Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গান্ধর্বী || Bani Basu » Page 16

গান্ধর্বী || Bani Basu

টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। সরু রাস্তা। একটা নতুন ছাইরঙের মারুতি এসে থামল। নীচের ঘরে অপালা গান শেখায় এ সময়টা। বৃষ্টির জন্য বোধহয় আজ ছাত্র-ছাত্রী কম। সে নিজে রাস্তার দিকে মুখ করে বসে। দরজার একটা পাল্লা সামান্য বন্ধ। অপালার এই ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরা একটু পরিণত। এদের তার শেখানোর ধরন একদম অন্যরকম। প্রত্যেকে তানপুরো হাতে বসে থাকে। অপালার নিজের হাতে স্বরমণ্ডল। সে বেশ খানিকটা সুরবিহার করে থামে, তারপর একটু একটু করে সেটা আবার করে, সে একটু করার সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্র-ছাত্রীদের গলায় সেটা করে দেখাতে হয়। এই ব্যাচে মাত্র পাঁচ জন। এসেছে আজ তিন জন। সে আজ বেহাগ নিয়ে পড়েছে। গান দিচ্ছে প্রথমে ‘পানিয়া ভরনে ক্যায়সে জাউঁ সখী ম্যায়/বিচমে ঠাড়ো কুমার কনহাই। নি সা ম গ। প প নি নি। পা নি য়া ভ। র ণ কয়সে বেশ কিছুক্ষণ গাড়িটাকে একটু আগে দাঁড় করিয়ে অপালার সুরবিহার শুনল মিতুল। আজকাল অপালা মাস্টারমশাইয়ের কাছে নিয়মিত যেতে পারে না। মাস্টারমশাই, না মিতুল সল্ট লেকে অপূর্ব এক বাড়ি বানিয়েছে। কিন্তু বড্ড যে দূর! অপালা আজকাল বেশির ভাগ শম্পাদির কাছেই যায়। কিন্তু শম্পাদির কাছে বাজনা শিখতেই এতো ছাত্র-ছাত্রী আসে যে তার নিজের জন্য তাঁকে বেশি খাটাতে তার সঙ্কোচ হয়। মাস্টারমশাইয়ের কাছে গেলেও মিতুলের সঙ্গে কখনও দেখা হয় না। সে বাড়ি নেই। অপালা কোথাও যায় না, রেডিও বা দূরদর্শনের রেকর্ডিং-এর জন্য যেতেই হয়। বাড়িতে একটা চাপা অসন্তোষ, একটা বিরুদ্ধতার আবহাওয়া সৃষ্টি হচ্ছে সে বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে শুধু মায়ের কাছে, দীপুর মা বা মাসীমার কাছে। বাস।

গাড়িটা মিতুল এগিয়ে এনে এবার দরজার প্রায় মুখোমুখি দাঁড় করালো। কত দিন মুখোমুখি বসে অপুদির গান শোনা হয়নি। গলা, শুধু গলাই কী! গাড়িটা অপালা চেনে না। সে একটু অবাক হয়ে চেয়ে আছে, গান থামিয়ে। ভেতর থেকে জীনস্‌ পরা একটা পা নামল, তারপর পুরো চেহারাটা দেখতে পেল অপালা। মিতুল। মিতুল এসেছে। মিতুলের প্রচও নামডাক আজকাল। গানের সঙ্গে সঙ্গে তার নানা ধরনের মুদ্রা বা মুদ্রাদোষের বিরূপ এবং অনুকূল দুরকম সমালোচনাই সে শুনতে পায়। ক্কচিৎ কখনও দূরদর্শনে তার প্রোগ্রামও দেখেছে। সেই বিরক্তিকর, মেঘ, ফুল, পাখি, বৃষ্টি ইত্যাদি দিয়ে গানকে দৃশ্যমান করবার চেষ্টা-ওলা প্রোগ্রাম। আরে বাবা, গান কান দিয়ে শোনার জিনিস, তাকে তার নিজের ক্ষমতায় মরমে পশতে দাও! আর গায়ক, তাকে চোখে দেখা সেও এক অভিজ্ঞতা। গান গাওয়ার সময়ে সম্পূর্ণ তার নিজের ব্যক্তিত্বে। অভিনয় করতে করতে নয়। শ্রোতার কাছে তাকে প্রকাশিত হতে দাও। দূরদর্শন মিতুলকে এইসব প্রোগ্রামে হাজির করে। লম্বা আঁচল দুলিয়ে মিতশ্রী গাছের ফাঁক দিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। তার পর আবার এক জাজিম পাতা হলঘরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বসে পড়ল। এই রকম প্রোগ্রাম দেখে তৃপ্তি হয় না অপালার। মিতুলের কয়েকটা ক্যাসেটও তার কাছে আছে। কিন্তু চোখের সামনে এই বৃষ্টিঝরা বিকেলে জীনস্‌ এবং আলগা সাদা শার্ট পরা মিতুল যে একটা কী সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা হতে পারে তা অপালা কল্পনা করতে পারেনি।

তার ছোট ঘরের ছোট্ট দুয়ার একেবারে ঝলসে দিয়ে এসে দাঁড়াল মিতুল। এ যেন ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়! অন্তত অপালার মনে লাইনটা ঝলসে উঠল বিনা প্রয়াসে। সে বলল—‘মিতুল! মিতুল তুই!’

তার ছাত্র-ছাত্রীদের সকলেই মিতশ্রীকে চেনে। বহু জলসায় টিকিট কিনে তার গান শুনেছে। এতো সামনে থেকে তাকে দেখবে কল্পনাও করতে পারেনি। —তাদের অপালাদির মিতশ্রী ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ আছে! এইরকম ডাকনাম ধরে, তুই করে ডাকার আলাপ!

মিতুল বলল—‘অপুদি, আজ তোমার ছাত্র-ছাত্রীদের ছুটি দিয়ে দাও। আমার বড্ড দরকার তোমার সঙ্গে।’

অপালা বলল—‘মিতুল দু মিনিট বোস। আমার হয়ে গেছে। ছোট্ট একটা নোটেশন লিখিয়ে দিচ্ছিলুম।’

মেঝেতে পাতা শতরঞ্জির ওপর দু হাঁটু একদিকে মুড়ে বসল মিতুল। তার আলগা শার্টের ওপরের বোতাম খোলা। সোনার হারের সঙ্গে চকচকে একটা মোহর সেখানে দুলতে দেখা যায়। আজকে চুলটাকে সে সম্পূর্ণ তুলে একটা হর্স-টেল করেছে। ঠোঁটে একটু লিপ-গ্লস। তাকে দেখাচ্ছে কলেজের মেয়েদের মতো। যদিও সেটা কোনও স্বপ্নলোকের কলেজ। নোটেশন দেওয়া শেষ করে অপালা ছাত্র-ছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে হাসল। খুব অনিচ্ছুকভাবে বেরিয়ে গেল তিনটি ছেলে মেয়ে। মিতশ্রী ঠাকুরের সঙ্গে তাদের গানের দিদির কী জরুরি কথা ছিল তা শোনবার তাদের যথেষ্ট ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তারা প্রত্যেকে দৃষ্টির আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত মিতুল শুধু একটু চিন্তান্বিত মুখে তার আঙুলের আংটিটা ঘোরাতে লাগল।

ওরা চলে গেলে মিতুল বলল—‘অপুদি, তুমি একমাত্র তুমিই তাহলে আমার বাবার প্রকৃত ভাবশিষ্যা হলে। প্রধানদের মধ্যে। লক্ষ লক্ষ পঙ্গপালের কথা আমি বলছি না।’

অপালা হেসে বলল—‘কি দেখে বলছিস? বুঝতে পারছি না।’

—‘এই নিজের গান ছেড়ে যত রাজ্যের অর্বাচীনদের নিয়ে পড়েছো! অন্যদের তৈরি করার মহাসাধনায় মহামগ্ন। বলি তোমার নিজের গান কি হল?’

বাইরে নিমগাছটার ওপর বিকেলের শেষ কাকের দল ডেকে উঠল। মেঘ ভেঙে এইবার শ্রাবণের অপূর্ব গোধূলি আলোর জোয়ার ঢুকছে অপালার ঘরে।

অপালা বিমর্ষ স্বরে বলল—‘আমার পরিস্থিতিতে যতদূর পারছি, গাইছি মিতুল। শেখাই। কারণ শেখাতে আমার ভালো লাগে। এক ধরনের রেওয়াজও হয়ে যায় তাতে। কিন্তু তুই তো জানিস আমি না গেয়ে পারি না!’

—‘টাকার জন্যে শেখাও?’

—‘না, তা ঠিক নয়। তোক তো বললুমই ভালো লাগে। প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, কথামালাগুলো বারে বারে ঝালিয়ে নেওয়া হয়ে যায়। আর টাকার কথা যদি বলিস, সংসারে টাকার দরকার না থাকলেও মেয়েদের নিজেদের হাতে একদম নিজস্ব কিছু টাকারও দরকার হয়। হয় না?’

মিতুল এক রকমের বাঁকা হেসে বলল—‘অফ কোর্স। নিজের হাতে নিজের উপার্জনের টাকা ছাড়া কোনও মেয়েই পুরো মানুষ নয়,হয় ছেলেমানুষ, নয় মেয়েমানুষ। কেন জানবো না অপুদি! না-ই বা বিয়ে করলুম। কিন্তু রামেশ্বর ঠাকুর শেখানোয় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন গলা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলে, তোমার তো তা নয়! বছর দশেক আগেও কোনও কনফারেন্স অপালা দত্তগুপ্তকে ছাড়া ভাবা যাচ্ছিল না। আসরের শেষ আর্টিস্ট হিসেবে নয় অবশ্য, তার জন্যে পণ্ডিতজী ওস্তাদজী এঁরা আছেন। কিন্তু সন্ধ্যায়, প্রথম রাতে শোনা যেত। কিন্তু আজকাল অপালা দত্তগুপ্তকে নিয়মিত বলতে গেলে রেডিও ছাড়া শোনাই যাচ্ছে না। রেডিও শোনে খুব কম লোকে। দূরদর্শনে খুব মাঝে মাঝে দেখি। ব্যাপারখানা কী বলো তো?’

অপালা হেসে তার বিমর্ষতাকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করতে করতে বলল—‘এত দিন পরে হঠাৎ এরকম নাটকীয়ভাবে উদয় হয়ে তুই শক্ত শক্ত প্রশ্ন করতে শুরু করলে আমি কী করে উত্তর দিই বল তো? ভাবতে হবে কেন!’

মিতুল বলল—‘অপুদি, আর যে শোনে না শোনে আমি রেডিও খুলে নিয়মিত তোমার গান শুনি। দূরদর্শন, তা-ও নেহাত অন্য কাজ না থাকলে মিস করি না। অপুদি, তুমিও একরকম আমার গুরু, অ্যান্ড ইউ আর স্টিল ওয়ান্ডারফুল। আ সিঙ্গার অফ সিঙ্গার্স। বাট…’

অপালা চেয়ে আছে, মিতুল বলল—‘বাট দি অডিয়েনন্স হ্যাজ চেঞ্জড। তাই যখন মিতশ্রী ঠাকুরের পঁচিশটা ক্যাসেট এখন বাজারে চলছে, সেখানে অপালা দত্তগুপ্তর একখানাও নেই।’

অপালা বলল—‘মিতুল তুই লাইট ক্ল্যাসিকাল গাস। নজরুল গাস। পপ গাস। তোর তো অত রেকর্ড হওয়া স্বাভাবিকই। তা ছাড়াও তুই প্লে-ব্যাক করিস। আমি বিশুদ্ধ মার্গসঙ্গীত গাই। হীরাবাই, কি মধুবাই এঁদের স্তরে তো উঠতে পারিনি যে, যে আমার রেকর্ড করতে ছুটে আসবে লোকে! ও সব নিয়ে আমি ভাবি না।’

মিতুল বলল—‘অপুদি, তোমায় আমার বড্ড দরকার! বলো যা চাইব দেবে! বলো আগে!’

এই সেই পুরনো মিতুল। আবদেরে। নাছোড়বান্দা। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির জমজমাট সঙ্গীতসন্ধ্যা। মিতুল হঠাৎ মজলিশের মধ্যিখানে বসে পড়ত, বলত, ‘আর গান নয়। কিছুতেই কাউকে গাইতে দেবো না, দেবো না।’ মাথাটা ক্রমাগত নাড়ত মিতুল। কিছুক্ষণ তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতেন মাস্টারমশাই। তারপরে হার মানতেন। করুণ গলায় বলতেন—‘তবে আর কি হবে? আজ মিতুল ঠাকরুণ যখন একবার বেঁকে বসেছেন…তোরা তবে চলেই যা।’

—‘না ওরা যাবে না।’ মিতুল আবার মাথা ঝাঁকাত। ওদের সবাইকে আমার সঙ্গে গল্প করতে হবে, হবে, হবে!’

সেভাবে না বললেও মিতুলের গলায় সেই ছেলেবেলাকার জেদের সুর শুনতে পায় অপালা—‘কি চাইবি? গান শেখানো ছেড়ে দেবো? না ক্ল্যাসিক্যাল ছেড়ে আধুনিক ধরব? কোনটা?’

