Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গুরুচণ্ডালী কথা || Samaresh Majumdar

গুরুচণ্ডালী কথা || Samaresh Majumdar

সেই দ্বিপ্রহরবেলা হইতে সমগ্র শহর এবং নিকটস্থ গ্রামগুলি এই নদীচরে যেন ভাঙিয়া পড়িতেছে। আজ কৃষ্ণা চতুর্থী, সারারাত্রিব্যাপী মেলা এবং প্রত্যুষে পুণ্যস্নান।

শহরটিকে মালার মতো জড়াইয়া যে বাঁধটি তৈয়ারি হইয়াছে, নদী হইতে তাহার দূরত্ব এখন প্রায় এক ক্রোশ। এই বিস্তীর্ণ বালুকাবেলায় কাশ এবং খড়ের জঙ্গলে শৃগাল ও খরগোশ নিরাপদে। বিচরণ করিত যতদিন বর্ষার আগমন না হয়। এখন শীতকাল। শীর্ণকায় নদীর চেহারা দেখিয়া। ইহার তাণ্ডব করিবার ক্ষমতা বোঝা দুঃসাধ্য। কিন্তু স্রোতের তীব্রতায় বিদ্যুতের চমক আছে। এই বালুচরে প্রতি বৎসরের মতো আজও মেলা বসিয়াছে। অসংখ্য হ্যাজাক এবং লণ্ঠনের আলোয়। চতুর্দিক দিনের মতো পরিষ্কার। অবশ্যই মেলার আশেপাশে যেখানে হ্যাজাকের আলো পৌঁছায়। নাই সেখানে রহস্যময় আবহাওয়া সৃষ্টি হইয়াছে। বিরক্ত শৃগালেরা স্থানচ্যুত হইয়া অদূরে দাঁড়াইয়া গলা খোলায় সেই রহস্য আরও বাড়িয়া গিয়াছে। প্রবাদ আছে, ব্রাহ্মমুহূর্তে এই নদীর হিমশীতল জলে অঙ্গ ডুবাইয়া পাপস্থালন করিলে পরজন্মে মোক্ষলাভ হয়। মোক্ষের আশা বড় মারাত্মক। যে জলে অঙ্গুলি স্পর্শ করিলে তাহার অস্তিত্ব অনেকক্ষণ উপলব্ধি হয় না, আজ। রাত্রিশেষে সেই জলে বেগুনটুলির বড় মাসি পটলদাসী পাপস্থালন করিবেন। ক্ষতের সন্ধান পাইলে যা হয়, মাছির সংখ্যা গণনার ক্ষমতাকে দুয়ো দিতেছে।

সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে অনেকক্ষণ। আকাশে ঈষৎ মেঘ থাকায় তারাদের দেখা যাইতেছে না। এই অন্ধকারে দুই ব্যক্তি বাঁধের ওপর দিয়ে নিম্নস্বরে বাক্যালাপ করিতে-করিতে আসিতেছিল। শশ্রুমণ্ডিত মুখ, আলখাল্লা জাতীয় পোশাক, দীর্ঘ কেশ লাল ফিতার বন্ধনে আবদ্ধ। তাহার সঙ্গী খর্বকায়, চর্বিযুক্ত এবং দেখিলেই বোঝা যায়, আরামপ্রিয় মানুষ। বাঁধটা বাঁক নিতেই তাহারা। সমুখে মেলার আলোকরাশি দেখিতে পাইল। অনুচ্চ গলায় প্রথম ব্যক্তি বলিল, মনে হয়, আজ যদি বিফল হও তাহলে তোমার মুখদর্শন করব না।

দ্বিতীয় ব্যক্তি বলিল, গুরুদেব, আপনার আদেশ শিরোধার্য। কিন্তু যদি অপরাধ না নেন তো বলি, এত টাকার কী প্রয়োজন?

গুরুদেব বলিল, গদাধর, পৃথিবীতে ঈশ্বরের বিকল্প হল টাকা। ঈশ্বরের আশায় তিরিশ বছর কাটালুম, বদলে পেলুম তোমার মতো মূর্খ শিষ্য। তাই ঈশ্বরের বিকল্প যখন চাইছি তখন একটু বুদ্ধিমান হওয়ার চেষ্টা করো!

গদাধর করুণ গলায় বলিল, আপনি আমার সঙ্গে থাকবেন তো?

গুরুদেব বলিল, থাকব। তবে নিজের দোষে যদি বিপদে পড়ো তবে আমার কাছে সাহায্য প্রত্যাশা করো না।

গদাধর মিনমিন করিল, পাপের ভয়ে বুকটা ধড়ফড় করে যে।

গুরুদেব ধমক দিলেন, মূর্খ, ঈশ্বর এবং তার বিকল্প অন্বেষণে কোনও পাপ নেই। মন শক্ত করো।

গদাধর কহিল, যথা আজ্ঞা। তারপর জনস্রোতে নিজেকে মিশাইয়া দিল।

একদিনের উৎসব বলিয়া বিদ্যুৎ-এর ব্যবস্থা নাই। তা ছাড়া এই অনুষ্ঠান ও মেলা আধা-অন্ধকারে ভালো খোলে বলিয়াই মানুষের ধারণা। গদাধর এই শহরে নবাগত, মেলায় তো বটেই। সে লক্ষ করিতেছিল তাহার আশেপাশে যাহারা হাঁটিতেছে সবাই পশ্চিমা শ্রেণির শ্রমিক সম্প্রদায়ের। ধর্মবিশ্বাস ইহাদের প্রবল। এই দরিদ্র মানুষগুলির টাকাকড়ি আত্মসাৎ করিবার সব রকম কৌশল গুরুদেব তাহাকে শিখাইয়াছেন। কিন্তু গদাধরের বাসনা মারিতে হইলে হাতি মারিবে, যদিও গুরুদেব বলিয়াছেন তাহাতে বিপদ বেশি।

বরং এইসব গরিবের ঘাড় মটকানো সহজ কাজ। কিন্তু সহজ কাজে তাহার প্রবৃত্তি নাই।

মেলায় আসিতে হইলে দীর্ঘ বালুকাপথ হাঁটিয়া আসিতে হয়। স্বভাবতই এই পথে অলো দেওয়া সম্ভব হয় নাই। লাল পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকাইয়া গদাধর জিনিসগুলির অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হইল। এই প্রায়ান্ধকারে উহা প্রয়োগ করিলে কেমন হয়? কিন্তু মানুষজনের ব্যস্ততা এবং অন্ধকারে ইহার রূপ কেমন খুলিবে বুঝিতে না পারিয়া সে মেলার দিকে হাঁটিতে লাগিল। টায়ারের চটিতে বালি ঢুকিয়া যাইতেছে। উত্তরবঙ্গের জলকাদায় ঘুরিয়া-ঘুরিয়া তাহার পায়ে নব্য হাজার আগমন হইয়াছে, এক্ষণে তাহাতে বালি প্রবেশ করায় যন্ত্রণায় গদাধর ল্যাংচাইয়া হাঁটিতে লাগিল।

কাননবালার গান বাজিতেছে চোঙের গানে। একজন সুদেহী পুরুষ পায়ে ঘুঙুর বাঁধিয়া সেই গানের তালে বালির ওপর নাচিয়া চানাচুর বিক্রি করিতেছে। কিছু গরিব রাজবংশি এবং বিহারি তাহাকে ঘিরিয়া আমোদ করিতেছে। জায়গাটায় ভিড় বেশি, গদাধর সরিয়া আসিল। চতুর্দিকে এখন বিভিন্ন জিনিসের দোকান। নিতান্ত সাধারণ জিনিসকে মেলায় কত আকর্ষণীয় বলিয়া বোধ হয়। বিশাল-বিশাল বপু মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা দলবদ্ধভাবে এক জায়গায় নামগান করিতেছে।

মেলায় ঘুরিতে-ঘুরিতে গদাধরের ক্ষুধার উদ্রেক হইল। নদীর শরীর ছুঁইয়া এখন বাতাস বহিতে শুরু করিতেছে। ফলে শীত জব্বর বাড়িয়াছে। গদাধর তাহার লাল পাঞ্জাবির তলায় ছেঁড়া সোয়েটার এবং ওপরে র‍্যা পার চাপাইয়া ঠকঠক করিয়া কাঁপিতে-কাঁপিতে খাবারের দোকানের দিকে চলিল। মাঝে-মাঝে বিরাট অগ্নিকুণ্ড জ্বালাইয়া মানুষজন তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া আছে। এই ঠান্ডায় সেইগুলিকে মাতৃস্নেহের চেয়ে মনোরম মনে হইতেছে।

গরম-গরম পুরি ভাজা হইতেছে দেখিয়া গদাধর দাঁড়াইয়া পড়িল। সারি-সারি খাবারের দোকান এই তল্লাটে। মানুষজন হা-ঘরের ন্যায় তাহা সাবাড় করিতেছে। গদাধর পকেটে হাত ঢুকাইয়া। দুইটি আধুলির সন্ধান পাইল। অনেক ভাবিয়া দোকানিকে চারটি পুরি তরকারি দিতে বলিয়া সে আসনের দিকে তাকাইল। রাত এখন কত বোঝা যায় না। অথচ আজ এই রাত্রির মধ্যে এক হাজার টাকা তুলিতে হইবে। বিশ্বস্তশিষ্যের ন্যায় সে গুরু-আদেশ পালন করিবে–দীক্ষার সময় এই অঙ্গীকার যখন করিয়াছে তখন আজও তাহার অন্যথা হইবে না।

গরম পুরি পেটে পড়িতে শীত কিঞ্চিৎ কমিল। গদাধরের ইচ্ছে হইল গুরুদেবকে ডাকিয়া দুই চারিটা পুরি সেবা করায় কিন্তু চতুর্দিকে নজর করিয়া তাঁহাকে দেখিতে পাইল না। হঠাৎ তাহার নজর এক ব্যক্তির ওপর গিয়া পড়িল। দৈর্ঘ্যে মানুষটি গদাধরের সমান। তবে সামান্য কৃশ। আচার আচরণ দেখিয়া সেই সব লক্ষণের সঙ্গে হুবহু মিলিয়া যায়। গুরুদেব শিকারের যেসব বর্ণনা দিয়াছেন ইনি তাহার প্রথম পর্যায়ে পড়েন। গোবেচারার মতন এপাশ-ওপাশ চাহিয়া লোকটি গদাধরের পাশে দাঁড়াইয়া দোকানিকে শুধাইল, গরম-গরম দুটো নুচি ভাজ দিকিনি। তারপর গদাধরকে প্রশ্ন করিল, হ্যাঁ মশাই, কেমন খাচ্ছেন?

মুখভরতি খাবার থাকায় ঘাড় নাড়িয়া গদাধর খাদ্যের উৎকৃষ্টতা জানাইল। লোকটির বোধহয় মুখে জল আসিয়া গিয়াছিল, দোকানিকে আর একবার তাড়া দিয়া বলিল, নুচি খেয়েছিলাম একবার কলকাতায়। বাগবাজারের নবীন ময়রার দোকানে, আহা! তারপর পুরি তরকারি গলাধঃকরণ করিতে-করিতে বলিল, তা, মশায় কি মেলা ঘুরতে এসেছেন?

গদাধর ঘাড় নাড়িল, হ্যাঁ।

লোকটি বলিল, এমন কিছু মেলা নয়, বাংলাদেশের সব বড়-বড় মেলা আমি দেখেছি, এ তো নস্যি। তবে শুনছি সকালবেলায় এখানে নাকি একটা কেলো হবে–তাই আসা-হেঁ–হেঁ!

গদাধর অবাক হইল, কী হবে?

লোকটি বলিল, জানেন না দেখছি। আরে মশাই, এখানকার শহরে কে এক নামকরা বেবুশ্যে আছে–পটলদাসী না কি যেন–তিনি নদীর বুকে বসে তার পাপের কথা বলবেন, বুঝলেন?

গদাধর ইহা জানিত না, শুনিয়া হাঁ করিয়া থাকিল।

লোকটি ফিসফিস করিল, তাই শুনে চলে এলাম। পটলদাসী যখন এসেছে তখন তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কি বাদ গেছে? সন্ধে ইস্তক খুঁজে বেড়াচ্ছি, এখন উত্তরদিকটা বাকি আছেন। জানেন নাকি?

গদাধর ঘাড় নাড়িল। তাহার মাথায় ব্যাপারটি স্পষ্ট প্রবেশ করে নাই।

সে বলিল, নদীর বুকে বসে পাপের কথা বলবে কেন?

লোকটি কিছু জবাব দেওয়ার পূর্বে দোকানি বেশ গর্বের সঙ্গে বলিল, কাল ব্রাহ্মমুহূর্তে যদি কেউ পবিত্র হয়ে নিজের মন পরিষ্কার করতে পারে তবে অক্ষয় পুণ্যলাভ হয়।

লোকটি বলিল, শুনলেন তো মশায়। জব্বর জমবে মনে হচ্ছে। বলিয়া নিঃশব্দে শরীর নাচাইয়া হাসিতে লাগিল।

গদাধর গুরুদেবকে স্মরণ করিল। ইহার আচরণে আর সন্দেহের অবকাশনাই। লক্ষণগুলি হুবহু মিলিয়া গিয়াছে। এই সব চালবাজ প্রমোদ-সন্ধানীরা উত্তম শিকার। পকেটে হাত ঢুকাইয়া গদাধর পয়সা বাহির করিল তারপর লোকটির আপত্তি সত্বেও দুজনের খাবারের দাম মিটাইয়া। দিল। লোকটি বলিল, হে-হেঁ মশায়, আপনি আমাকে ঋণী করলেন। তা ভালোই হল, একা-একা ভালো লাগছিল না, আপনার সঙ্গ পেলাম। চলুন এবার উত্তরদিকটা দেখা যাক।

উত্তরদিকে জনসমাগম কম, মানুষজন দ্রুত হাঁটাচলা করিতেছে। একটি চুড়ির দোকানের সামনে শেষ হ্যাজাকের আলো জ্বলিতেছে। বাঁ-দিকে বেশ ঘন খড়ের জঙ্গল। শেয়ালদের ডাক মাঝে মাঝে অন্ধকারকে রহস্যময় করিয়া তুলিতেছে। বাঁ-দিকে একটা চালাঘর, সেখান হইতে প্রচণ্ড হরিনাম ভাসিয়া আসিতেছে। গদাধরেরা সেইদিকে চলিল। ওপরের চ্যাটাই-এর ছাউনি চারটি খুঁটির ওপর আচ্ছাদনের কাজ করিতেছে। তলায় অগ্নিকুণ্ডের চারপাশে গোল হইয়া একদল রোগা-রোগা মানুষ খোল বাজাইয়া অঙ্গ দোলাইয়া হরিনাম করিতেছে। হঠাৎ গদাধরের সঙ্গী তাহার কোমরে আঙুল দিয়া খোঁচাইল, আগুনের ডানদিকে নির্ঘাত পটলদাসী।

সহসা গদাধরের নজরে পড়িল। লালপাড় গেরুয়া রঙের শাড়ি পড়িয়া একজন প্রৌঢ়া অগ্নিকুণ্ডের পাশে টানটান হইয়া বাসিয়া আছেন। তাঁহার দুই হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে কোলের ওপর ন্যস্ত, চক্ষু মুদ্রিত, কপালে বৃহৎ সিঁদুরের টিপ জ্বলজ্বল করিতেছে। আগুনের লাল আভা তাহার গৌরাঙ্গে পড়িয়া কেমন হইয়া যাইতেছে। এই মুহূর্তে তাঁহাকে এই পৃথিবীর মানবী বলিয়া বোধ হইতেছে না। যৌবন চলিয়া গেলেও সূর্যাস্তের পূর্বের রক্তাভাটুকু কি মায়ায় শরীরের হিমঘরে রাখিয়াছে তাহা না দেখিলে বোঝা যায় না।

লোকটি বলিল, হেঁ-হেঁ মশায়, চাবুক দেখতে, যৌবনে কেমন টুসকি ছিল ভাবুন তো!

গদাধর মাথা নাড়িল, সত্যি চক্ষু ফিরানো যায় না। তারপর কি মনে পড়িতে চট করিয়া চারধার দেখিয়া পকেটে হাত ঢুকাইল। উত্তেজনায় সমস্ত শরীর থরথর করিতেছে। গুরুর নির্দেশিত কর্মাদি করিতে-করিতে সে আবার সমুখপানে তাকাইল। সেই পবিত্র মুখের দিকে তাকাইয়া তাহার হঠাৎ দুর্গা ঠাকুরের কথা মনে পড়িয়া গেল। পটলদাসী বুঝি রূপের নিরিখে দুর্গা ঠাকুরকেও টেক্কা দিয়াছেন।

কিছুক্ষণ দর্শন করিয়া লোকটি বলিল, চলুন মশাই, বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়ালে ধার্মিক হয়ে পড়ব! তারপর পিছু ফিরিয়া দুই পা চলিতেই সে যেন প্রস্তরবৎ দাঁড়াইয়া পড়িল। পিছন হইতে গদাধর লক্ষ করিল যে মাছ টোপ গিলিতেছে। লোকটি ঈষৎ ঝুঁকিয়া সেই দূরবর্তী হ্যাজাকের নিস্তেজ আলোয় উদগ্রীব হইয়া কিছু লক্ষ করিতে-করিতে হঠাৎ গদাধরের দিকে তাকাইল।

গদাধর জিজ্ঞাসা করিল, কী হল!

কেমন ফ্যাসফেসে অথচ টালমাটাল গলায় লোকটি বলিল, দেখুন কী পড়ে আছে এখানে।

গদাধর দ্রুত আগাইয়া বালির ওপর হইতে একটি চন্দ্রহার তুলিয়া লইল, আরে এ যে দেখছি সোনার হার! এখানে এল কী করে?

লোকটি গদাধরের কাঁধের কাছে আসিয়া বলিল, সোনার তো?

নিশ্চিত প্রত্যয় গদাধর হারটি দেখিতে দেখিতে বলিল, একশোবার সোনা। আমাকে সোনা চেনাতে আসবেন না! আমার বাবার বন্দকী কারবার ছিল। তা চার-পাঁচ ভরি হবে বটে। যার হারিয়েছে তার কি অবস্থা কে জানে! চলুন মেলা কমিটির কাছে জমা দিয়ে আসি।

গদাধর হাঁটা শুরু করিতেই লোকটি তাহার হাত আঁকড়াইয়া ধরিল, আরে দাঁড়ান মশাই, এ হার কার বুঝতে পেরেছি।

গদাধর তাহার দিকে অবাক হইয়া তাকাইতে সে ফিসফিস করিয়া বলিল, এ হার নির্ঘাত পটলদাসীর। ওই আখড়ায় যাওয়ার সময় এখানে কোমর থেকে পড়েছে। প্রচুর সোনাদানা নিয়ে এসেছে বোধ হয় তাই খেয়াল নেই। পাপের টাকা পুণ্যবানে পায় মশয়। তাই বলছিলাম, জমা দিলে তো পাঁচভূতে গাপ করে দেবে, তার চেয়ে আমি যখন প্রথম দেখেছি এই হারটা আমিই নিয়ে নিই।

হেঁ-হেঁ গদাধর বলিল, আপনি নেবেন মানে?

লোকটা হঠাৎ কোমর হইতে গেঁজে বাহির করিয়া উহা হইতে তিনটে একশত টাকার নোট লইয়া গদাধরের দিকে বাড়াইয়া দিল। গদাধর কিন্তু-কিন্তু করিয়া বলিল, চার-পাঁচ ভরি আছে, সোনার দম কত জানেন?

লোকটি আর বাক্যময় না করিয়া আরও দুইশত টাকা যোগ করিয়া গদাধরের হাতে খুঁজিয়া দিয়া হারটি প্রায় ছিনিয়া লইল, আমার গিন্নির মশয় চন্দ্রহারের খুব শখ। কিন্তু দিন-দিন কোমর বেড়ে যাওয়ায় গড়াতে পারছিলাম না, হে-হেঁ। আপনি মশাই এই সবকথা কাউকে বলবেন না। বেশ্যার হার তো হাজার হোক। লোকটি এক হাতে গদাধরকে জড়াইয়া ধরিয়া হাঁটিতে লাগিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে গদাধরের শরীরে লক্ষ কদম্ব ফুল সুবাস ছড়াইতেছিল। পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে। নগদ পাঁচশো টাকা প্রাপ্তিতে তাহার হৃদয় ফুটবলের মতো নাচিতে লাগিল। হয়তো চাপ দিলে আরও কিছু আদায় হইত কিন্তু লোভই তো অনর্থের কারণ। এখন যত শীঘ্র এই লোকটির সঙ্গ ত্যাগ করা যায় ততই মঙ্গল।

উত্তর দিকের খড়ের জঙ্গলের নিকটে আসিতেই মনে হইল অজস্র জোনাকি জ্বলিতেছে। কাছে আসিতে ভ্রম দূর হইল। কাহারও হাতে কুপি, কাহারও হাতে লণ্ঠন–বেগুনটুলির বাসিন্দারা মনোহর ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া আছে। লোকটি বলিল, পেয়ে গেছি মশয়। আঃ, এরা ছাড়া মেলা জমে? হ্যারিকেনের আলোয় সেইসব রঙিন মুখগুলি তাহাদের দিকে গভীর প্রত্যাশা লইয়া তাকাইয়া আছে। লোকটি গদাধরের হাত ছাড়িতেছে না। পরিদর্শনরত কোনও সেনানায়কের মতো সে হাঁটিতে লাগিল। হঠাৎ গদাধরের চক্ষুস্থির হইয়া গেল। একটি মেয়ের কপালের ওপর টুনি বাল্ব জ্বলিতেছে। কী করিয়া তাহা সম্ভব হইল, মাথার পিছনে বিরাট খোঁপার অন্তরালে কোনও ব্যাটারির অস্তিত্ব আছে কিনা তাহা বোঝা গেল না। কিন্তু সেই বালবের আলোকপালে চুইয়া নাক মুখ বুকে আসা যাওয়া করিতে করিতে জানাইয়া দিতেছে। ঈশ্বর ইহাকে মন দিয়া গড়িয়াছেন। লোকটি নির্ঘাত জহুরি, কাছে যাইয়া বলিল, কী নাম তোমার?

ঈষৎ মোটা গলায় উত্তর হইল, পটল।

লোকটি বলিল, সে কি! পটলদাসী তো এখানে নামগান করছে।

মেয়েটি হাসিল, আজ রাতটার জন্যে আমরা সবাই পটলদাসী। আমি ভালো হরিনাম করতে পারি, শুনবেন?

কত দিতে হবে? লোকটি বলিল।

দশ টাকা আর আমার ব্যাটারির খরচ দুটাকা।

লোকটি ইঙ্গিতে সায় দিতেই মেয়েটি পিছনের জঙ্গলে ঢুকিয়া পড়িল। গদাধর পিছাইয়া যাইতেই লোকটি তাহার হাত ধরিল, যাচ্ছেন কোথায়, উটি হবে না। আমি মশায় বিবাহিত লোক। একা। থাকলে পাপ করে ফেলতে পারি, আপনিও চলুন, দুজনে একসঙ্গে তো পাপ হবে না। নামগান শুনব। বলিয়া গদাধরকে টানিতে-টানিতে জঙ্গলে প্রবেশ করিল। গদাধরের মনে হইল তাহার পকেটের পাঁচশত টাকার জলছাপ দেখিয়া লওয়া হয় নাই!

বেগুনটুলির বাসিন্দারা বাসা গাড়িতে দক্ষ। তাহা না হইলে এই খড়ের বনে বালুচরে বুদ্ধির এইরকম প্রয়োগ হইত না। একহাতে বালি খুঁড়িয়া তিন-চারিটি মানুষ শুইতে পারে এই রকম গর্ত করিয়া তাহার ওপর খড়ের ছাউনি দেওয়া হইয়াছে। বালির ওপর সতরঞ্জি পাতা। তাহার একাংশ ঈষৎ ভেজা। কিন্তু এই শীতের রাত্রে ভেতরের আবহাওয়া বেশ উষ্ণ, আরামপ্রদ। এককোণায়। একটি ভাঙা কড়াইতে কাঠকয়লার আগুন মৌতাত ছড়াইতেছে। তাহারই আলোতে এক মায়াময় পরিবেশ তৈয়ারি হইয়া গিয়াছে। নিচু হইয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া গদাধরের মনে হইল, আর যাহা হউক শীতল বাতাসের হাত হইতে সাময়িক মুক্তি ঘটিল। কিন্তু এই অসভ্য পরিবেশ এবং এই লোকটির সঙ্গ ত্যাগ না করিতে পারিলে কপালে কী আছে তাহা বলা যায় না। হঠাৎ গদাধরের কপালে সিক্ততা অনুভূত হওয়ায় সে হাত দিয়া দেখিল সেখানে ঘাম জমিতেছে–এই শীতেও।

মেয়েটি তাহাদের বসিতে বলিল। বসিবার জায়গা অবশ্যই কম, তবু লোকটির পাশে গদাধর জায়গা করিয়া লইল। পেছনের বালিতে ঠেস দিয়া মেয়েটি খোঁপা খুলিয়া ছোট ব্যাটারি এবং টুনি বালব খুলিয়া রাখিতে-রাখিতে বলিল, একটু খাওয়া-দাওয়া করবেন তো? ভালো জিনিস আছে।

লোকটি বলিল, এখানে পাওয়া যাবে?

মেয়েটি ঘাড় নাড়িতে সে গদাধরের দিকে ফিরিয়া হাসিল, সখী আমাদের দেখছি খুবই সংসারী। তা চলবে তো মশায়? না বললে শুনছিনে, হেঁ-হেঁ। মেয়েটি ততক্ষণে কড়াই-এর পাশে বালি সরাইয়া একটি বোতল বাহির করিয়াছে। তারপর ক্লিপ দিয়া তাহার কর্ক খুলিয়া এক ঢোঁক গিলিয়া লোকটির দিকে বাড়াইয়া দিল। মেয়েটির হাবভাব কথাবার্তা দেখিয়া গদাধরের সন্দেহ হইতেছিল সে এই তল্লাটের নয়। উত্তরবঙ্গে এত চালাকচতুর কথাবার্তায় এত মার্জিত মেয়ে এই লাইনে থাকিবে ভাবা যায় না। গেলাস নাই, তাহার প্রয়োজনও বোধ হয় নাই।

লোকটি ঢকঢক করে সরাসরি গলায় ঢালিয়া প্রশ্ন করিল, নাম তো বললে না, দেশ কোথায়?

মেয়েটি মুখ টিপিয়া হাসিল, কলকাতায়।

চোখ বড় করিয়া লোকটি তাহাকে দেখিল, এখানে এলে কী করতে?

চলে এলাম, পটলদির সঙ্গে যোগাযোগ হল। গদাধর লক্ষ করিল কথা বলিতে-বলিতে মেয়েটি বুকের আঁচল কোলের ওপর আনিয়া ফেলিয়াছে। লোকটি বলিল, তাই বলো বুঝলেন মশয়, কলকাতায় খুব সুন্দরী-সুন্দরী মেয়েছেলে পাওয়া যায়। মেয়েটি হাসিয়া উঠিল।

গুরুদেবের কাছে মাঝে-মধ্যে কারণবারি প্রসাদ পাইয়াছে গদাধর, কিন্তু কোনও নারীর সামনে বসিয়া মদ্যপান এই প্রথম। উৎকট গন্ধ এবং তীব্র জ্বালা তাহাকে এই মদ সম্বন্ধে নিরাসক্ত। করিয়া তুলিল। এক ঢোকের পর আর খাইবার স্পৃহা রহিল না। তা ছাড়া তাহার মস্তকে আরও পাঁচশত টাকা উপার্জনের চিন্তা বাদুড়ের মতো ঝুলিয়া ছিল। খুব অল্পসময়ের মধ্যে লোকটির চিন্তাশক্তি লোপ পাইল। জড়ানো গলায় সে বারবার মেয়েটিকে নামগান করিতে বলিতেছে। মেয়েটি সযত্নে শাড়ি ভাঁজ করিয়া একপাশে রাখিয়া গদাধরের দিকে তাকাইল, বেশিক্ষণ লাগবে না, দশ মিনিটের জন্যে ঘুরে আসুন না।

তড়িৎস্পর্শ পাইয়া গদাধর উঠিয়া দাঁড়াইতে লোকটি এক হাত বাড়াইয়া তাহাকে ধরিতে গেল, না, না, যাবে না। আমরা তিনজনে নামগান করব। আমি বিবাহিত লোক, একা থাকলে–

শেষের দিকের কথা জড়াইয়া যাইতে মেয়েটি তাহার হাত নিজের দিকে টানিয়া জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, ঠিক আছে, এসোনামগান করি। গদাধর বাহির হইয়া আসিল।

যদিও এখন রাত গভীর তবু মেলার অপর অংশ হইতে মানুষজনের কণ্ঠ ভাসিয়া আসিতেছে। বেগুনটুলির বাসিন্দাদের পাশ কাটাইয়া আসিতে-আসিতে গদাধরের কান লাল হইয়া গেল। উপপাসী ছারপোকাদের মতো তাহারা বাক্যবাণে তাহাকে ঠুকরাইতেছিল। দ্রুত পা চালাইয়া গদাধর ভাবিল গুরুদেব যদি এই তল্লাটে তাহাকে দেখেন তবে রক্ষা নাই। আর যাহা হউক, মেয়েছেলের প্রতি আসক্তি তিনি কিছুতেই সহ্য করিতে পারিবেন না। পাশেই পটলদাসীর ছাউনি হইতে কীর্তনের সুর ভাসিয়া আসিতেছে। রাত গভীর হওয়ায় স্বভাবতই গলার স্বর কিঞ্চিৎ দুর্বল। ওখানে গিয়া বসিয়া পড়িলে রাতটুকু উষ্ণতার মধ্যে কাবার হইতে পারে। কিন্তু আরও অর্থের দরকার। অর্ধপথে যাত্রাত্যাগ মূর্খতার সামিল।

হঠাৎ পেছনে ছায়ার মতো কিছুনড়িতে দেখিয়া গদাধর চমকাইয়া উঠিল। চমক খাইলে হৃদপিণ্ড বুকের মধ্যে লাফ দিয়া ওঠে, সামলানো দায় হয়। স্থির হইলে গদাধর গুরুদেবের দর্শন পাইল। তিনি প্রসন্নমুখে হাসিতেছেন। যদিও তাহার সর্বাঙ্গ বস্ত্রাবৃত, শুধু নাক চোখ উন্মুক্ত, তবু হাসি মায়াময়তা বোঝা কঠিন নয়। গুরুদেব বলিলেন, না গদু, তোমাকে আর মূর্খ বলা চলে না। কত বাগালে?

গদাধর মাথা নিচু করিয়া বলিল, পাঁচশো।

চাপ দিলে আরও আসত। থাক, বেশি লোভে কাজ নেই। তা মেয়েছেলেটাকে কিছু দিয়ে আসনি তো? গুরুদেব প্রশ্ন করিলেন।

ঘাড় নাড়িয়া গদাধর অপরাধীর গলায় বলিল, গুরুদেব!

গুরুদেব আবার সেই মায়াময় হাসি হাসিলেন, বৎস গদু, ঈশ্বরের বিকল্প খুঁজতে এসে পথ নিয়ে চিন্তা করো না। তবে ওই মেয়েছেলেটা বেশ খেলুড়ে। সঙ্কোচ রেখো না, টাকার গায়ে কখনও নোংরা লাগে না। তা মালগুলো তোমার কাছে রাখা ঠিক হবে না, আমায় দিয়ে দাও।

গ্লানিমুক্ত গদাধর উৎফুল্লচিত্তে পকেটে হাত দিতেই তিন-চারিটি নারীকন্ঠে সোডা ওয়াটারের ফুকার শব্দ শোনা গেল। গদাধর দেখিল বেগুনটুলির বাসিন্দাদের কয়েকজন তাদের গায়ের কাছে দাঁড়াইয়া আছে, পার্শ্ববর্তী জঙ্গল ও অন্ধকারে ইহাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় নাই। একটি জড়িত নারীকণ্ঠ কহিল, আ যাও প্যারে, এইসা রাত ফির না আউঙ্গে।

গুরুদেব বলিলেন, গদু, টাকাটা বের করো না। এরা শয়তানী। তুমি বরং পটলের কাছে যাও। ওখানে ভিড় আছে, ভিড়ে যাও। সন্ধানী মন কখনও বিফল হয় না। আমি নিকটেই আছি। যাও। শেষের দিকে গলাটি খুব দ্রুত চলিল। ফলে গদাধর আর অপেক্ষা না করিয়া পটলদাসীর ডেরার দিকে চলিল। চলিতে-চলিতে সে গুরুদেবের আর একবার দর্শন পাইবার জন্যে পিছন ফিরিয়া চাহিয়া তাঁহাকে আর দেখিতে পাইল না। তবে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে দুইজন বেগুনটুলিনীর সঙ্গে লম্বা যে দেহটি ঢুকিয়া যাইতেছিল তাহাকেনা, মন বড় অপবিত্র হইয়া যাইতেছে–গদাধর ভাবিল। ঠিক সেই সময় শৃগালেরা উল্লসিত চিৎকার শুরু করিল।

পকেটে অর্থ থাকিলে মন বড় সঙ্কীর্ণ হইয়া যায়, গদাধর কীর্তনে মনোনিবেশ করিতে পারিতেছিল না। অগ্নিকুণ্ডের চারিপাশের মানুষেরা খোল-করতালের সঙ্গে শীর্ণ কণ্ঠে মিলাইতেছে। গদাধর এক প্রান্তে বসিয়া পটলদাসীকে লক্ষ করিল। দুর্গা প্রতিমার মতো চেহারা। কী মহিমা। আহা! পটলদাসীর চোখ তাহার ওপর পড়িতে গদাধর নজর ঘোরাইল। এতক্ষণ লক্ষ করে নাই, ডেরার পেছনেই নদী। তাহার তীরে বসিয়া এই রাতেও কাহারা কলাগাছের পেটোয় প্রদীপ ভাসাইয়া দিতেছে। অন্ধকারে হঠাৎ মনে হয়, পৃথিবী হইতে স্বর্গের দুয়ার পর্যন্ত এই সকল প্রদীপ যেন কোনও বার্তা বহিয়া লইয়া যাইতেছে, কিন্তু তাহারা প্রবেশ অধিকার পাইয়াছে কিনা বোঝা। যাইতেছে না। কারণ, ঢেউগুলির গলাধঃকরণ করিবার ক্ষমতা প্রবল। সমুখস্থ মানুষজনের মধ্যে মালদার কে আছে ঠাওর করিতে-করিতে ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। সঙ্গে-সঙ্গে চারিদিকে সাড়া পড়িয়া গেল। কীর্তনের সুর উচ্চগ্রামে উঠিল। পার্শ্ববর্তী জঙ্গল হইতে বেগুনটুলিনীরা পটলদাসীর ডেরায় আসিতে লাগিল। যাহারা একা ছিল তাহারা তো বটেই, সঙ্গসুখ ত্যাগ করিয়া অন্যেরাও আসিয়া উপস্থিত হইল। সকলে উপস্থিত হইলে কীর্তন থামিল, পটলদাসী একটা উঁচু জায়গায় উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার শরীর হইতে আরও মহিমা বাহির হইতে লাগিল। সমুখস্থ বেগুনটুলিনীদের উদ্দেশ্যে তিনি একটি ছোট্ট ভাষণ দিলেন, এবার আমি চানে চললাম। তোরা এবার যা খুশি কর, আমি বাধা দেবুনি। যে যত টাকা ধারিস সব ফিরি করে দিলাম। একটা কথা বলি, খপরদার। পুরুষজাতটাকে রেয়াৎ করবিনি, শালারা হারামি। কথাগুলি বলে তৃপ্তমুখে পটলদাসী বাহিরে আসিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ঢাকে বোল উঠিল। চতুর্দিকে হইচই পড়িয়া গেল। একটি কুলায় অনেক রকম প্রদীপ এবং ধান দূর্বা ফুল লইয়া একজন সামনে আসিল। ডেরার পাশে রাখা পালকিতে পটলদাসী উঠিয়া বসিলে বাহকেরা তাহা তুলিয়া ধরিল। কুলোধারীর পিছন পিছন পালকি চলিতে লাগিল। পালকির পিছনে যাবতীয় বেগুনটুলিনীগণ এবং দর্শক। পথ যত নদীর সন্নিকটস্থ হইল দর্শক তত বাড়িতে-বাড়িতে গণনার সংখ্যাকে ছাড়াইয়া গেল। গদাধর দেখিল আকাশ ফরসা হইয়া আসিতেছে। শুধু শুকতারার আভায় উত্তরাংশ দপদপ করিতেছে।

নদীর তীরে আসিয়া পালকি থামিল তবে মাটিতে নামিল না। কিছু রমনী কলার পেটোয় প্রদীপ ভাসাইয়া দিল। উহারা মালার মতো ভাসিয়া যাইতে লাগিল। একজন প্রবলবেগে শঙ্খ বাজাইলে শীর্ণকায় এক পুরোহিত পালকির দরজার সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। পটলদাসী বলিলেন, বাবা, সব ব্যবস্থা হয়েছে তো?

পুরোহিত কহিল, হ্যাঁ মা। ঊষা হতে আর বিলম্ব নে। ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নানই বিধেয়। তবে একটা কথা জিগ্যেস করছি ধর্মের কারণে, আপনার পাপের বোঝাটা কীরকম?

বিস্মিত পটলদাসী বলিলেন, কেন?

পুরোহিত বলিল, শাস্ত্রে আছে অল্প পাপে অল্প স্নান, বেশি পাপে–।

বাধা দিয়ে পটলদাসী বলিলেন, পায়ের নোক থেকে মাথার চুল অবধি ডুবে আছি বাবা।

পুরোহিত বলিল, তাহলে মা আপনাকে একশো আটবার ডুব দিতে হবে।

পটলদাসী নামিলেন। তাঁহার স্নান দেখিবার জন্যে শতশত মানুষ হাঁ করিয়া আছে। বিনা পয়সার ফিস্টি লাগিয়া গিয়াছে যেন, গদাধর ভাবিল, একটু ঢাকিয়া ঢুকিয়া স্নানটা হইলে ভালো হয় না?

পুরোহিত বলিল, মা, আজ অবধি যত পাপ করেছেন তার বোঝা একটু পরে হালকা হয়ে যাবে। একশো আটবার স্নান এবং তৎসহ দান ও যজ্ঞের পর স্বর্গের দরজা আপনার জন্যে খুলে যাবে। আর দেরি নেই। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মুহূর্ত আসবে, সূর্যদেব উঠবেন। আপনি জলের ধারে দাঁড়ান।

পটলদাসী জলের ধারে আসিয়া পা ছোঁয়াইলেন, উঃকী ঠান্ডা! পারব তো ঠাকুরমশায়!

কুলায় প্রদীপ জ্বালাইয়া তাহা পটলদাসীর সামনে ধরিয়া পুরোহিত বলিল, পারতেই হবে মা। তবেই আপনার অতীত এখন ধুয়ে মুছে সাফ হবে। এখন থেকে আপনি অন্য মানুষ। লোকে আপনাকে দেখে পুণ্যসঞ্চয় করবে। খেয়াল রাখবেন আর যেন কোনওদিন পাপনা করেন। তাহলে সব নষ্ট।

হাঁ হইয়া তাকাইলেন পটলদাসী, কী বলেন বাবা, আর পাপ করিতে পারবুনি?

পুরোহিত ঘাড় নাড়িল, না।

সেকি! প্রায় ডুকরাইয়া উঠিলেন পটলদাসী, তাহলে বাঁচব কী করে? অম্বল হয়ে যাবে যে! সঙ্গে-সঙ্গে সমবেত দর্শকমণ্ডলী প্রবলবেগে হাসিয়া উঠিল। পটলদাসী কহিলেন, যা পাপ করেছি তা আজ ধুয়ে দাও বাবা, আর প্রতি বছর যা পাপ করব প্রতি বছর নতুন করে ধুয়ে দিও, হবে না?

পুরোহিত সবেগে ঘাড় নাড়িল, ওতে স্বর্গবাস হবে না। যে পুজোয় যা নিয়ম। আজকের স্নানের পরে আপনি আর কোনওদিন পাপ করতে পারবেন না, জেনে রাখুন।

মাথা নিচু করিয়া পটলদাসী কী ভাবিলেন। তাহার পর বলিলেন, বেশ আর পাপ করবুনি। তবে আজ শেষবার পাপ করে নিই, অনেক দিনের অভ্যেস তো! আর পাপ যখন করতেই পারবুনি তখন সাধটা মিটিয়ে ফেলি। কথাটা বলিয়া ধীর পায়ে সামনে আগাইয়া আসিলেন। এখন তাঁহার সমুখে বেশকিছুটা জায়গা উন্মুক্ত, তাহার চতুষ্পর্শ্বে গোল হইয়া মানুষ দাঁড়াইয়া আছে। সূর্যদেবের উঠিতে একটু বিলম্ব আছে।

পুরোহিত বলিল, মা, আর পাপের দরকার কী? এবার স্নানের জন্যে প্রস্তুত হন।

পটলদাসী কহিলেন, জিভে এখনও নোলা লেগে আছে বাবা, শেষতক বাকি জীবন হেঁচকি তুলে মরব! তা হয় না। কিন্তু কী পাপ করি তাই ভাবছি। চিন্তান্বিত চিত্তে পটলদাসী আরও দুই পা। অগ্রসর হইয়া আকাশের দিকে মুখ তুলিলেন। পাপ করিবার জন্যে তাঁহার সমস্ত সত্তা উদ্বেলিত। দুই হাত বুকের কাছে জোড়া করিয়া তিনি ভাবিলেন, সারা জীবন যে পাপ করেছি তা তো এ বয়সে সম্ভব নয়। মিছে কথা বলেও ছাই সুখ হয় না। সোনাদানা টাকাকড়ি দিয়ে আর কী হবে–সে সব তো প্রচুর দেখলাম। কাউকে যে খুন করব সেটাও আর ইচ্ছে হয় না, এখন কাউকে ক্ষমা। করে দিলে মনটা কেমন যেন ভালো হয়ে যায়। মরণদশা আমার। এইমতো ভাবিতে-ভাবিতে পটলদাসীনদীর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিলেন। কত রজনী নিদ্রাহারা লালসার মধ্যে কাটানো শরীরটার আজ সামান্য কোনও ক্ষমতা নেই। আবছায়া আকাশটাকে ছাতির মতো মাথায় ধরিয়া নদী বহিয়া যাইতেছে। তাহার কোনও খামতি নেই, চিরকাল হাতে কুপি জ্বলিয়া দরজায়। দাঁড়াইয়া থাকিতে পারে।

পুরোহিত কহিল, মা আর দেরি নেই, প্রস্তুত হন।

শঙ্খ বাজিয়া উঠিল, বেগুনটুলিনীরা উলুধ্বনি দিল, কে যেন সঙ্গে-সঙ্গে কাঁসরঘণ্টা বাজাইয়া দিল। হাত নাড়িয়া পটলদাসী তাহাদের থামাইয়া দিলেন। তারপর সমবেত জনতার দিকে মুখ ফিরাইয়া পিঠ হইতে কাপড় টানিয়া মাথায় ঘোমটা দিলেন। তারপর দুই হাত যুক্ত করিয়া সামান্য উচ্চস্বরে কথা আরম্ভ করিলেন, আমার নাম পটলদাসী। আমি ভগবানের কাছে নিজেকে ধুয়ে ফেলে শুদ্ধ হয়ে যাব চিরকালের জন্যে। কিন্তু মনে বড় সাধ শেষবার পাপ করে যাই, আর কখনও যখন করতে পারবুনি– গলা ধরিয়া আসিল পটলদাসীর। কোথাও কোনও গোলযোগ। নাই, সবাই বুড়ো আঙুলের ওপর ভর করিয়া তাঁহার কথা গিলিতেছে, তাই বলছিলাম, আমি তো ভেবে পেলামনি, তা আপনারা যদি দয়া করে পাপের হদিশ বলে দেন তো বড় উপকার হয়। কিছুক্ষণের জন্য যেন সমস্ত পৃথিবী স্তব্ধ হইয়া গেল, শুধু দূরবর্তী মাইকের আওয়াজ এবং নদীর কলতান কান বধির করিয়া তুলিল। তারপরই সমবেত জনসাধারণ গুঞ্জন করিয়া উঠিল। এ ধরনের প্রস্তাব যে আসিতে পারে তাহা স্বপ্নের আগোচরে ছিল। যে সমস্ত বয়স্ক মানুষ এককালে বেগুনটুলীর আশেপাশে ঘুরঘুর করিতেন পটলদাসীর ছায়া দেখিবার জন্য অথচ সমাজের ভয়ে ভিতরে ঢুকিতে সাহস পাইতেন না, এই মুহূর্তে মুখাভ্যন্তরে জিহ্বা সঞ্চালন করিতে গিয়া আবিষ্কার করিলেন তাহা শুষ্ক হইয়া গিয়াছে। গদাধর দেখিল সবাই উসখুস করিতেছে। কেহ-কেহ পটলদাসীর দিকে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া আছে। এখন এই বয়েসে, সূর্য অস্ত যাইবার পর পশ্চিমাকাশে যে রক্তাভাটুকু কয়েক মুহূর্তের জন্য রাখিয়া যায়, পটলদাসীর অঙ্গে-অঙ্গে তাহার বিচ্ছুরণ ক্ষণিকের জন্যও মোহ ধরাইতে পারে। হঠাৎ গদাধর লক্ষ করিল, গুরুদেব তাহার পিছনে ভিড়ের মধ্যে মিশিয়া আছেন। গদাধরের চিত্তে আনন্দ হইল। তাহার ইচ্ছা হইল গুরুদেবকে গিয়া বলে, তিনি তো সবই জানেন, তাই পটলদাসীকে একটা পথ বাতলাইয়া দেন। বেচারি চাতকের মতো চাহিয়া আছে। পরমুহূর্তেই তাহার স্মরণ হইল গুরুদেব উমেদারী একদম পছন্দ করেন না।

পটলদাসী করুণ কণ্ঠে কহিল, কই কিছু বলুন! মায়ার বাঁধন ছেঁড়ার আগে শেষবার–আচ্ছা আমি বললাম, যে আমাকে পাপের রাস্তা শেষবার দেখাতে পারবে তাকে পুরষ্কার দেব। এই ধরুন, একশো টাকা। গুঞ্জন বাড়িয়া গেল, কিন্তু কেহ আগুয়ান হইল না। এই ধরনের পুরস্কারের কথা কেউ কখনও শোনে নাই। কিন্তু ভিড় জমাট রহিল।

গদাধর শুনিল পার্শ্ববর্তী এক প্রৌঢ় তাঁহার সঙ্গীকে নিম্নস্বরে কহিতেছে, যা বাব্বা, আগে পটলের কাছে গেলে পয়সায় টান পড়ত এখন ওই উলটে টাকা দিতে চাইছে! সঙ্গী কী কহিল শোনা গেল না।

পটলদাসী একটু উষ্ণ গলায় কহিলেন, কী আশ্চর্য, সাহায্য করতে না পারলে সং-এর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ঠিক আছে, পাঁচশো টাকা দিয়ে দেব। ক্ষেন্তি, তোর কাছে আমার যে টাকা আছে তা থেকে পাঁচশো আলাদা কর। পার্শ্ববর্তী এক বর্ষীয়সী বেগুনটুলিনী ঘাড় দোলাইল।

সঙ্গে-সঙ্গে চারধারে সাড়া পড়িয়া গেল। পাপের পথ দেখাইলে পাঁচশো টাকা নগদা-নগদি। গদাধর অবাক হইয়া দেখিল ভিড় হঠাৎ পাতলা হইয়া যাইতেছে। মানুষজন যেন আশঙ্কা করিতেছে পটলদাসী টাকার লোভ দেখাইয়া তাহাদের হঠাৎ শেষ পাপের সঙ্গী করিয়া লইতে পারে! গদাধরের হাত নিশপিশ করিতে লাগিল। গুরুদেবের নির্দেশমতো হাজার টাকার অর্ধেক তাহার পকেটে, বাকিটা যখন পটলদাসীর মন ভেজাইলে পাওয়া যায় তখন তাহা ছাড়িয়া দেওয়া মূর্খতার সামিল, কিন্তু কোনও পাপই সে হঠাৎ তাহার নজরে পড়িল গুরুদেব কেটে পড়া মানুষের সঙ্গ লইতেছেন। তৎক্ষণাৎ সে গুরুদেবের দিকে ছুটিয়া গিয়া তাঁহার হাত ধরিল, গুরুদেব যাচ্ছেন কোথায়, এ সুযোগ ছাড়বেন না!

বিহ্বল গুরুদেব বলিলেন, আঃ গদু, হাত ছাড়।

উত্তেজিত গলায় গদাধর বলিল, আপনি চলুন, আপনি ত্রিকালজ্ঞ, সামান্য জ্ঞান দিলেই পাঁচশো টাকা চলে আসবে। আমার হাজার টাকার প্রতিশ্রুতি পূর্ণ হবে। দয়া করুন। এই বলিয়া পাগলের মতো তাহাকে টানিতে লাগিল। গুরুদেব বিরক্ত, কুপিত এবং সব কিছু হইয়াও হাত ছাড়াইতে পারিলেন না।

গদাধরের শরীরে যেন লক্ষ হাতির শক্তি, মুখে এক বুলি, আর কেউ না পারুক আপনি পারবেন, গুরুদেব।

সমবেত সজ্জনের সামনে এক অপূর্ব দৃশ্য উপস্থিত হইল। ঈষৎ মোটা এক ব্যক্তি লাল আলখাল্লা এবং দাড়িযুক্ত এবং এক ব্যক্তিকে হিচড়াইয়া লইয়া যাইতেছে। মেয়েছেলে এবং বোঝাই যায়। দাড়িওয়ালা ব্যক্তি সন্ন্যাসী–দুই-এর সম্মিলন বড়ই উপাদেয়।

পটলদাসীর সমুখে গিয়া বুক ফুলাইয়া গদাধর বলিল, নিন, এই হলেন আমার গুরুদেব। আপনার পাপের পথ ইনি বলে দেবেন। কারণ ইনি ত্রিকালজ্ঞ।

পটলদাসী সমুখে এক সন্ন্যাসীকে দেখিয়া ভক্তিভরে মাথা নিচু করিয়া বলিলেন, বাবা, আমি বড় হতভাগী, আমাকে দয়া করুন।

গুরুদেব তখনও হাঁপাইতেছিলেন, চতুর্দিকে নজর করিয়া বুঝিলেন পালাইবার পথ নাই। দাঁতে দাঁত চাপিয়া কহিলেন, গদু!

গদাধর জবাব দিল, বলুন গুরুদেব।

পটলদাসী হঠাৎ আপ্লুত হইয়া গুরুদেবের পদপ্রান্তে বসিয়া পড়িলেন, বাবা দয়া করুন আমাকে।

গুরুদেব কহিলেন, আমি চলিলাম।

তাঁহার কণ্ঠস্বরে হঠাৎ চমকাইয়া পটলদাসী মুখ তুলিলেন। তারপর অনেকক্ষণ নির্নিমেষে চাহিয়া বলিয়া উঠিলেন, ওমা তুমি! গদাধর দেখিল গুরুদেবের মুখ ন্যাপথলিনের মতো সাদা হইয়া গেল।

ততক্ষণে পটলদাসী উঠিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাই বলো, মুখ চোখ এমন জঙ্গল করে রেখেছ চিনব কি।

গুরুদেব ফ্যাসফেসে গলায় কহিলেন, কী বলছেন?

কোমরে হাত দিয়ে পটলদাসী চোখ ঘুরাইলেন, কী বলছি? আলখাল্লা তোলো, দেখি তোমার হাঁটুর ওপরে সেই কাটা দাগ আছে কিনা! সঙ্গে-সঙ্গে গুরুদেব ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। কিন্তু। পটলদাসীনাছোড়বান্দা, তাঁহার ইঙ্গিতে একজন আসিয়া গুরুদেবের আলখাল্লা তুলিয়া ধরিতে দুইটি শীর্ণ লোমশ পায়ের ওপরের একটিতে কাটা দাগ দেখা গেল।

হঠাৎ পটলদাসী বালিকার ন্যায় খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিলেন, ভগবান আছেন গো, ভগবান আছেন। সেই যৌবনকাল থেকে তোমাকে খুঁজছি। না, আর ভণ্ডামি করো না। আবার সন্নেসী হয়েছেন। মনে নেই, তেত্তির কাটিয়ে দশ টাকা কম দিয়ে কেটে পড়েছিলে?

গুরুদেব চাপা গলায় কহিলেন, আঃ পটু!

পটলদাসী উগ্র মূর্তি ধরিলেন, কী! আবার চোপা হচ্ছে। আমার শরীরটাকে শেষ করেছিল কে? কে আমাকে প্রথম রোগ ধরিয়ে বাঁজা করে পালিয়েছিল? থুথুথু:! মাথা ঝাঁকাইয়া প্রবলবেগে গুরুদেবের দাড়িতে একরাশ সাদা থুথু ছিটাইয়া দিলেন পটলদাসী, তারপর ডুকরাইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, আমাকে মা হতে দিলে না গো এই ঘেয়োটা–।

সমস্ত মেলা যেন বরফ হইয়া জমিয়া গিয়াছে। গুরুদেবের শরীরে যেন রক্ত নাই। হঠাৎ যেন বামনের মতো ক্ষুদ্র দেখাইতেছে তাঁহাকে। গদাধরের মনে হইল তাহার চারধারে, মাথায় যে উষ্ণ দেওয়াল ও ছাদ ছিল তাহা খসিয়া গিয়া শীতের হিম বাতাস আসিয়া পড়িয়াছে।

হঠাৎ পটলদাসী চুপ করিয়া গেলেন। তারপর মাথায় কাপড় দিয়া কহিলেন, আর সময় নেই। শেষ পাপটা করে নিই তাহলে। সমস্ত মেলাকে অবাক করিয়া দিয়া পটলদাসী তারপর সাষ্টাঙ্গে গুরুদেবকে প্রণাম করিলেন। প্রণাম শেষ করিয়া কোনওদিকে না চাহিয়া নদীর দিকে চলিতে চলিতে বলিলেন, পুরুতমশাই এবার মন্ত্র পড়ুন, আমার সাধও মিটেছে।

সঙ্গে-সঙ্গে চারধারে ঢাক, ঢোল, শঙ্খ, কাঁসি এবং উলুধ্বনি বাজিয়া উঠিল। পুরোহিত সবেগে মন্ত্র পড়িতে লাগিলেন। পূর্বাকাশে সূর্যদেব উদিত হইতে লাগিলেন। পটলদাসীর স্নান শুরু হইল। ভিড় হইতে নিঃশব্দে গদাধর নিজের অজান্তে নদীর ধারে চলিয়া আসিয়াছিল। এখন এই ব্রাহ্মমুহূর্তে সে পায়ে-পায়ে এই হিমবরফ জলে নামিয়া পড়িল। তাহার শরীরে কোনও সাড় নাই। পটলদাসী হইতে খানিক দূরে অঙ্গ ডুবাইয়া স্নান করিতে গিয়া মনে হইল, তাহার পকেটস্থটাকার জলছাপে জল লাগিতেছে। আর দেখিবার প্রয়োজন নাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress