গোলাপি ঘর
আমরা খুব খুউব দুষ্টুমি করলে আমাদের মা একটা অদ্ভুত ধরনের ভয় দেখাতেন আমাদের। ধরুন কিছুতেই আমাদের দস্যিগিরির সঙ্গে পেরে উঠছেন না। স্কুলের টাসক করেছি আধ-খামচা, কোনো কথা শুনছি না, বাড়ির বেচারি স্প্যানিয়েলের গায়ে টিউবের রং গুলে বেশ করে লাগিয়ে দিয়েছি, কিংবা পাশের বাড়ির মাথায় ছিট ঝড় কাকুর পেছনে লেগেছি। ঝড়কাকু রেগেমেগে নালিশ করছেন আর আমরা একটুও অনুতপ্ত না হয়ে হাসাহাসি করছি। এই রকম বাঁদরামি করলে তবেই মা ভয়টা দেখাতেন।
হঠাৎ আমাদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মুখটা ওপরে তুলে ধরলেন–যেন শূন্যে। ঘরের মধ্যেই কেউ আছে, যে মায়ের কাছে দৃশ্য কিন্তু আমাদের কাছে অদৃশ্য।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসছি। হ্যাঁ এবার আর দেরি নয়। একটু অপেক্ষা করো, জিনিসপত্রগুলো সুটকেসে ভরে নিই…কী বললে? দরকার হবে না? একটু ম্লান হাসি…তারপর…অবশ্য আমার যা যা লাগবে সেসব তো তুমি দেবেই। কেন বিশ্বাস করব না? আরে! হ্যাঁ ঠিক আছে। হ্যাঁ ওই সময়েই ভালো। নিশ্চয়! ফিরব না। ফিরব কেন?
ল্যাজামুড়া কিছুই বুঝতে পারতুম না। ঠিক যেন একটা টেলিফোনে কথা হচ্ছে। ল্যাজের দিকেরগুলো শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু মুড়োর দিকটা পাচ্ছি না। যতই কান খাড়া করি।
আমরা একেবারে জড়োসড়ো হয়ে যেতুম ভয়ে। সিঁটিয়ে যেতুম।
তারপরে মা উঠে দাঁড়াবেন। চারদিকে তাকাবেন যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। আমাদের ওপর দিয়ে চোখ চলে যাবে, অথচ আমাদের দেখবেন না। যেন এই ঘরের মধ্যে একটা অন্য ঘর জেগে উঠেছে। অন্য পৃথিবী। মা চলতে আরম্ভ করবেন, যেন ঘুমের মধ্যে চলেছেন।
এইবারে ভয়ে আমাদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হতে থাকবে। দু-জনে দুদিক থেকে ছুটে গিয়ে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরব। কোথায় যাচ্ছ? ও মা–কোথায় যাচ্ছ। আমাদেরও নিয়ে যাও।
কিন্তু ওখানে তো তোমাদের যেতে দেবে না, মা বলবেন যেন কেমন ঘোর লাগা গলায়।
তাহলে তুমিও যেয়ো না। তুমি যাবে না। কিছুতেই না।
কিন্তু তোমাদের তো আর আমাকে দরকার নেই। কী করা উচিত না উচিত, কী খাবে না খাবে, কী রকম ব্যবহার করবে না করবে-সবই তো তোমরা জেনে গেছ! তা ছাড়া তোমরা তো আমাকে ভালোও বাসছ না আর। যেসব ছেলেমেয়েরা মাকে ভালোবাসে তারা মা যা ভালোবাসেন সেইসব করে। যা বলেন তাই। যদি নিজেদের ভালো না লাগে তাও। শুধু মা খুশি হবেন বলে।
আমরাও তাই করব। তুমি যা বলবে তাই। আমাদের যদি লক্ষ্মী হতে ভালো না লাগে তা-ও লক্ষ্মী হব। ঝড়কাকার কানের কাছে ঠোঙা ফাটাব না, ভুলোর গায়ে রং দেব না। দাদার চোখ ছলছল, আমার চোখ জ্বালা করছে কান্নায়।
মা যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠবেন, হ্যাঁ, আজ যেতে পারছি না। না না ওরা লক্ষ্মী ভালো হয়ে যাবে বলছে। শুনতে পাচ্ছ তো! হ্যাঁ, যাব তো বটেই। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করো। ওদের এখনও আমাকে দরকার—বলছে। ওরা কথা দিচ্ছে, আচ্ছা এবারটি ওদের মাফ করো।
এরপর মা আবার আগের মা। আমাদের সঙ্গে খেলছেন। আলিবাবার গল্প বলছেন, গান করছেন। এইসব সময়ে মা আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরতেন, এমন শক্ত করে যেন মা নয়, আমরাই কোথাও চলে যাব বলে ভয় দেখিয়েছি। কেমন গা ছমছম করত, কিন্তু বুঝতে পারতুম মা আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে আছেন। যেন নরম পশমের কম্বলের মতো ওম-অলা সেই ভালোবাসা। নিবিড়, নিখাদ। আর সেই সময়গুলোতে আমরা যেন মায়ের হয়ে যেতুম, একলা মায়ের। আর কারও নয়। অনুভব করতুম মায়ের অনন্ত দুশ্চিন্তা, অনন্ত উষ্ণতা, গভীর আবেগ। সমস্ত জিনিসটা যেন বাস্তব জগতের নয়, কোনো ভাবজগতে ঘটছে। একেবারেই বিমূর্ত।
অন্যান্য সময়ে শত কৌতূহল সত্ত্বেও কিন্তু আমরা এ ব্যাপারটা নিয়ে মায়ের সঙ্গে স্পিকটি নট। যদি আবার মনে পড়ে যায়…যদি আবার সেই রকম…উঃ। না। একেবারেই না। কিন্তু নিজেদের মধ্যে জল্পনা চলত মাঝে মাঝেই।
কার সঙ্গে মা কথা বলেন বলতো!
নিশ্চয়ই বন্ধু-টন্ধু হবে। ম্যাজিক জানে তাই অদৃশ্য হয়ে থাকতে পারে।
কিন্তু আমরা তো ওর গলা, কথা, কিছুই শুনতে পাই না।
দাদা বিজ্ঞের মতো বলত, আমরা ছোটো তো! আমাদের কান মায়ের মতো নয়। বড়ো হলে কানের জোর বাড়বে তখন ঠিক শুনতে পাবো লোকটার গলা।
কিন্তু তুই ধরে নিচ্ছিস কেন ওটা একটা লোক! মেয়ে নয়!
এ কথার জবাব আমরা কেউই দিতে পারতুম না। যেমন যেন মনে হত, ও বিরাট কেউ, শক্তিমান, লম্বা-চওড়া–মেয়েরা অমন হয় না।
একদিন কিন্তু দাদা মুখ কালি করে স্কুল থেকে ফিরল। একটা কোণে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে চুপিচুপি বলল, আমি জেনে গেছি।
কী?
মা কার সঙ্গে কথা বলেন।
কে?—আমার গলা কাঁপছে।
মৃত্যুর দেবতা, যম।
ঝগড়া-টগড়া ভুলে আমরা দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরলুম।
কিন্তু এই মৃত্যুর দেবতা কি মানুষের সঙ্গে কথা বলে? বলতে পারে?
বলে। বলেছে। সাবিত্রী বলে একজন মেয়ে, আর নচিকেতা বলে একটা ছোট্ট ছেলের সঙ্গে বলেছে। আজই স্যার সেই গল্প করছিলেন আমাদের ক্লাসে।
ভয়ে আমরা আধমরা—যদি যমরাজের সঙ্গে মায়ের এতই জানাশোনা, যখনতখন কথা বলাবলির সম্পর্ক, তবে তো যে কোনো মুহূর্তে মা ওর কাছে চলে যেতে পারেন। ও-ও তো ডেকে নিয়ে যেতে পারে মাকে। কিছু একটা আমাদের করতেই হবে। আটকাতেই হবে। ঠিক আছে মা বিরক্ত হন এমন কিছু আর আমরা করব না। ভালো হয়ে থাকব।
চলে কিছুদিন। তারপর একদিন আবার সব গণ্ডগোল হয়ে যায়। আমার হাতে দাদার চুলের মুঠি, দাদা আমাকে বেধড়ক মেরে যাচ্ছে। আমি ওকে আঁচড়ে দিচ্ছি, ও আমাকে কামড়ে দিচ্ছে। মা আমাদের ছাড়াবার চেষ্টা করছেন, মিঠু মিঠু। চুল ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বলছি। তোমার দাদা হয় না? কান মুলে দিচ্ছ কি দাদার? রনি, ছি ছি, অমন করে মারছ কেন? মিঠু তোমার ছোটো বোন না? তোমরা কি বাচ্চা না রাক্ষস?
কিন্তু তখন দুজনেই মাথায় রাগ চড়ে বসে আছে। থামব না। আমরা কিছুতেই থামব না।
এমন সময় দেখি, মা নিথর হয়ে যাচ্ছেন, ছেড়ে দিয়েছেন আমাদের, মুখ ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে, চোখে নির্লিপ্ত দৃষ্টি।
কেন? কেন আমার ছেলে মেয়ে এত নিষ্ঠুর? কেন ওরা এত মারামারি করে? বলল, বলল আমাকে, বলো…ও, বুঝেছি ওরা আমার ভালোবাসে না। ভাই বোনকে, বোন ভাইকে কেউ কাউকে ভালোবাসে না। কিন্তু কেন? আমি তো ওদের মা! মাকে কি ভালো না বাসা…
কিছু যেন শুনলেন, তারপর বললেন, ও বুঝেছি। মা টা কিছুতে কিছু আসে যায় না। ভালোবাসে না তো ভালোবাসে না-এর কোনো কেন টেন নেই। যাব…কিন্তু ওদের ওপর আমার কিছু কর্তব্য তো এখনও রয়েই গেছে।
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলুম, মা! তুমি কার সঙ্গে কথা বলছ?—আমার গলা কাঁপছে!
ও সব তোমরা বুঝবে না।
দাদা গোঁয়ারের মতো বলল, আমি জানি। আমরা বুঝি।
কী বুঝিস? মায়ের গলায় কি সামান্য কৌতুক?
তুমি যমের সঙ্গে কথা বলল। দিনরাত ও তোমায় ডাকাডাকি করছে। আর তুমি চলে যেতে চাইছ। মানে মরে যেতে চাইছ! খারাপ মা! বিচ্ছিরি মা। বলতে বলতে দাদা ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। আমিই বা বাকি থাকি কেন?—ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকি।
দেখি মা যেন অস্বস্তিতে পড়েছেন। ঘাবড়ে গেছেন।
আরে না, না, কে বলেছে তোদের ওটা যম? দূর একদম ভুল।
ভুল না আরও কিছু। ও তোমাকে নরকে নিয়ে যাবে। বিরাট কড়ায় গরম তেলে ছ্যাঁক ছোঁক করে ভাজবে। সুষ্ঠু, সুষ্ঠু আমরা দুষ্টুমি করেছি বলে। বাজে লোক, বদমাশ।
সে কী রে? ও আমাকে ঠিক তোদেরই মতো ভালোবাসে। নরকে নিয়ে যাবে কেন? নরক বলে কিছু আছে না কি? যত্ত ভুলভাল ভাবছিস।
তাহলে কোথায়? কোথায় নিয়ে যাবে তোমায়?
মা যেন দেয়াল ভেদ করে অন্য কোনো দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। ধ্যানস্থ। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক, ভারী নরম একটা হাসির মতো কিছু খেলা করছে ঠোঁটে।
গোলাপি ঘর।
গোলাপি ঘর? কোথায়? আমরা আশ্চর্য হয়ে সমস্বরে বলি।
কোথায় তা জানি না। জানার দরকারও নেই। ঘরটা আগাগোড়া গোলাপি। ব্যস। খুব বোও নয়। খুব ছোটোও নয়, ইচ্ছে করলে তোমার দরকার মতো বাড়িয়ে নিতে পার। কিংবা কুঁচকে ছোট্টও করে নিতে পার। ছোট্ট সুন্দর ঘরখানা। একদিকে একটা সিঙ্গল খাট, তাতে গোলাপি চাদর, গোলাপি বালিশ। আর জানলা-দরজার পর্দাগুলো গোলাপিই, কিন্তু একটু গাঢ়, ধর ম্যাজেন্টা ম্যাজেন্টা। মেঝেতে একটা গোলাপি কার্পেট, তাতে গাঢ় গোলাপির ফুল লতা পাতা বোনা।
চেয়ার-টেবিল? সেগুলোও গোলাপি?
না, সেগুলো গোলাপি নয়। তবে এমন চকচকে আয়নার মতো পালিশ যে ঘরের সব গোলাপির ছায়া পড়ে পড়ে গোলাপিই মনে হয়। আর আছে একটা ম্যাজেন্টা শেডওয়ালা টেবিল-বাতি। জ্বাললে এত সুন্দর হয়ে যায় না ঘরখানা। চমৎকার একেবারে। …মার মুখে দিব্য আলো।
কী করে খাবে ওখানে?
কোনো ব্যাপারই না। একটা ছোট্ট রান্নাঘরও তো আছে, সেখানে গোলাপি উনুনে ভাত-ডাল-আর একটা সেদ্ধ কিছু করে নেব, তারপর গোলাপি কাচের প্লেটে করে খেয়ে নেব। তোরা তো জানিস আমার তোদের মতো খাওয়ার ল্যাঠা নেই।
আর মাছ? আর উচ্ছে। আমি বলে উঠি, আমার চোখ এইবারে চিকচিক করছে। মা যে আমাদের বিচ্ছিরি-লাগা এই দুটো জিনিস ভীষণ ভালোবাসেন। তার কী হবে?
সে যদি ইচ্ছে হয়, ঠিক এসে যাবে।–মা নিশ্চিন্তে উত্তর দেন।
আমরাও যাব মা, আমাদেরও নিয়ে চলো। আমাদেরও,–গোলাপি ঘরের স্বপ্নে কুঁদ হয়ে আমরা বলি।
কিন্তু ওখানে তো ছোটোদের, ছোটোদের কেন, কাউকেই নিয়ে যাওয়া যায় না। ও ঘর শুধু আমার, একা আমার। ওখানে কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই, দুঃখ নেই, ভয় নেই। খালি গান, নদী, পাহাড়, জঙ্গল, সবুজ মাঠ।…
এইবারে ধরে ফেলেছি। আমাদের সঙ্গে চালাকি, না?
বলি, এই যে বললে একটা ছোট্ট ঘর। ওর মধ্যে পাহাড়, জঙ্গল, মাঠ নদী এসব ধরবে কী করে? সব মিছে কথা।…
মায়ের অঙ্গ থেকে এখন রহস্য ঝরে ঝরে পড়ছে, মুখে একটা আবিষ্ট হাসি। বললেন, বুঝতে পারছিস না মিঠু। ওইটেই তো ম্যাজিক ঘরটার। তুমি যা-যা চাও, যা-যা ভালোবাসো সব, স-ব ওখানে পাবে।
আমরা যখন বড়ো হয়ে যাব, অনেক বড়, তখনও ওখানে যেতে পারব না?
নিশ্চয়ই পারবি। কিন্তু সেটা অন্য ঘর। ঘর আকাশ-নীল, কিংবা কচি কলাপাতা বা পেস্তার মতো সবুজ, হাতির দাঁতের মতো বা খুব হালকা বেগুনিও হতে পারে। কিন্তু গোলাপি ঘরটা শুধু আমার, একা আমার। ওই রংটা, আমার নিজস্ব রংটা আর কোথাও লাগানো যাবে না। ওই ঘরটাতেও কাউকে নিয়ে যাওয়া যায় না।
ছেলেমেয়েকেও না!
না।
আমরা বিমর্ষ মুখে চুপ করে যাই। একটু পরে মিয়োনো গলায় জিগ্যেস করি, ও লোকটা কে, যার সঙ্গে তুমি কথা বলো?
কিন্তু যতবার জিগ্যেস করি, মা শুধু আমাদের বুকের মধ্যে টেনে আদর করেন, চুমো খান, উত্তর দেন না।
আজ এতদিন পর, বহু রুক্ষ বছরের ভয়ংকর লড়াই, ভয়ংকরতম যন্ত্রণা, একটা গোটা জীবন-ভরতি বিদ্বিষ্ট মুখপ্রবাহ এবং প্রাণ-অবশ-করা লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে পথ চলবার পর, মা যখন আর ইহজগতে নেই, যখন আমি আমার সেই নীল ঘরটা পেয়ে গেছি—আকাশের মতো নীল ঠিক যেমনটি মা বলেছিলেন, যখন জেনে গেছি এই ঘর ইচ্ছে করলেও কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না, তখন অর্থাৎ এখন বুঝতে পারি মা কার সঙ্গে অমন কাতর ভরসায় কথা বলতেন। দেবতা ঠিকই। কিন্তু মৃত্যুর নয়। জীবনের।