মিতুল হেসে কুটি কুটি হয়ে বলল—‘কোনটাই না। আমাকে তুমি একটা টাইর‍্যান্ট ঠাউরেছো না? আমি নিজেরই ওপর জোর জবরদস্তি করতে পারি না যখন অন্যের ওপর জোর করা আমাকে মানায় না। মানায়?’

—‘তুইই সেটা ভালো বুঝবি।’

—‘শোনো, একটা দারুণ অপূর্ব ফিল্ম হচ্ছে। বাইলিঙ্গুয়াল, হিন্দি আর বাংলায়। গান নিয়ে। শুধু গান। গল্পটা একজন গায়িকার জীবনের ওঠাপড়ার। রোলটা আমি নিচ্ছি। কিন্তু আরও আরও গান তো চাই! সেই রকম একজন ক্ল্যাসিক্যাল গাইয়ের জায়গায় আমি তোমাকে চাইছি।’

অপালা সভয়ে বলল—‘আমি অভিনয় করব? তোর মাথা খারাপ হয়েছে মিতুল?’

মিতুল হাসতে হাসতে বললে—‘আরে বাবা অ্যাক্টোটা করবে অন্য লোকে। তুমি শুধু গলা দেবে। গাইবে। প্লিজ, তুমি না করো না। আমি কথা দিচ্ছি তোমার অমার্যাদা বা অসুবিধে কিছু না ঘটে এটা আমি দেখব। দক্ষিণাও তোমার সম্মান অনুযায়ী হবে। মিউজিক ডিরেক্টর কে বলো তো?

অপালা চুপ করে ভাবছে।

—‘রামেশ্বর ঠাকুর।‘

—‘সত্যি?’ অপালার মুখে-চোখে আলো ঝলসে ওঠে।

—‘অবশ্য, আরেকজনও সঙ্গে থাকবেন যুক্তভাবে, কিন্তু তোমার গানগুলো তুমি ইচ্ছেমতো বাবার সঙ্গে আলোচনা করে কমপোজ করে নিতে পারবে। এবার হ্যাঁ-টা বলো!’

অপালা বলল—‘মাস্টারমশাই যখন আছেন, তখন আমার না করবার কোনও প্রশ্ন নেই। তবু আমায় একটু সময় দে। …মিতুল এবার চল, ওপরে চল।’

মিতুল বলল—‘এখন তোমার ওপরে কে কে আছে বা আছেন অপুদি!’

‘রণো নেই, খেলতে গেছে। টিটু-বনি কোচিং-এ, ফিরতে দেরি হবে। মা মানে আমার শাশুড়ি, শ্বশুর আর জা আছে।’

মিতুল বলল—‘তাহলে কার কাছে যাবো? আমি সোজা কথার মানুষ অপুদি, তোমার যে শ্বশুর-শাশুড়ির দাপটে তোমার এত বড় প্রতিভা ছাইচাপা হয়ে পড়ে রয়েছে…তোমার জা কে কিরকম জানি না, নতুন অ্যাকোয়েন্টেন্স, জাস্ট ফর ফর্ম, এতে আমার ইনট্‌রেস্ট নেই। শাশুড়িই বলেছিলেন না “আমার অমন গোরাচাঁদ ছেলের এমন কালিন্দী বউ! শাদা শাড়ি পরে বিয়ের কনে এসেছে, এ কি অলুক্ষুনে বউ রে বাবা!” তাঁদের কাছে শুধু শুধু ভীম নাগের সন্দেশ খেয়ে ফর্ম্যালিটি করতে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই।’

অপালা হেসে বলল, ‘ওগুলো আমার পিসশাশুড়ি বলেছিলেন। তিনি মারা গেছেন মিতুল।’

—‘মারা গেছেন বলেই তাঁর সাতখুন আমার কাছে মাপ হয়ে যাবে না, অপুদি। একটা উনিশ কুড়ি বছরের বাচ্চা বউয়ের মনে এসব কিরকম লাগে বোঝবার মতো বয়স নিশ্চয় তাঁর হয়েছিল।’

‘আর শাড়িটা? তোমার ওই ঢাকাই বেনারসীটা দীপুদি পছন্দ করে কিনে এনেছিল। কী ফাইট করে! তোমার জেঠু আলতার মতো লাল চেলি কিনবেনই, দীপদিও সেটা কিছুতেই কিনবে না। জিনিসটা আছে এখনও? অমন শাড়ি আমি এখনও পর্যন্ত আর দ্বিতীয় দেখিনি। আর কালিন্দী বউ! ওঁদের জন্ম-জন্মান্তরের ভাগ্য তুমি ওঁদের ঘরে এসেছো। শিবনাথদা থাকলে সেটা বলে বেশ খানিকটা কড়কে দিয়ে যেতুম। নেই যখন, অপুদি প্লীজ আমাকে ওপরে তুললা না।’

অপালা হাসছে। বলছে—‘কী যে বলিস!’

‘না না। আমার ওসব ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় নেই। ওপরে গেলে কী বলব জানো? বলব— এই যে মহাশয় এবং মহাশয়ারা আপনাদের গোরাচাঁদটি এনার গান শুনেই এনাকে গানের জগৎ থেকে একরকম ছিনিয়ে এনেছিলেন। প্রতিশ্রুতি ছিল এঁর গানের পথে কোনও বাধা হবে না। গোবরের ঘুঁটে দেবার জন্যে, আর লুচি বেগুনভাজা ভাজবার জন্যে, কিংবা বছর বছর বাচ্চার কাঁথা কাচবার জন্যে উনি ব্যবহৃত হলে ঐশ্বরিক ক্ষমতা নামক কনট্রোভার্শাল ব্যাপারটার একটা হিউজ ওয়েস্টেজ হয়।

অপালা বলল— ‘থাম, থাম, উফ্‌— আমাকে ঘুঁটে দিতে হয় না। তুই মিতুল দিন দিন আরও ধারালো হয়ে উঠছিস। আর কী যে অপূর্ব দেখতে হয়েছিস আমি তো চোখ ফেরাতে পারছি না।’

—‘দা-রু-ণ! সুন্দর? তুমিও সুন্দর দেখছ আমায়? সত্যি অপুদি?’

—‘মানে? সুন্দরকে সুন্দর দেখব না? সুন্দর দেখবার চোখও আমার নেই বলছিস?’

—‘উঁহুঃ আমার কেমন মনে হয়, গানেও যেমন তুমি বাইরের অঙ্গগুলোর প্রথাসিদ্ধ কৃতকৃত্য না মেনে রাগের গভীরে চলে যাও, মানুষের বেলাতেও তেমনি। বাইরে আমি যতটা সো-কল্‌ড্‌ সুন্দর, ভেতরে হয়ত ততটা নই এবং তুমি হয়ত সেটাকেই দেখতে পাও।’

অপালা বলল—‘মিতুল, তুই তো আমাকে আমার চেয়ে বেশি চিনিস মনে হচ্ছে?’

—‘খুব বকবক করছি তো? আসলে কথা বলবার লোক পাই না অপুদি। জীবনটা কী ভাবে কড়ায় সন্দেশের পাকের মতো বিজবিজ করতে করতে তৈরি হয়ে উঠছে, কি ভাবে সন্দেশের কড়া থেকে রসগোল্লার কড়াতে ট্রান্সফার হয়ে যাচ্ছি, এসব উপলব্ধিগুলোর কথা বলবার লোক পাই না। অপুদি আমাকে এখনও ভালোবাসো?’

—‘তুই একটা খ্যাপা’

—‘সত্যি সুন্দর দেখো?’

—‘তুই না সত্যি…’

—‘তাহলে আমাকে একবার জড়িয়ে ধরো, প্লীজ।’

অপালার এসব অভ্যেস নেই। কিন্তু মিতুল ভেতরের আবেগে টগবগ করে ফুটছে। অপালা তো তার ছেলে-মেয়েকেও আদর করে না। যাই হোক, মিতুলকে নিয়ে তো পারা যাবে না, সে একটা হাত বাড়াতেই মিতুল প্রায় ঝাঁপিয়ে তার বুকের মধ্যে পড়ল, তার কাঁধে মাথা রাখল, দুদিকের গালে অনেকক্ষণ ঠোঁট রেখে মিষ্টি আওয়াজ করে চুমো খেল, তারপর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে দুলতে দুলতে বলল— ‘ও অপুদি, আই হ্যাভ অলওয়েজ লাভ্‌ড্‌ ইউ সো, অ্যাজ ইফ ইউ ওয়্যার মাই লাভার, দা বিগ, ডার্ক, হ্যান্ডসম লাভার, সো কেয়ারিং, সসা সফ্‌ট, সো আন্ডারস্ট্যান্ডিং! আই স্টিল রিমেমবার হাউ ইউ ইউজ্‌ড্‌ টু সিং মি টু স্লীপ, আই হ্যাভ অলওয়েজ বীন এ বিগ চাইল্ড, য়ু হ্যাভ অলওয়েজ বীন সো ম্যাচিওর। ওহ্, হাউ সফট ইয়োর চীকস আর, হাউ সুইট স্মেলিং, হোয়াই কান্‌ট্‌ মেন বী লাইক দিস?’

তার গলা জড়িয়ে ধরে মিতুল যখন এইভাবে প্রলাপ বকে যাচ্ছিল, তখন শিবনাথ ঢুকছিলেন অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে। তিনি মিতুলকে পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছেন, তার ফর্সা হাত আর গালের একটু অংশ, চুলের লালচে গুচ্ছ, সব মিলিয়ে তিনি তাকে মেমসাহেব-জাতীয় কিছু ভেবেছিলেন এবং এই অপরিচিত মেমসাহেব কেন তাঁর স্ত্রীকে এভাবে আদর করছে ভেবে পাচ্ছিলেন না। অপালা শিবনাথকে বড় বড় চোখে তাকাতে দেখে ভীষণ লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল। সে ডাকল—‘মিতুল, সোজা হ, তোর শিবনাথদা আসছে।’

মিতুল সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ‘আসছেন তো সসা হোয়াট! এই যে শিবনাথদা, ডু ইউ সি হাউ প্ৰেশাস অ্যান্ড লাভেবল্‌ ইয়োর ওয়াইফ ইজ? বেশ তো একটি নেয়াপাতি ভূঁড়ি বাগিয়েছেন দেখছি। আমি আপনার শ্যালিকা। কোনও কিছুতেই আমার ওপর আপনি রাগ করতে পারছেন না। কান মুলে দিলেও না। যাই বলুন আর তাই বলুন, আপনাদের বিয়ের সময়েই বুঝেছিলুম— ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ অপুদি। লেনার্ড উলফের কথা জানেন? ভার্জিনিয়া উলফের হাজব্যান্ড। নিজেও সম্ভাবনাময় পুরুষ ছিলেন। কিন্তু স্ত্রীর প্রতিভা নিজের থেকে অনেক উঁচু দরের বুঝে স্যাক্রিফাইস করেছিলেন প্রচুর। সোল এগজাম্‌প্‌ল। আপনাকে কেউ স্যাক্রিফাইস করতে বলছে না। অন্তত যাতে ক্ষমতাটা নিজের পথ ঠিকঠাক খুঁজে নিতে পারে সেটা তো দেখবেন?’

শিবনাথ খুব গম্ভীর চাপা স্বভাবের মানুষ। তিনি একদম অপরিচিত অনিন্দ্যকান্তি এই যুবতীর আক্রমণে একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন।

অপালা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে বলল— ‘চিনতে পারছো না? এ মিতুল! মাস্টারমশায়ের মেয়ে মিতশ্রী।’

এই বার শিবনাথ চিনতে পারলেন। কবে সেই বিয়ের সময়ে বাসরে গেয়েছিল, নেচেছিল, এখন নানা জায়গায় ছবি দেখেন, একেকটা একেক রকম। তিনি ঠিক বুঝতে পারেন না কোনটা মিতশ্রী ঠাকুরের আসল চেহারা। খুব পপুলার গায়িকা।

তিনি হেসে বললেন—‘আরে, সত্যিই তো আপনাকে আমার খুব চেনা উচিত ছিল। বাসরে সেই গান—

ট্যাং ট্যাং ডিং ডিং শাস্তি! কি শাস্তি লো

অপুদির গলাতেই ফাঁস দিলো

বরখানা গিরগিটি জিভটা সড়াত করে বার করে

তেলাপোকা গিলে নিলো!

তার সঙ্গে তেমনি রক নাচ। গানটা কি আপনার নিজেরই রচনা ছিল!’

—মিতুল ভীষণ হাসছে। বলছে—‘এ গান আবার, আমি ছাড়া কে বাঁধবে?’

শিবনাথ বলল— ‘আমি তো আপনার অপুদির যোগ্য নই-ই। আপনিও কিন্তু যোগ্য বোন নন। অন্তত আট দশ বছর পরে খোঁজ নিচ্ছেন।’

মিতুল নিচু হয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে একটা আদাব জানাবার মতো ভঙ্গি করলে। বললে— ‘অপুদির খাঁচাটা খুলে দিন শিবনাথদা, আজ চলি।’

শিবনাথকে কাটিয়ে সে দরজা পেরিয়ে ছোট্ট পথটুকু পার হল, তারপর তার মারুতিতে উঠে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল।

এখন তার সারা শরীরের ত্বক জুড়ে অপুদির স্পর্শ। ছেলেবেলার মধুর স্মৃতি মাখা। অপুদিকেই সে বাবার ছাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে ভালোবাসত। একটা বীরপূজার ভাব ছিল। ছোটবেলার চোখে অপুদিকে অসম্ভব সুন্দর লাগত। অপুদি যখন গান ধরত, অনেক সময়ই বাবা তাকে তানুপুরো ছাড়তে বলতেন। সে অবাক মুগ্ধ চোখে দেখত, ছোট্ট কপাল, চুলগুলো অতি সাধারণ ভাবে পেছনে একটা মোটা বেণী বাঁধা, ধনেখালি শাড়ির আঁচল কাঁধে বেড় দিয়ে সামনে এসে পড়েছে। লম্বা ভূরুর তলায় লম্বা লম্বা চোখ, কখনও বোজা, কখনও আধখোলা, ছোট্ট মুখ, তার মধ্যে দিয়ে জলস্রোতের মতো কলকল কলম্বনে সুর বেরিয়ে আসছে। অপুদির শরীরে কী সুন্দর একটা গন্ধ, এ কোনও পাউডারের বা পার্ফুমের নয়। এ বোধহয় একাগ্রতার, বিশুদ্ধতার গন্ধ।

প্রথমে সে ‘আশাবরী’ নামক ফিলমের নায়িকা হবার কাজটা নিজের জন্যই নিয়েছিল। সম্পূর্ণ নিজের জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে তার মত বদলেছে। সে অবশ্য খুব কম সময়েই এক খেয়ালে, এক সংকল্পে স্থির থাকতে পারে। যতই সে বুঝেছে প্রোডিউসারের ওপর তার প্রভাব দৃঢ় হচ্ছে ততই তার আব্দার বেড়ে যাচ্ছে। বাবাকে মিউজিক ডিরেক্টর করতে ওরা একেবারেই রাজি হয়নি। বলেছে ‘ছবি মার খেয়ে যাবে, মিতশ্রী দেবী, একটু কনসিডার করুন।’ কেন রাজি হবে? কে আজ চেনে রামেশ্বর ঠাকুরকে? সে এসব ভালোই বোঝে কিন্তু সে তার আবদারে অটল থেকেছে। বলেছে, ‘আরেকজন ডিরেক্টর রাখুন আপনাদের পছন্দ মতো। কিন্তু রাগসঙ্গীত পরিচালনা করা রামেশ্বর ঠাকুরের মতো কেউ পারবে না। আমি আপনাদের চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি।’ জনৈক বিখ্যাত মিউজিক ডিরেক্টরকে অনেক কষ্টে যুগ্মভাবে রামেশ্বরের সঙ্গে কাজ করতে রাজি করানো হয়েছে। প্রচুর গান, পপগান, নাচের সঙ্গে গান। সেসব তিনি করবেন। রামেশ্বরের এলাকা অন্য।

গল্পটা ওরা যখন তাকে শোনাল তখন মিতুলের প্রথমেই মনে হয় এটা একটা এমন গতানুগতিক গল্প, যাতে তার জীবনের কিছুই ফুটবে না। কল্পনা, গভীরতা এসব এদের কিছু নেই। একজন প্রতিদ্বন্দ্বিনী গায়িকার ভূমিকা আছে, প্রথম থেকেই সে এটাতে অপুদিকে ভেবে এসেছে। কিন্তু এদের গল্প অনুযায়ী সে চিরকাল তার ওই ঝিংচাক গেয়ে জিতে যাবে আর অপুদি ওই স্বর্গীয় গলা এবং গায়কী নিয়ে হেরে যাবে। এটা হাস্যকর তো বটেই, অপুদির কাছে পেশ করাও শক্ত। অপুদি তো পেশাদার প্লে-ব্যাক-সিঙ্গার নয়! তার মাথায় একটা আইডিয়া আসে, বাবার সঙ্গে আলোচনা করে সেটা আরও পূর্ণতা পায়। তখন সে সিন্‌হাকে বলে— ডোন্ট মাইন্ড, আপনাদের স্টোরি-লাইনটা… জাস্ট লাইক এনি আদার স্টোরি।’

সিনহা আমতা আমতা করে বলেন—‘আসলে আমাদের একটা ফর্মুলা আছে তো… মিস ঠাকুর।’

—‘আই নো। অ্যান্ড আই হেট ইট। অথচ বারে বারেই আপনারা ক্লেইম করছেন এটা নাকি এক্সপেরিমেন্ট। অর্ডিনারি মশালা ছবি নয়।’ তার পরে সে প্রকাশ করে তার গল্প। চটুল, মনভোলানো, জলুস-অলা গানের আত্মিক দিক থেকে সমৃদ্ধ সঙ্গীতের কাছে আত্মসমর্পণের গল্প। সে এ-ও জানায়, যে রাগসঙ্গীত গেয়েও দর্শককে মাতিয়ে দিতে পারেন এরকম গায়িকা তার জানা আছে।

সিনহা বললেন ‘আইডিয়াটা সত্যিই ভালো। আমরা নানারকম রুচিকে স্যাটিসফাই করবার স্কোপ পাচ্ছি। আপনি দেখছি সত্যিই ভার্সেটাইল মিতশ্রী দেবী। তা কে কণ্ঠ দেবেন, আমায় একটু যদি জানান, শেষকালে আপনাদের একটা ডুয়েট দিয়ে ছবি শেষ হতে পারে।’ তখন অপালার নাম করে সে।

নামটা শুনে মিঃ গৌরাঙ্গ সিনহা উত্তেজনায় উঠে দাঁড়াল, বলল ‘অপালা দত্তগুপ্ত! অপালা দত্তগুপ্ত। ইজ শী অ্যালাইভ? ইজ শী রিয়্যালি আভেলেব্‌ল্‌?’ বছর আষ্টেক আগে আমি ওকে ডোভার লেনে শুনি। মারোয়া গেয়েছিলেন, তারপর ঠুম্‌রি; শেষে ভজন ‘মৎ যা, মৎ যা, মৎ যা, যোগী…’ এক কথায় অনির্বচনীয় সেই এক্সপিরিয়েন্স। আমি জীবনে ভুলব না। কত খুঁজেছি তারপর ওঁর নাম। আর কখনও পাইনি।’

মিতুল বলল—‘গান বাজনার জগতের পলিটিকসের ব্যাপার জানেন তো? প্রথমত উদ্যোক্তারা ওঁকে হয় ঠুমরি নয় ভজন গাইতে বলেছিলেন। গানের মুড এসে গেলে অপালাদির জাতের গায়িকার ওসব মনে থাকে না। তিনি দুটোই গেয়েছিলেন। শ্রোতারা চেয়েছিল। এই এক, তার ওপর গান নিয়ে এক নামকরা সমালোচক প্রচুর তর্কের ঝড় তোলেন…’

সিন্‌হা বলল—‘গানের অত টেকনিক্যালিটি আমি বুঝি না। ইট ওয়াজ ফ্যানটাসটিক। মিতশ্রী দেবী, গানের ওপর আমার বিশেষ ঝোঁক বলেই কেজরিওয়ালকে এই ছবিটাতে ইনট্‌রেস্টেড করিয়েছি। আপনার অনেক প্রোগ্রাম শুনিয়েছি। কিন্তু স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি— অপালা দত্তগুপ্তকে পেয়ে যাবো। ইউ গো অ্যাহেড।’

মিতুল নিজের মনের মধ্যে খুঁজে খুঁজে দেখে সে কি এতে একটু ঈর্ষান্বিত হয়েছিল! না, না। একেবারেই না। একটা খুব সুন্দর সুগন্ধ ফুল, ফুটে আছে তার সমস্ত সৌন্দর্য ছড়িয়ে, সে কি দক্ষিণা হাওয়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে এক ধরনের আনন্দ পায় না। তার কোনও ক্ষণিকের ভালোবাসার মানুষকে আলিঙ্গন করে যে সুখ সে পায়নি, অপুদির বুকে মুখ ঘষে সে আজ তার চেয়ে অনেক বেশি সুখ কেন পেল! সে জানে না জানে না। অনেক আত্মবিশ্লেষণ করা সত্ত্বেও তার নিজের চরিত্রের কিছুটা এখনও মিতুলের কাছে ছায়াময়, দুর্বোধ্য। সে সানগ্লাসটা খুলে গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে রেখেছিল, এখন সেটা বার করে পরে নিল। রোদ নেই। গোধূলি ফুরিয়ে গেছে। রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠছে একে একে। সানগ্লাসের আড়াল তার এখনও কিছুক্ষণ দরকার।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress