Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গান্ধর্বী || Bani Basu » Page 26

গান্ধর্বী || Bani Basu

মিতুলের মন আজ খুব খুশি। ভারত সরকার ওদের প্রথমে রাশিয়ায় যেতে বাধ্য করেছিলেন। রাশিয়ায় প্রধানত মস্কো ও কিয়েভে অনুষ্ঠান করে ওরা দারুণ সাফল্য পায়। বিষয় ছিল সমুদ্রমন্থন এবং মহাপ্রলয়। সমুদ্রমন্থনের বিপুল তরঙ্গের আলোড়ন থেকে ঊবশী উঠছেন, লক্ষ্মী উঠছেন এই দুটি ভূমিকাতেই নৃত্যাভিনয় করেছে মিতুল। সামান্য একটু সাজপোশাকের এবং মেকাপের বদলে এবং উন্নত আলোক শিল্পের মহিমায় কেউ বুঝতে পারেনি। যে লক্ষ্মী সেই উর্বশী। নারায়ণের লক্ষ্মীলাভের অংশটুকু শেখরণের সঙ্গে তার দ্বৈত নৃত্য। আবার শিবের কণ্ঠে বিষধারণেও শেখরণ। এখানেও সেই একই মেকাপের অদল-বদল এবং আলোর কায়দা। দুটি মিথ্ই রাশিয়ান ভাষায় অনুবাদ করে বিলি করা হয়েছিল দর্শকদের মধ্যে। কিন্তু মিতুলের আসল লক্ষ্য ছিল পারী। পারী যাবার আগে রাশিয়া ছাড়াও ওদের যেতে হল রোমানিয়ায়। সেখানে ওরা মঞ্চস্থ করল ‘চার-অধ্যায়’। এগুলোই ওদের আপাতত তৈরি হয়েছে। গতকাল লা বুফ দ্যু নর-এর বিখ্যাত মঞ্চশালায় সমুদ্রমন্থন ও মহাপ্রলয় হয়েছে আরও অনেক পরিণত। শেখরণ নিজেই বলেছে পার্ফেক্ট। ‘মহাপ্রলয়ে’ হুড় হুড় করে ভেঙে পড়া জলের দৃশ্যে, শুধু একটি মাত্র দৃশ্যে আলোর কেরামতির সাহায্য নিয়েছে। সেটি চমক, বৈজ্ঞানিক চমক, যদিও তারও সঙ্গে কুটোর মতো ভেসে যাওয়া মনুষ্য স্রোত ছিল। তাদের হাতের মুদ্রা, পায়ের কাজ, চোখের অভিনয় ছিল অসাধারণ। কিন্তু মহাপ্রলয়ের একটি দৃশ্য তারা করেছে শিল্পীদের থাকে থাকে সাজিয়ে, তাদের আঙুলে ও মাথায় সমুদ্র সবুজ, ফেনশুভ্র, ছাই-ছাই রঙের বড় বড় রুমাল উড়িয়ে। উদয়শংকরের ‘সামান্য ক্ষতির’ আগুন-জ্বলে ওঠার দৃশ্য পরিকল্পনা থেকে শেখরণের মাথায় এসেছিল এ জিনিস। সেই সঙ্গে নানারকম পাকশিন ইনস্ট্রুমেন্ট ও গং-এর বাজনা। এবং মিতুলের বাণীহীন সুরের আলাপ। সমুদ্রমন্থন ওরা প্রথম দেখায়, তারপর ‘মহাপ্রলয়’, কারণ মহাপ্রলয়ের অভিঘাতের পর আর কিছু চলে না। আধুনিক সভ্যতার সব মিনার, সব যন্ত্র, অত্যাধুনিক পোশাক পরিহিত মানুষ, তাদের নানা ধরনের বিকৃতি, এমনকি সম্পূর্ণ নগ্নতাও তারা হাজির করেছে প্রথম পর্বে। তারপর আসে আকাশ থেকে মেঘ গর্জনে দৈববাণী। তাকে মানুষের ভাষা বা কণ্ঠ বলে বোঝার কোনও উপায় নেই। খালি বোঝা যায় এক ভৈরব আসছে। এ অংশটার রাশিয়া-পর্বে এতো উৎকর্ষ ছিল না। রিহার্স্যাল, রিহার্স্যাল, রিহার্স্যাল, শেখরণ, মিতশ্রী এবং অন্যান্য শিল্পীদের মহড়া চলেছে দিনের পর দিন, বাতানুকূল ঘরের মধ্যে ঘেমে চকচকে হয়ে গেছে সবাই। তবুও করেছে, করে চলেছে। তার ফল মিলল লা বুফ-এর প্রযোজনায়। মনে হচ্ছে এই নাট্যনৃত্য এখন বহুদিন ধরে চলবে। ভেঙে পড়ছে দর্শক, মফস্বল থেকে, অন্যান্য প্রদেশ থেকে। টিকিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে দর্শক আসছে। ইংলন্ড থেকে আমন্ত্রণ। কদিন পর মঁমাত্রের এক পেভমেন্টের কাফেতে শেখরণ এবং ওদের গ্রুপের আরও কিছু শিল্পীর সঙ্গে পারীর লোকজনের খুব আড্ডা চলছে। খালি মিতুল একটা কোণের টেবিলে বসে স্কেচবুক নিয়ে নকশা আঁকছে। লক্ষ্মী-নারায়ণের নৃত্যের আরও নানা নকশা। একটি বৃদ্ধ, তালিমারা জামাকাপড় পরা দন্তহীন সাহেব, হয়ত ফরাসীই, এসে বিনা ভূমিকায় তার সামনের চেয়ারটাতে বসে পড়ল। লোকটাকে ভিখারির মতো দেখতে। মিতুল একবার চোখের কোণ দিয়ে দেখেই আবার নিজের নকশায় মনোনিবেশ করেছে। হঠাৎ মনে হল লোকটি বিড়বিড় করে তাকে কিছু বলছে! অনেক চেষ্টা করে সে উদ্ধার করল লোকটি বলছে ‘ভোয়ালা মাদমোয়াজেল’। অর্থাৎ সে এবার কথাবার্তা বলতে চায়। মিতুল ফরাসীভাষার ন্যূনতম বাক্যগুলোও রপ্ত করতে পারেনি। তার আর যে প্রতিভাই থাক, ভাষা শেখার প্রতিভা নেই, যে প্রতিভা শেখরণের বিস্ময়কর। কাজ চালানো কয়েকটা বাক্য সে শিখে রেখেছে বটে, কিন্তু বললে ফরাসীরা বোঝে না, ফরাসীরা বললে সে বোঝে আরও কম। কাজেই বৃদ্ধ যখন তাকে ফরাসীতে জিজ্ঞাসা করলেন—সে ফরাসী বোঝে কি না। সে বিনা দ্বিধায় বলে দিল ‘না’। তখন বৃদ্ধ ইংরেজি আরম্ভ করল। সে না-ছোড়। অনেক দূরের দিকে সে এক একবার তাকায় আবার তাকায় মিতুলের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। অবশেষে সে বলল—‘আই হ্যাভ এ স্ত্রং ফীলিং দ্যাত আই হ্যাভ সীন য়ু সামহোয়্যার।’ মিতুল কাজে মগ্ন, সে তার ছবিতে টান টোন দিতে দিতে বলল—‘আই অ্যাম অ্যান ইন্ডিয়ান, দিস ইজ দা ফার্স্ট টাইম আই অ্যাম ট্র্যাভলিং অ্যাব্রড, হাউ ক্যান ইউ সি মি? আই ডান্সড লাস্ট নাইট অ্যাট ‘লা বুফ’, ইউ মে হ্যাভ সীন মি দেয়ার।’ বৃদ্ধ বলল, না, সে লা বুফের প্রোগ্রাম দেখেনি। হঠাৎ সে প্রায় ভিক্ষে করার ভঙ্গিতে মিতুলের কাছ থেকে তার স্কেচ বুক ও পেনসিল চাইল। মিতুল খুব বিরক্ত ভাবে যখন জিনিস দুটো এগিয়ে দিল, তখন কাফের আরেকপ্রান্ত থেকে তাদের বাঙালি বন্ধু অনীক হালদার এগিয়ে এসে বললেন-‘মিতশ্রী, মিতশ্রী এই ভদ্রলোকটি এক অসাধারণ পেইন্টার। প্রতিকৃতি আঁকতেন, শুদ্ধু প্রতিকৃতি। শিল্পজগতের নানা নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উনি ভেড়েননি। বেচারি ভেসে গেছেন। এখানকার সবাই ওঁকে দয়া করে খাওয়ায়, সরকারি সাহায্যও উনি কিছু পান। কিন্তু সেগুলো যথেষ্ট নয়। ইনি খুব সম্ভব ভারতেও গিয়েছিলেন ছবি আঁকতে। দ্যাখো উনি নিশ্চয়ই তোমার একটা স্কেচ করছেন।’

এক পলক তাকিয়ে সত্যিই মিতুল দেখল স্কেচবুকের পাতায় দু-চারটে টানে তার নাক চোখ, চুলের ফের ফুটে উঠছে। সে বলল, ‘ওঁর নাম কী?’ ‘পোল মাসো। অখ্যাত, অবহেলিত একেবারে।’ ততক্ষণে বৃদ্ধ স্কেচবুক আর পেন্সিলটা মিতুলকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাতে বলিষ্ঠ রেখার আঁচড়ে মিতুলের আবক্ষ মূর্তি। যেমন সে কাঠের চেয়ারে বসে আঁকছে ঠিক সেইভাবে। বিড়বিড় করে ‘মের্সি, মের্সি’, বলতে বলতে বৃদ্ধ ভিড় কাটিয়ে চলে গেলেন, মিতুলের ইচ্ছে থাকলেও তাঁকে কিছু খাওয়াতে পারল না। অনীক বলল ‘অদ্ভুত যাযাবর লোক। হয়ত এখন আর পারীতেই থাকবে না। চলে যাবে পাহাড়ে, গ্রামে, রাস্তার ধারে শুয়ে শুয়ে ফুলের মেলা দেখবে। এই রকম স্কেচ-টেচ করে কিছু রোজগার করবে তা দিয়ে একটু রুটি, একটু পনীর আর একটু মদ।’

এর দিনকয়েক পর লুভ্‌র্ দেখে ফিরে এসে মিতুল একটা পার্সেল এবং একটা চিঠি পেলো। চিঠিটা রামেশ্বরের। তিনি জানিয়েছেন অপালার সহসা গলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। অত্যন্ত আকুল হয়ে জানিয়েছেন। নানা চিকিৎসা করেও উন্নতি হচ্ছে না। মিতুল কি এ বিষয়ে ভাববে? কিছু করবে? আর কোনও কথা নেই রামেশ্বরের চিঠিতে। তিনি কেমন আছেন। মিতুল কেমন আছে। তাদের প্রোগ্রাম কিরকম হচ্ছে। কিছু না। চিঠিটা শুধু একটা দীর্ঘ তীব্র মিড়, মুদারার কোমল রেখাব থেকে ষড়জ পর্যন্ত। প্রথমেই মিতুলের মাথাটা একদম গুলিয়ে গেল। প্রথম ভয়ংকর কথাটাই মনে হল—‘ক্যানসার, ক্যানসার নয় তো!’ সে সঙ্গে সঙ্গে এয়ার-লেটার বার করে উত্তর লিখল, সংক্ষেপে—‘বাবা, অপালাদির খবর শুনে আমি বড্ড বিচলিত হয়ে পড়েছি। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে, যত বড় ডাক্তার বা হসপিট্যালই হোক, যত টাকাই লাগুক যেন একটুও দেরি এবং দ্বিধা করা না হয়। আমি এদিক থেকে খোঁজ নিতে থাকছি। তোমার আমার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে যা টাকা আছে তা থেকে এখন যত দরকার খরচ করো, আমি শিগ্‌গিরই ডলারের ড্রাফট্ পাঠাচ্ছি।

মিতুল।’

পার্সেলটার কথা তার মনেই ছিল না। শেখরণ ঘরে নক করে ঢুকল। সে কোনিয়াকের কথা বলেছে, এখুনি আসবে। বললোলুভর—লুভ্‌র্ দেখতে অন্তত এক মাস লাগবে আমার। মিতুল তুমি কি বলে!

মিতুল ভীষণ উদ্বিগ্ন মুখে চিঠিটা দেখিয়ে দিল। সে কথা বলতে পারছে না। চিঠিটা পড়ে শেখরণ মিতুলের জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে বলল—‘এ কি কাঁদছো কেন? অসুখ করেছে। চিকিৎসা হবে!’

মিতুল ধরা গলায় বলল—‘অপুদির নিশ্চয়ই ক্যানসার হয়েছে!’

শেখরণ বলল—‘গলায় ব্যথা নেই, খাওয়া-দাওয়া করতে পারছেন। চেহারায় কোনও কষ্টের ছাপ নেই লিখছেন। আই ডোন্ট থিংক ইট ইজ ক্যানসার।’

মিতুল বলল—‘বলছো? সত্যি তোমার তাই মনে হচ্ছে?’

শেখরণ বলল—‘অফ কোর্স, এতো ভেঙে পড়ার কী আছে!’ সে মিতুলের ভিজে চোখের ওপর সুদীর্ঘ চুম্বন দিল। কিন্তু মিতুল আজ মেতে উঠতে পারছে না। শেখরণ বলল—‘মিতুল এ পার্সেলটা খোলোনি? খোলো?’

মিতুল বলল—‘বাবাইয়ের চিঠিটা পাওয়ার পর আমার আর…’

নিজেই খুলে ফেলল শেখরণ পার্সেলটা। ওপরেই একটা খামের চিঠি। মিতুল খুলে পড়তে লাগল।

প্রিয় মিতুল,

ভেবেছিলাম এই দরকারি কাগজপত্রগুলো অপুর হাত দিয়ে তোকে দেওয়াবো। কিন্তু অপুকে এখন কিছুর মধ্যে জড়াতে ইচ্ছে করছে না। শোন, ক্যালিফর্নিয়ায় একটা প্রোগ্রাম করতে হয় আমাকে একটা ওল্ড পীপল্‌স্ হোম-এর জন্য, সেখানে আমার পূর্ণ পরিচয় দেবার পর আমি গান আরম্ভ করি। যেমন সর্বত্র করে থাকি। গান শেষে যখন চলে আসছি, তখন ওঁদের কর্তারা আমাকে জানান একজন জু ভদ্রমহিলা, ওখানকারই স্থায়ী বাসিন্দা আমার সঙ্গে বড্ড দেখা করতে চাইছেন। আমি যদি তাঁকে এবং তাঁদের বাধিত করি।

মিতুল, এই জ্যুয়িশ মহিলা খুব মৃদু আলোয় নিজেকে অন্ধকারে এবং আমাকে আলোতে রেখে বসেছিলেন। তিনি আমাকে খুব চমকপ্রদ একটি গল্প শোনান সেটি আমি তাঁর জবানিতেই তোকে শোনাচ্ছি: ‘আমি জু নই। আমার নাম, প্রকৃত নাম, সিতারা। আমি বেনারসে এক বাঈজীর ঘরে জন্মাই। মা যখন আমাকে নাচ গানের তালিম দিয়ে তৈরি করে দিয়েছেন, এবং আমি আমার বাঈজী জীবন শুরু করে দিয়েছি, সেই সময়ে এক সাহেব কাস্টমারের সঙ্গে আমার ভারী আলাপ হয়ে যায়। সে কথায় কথায় জানায় সে আমাকে মডেল করে ছবি আঁকতে চায়, আমি রাজি হয়ে যাই। তার সঙ্গে আমি বেনারসের নানান জায়গায় ঘুরতে থাকি। এমনকি চলন্ত নৌকার বুকেও সে আমার ছবি আঁকতো। এবং যথেষ্ট টাকা দিত। এর নাম জাঁ পোল মাসো। এই ফরাসী চিত্রকরকে আমি ভালোবেসে ফেলি। মিতশ্রী এরই সন্তান। মা আমার সন্তান সম্ভাবনার কথা জানতে পেরে আমাদের মেলামেশা বন্ধ করে দ্যান। তিনি আমার গর্ভের সন্তান নষ্ট করে দেবার চেষ্টাও করেন। কিন্তু আমি আমার সঙ্গীত শিক্ষক কেদারনাথজীর কাছে অনেক কাকুতি-মিনতি করে আশ্রয় জোগাড় করি। ক্রমে হয়ে গেলাম কেদারনাথজীর স্ত্রীর মতো। মিতুল জন্মালো। মায়ের ভয়ে আমি বাড়ি থেকে বেরোতে পারতুম না। কেদারনাথ কথা দিয়েছিলেন। পোল-এর খোঁজ এনে দেবেন। দ্যাননি। সেখান থেকে অতএব পালালাম তোমার গুরু রামেশ্বরকে অবলম্বন করে, খোঁজ করতে থাকলাম। তারপর ইমদাদ বিদেশ যাচ্ছে শুনে তার সঙ্গেই ভেসে পড়ি। এদের কাউকেই আমি আমার আসল উদ্দেশ্যর কথা বলিনি। কিন্তু সারা আমেরিকা ইয়োরোপ ঘুরেও আমি জাঁ পোল মাসোর দেখা পাইনি। সৌন্দর্য ছিল, নাচ-গানের শিক্ষা ছিল, অনেক উপার্জন করেছি। ভেবেছিলাম, যে বৃদ্ধাবাস আমাকে শেষ আশ্রয় দিল তাকেই ডোনেশন হিসেবে সব দিয়ে যাবো। কিন্তু এখন যখন নিজের সন্তানের খোঁজ পেয়েছি, তখন আমার যা কিছু সব তারই।’—মিতুল, তোর মা-বাবা দুজনেরই সন্ধান এনে দিলাম। এবার আমায় মাফ করবি তো!

সোহম্

চিঠিটা পড়ে মিতুল ঠিক একটা পাথরের মূর্তির মতো হয়ে গেল। তার শুকনো মুখ, স্তব্ধতা দেখে শেখরণ বলল—‘এ চিঠিটা কার? পড়তে পারি?’ মিতুল শুধু ঘাড় নাড়ল। চিঠি পড়া শেষ করে শেখরণ, অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর আস্তে আস্তে বলল—‘মিতুল, তুমি বিধাতার এক অনবদ্য সৃষ্টি, ফরাসী চিত্রকর তোমার পিতা, কাশীর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যসম্পন্ন নৃত্যগীত-পটিয়সী রূপসী তোমার মাতা, তোমাকে পালন করেছেন অসাধারণ গীতকোবিদ কেদারনাথ চৌবে আর রামেশ্বর ঠাকুর, তুমি সত্যিই উর্বশী। এসো মিতুল আমরা লক্ষ্মী নারায়ণের মহড়াটা আজ কমপ্লিট করি। করবে না?’ মিতুল খুব অনিচ্ছুক ভাবে আস্তে আস্তে উঠল। তারপর ঘরের মাঝখানে খুব ধীর গতিতে তার পদসঞ্চার আরম্ভ হলো। মুদ্রাগুলি অনেক সময় নিয়ে বন্ধ হচ্ছে খুলছে, যেন এক একটা ফুল সূর্য ওঠার সময়ে খুব আস্তে সবার অলক্ষ্যে ফুটে উঠছে আবার সূর্যাস্তের পর খুব আস্তে সবার অলক্ষ্যে মুদে যাচ্ছে। ব্যালের অনুকরণো যেখানে শেখরণ তাকে উঁচুতে তুলে ধরে, সেখানেও সে এইরকম দীর্ঘায়িত ছন্দের ভঙ্গিমা হয়ে রইল। নাচ শেষ হলে, শেখরণ বলল—‘আজ একটা নতুন আইডিয়া এলো। লক্ষ্মী নারায়ণের নাচটা করতে করতে হঠাৎ আমরা এরকম স্লো-মোশন হয়ে যাবো। অদ্ভুত হবে।’

মিতুল কোনও কথা বলল না। পার্সেলের বাকি অংশগুলো এবার সে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। অনেক বিবর্ণ ফটোগ্রাফ। কিছু স্কেচ, একটি নূড, সবই তার মতো দেখতে একটি তরুণীর। ফটোগ্রাফগুলির ভেতর থেকে শনাক্ত করা যায় একটি তরুণ স্পর্শকাতর বিদেশী মুখ, সুন্দর, খুবই সুন্দর। তার সঙ্গে কদিন আগে দেখা ওই জীর্ণ-শীর্ণ ভিখারি আর্টিস্টকে মেলানো যায় না। উইলের কপি রয়েছে ভেতরে। রয়েছে তার মায়ের বিভিন্ন সময়কার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি।

শেখরণ বলল— ‘সর্বাগ্রে তোমার খোঁজ করা দরকার তোমার মার।’ মিতুল এখনও কোনই কথা বলছে না।

পরদিন শেখরণই পার্সেলে প্রদত্ত ঠিকানার ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে জানল— বৃদ্ধা মিশেল ক্লেয়ার্স মাস তিনেক হল মারা গেছেন। যা কিছু আইনগত কাজ কারবার আছে সেগুলি মেটালেই মিতশ্রী ঠাকুর পেয়ে যাবে মিশেল ক্লেয়ার্সের সঞ্চিত অর্থ সুদে-আসলে সতের লক্ষ ডলার।

খবরটা পাওয়ার পর মিতুল আস্তে আস্তে বলল— ‘এই টাকাটা ওই শিল্পী জাঁ পোল মাসোকে দিয়ে দেওয়া যাক।’

শেখরণ বলল— ‘উনি মদ খেয়ে ও টাকা ওড়াবেন। ওঁর জন্য কিছু টাকার ব্যবস্থা আমরা অনীকের সঙ্গে আলোচনা করে করতে পারি। কোনও না কোনওদিন তো উনি মঁমাত্রের ওই কাফেতে আসবেনই। অপালাদির চিকিৎসার জন্য খরচও এর থেকে করা যায়।’

মিতুল বলল— ‘না। অপুদির চিকিৎসার খরচ আমার। এ টাকা দিয়ে অন্য কিছু করার প্ল্যান করো।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress