Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস || Sankar Brahma » Page 2

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস || Sankar Brahma

দ্বিতীয় পর্ব : গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস–এর জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা

গাব্রিয়েল সম্পর্কে যা জানি
আলভারো মুতিস্‌

কার্তাহেনার বোকাগ্রান্দে অঞ্চল, সে এক প্রচণ্ড ঝড়ের রাত, ৪২ বছর আগে সেদিন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, আলাপ করিয়ে দিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-এর সহপাঠী এবং গুণমুগ্ধ বন্ধু গনসালো মাইয়ারিননা। হাওয়ার দাপটে গাছের ডাল শুয়ে পড়ছে মাটিতে, কান ফাটানো শব্দে ডাব পড়ছে ফুটপাথে, পুরো ফকনারীয় পরিবেশ।

ওর চরিত্রে দুটো বিষয় দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম, তখন সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে তার গল্প “La noche dc tos alcaravanes” অর্থাৎ বাঁকা চোখের রঙিন পাখির রাত। আমার মতে ওটা অসামান্য এক সৃষ্টি, অপরিসীম সম্ভাবনাময়–জানি না কেন সম্ভাবনাকে অপরিসীম বলেছিলাম। তার চরিত্রের দুটি বৈশিষ্ট্য–পাণ্ডিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা অতল, অনিঃশেষ, অভাবনীয় আর লেখা শব্দের গোপন সৌন্দর্যের প্রতি দুর্নিবার প্রেম (কেবলমাত্র এই বিপুল প্রাণবন্ত আগ্রহ দেখা যায় ‘দন কিহোতের মধ্যে যখন তিনি পাণ্ডিত্য এবং অস্ত্র বিষয়ে বক্তৃতা করেন) আর আমার মনে হয়েছিল এক পরিণতমনস্ক পৌরুষের অধিকারী সে, দীপ্তিমান, অসামান্য অব্যর্থ সাধারণ-জ্ঞান–যা কুড়ির যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত অবিচল থেকেছে। গাব্রিয়েল-এর জীবনে দেখা যায় যে কোনো কোনো জিনিসের প্রতি বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্রয় আর বন্ধুত্বের ওপর ভরসা। এমন বন্ধু আর কাউকে আমি পাইনি, আবার এমন লোকও দেখিনি যার মধ্যে ভালোবাসা আর স্থৈর্যের এমন যুগলবন্দি আছে। আমার প্রায়শই মনে হয়েছে গাব্রিয়েল জন্মেছে পরিণত মন নিয়ে, বয়স বাড়েনি, আর কোনোকালে সে বুড়ো হবে না যাবতীয় বস্তুর এক অপরিবর্তনীয় আলোর রূপে বিভোর থাকে সে আর এটা তার সষ্ট চরিত্রের মধ্যে অনায়াসে মিশে যায়।

তার সাহিত্য সম্পর্কে মন্তব্য করা আমার পক্ষে বেশ কঠিন। প্রকাশিত হবার আগে আমি তার সব পাণ্ডুলিপি পড়েছি। আমার মনে হয় ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ এক সম্পূর্ণ সফল উপন্যাস, যদিও এটাকে অনেকে ফাউ বলে মনে করে। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ পড়ার সময় আতঙ্কে আমি বধির হয়ে যাই। আমাদের আমেরিকার অসচেতন সার্বিক জীবনযাপনের প্রতিটি স্তর তিনি ছুঁয়েছেন, এর মধ্যে আছে পুরাণ, গভীর মননশীলতা আর অনুমানের অপরিমেয় শক্তি, এর সবটা বোঝার জন্যে যে শান্ত মনঃসংযোগ প্রয়োজন তা আমি হারিয়ে ফেলি। আমি বিশ্বাস করি ওই গ্রন্থের মধ্যে এমন রত্ন লুকিয়ে আছে, যা নিয়ে এখনও কিছু বলা হয়নি। প্রতিটি প্রজন্ম গ্রন্থটিকে গ্রহণ করবে ভবিতব্য এবং সময়ের আহ্বান হিসেবে আর পরিবর্তন তেমন কিছুই হবে না।

গাব্রিয়েল আর আমি একসঙ্গে অনেক সুখের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ভাগ করে নিয়েছি, আমরা তিনটি মহাদেশ ঘুরেছি একসঙ্গে, ভাগাভাগি করে বই পড়েছি, গান শুনেছি এবং কত বন্ধুর সঙ্গে একসঙ্গে আড্ডা মেরেছি। তার সান্নিধ্য জীবনের অন্ধকার সময়ে এক অবলম্বন। তার নোবেল পাওয়ার আনন্দ একসঙ্গে উপভোগ করেছি, অত্যুৎসাহের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, সবসময় অবিচলিত থাকার চেষ্টা করেছি। মদ্যপান করতে করতে মধ্যরাত পার করেছি। মের্সেদেস এবং কারমেন-এর কত স্মৃতি আমাদের একই ভাগ্যের দোসর। সত্যি কথা বলতে কী, কিছুই যেন ঘটেনি। অথবা আরও ভালোভাবে বলা যায় যে সেই ভাগ করা সময়টার এদিক ওদিক হয়নি, এটা ছিল এবং এখনও আছে এক চলমান ভোজসভা হয়ে।

পাদটীকা

১. লেখক আলভারো মুতি গার্সিয়া মার্কেস-এর অন্তুরঙ্গ বন্ধু।

২. মের্সেদেস-গার্সিয়া মার্কেস-এর স্ত্রী।

৩. কারমন সম্ভবত আলভারোর স্ত্রী, যিনি গার্সিয়া মার্কেসকে সাহায্য করেন লেখায়।

ভূমিকা

নোবেল পুরস্কার একটি সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হতে পারে না, কিন্তু গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর নোবেলজয়ী উপন্যাস Cien años de soledad / ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়ে প্রায় চার দশকব্যাপী পাঠকের আগ্রহ ধরে রেখেছে এবং সমালোচকদের নিত্যনতুন লেখায় সমৃদ্ধ হচ্ছে। গত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে স্প্যানিশ ভাষার কোনো উপন্যাস এর ধারে কাছে পৌঁছোত পারেনি এবং পাঠকের এমন বিপুল আগ্রহ দেখা যায়নি। পাঠকের চাহিদার জন্যে সপ্তাহে একটি সংস্করণ পর্যন্ত মুদ্রিত করতে হয়েছে। এটি এক বিরল ঘটনা। ‘ya es un libro clasico’ অর্থাৎ ইতিমধ্যেই এই গ্রন্থ ধ্রুপদি সাহিত্যের মর্যাদা অর্জন করেছে, বলেছেন লেখক পেদ্রো লুইস বার্সিয়া। অবশ্য চেষ্টারটন্ ঠাট্টা করে বলেছিলেন—‘ক্লাসিক হচ্ছে সেই গ্রন্থ যা লোকে না পড়েও অনেক কিছু বলতে পারে।‘ কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস-এর এই উপন্যাসটির চাহিদা ক্রমবর্ধমান।

পেরু তথা লাতিন আমেরিকার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা বলেন যে, উপন্যাসটি এমনই স্বয়ংসম্পূর্ণ যে এর গভীরতার পূর্ণ আধার আয়ত্তে না থাকলেও পাঠক এটি পড়ে রসাস্বাদন করতে পারে। এটির জন্যে ইতিহাস, পূরাণ কিংবা পূর্বসূরিদের রচনার পূর্বপাঠ আবশ্যিক বলে মন হয় না। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যধারায় এর তাৎপর্য কী বুঝতে হলে এই উপন্যাসটির জন্মের প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে চলে আসে।

ষাটের দশক লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ। স্প্যানিশ ভাষার শ্রেষ্ঠতম উপন্যাসগুলি এই সময় আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬২-তে আলেহো কাপেনতিয়ের-এর ‘আলোর শতাব্দী’ এবং কার্লোস ফোয়েন্তেস রচিত ‘আর্তেমিও ক্রুশ-এর মৃত্যু’ প্রকাশিত হল, ১৯৬৩ তে হুলিও কোর্তাসার-এর ‘এক্কাদোক্কা’ এবং মারিও ভার্গাস ইয়োসার ‘শহর আর কুকুর’-এর প্রকাশনার কাজ চলছে, ১৯৬৬ সালে বেরোয় হুয়ান কার্লোস ওনেত্তির ‘শব-পারিষদ’ কাব্রেরা ইনফান্তের ‘তিন বিষণ্ণ বাঘ’, লেসামা লিয়ার ‘স্বর্গ’ আর ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হল ‘নিঃসঙ্গ তার শতবর্ষ’।

অসামান্য সাহিত্যের দীপ্তিময়তার কাল একটি সম্মাননীয় নামে অভিষিক্ত হল—‘বুম’, অথবা বলা হল ‘লাতিন আমেরিকার নতুন উপন্যাস’। কেউ কেউ বললেন যে পুরোনো যুগের লেখা বাতিল হয়ে সৃষ্ট হল কাহিনি নির্মাণের নতুন ধারা, আর অনেকে বললেন যে আন্তর্জাতিক গ্রন্থ প্রকাশনার প্রতিযোগিতায় এই লেখকরা দিবারাত্র পরিশ্রম করে বাজার দখল করলেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে লাতিন আমেরিকার পূর্বসূরিদের পথেই এই নতুন ধারার জন্ম। বোর্হেস, মাসেদোনীয় ফের্নানদেস, হোসে মারিয়া আর্গেদাস প্রমুখ লেখকদের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। ওক্তাভিও পাস খুব সুন্দর বলেছেন—’ভবিষ্যতের অন্বেষণ সবসময় শুরু হয় অতীতকে পুনর্জীবিত করে।’

‘বুম’-এর প্রত্যক্ষ প্রভাব ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে আছে কি না তা নিয়ে মতানৈক আছে। কিন্তু একথা মানতেই হবে যে ওই যুগের উপন্যাস নির্মাণের চূড়ান্ত রূপ এটি এবং একই সঙ্গে ভিন্নতর সৃষ্টির অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। এই নতুন ধারার বিরোধীরা যে ‘মাফিয়া’র জগৎ সৃষ্টি করেন তার প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায় না ওই উপন্যাসে। তথাপি আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ওই দুই ধরনের পরস্পর বিরোধী সাহিত্যের এক চোরা স্রোত গার্সিয়া মার্কেস-এর উপন্যাসে আলতো দোলা দিয়ে যায়। তিনি সচেতনভাবে উপন্যাস ও ছোটোগল্প নির্মাণের নতুন ভাষা ও বিষয়বস্তুর পুরোধা হয়ে ওঠেন।

১৯৫৯ সালে কিউবার বিপ্লব সফল হওয়ার পর লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠল বিপ্লবের সাহিত্য, না, সাহিত্যের বিপ্লব? আরজেনটিনার প্রখ্যাত লেখক হুলিও কোর্তাসার বললেন যে নতুন বিষয় পরিবেশন করার জন্যে ভাবতে হবে নতুন আঙ্গিক নিয়ে, ভাষা নিয়ে। ফলে অনেক সাহিত্য কেবল আঙ্গিকসর্বস্ব হয়ে পড়ল। কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস সে পথে হাঁটলেন না। সাহিত্যের বাস্তবতা, অবাস্তবতা নিয়ে অনেক কথা হল। সব তর্কবিতর্ক শোনার পর গার্সিয়া মার্কেস বললেন—’পুলিশ মানুষকে হত্যা করছে বলাটাই শুধু বাস্তবতা নয়, বাস্তবতার মধ্যে আছে পুরাণ, রূপকথা, ইতিহাস–যা জড়িয়ে আছে মানুষের জীবনে এবং সবকিছুকেই গ্রহণ করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা তার লেখায় হয়ে ওঠে পুরাণকথার মত রহস্যময় আর সুপাঠ্য। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে অনায়াসে চলে আসে–সৃষ্টির আনন্দ, আদি পাপ, জীবনের অনন্ত চক্র, অপ্রতিরোধ্য ভবিতব্য, পৃথিবীর অক্ষরেখার মতো বংশলতিকা, হারানো স্বর্গ, সাবেকি এক মা ইত্যাদি।

উপন্যাসের মতোই বাস্তব বেঁচে থাকে, কিন্তু তার প্রকাশ কেবল বদলে যায়, শুধুমাত্র ফটোগ্রাফের নিশ্চল বাস্তবতা হয়ে থাকে না। তার নতুন নতুন বর্ণচ্ছটা আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হতে থাকে–অলীক বাস্তব, বিস্ময়কর বাস্তব, পুরাণে রূপান্তরিত বাস্তব, আশ্চর্য বাস্তব, আরও কত কী চলতে থাকে। এর মধ্যে সাহিত্যে যা বহুল প্রচলিত তা হল জাদু বাস্তবতা। হিসপানিক সাহিত্যধারার দীর্ঘকালব্যাপী পথ পরিক্রমার শেষে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর উপন্যাস নির্মাণে এই নতুন ধারাটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

। প্রশ্ন ওঠে অনিবার্যভাবে যে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেন্স কি কোনো তত্ত্ব উত্থাপন করেন, যেমন কোর্তাসার করেছেন ‘রাইওয়েলা’ (এক্কা দোক্কা) উপন্যাসে? না, তিনি তেমন কিছু উল্লেখ করেননি, তবে তত্ত্ব লুকিয়ে থাকে উপন্যাসের ভেতর। উপন্যাস নির্মাণে প্রথাভঙ্গের পথ শুরু করেন কোতাসার, শেষ করেন গার্সিয়া মার্কেন্স।

‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটি সম্বন্ধে মারিও ভার্গাস ইয়োসা বলেন যে এটি সম্পূর্ণ বাস্তবতা, সম্পূর্ণ উপন্যাস। মাকন্দোয় বৃষ্টি দেখে ইসাবেলার ‘স্বগোতোক্তি’ শীর্ষক গল্পটি থেকে ‘ঝরাপাতা’ উপন্যাস রচনা পর্যন্ত গার্সিয়া মার্কেস বাস্তবতার সাহিত্যরূপ (কল্পনাশ্রয়ী বাস্তবতা) নিয়ে যে প্রক্রিয়া শুরু করেন তার চূড়ান্ত রূপ নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ পূর্বসূরিদের সব উপন্যাসের এক পরিণত বুদ্ধিদীপ্ত সংশ্লেষ পাওয়া যায় এটিতে। তিনি এক অসামান্য ঐশ্বর্যময় জগৎ সৃষ্টি করেন, এই জগৎ এবং উপন্যাস এক সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। মানুষকে নিয়ে ঠাট্টার খেলা হয়ে উঠতে পারে সাহিত্য। সেটা দেখায় আলভারো এক রাতের পার্টিতে। ‘প্রাজ্ঞ কাতালুনিও’র কথায় বাস্তব এবং অবাস্তব জগতের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়।

‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ কি এই পৃথিবীর এক প্রহসন? ‘দন কিহোতে’ যেমন শিভালরি গ্রন্থের অতিশয়োক্তিকে ব্যঙ্গ করে, তেমনই কি সাহিত্য নিয়ে ব্যঙ্গ এই গ্রন্থ? মাকন্দোর চরিত্ররা একে একে সে দেশ ছেড়ে চলে যায়, শুধু থাকে গাব্রিয়েল, ‘একটি ফরাসি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে উত্তর পাঠায়; এই প্রতিযোগিতায় জেতার পুরস্কার প্যারিস ভ্রমণ।‘ প্রাজ্ঞ কাতালুনিও ‘এক বুদ্ধিজীবী, ধ্রুপদি সাহিত্য পাঠ করেছেন তিনি।‘ লিখিত শব্দের প্রতি তার আবেগ শ্রদ্ধার এবং পাড়ার গল্পকথার প্রতি অশ্রদ্ধা একটা পরিকল্পনা। তার নিজের পাণ্ডুলিপির মধ্যেও এই দ্বিত্ব দেখা যায়। সাহিত্যের ভবিতব্য মানুষের মতো বেশ্যালয়ে হারিয়ে যাওয়া, বলেন প্রাজ্ঞ কাতালুনিও। লিখিত প্রমাণাদির সঙ্গে মানুষ একসূত্রে বাঁধা। প্রাজ্ঞ কাতালুনিও বলেন—’যেদিন মানুষ ভ্রমণ করে ট্রেনের প্রথম শ্রেণিতে আর সাহিত্য যায় মালগাড়িতে সেদিনই পৃথিবীর শেষ।’ এই গ্রন্থপ্রেমিক মাকন্দো ছেড়ে যাবার সময় তার বইগুলি লাগেজে দিতে চাননি এবং সঙ্গে করেই নিয়ে যান। গার্সিয়া মার্কেস এই বিদগ্ধ মানুষটির প্রতি অন্য লোকেদের শ্রদ্ধার ভাবই দেখিয়েছেন। তাঁর পাণ্ডুলিপি অনুবাদ করার জন্যে আলফনসো কাতালান ভাষা শেখে, তাকে দেখে আউরেলিয়ানোর মনে পড়ে জিপসি মেলকিয়াদেস-এর দলিল-দস্তাবেজের কথা। এভাবে জাদুর সঙ্গে সংস্কৃতির এবং সেই সূত্রে সাহিত্যের মিলন ঘটে যায়।

গার্সিয়া মার্কেস সাহিত্যের ভবিতব্যকে তুলনা করেন মানুষের সঙ্গে, মহত্ত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ রচনার দর্শন অসাধারণ কয়েকটি পক্তির মধ্যে নিহিত আছে। সময়ের প্রচলিত ধারণা ভেঙে যায়, এক কাল্পনিক দেশের মধ্যে প্রবেশ করে পাঠক আর অদ্ভুত যা কিছু ঘটে, জাদুকরী সবকিছুই দৈনন্দিন জীবনের সত্যতা থেকে কম বিশ্বাসযোগ্য নয়।

‘মাকন্দো’ অবশ্যই এক কাল্পনিক নাম, লেখক শৈশবে এই নামের একটি কলা চাষের খামার সম্ভবত দেখেছিলেন, এটি তার জন্মস্থান আরাকাতাকার কাছেই ছিল। রিকার্দো গুইয়োন (Ricards Gullon) নামে সমসাময়িক এক লেখকের মতে মাকান্দা লাতিন আমেরিকার সঙ্গে একাত্মীভূত কোনো স্থান নয়; একটিমাত্র প্রতীকী স্থান নয় মাকন্দো, কারণ উপন্যাসে মিশ্র প্রতাঁকের উল্লেখ আছে। মাকন্দোর মানুষ এই স্থানের ভূচিত্র এবং মাটি সম্পর্কে সচেতন। আসলে মাকন্দোর প্রতিষ্ঠাতা উরসুলা। কারণ এখানে আমাদের এক সন্তানের জন্ম হয়েছে, বলে সে। স্থানটির প্রতিষ্ঠার জন্যে যারা হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়ার সঙ্গে অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল তারা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক অবস্থা পার হয়, সাধারণভাবে বলা যায় যে ওইখানে ট্রপিক্যাল গাছগাছালির সংখ্যাধিক্য ছিল। আর্দ্রতা এবং নৈঃশব্দের স্বর্গ সে অঞ্চল। এক আবিষ্কারকের মতে হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া সমুদ্রের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। প্রথমে সমুদ্রের সংকেত মেলে একটি বিধ্বস্ত স্পেনীয় জাহাজে। কীভাবে জাহাজটি সেখানে পৌঁছেছে তার উল্লেখ নেই, কিন্তু আমরা ধরে নিতে পারি যে তার কাছাকাছি সমুদ্র আছে আর বাকি কাহিনিটা রহস্যাবৃত থাকে। কয়েকবছর পর হেসে আরকাদিও বোয়েলদিয়া ‘স্পেনীয় জাহাজটি থেকে ১২ কিমি দূরে’ সমুদ্র আবিষ্কার করবে এবং এই কাহিনি বিস্তারের পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠবে। অবশ্য এই আবিষ্কারের এমনকিছু গুরুত্ব দেবে না কেউ। এক নদীর ধারে খোলা মাঠের মধ্যে মাকন্দোর প্রতিষ্ঠা হয়, চারপাশে কাদা আর জল, সমান সমান, অভিযাত্রী প্রতিষ্ঠাতারা তার মধ্যে একবার হারিয়ে যায়, সেখানে আদিবাসীদের বসতি আছে। আমারান এবং আরকাদিও স্প্যানিশ ভাষা শিখতে গিয়ে ‘ইন্দিয়োস’-দের (দক্ষিণ আমেরির ইনডিয়ান) ভাষা ভুলে যাবে। হোসে আরকাদিও স্বপ্ন দেখে যে সেই উষ্ণ অঞ্চলে সে বরফ আবিষ্কার করবে এবং তারপর মাকান্দায় স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আদিবাসীরা আগন্তুক-প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে বাস করতে থাকে, কিন্তু উপন্যাসে ওদের উপস্থিতি খুব একটা নেই। মাকন্দোয় ভারী বর্ষণ উল্লেখযোগ্য এক চরিত্র। কিন্তু ইচ্ছেশক্তিতে মানুষ সেখানকার ভূচিত্র বদলে দেয়। জাহাজ আসার সুবিধে হবে বলে নদীটাকে ওরা বাড়িয়ে নেয়। রেলপথ, সিনেমা, গ্রামোফোন এমনকি টেলিফোন পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়। এই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসের বীজ বোনা হয়। মাকন্দোর পতন শুরু হয় প্রথম দিকের সামাজিক সংঘাতের ভেতর দিয়ে। মেমে বোয়েনদিয়ার পুত্রকে বাড়িতে আনার ঘটনাটি মাকন্দোর ওপর চরম আঘাত হানার ঘটনাবলির একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। তখন জনগণের অবস্থা এত অনিশ্চিত যে-কোনোলোক কারো ঘরের কোনো কেচ্ছা নিয়ে মাথা ঘামাত না। কলা চাষের সময় একটি ধর্মঘটের কিছু ঘটনার কথা জানতে পারি, যার সূত্রপাত পূর্বেই ঘটেছিল। মাকন্দোর সমৃদ্ধি ও পতন এক বাস্তব স্থানের সাহিত্য-দর্শন। অনেকবারই লেখক বলেছেন–জীবনের শুরু থেকে ছোটোবড়ো যা কিছু দেখেছি সবই আমার জন্মস্থানের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা, আমার দাদু-দিদিমার বাড়িতে মানুষ হওয়ার সুবাদে সবই আমার দেখা। ক্যারিবীয় অঞ্চলের যে-কোনো গ্রামের মতোই ছিল সে গ্রাম, বাড়িটাও আর পাঁচটা বাড়ির মতোই, আমার প্রতিবেশীদের মতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং অন্ধ বিশ্বাসপ্রবণ মানুষ ছিলেন, সকাল থেকে রাত আমার কাছে সবই ছিল জাদুর মতো, কী কারণ কেউ জানত না, দিদিমা-দাদু মারা যাবার পর, উইপোকার দাপটে বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আর গ্রামটা হয়ে পড়েছিল বড়ো দুঃখী, নিঃসঙ্গ। এমন বিষণ্ণ গ্রামটি দেখে মনে হত বোধহয় ধ্বংসপ্রবাহ তার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। মাকলো ধ্বংস হয় নিজস্ব অন্তর্দ্বন্দ্বে, কিন্তু উপন্যাসে দায়ী বলা হয়েছে ইয়াঙ্কিদের বাণিজ্যিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা, সামাজিক অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি, কিন্তু বোয়েনদিয়া পরিবারের নিজস্ব দুর্বলতাও কম দায়ী ছিল না। দ্বিতীয় আউরেলিয়ানো ধনী হয়েও প্রগতির পথ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। মেমে-র চোখে দেখানো হয়েছে বিদেশিরা মাকাম্পোর ঐশ্বর্যের কেমন সদ্ব্যাবহার করেছিল। নেতিবাচক ভাষ্য এবং তথ্যে ব্যাপারটা বলা হয়–”লাইনের ধারে ধারে কলার খেত দেখেনি। গ্রিঙ্গোদের সাদা বাড়িগুলো লক্ষ করেনি, গরম আর ধুলোয় ধূসর বাগান দেখেনি, ছোটো প্যান্ট আর নীল ডোরা কাটা জামা পরা মেয়েরা যে গাড়ি বারান্দায় বসে তাস খেলত তাও তার চোখে পড়েনি। ধুলোভরা পথে মালবোঝাই গোরুগাড়ি, সে দেখেনি। সবলা মাছের মত স্বচ্ছ জলে যে তরুণীরা লাফায়ঝাপায় তাদের সে দেখেনি, তাদের সুপুষ্ট স্তনের দিকে চেয়ে ট্রেনযাত্রীরা এক তিক্ত স্বাদ অনুভব করত, মজুরদের নোংরা ঘিঞ্জি দুর্দশাগ্রস্ত বস্তিগুলো তার চোখে পড়েনি, এরই ওপরে পতপত করে উড়ে বেড়াত মাউরিসিও বাবিলোনিয়ার হলুদ প্রজাপতিরা আর যেসব বাড়িতে থাকত সবুজ রঙের শিশু আর ট্রেন চলার সময় গর্ভবতী নারীরা কি বিশ্রী চিৎকার করত। স্থান তো কেবল ল্যান্ডস্কেপ নয়। কিন্তু কেনেথ ক্লার্ক বলেন–মধ্যযুগের মাঠ বলতে কঠোর শ্রমের জায়গা ছাড়া কিছু নয়… এসব জায়গা থেকে অনেক দূরে দেখা যায় উর্বর জমিতে অরণ্য আর কাদাভরা অগভীর জলাভূমি। তিনি আরও বলেন যে প্রকৃতির প্রতি অবিশ্বাস আর তাদের ক্ষমতা যেন এক প্রতীক। “তিন শতাব্দীর বিজ্ঞান চর্চার ধারক আমরা, আমাদের মনেও কিন্তু পার্থিব সব কিছুই আধ্যাত্মিক জগতের কিংবা পবিত্র ইতিহাসের প্রতীকরূপে উপস্থিত হয়। মাকন্দোর ল্যান্ডস্কেপ সম্পর্কে এমন ধারণা খুব স্পষ্ট। লেখক তার প্রায় সমস্ত নিসর্গচিত্রকে প্রতীক রূপেই বর্ণনা করেন। কিন্তু মানুষেরই বাস সেখানে। গার্সিয়া মার্কেস-এর সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থাকে বৈপরীত্য। মাকন্দোর প্রকৃতি ও মানুষ কল্পনার অবাস্তব ধারণার চেয়ে কিছু বেশি তাৎপর্য বহন করে। ফুলে ফুলে ভরা সমতলে কলা বাগান তৈরি হওয়ার পর স্পেনীয় জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়, আরও দূরে বিস্তীর্ণ জলাভূমি।

প্রকৃতি এবং মানুষ ব্যতিরেকে বস্তুর মধ্যেও স্থানের আভাস পাওয়া যায়। ফেরানদার মনে হয় ওসব জিনিসেরও যেন নিজস্ব জীবন আছে। এসব দেখে লেখকের ধন্দ হয়। তিনি এসবের মধ্যে দোয়েলের প্রেতাত্মা) অস্তিত্ব অনুমান করেন। কারণ পুরোনো বাড়িলিতে এদের আবাস। আমরা জানি যে গার্সিয়া মার্কেস তার শৈশবের বাসস্থান সেই প্রাচীন বাড়িটা খুঁজতে চেয়েছিলেন। আত্মজৈবনিক এক সুত্র উপলক্ষে লেখকের নিজের কথায় স্পষ্ট হয় ‘দোয়েশের কীরকম জাদু সেই বাড়িটায় ছিল। আমার দিদিমা বিশালদেহী। আমি তাকে সবসময় দেখতাম শোকের পোশাকে। অদ্ভুত সব গল্পের ঝাপি ছিল তার। তিনি আমার কল্পনাকে উদ্দীপিত করতেন। লেখক গুইয়ান (Gollon) উপন্যাসটি বিশ্লেষণ করার সময় বলেন যে বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায় রূপান্তরটা এই উপন্যাসের স্থানিক পরিচয় বহন করে। কিন্তু এখানে শঙ্খলা বলতে জাদুকরী শঙ্খলা বোঝায়। যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া তার চারপাশে এমন জগৎ তৈরি করে নেয়, যা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন… বিচ্ছিন্নতা এবং নির্জনতার মধ্যে তার একাকিত্ব বেড়ে যায় এবং জাদুকরী পরিমণ্ডল বেষ্টিত এক ঐতিহ্যবাহী স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় আর এই আবহে মানুষ সুরক্ষিত বোধ করে এবং অতিপ্রাকৃত জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। জাদু কিন্তু মাকন্দোর সর্বত্র বিরাজমান, সমস্ত অঞ্চলটাই জাদুগ্রস্তু। সময়ের অতি সরল বিন্যাসের এবং ফলে উপন্যাসটি আমাদের বিশ্বাস করিয়ে দেয় যে প্রগতি বাধা পায় জাদুতে এবং মাকন্দোর ধ্বংস ত্বরান্বিত করে ওই জাদু। কিন্তু এ এক যান্ত্রিক ব্যাখ্যা, এমন ব্যাখ্যা উপন্যাসের ঐশ্বর্যময় উদ্দেশ্যটিকে আঘাত করে, এখানে কার্যকারণ এবং প্রতিক্রিয়ার সরলীকৃত মিশ্রণ নেই। উপন্যাসটি পাঠ করে যা প্রথমেই মনে হয় তা হল বিষয়বস্তুটি বড়ো জটিল, কারণ সংঘাত এবং পরিণতি বিভিন্ন স্তরে গড়ে ওঠে, যেখানে সময় ঘটনা বিন্যাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সময়নির্ভর ঘটনার গতি এক সমস্যাও সৃষ্টি করে। এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে তাৎপর্যময়, কারণ এখানে সময়ের ব্যাপ্তি একশো বছর। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি যে এতে অনেক বেশি সময়ের কথা বলা হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সময়টা দেখতে হবে। আউলিয়ানো বায়েনদিয়া সময়ের গতি দেখে বিস্মিত হয়, এক বছরে শহরের বয়স বেড়ে যায় এবং তাতে বিস্মিত হয় সে এবং পরক্ষণেই সংলাপ, উরসুলা ফিসফিস করে জিগেস করতই কী আশা করেছিলি?’ আউরেলিয়ানো বলে—’সময় বয়ে যায় ঠিক, ভাবলে এত দ্রুত ভাবতে পারিনি।‘ ‘একশো বছরের’ এক উপলক্ষ উল্লেখ করে দ্বিতীয় আউরেলিয়ানো। লোকজীবনের অঙ্গ লটারি, টিকিট বিক্রির জন্যে সে ঘোষণা করে এখানে ঈশ্বরের হাত আছে, এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না, কারণ প্রত্যেক শতবর্ষের পর একবারই এটা আসে। আর-একবার রাজনৈতিক অবস্থা প্রসঙ্গে ‘কর্তামশায়ের শরৎকাল’ উপন্যাসেও এমন এক ঘোষণা হয়। রক্ষণশীল সরকার ক্যালেন্ডার সংস্কার করছে যাতে প্রত্যেক প্রেসিডেন্টের শাসনকাল একশোবছর স্থায়ী হয়। ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একশো বছরের জীবন বেশ দীর্ঘ। এই উপন্যাসে একশো বছরের অর্থ সময়ের কোনো নির্দিষ্ট মাপ নয়, ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ এক সিসটেমের ব্যাপ্তির মাপ। বোয়েনদিয়া পরিবারের রাজত্বকাল একটি অংশমাত্র। গুইয়োন (Gollon) এক সময়চক্রের উল্লেখ করে বলেন যে লেখকের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে সময়ের পরিসর।

সময়ের গতির যথেষ্ট ব্যবহার আছে ঘটনাক্রমে। লেখকের ইচ্ছে অনুসারে সময় এগোয়, পেছোয় এবং এই ধারাটি আমরা দেখি যে লোকগাথা এবং লোককাহিনির ঐতিহ্য অনুসারী।

কোনো কোনো লেখক উপন্যাসটিতে সময় প্রসঙ্গে ফনারের প্রভাব লক্ষ করেছেন। গার্সিয়া মার্কেস অবশ্য বলেছেন যে, এই উপন্যাসটি লেখার আগে কখনও ফকনারের লেখা পড়েননি। গার্সিয়া মার্কেস-এর ব্যারোক এবং মিথ-এর অনবদ্য ভঙ্গিতে সময়ের ব্যবহার এমন উচ্চাঙ্গের যে সমকালীন কোনো লেখকের মধ্যে তা দেখা যায় না। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ এর শুরুর পঙক্তিগুলো একবার লক্ষ করা যাক–অনেক বছর পর ফায়ারিং স্কোয়াড-এর মুখোমুখি কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার মল বিদ্ধ করে এক স্মৃতি, সেই সুদূর এক বিকেলের কথা যেদিন ওর বাবা বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল। এতে সময় বহুমাত্রিক, বর্তমান (ফায়ারিং স্কোয়াড-এর সামনে), ভবিষ্যৎ (অনেক বছর পর) এবং এক অতীত (সেই সুদূর বিকেল) যাতে পারিবারিক এক স্মৃতির চিত্র পাওয়া যায়। সময়ের গতি বদলাতে থাকে। সময়ের এমন উল্লেখ দেখে কেউ কেউ বলেছেন যে, যেন পুরাণের কোনো কল্পলোকে পাঠক গিয়ে ভাসতে থাকেন হাওয়ার পিঠে চেপে। সময়ের গোলকধাঁধা প্রথমেই শুরু হয়ে যায়। গ্রামের পত্তন থেকে মেলকিয়ালেস-এর আবির্ভাব এবং বস্তুর পরিবর্তন পর্যন্ত একটা সময়। সময়, অভ্যন্তরীণ ইতিহাস এবং স্মৃতি হয়ে ওঠে। মাকলন্দাবাসীর স্মৃতি লোপ সমস্ত। বস্তুজগৎ সম্পর্কে বিভ্রম সৃষ্টি করে। অনিন্দ্রার মহামারীর ফলে বিলুপ্ত স্মৃতি অতীতবিহীন এক নির্বুদ্ধিতার ফসল। গার্সিয়া মার্কেস ভাঙা পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া সময়ের এক মহাকাব্য রচনা করনে। তার প্রকাশভঙ্গি প্রাণবন্ত, অনবদ্য।

অতীতের কলঙ্কজনক অধ্যায় সময় কমিয়ে দিতে পারে। কলা কোম্পানির শ্রমিকদের ধর্মঘটে মাকলন্দর কর্তৃপক্ষ অত্যাচার করে না। ইতিহাস বিকৃত করে ঐতিহাসিক কিন্তু হোসে আরকাদিও দ্বিতীয়র ব্যক্তিগত স্মৃতি জাগরুক, যাকে পাগল বলা হয় সে আদতে বুদ্ধিমান। আর যমজ হওয়ার ঘটনা কাকতালীয়–সবকিছু আবিষ্কৃত হয় মার্চ মাসে এবং সোমবার। বসন্তকাল, কাজের সময়। জাদুবিদ্যা অনেক পরিবর্তন ঘটায় এবং আমরা বুঝতে পারি যে “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ সেইসব অতিনাটকীয় ঘটনার বিবরণমাত্র। মাকান্দার সময় চক্রাকারে ঘোরে, মিথ্যা চক্রের আবর্তন। আমারানতার পুত্র আউরেলিয়ানো, সে এক আউরেলিয়ানোর পুত্রও বটে, তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করার জন্যই পূর্বনির্ধারিত। তার নাম হবে আউরলিয়ানো বোয়েনদিয়া এবং সে বত্রিশটি গৃহযুদ্ধে জয়ী হবে। এক্ষেত্রে ইতিহাসের নবালত্তি উলটোভাবে ঘটতে পারত (আয়নায় যেমন হয়)।কিন্তু সমস্ত রাজবংশের মতোই বোয়েনদিয়া পরিবারের ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত, যেন এটাই ভবিতব্য। প্রথম বংশধারা গাছের তলায় আটকে থাকে আর শেষটা খেয়ে ফেলে পিঁপড়ে’। এটা বর্তমান, ইতিহাস হয়ে ওঠেনি। সমস্ত রাজবংশের উত্থান ও পতন আছে, বাস্তববাদী লেখকরা তার বন্দনায় জন্ম আর পতনের কথা লেখেন।

‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে কালচক্র ধরা পড়ে নামের পুনরাবৃত্তিতে, আকস্মিক ঘটনায় নয়। চরিত্রের প্রণাবলী বংশধারায় লালিত। “বাবাদের পাগলামো এসেছে সন্তানদের মধ্যে কথাটা বলে উরসুলা। উৰ্ত্তরাধিকার প্রথা যথার্থ প্রকাশ পায় অজাচার-আতঙ্কে, যার ফলে সন্তানরা শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শেষ উত্তরাধিকারী ব্যতীত এই অঘটন ঘটে না। এও ঘটে তাদের ইচ্ছেয়। লেখক বৈপরীত্য নিয়ে খেলা করেন। অজাচার-ভীতি বেশ বাড়িয়ে বলা হয়। তুতো ভাইবোনের বিয়ে ইয়ানার জন্ম দেয়। মিথ’-এর পরিসরে সময়ও থেমে যেতে পারে। গার্সিয়া মার্কেস মনস্তত্ত্বের সদ্ব্যবহার করেন যখন কল্পনা করা হয় যে সময় এগিয়ে গেছে। এই ভাবে এতদিনের প্রত্যাশিত সাক্ষাৎকার ঘটে, যার জন্যে দুজনই প্রশ্ন তৈরি করে রেখেছিল; এমনকি উত্তরগুলো পূর্বপরিচিত, আবার হয়ে গেল চিরকালের দৈনন্দিন কথাবার্তা। উরসুলা এবং আউরেলিয়ানো এক আশ্চর্য পরিবেশে বাস করে যদিও ওটা অভ্যস্ত জীবন, আগে থেকে নির্ধারিত এক ছবি (prevista) এদিক থেকে দেখলে আমরা এই চরিত্র দুটিকে determinista-naturalista অর্থাৎ প্রকৃতির ইচ্ছেয় নিয়ন্ত্রিত ভাবতেই পারি। উপন্যাসটির চরিত্রাবলী ॥atun-tragico ‘ট্রাজিক ভাগ্যের শিকার। দূরত্বের জন্যে উপন্যাসটিকে বলা হয়েছে (oliardesco groliardic (ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিদ্রুপাত্মক রচনা) এবং কাব্যময়। লুকোনো এক অর্থ আছে এর মধ্যে, সেটি হল যে মানুষ তার নিজের বা অপরের তৈরি করা ভবিতব্য অতিক্রম করতে পারে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress