গান্ধর্বী (Gandharbi) : 12
রেডিওর জন্য যেদিন অপালার প্রথম রেকর্ডিং হল, সঙ্গে রামেশ্বর গিয়েছিলেন। তাছাড়াও ছিল বেণু, রামেশ্বর অপালা উভয়েরই বশংবদ, উঠতি তবলিয়া। রেকর্ডিং-এর সময়ে অপালা অন্তঃসত্ত্বা। যদিও ভালো করে মেয়েলি চোখে লক্ষ না করলে বোঝা যায় না। তার মাস্টারমশাইয়ের জানার কথা নয়। সে ইমন-কল্যাণে খেয়াল গাইল। রামেশ্বরের মুখ বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে, তিনি সেই ক্রমাগত ঊর্ধ্বারোহী, সতেজ তরুটিকে পাচ্ছেন না। এ যেন এক নতশাখ বৃক্ষ। জলের অভাবে, সূর্যালোকের অভাবে বিবর্ণ, ক্লান্ত, হতশ্বাস। ফেরবার সময়ে অপালা বলল—‘মাস্টারমশাই গান ভালো হয়নি, না?’
—‘তুমি গেয়ে আনন্দ পেয়েছো তো?’ রামেশ্বর প্রশ্নের সোজা জবাব এড়াতে চাইলেন। সত্যি কথা বলতে কি রামেশ্বরের বাড়ি সপ্তাহে দুদিন আসে অপালা, সেই দুদিনই তার যথার্থ রেওয়াজ হয়। বাকি পাঁচটা দিন বোধহয় তার গানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে না।
মাস্টারমশাইয়ের প্রশ্নের জবাবে অপালা বলল—‘আমার বড্ড দমের অসুবিধে হচ্ছিল।’
—‘সে কি?’ অপালার মুখ আস্তে আস্তে লাল হয়ে উঠছে। রামেশ্বর এইবার তার দিকে ভালো করে তাকালেন। মনে মনে বললেন—‘তাই বলো!’
মুখে বললেন—‘তোমার শ্রেষ্ঠ গানগুলির মধ্যে নয়। কিন্তু যথাযথ। পরিপূর্ণ। তোমার গানে একটা উপচে পড়া ভাব থাকে না, যেন যা দেবার তার চেয়ে অনেক বেশি দিচ্ছে। সেই ভাবটা পেলাম না আজ। কিছুদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। শরীরটা তো ঠিক থাকা দরকার!’
শিবনাথ বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিল ফেরবার সময়ে। সে হাত ধরে অপালাকে নামাল। বেণু, তানপুরো পৌঁছে দিল।
এর তিনদিন পর অতি-অকালে অপালা তার প্রথম সন্তানের জন্ম দিল। মাত্র দেড় কেজি ওজন। অনেকটা লম্বা। কিন্তু একদম হাড়ের ওপর চামড়া জড়ানো। তারপর ব্রহ্মতালুর কাছটা একটু বেশিই তলতল করছে।
ডাক্তার বললেন—‘ওকে তুলোর মধ্যে শুইয়ে রাখা দরকার। একদম নাড়াচাড়া করা বারণ। মাতৃদুগ্ধ ছাড়া কিছু খাবে না। অন্তত মাস দেড়েক। ওর ঘরে কোনও বাইরের লোক ঢুকবে না। অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে শুধু ওর জামাকাপড় নয়, ওর ধাত্রীদের জামাকাপড়ও ধুতে হবে। অপালা নার্সিং হোম থেকে বাড়ি আসার পর বাড়ির মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল।
পিসিমা বললেন—‘আমি তখনই বলেছিলম ভরা পোয়াতি। ওভাবে কালোয়াতি গাইতে না গেলেই কি হত না? কাতোয়াতি গানের কসরত কতো! এ তো এক রকমের কুস্তি! আমাদের ছেলেবেলায় শুনতুম গোবরবাবু কুস্তিগীর, গামা পালোয়ান। এও তো গলার কুস্তি একরকম। অনেকে দেখেছি সামনে শতরঞ্জি গালচে যা পায় প্রাণপণে খিমচে ধরে গাইবার সময়ে। অনেকে আবার এ হাত দিয়ে ঘুড়ির সুতো ছাড়ছে, ও হাত দিয়ে সুতো টানছে। বউমা অবশ্য আমাদের শান্ত-দান্ত হয়েই গায়। মানুষটিও তো জলের মতন। কিন্তু যতই ঠাণ্ডা হোক, ভেতরে তো প্যাঁচ পোঁচ কষতেই হয়, শুধু শুধু কি আর গলা দিয়ে অমন ধমক ধামক বেরোয়!’
শাশুড়ি বললেন—‘বংশের প্রথম ছেলে। কুলপ্রদীপ। এখন বাঁচলে হয়!’
তিনি এখন নাতির ভালো মন্দ ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবতে পারছেন না। কোনদিকে তাকাতে পারছেন না। বাচ্চাটাকে তুলোর চুষি করে করে মায়ের পাম্প করে বার করে নেওয়া দুধ খাওয়াতে হয়, তার নিজের টানবার ক্ষমতা নেই। গায়ে যতটা সম্ভব হাত কম লাগিয়ে তার পোশাক বদলানো, স্পঞ্জ করা, এসব তিনি ছাড়া আর কেউ পারে না। অপালার ডিউটি শুধু বাচ্চার জামা-কাপড়, শাশুড়ির এবং নিজের জামাকাপড় সাবান ও অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে ধোয়া। শাশুড়ি তার ছেলেকে সামলান। সে অসহায় চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।
অফিসে যাবার আগে শিবনাথ ডাকে—‘অপু, একবার শুনে তাও।’ ক্লান্ত শরীর টেনে টেনে ঘরে যায় অপালা। শিবনাথ পোর্টফোলিওর ভেতর থেকে একটা কৌটো খুলে দুটি পরিষ্কার ঝকঝকে ডিম বার করে। টুক করে ফাটিয়ে বলে—‘হাঁ করো দেখি’, ‘কাঁচা ডিম খাবো?’ অপালা মুখ বিকৃত করে। ‘একদম কাঁচা খাবে। আমার এক কলিগের নিজস্ব পোলট্রির লেগহর্নের ডিম। একদম বিশুদ্ধ।’ দুটো ডিম তাকে এইভাবে খাওয়ায় শিবনাথ। অপালা বলে—‘পিসিমা জানলে মূর্ছা যাবেন কিন্তু।’
—‘আপাতত তুমি মূর্ছা না গেলেই হল আমার। এগুলো ভীষণ পুষ্টিকর। পিসিমার জানবার কোনও দরকার নেই। খোলাগুলো এখান থেকে অনেক দূরে কোনও ম্লেচ্ছ রাস্তায় ফেলে দেওয়া হবে।’ সন্ধেবেলাতেও তার ব্যাগ থেকে আঙুর বেদানা খেজুর বাদাম পেস্তা ইত্যাদি বেরোয়। শিবনাথ অপালার সমস্ত আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে এগুলো তাকে খাওয়ায়।
প্রচণ্ড খিদে এখন অপালার। কিন্তু শাশুড়ি এখন নাতিকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। ছেলে এরকম অস্বাভাবিক হওয়ার দরুন সে মায়ের কাছেও যেতে পারেনি। পিসশাশুড়ি বালবিধবা। কোনদিন সন্তান ধারণ করেন নি। অতশত জানেন না। তিনি শুধু জানেন নতুন মাকে খুব কষে ঘি আর দুধ সাগু খাওয়াতে হয়। জেঠুর শরীর খুব খারাপ। মাকে একমিনিটের জন্যেও চোখের আড়াল করতে চান না। এদিকে প্রদ্যোৎ ইউসিস-এ কি পরীক্ষা দিয়ে আমেরিকা চলে গেছে। ব্রংক্স্-এর কোন হসপিটালে এখন সে ইনটার্নি। দাদা না থাকায় সে খুব অসহায় বোধ করে। ছোট্ট এই মাংসপিণ্ডটা বাঁচবে তো? ঠিক মতন হাত-পা-মস্তিষ্ক নিয়ে? মানুষের মতো হয়ে উঠবে তো? তারই জন্যে এরকম হল সত্যি সত্যি? প্রদ্যোৎ থাকলে বলতে পারত। বিদ্যুৎদা থাকলেও বলতে পারতেন। মমতামাখা চোখে সে ছোট্ট জীবটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কী লোমশ! বাঁদরের বাচ্চার সঙ্গে কোনও তফাতই নেই। তবু তার চোখ পিট পিট করে তাকানো, চিঁচিঁ করে কাঁদা আর যখন তখন বুড়ো পুতুলের মতো হাত পা সব খিঁচে তুলে আড়মোড়া ভাঙা দেখলে তার বুকের ভেতরটা কেমন আনচান করতে থাকে। সে সন্তর্পণে ছেলের নাম রাখে হিন্দোল। অবশ্যই সে নাম টেঁকে না। ঠাকুর্দাদা নাতির ঘোরঘটার অন্নপ্রাশনে ঘোষণা করেন জীবনের প্রথম যুদ্ধে ও জয়ী হয়েছে খুব শক্ত খেলায়। পরবর্তীকালেও হবে। ও রণজয়।
রণজয় যখন দুরন্ত দুবছরের শিশু, পরিবারের এবং ডাক্তারবর্গের সমস্ত ভয়-ভাবনা মিথ্যে প্রমাণিত করে সমস্ত জানলা, ঠাস ঠাস করে খুলছে আর বন্ধ করছে, সমস্ত রেলিং বেয়ে উঠছে, আর নামছে, আলমারি হাঁটকাচ্ছে, কাচের এবং মাটির জিনিস ভাঙছে এবং রান্নাঘরের বাসন-কোসন তছনছ করছে তখন দু বছর পর পর অপালার দুটি কন্যা জন্মাল। সকলেই বলাবলি করতে লাগল তিন ভাই বোনের একটিও মায়ের মতো কালো হয়নি। এবার আর অপালা নিজে নামকরণের ঝামেলায় গেল না। বড় মেয়েকে সবাই ডাকে টিটু, ছোটকে বনি। ছোটটি একদম বাবা বসানো। ওইরকম গোলগাল, ধবধবে ফর্সা, কুচকুচে কালো মাথা ভর্তি চুল, কুটি কুটি দাঁত। আর বড়টি তার নিজের মতো। নতুন শিশু জন্মাবার পর এবং ক্রমাগত বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ এবং পরিবারের নিয়মই হল মাঝে মাঝে শিশুর চেহারা এবং প্রকৃতির বিশ্লেষণ করা বেশ করে গালে হাত দিয়ে। টিটু হাসল, পিসিমা বা পিসিদিদা বলে উঠলেন—‘দেখলি অবিকল মনু হাসল’, মনু অর্থে টিটুর দাদু। টিটুর দিদা বলেন—‘কি যে বলেন দিদি তার ঠিক নেই, ও হাসি শিবুর আর কারো নয়।’ টিটু কাঁদল, পাশের বাড়ির গিন্নি এ বাড়ির গিন্নির সঙ্গে যাঁর খুব ভাব গলা বাড়িয়ে বললেন—‘অ পারুল পারুল কে কাঁদছে গো? তোমার বড় নাতনি? আমি বলি তোমার খুকি আমার মলিরাণী যাকে কবেই বিয়ে করে পার করে দিয়েছে সে-ই আজ কত বছর পরে তোমার ঘরে এসে কাঁদছে। অবিকল সেই আওয়াজ!’ টিটুর পায়ের গড়ন নাকি অবিকল তার দিদিমার মতো। অমনি চ্যাটালো। লম্বা লম্বা আঙুল। আর চুল? চুলগুলো হচ্ছে মায়ের মতো একটু লালচে, লালচে, হাজার তেল দাও কুচকুচে কালো হবে না। বনির মতো কোঁকড়াও হয়নি। ঝাঁটার কাঠির মতো না হলেও সোজা-সোজা। আর চোখ মুখ? সবাই দিশেহারা হয়ে যান। এরকম গোল গোল চোখ, লম্বা পাতলা নাক, এত সংক্ষিপ্ত ভূরু, ছোট্ট ঠোঁটজোড়া এসব ও কোথা থেকে পাচ্ছে? সকলেই বলেন—‘আরে ওকে বড় হতে দাও। বাচ্চা কতবার বদলায়। এই দেখবে বাপের মতো, ওই দেখবে মায়ের আদল—এমনি করতে করতে ঠিক বংশের ধারা পেয়ে যাবে।’ বনি যেমন হাসি খুশী, যাকে বলে ‘জলি’ বাচ্চা, রণজয় যেমন দুরন্ত, টিটু তেমন নয়। সে একটু গম্ভীর-গাম্ভার। পাতলা-চেহারা। কেউ যদি তাকে নানা কসরত করে হাসাতে গিয়ে ব্যর্থ হয় এবং বলে ‘রামগরুড়ের ছানা’, হঠাৎ তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাচ্চা টিটু বলবে ‘হাছব না না না না’। তার মুখে তখন একটু হাসি একটু বিরক্তি। আসলে সে কোনও ছবিবহুল বই দেখছিল, কিম্বা জিগস’ পাজ্ল্ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। কিম্বা পাতার ওপর পেন্সিল দিয়ে প্রাণপণে ‘গউ’ অর্থাৎ গরু আঁকবার চেষ্টা করছিল। এই সমস্ত সময়ে বড়দের এই সব ইয়ার্কি, নানারকম মুখভঙ্গি করে হাসাবার চেষ্টা, হঠাৎ কোলে তুলে হামি এবং অব্যর্থভাবে কিছু লালা মাখিয়ে দেওয়া তার ঘোরতর অপছন্দ। সুতরাং বনিকে সবাই ভালোবাসে, রণোকে সবাই প্রশ্রয় দেয়, কিন্তু টিটুর সম্পর্কে সবাই বলে ওটা সৃষ্টি ছাড়া। একটু বড় হতে মা ছড়ার গান শোনায়, গান করাবার চেষ্টা করে দুই মেয়েকেই, বনি আধো আধো গলায় গেয়ে ওঠে লয় তাল ছাড়া ‘যমুনাবতী সরস্বতী কাল যমুনা লীলাবতী।’ টিটু খুব সুরেলা গলায় হাতে তাল দিয়ে গায় ‘যমুনা যাবেন শ্বশুরবাড়ি কাজিতলা দিয়ে’ বলেই তালি থামিয়ে, গান থামিয়ে টিটু জিজ্ঞেস করবে—‘মা কাজিতলা কী!’ মা বলতে পারবে না। টিটু তখন গোঁ ধরবে। কাজিতলা কী না জানলে সে গাইবে না। কেনই বা একটা নাম-না-জানা তলা দিয়ে যমুনাকে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে! যমুনা নিমতলা দিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাক না। হায় হায় ‘নিমতলা’! শেষ পর্যন্ত ‘নিমতলা!’ আসলে তাদের বাড়িতে একটা বিশাল নিমগাছ আছে উঠোনের একপাশে। রণো ছুতো পেলেই দু বোনকে পেটে। পিটে ধামসে দেয় একেবারে। হয়ত একটা সামান্য খেলনা কি কাগজ কি অন্য কিছু নিয়ে এই ঝামেলা। ঠাকুমা এসে কোন কিছু শোনার আগেই দুমদাম করে দুই নাতনির পিঠে দু ঘা বসিয়ে দেন। বনি আরও কাঁদতে থাকে, —‘আমার কাজক (কাগজ) নিয়ে গেল, আমায় ঠাম্মা মারল, আমায় দাদা মারলো-ও-ও। ও বাবা, ও দাদু আমায় দাদা মারল, আমায় ঠাম্মা মারলো-ও-’ পাড়া মাথায় করে সে কচি গলায়। টিটুর চোখে এক ফোঁটা জল নেই। সে জিভ বার করে ঠাকুমাকে প্রাণপণে ভেংচি কাটে, দাদার দিকে পা তুলে লাথি দেখায়। সবাই বলে ‘ও মা, কী অসভ্য মেয়ে রে বাবা। বাবা অমন শান্ত, মা অমন নম্র, এ মেয়ে কার ধারা পেল?’ টিটু তখন তার কচি গলায় ভেংচি কেটে কেটে বলবে ‘দাদা এতো অছভ্য, ঠাম্মা এতো অছভ্য, ওলে বাবা এ মেয়ে কাল ধালা পেল?’ টিটুর সবচেয়ে প্রিয় খেলা বাবা যখন অফিসের ফাইল নিয়ে বসবে, সে-ও তখন টেবিলের ওপর তার ছোট্ট ফাইল নিয়ে উঠে বসবে, তাতে তাড়া তাড়া আজে-বাজে কাগজ। তাতে সে সংখ্যা বসায়, নানারকম শব্দ এবং বাক্য ভুলভাল লেখে। আর ক্রমশই তার শব্দ, বাক্য, সংখ্যা গণনা নির্ভুল হয়ে উঠতে থাকে। তাকে এই কাজটি করতে দাও, টিটুর সাড়া-শব্দ পাবে না। সে বিনা ধস্তাধস্তিতে নাওয়া-খাওয়া সেরে নেবে। বনি তার নাইলনের ভুল বুকে করে ঘুরে বেড়ালে, এবং টিটুরটা টিটুকে দিলে অসীম তাচ্ছিল্যের সঙ্গে টিটু বলবে—‘আমি কি মেয়ে যে পুতুল নিয়ে খেলব! আমার অনেক দরকারী কাজ আছে। আমি এখন বাবার অপিসের আর্দালি।’ শুনে সবাই হেসে বাঁচে না। তাই বলে টিটু যে ছেলে সাজবার বায়না ধরে তা-ও কিন্তু নয়। সে ফ্রক পরেই থাকে। শীতকালে স্ল্যাকস টিশার্ট পরে, তবুও তাকে ছেলে ছেলে দেখায় না। তার চুল খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়। পিঠের মাঝখান অব্দি সোজা, ঈষৎ লালচে চুল নিয়ে, কানে সোনার মাকড়ি, স্ল্যাকস এবং নীল ডোরা কাটা ফুলহাতা সোয়েটার পরে সে তার ছোট্ট গোলাপি ফাইল বুকে করে ঘুরে বেড়ায়। রণজয় বা বনি, অপালা বা শিবনাথ, মনোহরবাবু ও পারুল দেবী, তাঁদের ছোট ছেলে বিশ্বনাথ তাঁদের বিধবা ননদ করুণা, কিম্বা তাঁদের সঙ্গীতপ্রিয় জ্যেষ্ঠা কন্যা মল্লিকা মলির সঙ্গে টিটুর কোথাও কোনও মিল নেই। টিটু এরই মধ্যে কাকা এবং বাবার একটু ন্যাওটা, কাকার হাত ধরে বেড়াতে যেতে তার কোনও আপত্তি নেই। কাকা তাকে কাঁধে তোলে, দু হাত ধরে বাঁই বাঁই করে ঘোরায়, এসবে টিটুর মজা, খিলখিল হাসি। কিম্বা বাবা অপিস থেকে ফিরলেও সে বাবার হাঁটু ধরে ঊর্ধ্বমুখে চেয়ে সরল কৌতূহলে জিজ্ঞেস করে—‘বাবা আজকে কটা অঙ্ক করলে?’ তার ধারণা বাবা শুধু অঙ্ক করে। তার বাবার ক্যালকুলেটরটা নিয়ে সে সুযোগ পেলেই টিপে-টুপে দেখে, তবে খুব সাবধানে এবং গোপনে। ঠিক কোন সময়টিতে ড্রয়ারের চাবি খোলা এবং বাবা অনুপস্থিত সে শ্যেন দৃষ্টিতে নজর রাখে। কিন্তু মা হার্মোনিয়াম নিয়ে গানে বসলে এবং বাবা এবং অনেক সময় কাকা সেখানে বসে আহা! আহা!’ করতে থাকলেই সে অব্যর্থভাবে সে তল্লাট ছাড়া হয়ে যাবে। রেডিওতে যখন মায়ের গান হয়, তখন সে রেডিওর পাশের ঘরে। অপালা অনেক সময়ে বিষণ্ণ গলায় বলে —‘টিটু, তোর মার গান ভালো লাগে না না?
টিটু প্রথমে জবাব দেয় না, তারপর বলে—‘জানি না, যাও!’ আরও জোরাজুরি করলে বোঝা যায়—গানটা অত্যন্ত মেয়েলি ব্যাপার বলে সে ধরে নিয়েছে। তাই পুতুল খেলারই মতো গান বাজনার ব্যাপারেও তার প্রচণ্ড অনীহা। সে এখন বাবার অপিসের কাজ করছে।
রণজয় যখন পাঁচ বছরের, টিটু তিন এবং বনি দুই তখন একটা বিশ্রী অঘটন ঘটল। অপালার চতুর্থ সন্তান ছ মাসে নষ্ট হয়ে গেল। অপালা নিজেও প্রায় অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলো। এবার ডাক্তার বরাবরের মতো জন্মনিরোধের ব্যবস্থা রোগিণীর দেহে করে দিলেন। শিবনাথ ডাক্তারের কাছ থেকে পেশাদারী তিরস্কার শুনল। বাড়িতে তার ছোট ভাই বিশ্বনাথ কিছুদিন ঘৃণায় দাদার সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিল। শিবনাথের বাবা একদিন অনেক গলা খাঁকরে, চটির শব্দ করে, উল্টোপাল্টা কথা বলে বড় ছেলেকে যা বলতে চাইলেন সোজা কথায় তার অর্থ হয়—‘সে কি মানুষ? তাঁদের সময়ে বিজ্ঞান এতে উন্নতি করেনি, তবুও তিনি তিনটিতে তাঁর সন্তান সংখ্যা সীমিত রাখতে পেরেছেন, আর এতে উচ্চশিক্ষিত হয়ে শিবনাথ…ছি…ছি ভগবান রেখেছেন তাই। কিন্তু বউমা যদি চলে যেত? তিনটি সন্তান নিয়ে কী করত শিবনাথ!
এবার সেরে ওঠবার জন্য দুই মেয়েকে নিয়ে অপালা তার মায়ের কাছে কীর্তি মিত্র লেনে গেল। জেঠু মারা গেছেন। তাঁর সঞ্চিত অর্থে, এবং পুরো একতলাটা সরকারি অফিসারকে ভাড়া দিয়ে মা এখন যথেষ্ট সচ্ছল এবং স্বাধীন। প্রদ্যোৎ নিউ ইয়র্কেরই হাসপাতালে আছে, মাকে নিয়মিত ডলার পাঠায়। তাঁর একমাত্র অভাব সঙ্গীর। বড় একা। চিরকালই একা, ভেতরে ভেতরে, কিন্তু এখন বাইরেও। কেউ নেই। ছেলে নেই, মেয়ে খুব মাঝে মধ্যে আসে। তেমন আত্মীয় স্বজন বলবার মতো কেউ নেই। নীচের ভাড়াটে ভদ্রলোকের পরিবার অতি সজ্জন। তিনি নিজেও নির্বিরোধ। কাজেই নীচের দেখাশোনার ভরসাতেই তিনি আছেন।
মেয়ে আসাতে তিনি হাতে চাঁদ পেলেন। নাতি আসেনি। নাতিকে তার ঠাম্মা ও দাদু কখনও কাছছাড়া করেন না। কিন্তু নাতনি দুটি তাঁর হাতে স্বর্গ এনে দিল। আর কতদিন পর মেয়েকে এতদিন ধরে, এমন করে কাছে পাওয়া! সেবা তাঁর স্বভাব। তিনি প্রাণপণে মেয়েকে সেবা করে খাড়া করে তুলেছেন। জামাই প্রায় রোজই অফিস-ফেরত আসে। তাঁর ফরমাশমতো দোকান-বাজার করে দিয়ে যায়। অপালা রাত্রে মার কাছে শুয়ে শুয়ে গল্প করে, বলে ‘মা এবার থেকে তোমার কাছে অনেক দিন ধরে আমাকে এমনি করে রেখো। রাখবে তো?’
—‘থাকলে তো হাতে চাঁদ পাই অপু। কিন্তু জামাই কি তোকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারবে?’
—‘আমি তো তোমারও, মা।’
—‘ওঁরা যদি ছাড়তে রাজি না হন! এর পর নাতি নাতনিরা স্কুলে যাবে!’
—‘ওঁরা আমার চেয়ে দাদু-ঠাকুমাকে বেশি চেনে, মা, অসুবিধে হবে না।’
—‘তোর কি ওখানে… ভালো লাগে না!’ ওঁরা কি তোকে মানে তোর সঙ্গে কিছু…’ মা কথা শেষ করতে পারেন না।
অপালা বলল ‘ওঁরা বেশ ভালো লোক। কিন্তু তুমি নিজেই বলো, নিজের মা আর অন্যের মা কি কখনও একরকম হতে পারে?’
সুজাতা খুব ভালো করে এ কথা জানেন। তাঁর বিয়ে হয়েছে ষোল পূর্ণ সতেরয়। বাপের বাড়ি কেমন ছিল সে এখন এক সুখস্বপ্ন, কিন্তু স্বপ্নই, যেন সম্পূর্ণ অবাস্তব। বাস্তব হচ্ছে ‘খামখেয়ালী, বেহিসেবী, ভালোমানুষ স্বামীর অকস্মাৎ মৃত্যু, ভাসুরের অধীনে সারাটা জীবন ছেলে-মেয়ে নিজের সমস্ত সুখ-দুঃখ-আহ্লাদের স্বাভাবিক চেহারাকে দমন করে ভয়ে আধমরা হয়ে জীবন-কাটানো। এখন ভাসুর নেই, ছেলে-মেয়েও কাছে নেই। তবু যেন সুজাতা দেবী জীবনে এই প্রথম সুখী। স্বীকার করতে লজ্জা হয় কিন্তু এখন, এতদিনে আর কারো কাছে তাঁর কোনও কৈফিয়ত দেবার নেই, কারো ইচ্ছা বা সাধ মেটাবার দায় নেই, তাঁর যা-ইচ্ছে করার স্বাধীনতা আছে, তিনি বছরে একবার করে এক একটা দলের সঙ্গে ভারতের একাংশ ঘুরে আসেন। ছেলের চিঠি আসে, মেয়ে মাঝে মাঝে এসে পড়ে, ছোট ছোট শিশুগুলির কলকাকলি। তিনি বেশ আছেন।
ইতিমধ্যে এক দিন স্নান সেরে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বাথরুম থেকে বেরিয়ে অপালা দেখল বিদ্যুৎদা বসে আছেন। ছ সাতবছর বিদেশে কাটিয়ে, বিদ্যুৎদা এখন খুব চকচকে, সাহেবি ধরনের হয়ে গেছেন। যদিও পরে আছেন টেরিকটনের পায়জামা এবং খাদির কলার তোলা যাকে বলে গুরু পাঞ্জাবি। বিদেশে যাঁরা থাকেন, এদেশের শীত তাঁদের গায়ে লাগে না। সুজাতার গায়ে গরম চাদর। অপালা উলের ব্লাউজ পরে রয়েছে। এবে সে রোগা, তার ওপর রক্তাল্পতায় ভুগছে। এখন চান করে উঠে এই বারোটা বেলাতেও তার শীত-শীত করছে, সে তাড়াতাড়ি একটা শাল গায়ে জড়িয়ে বিদ্যুৎদার সামনে এসে বসে পড়ল। ভীষণ খুশি, ভীষণ অবাক। বলল—‘কবে এলেন? বেশ তো! জানালেন না কিছু না। আমার বন্ধু কই, তাকে নিয়ে আসেননি কেন? খুব সাহেব হয়েছেন, না?’
বিদ্যুৎদা অপলার দিকে চাইলেন—‘আসতে চাইল না তোমার বন্ধু।’
—‘ইসস্, আপনি খেপালেই আমি খেপছি আর কি?’
—‘সত্যিই, আনবার কোনও উপায় ছিল না অপালা।’
—‘তবে কি ইংল্যান্ড থেকে এতদিন পরে একলাই এলেন?’
—‘উপায় কী?’ বিদ্যুৎদা খুব গম্ভীর।
এবার অপালার শঙ্কিত হবার পালা। দীপালি বিদ্যুৎদাকে খুব একটা পছন্দ করে বিয়ে করেনি। যদিও উচ্ছ্বসিত হয়ে চিঠি লিখেছে বরাবর। কিন্তু ভেবে দেখতে গেলে সে সব বিদ্যুৎদার উচ্ছ্বস নিয়ে উচ্ছ্বস। সে যে বিদ্যুৎদাকে ভালোবাসছে এমন কথা দীপুদি কোনদিন লেখেনি। বরং বিদ্যুৎদার কালো রঙ, কম দৈর্ঘ্য এবং মাঝে মাঝে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করে গেছে। ও নিজেই লিখেছে ওখানে ওর কি রকম জনপ্রিয়তা। ও যে কোনও পার্টির মধ্যমণি। দীপুদি কিছু ঘটিয়ে বসল না তো! অপালার মুখ এখন এমনিতেই ফ্যাকাশে, সে আরও ফ্যাকাশে হয়ে বলল—‘কী হয়েছে বিদ্যুৎদা?’
বিদ্যুৎকান্তি বললেন—‘লন্ডনের মতো জায়গা, যেখানে সারা ইয়োরোপ এবং আমেরিকা থেকে লোকে বাচ্চা হতে আসে, সেইখানে আমার এবং অন্যান্য ডাক্তারদের চোখের সামনে তোমার বন্ধু চাইল্ড বেড়ে মারা গেল, বিশ্বাস করতে পারো?’
অপালা মোড়ায় বসেছিল। সে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল। বিদ্যুৎকান্তিই তাকে ধরে ফেললেন। অপালার হাত পা কাঁপছে, বুকের ভেতরটা কেমন করছে, ইদানীং তার এরকম প্রায়ই হয়। ডাক্তার বলছেন রক্তাল্পতার জন্য। তার চেতনার মধ্যে খুব দূরে কিন্তু চড়াসুরে প্রাণপণে ঝালা বাজাচ্ছে কেউ সেতারে, মিড় টানছে লম্বা লম্বা আঙুলে, অপালা রাগ-পহ্চানে হেরে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না এমন অবিমিশ্র-বীভৎস-কারণ্য কোন রাগে আছে। মা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, তিনি বিদ্যুৎদার সংবাদ শোনেননি। অপালার অবস্থাটাই দেখছেন। তিনি বললেন—‘বিদ্যুৎ অপুর পর পর দুবছর দুটি মেয়ে হয়ে গেল। দু বছর বাদ দিয়ে এবার একটি…’
—‘আবারও একটি হয়েছে? অ্যানাদার?’ —বিদ্যুৎদা ভুরু কুঁচকোলেন।
—‘হল আর কই?’ মা জবাব দিলেন।
—‘কি অ্যাবর্শন না স্টিল-বর্ন।’
—‘নষ্ট হয়ে গেছে বিদ্যুৎ, তারপর থেকে মেয়েটা কিছুতেই সারতে পারছে না।’
বিদ্যুৎ বললেন—‘অপালা দেখি একবার নাড়িটা,’ একটু পরে বিদ্যুৎ বললেন—‘একি? মাঝে মাঝে বীট মিস হচ্ছে কেন?’
—‘ওটা আমার বরাবরই আছে, বাড়ির ডাক্তারবাবু বলতেন অ্যাথলিটস হার্ট নাকি!’
—‘অ্যাথলিটই বটে’— বিদ্যুৎদা একটু হাসবার চেষ্টা করলেন। বললেন আজ তো আমার কাছে কিছু নেই। আরেক দিন যন্ত্রপাতি নিয়ে আসব, ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করব তখনই।’ অপালা কোনমতে কয়েকটা কথা মুখ দিয়ে বার করেছিল, আর কিছু বলতে পারছে না, অস্বাভাবিক ভারী হয়ে উঠেছে বুক। তারপর ভরা বাদল শুরু হল চোখ দিয়ে। অবিরল ধারে। চোখের ভেতরেও যে এমনি পুরো একটা বার্ষা লুকিয়ে থাকতে পারে, এবং সঠিক ঋতু অনুসারী সুরটা স্পর্শ করলেই এমনি ত্রি-সপ্তকের ছত্রিশটা স্বর ব্যবহার করে বিগলিত হতে পারে ক্রন্দনবিমুখ-স্বভাব অপালা এতদিন জানত না। সে এভাবে কোনদিন কাঁদেনি। তার মুখ-চোখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, আওয়াজ বেরিয়ে যাচ্ছে গলা দিয়ে, বেসুরো আওয়াজ। সে প্রাণপণে শালের আঁচল দিয়ে মুখ আড়াল করবার চেষ্টা করে।
বিদ্যুৎদা বললেন—‘কাঁদো অপালা কাঁদো! আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ি করলাম। সে তার পছন্দমতো সাজাল। বাগান করল। প্রত্যেকটি জিনিস তার নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে করা। কালচার্যাল ব্যাপারে লন্ডনের এশিয়ানদের মধ্যমণি। পাঞ্জাবিগুলোকে শুদ্ধু টপ্পা গেয়ে মাতাল করে দিত। শিখতে আরম্ভ করেছিল ওয়েস্টার্ন পপ-সঙ। তোমাকে ছবির অ্যালবাম দেখাবো অপু। কত অনুষ্ঠান, কত ট্রিবিউট, উই ওয়্যার সো হ্যাপি, সো সাকসেসফুল! সইল না।’
বিদ্যুৎ উঠে দাঁড়ালেন, পেছনে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পায়চারি করতে করতে বললেন—‘এখন সবচেয়ে বড় প্রবলেম হচ্ছে বাচ্চাটা। সে এখনও হসপিটালে, ডাক্তার-নার্সদেব কেয়ারে আছে। কিন্তু এভাবে তো আর বেশিদিন চলতে পারে না!’
সুজাতা দেবী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্তম্ভিত হয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে বললেন—‘ওদের বাড়ি থেকে কী বলছে? দিদি? মেয়েরা?’
—‘মা, মানে আমার শাশুড়ি বলছেন গীতালিকে নিয়ে যেতে।’
গীতালি, দীপালির মেজদি। স্কুলের সেলাইয়ের টিচার। বড় আর মেজটি ছাড়া আর সবাইকার বিয়ে হয়ে গেছে। বড়টিই সবচেয়ে শক্ত, ব্যক্তিত্বশালিনী। সে এখন নিজেই একটি প্রাইভেট নার্সিং প্রতিষ্ঠান চালায়।
—‘তাই যান না বিদ্যুৎদা, গীতালিদি যদি রাজি থাকে!’
—‘গীতালি রাজি আছে অপু। ওরা বোনেরা পরস্পরকে কিভাবে ভালোবাসে জানো তো! কেউ কারোকে সাহায্য করতে বা স্যাক্রিফাইস করতে পিছপা নয়। কিন্তু আমি কি করে নিয়ে যাই! সর্বত্র একটা সমাজ আছে। ইংলন্ডেও ভারতীয় সমাজ আছে। এঁরা এখানে লিবার্যাল হলে হবে কি? তা ছাড়াও অপু, গীতালির একটা কেরিয়ার আছে, সে সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে আমার ছেলে মানুষ করতে যাবে? এতোটা স্যাক্রিফাইস আমি কেমন করে মেনে নেবো? ওর পক্ষেও ব্যাপারটা খুবই হিউমিলিয়েটিং মনে হচ্ছে আমার কাছে।’
সুজাতা বললেন—‘একটা কথা বলব বিদ্যুৎ কিছু যদি মনে করো!’
—‘কী কথা মাসিমা বলুন, আমি এখন মনে করা-না করার বাইরে। আমার মা-বাবা যদি তাঁদের জেদ ছেড়ে খুলনা থেকে আসতেন! অনায়াসে আমি তাঁদের নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু সেই স্কুল পার হবার পর তাঁদের কাছ ছাড়া হয়েছি। তাঁদের বোধহয় ছেলে বলে আমার জন্যে আর একটুও সেন্টিমেন্ট অবশিষ্ট নেই। আমার দাদার ফ্যামিলি এবং দেশের জমি-জমা বাস্তু নিয়ে তাঁরা আপাদমস্তক জড়িয়ে আছেন। আমি আমার সমস্যা এসব কিছু না। কিচ্ছু না।’
সুজাতা মৃদু গলায় কিন্তু বেশ জোর দিয়ে বললেন—‘তুমি গীতালিকে বিয়ে করে নিয়ে যাও না বিদ্যুৎ! দীপুর স্বৰ্গত আত্মা এতেই তৃপ্তি পাবে, আমি বলছি। তার ছেলেটিকে মায়ের মতো দরদ দিয়ে মাসী ছাড়া আর কেউ দেখতেও পারবে না। দীপালিরা পাঁচ বোনই অত্যন্ত গুণী। মানিয়ে দিতে ওস্তাদ। বড় ভালো মেয়ে ওরা। কত কষ্ট করে যে সব বড় হল, বাপ নেই, একটা পরামর্শ দেবার কেউ নেই! ঈশ্বর যে কেন এতো নিষ্ঠুর, কেন যে কারও সুখ দেখতে পারেন না, কেন এমন হিংসুটে-কুচুটে আমি আজও জানি না বাবা।’
সুজাতা চোখে আঁচল দিলেন। তাঁর নিজের জীবনও তো এই। সমৃদ্ধি ছিল না, কিন্তু শান্তি ছিল, অসীম প্রেম ছিল, পূজাও ছিল। কিন্তু তিনি কেড়ে নিলেন, তখন তাঁর কতই বা বয়স, দুটি ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে যুঝেই গেলেন। যুঝেই গেলেন সারা জীবন!
বিদ্যুৎ স্থাণু হয়ে বসে রইলেন। এরকম অদ্ভুত সমাধানের কথা তাঁর মনে একবারও উদয় হয়নি। দীপালির সঙ্গে তাঁর বিবাহ-পরবর্তী মধুযামিনী পর্বও এখনও পার হয়নি। স্বামী-স্ত্রীর দীর্ঘদিন একত্র বসবাসের ফলে যেসব অবশ্যম্ভাবী ব্যক্তিত্ব-সংঘাত হয়, রুচির ঝগড়া হয়, ছোটখাটো তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস নিয়ে তুলকালাম হয়ে যায়, বিদ্যৎকান্তির ছ’ সাত বছরের দাম্পত্য-জীবনে তা এখনও আসেনি। একে তিনি নিজের কর্মজীবন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত, তার ওপর দীপালির রূপে, গুণপনায় তিনি একেবারে সম্পূর্ণ বশীভূত। পুরুরবা-উর্বশীর পুরুরবার মতো দশা। তার ওপরে দীপালির অসাধারণ মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, প্রত্যেকটি পরিস্থিতিকে অত্যন্ত সুকৌশলে নিজের আয়ত্তের মধ্যে এনে ফেলার সামর্থ্য, রসবোধ, গৃহিণীপনা, এ-সব, না, না, তিনি দীপালির জায়গায় অন্য কাউকে কখনও বসাতে পারবেন না।
গীতালিও খুব ভালো মেয়ে। ওইরকমই নেপালি ধাঁচের মুখ। ওইরকমই প্রায় ফর্সা। একটু শান্তশিষ্ট, একটু কম চালাক। সে যেন দীপালির একটা অক্ষম ছায়া। কিন্তু ভালো। নিঃসন্দেহে ভালো। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠলেন—একি? তিনি কি করছেন? তাঁর প্রাণ-প্রিয়া দীপালির সঙ্গে অন্য কারো রূপগুণের তুলনা করছেন! যেন রূপগুণে দীপালির সমকক্ষ হলেই তাঁর বিয়ে করতে আটকাবে না?
তিনি কি রকম উদভ্রান্তের মতো উঠে দাঁড়ালেন। অপালার মা বললেন—‘একি বিদ্যুৎ তুমি কফিটুকু খেলে না! ওইটুকুই তো চাইলে বাবা!’
বিদ্যুৎ অন্যমনস্ক গলায় বললেন—‘তা হয় না মাসিমা’ তিনি যে কোন প্রশ্নটার জবাব দিচ্ছেন বোঝা গেল না। পূর্ণ কফির পাত্র ফেলে, কাউকে একটা বিদায় সম্ভাষণ পর্যন্ত না করে তিনি চলে গেলেন।
বিকেলবেলাতেই সুজাতা অপালাকে নিয়ে দীপালিদের বাড়ি গেলেন। তিনি প্রাণপণে দীপালির মাকে বোঝালেন, শুধু শুধু গীতালিকে বিদ্যুতের সঙ্গে পাঠানো খুব খারাপ দেখাবে। তাছাড়া গীতালি তার চাকরি-টাকরি ছেড়ে ওভাবে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের পথে পা বাড়াবে, কী হবে তার? সে কি বিদ্যুতের ছেলেকে নিয়ে এখানে ফিরে আসবে? বিদ্যুতের রকম-সকম দেখে মনে হয় ছেলেকে সে ছাড়বে না। তাহলে? তাহলে? তার চেয়ে তিনি নিজে প্রস্তাব করুন। বিদ্যুৎকে বোঝান। সে নিশ্চয় বুঝবে।
দীপালির মা অঝোরে কাঁদতে লাগলেন।
সুজাতা বললেন ‘দিদি, আপনার এক মেয়ের সুখের মধ্যে দিয়ে আরেক মেয়ের সুখ বেঁচে থাকবে। বিদ্যুৎ অমন উদারস্বভাব দয়ালু চরিত্রের ছেলে, আপনার প্রত্যেক মেয়ের বিয়েতে অমন মুক্তমনে সাহায্য করেছে, খরচ করেছে। দীপুর সইল না। দীপুর ভাগ্য দিদি। কিন্তু তার স্থান তার বোন না নিলে আপনি অমন একটি ছেলে হারাবেন। বাচ্চাটার কী দুর্গতি হবে ঈশ্বর জানেন?’
দীপালির মা অবশেষে সুজাতার কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করলেন। প্রস্তাবটা যখন তাঁর দিক থেকে এলো বিদ্যুৎকে আর অতটা উদ্ভ্রান্ত দেখাল না। সন্দেহ নেই এর চেয়ে ভালো সমাধান আর হয় না। সে গীতালির সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলতে চাইল। কী কথা হল কেউ জানে না। কিন্তু দেখা গেল দুজনেই ছলছলে চোখে বেরিয়ে এসেছে, দুজনেই মত দিল। কোনও অনুষ্ঠান, কোনও আড়ম্বর, লোক জানাজানি করে শুধু অপালা শিবনাথ সুজাতার উপস্থিতিতে বিদ্যুৎ-গীতালির বিয়ে হয়ে গেল। রেজিস্ট্রেশনের সময়ে গীতালি কাঁদছিল, বিদ্যুৎ কাঁদো-কাঁদো। ফেরবার সময়ে সুজাতা বললেন,—‘আহা, ওরা সুখী হোক। কার ভাগ্য যে কে ভোগ করে! বড়টি তো কোনদিনই বিয়ে করবে না বলে দিয়ে দিয়েছে। এই মেয়েটিরই দিদির বিয়ে হচ্ছিল না কিছুতেই। এক ধাক্কায় স্বামী-পুত্র-বাড়ি-গাড়ি-বিলেত সবই পেয়ে গেল। ওপরে যিনি আছেন তাঁর মতলবখানা যে কী আজও বুঝে উঠতে পারলুম না।’