Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

খাওয়াদাওয়া সেরে

খাওয়াদাওয়া সেরে উঠতে বেশ রাত হয়ে গেল। আর খাওয়াটাই তো এক এলাহি ব্যাপার। পোলাও, মাছের কালিয়া, মাংসের কোর্মা, ছানার ডালনা, মুড়িঘন্ট, মাছের মুড়ো দিয়ে মুগডাল, চাটনি, রাবড়ি, রসগোল্লা, সরভাজা…উফ। সকলে খেতে খেতে একেবারে জেরবার হয়ে গেল। তবে গৌর মাছমাংস, পেঁয়াজ রসুন খায় না। তার মা তাকে ছেলেবেলা থেকেই ওসব খাওয়ায়নি! তাদের বংশটাই নিরামিষ বংশ। বহুঁকাল ধরে প্রথাটা চলে আসছে। কিন্তু নেতাইগোপাল তার বউয়ের পাল্লায় পড়ে ওসব আর মানে না। গৌর মানে। মা বারণ করে গেছে বলেই মানে। সে ছানার ডালনা দিয়ে পোলাও খেল, আর প্রায় এক হাঁড়ি রাবড়ি।

খেয়ে উঠে সবাই মিলে গলায় মেডেল আর মালা ঝুলিয়ে, ট্যাকে প্রাইজের টাকা গুঁজে রওনা হল। মল্লারপুরের লোকেরা যারা খেলা দেখতে এসেছিল, তারা সবাই আগেই ফিরে গেছে। এখন তারা শুধু আট-দশজন।

রাস্তা অন্ধকার বলে দুটো মশাল জ্বালিয়ে নিয়েছে তারা। গল্প করতে করতে হাঁটছে। আজকের খেলার কথাই হচ্ছে বেশি। সবাই বেশ নিশ্চিন্ত আর খুশি।

কিন্তু গৌর নিশ্চিন্তও নয়, খুশিও নয়। ন’পাড়ার দলে মাউ আর খাউ ছাড়াও আর একটা লোক ছিল, যে অনেকটা ওদের মতোই দেখতে। লোকটা কে তা বুঝতে পারছে না সে। অথচ মনটা টিকটিক করছে। লোকটা তাকে নির্ঘাত খুন করে ফেলতে চেয়েছিল। তার ওপর রাজা রাঘব। রাঘব যে কেন ওখানে জুটল তা-ই বা কে বলবে?

গৌর স্পষ্টই টের পাচ্ছে, এই খেলাটা এক মস্ত ষড়যন্ত্র। সম্ভবত এ-খেলার উদ্দেশ্য ছিল তাকে খুন করা। খেলার মধ্যে বেকায়দায় লেগে সে মরে গেলে সেটা ইচ্ছাকৃত খুন বলে কেউ প্রমাণ করতেও পারত না এবং খুনি ধরা পড়ত না। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। সুতরাং ওরা আবার চেষ্টা করবে। কখন, কোথা দিয়ে যে আক্রমণটা আসবে, তার তো ঠিক নেই। কিন্তু তার মতো এক অতি সাধারণ ছেলেকে খুন করে কী লাভ, সেটাই গৌর ভাবছে।

ন’পাড়ার প্রকাণ্ড মাঠটা পেরিয়ে তারা ফলসাবনে ঢুকল। চারদিকটা ছমছম করছে। একঝাঁক শেয়াল পালাল পাশ দিয়ে। ঘুমন্ত পাখিরা কেউ-কেউ একটু ডানা ঝাঁপটে ডেকে উঠল ভয় পেয়ে। গৌরের বন্ধুরা খুব নিশ্চিন্তে হাঁটছে। সকলেরই ভারী ফুর্তি। সোনার মেডেল, টাকা পাওয়া, ভরপেট ভালমন্দ খাওয়া- এ-সব তো সচরাচর জোটে না কপালে!

ফলসাবন পার হয়েই আর একটা বড় মাঠ। তার পরেই মল্লারপুরের সীমানা। বন্ধুরা এখান থেকেই ভাগ-ভাগ হয়ে যে যার বাড়ি যাবে। গৌরের বাড়ির দিকে যাওয়ার কেউ নেই। রাস্তাটাও নির্জন। এত রাতে গাঁ-গঞ্জে কেউ জেগে থাকে না।

তেজেন বলল, “গৌর, তুই একা যাবি, একটা মশাল নিয়ে নে।”

মশাল হাতে গৌর একা-একাই চলল, ভয়ডর তার বিশেষ লাগছিল না, কিন্তু কেমন যেন মনের মধ্যে একটা সুড়সুড়ি টের পাচ্ছিল সে। রাঘবরাজা এত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। কাবাডি খেলায় এত লোকের সামনে ওরকম হেনস্থা আর লাঞ্ছনা নীরবে হজম করে যাওয়ার পাত্রও নয় মাউ আর খাউ। একটা কিছু করবে।

সামনেই মহাবীর থানের বটতলার ঝুপসি অন্ধকার। থোকা থোকা জোনাকি জ্বলছে। মশালের আলো এখন নিভু নিভু। সেটা উঁচু করে তুলে ধরে গৌর বটতলাটা দেখার চেষ্টা করল। মনটায় বড় সুড়সুড়ি লাগছে। বাঁ দিকে বুড়ো শিবের ভাঙা মন্দিরে একটা তক্ষক ডেকে ওঠে। একটা কেলে খোঁড়া কুকুর এই বটতলায় রোজ শুয়ে থাকে। আজ সেটার কোনও সাড়াশব্দ নেই। পা বাড়িয়েও বটতলাটা পেরোতে একটু ইতস্তত করতে লাগল সে। মশালের নিভু নিভু আলোয় কাউকে দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু জায়গাটা যে বেশ ছমছমে সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।

ঘুরপথে যাওয়ারও উপায় নেই। একধারে নিবিড় কাঁটাবন, অন্য ধারে বিপজ্জনক জলার ধারে চোরাবালি, পথ এই একটাই। গৌর করে কী?

একটু ভেবেচিন্তে গৌর দ্বিধার ভাবটা ঝেড়ে ফেলল। তারপর চারদিকে সতর্ক চোখ ফেলে ধীর পায়ে এগোল।

বটের ঝুরি নেমে চারদিকটা যেন জঙ্গলের মতো হয়ে আছে। অনেকটা জায়গা নিয়ে বটের বিস্তার। গৌর যখন মাঝামাঝি এসেছে তখন পিছনে হঠাৎ অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনতে পেল সে। যেন কে শুকনো পাতা মাড়িয়ে দিল। বিদ্যুদবেগে ঘুরে দাঁড়াল গৌর।

কিন্তু কিছু করতে পারল না। একটা লাঠি এসে মশালটা ছিটকে ফেলে দিল মাটিতে। আর একটা লাঠি এসে পড়ল বাঁ দিকের কাঁধে।

গৌর লাঠি খেয়ে চোখে সরষেফুল দেখে বসে পড়ল মাটিতে। মাথাটা ঘুরছে। মাটি দুলছে। সে অজ্ঞান হয়ে যাবে নাকি? ন’পাড়ার কালীবাড়ির মাঠে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে যে গৌর সাত-সাতটা দানবকে একাই মোর করেছে, সে মাত্র দু’ঘা লাঠির চোটে কুপোকাত হয়ে যাবে? এখনও সোনার মেডেলটা তার গলায় দুলছে যে! টাকে রয়েছে প্রাইজের কড়কড়ে দেড়শোটা টাকা। মল্লারপুরের লোকেরা তাকে বীর বলে একটু আগেই কাঁধে নিয়ে কত নাচানাচি করেছে যে! এত সহজে হার মানলে তার চলবে কেন?

এই সব ভাবতে কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময় নিয়েছে সে। এর মধ্যেই উপর্যুপরি কয়েকটা লাঠি এসে পড়ল তার ওপর। ভাগ্যি ভাল যে, মশালটা পড়েই নিভে গেছে। অন্ধকারে তাই লাঠিগুলোর সবকটা তার শরীরে পড়ল না। একটা মাজায় লাগল বটে, কিন্তু তো জোরে নয়। বোধহয় বটের কোনও ঝুরিতে ঠেকে গিয়েছিল লাঠিটা। আর দুটো লাঠি পরস্পরের সঙ্গে লেগে কাটাকুটি হয়ে গেল।

কে একজন চাপা স্বরে বলল, “শেষ করে দে! শেষ করে দে! তারপর কবচটা ছিঁড়ে নে কোমর থেকে। নইলে রাজার কাছে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না।”

গৌর মাথা বাঁচানোর জন্য একটা হাত তুলে রেখেছিল। একটা লাঠি এসে পড়ল ঠিক তার মুঠোয়। প্রচণ্ড লাগল হাতে। মনে হল চামড়া ছড়ে গেল লাঠির চোটে। কিন্তু গৌর তবু চেপে ধরল লাঠিটা। প্রথমে একহাতে, তারপর দু’হাতে, এক হ্যাঁচকা টান মেরে অদৃশ্য আততায়ীর হাত থেকে লাঠিটা ছিনিয়ে নিয়েই খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে সরে গিয়ে লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল গৌর।

তারপরে অন্ধকারে কী যে হল তা গৌর বলতে পারবে না। তার আনাড়ি হাতের লাঠি অন্ধকারে এলোপাথাড়ি চলতে লাগল। ঠকাঠক-ঠকাঠক শব্দ উঠতে লাগল মুহুর্মুহু। অদৃশ্য আততায়ীদের শরীরেও লাগল বোধহয়। কে একজন চেঁচাল–”উঃ!” আর একজন বলল, “বাবা রে!”

মিনিট কয়েক লড়াই চলার পর গৌর টের পেল, ওরা রণে ভঙ্গ দিচ্ছে। একজোড়া পা বাজারপানে দৌড় মারল। একজন বুড়ো শিবের মন্দিরের দিকে ছুটল। একজন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চার নম্বরটা সত করে কোথায় লুকিয়ে পড়ল লাঠি ফেলে।

হতভম্বের মতো লাঠি হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল গৌর। চার-চারটে লোক যে তার জন্য ওঁত পেতে ছিল, এটা যেন তার বিশ্বাস হল না। চারজনেই যে রণে ভঙ্গ দিয়েছে, এটাও হজম করতে একটু সময় লাগল তার। কোমরে হাত দিয়ে সুতলিতে বাঁধা কবচটা একবার ছুঁয়ে দেখল, গলায় মেডেল বা ট্যাকে টাকা, কিছুই খোয়া যায়নি। তারপর সে জোর কদমে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress