Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

গৌর নিজের অন্ধকার ঘরখানায় ঢুকে

গৌর নিজের অন্ধকার ঘরখানায় ঢুকে একপেট জল খেয়ে বসে রইল। নিতাই আর তার দুই শালা আঁচিয়ে ঘরে ঢুকল। বউদি এঁটো সারছে। আজ আর তাকে কেউ খেতে ডাকল না। শুধু নিতাই নিজের ঘর থেকে একখানা হাঁক দিয়ে বলল, “গৌর, জেগে আছিস তো?” ||

গৌর ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “আছি।”

“এবার তা হলে রোদে বেরিয়ে পড়। আমরা ঘুমোচ্ছি।”

গৌর কী আর করে। লাঠিগাছ হাতে নিয়ে বেরোল। ঠিক নিতাই যেমন বলেছিল, তেমনি লাঠি ঠুকে ঠুকে চারদিক ঘুরে ঘুরে পাহারা দিতে লাগল।

তারপর শেয়াল ডাকল, প্যাচা ডাকল, ঝিঝি ঝিনঝিন করতে লাগল। ক্রমে রাত নিশুত হয়ে গেল। গৌরের পেট খাঁখাঁ করতে লাগল খিদের চোটে। বড় ঘরের দাওয়ায় একটু জিরোতে বসল সে। তারপর কখন একটু ঢুলুনি এসে গেল।

আচমকা চটকা ভেঙে উঠে বসল সে। কীসের একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনেছে সে ঘুমের মধ্যে। অনেকটা দরজার শেকলের শব্দের মতো। লাঠি হাতে গৌর উঠে আর-একবার বাড়িটা একপাক ঘুরে দেখল। দরজা-জানালা সব ঠেলেঠুলে দেখল, সবই বন্ধ আছে। নিশ্চিন্ত হয়ে আবার সে দাওয়ায় বসে একটা হাই তুলল। গোবিন্দদা বলেছিল আসবে। এল না কেন তা বোঝা যাচ্ছে না।

ফের দুলুনি আসতে না আসতেই আবার শব্দ। শেকল নাড়ার শব্দ নয়, এবার বেশ মনে হল ধারেকাছে কেউ ফিসফাস করে কথা বলছে। গৌরের গায়ে একটু কাঁটা দিল। ভয়-ভয় করতে লাগল। আর-একবার লাঠি ঠুকে বাড়িটা চক্কর দিল সে। কোথাও কিছু নেই।

এবার গৌর দাওয়ায় একটু গা এলিয়ে দিয়ে বসল, শরীরটা ঝিমঝিম করছে খিদে আর ক্লান্তিতে। হাঁটাহাঁটি ভাল লাগছে না। ঢুলতে ঢুলতে গৌর কখন হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা আর খেয়াল নেই।

খাউ আর মাউ যে ঘরটায় থাকে, সেটা এ বাড়ির সেরা ঘর। তবে পুরনো বাড়ি বলে জানালা-দরজা খুলতে বা বন্ধ করতে প্রচণ্ড কাঁচকোঁচ শব্দ হয়। আচমকা সেই শব্দ গৌরের ঘুমের মধ্যেও সেঁধোল গিয়ে। চটকা ভেঙে সে উঠে বসল। তারপরই দেখল, খাউ আর মাউয়ের ঘরের দরজা খুলে সেই লম্বা লোকটা বেরিয়ে আসছে। লোকটার পরনে একটা আলখাল্লার মতো লম্বা ঝুলের পোশাক। কোনওদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে লোকটা লম্বা লম্বা পা ফেলে উঠোনে নেমে চলে যাচ্ছিল।

গৌর কী করবে প্রথমটায় বুঝতে পারেনি। হাতের লাঠিটার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে তাই সে হঠাৎ চিৎকার করার জন্য হাঁ করল।

কিন্তু সেই সুযোগ আর পেল না। পিছন দিক থেকে একটা হাত এসে তার মুখ খুব শক্ত করে চেপে ধরল। প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়ে আঁট হয়ে বসা হাতটার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে জুত করতে পারল না গৌর। একে উপোসি শরীর, তার ওপর রাত জাগার ক্লান্তি। তবে বুদ্ধি করে সে ফুট করে একটা কামড় বসাল হাতটায়।

পিছন থেকে “উঃ” শব্দ শোনা গেল। তারপরই হাতটা সরে গেল মুখ থেকে। গোবিন্দ হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “আর-একটু হলেই কাঁদিয়ে দিয়েছিলি আর কী।”

“ওঃ, গোবিন্দদা! তুমি কখন এলে?”

“এসেছি অনেকক্ষণ, তোর দাদা ঘুমোতে যাওয়ার আগে।”

“সে কী! টের পাইনি তো?”

“আমরা কি আর জানান দিয়ে আসি রে। লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছিলাম।”

“লোকটাকে দেখলে?”

গোবিন্দ একটা শ্বাস ফেলল, তারপর পাশে রাখা একটা পুঁটুলি খুলতে খুলতে বলল, “দেখেছি। এখন এই রুটি ক’খানা আর তরকারিটুকু খেয়ে নে তো।”

খাবার দেখে গৌরের চোখে জল এসে গেল। বলল, “ওঃ, খিদে যে কী জিনিস তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি গোবিন্দদা।”

“ভাবিস না, রাতের খাবারটা এখন থেকে রোজ আমিই এনে দেব’খন। এখন আর কথা নয়, আগে খা, মাথা ঠান্ডা হোক, বুদ্ধি খুলুক, তারপর কথা।”

গৌরকে দুবার বলতে হল না। আটখানা রুটি চোখের নিমেষে উড়িয়ে এক ঘটি জল খেয়ে ঢেকুর তুলে সে বলল,”লোকটা চোর নয়?”

গোবিন্দ একটু গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “জানি না।”

“তা হলে লোকটাকে ধরলে না কেন?”

“ধরা কি অত সোজা?”

“চেঁচালেও হত। লোকজন উঠে পড়ত, তারপর সবাই মিলে তাড়া করে ধরে ফেলতাম।”

গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে, “অত সোজা নয় রে। অনেক গুহ্য কথা আছে।”

গৌরের একটু অভিমান হল। সে বলল, “তোমরা সবাই আমার কাছে কী যেন একটা লুকোচ্ছ গোবিন্দদা।”

গোবিন্দ একটু হেসে বলে, “যদি লুকিয়েই থাকি তবে সে তোর ভালর জন্যই। এখন একটা কথা জিজ্ঞেস করি। তোর মা মরার আগে যে কবচটা তোকে দিয়ে গেছে, সেটা কোথায়?”

“কবচ! সেই কবচ তো চুরি গেছে।”

“চুরি! বলিস কী?”

গৌর বিপন্ন গলায় বলে, “কবচ চুরি গেছে শুনে ফকিরবাবা আর কবরেজমশাইয়ের যে কী রাগ!”

গোবিন্দ কিছুক্ষণ গৌরের দিকে চেয়ে বলল, “রাগ না হওয়াই বিচিত্র কিনা। শুনে আমারও হচ্ছে। তা সেটা চুরি গেল কী করে?”

গৌর মাথা নেড়ে বলে, “জানি না। ঘরে ছিল, খুঁজে পাচ্ছি না।”

“তোর ঘরে তালা দেওয়া থাকে না?”

“বাড়িতে লোক থাকতে কেউ ঘরে তালা দিয়ে বেরোয়? তা ছাড়া আমাদের তালাটালা নেই, চোরের নেওয়ার মতো থাকেও না কিছু ঘরে। কিন্তু আগে বলো, কবচটা এমন কী দামি জিনিস যে চুরি গেছে শুনে তোমরা অত রেগে যাচ্ছ?”

গোবিন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল, “সে তুই বুঝবি না। তবে কবচটা যে অমূল্য জিনিস তা আমরা জনাকয় লোক ছাড়া আর কেউ জানে না। তা হলে একটা সামান্য কবচ চুরি করতে কে আসবে বল তো! যারা জানে তারা সব আমার মতোই বুড়োটুড়ো লোক, আমি ছাড়া চুরি করার এলেমও কারও নেই। আর চুরি করে লাভও নেই, যার কবচ সে ছাড়া অন্য কারও হাতে গেলে তার সর্বনাশ হবে, এও আমরা জানি।”

গৌর বলল, “তা হলে?”

গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “চুরি যায়নি। কোথাও আছে। খুঁজে দেখতে হবে।”

“আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।”

“তোর খোঁজা আর আমার খোজায় তফাত আছে।”

“তুমি খুঁজবে?”

“খুঁজতেই হবে রে। এখন দাওয়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে থাক। আজ রাতে আর কোনও উপদ্রব হবে বলে মনে হয় না। আমি সকালবেলায় আসব’খন।”

গোবিন্দ নিঃশব্দে চলে গেল। গৌর আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে হাই তুলে দাওয়ায় এলিয়ে পড়ল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা টেরও পেল না।

ঘুম ভাঙল মাজায় দুটো মোক্ষম লাথি খেয়ে! সঙ্গে বাজখাঁই গলা, “অ্যাই গাধা, ঘুমোচ্ছিস যে বড়! তোকে না জামাইবাবু পাহারা দিতে বলেছে?”

গৌর ঘুম ভেঙে উঠে বসে হাবার মতো তাকিয়ে দেখে, সামনে মাউ আর খাউ দাঁড়িয়ে। এখনও ভোর হয়নি। ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। দুঃখে তার চোখ ফেটে জল এল। রাগও হল খুব। তেজের গলায় বলল, “আমাকে লাথি মারছ কেন? তোমাদের ঘরে চোর আসে, তোমরা পালা করে পাহারা দিলেই পারো।”

একথায় দু’ভাই একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। মাউ বলল, “আমরা না তোদের কুটুম! আমাদের বাড়ি পাহারা দিতে বলিস, এত বড় সাহস! বড় বড় কথা বলছিস, দেব জামাইবাবুকে বলে? একবেলা খাওয়া জুটছে, তাও বন্ধ হয়ে যাবে।”

গৌর জানে কথাটা ঠিকই। সে নিতাইগোপালের মায়ের পেটের ভাই হলে কী হবে, নিতাই তাকে মানুষ বলেই জ্ঞান করে না।

অসহায় গৌর কাপড়ের খুঁটে চোখের জল মুছে উঠে পড়ল।

উঠতেই মাউ তার চুলের মুঠিটা ধরে মোলায়েম করে একটা নাড়া দিয়ে বলল, “এবার বলো তো বাছাধন, আমাদের ঘরে যে চোর আসে, সেটা আর কে কে জানে!”

গৌর কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “দাদা জানে।”

“শুধু দাদা? আর কেউ না?” গৌর ভয় খেয়ে বলল, “না।”

“তুই চোরকে দেখেছিস? বল তো কেমন চেহারা?”

এবার চুলের টানে গৌরের চোখে নতুন করে জল এল। বলল, “লম্বা সুড়ঙ্গে একটা লোক।”

“সে যে চোর, তা কী করে বুঝলি?”

“চোরের মতোই মনে হল যে! নিশুত রাতে তোমাদের ঘর থেকে বেরোল।”

“তুই ভুল দেখেছিস।”

গৌর হাঁ করে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, মাউ তার বঁটিটা ধরে এত জোরে নাড়া দিল যে, পটপট করে কয়েকটা চুল ছিঁড়ে গেল, কতকগুলোর গোড়া আলগা হয়ে গেল। গৌর “বাপ রে” বলে চাপা আর্তনাদ করল একটা। মাউ কঠিন গলায় বলল, “চেঁচাবি তো গলা টিপে মেরে ফেলে দেব। এখন যা জিজ্ঞাসা করছি, ঠিকঠাক জবাব

দে। লোকটা আজ এসেছিল?”

“এসেছিল।”

“তা হলে চেঁচাসনি কেন?”

গৌর চেঁচাতেই চেয়েছিল, কিন্তু গোবিন্দ চেঁচাতে দেয়নি। কিন্তু সেই কথাটা মাউকে বলে কী করে গৌর। তাই হাত দিয়ে চোখের জল মুছে ধরা গলায় বলল, “ভয় পেয়েছিলাম।”

“ভয় পেলে পাহারা দিস কী করে? তোর দাদাকে বলে দেব যে, তুই চোরকে দেখেও চেঁচাসনি বা ধরার চেষ্টা করিসনি?”

“বোলো না। তা হলে দাদা তাড়িয়ে দেবে।” গৌর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল।

গৌরের কান্না দেখেও মাউ চুলের মুঠি ছাড়ল না, বরং আরও শক্ত হাতে চুলের গোছা চেপে ধরে বলল,”তা হলে আমাদের কথা শুনে চলতে হবে। যা বলব তা-ই করতে হবে। রাজি?”

চুলের টানে গৌরের বোধবুদ্ধি গুলিয়ে যাচ্ছিল। চিটি করে বলল, “রাজি। আমাকে খামোখা মারছ কেন? আমি তো কিছু করিনি।”

“করেছিস বই কী! যে ব্যাপারে তোর নাক গলানো উচিত নয়, তাইতে নাক গলিয়েছি। এখন আমাদের কথায় রাজি না হলে একদম শেষ করে পাঁকে পুঁতে দেব। বুঝলি?”

গৌর বুঝেছে। না বুঝলেও বুঝেছে। বলল, “আচ্ছা।”

মাউ চুল ছেড়ে দিয়ে বলল, “আমাদের সঙ্গে আয়।”

গৌরকে নিজেদের ঘরে নিয়ে গিয়ে মাউ আর খাউ দরজাটা বন্ধ করে দিল, তারপর মাউ বলল, “বোস।”

গৌরের চুলের গোড়াগুলো ফুলে উঠেছে। একশো ফোড়ার যন্ত্রণা তার মাথায়। মাথায় চিন্তাভাবনা কিছু আসছে না। চুপ করে ভ্যাবলার মতো বসে রইল সে।

মাউ হ্যারিকেনটা একটু উসকে দিয়ে গৌরের দিকে আগুন-চোখে চেয়ে রইল। মাউ আর খাউ পাজি বটে, কিন্তু এরকম ঠান্ডা খুনির মতো চেহারা তাদের কখনও দেখেনি গৌর। এ যেন অন্য জগতের দুটো মানুষ। চোখ ধকধক করে জ্বলছে, কপালের শিরা ফুলে উঠেছে, চিতাবাঘের মতো থাবা পেতে আছে যেন, একটু বেয়াদবি করলেই লাফিয়ে পড়বে।

মাউ চাপা গলায় বলল, “যাকে তুই দেখেছিস, সে চোর নয়। আমাদের কাছে প্রায়ই আসবে। গভীর রাত্রেই আসবে। কিন্তু খবরদার, তাকে দেখে একটি শব্দও করবি না। যদি করিস তা হলে তার কিছুই হবে না, কেউ ধরতে পারবে না তাকে, কিন্তু তোর দারুণ বিপদ ঘটবে। বুঝেছিস?”

গৌর সম্মোহিতের মতো মাউয়ের দিকে চেয়ে ছিল। মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি।”

“আর-একটা কথা। এসব ব্যাপার যদি বাইরের কেউ জানতে পারে, তা হলে কিন্তু…” মাউ কথাটা শেষ না করে অর্থপূর্ণ চোখে গৌরের দিকে চাইল।

গৌর মাথা নেড়ে বলে, “কেউ জানবে না।”

“ঠিক বলছিস?”

“দিব্যি করে বলতে পারি।”

“তোর দিব্যির কোনও দাম আছে নাকি? সে যাকগে, দিব্যি-টিব্যি করতে হবে না। শুধু বলে দিচ্ছি, তার কথা কেউ জানলে তোর গলার ওপর মাথাটা আর থাকবে না। যদি প্রাণে বাঁচতে চাস তো মুখে কুলুপ এঁটে রাখিস। এখন যা।”

গৌর পালিয়ে বাঁচল। নিজের ঘরে এসে দু’ঘটি জল খেল, তারপর বসে বসে ব্যাপারখানা ভাবতে লাগল। ব্যাপারটা যে জটিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এবাড়িতে আর থাকাটাই তার পক্ষে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই বাড়িতেই তার জন্ম, এই গাঁয়েই সে এত বড়টি হয়েছে। এ-জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে তার একটুও ইচ্ছে করে না। এ বাড়িতে তারও অধিকার আছে। মাউ আর খাউ উটকো লোক, তাদের ভয়ে নিজের বাপ-পিতামহের ভিটে ছেড়ে পালাতেও ইচ্ছে করে না। এই বাড়ি, এই গাছপালা, এরা

সব যেন তার বন্ধু, তার আপনজন। ভাবতে ভাবতে তার চোখে জল এল। আপনমনে নিজের মাথায় একটু হাত দিল সে। চুলের গোড়ায় রক্ত জমে আছে, সাংঘাতিক ব্যথা।

কী করবে বুঝতে না পেরে গৌর কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। তারপর আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। ভোরের দিকে একটু ঢুলুনি এসেছিল তার। তখন স্বপ্নে তার মা দেখা দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “বড্ড লেগেছে বাবা? তা কবচটা হারিয়ে ফেললি, কী যে করি তোকে নিয়ে! একটা কথা বলি শোন, রাজা রাঘব কিন্তু ভাল লোক নয়। তাকে কখনও বিশ্বাস করিস নে।”

ঘুম ভেঙে গৌর দেখল, ভোর হয়ে গেছে। গোয়ালে গোরুগুলো ডাকাডাকি করছে খুব। গৌর তাড়াতাড়ি উঠে বাসন-টাসন মেজে, ঝটপাট দিয়ে, পান্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল গোরু নিয়ে।

নদীর ধারে একটা বেশ বড় বটগাছ আছে। গোরুগুলোকে ছেড়ে দিয়ে সেই বটগাছের ছায়ায় বসে গৌর কাল রাতের কথা, স্বপ্নের কথা, সব ভাবছিল। মা স্বপ্নে এসে বলল, “রাজা রাঘব ভাল লোক নয়।” কিন্তু রাজা রাঘবটা কে? সে তো এরকম কোনও রাজার নামই শোনেনি।

বটের ছায়ায় বসে একটু ঝিমুনি এসেছিল গৌরের। হঠাৎ একটা কর্কশ গলা-খাঁকারির শব্দে চোখ চাইল। বটগাছের কাছেই একটা বহু পুরনো ঢিবি। রাখালরা ওখানে লুকোচুরি খেলে। সেই ঢিবির চুড়োয় একটা শুটকো চেহারার বুড়োলোক দাঁড়িয়ে জুলজুলে চোখে তাকে দেখছে। পরনে চোগা-চাপকান, হাতে লাঠি। গৌর চমকে উঠে বসতেই বুড়ো লোকটা ঢিবির আড়ালে ওধারে নেমে গেল ধীরে ধীরে।

দুপুরবেলা ফেরবার পথে গৌর ফকিরসাহেবের থানে আবার হানা দিল। লোকটা বুজরুক হোক, মিথ্যেবাদী হোক, বেশ মজার লোক। তাকে গৌরের ভালই লাগে।

“ও ফকিরবাবা।” ফকিরসাহেব একটা পুরনো পুথি পড়ছিলেন। চোখ তুলে অবাক হয়ে বললেন, “বেঁচেবর্তে আছিস এখনও। শুনলুম কাল রাতে মাউ আর খাউ তোকে ভালরকম ডলাই মলাই করেছে। তা মরিসনি কেন? মরলে এতক্ষণে দিব্যি আমার আরশিনগরে থাকতে পারতি। তা বৃত্তান্তটা কী?”

গৌর অবাক হয়ে বলে, “ডলাই মলাই নয়, চুল ধরে খুব টেনেছে। কিন্তু সেকথা আপনি জানলেন কী করে?”

ফকিরসাহেব খুব হেঃ হেঃ করে হেসে বললেন, “আমার আরশিখানা যে সবজান্তা রে।”

কথাটা ঠিক বিশ্বাস হল না গৌরের, আবার অবিশ্বাসই বা করে কী করে? একটু মাথা চুলকে সে বলল, “কাল রাতে মাকে স্বপ্নে দেখলাম। তা মা বলল, রাজা রাঘব নাকি খুব খারাপ লোক। কিন্তু মুশকিল হল, রাজা রাঘব লোকটা যে কে, তা-ই আমি বুঝতে পারছি না। আপনি জানেন ফকিরবাবা।”

ফকিরসাহেবের মুখোনা দিব্যি হাসি-হাসি ছিল এতক্ষণ। কানের আতর-ভেজানো তুলো থেকে দিব্যি সুবাস আসছিল। তেল-চুচুক করছিল মুখোনা। রাজা রাঘবের নামটা শুনেই কেমন যেন হত্ত্বকির মতো শুকিয়ে গেল। ফকিরসাহেব একটা ঢোক গিলে বললেন, “তোর মা বলল? অ্যাঁ! ওরে বাবা! তা কী বলল বল তো! রাঘব আসছে নাকি?”

“তা আমি জানি না। মা শুধু সাবধান করে দিয়ে গেল। কেন ফকিরবাবা, রাঘবরাজা কি খুব সাংঘাতিক লোক?”

ফকিরসাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে অনেকক্ষণ কী যেন ভাবলেন। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “ঈশানকোণে রক্তমেঘ! আগেই জানতুম, আর বেশিদিন নয়। লেগে যাবে সুন্দে-উপসুন্দে। গাঁ ছারখার হয়ে যাবে। ওরে বাবা!”

গৌর হাঁ করে ফকিরসাহেবের মুখের দিকে চেয়ে ছিল। বুঝতে পারছিল না, ব্যাপারখানা কী।

ফকিরসাহেব বিড়বিড় করা থামিয়ে তার দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে বললেন, “এখনও বসে আছিস যে বড়! এখনই গিয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মরে যা। কোনও ভয় নেই, মরতে না মরতেই আমি আত্মাটাকে চিমটে দিয়ে ধরে বের করে এনে আরশিতে পুরে ফেলব।”

“মরব ফকিরবাবা? কেন?”

“বেঁচে থেকে আর সুখ কী রে? সে যদি এসেই যায়, তবে বেঁচে থেকে আর সুখ কী? গাঁ কে গাঁ শ্মশান হয়ে যাবে।”

“রাঘব কে ফকিরবাবা?”

“ওরে বাবা, সে আমি জানি না।”

“এই যে এতক্ষণ বিড়বিড় করে কী সব বলছিলেন, যা শুনে মনে হল, রাঘবরাজা খুব খারাপ লোক।”

ফকিরসাহেব নিজের কানে হাতচাপা দিয়ে বললেন, “ভুল বলেছি তা হলে। ও কিছু নয়। তুই বাড়ি যা তো, বাড়ি যা।”

গৌর বেজার মুখে উঠে পড়ল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *