গান্ধর্বী (Gandharbi) : 19
‘আশাবরী’ ফিল্মের শেষ গানটি ছিল অপালা এবং মিতশ্রীর যুগ্ন গান। আসাবরীতে। ললিতে আরম্ভ করে ধীরে ধীরে আসাবরীতে মিশে গেছে। অসম্ভব সাফল্য পেয়েছে গানটি। মিতশ্রীর গলার দানাওলা বুনোট, একটু ভারী যেন স্প্যানিশ গীটারের মতো দাপট, অন্যদিকে অপালার সুরবাহার। সত্যি-সত্যিই কখনও নাভি থেকে, কখনও হৃদয় থেকে, কখনও কণ্ঠ থেকে কখনও মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসছে সুরধারা। দুটো স্বর একেবারে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে তাদের দ্বৈতসঙ্গীতে। তারা কখনও গেয়েছে দুজনে, কখনও এ একা, কখনও ও একা।
‘আশাবরী’ ফিল্ম জগতে একটা হই-হই ফেলে দিল। সকলেই বলছে মার্গ-সঙ্গীতের ওপর ভিত্তি করে কোনও ছবির এতখানি সাফল্য কেউ চিন্তাতেও আনেনি। মার্গ সঙ্গীতের বিক্রিরও একটা রেকর্ড হয়ে গেল। সকলেই বলছে ফিল্ম যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এক সময় পপুলার করেছিল, সেরকমই ফিল্ম এবার উচ্চাঙ্গসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করল। ছবির প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী চললে এটা হত কিনা সন্দেহ। গল্পটাকে বহুবার বদলে বদলে ফেলা হয়েছে। বেশ কিছু ফিল্ম নষ্টও হয়েছে। কিন্তু মিতুল যতক্ষণ না তৃপ্ত হচ্ছে ততক্ষণ থামেনি। এবং দেখা গেছে তার সৃজনীশক্তি, কল্পনা, পরিচালক গৌরাঙ্গ সিন্হার থেকে অনেক অনেক পরিণত। রামেশ্বরের অপূর্ব সব বন্দিশ চয়ন, অপালার অপ্রত্যাশিত কণ্ঠলাবণ্যের আবিষ্কার ছবির মূল ভিত্তি। মিতুল তার জীবনের যা কিছু স্খলন, পতন, ত্রুটি, খেয়াল, জেদ, সাফল্য, গ্ল্যামার ছড়িয়ে দিয়েছে ছবিটির প্রথম অংশে। অপালার সঙ্গে তার গানের মোকাবিলা ছবিটির ক্লাইম্যাক্স। প্রথমে এরা রেখেছিল সেই বহুব্যবহৃত প্রতিযোগিতা টেকনিক। কিন্তু অপালার গানের পরিপক্কতার সঙ্গে প্রতিযোগিতাকে খাপ খাওয়াতে স্বয়ং মিউজিক ডিরেক্টরই ব্যর্থ হয়ে গেলেন। মিতুল একে পাল্টে দিল এক জলসায়। যাতে নাকি সে জনপ্রিয়তম পপ-সিঙার হিসেবে উপস্থিত। এবং এইখানে মিতুল তার মনের সাধ মিটিয়ে গানের সঙ্গে নাচলও। সে নাচ ভরতের নাট্যশাস্ত্র মেনেও নয়, ব্যালের নিয়ম মেনেও নয়, শুধু গানের সুরের সঙ্গে নিজেকে কখনও সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ মুচড়িয়ে যাওয়া, কখনও ভেসে যাওয়া মঞ্চের ওপর দিয়ে, কখনও শুধু পায়ের কাজ, কখনও কত্থকের মতো, কখনও ব্যালের ভঙ্গিতে। তার এই অদ্ভুত খিচুড়ি নাচের এফেক্ট দেখে ডিরেক্টর আরও কয়েকটা এরকম নাচের সিকোয়েন্স রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মিতুল রাজি হয়নি। অন্য গানের সঙ্গেও সে নেচেছে কিন্তু সে শুধু অল্পস্বল্প হাতের মুদ্রা, কটিভঙ্গ। একটু পায়ের কাজ, চোখের ভঙ্গি এই পর্যন্ত। তার যুক্তি এ জিনিস আগে থেকে অভ্যাস করিয়ে দিলে ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যে এর তেমন ইম্প্যাক্ট হবে না। উপস্থাপনার শিল্পে মিতুলের জন্মগত অধিকার। দেখা গেল মিতুলের ধারণাই ঠিক। ফিল্মে আছে নায়িকার এই গানের পরে দর্শক-শ্রোতা তুমুল হাততালিতে ফেটে পড়ল। হলে হলে ফিল্মটি দেখার সময়েও দর্শকদের একই প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত। এর পরই অপালার গান। অভিনয় করছেন একজন নামকরা পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন বছর বয়স্ক প্রতিথযশা অভিনেত্রী। সেই তুমুল হাততালির পর তিনি তাঁর মহিমাময়, শান্ত, প্রত্যয়ী পদক্ষেপে আস্তে আস্তে এসে বসছেন, যন্ত্রীরা চারপাশে নিজেদের সাজিয়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। তিনি ধীর ভঙ্গিতে আরম্ভ করলেন কৌশিকী কানাড়া। আশ্চর্যের বিষয় অন্তত কুড়ি মিনিট এই গানের সিকোয়েন্স। আলাপ, গান, সুরবিস্তার, নানারকম লয়কারি, সরগম। এবং অবশেষে ভজন ‘দুসর ন কোই মেরে তো গিরধার গোপাল।’ ফিলমের দর্শক একেবারে লুপ্ত পূর্বস্তৃতি হয়ে এই গান শুনল, যখন শেষ হল তখন নায়িকার বহু আলো এবং যন্ত্রের কারসাজি সমেত গান ও নাচের রেশ সম্পূর্ণ মিলিয়ে গেছে। ফিলমে দেখানো হচ্ছে এই গানের শেষে একটিও হাততালি নেই, আবহসঙ্গীত নেই, এক ভরাট নৈঃশব্দ্যের মধ্যে গায়িকা যুক্ত করে মাথা নিচু করে তাঁর শ্রোতাদের নমস্কার জানাচ্ছেন। শ্রোতারাও ঠিক সেই একইভাবে তাঁকে নমস্কার করছেন, নিচু হয়ে। পাশ থেকে সামনে থেকে ওপর থেকে শট নেওয়া হয়েছে। ওপর থেকে নেওয়া শটটা দেখাচ্ছে অনেকটা রেড বোডের ওপর ঈদের নামাজের দৃশ্যের মতো। তারপর দিগ্ধা দিগ্দি্গ থেই এই ছন্দের তেহাইয়ে সমস্ত দৃশ্যপটটিকে তিনবার ঘুরিয়ে অবশেষে অডিটোরিয়ামে বসা মিতশ্রীর স্তব্ধ দেহ আর মুখের ওপর ক্যামেরাকে স্থির করা হয়েছে। যেন একটা উদ্দেশ্যহীন ঘুরন্ত জীবনের চক্রদার শেষ করে এবার তার জীবন এক অর্থপূর্ণ মূল্যবান সমে এসে থামল। ইঙ্গিতটা এইরকম। এরপর আছে অপালার যথেষ্ট গান, ভাটিয়ার, বৃন্দাবনী সারং-এ রাগপ্রধান, তিলক কামোদ যার শেষে সে হঠাৎ নজরুলের গানটি ধরে নেয় মাঝখান থেকে। ছবি যেখানে শেষ হচ্ছে সেখানে অনেক প্রার্থনা অনেক সাধনার পর নায়িকা এই সাধিকা শিল্পীর পর্যায়ে পৌঁছতে আরম্ভ করেছেন। নির্জন পর্বতবাসে ডুয়েট গান প্রথম ললিত তারপর আসাবরীতে। পুরো আধ ঘণ্টার গান, আলাপ, বিলম্বিত খেয়াল, দ্রুত খেয়াল যার অনেকটাই যন্ত্রসঙ্গীতের মতো ঝালার ভঙ্গিতে গাওয়া। একজন দ্রুত তান করে যাচ্ছে, আরেকজন মিড় টানছেন কণ্ঠে, গভীর দরদী। ব্যাকুল মিড়। তারপর সেই দ্রুত গান চৌগুণ থেকে একেবারে প্রথমে যে ভাবে আরম্ভ হয়েছিল সেই ধীর বিলম্বিত ঠায়ে শেষ হচ্ছে। অবশ্য এর সঙ্গে আছে প্রচুর দৃশ্য। নায়িকার জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, দুঃখ, শোক, আনন্দ, আবেগ সবই এখানে গানের অগ্রগতির সঙ্গে দেখানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে অন্ধকার কেটে ভোর হবার দৃশ্য। পাহাড়ের তুষারাবৃত শৃঙ্গে শূঙ্গে নানান রঙে সূর্যালোকের প্রতিবিম্বিত হবার দৃশ্য। কিন্তু এই সব দৃশ্য-কাব্য ছাড়াও শুধু গানের গুণেই ছবিটি জনপ্রিয়তা অর্জন করল। এটা কোনও মার্গসঙ্গীত-ভিত্তিক ছবির পক্ষে সম্ভব বলে কেউ মনে করেনি। পরিকল্পনার বাহাদুরি যে প্রায় সম্পূর্ণই মিতশ্রীর প্রাপ্য সে কথা স্বয়ং গৌরাঙ্গ সিনহা পর্যন্ত শতমুখে স্বীকার করলেন। ছবিটির ইংরেজি সাব-টাইটল হল— ‘দা মিউজিক অফ অ্যাসপিরেশন।’ স্বদেশ-বিদেশে প্রচুর পুরস্কার পেলো ছবিটি। শ্রেষ্ঠ গায়িকার পুরস্কার পেলো অপালা দত্তগুপ্ত। কিন্তু মিতুলের আসল লাভ হল অন্যখানে। সে বরাবর অপালাকে ভালোবাসে। অপালাদির এই সাফল্যে সে শুধু যে আনন্দিত তাই নয়, একটা প্রিয়জনকৃত্য এতদিনে করল—এই তার মনোভাব। দ্বিতীয়ত রামেশ্বর ঠাকুরকে এখন অনেকেই মিউজিক ডিরেক্টর হবার জন্য ডাকছে। তিনি রাগসঙ্গীতের সুর তো সম্পূর্ণ দিয়েছেনই, তার ওপর জায়গায় জায়গায় আবহসঙ্গীত করেছেন অসাধারণ। আর তৃতীয়ত মিতুল এতদিনে বোধহয় তার বহুদিনের অন্বিষ্ট এবং নাচকে একত্রে পেলো।
নাচের কমপোজিশনের জন্য রাখা হয়েছিল শেখরণ নামে একটি যশস্বী শিল্পীকে। অন্যান্য নাচের রচনা ইনি নিজেই করলেন যথাযথ। কিন্তু মিতুল যখন তার ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যের নাচটি দেখালো, শেখর বললেন—‘এ তো একেবারে অন্যরকম। খানিকটা আমেরিকান মডার্ন ডান্সের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এতে আমি হাত দিতে পারবো না। এতে কিছু করার নেই। ইট ইজ পার্ফেক্ট ইন ইটস ওন ওয়ে। আপনি কার কাছে নাচ শিখেছেন?’
মিতুল একটু হেসে বলল—‘কারুর কাছে না। দেখে দেখে। বই পড়ে পড়ে।” শেখরণ্ অবাক হয়ে বললেন—‘আর ইউ সীরিয়াস?’
—‘ওহ ইয়েস।’
—‘আমার কাছে শিখবেন? আপনাকে আমি কয়েক বছরের মধ্যেই তৈরি করে দেবো। আপনার তো দারুণ ফ্লেক্সিব্ল্ বডি, শিখবেন?’
শেখরণ্ দক্ষিণী ব্রাহ্মণ। তার গায়ের রঙে একটা খাঁটি সর্ষের তেলের মতো আভা। শুধু গায়ে এক ফালি উত্তরীয় পৈতের মতো করে পরে মাথার ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে যখন বিশুদ্ধ তাঞ্জোর স্টাইলে নাচে, তার দেহের সমস্ত পেশীগুলিও নাচতে থাকে। মিতুলের গা শিরশির করে। সে অনুভব করে ডিরেক্টর সিনহার প্রতি তার যে একটা প্রাথমিক যৌন টান গড়ে উঠেছিল, সেটা কবে ছবি তৈরির নানা মুহূর্তে শিথিল হতে হতে এখন একেবারে উধাও হয়ে গেছে। সিনহার মতো কল্পনাহীন, এক কথায় ম্যাদামারা পুরুষ, যে আবার কেজিরিওয়ালের থাবার দিকে তাকে নানান কায়দায় এগিয়ে দেবার চেষ্টা করে গেছে, তার প্রতি যে কোনদিন কোনও আকর্ষণ অনুভব করেছিল এটা ভাবলেও মিতুলের নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে হয়। কেজরিওয়াল একেবারে তার গা ঘেঁষে নিজের সমস্ত মেদভার তার ডানদিকটার ওপর ন্যস্ত করে বসল। দুজনের হাতেই গ্লাস। মিতুল খাচ্ছে জিঞ্জার বীয়ার, কেজরিওয়াল হুইস্কি। মিতুল মিষ্টি হেসে জিগগেস করল— ‘হুইচ ব্র্যান্ড অফ আফটার শেভ ডু ইউ ইউজ মিঃ কেজরিওয়াল?’
কেজরিওয়াল প্রায় মিতুলের গালে গাল ঠেকিয়ে বলল—‘হোয়াই শুড আই, ডিসক্লোজ মাই সিক্রেট মিতসিরি?’
মিতুল আরও হেসে বলল— ‘নো, আই ওয়াজ ওয়ান্ডারিং ইফ ইট ওয়াজ মেড অফ কাউ-ডাঙ।’
তখন ছবি শেষের দিকে। কেজরিওয়ালের আর ফেরবার পথ নেই। সিনহাকে নিজের ঘরে ডেকে মিতুল বলল— ‘গৌরাঙ্গ, এখন যদি আপনার দু গালে কষে দুটো চড় কষাই পুরো টীমের সামনে, হাউ উড য়ু ফীল।’
গৌরাঙ্গকে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হয়েছিল। বহু টাকার প্রজেক্টটা নইলে মুখ থুবড়ে পড়ত।
কিন্তু শেখরণ্কে সে কিছুতেই তার মন থেকে সরাতে পারছে না। অথচ আপাতদৃষ্টিতে শেখরণ্ তার বিখ্যাত আবেদন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন। তার সঙ্গে শেখরণের বেশি কাজও নেই। তা সত্ত্বেও বম্বের যে হোটেলে মিতুলরা তখন বাস করছে সেখানে নিজের ঘরে সে শেখরণ্কে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠাল।
কিছুক্ষণের মধ্যে শেখরণ্ এসে গেল। সে পরেছে ফেডেড জীনস্ এবং ঢোলা হাওয়াই শার্ট। শেখরণের চলাতেও একটা তাল থাকে। সে যখন তালে তালে চলছে তার শার্টটা দুলছে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। কোথাও বাধছে বলে মনে হচ্ছে না। এতো সরু কোমর। মিতুল আজকে একটা চামুণ্ডি জর্জেট পরেছে। মাথার চুল ছাড়া। ঠোঁটে কোনও প্রসাধন নেই।
শেখরণ্ ভালো বাংলা বলতে পারে— আড়াই বছর শান্তিনিকেতনে নাচ শিখিয়েছে। সোফার ওপর বসে সে হাঁটুর ওপর হাঁটু রাখল, তারপর তার উদয়শংকরী হাত দুটো দুদিকে ডানার মতো মেলে দিয়ে বলল— ‘বলুন।’
কোনও নর্তক যখন পোশাক পরে থাকে তখন তার দেহসৌষ্ঠব প্রায় কিছুই বোঝা যায় না। ঠিক ব্যায়ামবীরদের মতো। কিন্তু শেখরন্ আয়ার শুধু সুদেহী নয়, সুমুখও। তার ভ্রূ দুটি প্রায় জোড়া। শক্তপোক্ত টিকোলো নাক। চোখ দুটি ভাষাময়। ঈষৎ স্থুল, বঙ্কিম এবং একটু ছড়ানো তার ওষ্ঠাধর।
মিতুল অপলকে তার দিকে তাকিয়ে বলল— ‘বলবার কথা তো আপনারই?’
—‘আমার?’
—‘বাঃ আপনি তো বলছিলেন আমার নাচের ট্যালেন্ট আছে। বছর দুয়েকের মধ্যে নাকি তৈরি করিয়ে দেবেন!’
—‘দেখুন মিতশ্রী, পিওর ক্ল্যাসিক্যালের দৃষ্টি থেকে দেখতে গেলে আপনার অনেক ভুল আছে। যেমন আপনি কত্থকের পায়ের কাজের সময় যেখানে পায়ের পাতা সোজা পড়বে, সেখানে গোড়ালি তুলছেন। তাছাড়া কত্থকের পায়ের সঙ্গে আপনি প্রচুর ভরতনাট্যমের মুদ্রা করেছেন। অনেক লিবার্টি নিয়েছেন। সেই জন্যেই জিজ্ঞেস করছিলুম আপনি কার কাছে শিখেছেন। কিন্তু আপনি যে আনইউজুয়ালি ক্রিয়েটিভ, সে আমি একটু দেখেই বুঝে নিয়েছি। আর যেহেতু এতে আবার ব্যালের অঙ্গও মিশিয়ে একটা ইম্প্রোভাইজ্ড্ ধরনের নাচ তৈরি করেছেন, আমি এতে দোষের কিছু দেখতে পাইনি। এটুকু ক্যাথোলিসিটি আমার আছে। ইভ্ন দো আই বিলং টু দা কট্টর তাঞ্জোর ঘরানা।’
—‘আপনি কি সত্যিই মনে করেন, এই বয়সেও আমি নতুন করে নাচ শিখতে পারবো?’
—‘দ্যাট ডিপেন্ডস্’···
—‘বুঝিয়ে বলুন।’
—‘আপনি কি একেবারে পিওর ক্ল্যাসিক্যাল ডান্সার হতে চান?’
—‘আমি কিছু হতে চাইনি। আপনিই বলছিলেন···’
—‘বলেছিলাম···তবে সেটা অন্য কথা ভেবে···’
—‘অথাৎ···’
—‘দেখুন মিতশ্রী, আমি নিজেও ক্রিয়েটিভ স্বভাবের মানুষ। কতকগুলো স্টাইলের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে বিশিষ্ট ঘরানার প্রয়োজন আছে এটা আমি অবশ্যই অনুভব করি। কিন্তু শান্তিনিকেতনে থাকবার সময়ে ওখানে বহু নৃত্যনাট্যর কোরিয়োগ্রাফি করবার সময়ে বিশেষত উদয়শংকরের ‘কল্পনা’ দেখে আমার ভেতরে অনেকদিন থেকেই কতকগুলো আইডিয়া আসছে। ভরতনাট্যম পুরোপুরি ভাবনৃত্য ও নাট্যনৃত্য। কিন্তু কিছুটা ইনিসিয়েশন না থাকলে তার মর্ম বুঝতে সাধারণ দর্শকের কালঘাম ছুটে যাবে। বিদেশি দর্শক শুধু অঙ্গভঙ্গি, সাজপোশাক আর সমবেত নৃত্যের যে অ্যাপীলটা আছে সেটা বুঝবে। তার বাইরে কিছু না। আমার ইচ্ছে ছিল কিছু নাট্যনৃত্য কমপোজ করি কিছু মিথ-এর ওপর বেস করে যেমন মহাপ্রলয়, মডার্ন থীমস্ যেমন বার্লিন ওয়ল, ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের কিছু পর্যায়। রবীন্দ্রনাথের ‘চার-অধ্যায়’ও আমার মাথায় আছে। এর মধ্যে সব রকম আঙ্গিকের মিশ্রণ থাকবে, মিশ্রণটা ইচ্ছে মতো হবে না, ভাবকে অনুসরণ করবার জন্য হবে। যেমন আপনি ‘আশাবরী’র ক্লাইম্যাকটিক সিনে করলেন। জিনিসটা আরও রিচ হবে যদি আপনি কিছু ভারতীয় ক্লাসিক্যাল এবং ফোক ডান্স শিখে নেন।’
—‘ওরে বাবা’, মিতুল বলল—‘সে তো ভীষণ পরিশ্রম!’
—‘তা একটু আছে। তবে ইউ আর আইডিয়্যালি সুটেড ফর দিস কাইন্ড অফ থিং। আমরা একটা ইয়োরোপ টুর অ্যারেঞ্জ করতে পারি। আমার সঙ্গে যেতে রাজি, এরকম অনেক আর্টিস্ট আছেন, বাই দা ওয়ে, অপালাদিকে পাওয়া যাবে এ ধরনের পরিকল্পনায়?’
মিতুল নিজের ভেতরে সূক্ষ্ম খুব সূক্ষ্ম একটা বিদ্রোহ অনুভব করল, বলল— ‘না। অপালাদি ঘরোয়া মানুষ। আমার মনে হয় না উনি রাজি হবেন।’
—‘আমারও তাই মনে হয়েছিল। শী ইজ কোয়াইট ডেফিনিটলি এ জিনিয়াস।’
মিতুল বলল— ‘আমার জাস্ট দেখে দেখে শেখা একটা তিল্লানা দেখবেন?’
—‘দেখান।’
একজন নামী ক্লাসিক্যাল ডান্সার-এর কাছে সে তার অ্যামেচারি দেখাচ্ছে, কিন্তু মিতুল বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়।
সে তৎক্ষণাৎ তার জর্জেটের আঁচল কোমরে জড়িয়ে চুলে একটা ফেট্টি বেঁধে নাচতে প্রস্তুত হয়ে গেল। শেখরণ্ আদিতালে গান ধরল। মিতুল নাচতে থাকল।
কিছুক্ষণ পর সে শেখরণের পাশে বসে পড়ল। তার ডান কাঁধ স্পর্শ করেছে শেখরণের প্রসারিত হাতের আঙুল।
শেখরণ্ বলল—‘ফ্যানটাসটিক। এটা আপনি শুধু দেখে তুলেছেন? আপনার নাচের প্রতিভা জন্মগত। গানও খুব ভালো গান। রিচ ভয়েস। কিন্তু নাচ করলে আপনি এতোদিনে একটা ওয়ার্ল্ড ফিগার হয়ে যেতেন। এটা কি আপনি আমাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখালেন? পিওর ক্ল্যাসিক্যালে যাওয়া শক্ত হিন্ট দিয়েছিলাম বলে?’
মিতুল ছেলেমানুষের মতো বলল—‘আপনি যদি সাভেরীতে গানটা ধরেন আমি আপনাকে একটা পল্লবীও দেখাতে পারি। এক্ষুনি। জাস্ট ফাইভ মিনিটস রেস্ট।’
শেখরণ্ হেসে বললেন—‘লোভ হচ্ছে দেখতে। কিন্তু দরকার নেই। আপনি সব পারবেন এ বিশ্বাস আমার হয়েছে। আমি যে প্রজেক্টটা করছি, তাতে যদি আপনি ইন্টারেস্টেড হন তাহলে খুব ভালো হয়। ইন্টেনসিভ রিহার্সাল দিলে ছ মাসে আমরা তৈরি হয়ে যেতে পারবো। দা টুর ইটসেলফ মে টেক, সে, টু ইয়ার্স।’
—‘আমার একটা নিজস্ব কেরিয়ার আছে।’
—‘সেই জন্যই তো জিজ্ঞেস করছিলাম।’
মিতুল একটু ভাবল। এক ‘আশাবরী’ থেকেই সে বহু টাকা পেয়েছে। দু বছর বাবাকে ছেড়ে থাকতে হবে। দুই কেন আড়াই। অপুদির সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। এতদিনে দীপালিদির দিদি মিলিদির ক্লাসগুলোতে হাঁ করে বসে থাকার ফল মিলল। সে মাথাটা হেলিয়ে বলল— ‘ডান।’
শেখরণ্ উঠে পড়ল, বলল— ‘মেনি মেনি থ্যাংকস। আমার কয়েকটা কোরিওগ্রাফি রেডি। মডার্ন থিমগুলো নিয়ে এখন কাজ করছি। আপনি যখন রিং করলেন, ইন ফ্যাক্ট তখনও ওই কাজই করছিলাম।’
মিতুল ব্যস্ত হয়ে বলল—‘অ্যাট লস্ট হ্যাভ সাম ড্রিঙ্কস শেখরণ্।’
তার স্বরে কি ছিল, শেখরণ্ মুখ ফিরিয়ে চইল, মিতুলের চোখে চোখ পড়ল। এই প্রথম, জীবনে এই প্রথম বোধ হয় মিতুল তার চোখ নামিয়ে নিল। শেখরণ্ খুব নরম গলায় বলল—‘ও কে। লেটস হ্যাভ সামথিং হট্। ধরুন কফি।’
ফোন তুলে কফির অর্ডারটা দিল মিতুল। সে একটু একটু কাঁপছে। তানপুরোর খরজের তারটা বাজালে, জুড়ির তার দুটো যেমন সরু করে বেজে ওঠে! তেমন! শেখরণ্ হঠাৎ একদম অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল—‘জানেন মিতশ্রী, আই ওয়জ ম্যারেড হোয়েন আই ওয়জ টোয়েন্টি। তখন আমার স্ত্রী সাবিত্রীর বয়স ছিল পনের। আমার এখন বিয়াল্লিশ বছর বয়স। সাবিত্রী আমার ছেলেবেলাকার সাথী বলতে পারেন। আনফর্চুনেটলি উই আর চাইল্ডলেস। সাবিত্রী একটি ছেলেকে অ্যাডপ্ট করেছে। আমার বাবা-মার সঙ্গে থাকে মাদ্রাজের একেবারে উত্তরে এরুক্কানচেরি বলে একটা জায়গায়। গান, বাজনা, নাচ কিছুই ওর আসে না। এমনকি খুব বোঝেও না। বাট শী ইজ ভেরি ভেরি সুইট অ্যান্ড গুড়। আমি তো বাইরে বাইরেই থাকি। বাট হোয়েন আই অ্যাম ইন ম্যাড্রাস, আই অ্যাম অল হার্স। এ গুড অ্যান্ড ডিউটিফুল, রেসপনসিব্ল অ্যান্ড লাভিং হ্যাজব্যান্ড। তখন এসব নাচ-টাচ চলবে না। অথচ আশ্চর্যের কথা, ওই সময়টা থেকেই আমি আমার অনেক আইডিয়াজ, ইনসপিরেশন পাই।’
কফি এসেছে। মিতুল কাঁপা কাঁপা হাতে শেখরণ্কে ঢেলে দিল তার কফি। শেখরণের বিয়াল্লিশ বছর বয়স? সে ভেবেছিল বত্রিশ-টত্রিশ হবে। কী ভাবে চেহারা রেখেছে? ম্যারেড? ম্যারেড টু এ তামিল হাউজওয়াইফ! নাকের দুদিকে দুটো নাকছাবি। কুচকুচে কালো রঙের ওপর বেগনি কাঞ্জিভরম্ পরে ইডলি বানাচ্ছে! মাথায় গাঁদা ফুল!
শেখরণ্ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল—‘অ্যান্ড হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?’
মিতুল প্রথমটা জবাব দিল না। শেখরণের এই অপ্রাসঙ্গিক কিম্বা কে জানে হয়ত প্রাসঙ্গিক স্বীকারোক্তি তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নিয়েছে। তারপরে তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে—ক্রোধ! ক্রোধ! ক্রোধ! তার চেহারাটা লাল হয়ে উঠেছে।
সে বলল—‘বাবা অথাৎ রামেশ্বর ঠাকুর ছাড়া আমার কেউ নেই। আই লাভ হিম, অ্যান্ড হিম অ্যালোন। আমার মা আমার পাঁচ বছর বয়সের সময়ে বাবার এক মুসলিম শিষ্যর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সে ভদ্রলোকের নাম বললে আপনি চিনবেন। এখন মায়ের সঙ্গে থাকেন না। মোস্ট প্রব্যাব্লি মাই মাদার ইজ দা সোর্স অফ মাই ট্যালেন্ট ইন ডান্স। আমি বিয়ে করিনি, করবও না। আই হেট মেন।’
শেখরণ্ দেখল— মিতুলের চোখ দিয়ে জল ঝরছে। নীচের ঠোঁটটা সামান্য ফুলে ফুলে উঠছে।
শেখরণ্ নিজে শিল্পী। তার সমস্ত দেহ-মন সুর তাল ছন্দে বাঁধা। সে ভীষণ স্পর্শকাতর। কিন্তু তার আরেকটা দিকও আছে। বৈরাগ্যের দিক। জীবনে কিছু-কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস না পেয়ে পেয়ে যেমন মনোবৃত্ত্যনুসারিণী স্ত্রী, সন্তান, হয়ত আরও কিছু, এবং এই না পাওয়াটাকে মেনে নিতে নিতে সে সচেতনভাবে নিজের মধ্যে এই বৈরাগ্যকে গড়ে তুলেছে। এই বৈরাগ্য থেকে সে বহু উদাসীন প্রতিক্রিয়া আয়ত্ত করেছে। সে জানে এখন যদি ওই ক্রন্দসী শিল্পীকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে বহু যন্ত্রে এখনই বাগেশ্রী বেজে উঠবে, দুটি দেহকে নিঙড়িয়ে নিঙড়িয়ে। সে জানে মিতশ্রী কেন কাঁদছে। কতটা তার মায়ের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে আর কতটা জীবনের এই পরিপূর্ণ বিশ্বাসঘাতকতার জন্য যা আজ শেখরণের প্রতীকে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সেই অনুপাতটা সে শুধু জানে না।
শেখরণ্ বহু প্রয়াসে নিজেকে সংযত করে ফিরে দাঁড়াল। বলল—‘প্লীজ কালেক্ট ইয়োরসেলফ্ মিতশ্রী। কত আঘাত, কত হতাশা, আবার কত আনন্দে একটা শিল্পী তৈরি হয়! আই টূ হ্যাভ গ্রোন আপ লাইক দ্যাট।’ বলতে বলতে শেখরণ্ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
কে চেয়েছিল, কে চায় এই উপদেশ, সান্ত্বনা, এতো কথা! মিতুলের শরীরের ক্রোধটা যেন দাউ-দাউ করে জ্বলে তাকে পুড়িয়ে দিয়ে এবার আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে। চোখের জলে নয়, শেখরণের কথায় তো নয়ই। কিসে এ আগুন নিবল তা সে জানে না। মিতুল হোটেলের মহার্ঘ শয্যার ওপর শুয়ে পড়ল সটান। সেই জর্জেট পরেই। তার শরীরে তিল্লানা নিভে গেছে, বাগেশ্রী বাজছে না। কিন্তু কিরকম একটা ঘুম আসছে, খুব গভীর ঘুম। যেন সুষুপ্তি। সে ঘুমে কোনও স্মৃতি নেই, স্বপ্ন নেই, এমনকি কারুর প্রতি কোনও নালিশ পর্যন্ত নেই।