তুলসীবাবু আর জটায়ু
তুলসীবাবু আর জটায়ু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন; এতক্ষণে ইলেকট্রিক লাইটে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। লালমোহনবাবু বললেন, ভাবতে পারেন, এই গণ্ডগ্রামে প্রায় বিশ জনের মতো লোক পাওয়া গেল। যারা আমার ফিফটি পারসেন্টের বেশি বই পড়েচে? অবিশ্যি সবাই যে কিনে পড়েচে তা নয়; সিক্সটি ফাইভ পারসেন্ট ইস্কুলের লাইব্রেরি থেকে নিয়ে পড়েচে। যারা কিনোচে তারা এসে বইয়ে সই নিয়ে গেল।
তুলসীবাবু ফেলুদাকে বললেন, আপনার অপেক্ষাতেই বসে আছি। একবার আত্মারামের দর্শনটা করে নিন। বাদুড়েকালী না হয় কাল দেখা যাবে।
সেটা আবার কী?
গোসাঁইপুরের আরেকটি অ্যাট্রাকশন। আপনারা যে বাঁশবন দিয়ে এলেন, তারই ভেতরে একটি দুশো বছরের পুরনো পোড়ো মন্দির। বিগ্রহ নেই। বহুদিন থেকেই বাদুড়ের বাসা হয়ে পড়ে আছে। এককালে খুব জাঁকের মন্দির ছিল।
ভাল কথা, আপনার এই আত্মারামবাবুট এ-গাঁয়েরই লোক?
না, তবে রয়েছেন। এখানে অনেক’দিন। বছর দুয়েক হল ভদ্রলোকের এই ক্ষমতা প্রকাশ পায়। তা ছাড়া জ্যোতিষও জানেন। খুব নাম-ডাক। কলকাতা থেকে লোক এসে হাত-টাত দেখিয়ে যায়।
পয়সা নেন?
তা হয়তো নেন। কিন্তু এখানের কারুর কাছ থেকে কোনওদিন কিছু নিয়েছেন বলে শুনিনি। আত্মা নামান সোম আর শুকুরে; আজ শুধু দর্শনটা করিয়ে আনব।
ফেলুদা দর্শনের ব্যাপারে দেখলাম কোনও আপত্তি করল না। কারণ পরিষ্কার : সে বুঝেছে মৃগেন ভট্যচায এখন তদন্তের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
বাইরে গাছপালার ফাঁক দিয়ে এবাড়ি-ওবাড়ির বিজলি-আলো দেখা গেলেও অন্ধকারটা বেশ জমজমাট। চাঁদ এখনও ওঠেনি। বিপ্নবিষ্ণু প্যাঁচ শেয়াল সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল এখানে শ্যাম মল্লিকের পালকি আর কেরোসিন ল্যাম্পই মানায় বেশি। লালমোহনবাবু বললেন এর চেয়ে রহস্যময় আর রোমাঞ্চকর পরিবেশ তিনি আর দেখেননি। বললেন, যে-উপন্যাসটার ছক কেটেচি সেটা গোয়াটেমালায় ফেলব ভাবচিলুম, এখন দেখাচ গোসাঁইপুর প্রেফারেবল।
তাও তো ঠগীর ফাঁসটা দেখেননি, তা হলে বুঝতেন রোমাঞ্চ কাকে বলে।
সে কী ব্যাপার মশাই?
ফেলুদা সংক্ষেপে ঘটনাটা বলল। হুমকি চিঠির কথাটাও বলল। তুলসীবাবু মন্তব্য করলেন,মৃগেন ভটচায। যদি আত্মা আনিয়ে ওই কথাই বলে থাকে যে মল্লিক বাড়িতেই রয়েছেন শ্যাম মল্লিকের শত্রু তা হলে সেটা মানতেই হবে। আপনার সারা গাঁ চষে বেড়ানোর দরকার নেই।
আমি মনে মনে বললাম—তুলসীবাবুর ভক্তির পাত্রের মধ্যে আরেকজন লোক পাওয়া গেল—আত্মারাম মৃগেন ভট্টাচার্য।
মৃগেনবাবুর বাড়িতেও দেখলাম ইলেকট্রিসিটি নেই। বোধহয় আবছা আলোয় আত্মা সহজে নামে তাই। ভদ্রলোকের চেহারাটা বেশ চোখে পড়ার মতো। দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। পাতলা চুলে পাক ধরেনি, যদিও চোখের কোলে আর থুতনির নীচে চামড়া কুঁচকে গেছে। নাক, চোখ, কপাল, পাতলা ঠোঁট, গায়ের রং সবই একেবারে কাশির টালের পণ্ডিতের মতো। মানে যাকে বলে মাকৰ্গ মারা বামুন। পায়ের গুলি দেখে মনে হল ভদ্রলোক এখন না হলেও এককালে প্রচুর হেঁটেছেন।
বিজলি না থাকলেও এখানে চেয়ার টেবিলের অভাব নেই। ভট্যচায মশাই নিজে তক্তপোষে বসে আছেন, সামনে তিনটি টিনের আর একটা কাঠের চেয়ার ছাড়া দুপাশে দুটো বেঞ্চ রয়েছে। ডান দিকের বেঞ্চিতে একজন বছর পচিশের ছেলে বসে একটা পুরনো পাঁজির পাতা উলটাচ্ছে। পরে জেনেছিলাম ও মৃগেনবাবুর ভাগনে নিত্যানন্দ, আত্মা নামানোর ব্যাপারে মামাকে সাহায্য করে।
তুলসীবাবু ভটচার্য মশাইকে টিপ করে একটা প্ৰণাম করে আমাদের দিকে দেখিয়ে বললেন, কলকাতা থেকে এলেন এরা। আমার বন্ধু। নিয়ে এলাম। আপনার কাছে। গোসাঁইপুর কাকে নিয়ে গর্ব করে সেটা এদের জানা উচিত নয় কি?
মৃগাঙ্কবাবু ঘাড় তুলে আমাদের দেখে চেয়ারের দিকে দেখিয়ে দিলেন। আমরা তিনজনে বসলাম, তুলসীবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন।
মৃগাঙ্কবাবু হঠাৎ টান হয়ে পদ্মাসন করে বসে মিনিট খানেক চোখ বুজে। চুপ করে রইলেন। তারপর সেই অবস্থাতেই বললেন, সন্ধ্যাশশী বন্ধুটি কোন জন?
আমরা সবাই চুপ। ফেলুদার চোখ কুঁচকে গেছে। লালমোহনবাবু বললেন, আজ্ঞে ওই নামে তো কেউ—?
তুলসীবাবু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিলেন।
প্রদোষ চন্দ্ৰ মিত্র আমার নাম, হঠাৎ বলে উঠল। ফেলুদা। সত্যিই তো!—প্রদোষ মানে সন্ধ্যা, চন্দ্র হল শশী, আর মিত্র হল বন্ধু!
ভটচায মশাই চোখ খুলে ফেলুদার দিকে মুখ ঘোরালেন। তুলসীবাবু দেখি বেশ গর্ব-গর্ব। ভাব করে ফেলুদার দিকে চেয়ে আছেন।
বুঝলে তুলসীচরণ, বললেন ভটচার্য মশাই।কিছুদিন পরে আর আত্মার প্রয়োজন হবে। না। আমার নিজের মধ্যেই ক্ৰমে ত্রিকাল দর্শনের শক্তি জাগছে বলে অনুভব হচ্ছে। অবিশ্যি আরও কয়েক বছর লাগবে।
ওঁর পেশাটা কী বলুন তো! তুলসীবাবু ফেলুদার দিকে দেখিয়ে প্রশ্নটা করলেন। ইতিমধ্যে একজন বাইরের লোক এসে ঢুকেছে, তার সামনে ফেলুদা যে গোয়েন্দা এই খবরটা বেরিয়ে পড়লে মোটেই ভাল হবে না।
সেটা আর বলার দরকার নেই, বলল ফেলুদা। তুলসীবাবুও নিজের অসাবধানতার ব্যাপারটা বুঝে ফেলে জিভা কেটে কথা ঘুরিয়ে বললেন, শুকুরবার আরেকবার আপনার এখানে নিয়ে আসবা ওঁদের। আজ কেবল দর্শনটা করিয়ে গেলাম।
মৃগাঙ্কবাবুর চোখ এখনও ফেলুদার দিকে। একটু হেসে বললেন, সূক্ষ্ম সাল শস্যের কাজে এসেছেন। আপনি, এ কথা বললে আপনি ছাড়া আর কেউ বুঝবে কি? আপনি অকারণে বিচলিত হচ্ছেন।
ভদ্রলোকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে এসে ফেলুদা বলল, চতুর লোক। এর পাসার জামবে না তো কার জমবে?
সূক্ষ্ম সাল শস্য কী মশাই? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। সন্ধ্যা শশী বন্ধু তো তাও অনেক কষ্টে বুঝলাম–তাও আপনি নিজের নামটা বললেন বলে।
সূক্ষ্ম হল অণু, সাল-দস্ত্য সা-হল সন, আর শস্য হল ধান। তিনে মিলে—
অনুসন্ধান! লালমোহনবাবু ক্ল্যাপ দিয়ে বলে উঠলেন, লোকটা শুধু গণনা জানে না, হেঁয়ালিও জানে। আশ্চর্য!
কে যেন এদিকেই আসছে-হাতের লণ্ঠনটা দোলার ফলে তার নিজের ছায়াটা সারা রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে এগিয়ে আসছে; তুলসীবাবু হাতের টর্চ তুলে তার মুখে ফেলে বললেন, ভট্টচাযের ওখানে বুঝি? কী ব্যাপার, ঘন ঘন দৰ্শন?
ভদ্রলোক একটু হেঁ হেঁ ভাব করে কিছু না বলে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
ভোলানাথবাবু বললেন তুলসীবাবু, ভটচার্য মশাইয়ের লেটেস্ট ভক্ত। মাঝে এক’দিন ওঁর বাড়িতে গিয়ে কার জানি আত্মা নামিয়েছেন।
রাত্রে তুলসীবাবুর দাওয়ায় বসে তিনরকম তরকারি, মুগের ডাল আর ডিমের ডালনা দিয়ে দিব্যি ভোজ হল। তুলসীবাবু বললেন যে এখানকার টিউবওয়েলের জলটায় নাকি খুব খিদে হয়।
খাওয়া-দাওয়া করে বাইরের দাওয়ায় বসে তুলসীবাবুর কাছে ওঁর মাস্টারি জীবনের গল্প শুনে যখন দোতলায় শুতে এলাম। তখন ঘড়ি বলছে সাড়ে নটা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন মাঝরাত্তির। আমরা মশারি সমেত বিছানাপত্ৰ সব নিয়ে এসেছিলাম; ফেলুদা বলল ওডোমস মেখে শোব, মশারির দরকার নেই। আমি লক্ষ করেছি। গত দেড় ঘণ্টায় ও একবার কেবল গঙ্গার রান্নার প্রশংসা ছাড়া আর কোনও কথা বলেনি। এত চট করে ওকে চিন্তায় ডুবে যেতে এর আগে কখনও দেখিনি। লালমোহনবাবু বললেন ওঁর সংবর্ধনার স্পিচটা তৈরি করে রাখতে হবে, তাই উনি একটা লণ্ঠন চেয়েছেন, কারণ ঘরে বাতি জ্বলিয়ে রাখলে আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে।
আমি বিছানায় শুয়ে ফেলুদাকে একটা প্রশ্ন না করে পারলাম না।
তোমার নাম আর পেশ কী করে বলে দিল বলো তো?
আমার মনের অনেকগুলো প্রশ্নের মধ্যে ওটাও একটা রে তোপ্সে। তবে অনেক লোকের অনেক পিকিউলার ক্ষমতা থাকে যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
লালমোহনবাবু বললেন, আমাকে এভাবে স্রেফ ইগনোর করল কেন বলুন তো।
সারা গাঁয়ের লোক আপনাকে অভ্যর্থনা দিতে চলেছে, আর একটি লোক আপনার নামে হেঁয়ালি বাঁধল না বলে আপনি মুষড়ে পড়লেন?
তা হলে বোধহয় আমার নাম থেকে হেঁয়ালি হয় না তাই।
ফেলুদা দুটো ধোঁয়ার রিং ছেড়ে বলল, রক্তকরণ মুগ্ধকরণ নদীপাশে যাহা বিঁধিলে
মরণ-কেমন হল?
কীরকম, কীরকম? বলে উঠলেন লালমোহনবাবু। ফেলুদা এত ফস করে ছড়াটা বলেছে যে দুজনের কেউই ঠিকমত ধরতে পারিনি। ফেলুদা আবার বলল-রক্তবরণ মুগ্ধকরণ নদীপাশে যাহা বিঁধিলে মরণ।
দাঁড়ান, দাঁড়ান…রক্তবরণ লাল, আর মুগ্ধকরণ–
মোহন! আমি চেঁচিয়ে বলে উঠলাম।
ইয়েস, লালমোহন-কিন্তু গাঙ্গুলী?-ওহা, নদী হল গাঙ আর গুলি বিধিলে মরণ–ওঃ, ব্রিলিয়ান্ট মশাই! কী করে যে আপনার মাথায় এত আসে জানি না! আপনি থাকতে সংবর্ধনাটা আমাকে দেওয়ার কোনও মানেই হয় না। ভাল কথা, স্পিচটা তৈরি হলে একটু দেখে দেবেন তো?