গান্ধর্বী (Gandharbi) : 08
সকাল সাড়ে নটা নাগাদ প্রতাপবাবুর টেলিফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। কটা দিন তিনি প্রায় সারাক্ষণই বাড়িতে আছেন।
—‘প্রতাপ চক্রবর্তী বলছি।’
—‘আমি প্রদ্যোৎ। অপালার দাদা।’
—‘ও আচ্ছা, আচ্ছা, বলো!’
—‘সোহম কেমন আছে?’
—‘সিডেশনে আছে তো! ঘোরটা কাটলেই আর বাড়ির কাউকে সহ্য করতে পারছে না। কাউকে না। খাওয়াতেও সেই একই অসুবিধে। তবে ভায়োলেন্সটা অনেক কমে গেছে।’
—‘আপনি ভয় পাবেন না কাকাবাবু। আমার যে সারকে নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর ডায়গনোসিস ভীষণ ভালো। তিনি বলছেন এটা একটা নার্ভাস ব্রেক ডাউন জাতীয় ব্যাপার। খুব শিগগিরই সেরে যাবে। ওকে থাকতে দিতে হবে নিশ্চিন্তে, ওর যেরকম আবহাওয়া পছন্দ তার মধ্যে। ডক্টর বিদ্যুৎ সরকারের সাজেশন, আমার বোনেরও ইচ্ছে ও রোজ একটা সময়ে আপনাদের বাড়ি গিয়ে ওকে গান শোনাবে। কী শুনলে ওর ভালো লাগবে সে সব অপুই ভালো জানে।’
—‘সে কি? কদিন পরেই তো ওর বিয়ে?’
—‘দরকার হলে বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত ও যাবে, তারপর সাত-আট দিন বাদ দিয়ে আবার যাবে। কিন্তু প্রতিদিন ওকে নিয়ে যাওয়া-আসা করার ব্যবস্থাটা আপনাকে করতে হবে কাকাবাবু!’
—‘সেটা কোনও প্রবলেম না। ওয়ান অফ মাই কারস উইল অলওয়েজ বি অ্যাট ইয়োর সার্ভিস। কিন্তু…. তুমি কি সত্যিই বলছো এতে ওর উপকার হবে?’
—‘আমাদের সেটাই আশা। লেটস ট্রাই অ্যাট লস্ট।’
—‘আমি সকালে কলেজ যাবার পথে সোহমকে খাইয়ে আসব। আর অপু যাবে সন্ধেবেলা।’
—‘অল রাইট, মাই বয়, আই ডোন্ট নো হাউ আই কান থ্যাঙ্ক ইউ।’
বিদ্যুৎদা বললেন— ‘নার্ভের ওপর সঙ্গীতের প্রভাব নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। বিদেশে। বিশেষত রাশিয়ায়। ওরা স্কাইজোফ্রেনিয়া পর্যন্ত ট্রীট করছে মিউজিকের সাহায্যে। তোমার বোন সাজেশনটা খারাপ দেয়নি। কিন্তু অপালার দুর্দান্ত সাহস এটা মানতেই হবে প্রথম দু চার দিন আমি আর তুমি হাতের কাছে থাকবো। রি-অ্যাকশনটা দেখা দরকার।’
প্রথম যেদিন প্রতাপবাবুর নীল অ্যাম্বাসাডরটা সন্ধেবেলায় কীর্তি মিত্রর গলিতে এসে দাঁড়াল এবং অপালা নীল শাড়ি পরে দাদার সঙ্গে গিয়ে গাড়িতে উঠল, সেদিন জেঠুর মুখ অসন্তোষে কুঁচকে উঠেছিল। তিনি শুধু এইটুকু জানেন— সোহমের খুব শরীর খারাপ, সে যাকে বলে বেড-রিড্ন্। কী হয়েছে নাকি এখনও ধরা যাচ্ছে না। অপাই রোজ তাকে দেখতে যাবে, বেশ কিছুক্ষণ থাকবে— এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত এরা তাঁকে না জানিয়েই নিয়ে ফেলেছে— এতে তিনি শুধু বিরক্ত নন, বিস্মিত। ব্যাপারটা তিনি তিনটে কারণে পছন্দ করছেন না। প্রথমত সোহম ছেলেটির কোনও ছোঁয়াচে রোগ হয়ে থাকতে পারে, সে-ক্ষেত্রে বিয়ের আগে অপালার সেখানে রোজ যাওয়াটা খুবই ঝুঁকি নেওয়ার শামিল। দ্বিতীয়ত, কথাটা যদি হবু-কুটুমদের কানে যায়? তাদের বাড়ির হবু-বউ রোজ সন্ধেয় একটি ছেলে-বন্ধুকে সাহচর্য দিতে যাচ্ছে যেহেতু সে শয্যাবন্দী? কিভাবে জিনিসটা তাঁরা নেবেন ভেবে কূল পাচ্ছেন না তিনি। তৃতীয় কারণটা একেবারে ব্যক্তিগত, তাঁর নিজস্ব অনমনীয় অহং সম্পর্কিত। ‘তাঁকে’ না জিজ্ঞেস করে, তাঁকে ‘না জিজ্ঞেস’ করে এরা দু ভাই বোন কি করে এটা করতে পারল? এসব ব্যাপারে তাঁর একমাত্র ভরসা বউমা। গাড়িটা বেরিয়ে গেলে তিনি বউমাকে ডেকে বললেন— ‘বউমা ওরা না হয় ছেলেমানুষ। সব জিনিসের কার্যকারণ বোঝবার অভিজ্ঞতা নেই। তুমি এটা কী করে অ্যালাউ করলে মা? ওদের তো আমি বুঝতে পারিই না। এখন দেখছি তোমাকে চিনতেও আমার অনেক বাকি ছিল।’
ভাসুরের সামনে তর্কাতর্কি করবার অভ্যাস সুজাতা দেবীর কোনকালেই নেই। তিনি ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নিয়ে বললেন— ‘দাদা, মেয়েটা তো বিয়ে করতেই চাইছিল না, অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছি, আপনি তো জানেন। একটা আবদার ধরেছে, ধরুন আইবুড়ো বেলার এই শেষ আবদার,’ বলতে বলতে তাঁর গলা ধরে এলো।
বউমার চোখের জলের সামনে রসময়বাবু একদম নিরুপায়। তিনি বললেন— ‘যা ভালো বোঝো করো। আমি আর কী বলব। ভালোর জন্যেই বলি। বুড়ো মানুষ। বাতিলের দলে।’
এ কথার কী উত্তর দেবেন বউমা। রসময় যে এ সংসারে এখনও সর্বময়, তা তাঁর থেকে বেশি আর কে জানে। কিছুক্ষণ ঘোমটা মাথায়, চুপ করে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থেকে থেকে তিনি চলে এলেন। অ্যামবাসাডরটা তখন হুহু করে ছুটে চলেছে।
নির্জীবের মতো শুয়ে ছিল সোহম। অপালাকে দেখে দুর্বল গলায় বলল —‘অপু এসেছিস? এরা আমায় মেরে ফেলতে চাইছে, মাই ওন পীপল, চিন্তা কর, ঘুমোচ্ছি, খালি ঘুমোচ্ছি, এইবার একদিন আর জাগব না।’
প্রদ্যোৎ বলল— ‘তোমার বাঁচতে ইচ্ছে করে তো সোহম?’
—‘করে বই কি? আমার তো এখনও কিছুই করা হল না। লাইফ হ্যাজ জাস্ট স্টার্টেড। হেগেলের অ্যাবসলট আইডিয়ালিজ্ম্ আর হংসকিংকিণীর রাগ-পরিচয় মাথার মধ্যে খিচুড়ি পাকিয়ে যাচ্ছে। আই কান্ট থিংক ক্লিয়ারলি।’
প্রদ্যোৎ বলল— ‘এই আমার সার, ডক্টর বিদ্যুৎ সরকার, এঁর ওপর আমাদের সবাইকার দারুণ কনফিডেন্স সোহম। ইনি বলছেন তুমি আর দিন সাতেকের মধ্যে দাঁড়িয়ে উঠতে পারবে। সব কিছু করতে পারবে। কোনও ভয় নেই। সার হলেও উনি আমার খুব বন্ধু। উনি তোমাকে ঘুমের ওষুধ দিতে বারণ করে যাচ্ছেন। নো মোর ইনজেকশনস। তা অপুর কি যেন একটা আবদার আছে তোমার কাছে।’
অপালা সোহমের বিছানার কাছে চেয়ার টেনে বসল, বলল— ‘জানিস তো সোহম, আমার নিজস্ব একটা হারমোনিয়াম নেই ভালো। এদিকে একটা অডিশন রয়েছে রেডিওয়। তোরটা যদি ধার দিস। আমি কদিন একটু রেওয়াজ করতে পারি।’
—‘নে না, নিয়ে যা না। নিয়ে যা বরাবরের মতো। আমি তো আর গাইতে পারব না।’
তার শেষ কথাটাকে অগ্রাহ্য করে অপালা বলল— ‘দূর, আমাদের বাড়িতে তোর ভালো হার্মোনিয়ম নিয়ে যাই আর ইঁদুরে কেটে দিক। তার চেয়ে আমিই রোজ এখানে এসে রেওয়াজ করে যাবো। তোর কোনও অসুবিধে হবে না তো! ধর, পাশের ঘরেও গাইতে পারি।’
—‘পাশের ঘরে কেন, এ ঘরেই গা না। গা!’
—‘কী গাইব সোহম?’
—‘তোর যা ইচ্ছে। তোর অডিশন। তুই ঠিক কর।’
—‘তুই ঠিক করে দিলে আমার ভালো লাগবে।’
—‘দরবারী গা তবে, দরবারী কানাড়া।’
—‘ঠিক আছে।’
বিদ্যুৎ সরকার আর প্রদ্যোৎ সোহমের মাথার দিকে বসে রইল। সোহম তাদের দেখতে পাচ্ছে না। সে অবসন্নভাবে বিছানায় শুয়ে। মেঝেতে কার্পেট বিছিয়ে হারমোনিয়ম তানপুরা সবই দিয়ে গেল বনমালী।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার বেঁধে তানপুরা কোলেই দরবারীর আলাপ ধরল অপালা। এক ঘণ্টা প্রায় পার হতে চলল। মধ্য সপ্তকের বড় কোমল ধৈবতে অপালার কণ্ঠস্বর হালকা মালতী ফুলের মালার মতো দুলছে। বিদ্যুৎ সরকারের ইঙ্গিতে বনমালী এক বাটি স্যুপ হাজির করল। তার মধ্যে নানারকম আনাজের কুচি। চিকেনের ফালি, নুড্ল্স্, এবং সস দেওয়া। প্রদ্যোৎ বাটিটা হাতে করে সোহমের গলায় তোয়ালে বেঁধে আস্তে আস্তে খাইয়ে দিতে লাগল। আলাপেই গান শেষ করল অপালা। তারপর বড়ে গোলাম আলির দরবারীর একটা ক্যাসেট চাপিয়ে দিল টেপে। এইসব টেপ, ক্যাসেট সবই বিদেশী। এখানে পাওয়া যায় না অত সহজে। কোনও কনফারেন্সে সোহম চুপিচুপি এই তরানা রেকর্ড করেছে। বড়ে গোলামের কণ্ঠের খেয়াল তরানা, তার সঙ্গে প্রাণভরে গাওয়া হরি ওম্ তৎ সৎ। আস্তে চালিয়ে দিয়ে ওরা ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সোহম এখন ঘুমের ঘোরে। বনমালীর ওপর ভার রইল সে সময় বুঝে ক্যাসেট বন্ধ করবে। বাইরে সোহমের দুই বউদি, এক দাদা, এবং বাবা। প্রতাপবাবু বললেন, —‘খেলো ঘুমোতলাও, কিন্তু ঘুমের ওষুধ দেওয়া হল না, ও যদি মাঝ রাত্তিরে উঠে গোলমাল করে?’
বিদ্যুৎ বললেন— ‘আমি মাইন্ড একটা ট্রাংকুলাইজার ওর জলের গ্লাসে গুলে রেখে এসেছি। যদি ঘুম ভাঙে ও জলটা খাবে, হয়ত সামান্য তেতো লাগবে। কিন্তু খেয়ে নেবে। তাতেই আবার ঘুম এসে যাবে। নইলে স্ট্রং সিডেটিভ রাখছি। প্রদ্যোৎ থাকতে পারে, যদি বলেন। তবে আমার মনে হয় স্ট্রং কিছু দরকার হবে না।’
—‘সেই ভালো বাবা, প্রদ্যোৎ যদি থাকে… প্রদ্যোতের হাতে ছাড়া তো ও খাচ্ছেও না।’
অপালা চাইল দাদার দিকে। প্রদ্যোৎ বলল— ‘অল রাইট। আমি কাল সকালে ওকে খাইয়ে তারপরে যাবো। বিকেলে কি সন্ধের দিকে অপু আসবে।’
সাত দিনের দিন বিদ্যুৎ বললেন—‘এতো ভালো ফল যে হতে পারে গানে তা তিনি নিজেও ভাবেননি।’ খুব সামান্য ট্রাংকুলাইজার দরকার হচ্ছে সোহমের। প্রদ্যোৎ এবং অপালা ছাড়াও বনমালীর হাতে সে খাচ্ছে। হিংস্র ভাবটা একেবারে চলে গেছে। কিন্তু এখনও সে বিভ্রান্ত। মনে হচ্ছে আগেকার কথা কিছু মনে নেই। অপালার গান ছাড়াও অন্যান্য গানের রেকর্ড তার ঘরে, কিংবা পাশের ঘরে মৃদু স্বরে চাপানো থাকে। খালি একদিন সরোদ চাপাতে সে রাগে কি কষ্টে কে জানে গোঁ গোঁ করতে থাকে। রেকর্ডটা চাপিয়েছিল প্রদ্যোৎ। অপালা তাড়াতাড়ি এসে সেটা তুলে নেয়, নইলে কি হত বলা যায় না।
এখন অপালার বিয়ের আর তিনদিন বাকি। বিদ্যুৎ এবং অপালার দাদার আর প্রতিদিন আসার প্রয়োজন হয় না। অপালা এসে গান ছাড়াও অনেক ক্ষণ গল্প করে। তার বিয়ের বাজার করছে প্রধানত দীপালি আর জেঠু। মা ঘর-ভর্তি আত্মীয়-স্বজনকে সামলাচ্ছেন। সোহম বলল— অপু, ওই তিলং ঠুংরিটা জানিস? ‘তোরে দেখনে কো জিয়া লাল চায়…’
অপালা বলল— ‘শুনবি?’
—‘শোনা। প্লীজ!’
মৃদু আলো জ্বলছে ঘরে। বনমালী অপুদিদি আসায় নিশ্চিন্তে আড্ডা দিতে গেছে। বউদিরা কেউ পারতপক্ষে এ ঘর মাড়ায় না। সোহমের বাবাও এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। নিজের এতদিনের কাজকর্ম পড়েছিল, তাই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
অপালা গান ধরেছে, মিড়ে মিড়ে, ছোট ছোট মুরকির কাজে ভর্তি তার আস্থায়ী। হঠাৎ অন্তরায় আসতে সে দেখল সোহম উঠে এসেছে। তার গলায় গানের কলি। সেই আগকার গলা, আগেকার সুর, খালি আরও অনেক নম্র, ব্যাকুল, মিনতিতে যেন পূর্ণ। সে হারমোনিয়মটা টেনে নিল। হঠাৎ সে গাইতে গাইতে প্রাণপণে অপালাকে জড়িয়ে ধরল। তানপুরা কেড়ে শুইয়ে রাখল কার্পেটের ওপর। হারমোনিয়ামের বেলো খোলা রইল। তারপর সে একটা পুতুলের মতো অপালাকে তুলে নিয়ে গেল তার বিছানায়। উন্মাদের মতো চুমু খেতে খেতে বলতে লাগল —‘মিতুল, ওহ্ মাই মিতুল, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ। তুমি জানো না তুমি আমার কী? তুমি আমার পরজের পঞ্চম। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না।’
সোহমের চুমোয় অপালার মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, জিভে লোনা স্বাদ, তার বুক পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মথিত হচ্ছে সমস্ত শরীর। অপালা শুধু প্রাণপণে বলতে লাগল— ‘সোহম, সোহম, আমি মিতুল নই, আমি অপু। আমায় ছাড় সোহম, ছাড় প্লীজ।’ অপালাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে সোহম, কিন্তু অসীম মমতায়, আদরে। অপালার শরীর মন বিহ্বল হয়ে যাচ্ছে। এখনও সোহম তার পূর্ণ শক্তি ফিরে পায়নি, তাই অপালা অনেক চেষ্টায় নিজেকে মুক্ত করতে পারে। সে আশ্চর্য হয়ে যায় তার একটুও ভয় করছে না। সোহম মুখ নিচু করে আছে। অপালার গালে রক্ত ছোটাছুটি করছে। হঠাৎ সোহম মুখ তুলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক গলায় বলল— ‘অপু, তুই মিতুল নোস। মিতুল যদি তুই হতো! তুই একটু মিতুলকে বোঝবি আমার হয়ে?’
অপালার ভেতরটা এখনও শীত লাগার মতো কাঁপছে। সে বলল— ‘আমাকে বোঝাতে হবে কেন সোহম, যদি বোঝবার হয় মিতুল আপনি বুঝবে।’
—‘কিন্তু ও যে দিলীপ সিনহার মোহে পড়ে যাচ্ছে!’
—‘বাজে কথা। এক্কেবারে বাজে কথা। ওসব গুজবে কান দিস না। তবে একটা কথা বলি সোহম— যে ভালোবাসা তোকে এমনি যন্ত্রণার মধ্যে, নিষ্ঠুরতার মধ্যে, অসংযমের মধ্যে ঠেলে দেয় তুই সেটাকে ধ্রুব করে রাখিসনি জীবনে। ভালোবাসার চেয়েও বড় কিছু তুই পেয়েছিস। ভালোবাসা হয়ত একদিন ফুরিয়ে যাবে সোহম, গান ফুরোবে না। মিতুলকে যদি না-ও পাস, আর কাউকে নিশ্চয় পাবি, যে সাড়া দেবে তোর ডাকে। তাকে দিয়ে তুই তোর ভালোবাসার সাধ মিটিয়ে নিস। কিন্তু গানকে ছাড়িস না কখনও। ভালোবাসার জন্যই গানকে ছাড়িস না।’
—‘গান যদি বিট্রে করে?’ সোহম এখন আবার মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে ফেলেছে। অপালার দিকে সোজাসুজি চাইতে পারছে না।
—‘গান বিট্রে করবে না। যদি না তুই আজে-বাজে চিন্তা করে, অশুচি আবর্তে পড়ে তাকে বিট্রে করিস।’
—‘আমি অশুচি, অপবিত্র হয়ে গেছি, না রে অপু!’
—‘না, আমি একেবারেই তা বলছি না। তুই খারাপ কিছু করে ফেলেছিস অসুস্থ হয়ে পড়েছিলি বলে। তুই সেটা কাটিয়ে উঠেছিস।’
সোহম ধরা-ধরা গলায় বলল—থ্রু ইয়োর মিউজিক, অপু অ্যান্ড থ্রু ইয়োর কিসেস।’ অপালার মুখ চকচক করছে লালিমায়।
সোহম বলল— ‘তুই রাগ করেছিস?’
অপালা বলল— ‘না।’ সে বেরিয়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে। সোহম হঠাৎ এগিয়ে এসে তাকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে বললে— অপু আমাকে গান গাইতে দে। অদ্ভুত ছোট্ট একটা ফিরৎ। আমার সমস্ত রক্ত গান চাইছে। অপু আমরা ছোট্ট থেকে এক সঙ্গে গান করছি। আমরা বোধহয় তানপুরোর জুড়ির তার। বোধ হয় আমরা অর্ধনারীশ্বর। অপু প্লীজ। কিস মি বাট ওয়ান্স।’
অপালা কি করবে? সে দিশেহারার মত সোহমের এলোমেলো চুলে ভর্তি ফর্সা দেবতার মতো কপালে তার পাতলা ছোট্ট ঠোঁট ঠেকালো। তারপর একটু দ্রুতই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শুনতে পেল সোহম আকুল হয়ে বলছে— ‘অপু আর আসবি না?’ অপালা চলতে চলতে বলল—‘আসব। আসর। খালি তুই যন্তরটা তুলে নে সোহম। তুই গা। পরদিন এসে যেন দেখি তুই গাইছিস।’
ঘটনাটা কাউকে বলতে পারছে না অপালা। দাদাকে না। দীপালিকে না। এ কথা কাউকে বলা কি সহজ? অথচ না বলতে পারলে তার বুকের ভেতরটা কেমন করছে। অনেক প্রশ্ন তার, অনেক জটিল প্রশ্ন ও সমস্যা মনের মধ্যে জাগছে যার উত্তর পাওয়া দরকার। উনিশ পেরিয়ে কুড়িতে পড়লেও বিবাহের অর্থ সে ভাসা-ভাসা বোঝে। পুরোপুরি এখনও বোঝে না। দীপালি তাকে একটু অবহিত করবার চেষ্টা করছে অবশ্য। কিন্তু সে মাঝে মাঝেই এমন এক একটা প্রশ্ন করে ফেলছে যে দীপুদি বলছে— ‘উঃ অপু, তোকে নিয়ে আর পারি না। বাকিটা তোর বর বোঝাবে। আমার দ্বারায় হবে না।’ দীপালির অনেক কাজও। সে নিজের গানের ক্লাস সামলে অপালার সমস্ত শাড়ি, গয়না, ব্লাউজ, পেটিকোট, জুতো ইত্যাদি প্রত্যেকটি নিজে পছন্দ করে করে কিনেছে। বরের জামা-কাপড়-জুতো, তা-ও। এবং সেইসঙ্গে প্রসাধনদ্রব্য। এতে অনেক সময় যায়। অপালা দুরু দুরু বুকে ভাবছে সোহম তার সঙ্গে ওভাবে ব্যবহার করার পর এই শরীর নিয়ে সেই রাজপুত্রের মতো সুন্দর, পবিত্র, দরদী ভদ্রলোকটির কাছে সে কী করে যাবে? তিনি তো জানবেন না! অপালা তো তাহলে তাঁকে ঠকাচ্ছে। একেই তো সে বলেই দিয়েছে গানের চেয়ে বেশি সে কাউকে কিছুকে ভালোবাসতে পারবে না। তার ওপর এই। কিন্তু সোহম কি তার প্রেমিক? না না। সোহম তার শরীরের মিতুলকে প্রেমনিবেদন করছিল। সে মুখ ফুটে বলেওছে— মিতুলকে যেন সে বোঝায়। সোহম অদ্ভুত জটিল মানুষ। অপালার সব কিছু সোজা, সরল। সবচেয়ে ভয়ের কথা সোহম তাকে অশুচি করেছে বলে একবারও মনে হচ্ছে না, উপরন্তু সোহমের স্পর্শে তার শরীরে যে শিহরণ জেগেছিল তার স্বাদ সে এখনও তার ওষ্ঠাধরে, জিভে, স্তনবৃন্তে পাচ্ছে, পাচ্ছে তার চোখের পাতার কোমল নীল শিরা-উপশিরায়, মনে হচ্ছে এই অনাস্বাদিতপূর্ব স্বর্গীয় অনুভূতি সে আরও অনেক দিন ধরে পেয়ে যাবে। বিবাহের কেন্দ্রে যদি এই স্বাদ এই আনন্দ থাকে তাহলে তো বিবাহ খুব সুন্দর জিনিস। গানের সঙ্গে তার খুব সামান্যই তফাত। কিন্তু ওই কেন্দ্রে তো সোহম নেই! কেমন লাগবে? ওঁকে ওই ভদ্রলোক যদি এভাবে…কেমন লাগবে? অপালা এমন জটিলতার মধ্যে পড়েনি আগে। এখন ঘটনাস্রোত তার হাতের বাইরে চলে গেছে। তত্ত্বর জন্য জিনিস গোছগাছ হচ্ছে। এয়োডালা, নমস্কারী সাঁইত্রিশখানা, বরণডালার জিনিস, ছাঁদনাতলার জিনিস, নান্দীমুখের হাজারখানা টুকিটাকি। ফর্দ মিলিয়ে দেখছেন তার মা আর মাসিমা, বাড়ি আত্মীয়-কুটুম্বে গমগম করছে। সকালবেলায় ওঁরা সোনার মফচেন দিয়ে আশীর্বাদ করে গেলেন। ফুলের অর্ডার যাচ্ছে। ইলেকট্রিকের লোক, ডেকোরেটরের লোক, হালুইকর বামুন। বাড়িতে এখনই যজ্ঞি শুরু হয়ে গেছে। কাছাকাছি একটি বাড়ি বিয়ের দিনের জন্যে ভাড়া নেওয়া হয়েছে। যদিও সামনেই, ফড়িয়াপুকুরের ওপর। তবু দুজায়গায় বলে—খুব ছরকট হচ্ছে। এই রাজসূয় আয়োজনের মধ্যে অপালা বসে আছে তার শিহরিত, বিভ্রান্ত শরীর মন নিয়ে। একেবারে স্থাণু।
কী কাজে প্রদ্যোৎ সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। সে ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকল— ‘দাদা!’ প্রথমটা প্রদ্যোৎ শুনতে পায়নি। দ্বিতীয়বার ডাকতে সাড়া দিয়ে বলল— ‘কিরে? আরে তুই এরকম ফ্যাকাশে হয়ে গেছিস কেন? বিয়েটা এমন কিছু ভয়ের ব্যাপার নয়! টেক ইট ফ্রম মি।’
অপালা বলল— ‘না, সোহমের খবর কি?’
—‘অনেক ভালো। প্রায় নর্ম্যাল। ওষুধপত্রের জন্যেই যা কমজোরি হয়ে রয়েছে। বই পত্র টেনে পড়াশোনা আরম্ভ করে দিয়েছে দেখলুম। কদিন যাবো না বলেই এসেছি। তোর বউভাতের পরদিনই যাবো।’
—‘দাদা, ও যদি জানতে পারে আমার বিয়ে?’
—‘তো কি?’
—‘যদি রি-অ্যাকশন হয় কোনও? এতো কষ্টে ভালো করে তোলা হল!’
—‘ঘাবড়াসনি। ও জানে।’
চমকে উঠল অপালা। —‘জানে? কখন? কিভাবে?’
—‘কাল যখন বললুম দিন তিনেক আসছি না, অপুও হয়তো বেশ কিছুদিন আসতে পারবে না তখন আমাকে জিজ্ঞেস করল কেন। বলে দিলুম।’
—‘অমনি বলে দিলি! ও অবাক হল না?’
—‘অবাক হল বই কি! কেন নেমন্তন্ন করিনি জানতে চাইল। বললুম করা হয়েছে। ওর যদি আসার মতো শারীরিক শক্তি থাকে নিশ্চয় আসবে, হাজারবার আসবে।’
—‘কেন বললি? ভয় হল না? যদি কিছু হয়?’
—‘কিস্যু হবে না। সাময়িক একটা চাপে জিনিসটা হয়েছিল। সে শকের সঙ্গে তোর কোনও সম্পর্ক নেই। ওষুধে…মানে বিদ্যুৎদা আর তোর ওষুধে ও ঠিক হয়ে গেছে। সত্য জানতে দেওয়া ভালো। ও যদি তোর ওষুধের ওপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সেটা কি খুব ভালো হবে?’
অপালা নিশ্চল হয়ে রইল।