্দর ছিল জিনিসটি, এখনো আমার মনে পড়ে।

আমরা দাঁড়িয়ে দেখছি বারান্দা থেকে গাছের সঙ্গে একটা মোটা দড়ি বাঁধা হয়েছে। বল্‌ডুইন সাহেব, আমরা বলতুম ব্লণ্ডিন সাহেব, দড়ার উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে গেলেন; একটা চাকার মতো কী যেন তাও পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে গড়িয়ে নিলেন। চার দিকে বাহবা রব।

বাঁশবাজির বেদেনী ছিল কয়েকজন মেলাতে; তারা বললে, ও আর কী বাহাদুরি। খাঁজকাটা জুতো পরে দড়ার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া তো সহজ। আমরা খালি পায়ে হাঁটতে পারি। এই বলে বেদেনীরা কয়েকজন পায়ের নীচে গোরুর শিঙ বেঁধে সেই দড়ার উপর দিয়ে হেঁটে নেচে সবাইকে তাক্‌ লাগিয়ে দিলে। কোথায় গেল তার কাছে ব্লণ্ডিন সাহেবের রোপ-ওয়াকিং।

এই-সব দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গেছি, এমন সময় চারি দিকে মার-মার মার-মার হৈ-হৈ পালা-পালা রব। যে যেদিকে পারছে কেউ পাঁচিল টপকে কেউ রেলিং বেয়ে ফটকের নীচে গলিয়ে ছুটছে, পালাচ্ছে। আমরা ছেলেমানুষ, কিছু বুঝি না কী ব্যাপার, হকচকিয়ে গেলুম। রামলাল আমাদের হাত ধরে টানতে টানতে দৌড়ে ফটকের কাছে নিয়ে গেল। ফটক বন্ধ, লোহার গরাদ দেওয়া, খোলা শক্ত। তখনো চার দিকে হুড়োহুড়ি ব্যাপার চলছে। সঙ্গে ছিলেন কেদার মজুমদার—ছোটোদিদিমার ভাই, আমরা বলতুম কেদারদা—আর ফটকের ওপারে ছিলেন শ্যামবাবু, জ্যোতিকাকামশায়ের শ্বশুর। অসম্ভব শক্তি ছিল তাঁদের গায়ে। কেদারদা দুহাতে আমাদের ধরে এক এক ঝটকায় একেবারে ফটক টপকে ও ধারে শ্যামবাবুর কাছে জিম্মে করে দিচ্ছেন।

স্বর্ণবাঈ ছিল সেকালের প্রসিদ্ধ বাঈজী, তারই জন্য কী একটা হাঙ্গামার সূত্রপাত হয়।

সেই আমাদের হিন্দুমেলাতে শেষ যাওয়া। তার পরও কিছুকাল অবধি হিন্দুমেলা হয়েছে, কিন্তু আমাদের আর যেতে দেওয়া হয় নি। হিন্দুমেলা, সে প্রকাণ্ড ব্যাপার তখনকার দিনে। তার অনেক পরে হিন্দুমেলারই আভাস দিয়ে মোহনমেলা, কংগ্রেসমেলা, এ মেলা সে মেলা হয়, কিন্তু অতবড়ো নয়। হিন্দুমেলার উদ্দেশ্যই ছিল ভারতপ্রীতি ও আজকাল তোমাদের যে কথা হয়েছে কৃষ্টি—সেই কৃষ্টির উপর তার প্রতিষ্ঠা ছিল। কিন্তু বাঙালির যা বরাবর হয়, শেষটায় মারামারি করে কৃষ্টি কেষ্ট পায়, হিন্দুমেলারও তাই হল।

নবযুগের গোড়াপত্তন করলেন নবগোপাল মিত্তির। চার দিকে ভারত, ভারত—‘ভারতী’ কাগজ বের হল। বঙ্গ বলে কথা ছিল না তখন। ভারতীয় ভাবের উৎপত্তি হল ঐ তখন থেকেই, তখন থেকেই সবাই ভারত নিয়ে ভাবতে শিখলে।

তার পর অনেক কাল পরে, বাবামশায় তখন মারা গেছেন, নবগোপাল মিত্তিরের বৃদ্ধ অবস্থা, তখনো তাঁর শখ একটা-কিছু ন্যাশনাল করতে হবে। আমরা তখন বেশ বড়ো হয়েছি, একদিন নবগোপাল মিত্তির এসে উপস্থিত; বললেন, একটা কাণ্ড করেছি, দেশী সার্কাস পার্টি খুলেছি। ও ব্যাটারাই সার্কাস দেখাতে পারে, আর আমরা পারি নে, তোমাদের যেতে হবে।

আমি বললুম, সে কী কথা, দেশী সার্কাস পার্টি! মেম যে ঘোড়ার পিঠে নাচে, সে কোথায় পাবেন আপনি?

 তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি সব জোগাড়-যন্তোর করেছি, শিখিয়েছি, তৈরি করেছি কেমন সব দেখবে’খন।

গেলুম আমরা নবগোপাল মিত্তিরের দেশী সার্কাস পার্টিতে। না গিয়ে পারি? একটা গলিজ জায়গা; গিয়ে দেখি ছোট্ট একখানা তাঁবু ফেলেছে, কয়েকখানা ভাঙা বেঞ্চি ভিতরে, আমরা ও আরো কয়েকজন জানাশোনা ভদ্রলোক বসেছি। সার্কাস শুরু হল। টুকিটাকি দুটাে-একটা খেলার পর শেষ হবে ঘোড়ার খেলা দেখিয়ে। দেশী মেয়ে ঘোড়ার খেলা দেখাবে। দেখি কোত্থেকে একটা ঘোড়া হাড়গোড়-বের-করা ধরে আনা হয়েছে, মেয়েও একটি জোগাড় হয়েছে, সেই মেয়েকে সার্কাসের মেমদের মতো টাইট পরিয়ে সাজানো হয়েছে। দেশী মেয়ে ঘোড়ায় চেপে তো খানিক দৌড়ঝাঁপ করে খেলা শেষ করলে। এই হল দেশী সার্কাস।

নবগোপাল মিত্তির ঐ পর্যন্ত করলেন, দেশী সার্কাস খুলে দেশী মেয়েকে দিয়ে ঘোড়ার খেলা দেখালেন। কোথায় হিন্দুমেলা আর কোথায় দেশী সার্কাস। সারা জীবন এই দেশী দেশী করেই গেলেন, নিজের যা-কিছু টাকাকড়ি সব ঐতেই খুইয়ে শেষে ভিক্ষেশিক্ষে করে সার্কাস দেখিয়ে গেলেন।

সেই স্রোত চলল। তার অনেক দিন পরে এলেন রামবাবু। তারও নবগোপাল মিত্তিরের মতোই ন্যাশনাল ধাত ছিল। তিনি এসে বললেন, বেলুনে উড়ব, ওরাই কেবল পারে আর আমরা পারব না?

তার আগেই স্পেন্সার সাহেব, মস্ত বেলুনবাজ, বেলুন দেখিয়ে নাম করে গেছেন।

গোপাল মুখুজ্জের হলেতে থান থান তসর গরদ কেটে বেলুন তৈরি হল, একদিন তিনি উড়লেনও সেই বাঁধা বেলুনে; তার আবার পাল্টা জবাব দিলে সাহেবরা খোলা বেলুনে উড়ে। রামবাবুর রোখ চেপে গেল; তিনি বললেন, আমিও উড়ব খোলা বেলুনে, প্যারাসুট দিয়ে নামব।

 আবার সেই গোপাল মুখুজ্জের হলেই প্যারাসুট বেলুন তৈরি হল। গোপাল মুখুজ্জের অনেক টাকা খরচ হয়েছিল এই-সব করতে। নারকেলডাঙার যেখানে গ্যাস তৈরি হয় সেখান থেকে বেলুন ছাড়া হবে, আমরা অনেকেই সেখানে জড়ো হয়েছি। প্রথম বাঙালি বেলুনে উড়ে প্যারাসুট দিয়ে নামবে, আমাদের মহা উৎসাহ। সব ঠিকঠাক, বেলুন তো উড়ল, তখনো বাঁধা আছে দড়ির সঙ্গে, কথা ছিল রামবাবু রুমাল নাড়লে দড়ি কেটে দেওয়া হবে। খানিকটা উঠে রামবাবু রুমাল নাড়লেন, অমনি খটাস করে দড়ি কেটে দেওয়া হল। বেলুন উপরে উঠছে তো উঠছেই। দেখতে দেখতে বেলুন একেবারে বুঁদ হয়ে গেল। আমরা তো সব স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছি, ভাবছি এখনো রামবাবু লাফিয়ে পড়ছেন না কেন। লাখো সাহেবও ছিলেন সেই ভিড়ে—মস্ত সায়েন্টিস্ট—তিনি বললেন আর নামতে পারবেন না রামবাবু, একেবারে কোল্ড ওয়েভের মধ্যে চলে গেছেন, সেখান থেকে জীবন্ত অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব নয়।

আমাদের তো সবার মুখ চুন। গোপাল মুখুজ্জের টাকা গেল, বেলুন গেল, আবার রামবাবুও গেলেন দেখছি।

দুরবীন লাগিয়ে দেখছি; দেখতে দেখতে এক সময়ে দেখলুম, রামবাবু যেন লাফিয়ে পড়লেন বেলুন থেকে। বেলুন তো আরো উপরে উঠে গেল, আর রামবাবু লাফিয়ে পড়ে পাক খেতে লাগলেন কেবলই, প্যারাসুট আর খোলে না। আমরা ভাবছি গেল রে, সব গেল এইবার। শূন্যে পাক খাওয়া মানে বুঝতেই পারো, এক-একবারে পঞ্চাশ-ষাট হাত নেমে আসছেন। এই রকম দু-তিনবার পাক খাবার পর প্যারাসুট খুলল। আমরা সব আনন্দে হাততালি দিয়ে রুমাল উড়িয়ে টুপি উড়িয়ে দু-হাত তুলে নাচছি—জয় রামবাবুকী জয়, জয় রামবাবুকী জয়! সে যা শোভা আমাদের তখন, যদি দেখতে হেসে বাঁচতে না। দুপুর রোদ্‌দুরে দু-হাত তুলে সবার নৃত্য। রবিকাকা ছিলেন না সেখানে, তিনি বোধহয় সে সময়ে অন্য কোথাও ছিলেন। যাক, আস্তে আস্তে প্যারাসুট তো নামল। আমরা দৌড়ে গিয়ে রামবাবুকে ধরে নামিয়ে হাওয়া করে শরবত-টরবত খাইয়ে সুস্থির করি। পরে জিজ্ঞেস করলুম, আচ্ছা বেলুন থেকে লাফিয়ে পড়তে এত দেরি করলেন কেন, বুঝতে পারেন নি বুঝি?

তিনি বললেন, আরে না না, ও সব না। বুঝতে ঠিকই পেরেছিলুম, কিন্তু যত বারই লাফিয়ে পড়বার জন্য দড়ি ধরতে যাই মনের ভিতর কেমন যেন করে ওঠে, হাত সরিয়ে নিই। তার পরে যখন দেখলুম বেলুন উঠতে উঠতে এত উপরে উঠে গেছে যে আর কিছুই প্রায় দেখা যায় না তখন সাহসে ভর করে ‘জয় মা’ বলে লাফিয়ে পড়লুম।

যাক, দেশী লোকের খোলা বেলুনে ওড়াও হল, প্যারাসুট দিয়ে নামাও হল।

এবারে রামবাবু বললেন, বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। নবগোপালবাবু যা পারেন নি সেইটে তিনি করলেন। রামবাবু বললেন, ও-সব নয়, আমি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সঙ্গে লড়াই করব।

কোত্থেকে একটা কেঁদো বাঘ জোগাড় করে একদিন খেলা দেখালেন পাথুরেঘাটার রাজবাড়িতে। রামবাবু বললেন, সাহেব বেটারা আর কী খেলা দেখায় বাঘের, দু পাশে দুটাে বন্দুক নিয়ে লোহার খাঁচার ভিতরে। আমি দেখাব খেলা খোলা উঠানে।

ছোটাে একটা খাঁচায় বাঘটাকে আনা হল। রামবাবু বাঘের খেলা দেখালেন; ঘুষোঘাষা চড়চাপড় মেরে কেমন করে বেশ বাগে আনলেন বাঘটাকে। খেলা দেখিয়ে আবার খাঁচায় পুরে দিলেন।

অসীম সাহসী ছিলেন তিনি। ঐ বাঘের খেলাই তার শেষ কীর্তি। কিছুদিন বাদে শুনি তিনি সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেছেন হিমালয়ে। এখনো নাকি তিনি জীবিত আছেন, চন্দ্রস্বামী না কী নাম নিয়ে হিমালয় পাহাড়ে তপস্যা করছেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress