গোধূলী বেলা
বহু বছর পর অনির্বান গ্ৰামের বাড়িতে এলো।
কোলকাতা থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টার পথ।
তবুও আসা হয়নি বহুবছর।
কোলকাতায় চাকরি হওয়ার পরে মাত্র দু চারবার এসেছিল।
তখন কি ভেবেছিল আবার এই দেশের বাড়িতেই ফিরে আসতে হবে একা সঙ্গীহীন হয়ে।
কোলকাতায় ধনী পরিবারের মেয়ের সাথে প্রেম করে বিয়ে করলো বাবার অনুমতি ছাড়াই।
বড় অফিসার হয়ে সুন্দর সাজানো ফ্লাট, গাড়ি সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে সুখের সংসার। স্ত্রীকে নিয়ে কখনো দেশের বাড়িতে আসেনি। গ্ৰামের ভাঙাচোরা বেহাল অবস্থা স্ত্রীকে দেখাতে লজ্জা পেয়েছিল।
বাবার সাথে যোগাযোগ প্রায় ছিলইনা। মাঝে মাঝে বাবার খবর নিত। সবসময় বাবা বলতো আমি খুব ভালো আছি। বাবা ছিল স্কুল মাস্টার। অবসর ভাতা যা পেতো তাতেই চলে যেত।
আজ এতবছর পর নিজের দেশের বাড়ির মাটির উঠোনে দাঁড়িয়ে,
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখছে নিজের জন্মস্থান।
শেষ আসার দিনটা মনে পরছে আজ। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে এসেছিল! অনিল কাকার ফোন পেয়ে।
অনিল কাকা ছিলেন বাবার খুব কাছের মানুষ। পাশাপাশি থাকতো। ওকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল। অনিল কাকার একটি মেয়ে ছিল তার নাম মল্লিকা।
ওর থেকে চার বছরের ছোট।
ছোট থেকে মল্লিকার সাথে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল অনির্বানের। দুজনের মধ্যে খুব ভালো বোঝাপড়া ছিল। অনির্বান চাকরি নিয়ে কোলকাতা চলে যাবার দিন মল্লিকার চোখে জল দেখেছিল।
মল্লিকা বলেছিল আবার ফিরে আসবে তো! অনির্বান সেদিন চমকে উঠে বলেছিল, যদি কখনো ফিরি, তুমি তখনও কি থাকবে আমার পথ চেয়ে! মল্লিকা আনত মুখে বলেছিল, হয়তো থাকবো অনিদা; বলা যায়না কিছু। অনির্বান ঠাট্টা করে বলেছিল ঠিক আছে কথাটা যেন মনে থাকে।
কিন্তু, তখন বুঝতেই পারেনি কখনো বন্ধুত্ব ছাড়া অন্য কিছু!
আজ যেন মনে মনে বুঝতে পারছে, বহুদিন পর নিজের বাবার ভিটেতে পা রেখে। অজানা একটা আকর্ষণ অনুভব করছে।
সন্ধ্যার স্তব্ধতায় ওই দূরের জামরুল, কাঁঠাল, গাছে পাখিরা ফিরছে নীড়ে। আজ যেন মনে হচ্ছে ওর, ও ফিরেছে সারাদিনের ক্লান্তির পর নিজ নীড়ে!
মনে পড়লো, বাবার ভীষণ জেদী দৃঢ় চরিত্র। কিছুতেই কোলকাতায় নিয়ে যেতে পারেনি। হঠাৎ একদিন,
অনিল কাকার ফোনে জানতে পেরেছিল বাবার মৃত্যু সংবাদ।
অনিল কাকা এও জানিয়েছিলেন পারলে তুমি একাই এসো। তোমার বাবার মোটেও ইচ্ছে ছিলনা তার মৃত্যু সংবাদ তুমি পাও; তবুও আমি না জানিয়ে পারলাম না। আবার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
মা.…চলে গিয়েছিল অনেক আগেই। তখন সবেমাত্র অনির্বান কোলকাতার চাকরিটা পেয়েছে।
মা চলে যাওয়ার পরই বাবা মানসিক ভাবে ভেঙে পরেছিলেন।
অনির্বান চেষ্টা করেছিল বাবাকে কোলকাতায় নিয়ে যাবার জন্য কিন্তু বাবা যায়নি। নিজের ভিটে ছেড়ে কোথাও যাবেনা।
বাবার প্রবল ইচ্ছে ছিল অনিল কাকার মেয়ের সাথে ওর বিয়ে হোক।
কিন্তু তখন ও বাবার ইচ্ছের দাম দেয়নি। আঠাশ বছরের সুদর্শন চেহারার এক যুবক;
সে কখনো গ্ৰাম্য পরিবেশের এক শ্যামাঙ্গীকে ঘরণী করতে পারে?
তাছাড়া মল্লিকাকে সেই ভাবে কখনো ভাবেইনি।
ভালো চাকরি, সামনে উন্নত ভবিষ্যৎ এসবের মর্ম বাবা কি বোঝে!!
আজকে নিজের জন্মস্থানে দাঁড়িয়ে দুচোখে জলের বিন্দু।
আজ এই অবসর জীবনে এসে অতীতের স্মৃতিগুলো ভীষণ নাড়া দিচ্ছে।
পরিবারের সবাই চলে গেছে দূরে।
শিক্ষিত বড়োলোর মেয়েকে ভালবেসে বিয়ে করেছিল ঠিকই, কিন্তু সংসার সুখের ছিলনা। প্রচুর প্রাচুর্য দিয়ে সাজিয়ে ছিল সংসার। কিন্তু, তখন বুঝেছিল মনের ঘরটা সাজানো হয়নি ঠিকমত। একটা অন্ধ মোহের দাম্ভিকতায় জীবনের এতোগুলো বছর কাটিয়ে দিল।
একটি পুত্র সন্তান তাকে মানুষের মতো মানুষ করার জন্য কনভেন্টে রেখে মানুষ করলো। পরবর্তী কালে সেই সন্তান বিদেশের জল বাতাসে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায জন্য দেশ ছাড়লো।
গত বছর স্ত্রীকেও মহামারীতে…..কেড়ে নিল। এখন জীবন সায়ান্থে কেউ নেই পাশে। আবার ফিরে এলো বাবার আশ্রয়ে। এখন বুঝতে পারলো একটি নিরাপদ আশ্রয় এখনো আছে সেটা এই গ্ৰামে, নিজের জন্মস্থানে।
সন্ধ্যার গোধুলী রঙে চারিদিকে চেয়ে মনটা ভরে যাচ্ছে অনির্বানের।
মনে পড়ছে ছোট বেলার কত স্মৃতি।
নাহ্ কিছুই তো তেমন বদলায়নি!!
যেমন দেখে গিয়েছিল নিজের এক চিলতে শান্তির নীড় সেতো তেমনি আছে আজও!!
শুধু বদলেছে কিছু সময় যা আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবেনা। মায়ের আদর, বাবার স্নেহ, প্রতিবেশী অনিল কাকার শুভকামনা;
জীবনের উন্নতির করতে গিয়ে জীবনের আসল দিকটাই হারিয়ে গেছে কখন একটু একটু করে!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুকের ভেতর থেকে।
গোধুলীর সোনালী রঙের প্রলেপ ছড়ানো নিজের গ্ৰামখানি বহুদিন এমন করে প্রাণ ভরে দেখা হয়নি।
এমন সৌন্দর্য ভরা সবুজের সমারহো! নাড়কোল, তালের সারিতে গ্ৰামখানি যেন ওকে ভর্তসনা করছে।
একঝলক দখিনা বাতাসের মতো–
হঠাৎ একটি মধ্য বয়সী মহিলা একটি লন্ঠন নিয়ে এগিয়ে এসে অনির্বানের মুখের ওপর তুলে ধরে জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?
অনির্বান অপলক গ্ৰাম্য বিধবা যৌবনোর্ধ সৌম্য বধুটিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।
কিছু হারিয়ে ফেলা স্মৃতি যেন সামনে দৃশ্যমান।
সম্বিত ফিরতেই লজ্জিত হয়ে নিজের পরিচয় জানায়।
মহিলাটি বললো, আমিই আপনার অনিল কাকার একমাত্র মেয়ে! বিয়ের এক বছরের মধ্যে বিধবা হয়ে এখানেই থাকি।
আপনার বাবার আর আমার বাবার এই ভিটে পাহারা দিই!
অনির্বান অপরাধীর মতো কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে চেয়ে আছে ওই মধ্য বয়সী লক্ষী স্বরূপা মহিলাটির দিকে।
অস্পষ্ট স্বরে শুধু একটি বাক্য উচ্চারণ করলো, মল্লিকা……
শুভ্রবসনা মহিলাটি আশ্বাস দিয়ে বললো, মনে আছে সেদিনের কথা?
কথা দিয়েছিলাম -আমি অপেক্ষায় থাকবো!!
অনির্বান তমসা ঘেরা গোধুলী বেলায় মল্লিকার ঘোমটা টানা মুখটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করছে।
বলছে, সত্যিই তুমি থাকবে আমি ভাবতেই পারিনি। মল্লিকা কম্পিত কন্ঠে বললো কথা দিয়েছিলাম আমি, বিধাতা হয়তো অলক্ষে শুনেছিলেন।
এখানে থাকতে আপনার কোনো অসুবিধা হবেনা আমিতো আছি!
আমিতো আছি!!!!
এই একটি কথাই যথেষ্ট মনে হলো অনির্বানের।
অনির্বান তখন উদাসীন!
ভাবছে– –
সকালের মল্লিকা সন্ধ্যায় এখনো এতো প্রস্ফুটিত!!
যার সাথে ছাদনা তলায় দেখা হোলনা আজ সায়ান্থে এসে তারই সঙ্গে শুভদৃষ্টি হলো!!
অনেক সুন্দর একটি লেখা পড়লাম খুব ভালো লাগলো।