হাতে হাতকড়া
পাঁচ মিনিটের মধ্যেও তুলসীবাবু এলেন না দেখে মৃগাঙ্কবাবু কাজ আরম্ভ করে দেওয়া স্থির করলেন। মনে মনে বললাম।–তুলসীবাবু এ জিনিস অনেক দেখেছেন, তাঁর পুরোটা না দেখলেও চলবে।
অনুগ্রহ করে আপনাদিগের প্রত্যেকের হস্তদ্বয় অঙ্গুলি প্রসারিত করে এই টেবিলের উপর স্থাপন করুন।
কাঠের টেবিলে হাতগুলো রাখার সঙ্গে সঙ্গে যে একটা টক টক শব্দ শুরু হল সেটা আর কিছুই না, লালমোহনবাবুর কাঁপা আঙুল টেবিলের উপর তবলার বোল তুলে ফেলছে। ভদ্রলোক দাঁতে দাঁত চেপে হাত স্টেডি করলেন।
মৃগাঙ্কবাবুর চোখ বন্ধ, ঠোঁট নড়ছে। চারিদিক একেবারে নিস্তব্ধ বলেই বুঝলাম উনি ফিস ফিস করে একটা শ্লোক আওড়াচ্ছেন।
এক মিনিট পরে সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। এবারে যাকে ইংরিজিতে বলে ডেথলি সাইলেন্স। পিন্দিমের শিখা কাঁপছে, আর তার চার পাশে ঘুর ঘুর করছে তিনটে ফড়িং। ঘরের চারিদিকের দেয়ালে চারটে মানুষের ছায়া থর থর করে কাঁপছে। আড়চোখে ফেলুদার দিকে চেয়ে তার মনের অবস্থা কিছু বুঝতে পারলাম না। চায়াল শক্ত, চোখের পাতা প্ৰায় পড়ছেই না, দৃষ্টি সটান মৃগাঙ্কবাবুর দিকে। মৃগাঙ্কবাবু নিজে যেন পাথরের মূর্তি। এর মধ্যে কখন যে পেনসিলটা তার হাতে চলে গেছে জানি না। সেটা এখন খাতার সাদা পাতার উপর ধরা, শিসের ডগাটা ঠেকে রয়েছে। কাগজের সঙ্গে।
এবার মৃগাঙ্কবাবুর ঠোঁটে কাঁপুনি আরম্ভ হল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমার পাশে আবার তবলার বোল শুরু হয়েছে, এখন আওয়াজটা রীতিমতো ভৌতিক বলে মনে হচ্ছে। অনেকেরই এ অবস্থায় এভাবে হাত কাঁপতে পারে, যদিও আমার কাঁপছে শুধু বুক।
জীবনলাল, জীবনলাল, জীবনলাল…
তিনবার পর পর অতি আস্তে উচ্চারণ হল নামটা। মৃগাঙ্কবাবুর ঠোঁটটা নড়ল কি না তাও ভাল করে বুঝতে পারলাম না।এসেছেন? আপনি এসেছেন?
প্রশ্ন এল আমাদের চমকে দিয়ে আমাদের পিছন থেকে। এইবারে বুঝলাম নিত্যানন্দের ভূমিকাটা কী। মৃগাঙ্কবাবু নিজে এই অবস্থায় কথা বলেন না। হয়তো বলা সম্ভবই না। এসেছি।
ফেলুদার গলা। খাতায় লেখা হয়েছে ফেলুদা সেটাই পড়ে বলেছে।
আমার চোখ মৃগাঙ্কবাবু হাতের দিকে গেল। পিছন থেকে প্রশ্ন এল, তুমি কোথায় আছ?
কাছেই—পড়ে বলল ফেলুদা।
কতগুলি প্রশ্ন তোমাকে করা হবে, সেগুলোর জবাব দিতে পারবে? পেনসিল নাড়ল।
পারব—পড়ে বলল ফেলুদা।
সিন্দুক খুলে টাকা নিল কে? আমি।
তোমাকে যে হত্যা করল, তাকে দেখেছিলে? হ্যাঁ।
চিনেছিলে? হ্যাঁ।
কে সে? বাবা।
কিন্তু কী ভাবে খুনটা করা হল সেটা আর জানা হল না, কারণ প্রশ্নটা হবার সঙ্গে সঙ্গে এতেই হবে বলে ফেলুদা উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, তোপ্সে, ওই লণ্ঠনটা আন তো—দরজার বাইরে রাখা রয়েছে। আলো বড় কম।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা, লণ্ঠনটা এনে টেবিলের উপরে রাখলাম।
ফেলুদা মৃগাঙ্কবাবুর সামনে থেকে কাগজটা তুলে নিল। তারপর উত্তরগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, মৃগাঙ্কবাবু, আমার মনে হচ্ছে আপনার এই আত্মটি এখনও ঠিক ত্রিকালজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেনি, কারণ প্রশ্নোত্তরে কতগুলো গোলমাল পাচ্ছি।
মৃগাঙ্কবাবু কটমট করে ফেলুদার দিকে চাইলেন, যেন এক চাহনিতে ফেলুদাকে ভস্ম করবেন। ফেলুদা তাঁকে অগ্রহ করে বলে চলল, যেমন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সিন্দুক খুলে টাকা নিল কে, উত্তর হচ্ছে—আমি। কিন্তু সিন্দুকে তো টাকা ছিল না মৃগাঙ্কবাবু!
ম্যাজিকের মতো মৃগাঙ্কবাবুর মুখ থেকে ক্রোধের ভাবটা চলে গিয়ে সেখানে দেখা দিল সংশয়। ফেলুদা বলল, টাকা ছিল না বলছি। এই কারণে যে সিন্দুক খুলেছিল জীবনলাল নয়, খুলেছিল প্রদোষ চন্দ্ৰ মিত্ৰ। অবিশ্যি জীবনবাবু এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছিলেন। তিনিই মাঝরাত্তিরে দরজা খুলে আমাকে ঢুকতে দেন, তিনিই বলে দেন যে তাঁর বাবার বালিশের তলায় থাকে সিন্দুকের চাবি; ভোলানাথবাবু আর শ্যামলালবাবুকে বাঁধার ব্যাপারেও অবিশ্যি তিনি আমাকে সাহায্য করেন। যাই হাক, সিন্দুকে টাকার বদলে যেটা ছিল সেটা হল–
ফেলুদা পকেট থেকে আর একটা কাগজ বের করল। এটাও খাতার কাগজ, এটাতেও পেনসিল দিয়ে লেখা।
এই কাগজটাই, বলল ফেলুদা, শ্যামলালবাবুর কাছ থেকে চেয়ে আমি পাইনি। এটার প্রয়োজন হয়েছিল। এই কারণেই যে মৃগাঙ্কবাবুর সততা সম্বন্ধে আমার মনে সন্দেহ উপস্থিত হয়েছিল, আর সেটা হয়েছিল একেবারে প্রথম দিনের সাক্ষাতের পরেই। আমার সঙ্গে আলাপ হবার পরমুহূর্তেই তিনি ভান করলেন যে আমার নাম এবং পেশা তিনি অলৌকিক উপায়ে জেনে ফেলেছেন। আসলে এগুলো কিন্তু তাঁকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। তুলসীবাবু। তাই নয়, তুলসীবাবু?
তুলসীবাবু এর মধ্যে কখন যে অন্ধকারে ঘরে ঢুকে মোড়ায় বসেছেন তা দেখিইনি। ভদ্রলোক ফেলুদার কথায় ভারী অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে বললেন, মানে আপনার মনে, ইয়ে, যদি একটু ভক্তিভাব জাগে…
ফেলুদা তাঁকে থামিয়ে বলল, দোষ আমি আপনাকে দিচ্ছি না তুলসীবাবু। আপনি তো আর নিজেকে মহৎ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন না। কিন্তু ইনি করেন। যাই হাক, এই ভণ্ডামির গন্ধ পেয়েই আমি কাগজটা পেতে বদ্ধপরিকর। আমার আশা ছিল শ্যামলালবাবু সম্পর্কে কয়েকটা খটকার উত্তর আমি এই কাগজে পাব।
পিন্দিমের আলোতেও বুঝতে পারলাম মৃগাঙ্কবাবুর কপাল ঘেমে গেছে। ফেলুদা কাগজটা আলোয় ধরে বলল, দুর্লভ মল্লিকের আত্মা এই কাগজে তাঁর ছেলের কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। প্রশ্নগুলো মুখে করা হয়েছিল, তাই এতে লেখা নেই; কিন্তু উত্তরগুলো থেকে প্রশ্নগুলো অনুমান করা যায়। আমি উত্তরের পাশে পাশে সেগুলো লিখেছি, এবং সেই ভাবেই পড়ে শোনাচ্ছি; আমার ভুল হলে সংশোধন করে দেবেন মৃগাঙ্কবাবু!
মৃগাঙ্কবাবুর দ্রুত নিশ্বাসে প্রদীপের শিখা কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফেলুদা পড়া আরম্ভ করল—
এক নম্বর প্রশ্ন—আমার শত্রু কে? উত্তর—ঘরেই আছে।
সে কি আমার মৃত্যু কামনা করে—না। তবে কী চায়?—টাকা। টাকা রক্ষার উপায় কী?–সিন্দুকে রেখো না। কোথায় রাখব?—মাটির নীচে। কোনখানে?—বাগানে। বাগানের কোথায়?—উত্তরে। উত্তরে কোথায়?—আম গাছের নীচে। কোন আম গাছ?—দেয়ালের ফাটলের ধারে।
ফেলুদা এবার হাতের কাগজটা টেবিলের উপরে রেখে বলল, শ্যামলালবাবুর পায়ের তলায় মাটি এবং গায়ে মশার কামড় দেখে মনে হয়েছিল। তিনি কোনও কারণে বাগানে গিয়ে সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়েছেন। আজ জানি তিনি এই কাগজের— অর্থাৎ মৃগাঙ্কবাবুর-নির্দেশ অনুযায়ী সিন্দুক থেকে টাকার বাক্স বার করে মাটিতে পুঁতিতে গিয়েছিলেন। টাকা লুকিয়ে রাখার এই প্রাচীন পন্থা শ্যামলালবাবুর মনঃপূত হবে এটা মৃগাঙ্কবাবু বুঝেছিলেন। এই টাকার উপর মৃগাঙ্কবাবুর লোভ অনেক দিনের, কিন্তু বিশ্বস্ত ভোলানাথ যদ্দিন আছেন তদিন সিন্দুকের নাগাল পাওয়া অসম্ভব। প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন ভোলানাথবাবুর উপর শ্যামলালের সন্দেহ ফেলে তাকে হাঁটানোর। সেটা সফল হয়নি। কিন্তু সেই সময় আশ্চর্য সুযোগ এসে যায়। শ্যামলালবাবু নিজেই মৃগাঙ্কবাবুকে ডেকে পাঠান আত্মা নামানোর জন্য। মৃগাঙ্কবাবু তাঁর আশ্চর্য বুদ্ধি বলে এক টিলে দুই পাখি মারেন; শ্যামলালের ঘরের লোককেই শ্যামলালের শত্রু করে দেন, এবং টাকার বাক্স সিন্দুক থেকে বার করিয়ে বাগানে অন্যান। সেই বাক্স কাল সন্ধ্যাবেলা–
একটা শব্দ শুনে পিছন ফিরে দেখি ভাগনে বেঞ্চি ছেড়ে দরজার দিকে একটা লাফ মেরেছে। কিন্তু ঘর থেকে বেরোনো আর হল না। কারণ দুটো শক্ত হাত তাকে বাধা দিয়েছে। এবার হাতের মালিক ভাগনে সমেত ভিতরে ঢুকলেন। আরেব্বাস-এ যে সুধাকর দারোগা : দারোগ বললেন, বাক্সটা পেয়েছি মিস্টার মিত্তির; একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে কাপড়ের নীচে রাখা ছিল। মণীশ–দাও তো!
একজন কনস্টেবল একটা স্টিলের বাক্স নিয়ে ঘরে ঢুকে সেটাকে টেবিলের উপর রাখল।
এর ডালা তো ভেঙেই ফেলা হয়েছে দেখছি, বলল ফেলুদা।
বাক্স খুলতে লণ্ঠন আর পিন্দিমের আলোয় তাড়া তাড়া একশো টাকার নোট দেখেই বুঝলাম। এত টাকা আমি একসঙ্গে কখনও দেখিনি।
কিন্তু খুন? হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন মৃগাঙ্কবাবু।খুন করল কে? খুন তো আমি করিনি!
খুন একজনই করেছে মৃগাঙ্কবাবু!—ফেলুদার গলা যেন খাপখোলা তলোয়ার্ক্স—এবং তারও নাম প্রদোষ চন্দ্ৰ মিত্র। খুন হয়েছে। আপনার ভণ্ডামি, আপনার শয়তানি, আপনার লোভ। এর কোনওটাই আর কোনওদিনও মাথা তুলতে পারবে না, কারণ সকলেই জানবে যে আপনি আজ অপূর্ব ক্ষমতাবলে একটি জীবন্ত ব্যক্তির আত্মাকে পরলোক থেকে ডেকে এনেছেন আপনার এই ঘরে—আসুন, জীবনবাবু!
এবার পিছন নয়, সামনের দরজা দিয়ে ঢুকলেন জীবনলাল মল্লিক। তাঁকে দেখেই মৃগাঙ্কবাবু যে কথাটা বলে আর্তনাদ করলেন, সেটা লালমোহনবাবুর বিশ্বাস হা হতোহস্মি, কিন্তু আমি যেন শুনলাম হায়! হাতে হাতকড়া।
অবিশ্যি হাতে হাতকড়া পড়েছিল ঠিকই। সুধাকরবাবু শুধু একটা অভিযোগ করলেন ফেলুদাকে—মিছিমিছি দুটো পুকুরে জাল ফেললেন আমাদের দিয়ে।
কী বলছেন সুধাকরবাবু, বলল ফেলুদা,জীবনবাবু খুন হয়েছে। এ ধারণা সকলের মনে বদ্ধমূল না হলে মৃগাঙ্কবাবুর ভণ্ডামি হাতেনাতে ধরব কী করে?
জীবনবাবু খুনের ব্যাপারটা শুধুই মৃগাঙ্কবাবুকে সায়েস্তা করার জন্য। একেবারে প্ল্যান করে ভাঁওতা। এদিকে আমি আর ফেলুদা, আর ওদিকে লালমোহনবাবু ও ভোলানাথবাবু চলে যাওয়া মাত্র ভদ্রলোক বাগান থেকে উঠে বাড়িতে ফিরে গিয়ে দোতলার পিছন দিকের একটা গুন্দোম ঘরে গা ঢাকা দেন। যাবার পথে ঠাকুমা দেখে ফেলেছিলেন, কিন্তু সেটা ফেলুদা ম্যানেজ করে। আজ সন্ধ্যায় তিনি আবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। মৃগাঙ্কবাবুর বৈঠকের শেষে আত্মপ্রকাশ করবেন বলে! সেই সময় বাঁশ বনে দূর থেকে আমাদের দেখে বাদুড়ে কালীমন্দিরে ঢুকে মড়া সেজে পড়ে থাকতে হয়।
রাত্রে খাবার সময় তুলসীবাবু কাঁচুমাচু ভাব করে ফেলুদাকে বললেন, আপনি আমার উপর অসন্তুষ্ট হননি তো?
অসন্তুষ্ট? বলল ফেলুদা, আপনি আমাকে কতটা হেলপ করেছেন জানেন? লোকটা সেদিন আমার নাম নিয়ে হেঁয়ালি না করলে তো ওর ওপর আমার সন্দেহই পড়ত না! আমার তো আপনাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।
আজ জীবনবাবু আমাদের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। বললেন, আমি বেক্সেবার আগে বাবাকে প্ৰণাম করে এলাম।
কী মনে হল? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
তাজ্জব বনে গেলাম, বললেন জীবনবাবু।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ব্যবসা কেমন চলছে।
লালমোহনবাবু এতক্ষণ মাছের মুড়ো চিবোচ্ছিলেন বলে কিছু বলেননি। এবার তুলসীবাবুর দিকে ফিরে বললেন, তা হলে কালকের ইয়েটা—?
হচ্ছে বইকী। এখন তো আর কোনও বাধা নেই।
ভেরি গুড। আমার ইয়েটাও রেডি আছে।