Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

একটা ছেলে এসে গৌরকে খবর দিল

পরদিন সকালেই একটা ছেলে এসে গৌরকে খবর দিল, বিকেলে ন’পাড়ার সঙ্গে দারুণ হাডুডু ম্যাচ। এরকম কোনও ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু ন’পাড়ার কোন বড়লোক নাকি এই হাডুডু ম্যাচের জন্য টাকা দিচ্ছেন। যে-দল জিতবে, তার প্রত্যেক খেলোয়াড় একটা করে সোনার মেডেল আর নগদ পঞ্চাশ টাকা পাবে। তা ছাড়া খেলার শেষে বিরাট ভোজের ব্যবস্থা হয়েছে।

খবরটা পেয়ে গৌরের ভারী আনন্দ হল। সোনার মেডেল, টাকা, এ-সব তার কাছে স্বপ্নের মতো। হাডুডু সে ভালই খেলে। তার দম অফুরন্ত, গায়ে জোরও সাংঘাতিক। চটপটেও সে বড় কম নয়। গাঁয়ের দলের সে-ই সবচেয়ে ভাল খেলোয়াড়।

সারাদিনটা মেডেল আর টাকার কথা চিন্তা করে মনটা বেশ

উড়ুউড়ু হয়ে যাচ্ছিল তার। আবার মাঝে মাঝে কেমন যেন একটা আবছা ভয়ও হচ্ছিল। ন’পাড়া তাদের পাশের গ্রাম। বেশি দুর নয়। তবে ন’পাড়ার সঙ্গে তারা কখনও খেলেনি। গ্রামটার খুব বদনাম আছে ডাকাতের গাঁ বলে। ন’পাড়ার নামে লোকে ভয়ে কাঁপে। লটকা, কচি বেত বা কামরাঙার খোঁজে বন্ধুদের সঙ্গে কয়েকবার ন’পাড়া গেছে গৌর। গাছপালায় ঘেরা অন্ধকার গা-ছমছমে পরিবেশ। একটা হাজার বছরের পুরনো কালীবাড়ি আছে। সেখানে এখনও রোজ পুজো হয়। ঠ্যাঙাড়ে ডাকাতরা নাকি এই কালীকেই পুজো দিয়ে ডাকাতি করতে বেরোয়। ন’পাড়ার মানুষগুলোও কিছু অদ্ভুত। প্রত্যেকেরই বেশ মজবুত চেহারা আর প্রত্যেকেই ভীষণ গোমড়ামুখো। দেখলেই ভয় করে। ন’পাড়ার ছেলেরা যে হাডুডু খেলে, এটা গৌর জানতই না, তাই কেমন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল তার।

বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরে গোরুর জাবনা দিয়ে, ঘরদোরের কাজ চটপট সেরে গৌর গিয়ে দক্ষিণের মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে জুটে ন’পাড়া রওনা হল।

তেজেন হল দলের ক্যাপটেন। গৌর তাকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে তেজেন,ন’পাড়ার আবার কবে থেকে খেলাধুলোর শখ হল?”

তেজেন বলল, “কী জানি ভাই, ন’পাড়ার ছেলেরা যে খেলে তা-ই তো জানতাম না। তবে শুনেছি, এক বড়লোক জুটেছে সেখানে। যে নাকি গাঁয়ের চেহারা বদলে দেবে, জলের মতো টাকা ঢালছে।”

“সোনার মেডেল দেবে সত্যি?”

“সোনার মেডেল, টাকা, তার ওপর পোলাওকালিয়া দিয়ে

ভোজ।”

“এর মধ্যে কোনও গোলমাল নেই তো?”

“গোলমাল আর কী থাকবে? বিশে নিজে আজ ন’পাড়ায় গিয়ে দেখে এসেছে সেখানে সাজো-সাজো রব, রঙিন কাগজ দিয়ে সারা গাঁ সাজানো হয়েছে। কালীবাড়ির সামনের চাতালে বিশাল উনুন তৈরি হচ্ছে, বত্রিশটা পাঁঠাবলি হয়ে গেছে, হাঁড়ি-হাঁড়ি দই-মিষ্টি আসছে ঘোষপাড়া থেকে।”

দলের সকলেরই ভারী ফুর্তি, জোর কদমে হাসাহাসি আর গল্পসল্প করতে করতে হাঁটছে সবাই।

গৌর হঠাৎ তেজেনকে জিজ্ঞেস করল, “আর হেরে গেলে কী দেবে?”

তেজেন বলল, “সেকথাও হয়েছে, হারলে পাঁচ টাকা করে পাবে সবাই। খাওয়া তো থাকছেই। তবে ভাবছিস কেন, আশপাশের দশখানা গাঁয়ে আমরাই সেরা। ন’পাড়ার ছেলেদের গায়ে যত জোরই থাকুক, আমাদের মতো কায়দা জানে না। হেরে ভূত হয়ে যাবে।”

কিন্তু গৌর তেজেনের মতো নিশ্চিন্ত হল না। তার মনে কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। এই যে হুট করে খেলার আয়োজন, এত প্রাইজ আর মেডেলের লোভানি, এটাকে খুব স্বাভাবিক ঘটনা বলে ভাবতে পারছে না সে।

ন’পাড়ায় ঢুকে তার অস্বস্তিটা বরং বাড়ল। বাস্তবিকই এ-পাড়াকে আজ চেনা যায় না। গাছে গাছে রঙিন ফেস্টুন, রঙিন কাগজের শিকলি, নিশান, কালীবাড়িতে ব্যান্ড পার্টিও এসেছে, দারুণ বাজনা বাজছে সেখানে।

কালীবাড়ির পাশেই খেলার মাঠে কোর্ট কাটা হয়েছে। লোকে লোকারণ্য, গৌররা সেখানে যেতেই একদল বাচ্চা মেয়ে এসে সবাইকে মালা পরিয়ে দিল, কপালে দিল চন্দনের ফোঁটা, এই সব দেখে সকলেই কেমন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

কোর্টের পাশেই সুন্দর করে সাজানো টেবিলে ছোট ছোট নীল ভেলভেটের বাক্সে সোনার মেডেলগুলো ঝকঝক করছে। টেবিলের ওধারে চারটে চেয়ারে চারজন বেশ সম্রান্ত চেহারার মানুষ বসে আছেন।

গৌররা ঢুকতেই সকলে হাততালি দিয়ে হর্ষধ্বনি করে উঠল। তেজেন গৌরের কানে কানে বলল, “আজ জিততেই হবে গৌর।”

“চেষ্টা করব।”

“জিতে না ফিরলে প্রেস্টিজ থাকবে না, মনে রাখিস।”

খেলা শুরু হতে একটু দেরি আছে; দু’পক্ষের টিম এসে মাঠের ধারে জড়ো হয়েছে সবে। একটা দৃশ্য দেখে সকলে অবাক। ন’পাড়ার খেলোয়াড়দের মধ্যে মাউ আর খাউ রয়েছে।

তেজেন ন’পাড়ার ক্যাপটেনের কাছে গিয়ে আপত্তি জানাল, “ওরা তো আমাদের গাঁয়ে থাকে, ওরা তোমাদের হয়ে খেলছে কেন?”

ন’পাড়ার ক্যাপটেন বলল, “মোটেই তোমাদের গাঁয়ের লোক নয় ওরা, কুটুমবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে এই মাত্র। তোমরা ওদের টিমেও নাওনি, তাই আমরা হায়ার করেছি।”

তেজেন আর যুক্তি খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসে গৌরকে চুপিচুপি বলল, “তোর কুটুমরা ও-দলে খেলছে, ব্যাপারটা একটু গোলমেলে।”

“তা-ই দেখছি।”

গৌরের বুকের ভিতরটা একটু ঢিপঢিপ করতে লাগল। মাউ আর খাউ নপাড়ার হয়ে খেলছে খেলুক, সেটা বড় কথা নয়। কিন্তু রাঘবরাজা ওদের যে হুকুমটা দিয়েছে, সেটা মনে করেই গৌরের হাত-পা হিম হয়ে আসছিল। তার মনে হচ্ছিল, খেলায় না নেমে ফিরে গেলেই বোধহয় ভাল হত। মাউ আর খাউয়ের মতলব হয়তো ভাল নয়।

কিন্তু পিছিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। মালা পরে চন্দনের ফোঁটা নিয়ে পিছিয়ে গেলে সবাই দুয়ো দেবে। তাদের গাঁ থেকেও অনেকে খেলা দেখতে এসেছে, তারাই বা মনে করবে কী? ভিড়ের মধ্যে গৌর কবরেজমশাই, ফকিরসাহেব, গোবিন্দদা, সবাইকেই দেখতে পেল।

শরীরের আড় ভাঙার জন্য কোর্টে নামার আগে একটু ডনবৈঠক করে গা ঘামিয়ে নিচ্ছিল সবাই। এমন সময় কবরেজমশাই এগিয়ে এসে একটা ছোট্ট শিশি গৌরের হাতে দিয়ে বললেন, “চটপট তেলটুকু মেখে নে। হাতে-পায়ে আর ঘাড়ে ভাল করে মাখিস।”

“এ মেখে কী হবে কবরেজমশাই?”

“হবে আমার গুষ্টির পিণ্ডি, যা বলছি, চোখ বুজে করে যা। আজ তোর বড় ফাঁড়া।”

গৌর আর দ্বিরুক্তি না করে তেলটা মেখে ফেলল। ভারী অদ্ভুত তেল। জলের মতো পাতলা, মাখতেই শরীরে মিশে গেল। কোনও তেলতেলে ভাব অবধি থাকল না।

খেলা শুরু হল। প্রথম দান গৌরদের। তেজেন দম নিয়ে ‘ডু…উ..উ..উ…’ডাক ছেড়ে ঢুকে গেল নপাড়ার এলাকায়। দু’হাত পাখির ডানার মতো ছড়ানো, হালকা পায়ে উড়ে উড়ে কোর্টের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত যেতে যেতে হাত দিয়ে তীব্র কয়েকটা ছোবল ছুড়ল সে, চকিতে পা বাড়িয়ে দিল এদিক-সেদিক। না, ন’পাড়ার কেউ ‘আউট’ হল না।

তেজেন নিজের কোর্টে ফিরে আসতে না আসতেইন’পাড়ার এক বিশাল চেহারার কালো জোয়ান পাহাড়ের মতো ধেয়ে এল। বিকট ‘ডু…উ..উ..’শব্দ করতে করতে কোর্টে ঢুকে পড়তেই গৌর বুঝে গেল, লোকটা আনাড়ি। চেহারা বিশাল হলেই তো হয় না। এ-খেলায় চটপটে হওয়া এবং কূটকৌশল জানা একান্ত দরকার।

এ-লোকটার তা নেই, এক্ষুনি ধরা পড়ে যাবে। গৌর প্রস্তুত হল।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, লোকটা কাউকে আউট করার জন্য হাত-পা খেলানোর চেষ্টাই করল না। বিপক্ষের কোর্টে ঢুকে সে একটু থমকে দাঁড়িয়ে হঠাৎ প্রবল আক্রোশে আর প্রতিহিংসায় সোজা এগিয়ে এল গৌরের দিকে।

গৌর নোকটার কাণ্ড দেখে অবাক। তেজেন এবং তার দলবল চারদিক থেকে ঘিরে ধরে জাপটেও ফেলল লোকটাকে। কিন্তু দানবের মতো লোকটা দু তিন ঝটকায় সবাইকে ঝেড়ে ফেলে জোড়পায়ে একটা তুর্কি লাফ মেরে লাফিয়ে পড়ল গৌরের ওপর।

ওই বিশাল দানবীয় চেহারার জোড়া লাথি বুকে লাগলে পাজরের হাড় মড়মড় করে ভেঙে যাওয়ার কথা। কিন্তু গৌর নিজে ভাল খেলোয়াড়, গায়ের জোরে দানবটার সঙ্গে পাল্লা টানতে পারলেও সে দারুণ চটপটে, দ্রুতগতি। পা দুটো যখন তার বুকের ওপর নেমে আসছে, তখন সে খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। এ-খেলায় ছোঁয়াছুঁয়ি আছে বটে, কিন্তু ধরা পড়ার ভয় না-রেখে কেউ যে এ রকম বেহেড হয়ে কারও ওপর লাফিয়ে পড়তে পারে, এ-ধারণা তার ছিল না। তাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে সে চট করে বাঁ দিকে শরীরটা বাঁকিয়ে পাঁকাল মাছের মতো সরে গেল। দানবটা তাকে পেরিয়ে গদাম করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। গৌরই গিয়ে ধরে তুলল তাকে। অবাক হয়ে বলল, “এ কেমনধারা খেলা?”

লোকটা কুটি করে বলল, “এখনই কী? খেলা দেখবে।”

একটা লোক আউট হওয়ায় ন’পাড়ায় কোনও বৈলক্ষণ্য দেখা গেল না। পরের দান গৌরের, গৌর চোখ বুজে ঠাকুর স্মরণ করে বুকভরে দম নিল। তারপর ভিমরুলের মতো ডাক ছেড়ে হালকা পায়ে গিয়ে ঢুকল ন’পাড়ার কোর্টে। তেজেনের চেয়ে সে বহুগুণ দ্রুতগতি, অনেক বেশি তার গায়ের জোর। সে অনেক উঁচুতে লাফাতে পারে, শরীরে নানারকম অদ্ভুত মোচড় দিতে পারে। এ-খেলায় সেইটিই দরকার। গৌর ঢুকেই চটপট ডাইনে বাঁয়ে একটু বিদ্যুতরঙ্গের মতো নিজেকে বইয়ে দিল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, ন’পাড়ার খেলোয়াড়গুলো আসলে খেলোয়াড় নয়, খুনে, কেন মনে হল কে জানে!

ডান থেকে বাঁয়ে, বাঁ থেকে আবার ডান দিকে ঘুরে যাওয়ার মুখেই এক পায়ের ওপর শরীরটাকে রেখে আর-এক পা চকিতে বাড়িয়ে লাইনে দাঁড়ানো একজন মুশকো চেহারার লোককে ছুঁয়ে দিল। আউট। গৌর চোখের পলকে বাতাসে শরীর ভাসিয়ে একটা লাফ মারল নিজের কোর্টের দিকে।

কিন্তু মাটিতে পড়তে পারল না গৌর, মুশকো লোকটা মোর হয়ে তখন মরিয়া। সেও এক লাফে এগিয়ে এসে গৌরের কোমরটা দু’হাতে জাপটে ধরে পেড়ে ফেলল মাটিতে। কিন্তু গৌর পাকা খেলোয়াড়। এই হুটোপাটিতেও দম হারায়নি। ডাক ছাড়তে ছাড়তেই সে লাইনের দিকে খানিকটা গড়িয়ে গেল লোকটাকে জাপটে ধরেই।

কিন্তু ন’পাড়ার খেলুড়েরা তখন কটা মস্ত মস্ত পাথরের মতো গদাম গদাম করে এসে তার ওপর পড়ছে। এ-খেলায় হুটোপাটি হয়ই। কিন্তু মারদাঙ্গার তো নিয়ম নেই। কিন্তু গৌর বুঝতে পারছিল, তাকে আউট করার ছল করে কে যেন লোহার হাতে তার গলার নলি টিপে ধরেছে। আর-একজন ঘুসি চালাচ্ছে কানের পিছনে। কে যেন হাঁটু দিয়ে তার বুকের পাঁজর ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কনুই দিয়ে কে যেন মারল তার পেটে। একটা লাথি এসে জমল তার মুখে।

অন্য কেউ হলে এতক্ষণে অজ্ঞান হয়ে যেত। কিন্তু গৌর অনেক

কষ্ট করে বড় হয়েছে। ব্যথাবেদনা তাকে কাবু করতে পারে না। শরীরটাও তার যথেষ্ট সহনশীল। তাই অতগুলো লোকের জাপটাজাপটি এবং আক্রমণের মধ্যেও সে দম ধরে রেখে ইঞ্চি-ইঞ্চি করে এগোতে লাগল লাইনের দিকে। যেন পাহাড় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে তার, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু সে জানে, ন’পাড়ার এই লোকগুলো খেলোয়াড়ই নয়, এরা চায় তাকে খুন করতে। খেলায় হারজিত নিয়ে এরা মাথা ঘামায় না।

চারদিকে খুব চেঁচামেচি হচ্ছিল। গৌর লক্ষ করল, কে যেন তাকে। আটকাতে না পেরে তার চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। হাতের অনামিকায় পলার আংটিটা দেখে চিনল গৌর। মাউ। মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নিল গৌর। বুক ফেটে যাচ্ছে, তবু দম না ছেড়ে সে একবার শেষ চেষ্টায় শরীরে একটা ঢেউ দিল। সামান্য আলগা হল কি পিঠের ওপর পাহাড়টা? তবে গৌর দেখল, খুব চেষ্টা করলে তার আঙুল লাইনটা ছুঁয়ে ফেলতে পারে।

‘ডু…উ…উ..’ করে বুকের তলানি বাতাসটুকু উজাড় করে দিয়ে গৌর মাটির ওপর নিজেকে ঘষে দিয়ে এগোল। এগোতেই হবে। ডান হাতখানা আকুলভাবে বাড়িয়ে দিল লাইনের দিকে।

লাইনটা ছুঁল কি না বুঝতে পারল না গৌর, তবে একটা বিশাল চিৎকার উঠল চারদিকে। গৌরের চোখে সেই সময়ে নেমে এল নিবিড় অন্ধকার। সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

যখন জ্ঞান ফিরে এল, তখন তার সর্বাঙ্গ জলে ভেজা। কোর্টের ধারে তাকে শুইয়ে ক্ষতস্থানে ওষুধ মাখাচ্ছেন কবরেজমশাই। ক্ষত হয়েছেও বড় কম নয়। বুক আর হাতের অনেকটা ছাল উঠে গেছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে, নাক ভেঙে গেছে, কানের পিছনে মাথাটা ফুলে ঢোল, কপালের অনেকটা ছড়ে গেছে। চারদিকে ভিড়ে ভিড়াক্কার।

গৌর প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, “আমার দানটার কী হল?”

কে একজন চেঁচিয়ে বলল, “ওঃ, যা দেখালে খেলা একখানা বাপ! এক দানে ন’পাড়ার গোটা দল আউট!”

শুনেই গৌরের রক্ত গরম হয়ে গেল। শরীরের ব্যথাবেদনা যেন উড়ে গেল ফুকারে। সে একলাফে উঠে পড়ে বলল, “আমি পরের গেম খেলব।”

ন’পাড়া কী চায় তা গৌর বুঝে গেছে। সে বুঝে গেছে, রাজা রাঘবের আদেশে ন’পাড়ার সাত খুনি সব খেলুড়েকে ছেড়ে শুধু তার ওপরেই চড়াও হবে। এই খেলার লক্ষ্যই হল গৌর। কিন্তু গৌরের আর ভয় করছিল না।

তেজেন তার অবস্থা দেখে চিন্তিত মুখে বলল, “এ কি খেলা নাকি? এ তো খুনখারাপি! তোকে আর খেলতে হবে না, বসে যা।

একটা গেম তো একাই জিতিয়ে দিয়েছিস, এখন বসে জিরো।”

গৌর মাথা নেড়ে বলল, “না, বসব না। আমার কিছু হয়নি।”

“পারবি তো?”

“খুব পারব।”

পরের গেম শুরু হল। ন’পাড়ার দলটা একটু মনমরা বটে, কিন্তু ওদের চোখ ধকধক করে জ্বলছে। আর সকলেরই দৃষ্টি প্রতিপক্ষের একজনের ওপর। সে হল গৌর। গৌর যে এই বাঁশডলা খাওয়ার পর এখনও দাঁড়িয়ে আছে এবং আবার খেলার জন্য তৈরি হচ্ছে, এটা যেন তাদের বিশ্বাসও হচ্ছিল না, তারা সইতেও পারছিল না। সবচেয়ে বেশি ছটফট করছিল মাউ আর খাউ। পারলে তারা যেন ছিঁড়ে খায় গৌরকে।

খেলা শুরু হল। প্রথম ন’পাড়ার দান। যে দানবটা প্রথম দান দিতে এসে গৌরকে জোড়পায়ে লাথি মারার চেষ্টা করেছিল এবারও সে-ই আসছে। ডু…উ…উ..’ বলে ডাক ছেড়ে সে লাফিয়ে এল গৌরদের কোর্টে। তবে এবার আর গৌরকে লাথি মারার মতো ৬৪

বোকামি করল না। খেলার ভান করে এদিক-ওদিক ঘুরতে লাগল। গৌর স্থির দৃষ্টিতে লোকটাকে দেখছিল। মাউ আর খাউয়ের সঙ্গে লোকটার চেহারার বেশ মিল আছে। তবে এ আরও বেশি লম্বাচওড়া এবং আরও বেশি নিষ্ঠুর প্রকৃতির।

লোকটা কাউকে ‘মোর’ করতে না পেরে ফিরে যাচ্ছিল। হঠাৎ গৌর লাইন ছেড়ে এগিয়ে এল। বিদ্যুদগতিতে গিয়ে লোকটা লাইন পার হওয়ার আগেই দু’হাতে লোটার কোমর ধরে ফেলল। গৌরের দলের সকলেই হায় হায়’ করে উঠল। এ অবস্থায় লোকটাকে ধরে রাখা অসম্ভব। গৌর আউট হবেই, কারণ লোকটা গৌরের চেয়ে চেহারায় দেড়গুণ এবং লাইনে প্রায় পৌঁছেও গেছে।

কিন্তু গৌর অবিচল। কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সে আচমকা একটা হ্যাঁচকা টানে লোকটাকে প্রায় লাইনের ওপর থেকে টেনে আনল। গৌরের এই দুঃসাহসে লোকটা অবাক। তবে মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে সেও এক ঝটকা মারল। সেই ঝটকায় হাতি অবধি ছিটকে যায়।

কিন্তু গৌরের আজ হল কী কে জানে। সে সেই বিকট ঝটকায় একচুলও টলল না। একটা কোঁত’ শব্দ করে সে লোকটাকে দুহাতে শূন্যে তুলে নিল, তারপর কয়েকটা পাক দিয়ে নিজের কোর্টে মারল এক আছাড়। সেই আছাড়ে মাটি কেঁপে উঠল। চারদিকে এক সূচীভেদ্য নিস্তব্ধতা। কেউ যেন ঘটনাটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে । তারপরেই বিপুল উল্লাসে দর্শকরা ফেটে পড়ল।

তেজেন এসে গৌরের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “তুই আমাদের সেরা খেলোয়াড় বটে, কিন্তু এরকম খেলা আগে কখনওই তো দেখিনি তোর! হল কী রে গৌর?”

গৌর গম্ভীরভাবে বলল, “আমিও তা জানি না। তবে এবার আমি দান দেব।”

তেজেন একটু দোনোমনো করে বলল, “দে তা হলে। আজ তোর কপালটা ভালই যাচ্ছে।”

কপাল নয়, অন্য কিছু। কিন্তু সেটা যে কী, তা গৌর বুঝতে পারছে না। হঠাৎ যেন শরীরে একশো হাতির জোর জোয়ারের মতো নেমে এসেছে। ঘোড়ার মতো টগবগ করছে হাত-পা। রক্ত গরম। শরীর পালকের মতো হালকা।

সে যখন হানা দিতে ন’পাড়ার কোর্টে ঢুকল তখন তার শরীরে ঘূর্ণিঝড়ের মতো গতি। শব্দ করে দম ছাড়তে ছাড়তে সে একেবারে বিপক্ষ দলের মধ্যে ঢুকে গেল। ন’পাড়ার মুশকো-মুশকো খেলোয়াড়রা তার কাণ্ড দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সকলে একেবারে শেষপ্রান্তে সরে গিয়ে অপেক্ষা করছে।

ডান কোণে দাঁড়িয়ে ছিল মাউ। চোখে উপোসি বাঘের মতো তীব্র দৃষ্টি। হঠাৎ যেন ভোজবাজির মতো মাউয়ের হাতে একটা গজাল এসে গেল কোথা থেকে। এমন কৌশলে সেটা হাতের পাতায় ঢেকে রেখেছে মাউ যে, কারও চোখে পড়ার কথা নয়। কিন্তু গৌর ঠিকই দেখতে পেল।

বাঁ দিকে একটু ঢেউ খেয়ে গৌর সোজা মাউয়ের দিকেই এগিয়ে গেল। পা বাড়িয়ে একটা ভড়কি দিয়েই সরে এল। ফের ডান দিকে ঝুল খেল। সবাই ভাবছে এবার সে ডান দিকে সরে যাবে। কিন্তু গৌর আবার বাঁ দিকে বিদ্যুদগতিতে এগিয়ে গিয়ে মাউকে বাঁ হাতে মোর করে দিল। কিন্তু মোর হয়েই মাউ লাফিয়ে পড়ল তার ওপর। হাতে লুকোনো গজাল।

গৌর শুধু হাতটা নজরে রেখেছিল। গজালসুষ্ঠু হাতটা সোজা এগিয়ে এসেছিল তার পেটের দিকে। গৌর শরীরটা সরিয়ে নিয়ে হাতটা ধরে ফেলল, ঠিক যেমনভাবে নিপুণ সাপুড়ে বুনো সাপ ধরে। সঙ্গে সঙ্গে একটা মোচড়।

পাটকাঠির মতো মাউয়ের হাতটা যে ভেঙে যাবে, তা গৌর স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। মাউয়ের চেহারা বিশাল, গায়ে দানবের মতো জোর। এই সেদিনও গৌরকে মনের সুখে মেরেছে। গজালটা পড়ে গেল হাত থেকে। বাঁ হাতে ডান হাতটা চেপে ধরে বাপ রে’ বলে চেঁচিয়ে বসে পড়ল মাউ। চারদিকে একটা হইহই উঠল। “গজাল! গজাল! …এ তো খুনখারাপির মতলবে ছিল! বের করে দাও! ন’পাড়া হেরে গেছে। …দুয়ো… দুয়ো..”

কিন্তু লোকে চেঁচালে হবে কী?ন’পাড়ার উদ্দেশ্য তো খেলা নয়। মাউ পড়ে যেতেই নপাড়ার বাকি ছ’জন আবার লাফিয়ে পড়ল গৌরের ওপর।

গৌর পড়ে গেল না, ঘাবড়াল না। সাবধানে দমটা ধরে রেখে সে শরীরে একটা ঘূর্ণি তুলল আবার। চরকির মতো বোঁ বোঁ করে ঘুরপাক খেতে লাগল সে। আর ঘূর্ণাবেগে ন’পাড়ার বিশালদেহী খেলোয়াড়রা ছিটকে ছিটকে যেতে লাগল এদিক-সেদিক। দু’জন গিয়ে পড়ল কোর্টের বাইরে, একজন দর্শকদের মধ্যে।

গৌর সবাইকে আউট করে নিজের কোর্টে ফিরে আসতেই এমন তুমুল হাততালি আর হর্ষধ্বনি উঠল যে, কানে তালা ধরার উপক্রম।

দর্শকদের সেই উল্লাস ছাপিয়ে একটা রাজকীয় গুরুগম্ভীর গলা থেকে একটামাত্র শব্দ বেরিয়ে এল, “শাবাশ!”

গৌর তাকিয়ে হিম হয়ে গেল। যে-টেবিলে প্রাইজ রাখা আছে, তার ও-পাশে দাঁড়িয়ে রাজা রাঘব। প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা, সাদা একটা জোব্বার মতো পোশাকে তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

গৌর সম্মোহিতের মতো রাজা রাঘবের দিকে চেয়ে ছিল।

হঠাৎ রেফারি ঘোষণা করল, “খেলা শেষ। পাঁচ পাটি খেলা বাতিল করা হল। মল্লারপুরকে বিজয়ী ঘোষণা করা হচ্ছে। বিজয়ী দলের গৌরগোপাল এ-খেলায় শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের সম্মান পেয়েছে। তাকে এর জন্য অতিরিক্ত একশো টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।”

এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মল্লারপুরের লোকেরা দারুণ নাচানাচি আর হইহই শুরু করে দিল। খেলোয়াড়দের কাঁধে তুলে কোর্টের চারপাশে ঘোরানোনা হল। গৌরকে নিয়েই হইচই হল সবচেয়ে বেশি। গোলমাল থামবার পর গৌর আর রাজা রাঘবকে কোথাও দেখতে পেল না, ন’পাড়ার গুন্ডা খেলোয়াড়রাও কে কোথায় সরে পড়েছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress