এক যুবতীর বৈধব্য
লাল ল্যান্ডরোভার গাড়িটি জ্যামে আটকে যাচ্ছিল বার বার। গতি উত্তরে। কর্নেল বিডন স্ট্রিটের কাছে পৌঁছে বাঁ হাতে জ্যাকেটের ভেতর থেকে ছোট্ট নোট বই বের করে ঠিকানাটি দেখে নিলেন। হাথিয়াগড়ে প্রিয়দর্শী হোটেলে তপেশের লেখা ঠিকানা : সুশোভন রায়, ৫/১ গোবিন্দ নস্কর লেন। কলকাতা-৬।
একজন লোককে গলিটার কথা জিজ্ঞেস করলে বাৎলে দিল। গলিটা ঘিঞ্জি নয়। ৫/১ নম্বরে একতালা একটা বাড়ি। দরজায় কড়া নাড়লে এক প্রৌঢ়া উঁকি দিলেন। কর্নেলকে দেখে একটু হকচকিয়েই গেলেন যেন। তাকিয়ে রইলেন। কর্নেল বললেন, এখানে কি সুশোভন রায় নামে কেউ থাকেন?
প্রৌঢ়া চমকে উঠলেন। তারপর ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। কর্নেলের মনে হলো, আচমকা একটা জোর ধাক্কা খেয়েছেন ভদ্রমহিলা। কর্নেল একটু হেসে বললেন, সুশোভন সম্পর্কে আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
প্রৌঢ়া কাঁপা কাঁপা স্বরে কষ্টে বললেন, কী কথা?
এ ভাবে তো বলা যাবে না। একটা বসা দরকার।
প্রৌঢ়ার পেছনে একটি যুবতী এসে দাঁড়াল। আস্তে বলল, মা, ওঁকে আসতে দাও।
প্রৌঢ়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। তাঁকে যুবতীটি ঠেলে ভেতরের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে এল। বলল, আপনি ভেতরে আসুন।
ঘরে শুধু একটা জীর্ণ টেবিল, তাকে কিছু বই, দুটো নড়বড়ে চেয়ার এবং একপাশে একটা তক্তাপোশ। গুটোনো বিছানা। কর্নেল চেয়ারে বসলে যুবতী দরজা বন্ধ করে দিল।
এবার কর্নেলের মনে হলো, একে, কোথায় যেন দেখেছেন। হুঁ, অরিজিৎ লাহিড়ী তপেশের বিছানার তলায় যে মেয়েটির ছবি পেয়েছেন, সেই বটে। তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক চোখে, কিন্তু মুখের ভাবে বিষাদ আছে। কষ্টের ছাপ আছে। কর্নেল বললেন, সুশোভন–
বাধা দিয়ে যুবতী বলল, আপনি কি পুলিশ অফিসার?
কর্নেল হাসলেন।…মোটেও না। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
যুবতীর মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটল না দেখে কর্নেল বুঝলেন সে এই নামটির সঙ্গে পরিচিত নয়। সে বলল, কী কথা আছে দাদার সম্পর্কে?
বলছি। সুশোভনবাবু কি বেরিয়েছেন কোথাও?
যুবতীর মুখে কষ্টের ভাব ফুটে উঠল। আস্তে বলল, দাদাকে আপনি চিনতেন?
না।
দাদা নাইনটিন সেভেনটির জুন মাসে মারা গেছে।
মাই গড! কর্নেল চমকে উঠলেন। মারা গেছেন? অসুখ হয়েছিল। নাকি–
দাদাকে কারা খুন করেছিল। হাসপাতালে-হাসপাতালে খুঁজে শেষে নীলরতননের মর্গে দাদার বডি দেখতে পাই।
পিঠে স্ট্যাব করা হয়েছিল কি? বডি নেকেড অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল?
যুবতী চমকে উঠেছিল। সামলে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর বলল, আপনি তাহলে পুলিস অফিসার।
কর্নেল একটু হাসলেন।…না।
তাহলে কেমন করে জানলেন—
এক মিনিট। তুমি বলছি, রাগ কোরো না। তোমার নাম?
কেয়া রায়।
কেয়া, এই আমার পরিচয়। বলে কর্নেল তাকে তার কার্ড দিলেন।
কেয়া কার্ডটি দেখে নিয়ে তাকাল। ন্যাচারালিস্ট অ্যান্ড প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আপনি দাদার সম্পর্কে কী ইনভেস্টিগেট করছেন?
কর্নেল সে-প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, কেয়া, তুমি তপেশ বসাক নামে কাউকে চেনো?
কেয়ার চোখে আবার চমক খেলল। আবার ঠোঁট কামড়ে ধরল। তার ধরা গলায় বলল, না। কে তপেশ? ও নামে কাউকে চিনি না।
আজকের কাগজে তার ছবি বেরিয়েছে। বিহারের হাথিয়াগড় হোটেলে সে মুখে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে সুইসাইড করেছে।
কেয়া মুখ নামাল। চল্লিশ ওয়াটের নিষ্প্রভ আলোয় কর্নেল লক্ষ্য করলেন, তার পায়ের নিচে শাড়ির পাড় কঁপছে। কর্নেল আস্তে অথচ দৃঢ় স্বরে বললেন, আমি তোমার দাদার খুনীদের ধরিয়ে দিতে চাই, কেয়া। প্লিজ হেল্প মি!
কেয়া মুখ তুলল। ভিজে চোখ।
তপেশের আসল নাম কী ছিল, কেয়া?
জানি না।
তুমি জানো! কারণ তপেশের ঘরে তোমার ছবি খুঁজে পাওয়া গেছে।
কেয়া দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল। তারপর চেয়ারে বসে পড়ল। একটু পরে সে আত্মসম্বরণ করে মুখ তুলল। শাড়িতে চোখ মুছে বলল, আমি মিথ্যা বলিনি। ওকে আমি তপেশ নামেই জানতাম। তবে দাদা বলত, ওর নাকি আরও কিছ ছদ্মনাম আছে, তখন আমার বয়স সতের-আঠারো মোটে। এ নিয়ে প্রশ্ন করার কথা মাথায় আসত না। পরে–মানে, দাদার মৃত্যুর বছর তিন-চার বাদে ও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। আমি ওকে তপেশ বলেই জানতাম।
কিছু মনে কোরো না ডার্লিং-তুমি তপেশকে ভালবাসতে?
কেয়া চুপ করে রইল। তোমরা কি বিয়ে করেছিলে?
কেয়া মাথাটা একটু দোলাল। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, মা ওকে পছন্দ করতেন না। তা ছাড়া দাদার খুন হওয়ার পিছনে তপেশের হাত আছে বলে সন্দেহ করতেন। তাই মাকে জানাইনি।
গোপনে রেজেস্ট্রি ম্যারেজ হয়েছিল?
হুঁ।
তোমার বাবা বেঁচে নেই?
আমার দুবছর বয়সে বাবা মারা যান।
এটা কি তোমাদের নিজের বাড়ি?
না ভাড়ার। তবে—
বলো!
লেকটাউনে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। আগামী মাসে সেখানে চলে যাব আমরা।
তুমি কি চাকরি কর?
করি।
কোথায়?
কেয়ার ভিজে চোখ জ্বলে উঠল।…বাবা আমার বিয়ের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ডে আর এল আই সিতে পলিসি করে টাকা রেখে গিয়েছিলেন। মায়ের গয়না ছিল। টুরুম ফ্ল্যাট কেনা কি অসম্ভব?
কর্নেল হাসলেন, সরি! সে উদ্দেশ্যে কিছু জিগ্যেস করিনি ডার্লিং! জাস্ট কৌতূহল। বাই দা বাই, তুমি শ্যামলকান্তি মজুমদার নামে কাউকে চেনো?
কেয়া শক্ত গলায় বলল, না।
সুভদ্র সিং নামে কাউকে?
না।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এই শোকদুঃখের সময় তোমাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, কেয়া! আচ্ছা, চলি।
কেয়া বলল, এসব ব্যাপারে আপনি জানতে এসেছেন কেন, বলবেন কি?
পরে যথাসময়ে যোগাযোগ করব। বলে কর্নেল নিজেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।