Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

খানিকবাদেই সেই সিঁড়ি দিয়ে যখন নামলাম তখন আর সে আওয়াজ নেই। পাগুলো যেন নড়তেই চায় না।

ঘনাদাকে আমাদের অনুরোধ-উপরোধ, যুক্তি তর্ক, প্রলোভন কিছুতে টলানো যায়নি। তাঁর ধনুকভাঙা পণ ওই তেতলার ঘর ছেড়ে পাদমেক ন গচ্ছামি।

খবরের কাগজে হলে নিশ্চয় একটা জুৎসই শিরোনাম দিত। সংকটজনক পরিস্থিতি গোছের কিছু।

তবু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলে তো চলে না। আমাদের মন্ত্রণাসভা বসল।

আমাদের অবশ্য উভয় সংকট। ঘনাদাকে বাদ দিয়ে নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়ার কথা ভাবতে পারি না। আবার ঘনাদার জেদের কাছে হার মানলে এমন একটা দাও ফসকে যায়!

সুতরাং যেমন করে হোক ঘনাদাকে এ বাড়ি ছাড়তে রাজি করাতেই হবে।

কিন্তু তা কী করে সম্ভব?

ভূতের ভয় দেখিয়ে! শিবুর প্রস্তাব।

প্রস্তাবটা মন্দ নয়। কিন্তু ভয় দেখালে হিতে বিপরীতে যদি হয়! একটা ছুতোনাতা করে আমাদের রামভুজকেই হয়তো ভোলা ছাদে শুতে বাধ্য করবেন। একবার চোরের ভয় হতে যেমন করেছিলেন। রামভুজ বেচারারই প্রাণান্ত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘনাদার বন্ধ দরজার ভেতর থেকে ডাক, রামভুজ জেগে আছ তো? তার সঙ্গে নুনের ছিটেটুকু আরও অসহ্য! রামভুজ হাঁ, বড়বাবু বলে সাড়া দেবার পর ঘনাদার উদার আশ্বাস,দেখো, ভয় পেও না। আমি তো আছি, তোমার ভয় কী?

না, ভূতের ভয় দেখানোটা বেকার। তা ছাড়া সদ্য সদ্য বাড়ি বদলের প্রস্তাবের পরই ভূতের ভয় দেখানোর মানেটা ধরেও ফেলতে পারেন।

শিবুর প্রস্তাব বাতিল হতেই শিশির নিজেরটা পেশ করল, মহামারির আতঙ্ক!

কীসের আতঙ্ক? আমাদেরই বিহুল প্রশ্ন।

মহামারির আতঙ্ক! শিশির নাটকীয় সুরে বুঝিয়ে দিলে, সারাক্ষণ বাড়িতে কী রকম একটা বিশ্রী গন্ধ। শুয়ে বসে কারুর শান্তি নেই। নিশ্চয় গুরুতর কিছু হবে। এই রকম গন্ধ পাবার পর কোন মেস বাড়িতে কোথায় নাকি সব ক-জন বোর্ডারকে ঝোল ভাত খাইয়ে ছেড়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে বাড়ি নাকি করপোরেশন থেকে ভেঙে ফেলতে হয়। সকাল বিকেল ঘনাদার কাছে এই সব গল্প।…

কিন্তু ঘনাদার নাকেও তো গন্ধটা যাওয়া চাই! আমাদের বাধা দিতে হল শিশিরের রাশছাড়া কল্পনায়।

নিশ্চয় যাওয়া চাই। শিশির জোরের সঙ্গে সায় দিলে, আমাদের সকলের নাকে যাবে, ঘনাদার যাবে না?

গন্ধটা কীসের? আমাদের সন্দিগ্ধ প্রশ্ন।

একটা বিতিকিচ্ছি কিছুর! শিশির সোৎসাহে ব্যাখ্যা শুরু করলে, সালফিউরিক অ্যাসিড খানিকটা কিংবা…

কিংবা তোমার মগজে যে বস্তুটি আছে সেইটি! গৌর খিচিয়ে উঠল। আমাদেরও বক্তব্য তাই। ঘনাদাকে বাড়ি ছাড়া করতে নিজেদের নাড়ি ছাড়াতে আমরা রাজি নই। শিশিরের প্রস্তাব সুতরাং সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল।

কিন্তু একটা কিছু ফন্দি তো না বার করলে নয়।

ভাবতে ভাবতে চমৎকার একটা মতলব মাথায় এসে গেল।

আচ্ছা, হঠাৎ একজনের মাথা খারাপ হয়ে যাক না? সগর্বে সকলের মুখের দিকে চাইলাম।

নাঃ, দুনিয়ায় সরেস কোনও কিছুরই কদর নেই। এমন একটা চমৎকার প্রস্তাবে সবাই মিলে আমার দিকে অমন অবজ্ঞাভরে চাইবার কী মানে হয়? তার ওপর হয়ে যাক কেন, হয়েছে তো! বলে চিপটেন কাটাটা একটু বাড়াবাড়ি নয়?

নেহাত ব্যাপারটা জরুরি বলেই অপমানটা গ্রাহ্য না করে কর্তব্যের খাতিরে বসে রইলাম।

হঠাৎ গৌর বললে, আচ্ছা, কাল থেকেই ঘনাদা খেপে আছে, কেমন? ব্যস! আর ভাবনা নেই।

তার মানে? আমরা বিমূঢ়।

মানে, অটোভ্যাকসিন! গৌর সংক্ষিপ্ত।

অটোভ্যাকসিন কী রকম?

রোগের বীজ থেকেই তার ওষুধ, আবার কী রকম? গৌরের মাথাগুলোনো ব্যাখ্যা!

ব্যাখ্যা যেমনই হোক মতলবটা যে পাকা মাথার তা আমাদের স্বীকার করতেই হল অভিযান আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।

অভিযান সেই দিন থেকেই শুরু হল। ঘনাদা তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক সান্ধ্যভ্রমণে বেরুবার জন্য নামবার আগেই আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পয়লা কাজ সেরে এলাম।

তারপর ঘনাদার লেক-বৈঠক থেকে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকা।

ঘনাদা দোতলায় উঠে তেতলায় পা বাড়াবার আগেই তাঁকে যেন সন্ত্রস্ত করে ঘিরে ধরা। মুখের ঘনঘটা দেখে মনে হল ওষুধ ধরেছে। ঘনাদা অবশ্য পাশ কাটিয়ে চলে যাবার উপক্রমই করছিলেন। কিন্তু সে সুযোগ আর তাঁকে দেওয়া হল না।

বড় মুশকিল হয়ে গেছে ঘনাদা! আমাদের মুখে উদ্বেগ, আশঙ্কা, উত্তেজনা।

ঘনাদাকে শিশিরের এগিয়ে-ধরা সিগারেটটা নিয়ে আড্ডাঘরে এসে বসতেই হল।

শিশির লাইটার জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে দিলেও ঘনাদার মুখের অন্ধকার যেন কাটল না।

পাড়ার সবাই তো মেতে উঠেছে! শিবু শুরু করল।

আমরা কত করে বোঝালাম! আমি চালিয়ে গেলাম, কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা।

অবশ্য ওদেরই বা দোষ কী! গৌর সত্যের মর্যাদা না রেখে যেন পারল না, আপনার মতো লোক পাড়ায় থাকতে আর কার কাছে যাবে?

ঘনাদা সত্যিই একটু কি গললেন নাকি?

ঠিক বোঝা গেল না। উলটো হাওয়া চালাতে হল তাই তৎক্ষণাৎ।

বললাম, কিন্তু এটা একটু বাড়াবাড়ি নয়? ঘনাদার মত না নিয়েই আগে থাকতে ওঁর নাম দিয়ে কাউন্সিলার হবার জন্য উনি প্রার্থী বলে দরখাস্ত করে দেওয়া!

শুধু তা-ই! শিবুও পোঁ ধরলে, রাস্তায় এরই মধ্যে ওগুলো সব!

শিশির যেন আকাশ থেকে পড়ল, রাস্তায় আবার কী হল?

ও, তা-ও বুঝি জানো না! শিবু বিজ্ঞ সাজল, ঘনাদার চোখেও কি আর পড়েনি! উনি তো এই মাত্র ফিরলেন।

আমরা উৎসুক ভাবে ঘনাদার দিকে তাকালাম। এইবার একটা সাড়া যদি পাওয়া যায়। কিন্তু না লাল, না সবুজ। এখনও শুধু হলদে। কোন দিকে যাবে বোঝবার জো নেই।

ঘনাদার সিগারেটের টানটা একটু লম্বা হল।

আবার খোঁচাতেই হল অগত্যা।

শিবুকে যেন ধমকে বললাম, হেঁয়ালি রেখে আসল কথাটা বলবি! কী হয়েছে

রাস্তায়?

এরই মধ্যে রাস্তায় পোস্টার পড়ে গেছে।

পোস্টার! আমরা যেন হতভম্ব, কীসের পোস্টার?

ঘনাদার জন্যে ভোটের, শিবু রহস্য তরল করলে, আজ শুধু দেয়ালে দেয়ালে খড়ি দিয়ে লিখেছে। কালই শুনলাম ছাপানো পোস্টারে এ তল্লাট ছেয়ে দেবে! তা স্লোগান কিন্তু দিয়েছে ভাল।

শিবুর গদগদ হওয়াটাকেই যেন সন্দেহ করে জিজ্ঞাসা করলাম, কী স্লোগান দিয়েছে?

দিয়েছে, শিবু সুর করে আওড়ালে,

দেশের নাড়ি বড় ক্ষীণ
ঘনাদাকে ভোট দিন।

ঘনাদার দিকে আড়চোখে চেয়ে আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করলাম, এ আর কী স্লোগান হল এমন!

আরও আছে শিবু আশ্বাস দিলে, যেমন,

সফেদ হবে লাল-চীন।
ঘনাদাকে ভোট দিন।

শিবুর স্লোগান শুনে গৌরেরও যেন নেশা ধরে গেল। বললে, তার চেয়ে আরও ভাল স্লোগান দিলেই পারত। যেমন,

ভোট দেবেন কাকে?
বিশ্ব-ঘনাদাকে!
কী করবেন তিনি?
কালো বাজার সাদা করে
সস্তা চাল তেল চিনি।

গৌর যদি এগোতে পারে আমিই বা পিছিয়ে থাকি কেন? বললাম স্লোগান আরও জবর হতে পারে!

কী রকম? গৌরের গলাটাই যেন একটু বেশি রুক্ষ।

বেশ কাঁপানো গলায় শোনালাম,

শুন শুন সর্বজন, শুন দিয়া মন
ঘনাদাকে ভোট দিতে কহি কী কারণ।
ঘোর কলিকাল এবে পাইতে উদ্ধার–
ঘনাদার স্কন্ধে হও দুঃখসিন্ধু পার।
ত্বরা করি ভোট দাও যে চাও তরিতে—
বিলম্বে হতাশ হবে ধন্দ নারি ইথে।

ছো? গৌরই সবার আগে সশব্দে তার মতামত জানালে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই।

ওটা একটা স্লোগান হল?

একি পাঁচালি পেয়েছিস?

ভোটাররা ও স্লোগান শুনলে হাসতে হাসতেই ভোট দিতে ভুলে যাবে!

প্রতিভার আদর যে এ দেশে নেই তা অনেক কাল আগেই বুঝেছি। গুম হয়ে তাই চুপ করে রইলাম। কিন্তু নিজেদের মধ্যে খাওয়াখাওয়ি করে আসল কাজটা তো ভেস্তে দেওয়া যায় না!

সকলেরই বোধহয় সে হুঁশ হল। শিশিরই হাওয়াটা ঠাণ্ডা করবার জন্যে প্রথম বললে, যাক গে। ঘনাদা ইলেকশনে নামলে স্লোগান ঢের জুটবে। বাংলা দেশের বাঘা বাঘা কবিকে সব লাগিয়ে দেব। কিন্তু দেয়ালে দেয়ালে এখনই এই সব লেখা কি উচিত হয়েছে? আবার কাল বলছে, ছাপানো পোস্টার ছাড়বে! ঘনাদার মতটা তো তোর আগে নেওয়া উচিত ছিল।

মত নেবে ওরা! শিবু আসল রাস্তা ধরলে, ওদের তো চেনো না। ঠিক যখন একবার করে ফেলেছে তখন ঘনাদাকে ওরা দাঁড় করাবেই।

ঘনাদা যদি রাজি না হন তবু? গৌর যেন রেগে কাঁই। রাজি ঘনাদাকে হতেই হবে। না হয়ে উপায় নেই। শিবু নিজেই যেন নাচার।

একি জুলুম নাকি! এতক্ষণে অভিমানটা সামলে আমিও সুর মেলালাম।

জুলুম জবরদস্তি যাই বলল, দেয়ালে যখন খড়ির দাগ কেটেছে, ওরা ঘনাদাকে দাঁড় করিয়ে ছাড়বে না! শিবু সার কথা শুনিয়ে দিলে।

ঘনাদা এতক্ষণে একটা সিগারেট শেষ করে আর একটা ধরিয়েছেন শিশিরের এগিয়ে দেওয়া টিন থেকে। কিন্তু কোনও সাড়াশব্দ তাঁর দিক থেকে শোনা যায়নি। চোখ দুটো মাঝে মাঝে কোঁচকানো ছাড়া কোনও ভাবান্তরও নয়।

কিন্তু এরকম শালগ্রাম শিলা হলে আমাদের তো চলবে না। আশেপাশে ঝোপঝাড় না নেড়ে একেবারে সোজাসুজি তাই খোঁচাতে হল।

আপনাকে তো দাঁড়াতেই হচ্ছে দেখছি, ঘনাদা!

আমাদের চার জোড়া চোখ যাকে বলে ঘনাদার মুখে নিবদ্ধ।

ঘনাদা সিগারেটের ছাই ঝেড়ে শুধু বললেন, হুঁ!

হু! শুনেই আমরা কিন্তু হাঁ। ঘনাদা বলেন কী! শেষে নিজেদের ফাঁসে নিজেরাই গলা গলিয়ে দিলাম নাকি!

তাড়াতাড়ি যা যা প্যাঁচ হাতে ছিল সব ছাড়তে হল।

অবশ্য ঘনাদাকে দাঁড় করাবার গরজ ওদের আলাদা। শিবু গম্ভীরভাবে জানালে।

কী গরজ? গৌর যেন অবাক।

ওদের দুজন কন্ট্রাক্টরকে কাজ পাইয়ে দিতে হবে। শিবু গোপন রহস্যটা ফাঁস করে দিলে যেন অনিচ্ছায়, আরবারে চুরির দায়ে তাদের নাম কাটা গেছল কিনা!

আর ওই চাঁইদের বাড়ির ট্যাকস কমানো! শিশির জোগান দিলে, দাড় করাবার কড়ারই তো তা-ই।

জন কয়েককে চাকরিও দিতে হবে। আমি জুড়ে দিলাম, শুনলাম এসবের মধ্যে বাঁ হাতের পাওনাও কিছু মিলবে!

তার মানে ঘুষ! আর ঘনাদা এতে রাজি হবেন! গৌরের গলায় আগুনের জ্বালা।

না হলে যে ছাড়ানছিঁড়েন নেই! শিবুর হতাশ মন্তব্য।

কেন, সাফ না বলে দেবেন। কী, করবে কী ওরা! গৌর রোখ দেখাল।

কী করবে! শিবুর মুখে যেন আতঙ্কের ছায়া, এ-পাড়ায় তা হলে বাস করতে পারব? রাস্তা দিয়ে হাঁটা যাবে না। চাকর পালিয়ে যাবে, ইলেকট্রিকের লাইন কাটা যাবে। দিন নেই, রাত নেই, মেসে ঢিল পাটকেল পড়বে। তারপর বোমা-ই বা ফেলতে কতক্ষণ!

একি মগের মুল্লুক নাকি! একটু প্রতিবাদ জানাতেই হল, থানা পুলিশ নেই?

থানা পুলিশ! শিবু তাচ্ছিল্য ভরে উড়িয়ে দিলে, রাতদিন পুলিশ পাহারায় নিজেরাই জেলখানায় থাকব নাকি!

কিন্তু এ তো হেঁজিপেঁজির কথা হচ্ছে না, কে এখানে আছে তা দেশে দশে জানে। বিধানসভা কেঁপে উঠবে না তা হলে? দিল্লির পর্যন্ত টনক নড়বে না? গৌরের গর্জন।

তা নড়লেও লাভটা হচ্ছে কী! শিশিরের বিজ্ঞ বিশ্লেষণ, তখন তারা বলবে, ও ছাই করপোরেশন কেন, ঘনাদার জন্য রাজসভা, লোকসভাই তো হা-পিত্যেশ করে আছে। সেখানে চালান করে দিয়ে দিল্লির সাউথ কি নর্থ অ্যাভেনিউ-এর এমপি কোয়ার্টারে তুলতে চাইবে। ঘনাদা কি তাতে রাজি হবেন? সে সাধ থাকলে ওঁকে আটকাতে পারত কেউ? উনি নিরিবিলিতে অজ্ঞাতবাসে থাকতে চান বলেই না আমাদের এই অখদ্দে মেসে পড়ে আছেন।

কিন্তু এখানে থাকতে হলেও যে ইলেকশনে দাঁড়াতে হয়? গৌরের দুর্ভাবনা।

আর না দাঁড়ালেও ওদের জুলুমবাজি সইতে হয়! আমার দুশ্চিন্তা।

তা হলে উপায়টা কী? গৌরের ব্যাকুল জিজ্ঞাসা।

উপায় হল, শিবুর সুচিন্তিত বিধান, এ পাড়াই ছেড়ে দেওয়া। এমন পাড়ায় যাওয়া যেখানে এ-সব ঝামেলাই নেই, পাড়াপড়শিও এমন ওঁচা নয়।

এটা তো খুব ভাল বুদ্ধি! আমরা সকলে একসঙ্গে উৎফুল্লভাবে মাথা নেড়ে ঘনাদার দিকে তাকালাম।

কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা!

যাঁর হয়ে এত তর্কাতর্কি, বিচার-বিশ্লেষণ, তিনি যেন আমাদের মধ্যে থেকেও নেই। বাইরের দরজার দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় সিগারেটও প্রায় শেষ করে এনেছেন তখন নির্লিপ্ত উদাসীনভাবে।

অগত্যা জিজ্ঞেস করতেই হল, নতুন সেই বাড়িটাই কি তা হলে দেখব নাকি, ঘনাদা? এখনও চেষ্টা করলে হয়তো পাওয়া যাবে।

ঘনাদা এতক্ষণে মুখ খুললেন। কিন্তু যা বেরিয়ে এল তা দার্শনিক বুজকুড়ি। মানে, যেমন খুশি বোঝো!

বললেন, হ্যাঁ চেষ্টা করলে তো অনেক কিছুই পাওয়া যায়।

তার পরই হঠাৎ উত্থান ও আমাদের হতভম্ব করে রেখে প্রস্থান-শিশিরের সিগারেটের টিনটা সমেতই অবশ্য।

পরের দিন আরও কড়া দাওয়াইয়ের ব্যবস্থা করতেই হল। দলের সব কটি একেবারে বাছা বাছা। নিজেদের পাড়ার নয়। এধার ওধার নানা তল্লাট চষে চারটি যে চেহারা জোগাড় হয়েছে, সিনেমায় পেলে বোধ হয় তাদেরকে লুফে নেয়।

দশরথ শিবুর মামার বাড়ির পাড়ায় কুস্তি করে। ছোটখাটো একটি হাতি বিশেষ। কামানো মাথাটা ঘাড়ের মাংসের মধ্যে কখন ড়ুবে যাবে সন্দেহ হয়। কাত হয়ে ছাড়া গেরস্ত বাড়ির দরজা দিয়ে যেতে পারে না। আর দশরথের চেলা বিশে তারই কিঞ্চিৎ সংক্ষিপ্ত সংস্করণ। এদের সঙ্গে পাল্লা ঠিক রাখতে নফর আর হাবুল দুজনে দুটি সিড়িঙ্গে সুপুরি গাছ।

দশরথ আর বিশের গায়ে মোটা খদ্দর, নফর আর হাবুলবাবুর কোঁচানো শান্তিপুরি ধুতি, কলিদার গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি। চার জনের শুধু একটি মিল কানে শুনে যাচাই করে নেওয়া। সবাই এরা স্যামবাজারের সসিবাবু।

সাতসকালেই তারা আমাদের ফরমাস মতো এসে হাজির। আমরাও হন্তদন্ত হয়ে একেবারে তেতলার ঘরে।

কী হবে, ঘনাদা? ওঁরা যে এসে গেছে!

ঘনাদা সবে শিশিরের কালকের কৌটো থেকে একটি সিগারেট বার করে সামনে বনোয়ারির আনা চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে মৌজ করতে বসেছেন।

আমাদের আর্তনাদে প্রথমে চমকে প্রায় লাফিয়েই উঠলেন। তারপর অবশ্য সামলে গিয়ে গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কারা?

ওই সেই ইলেকশনের পাণ্ডারা। আমরা তখনও যেন হাঁপাচ্ছি, একেবারে দল বেঁধেই এসেছেন!

ওঃ! ঘনাদা চায়ের পেয়ালাটা তুলতে গিয়ে আবার নামালেন।

গলাটা যেন একটু ভারীই লাগল বেশ। মুখেও যেন আর-এক পোঁচ ছায়া।

উৎসাহিত হয়ে বললাম, পরে আসতে বলব, ঘনাদা? বলব যে বেড়াতে বেরিয়ে গেছেন?

তাতে কী লাভ হবে? গৌর আমার প্রস্তাব সংশোধন করলে, ওরা তো তা হলে মাটি কামড়ে বসে থাকবে ঘনাদার ফেরার অপেক্ষায়। চা সিগারেট জোগাতে আমরা ফতুর। তার বদলে বলি, ঘনাদার কাল রাত থেকে, কী বলে, খুব বাড়াবাড়ি অসুখ, নস্ট্যালজিয়া কি হাইড্রোফোবিয়া!

তোর যেমন বুদ্ধি! ঘনাদার কুটিটুকু দেখা দিতে না দিতেই শিবু গৌরকে ধমক দিয়ে সামলাল, ঘনাদার হাইড্রোফোবিয়া হতে যাবে কোন দুঃখে। ও-রোগ তো কুকুরে কামড়ালে হয়। আর নস্ট্যালজিয়া কি রোগ নাকি? ও তো নিজের বাড়ি কি আগেকার দিনের জন্য মন কেমন করা!

আহা কে অত বুঝবে! শুধু ইয়া দিয়ে যাহোক একটা হলেই হল! গৌর ভাঙবে তবু মচকাবে না, ওই ইয়া লাগালেই রোগ লোগ বলে মনে হয়। ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, নিউমোনিয়া, অ্যানিমিয়া, পায়োরিয়া..

থাক, থাক! শিশির ব্যস্ত হয়ে গৌরকে থামাল, একেবারে হাসপাতাল করে তুললি যে! এর পর তেলাপিয়া, বোগেনভিলিয়াও রোগ বলে মনে হবে।

কিন্তু ওদিকে ওরা নীচে দাঁড়িয়ে, সে খেয়াল আছে! শিবু স্মরণ করিয়ে দিলে, ওদের যা হোক একটা কিছু বলে বিদায় না করলে তো নয়!

ঘনাদার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে শিবু তার প্রস্তাবটা জানালে, বলে দিই, ঘনাদাকে কাল হঠাৎ গুয়াতেমালা যেতে হয়েছে। কবে ফিরবেন, ঠিক নেই।

গুয়াতেমালা কেন? শিশিরের আপত্তি, যাবার আর জায়গা নেই?

থাকবে না কেন! শিবু বোঝাবার চেষ্টা করলে, ঘনাদা তো ইচ্ছে করলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি যেখানে খুশি যেতে পারেন। কিন্তু শুনলে একটু ভড়কে যায় এমন জায়গায় যাওয়াই ভাল নয়?

যদি জানতে চায় গুয়াতেমালায় কেন? শিশির ফ্যাকড়া তুলল।

সেখানে যাকে বলে জাতীয় সংকট! জবাবটা যেন শিবুর জিভের ডগাতেই ছিল। রাজ্য টলমল। প্রেসিডেন্ট জরুরি তার করে প্লেন পাঠিয়ে দিয়েছে। ঘনাদা না গেলে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে।

তা বলা যায় বটে! আমি প্রস্তাবটার পোকা বাছলাম, কিন্তু ঘনাদা তো আর ঘরবন্দী হয়ে থাকতে পারবেন না। এ পাড়ায় যাওয়া আসা করলেই ওদের চোখে পড়ে যাবে যে!

থাকবেন কেন এ পাড়ায়? শিবুর সহজ সমাধান, কালই আমরা রাতের অন্ধকারে নতুন পাড়ায় নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠছি। তখন আর আমাদের নাগাল পাবে কে? তা হলে ওই গুয়াতেমালাতেই আপনি গেছেন, কী বলেন ঘনাদা?

না! ঘনাদা আমাদের একেবারে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ওঁদের নীচে বসাও, আমি যাচ্ছি।

ওঁদের মানে…আপনি…? আমাদের বাকবোধ হবার উপক্রম।

তবু শেষ আশায় ভর করে নীচে নেমে গিয়ে ভাড়াটে দলকে আর একটু তালিম দিয়ে দিলাম ঘনাদা আসবার আগে। তাদের বোলচালে যদি কিছু কাজ হয়।

প্রথমটা শুভ লক্ষণ-ই দেখা গেল।

এই যে, ঘনশ্যামবাবু! আসুন, আসুন! দশরথের বাজখাঁই গলার অভ্যর্থনা শুনেই ঘনাদাকে একটু যেন কাহিল মনে হল।

তার ওপর বিশের মন্তব্যে বেশ যেন ফ্যাকাশে। দশরথেরই কপি করা গলায় বিশে রীতিমতো মেজাজ দেখিয়ে বললে, অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছেন কিন্তু স্যার। কাউন্সিলার আপনাকে বানিয়ে দেব, কিন্তু আমাদের কাছে এসব চাল-ফাল চলবে না। আমরা গাছে তুলতেও জানি আবার মই কেড়ে নিতেও।

আহা, খ্যামা দে না, বিশে। দশরথই বিশেকে সামলাল, দেখছিস না, কাঁচা ইট, এখনও পোড় খায়নি। আপনি বিশের কথা কিছু ধরবেন না, ঘনশ্যামবাবু। ওর মেজাজটা বড় গরম! মুখ চালাতে কখন হাত চালিয়ে দেবে তাই আমি সামলে সামলে রাখি।

কিন্তু ঘনশ্যামবাবুর কাছে আমাদের আর্জিটা আগে পেশ করা দরকার নয় কি? বললেন নফরবাবু। যেমন তাঁর হাত জোড় করা বিনয়ের ভঙ্গি, তেমনই সরু-সুতো কাটা গলা।

আজি-ফার্জি আবার কীসের? বিশে গর্জে উঠল, আমরা ঠিক করেছি, ঘনশ্যামবাবুকে কাউন্সিলার বানিয়ে দেব, ব্যস, মামলা চুকে গেছে। উনি কি না বলবেন নাকি? ঘাড়ে তো দেখছি মাথা একটাই।

আঃ, ফের বিশে! দশরথ ধমক দিলে না আদর জানালে বোঝা গেল না, তুই বড় ফজুল বকিস! ঘনশ্যামবাবু আগে না বলুন তবে তো মেজাজ করবি? তারপর ঘনাদাকে মধুর আশ্বস, আপনি কিছু ভাববেন না, ঘনশ্যামবাবু। আমরা থাকতে আপনার কোনও ভাবনা নেই।

প্যাকাটি মার্কা হাবুলবাবু মিহি সুরে সায় দিলেন, আপনার গায়ে আঁচটি লাগতে দেব না আমরা। সব ঝঞ্জাট আমাদের, আপনার শুধু ওই হাজার দশেক যা খসবে!

হাজার দশেক খসবে, মানে? আমরাই যেন ঘনাদার জন্য কাতরে উঠলাম, ঘনাদাকে দশ হাজার টাকা দিতে হবে?

তা নয়তো কি মিনিমাগনা কাউন্সিলার হবেন নাকি? বিশে মুখ বেঁকিয়ে হেঁড়ে গলা ছাড়ল, হেঁড়া ন্যাকড়ায় শালের জোড়া! দশহাজার তো সস্তা, মশাই!

তা ঠিকই বলেছেন! একটা ভোটের লড়াই-এ দশহাজার তো নস্যি!

নিজেদের কানকেই বিশ্বাস করব কি না বুঝতে না পেরে থ হয়ে গেলাম।

এ যে ঘনাদার গলা! ঘনাদা বলছেন, দশহাজার নস্যি!

না, কানের কি চোখের ডাক্তারের কাছে দৌড়বার দরকার নেই। ঘনাদাই তাঁর মৌরসি আরামকেদারাটিতে বসে শিশিরের সিগারেটের টিনটিই অতিথিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সহাস্য বদনে বলে চলেছেন, এত সস্তায় হবে আমি তো ভাবতেই পারিনি। দু-চার হাজার উপরি অবশ্য আমি ধরেই রাখছি।

আমাদের শুধু নয়, এবার ভাড়াটে দলেরও সকলের চোখই ছানাবড়া।

গৌর কোনওরকমে ঢোক গিলে তোতলাতে তোতলাতে বলল, আপনি…কী বলে…তা হলে ইলেকশনে দাঁড়াতে রাজি?

কী করি, বলো! নিজের পাড়ার লোক। এত করে ধরেছেন। সামান্য দশ-পনেরো হাজারের জন্যে ওঁদের নিরাশ করতে তো পারি না। কোটি কোটি টাকাই যখন যাচ্ছে তখন বোঝার ওপর ওই শাকের আঁটিটুকু সইতে পারব।

কথা বলব কি, আমাদের হাঁ করা মুখ আর বুজতেই চায় না। চোয়াল যেন আটকে গেছে।

ঘনাদাই ততক্ষণে নিজের একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলে আবার বললেন, শুধু ওই শুশুকগুলোর কথা ভাবছি।

কাদের কথা? সিড়িঙ্গে নফরবাবুর মিহিসুতোকাটা গলাটাই প্রথম কিচকিচিয়ে উঠল।

ওই শুশুকগুলোর! মানে, ম্যানাটি বললে তো আপনারা বুঝবেন না। তাই শুশুক বলছি। ডিমপাড়া মাছ নয়। ওই শুশুকের মতোই একরকম হাওয়ায় নিশ্বাস নেওয়া স্তন্যপায়ী জলের জানোয়ার! তবে খায় শুধু নিরামিষ, জলের পানা-টানা, দাম-শ্যাওলা—এই সব।

তাদের কথা ভাবছেন কেন? এবার বিশের হেঁড়ে গলা, কিন্তু কেমন যেন একটু ধরা ধরা, ভ্যাবাচাকা খাওয়া।

ভাবছি, ওগুলোকে জংলিরা সব সাবাড় করে দেবে বুঝতে পেরে। ঘনাদার একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস।

জংলিরা শুশুকগুলো সাবাড় করে দেবে প্যাকটি মার্কা হাবুলবাবু একেবারে থ। শুশুকগুলো আপনার?

হ্যাঁ, আমারই বলতে পারেন। আর কাপলান-এর।

কাপলান! কাপলান কে? পিপের দোসর বিশের হাঁ করা প্রশ্ন।

কাপলান আমার বন্ধু আর অংশীদারও বটে! সে-ই এখন ব্রিটিশ গায়নার ঘাঁটিতে কাজ করছে আমার হয়ে।

কী কাজ? ও! শুষ্ক চরানো? সিড়িঙ্গে নফরবাবু ধরা গলায় শুধোলেন।

তা-ও একরকম বলতে পারেন।

তা হলে জংলিরা শুশুকগুলো সাবাড় করবে কেন? বিশের ব্যাপারটা বুঝবার প্রাণান্ত চেষ্টা।

সাবাড় করবে কাপলান আর ওখানে থাকবে না বলে! আমার এ-খবর তার কানে গেলে সে সোজা উঠবে গিয়ে হাইতিতে! ঘনাদা অতি সহজ করে বোঝালেন।

কোথায়! মূর্তিমান জালা দশরথের হাবুড়ুবু খাওয়া অবস্থা।

হাইতিতে! ঘনাদা ধৈর্যের অবতার হয়ে বোঝালেন, হাইতির নাম শুনছেন কিনা জানি না। তবে আজকালকার খবরের কাগজে কিউবার খবর নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে। হাইতি আর কিউবা হল উত্তর আর দক্ষিণ আমেরিকার কোলের কাছে অতলান্তিক মহাসাগরের দুটো পাশাপাশি দ্বীপ। হাইতি অবশ্য একটা বড় দ্বীপের অংশ। ম্যাপে কিউবাকে গেলবার জন্য একটা কুমিরের মাথা যেন হাঁ করে আছে। দেখবেন। ওই মাথাটাই হল হাইতি আর বাকিটা ডোমিনিয়ন রিপাবলিক।

ওই কাপলান, না কে বললেন, আপনার সেই অংশীদার? তা তিনি শুশুক চরানো ছেড়ে হাইতিতে গিয়ে উঠবেন কেন? সিড়িঙ্গে নফরবাবু গুছিয়ে প্রশ্নটা করে ফেললেন কোনওমতে!

উঠবে ওখানে কুরুক্ষেত্র বাধাতে। একবার তাকে ঠেকিয়েছি, আর তো সে আমার কথা শুনবে না! ঘনাদা যেন নিরুপায়, সব লণ্ডভণ্ড করে ওই দুশমন শয়তান ডিক্টেটার দুলিয়েরটাকে যদি সরায় তাতে অবশ্য আপত্তিকর কিছু নেই। একটু আফশোস শুধু এই যে সোনার পালকগুলো যেখান থেকে মাঝে মাঝে এদিকে-ওদিকে ছিটকে এসে দুনিয়াকে চমকে দেয়, ব্রিটিশ গায়নার অজগর জঙ্গলে লুকোনো সেই রহস্যপুরী এলডোরাডোর হদিস আর কেউ কোনওদিন পাবে না। একেবারে নাকের ডগা দিয়ে কুবেরের ভাণ্ডার ফসকে যাবে!

একটু থেমে ঘনাদা যেন তাচ্ছিল্যভরেই সব উড়িয়ে দিয়ে হেসে বললেন, তা যাক! তোক না কোটি কোটি টাকা! টাকাটাই তো আর সব নয়। দেশের কাজ তারও আগে। হ্যাঁ, বলুন কী করতে হবে?

মাথায় চরকি বাজি থামাতেই আমরা তখন যে যেখানে পারি বসে পড়েছি।

নেহাত কুস্তির রদ্দা-খাওয়া-ঘাড়ে বসানো বলেই জালা প্রমাণ দশরথ আর পিপের দোসর বিশের মাথা দুটো একটু বোধ হয় বেশি মজবুত আর নিরেট। তারা দুজনেই তখনও পর্যন্ত ততটা কাবু হয়নি।

জালা প্রমাণ দশরথই ভাঁটার মতো চোখ দুটো প্রায় ঠেলে বার করে বললেন, না, দাঁড়ান। ওই কুবেরের ভাঁড়ার যা বললেন, আপনার ওই কাপলান শুশুক চরানো ছেড়ে চলে আসবে বলেই আর তার খোঁজ পাওয়া যাবে না? তা কাপলান চলে আসবে কেন?

আসবে আমার খবর পেয়ে। আমি কড়ার ভাঙছি বলে—ঘনাদার মুখের হাসিটা দুঃখের-ই নিশ্চয়। কিন্তু আমরা তাইতেই প্রমাদ গনলাম।

কী কড়ার! আমাদের ভাড়াটে চার মূর্তির মুখে একই প্রশ্ন সমস্বরে উঠবে আমরা যেন জানতাম।

কী কর? ঘনাদা আমাদের সকলের মুখের উপরই একবার যেন ক্লান্তভাবে চোখ বুলিয়ে নিয়ে অনিচ্ছার সঙ্গে প্রকাশ করলেন, সে কড়ার বোঝাতে গেলে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সান্টা মেরিয়া জাহাজ ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ঠিক বড়দিনের সকালে যেখানে চড়ায় আটকে গিয়েছিল আর চল্লিশ জন শ্বেতাঙ্গ নাবিককে যেখানে নামিয়ে রেখে গিয়ে নতুন আবিষ্কৃত মহাদেশে প্রথম ইউরোপের উপনিবেশ তিনি পত্তন করেছিলেন—সেই ক্যাপ হাইতিয়েনে একবার যেতে হবে।

এখন? জালা মূর্তি দশরথের সশঙ্ক প্রশ্ন।

ঘনাদা একবার শুধু দশরথের দিকে তাকালেন। মনে হল দশরথের জালা যেন সে-দৃষ্টির সামনে ঘড়া হয়ে গেল।

সিড়িঙ্গে নফরবাবু তাড়াতাড়ি সামাল দিতে দশরথকে ধমক দিয়ে বললেন, কিছু বুঝে যা তা বলে বসেন কেন? যেতে হবেটা হল কথার প্যাঁচ। বুঝলেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ঠিক বুঝেছি! পিপের দোসর বিশে নিজের উৎসাহটা আর চেপে রাখতে পারলে না। আজকাল গল্পেটল্পে ওই রকম সব প্যাঁচ-ট্যাঁচ থাকে। আপনি বলে যান ঘনশ্যামবাবু, ওরা না পারে আমি ঠিক সমঝে যাব।

আমরা চারজনে পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কখন যে এ-আসরে আমরা ফালতু হয়ে গেছি, টেরও পাইনি।

উপযুক্ত সমঝদার পেয়েই বোধহয় খুশি হয়ে ঘনাদা ধরলেন, তারিখটা বলবার দরকার নেই। তবে একটা ছোট মাছধরা লঞ্চে কিউবার সান্তিয়াগো বন্দর থেকে জেলে সেজে লুকিয়ে হাইতির ক্যাপ হাইতিয়েন বন্দরে যখন গিয়ে নামলাম তখন হাইতির হাওয়া গরম হয়ে আছে চাপা বিদ্রোহের আগুনে। হাইতির পক্ষে এরকম ব্যাপার অবশ্য নতুন নয়। কলম্বাস যেদিন এই দ্বীপটিতে নোঙর ফেলেন সেদিন থেকে শাস্তির মুখ এ-দেশ দেখেনি বললেই হয়। কলম্বাস চল্লিশজন ইস্পাহানিকে উপনিবেশ গড়বার জন্য সেখানে রেখে যান। তাদের অমানুষিক অত্যাচারে ও-দেশের আদিবাসীরা নির্মূল হয়ে গিয়ে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে বিশ বছর বাদেই কাজ করবার লোকের অভাবে ওখানে কাফ্রি ক্রীতদাস আমদানি শুরু হয়ে যায়। ইতিহাসের পাতা উলটোবার পর দেখা যায়, সেই কাফ্রিবংশের লোকেরাই হাইতির প্রধান বাসিন্দা। তারা স্বাধীন হয়েছে দেড়শো বছরের ওপর, কিন্তু সে স্বাধীনতা আগাগোড়া মারামারি কাটাকাটির রক্তে ছোপানো।

আমি যখন হাইতি-তে গিয়ে পৌঁছলাম তখন দুটি দলের ক্ষমতার লড়াই-এ সমস্ত হাইতি ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ছে।

দুটি দলের একটি হল দুভালিয়েরের আর একটি বার্বটের। তখন দুজনের কেউই ডিক্টেটার হয়ে বসতে পারেনি। শুধু তার তোড়জোড় চলছে। তোড়জোড় মানে বাইরে তোক দেখানো সভা-সমিতি-মিছিল, রাজ্যময় পোস্টার আর খবরের কাগজের লেখা। আর তলে তলে বিপক্ষদলের বড় ছোট যাকে পারা যায় গোপনে, হয় হাইতি থেকে, নয় তো একেবারে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়া।

দভালিয়ের কি বার্বট, কারুর দলের সঙ্গেই আমার সদ্ভাব নেই। দুজনেই যে সমান পাষণ্ড তা আমি ভাল করেই জানি। আমার হাইতি-তে থাকা কোনও দলেরই মনঃপূত নয়। যে-দলই হোক আমায় একবার ধরতে পারলে যে ছেড়ে কথা কইবে না, এ-বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। বিশেষ করে দুভালিয়েরের দল তো আমায় পেলে কাঁচা চিবিয়ে খাবে। কারণ তাদের অনেক কীর্তি এর আগে ইউরোপ-আমেরিকার ওপর মহলে আমি ফাঁস করে দিয়েছি।

দুই দলের কারুর কাছেই রেহাই পাব না জেনেও লুকিয়ে যমরাজের আপন দেশে ঢুকেছিলাম শুধু একটি মানুষকে খুঁজে বার করতে। যেমন করে থােক তাকে খুঁজে না বার করলেই আমার নয়। নাম, ধাম সব কিছুই সে যে এখানে এসে বদলেছে তা

জানতাম। শুধু একটি চাবিকাঠি ছিল আমার ভরসা।

কিছুদিন নানা সাজে গোপনে ক্যাপ হাইতিয়েন থেকে পোর্ট-অ-প্রিন্স হয়ে লেস কেয়েস, এমনকী পশ্চিম প্রান্তের ডেমন মেরি পর্যন্ত চক্কর দিয়ে বেড়িয়ে কোনও হদিস না পেয়ে সেই চাবিকাঠিটাই কাজে লাগালাম।

পোর্ট-অ-প্রিন্সের এক ভু-ড়ুর আসরে ওঝা সেজে গিয়ে ঢুকলাম একরাত্রে।

কী…কী…কীসের আসর বললেন? দশরথ কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলে।

ভু-ড়ু-র, ঘনাদা চকিতে একবার আমাদের চারজনকে দেখে নিয়ে বুঝিয়ে বললেন, ভু-ড়ু হল ঝাড়ফুক তন্ত্র-মন্ত্রের একরকম ডাকিনী বিদ্যা। হাইতি-র লোকেরা নামে ক্রিশ্চান, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আফ্রিকার পূর্বপুরুষদের ধর্মকর্মসংস্কার তাদের মধ্যে এখনও প্রবল। প্রতি শনিবার রাত্রে হাইতির নানা জায়গায় গোপনে এই সব ভু-ড়ুর আসর বসে। সেখানে ভু-ড়ুর ওঝারা নানারকম অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ দেখায়।

গিয়ে দেখি ভু-ড়ু অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।

ঢোলক বাজছে আকাশ ফাটিয়ে আর সেই সঙ্গে ঘোড়ার নালে লোহার শিকের আওয়াজ।

দুটো কালো মুরগি জবাই করবার পর উদ্দাম নৃত্য শুরু হল। সেনাচ থামবার পর আরম্ভ হল ভু-ড়ু ওঝার বাহাদুরির খেল।

কার খেতে গতবার ভাল আখ ফলেনি। এবছরও অজন্মা যাবে কি না সে জানতে এসেছে ওঝার কাছে।

ওঝা দুটো লম্বা কাঠি মেঝের উপর রেখে খানিক খুব ভড়ং করে হিজিবিজি মন্তর আউড়ে বললে, দেবতারা তো কথা বলেন না। তাঁরা এই কাঠি দুটো দিয়েই তাঁদের মত জানাবেন। ডান ধারের কাঠিটা যদি নিজে থেকে নড়ে এগিয়ে যায় তা হলে শুভক্ষণ। আখ হবে বাঁশের মতো মোটা। আর বাঁ ধারের কাঠি যদি এগোয় তা হলে আখের খেত শুকিয়ে ঝাঁটার কাঠি হয়ে যাবে।

তারপর বিজ বিজ করে ওঝা আবার খানিক মন্তর পড়তেই সত্যি-সত্যি কাঠি দুটো নড়ে উঠল। প্রথমে ডানদিকেরটা, তারপর বাঁদিকের।

ওঝার তখন কী বড়াই! হেঁকে হেঁকে শোনালে সকলকে, দেবতা সাড়া দিয়েছেন। তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারেন! কাঠিগুলো জ্যান্ত হয়ে উঠেছে তার মন্তরে!! এবার যে কাঠি এগিয়ে যাবে তা-ই দিয়েই বোঝা যাবে, চাষির কপাল এবছরে ভাল না মন্দ!!

ওঝার কথা শেষ হতেই হো হো করে হেসে উঠলাম।

ভু-ড়ু-র আসরের সবাই প্রথমে একেবারে যেন জমে পাথর।

ওঝার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। ছোবল দিতে ফণা তোলা সাপের মতো হিসহিসিয়ে বলল, কে হাসল, কে? কে করলে দেবতার অপমান?

সকলের চোখ তখন আমার দিকে। এখুনি বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

চোখের একটা পাতাও না ফেলে সোজা এগিয়ে গিয়ে কাঠি দুটোর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, হেসেছি আমি—তোমার বিদ্যের দৌড় দেখে। কিন্তু দেবতার অপমান আমি করিনি, করেছ তুমি।

আমি করেছি দেবতার অপমান! ওঝা প্রায় আমার গলা টিপে ধরে আর কী?

হ্যাঁ, ভুল মন্তর পড়ে অপমান করেছ! কাঠিগুলোর ওপর হাত নেড়ে বললাম, দেবতার রাগে কাঠিগুলো তোমার ডাকে আর তাই নড়বে না। কই নড়াও দেখি, কতবড় তোমার মুরোদ।

পারলে শুধু চোখের আগুনেই ওঝা আমায় তখন ভস্ম করে দেয়। কিন্তু তখন আসরের সবাই ভু-ড়ু-র লড়াইয়ের লোভে মেতে উঠেছে। ওঝার দলেরই লোক হলেও তারা আমাকে জব্দ করবার জন্যই ওঝার বাহাদুরি দেখতে চায়। সবাই প্রায় এক সঙ্গে চেঁচাতে লাগল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কাঠি নাড়িয়ে দেখিয়ে দাও এই নচ্ছার বেয়াদপটাকে। কাঠি যদি নড়ে তা হলে ওর ওই ঝুটো কথার জিভটা আমরা টেনে ছিঁড়ে নেব।

আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ওঝাকে অগত্যা আবার বিজ বিজ করে মন্তর পড়তেই হল।

কিন্তু কাঠি আর নড়ে না।

ওঝা হাত পা ছুঁড়ে পাগলে মতো লাফ দিয়ে চিৎকার করে চুল ছিঁড়ে দাঁত খিচিয়ে হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলল, তবু কাঠি দুটো যেমন ছিল তেমনই রইল পড়ে।

প্রথমে একটু আধটু গুনগুন তারপর ভনভন তারপরে একেবারে খোলাখুলি দূর দূর!

হেসে বললাম, দেবতাকে অপমান করেছ কি না বুঝলে এখন? আরও প্রমাণ দেখাচ্ছি। যেকাঠি তোমার অত চেষ্টাতেও নড়েনি, আমার কথায় এখুনি তা নড়বে। আর, শুধু নড়বেই নয়, দেবতাকে কে অপমান করেছে দেখিয়েও দেবে?

বলতে বলতে কাঠি দুটো যেন লাফ দিয়ে মেঝে থেকে উঠে ওঝারই গায়ে গিয়ে পড়ল।

অ্যাঁ!

না, আওয়াজটা কাঠির খোঁচা-খাওয়া ওঝার নয়, ঘনাদার মুখ থেকেও বার হয়নি। নিজের অজান্তে সশব্দ বিস্ময়টা প্রকাশ করে ফেলেছেন সিড়িঙ্গে নফরবাবু। কোনওরকমে হাঁ করা মুখের দুটো ঠোঁট আবার মিলিয়ে তিনি বললেন, আপনি সত্যিসত্যি ভূতের ওঝাটাকে হারিয়ে দিলেন। তার মানে, আপনি ওই ভু-ড়ু না কী বললেন, তার ওস্তাদ! কোথায় শিখলেন?

হুডিনির কাছে! শিবুর বোধহয় মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল।

কী বলছেন, মশাই! পিপের মাসতুতো ভাই বিশে-ই আগে খেপে উঠল, হুডিনি মানে সেই জাদুকরের কথা বললেন তো! সে ভু-ড়ুর জানত কী? ঘনশ্যামবাবু তার কাছে শিখতে যাবেন কোন দুঃখে! ভু-ড়ু আর ভোজবাজি এক নয়, বুঝেছেন?

টিপ্পনি কাটতে যাচ্ছিলাম, হ্যাঁ, ভোজবাজি হলে তো কাঠিতে বাঁধা কালো সুতো দুটো হাত নাড়বার ছলে হাতিয়েই তাক লাগিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু জনমত যেরকম চড়া তাতে সুশীল সুবোধ হয়ে পিপের ভাই বিশের কথাই মেনে নিয়ে নীরব হতে হল এর পর।

ঘনাদা আমাদের দুরবস্থাটা যেন দেখতে চান না এই ভাবে চার মূর্তির দিকেই মুখ ফিরিয়ে রেখে আবার ধরলেন, কাঠি দুটো ওঝার গায়ে গিয়ে লাগতেই একেবারে হইচই পড়ে গেল।

হাত তুলে গণ্ডগোল থামিয়ে বললাম, শোনো, হাইতির ভাই সব। এ-সব পুঁচকে ওঝার সঙ্গে লড়ে সময় নষ্ট করতে আমি আসিনি। আমি এসেছি হাইতির ভু-ড়ুর চেয়ে আমার দেশের ভু-ড়ুর তেজ যে বেশি তাই চোখের সামনে প্রমাণ করতে। আর শনিবারে সেই ভু-ড়ুর লড়াই হোক। তোমাদের সর্দার ওঝা যদি কেউ থাকে, ডাকো। তার জারিজুরি যদি আমি না ভেঙে দিতে পারি তো আমার মাথা মুড়িয়ে গাধার পিঠে চড়িয়ে তোমরা আমায় নিজের দেশে পাঠিয়ে দিয়ো।

তা-ই পাঠাব! তবে তার আগে ছাল চামড়াটা ছাড়িয়ে নিয়ে!ওঝা দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, কিন্তু কোথায় তোর দেশ? কোথাকার ভুড়ু নিয়ে তুই লড়তে এসেছিস?

হেসে বললাম, দেশ আমার অনেক দূর। কিন্তু যেখানে দুনিয়ার সব চেয়ে বড় অজগর অ্যানাকোন্ডা নদী-জলার তলায় কুণ্ডলি পাকিয়ে এল ডোরাডোর যখের ধন পাহারা দেয়, সেই গায়নার ভু-ড়ু আমি শিখে এসেছি। আর শনিবারে সেই ভু-ড়ুর দাপটই দেখাব। মর্জি হলে এল ডোরাডোর সোনার পালক আমদানি করেও তোমাদের চক্ষু সার্থক করতে পারি।

শেষ কথাগুলো শুনতে নেহাত অবান্তর। কিন্তু তাতেই আসল কাজটা হবে আঁচ করে ভুল করিনি।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *