গান্ধর্বী (Gandharbi) : 11
বিদ্যুৎদা শিগগিরই লন্ডন চলে যাচ্ছেন। সমস্ত ডাক্তারের সেই এক লক্ষ্য এম. আর. সি. পি. এফ. আর. সি. এস। নানারকম কার্যকারণে ছাত্র প্রদ্যোতের সঙ্গে বিদ্যুৎদার সম্পর্কটা এখন প্রায় ইয়ারের। এক গেলাসের নয় অবশ্য। কারণ মিত্র পরিবারের পরিমিতি বোধ প্রদ্যোতের মধ্যেও বিলক্ষণ বর্তমান। বিদ্যুৎদার লেজটাও সে প্রাণপণে ধরে আছে। বিদেশ সে যাবেই। এই সব হাসপাতাল, এই সব চাকরি, এই কণ্ঠাগত পরিশ্রম, পরিবর্তে কিছু নেই। প্রদ্যোৎ স্বপ্ন-টপ্ন দেখার মানুষ না। সে যাবেই। বিদ্যুৎদা তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন সে জানে। তারও হাউস-স্টাফ-শিপ শেষ হয়ে এলো। বিদ্যুৎদা তাকে পার্ক স্ট্রীটের এক চমৎকার রেস্তোরাঁয় খাওয়াচ্ছেন। মৃদু আলো। মৃদু স্বরে ঝমঝমে বাজনার সঙ্গে গান। কথা বলার কোনও অসুবিধেই হয় না।
তাদের উচ্চকাঙক্ষা, ব্যবহারিক সুবিধে-অসুবিধের সম্পর্কে নানা কথা বলতে বলতে হঠাৎ বিদ্যুৎ সরকার বললেন— ‘আচ্ছা প্রদ্যোৎ, অপুর বিয়েতে একটি মেয়েকে দেখছিলাম, সামান্য প্লাম্প, অপুর থেকে শর্ট হাইট, খুব ফর্সা, অরেঞ্জ রঙের শাড়ি পরেছিলো। মেয়েটি কে?’
প্রদ্যোৎ মিটিমিটি হেসে বলল—‘কোন মেয়েটি বলুন তো, ধরতে পারছি না।’
—‘ওই যে একটু নেপালি ধাঁচের চোখ মুখ!’
—‘ও বুঝেছি বোধহয়। গুড়িয়া জাপান কী? তা হঠাৎ? এতো খোঁজ খবর?’
—‘ভেরি ইন্টারেস্টিং—’ সংক্ষেপে বললেন বিদ্যুৎদা।
—‘প্রিটি, চার্মিং এসব বললে বুঝতে পারতুম। কিন্তু ইনট্রেস্টিং?
‘আরে আমিও তো তোমার বোনের বিয়েতে খেটেছি কম না। সারাদিনই ছিলাম। নিমেষের মধ্যে অখণ্ড মনোযোগে বড় বড় সব অপূর্ব আলপনা দিয়ে ফেলল। কোথায় বর এসে ফার্স্ট দাঁড়াবে, ছাঁদনাতলা, বাসর ঘর। হাতের এক এক টানে সোজা সোজা রেখা, বৃত্ত, কলকা, ফুলের পাপড়ি। কী সুইফ্ট্! তারপরেই দেখলুম অপুকে সাজাচ্ছে। অপুকে তো যখন বার করল তোমাদের ওই বিয়ের বাড়িটাতে নিয়ে যাবার জন্য আমি সেই অপু বলে চিনতেই পারিনি!’
—‘আমার বোনটাকে দেখতে খারাপ বলছেন বিদ্যুৎদা? বাঃ বেশ লোক তো আপনি?’
—‘আহা হা হা, তা বলব কেন, অপু সার্টনলি হ্যাজ হার ওন স্পেশ্যাল চার্ম। আমি বলতে চাইছি, শী ওয়াজ টোট্যালি ট্রান্সফার্মড্। শী ওয়াজ লুকিং লাইক এ প্রিনসেস, অর টু পুট ইট মোর প্রপারলি, লাইক এ গডেস। এটা মানবে তো?’
প্রদ্যোৎ তাঁর বলার ধরন দেখে হেসে ফেলল।
বিদ্যুৎদা বললেন—‘তারপর খাওয়া-দাওয়া শুরু হতেই দেখলাম মেয়েটি নিজেও দারুণ সাজগোজ করে মানে ওইরকম রাজ কন্যা-টন্যারই মতো সেজে গুজে তদারকি করে বেড়াচ্ছে। অ্যামে—জিং।’
প্রদ্যোৎ বলল—‘তবু তো আপনি বাসর জাগলেন না। থাকলে দেখতে পেতেন ও একাই গান গেয়ে বাসর মাত্ করে রেখেছিল। অন্য অনেকেই গেয়েছে। অপুর বেশির ভাগ বন্ধুই গান-টান গায়। কিন্তু মূল গায়েন ওই দীপালিই।’
—‘এর পরেও আবার গান জানে নাকি?’
—‘গান জানে মানে? রেডিওয় রেগুলার গায়। প্রতি বছর প্রয়াগের পরীক্ষায় ছাত্র-ছাত্রী পাশ করাচ্ছে।’
—‘ওরে বা বা!’
—‘প্রথমেই বলে রাখি বিদ্যুৎদা ওরা পাঁচ বোন। বাবা নেই। ভাই নেই। পাঁচজনেই অসাধারণ গুণী। প্রত্যেকে কিছু না কিছু করে সংসারটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। গৃহকর্ম, রান্না এসবেতেও ওরা ওস্তাদ। অপুর আইবুড়ো ভাতে নিজে রান্না করল, মাকে সরিয়ে দিয়ে। যা বেঁধেছিল না!’
—‘একি দ্রৌপদী-টদি নাকি?’
—‘পঞ্চস্বামীর ব্যাপারটা বাদে। বিয়ে করলে আপনি পঞ্চ শ্যালিকা, না ও-ও তো পাঁচ জনের মধ্যে, বিয়ে করলে আপনি পঞ্চরসিকা পাবেন। আর দীপালি নিজে যে একাই একশ এতে আপনি নিজের চোখেই দেখেছেন।’
বিদ্যুৎ সরকার বললেন—‘বলছো!’
—‘বলছি। তবে ওরা কিন্তু ব্রাহ্মণ। মিশ্র।’
—‘ওরে বাব্বা, ছোবল দেবে নাকি?’
—‘সে আপনার ভাগ্য। দেখুন কারা ছোবল দেয়। আপনাদের দিক থেকেও তো ছোবল আসতে পারে, বিদ্যুৎদা! আলাপ করিয়ে দেবো?’
—‘দাও।’
—‘এক কাজ করুন, অপু কদিন পর অষ্টমঙ্গলা না কিসে আসবে। ওর বন্ধুরাও বোধহয় সে সময়ে ওর বরের সঙ্গে ইয়ার্কি দিতে এসে পড়বে। আপনিও আসুন। খুব সহজে আমাদের কাজ হয়ে যাবে।’
বিদ্যুকান্তি ভারী লজ্জা পেয়ে গেলেন, বললেন, —‘ধুর, বড্ড মেয়েলি হয়ে যাবে ব্যাপারটা।’
—‘কি ভাবে তাহলে ছেলেলি করবেন ব্যাপারটা? আপনিই সাজেস্ট করুন।’
—‘ইজ শী গুড?’
—‘এই তো মুশকিল করলেন বিদ্যুৎদা! আমি কি করে জানবো?’
—‘তু তুমি বুঝি মেয়ে-টেয়েতে ইন্টারেস্টেড নও?’
—‘আমি এখনও খুব ছেলেমানুষ, বুঝতে পারছেন না! গাল টিপলে দুধ বেরোয়। কিন্তু আপনাকে তো বেশ ভালোমত আহত মনে হচ্ছে। একটা ব্যবস্থা করতেই হয়!’
বিদ্যুৎ চিন্তিত স্বরে বললেন—‘তুমি তো জানোই প্রদ্যোৎ আই অ্যাম ভেরি মাচ ইন নীড অফ এ কমপ্যানিয়ন। বাবা মা দেশে থাকেন, কোনও দিন জমি-জমা আর ভিটের মায়া ছেড়ে এ দেশে আসবেন না। আর আমি কোথায় যাবো, কী করব, কোথায় প্র্যাকটিস আরম্ভ করব—কিচ্ছুরই ঠিক নেই। আই নীড সামবডি। স্বীকার করছি মেয়েটিকে আমার ভালো লেগেছে।’
অষ্টমঙ্গলায় বিদ্যুৎকান্তি কিন্তু এলেন না। অপুকে সব কথা খুলে বলতে অপালাই বলল—‘দাঁড়া, আমি দীপুদির মন বুঝি।’ সে জানে দীপালির মধ্যে অনেক জটিলতা যা তার সুন্দর, নিভাঁজ, নেপালি মুখে ছায়ামাত্র ফেলে না। কিন্তু অপালা জানে দীপালি এক সময়ে সোহমকে পাগলের মতো ভালো বেসেছিল। তাকে পাবার জন্যে সে তার প্রতিদ্বন্দ্বিনীর সম্পর্কে অনেক উল্টোপাল্টা কথা সোহমকে বলেছিল। অপালার কাছে অবশ্য সে ভাব দেখায় যে মিতুলের সম্পর্কে সোহমের মনোভাবের কথা না জেনেই সে তথ্যগুলো এমনি এমনি কথায় কথায় বলে ফেলেছে। কিন্তু অপালা এ ক’দিনে অনেক পরিণত হয়ে উঠেছে। এখন তার সন্দেহ যে দীপালি খানিকটা জেনে শুনেই ইচ্ছাকৃতভাবে সোহমের মন বিষিয়ে দিতে চেয়েছিল। দীপুদির সম্পর্কে এ কথা ভাবতে তার খুব খারাপ লাগে, কিন্তু সত্য যা তাকে তো স্বীকার করতেই হবে। সেই দীপালিই যখন দেখল তার কৃতকর্মের ফলে সোহম বিকারগ্রস্ত উন্মাদ হয়ে গেল, তখন সে ভয়ে আধমরা হয়ে গেল। এখন সোহম আবার ভালো হয়ে গেছে, খুব সম্ভব বিকারের সময়কার কথা তার মনে নেই। কিন্তু দীপালির কথাগুলোই যে তাকে ওরকম উত্তেজিত করেছিল, এ কথা হয়ত সোহম ভুলবে না।
দীপালি অপালাকে একান্তে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল—‘কিরে অপু? খুব তো বিয়ে করব না, করব না, বলছিলি। এখন কেমন লাগছে?’
অপালা নিজের ভেতরের কথা পুরোপুরি খুলে সবাইকে বলতে পারে না, চায়ও না। সে একটু হেসে বলল—‘ভালো মন্দ মিশিয়ে।’
—‘ইস্স্’ মুখের চেহারাই পাল্টে গেছে, তোর বর তো খালি এদিক-ওদিক খুঁজছে তোকে! খুব স্ত্রৈণ হবে দেখিস! একেবারে আঁচলে বাঁধা।’
অপালা বলল—‘দীপুদি, তুই বিয়ে করবি?’
—‘আমাকে কে বিয়ে করবে বল?’ দীপালি হতাশ গলায় বলল—‘আমি ছাত্রী শেখাবো, দুই বোনে মিলে নৃত্যনাট্যের কোরিওগ্রাফি তৈরি করব, তারপর একদিন পট কবে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরে যাবো বাবার মতো।’
—‘তোর আত্মবিশ্বাস এতো কম কেন রে দীপুদি! নিজেকে অত ছোটই বা মনে করিস কেন? তোর মতো সুন্দর, সর্বগুণসম্পন্ন মেয়ে আর কটা আছে? আমি তো দেখি না। আমার মতো কালিন্দীর এক কথায় বিয়ে হয়ে যেতে পারে, আর তোর হবে না?’
দীপালি বলল—‘বিয়ে হয়ে তুই খুব উদার হয়ে গেছিস অপু। এসব কথা তো আগে কখনও তোর মুখে শুনিনি!’
অপালা বলল—‘কি জানি, বলি নি হয়তো, কিন্তু মনের অতলে ছিলই। সব কথা সব সময়ে আমি বলতে পারি না। আচ্ছা দীপুদি, এখনও তুই সোহমকে ভালোবাসিস? সোহম তো একদম ভালো হয়ে গেছে।’
—‘ওরে বাবা, সোহম চক্রবর্তীকে নমস্কার। সোহম যদি বাঁদিকের ফুটপাথ দিয়ে যায়, আমি তাহলে ডান দিকে যাবো ভাই। ভালোবাসা? ভালোবাসা ডকে উঠেছে। সোহমের সে মূর্তি তো তুই দেখিনি!’
অপালা বলল—‘তুই-ই কি দেখেছিস? শুনেছিস শুধু।’
দীপালি বলল—‘দ্যাটস এনাফ। গড ফরবিড। সোহম যেন কখনও আমার দিকে না আসে।’
অপালা বলল—‘একজন তোর সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে, তোকে খুব পছন্দ, আলাপ করবি?’
দীপালি চকিত হয়ে বলল—‘কে?’
—‘ডাঃ বিদ্যুকান্তি সরকার এম. ডি. দাদার একজন সিনিয়র বন্ধু। আমার বিয়েতে কদিনই ওঁকে দেখেছিস।’
—‘কালোমতো? বেঁটে?’
—‘কালো, হ্যাঁ। কিন্তু বেঁটে কেন হবে? বাঙালির অ্যাভারেজ হাইট। স্বাস্থ্য খুব ভালো। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিলেন। শিগগিরই বাইরে চলে যাবেন।’
দীপালি একটু ভাবল, বলল—‘ঠিক আছে, আলাপ করিয়ে দে।’
কাউকে একথা বলেনি, কিন্তু দীপালির ইদানীং পছন্দ ছিল প্রদ্যোৎকে। প্রদ্যোতের সহানুভূতিশীল ব্যবহার। তার খানিকটা উদাসীন চরিত্র। স্পষ্টবাক, প্র্যাকটিক্যল ব্যক্তিত্ব, তার পুরুষালি চেহারা—এসবই দীপালির মন কেড়েছিল। সোহমের পর। সোহমের ক্ষেত্রে আবার সোহমের চেয়েও ভালো লেগেছিল তার বাড়ি, তার সম্পদ, সচ্ছল জীবনযাত্রা। সোহমের দুঘরের স্যুইটটা দীপালির ভীষণ পছন্দ ছিল। আর পছন্দ ছিল দক্ষিণের ওই ঝুলবারান্দাটা। ওইখানে তারা দুজনে বসে গল্প করবে, চা বা কফি খাবে, রাস্তা দেখবে, মানুষ জনের চলাচল দেখবে। কিন্তু অপালাদের সংসারের চেহারা তার একদম পছন্দ হয় না। অপুর মা অবশ্য খুব ভালো। কিন্তু এই বাড়ির সঙ্গে তাদের বাড়ির তো কোনও তফাত নেই! প্রায় একই রকম। তফাত এই, তাদের ভাঙা রঙ চটা বাড়িটা ভাড়া, অপুদেরটা নিজেদের। জ্যাঠামশাইয়ের অংশটা বেশ সাজানো-গোছানো। কিন্তু বুড়ো মহা ধড়িবাজ তার ওপর সেকেলে। কিভাবে অপুর মাকে খাটায়! প্রদ্যোৎ আর অপুর ওপরও একচ্ছত্র অধিকার স্থাপন করে রেখেছে। এই পরিবেশকে দীপালি পাল্টে দিতে পারত যদি ওই জ্যাঠামশাইটি না থাকতেন। বাবা মারা যাবার পর পুরুষ কর্তৃত্বহীন সংসারে তারা পাঁচ বোন আর মা অনেক লড়াই করে হলেও স্বাধীনভাবে বাস করেন। জেঠু-টেঠু আর এখন সহ্য হবে না। বিদ্যুকান্তির প্লাস পয়েন্ট তার বাবা মা সুদূর বাংলাদেশে থাকেন। কোনদিন আসতে চান না। একদম একার সংসার। এবং এটাও স্পষ্ট যে বিদ্যুৎ ডাক্তার উন্নতি করবেই। এখনই স্ক্যুটার কিনেছে, ভবিষ্যতে আরও কত হবে!
অপালার বিয়ের তিনমাসের মধ্যে দীপালির বিয়ে হয়ে গেল বিদ্যুকান্তি সরকারের সঙ্গে। রেজিষ্ট্রি ম্যারেজ। ন্যূনতম খরচ। বিদ্যুৎ দুপক্ষের সবাইকেই একদিন আপ্যায়ন করলেন। বিদ্যুকান্তির বাবা মা যাঁরা এখনও খুলনা ফুলতলা গ্রামের ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছেন তাঁরা আসতে পারলেন না। তবে চিঠিতে জানালেন বিদ্যুৎ ছোটজাতের মেয়ে বিবাহ না করিয়া উঁচু জাতের মেয়ে বিবাহ করিয়াছে অতএব তাঁহাদের আপত্তি নাই। তবে প্রতিলোম বিবাহ সম্পর্কে একটু সাবধান। নবদম্পতিকে তাঁহারা সর্বান্তঃকরণে আশীর্বাদ করিতেছেন। যুগলের রঙিন ফটো দেখিয়া তাঁহারা যারপরনাই আনন্দিত। বংশে একটি প্রকৃত গৌরবর্ণ বধূ আসিল।
কয়েকমাসের মধ্যেই দম্পতি লন্ডনে চলে গেল। এবং সেখান থেকে অনতি বিলম্বে অপালা দীপালির একটি উচ্ছ্বসিত চিঠি পেল।
প্রিয় অপু,
আমার তোকে প্রিয়তমা অপু বলে সম্বোধন করতে ইচ্ছে করছে। তুই আমার জন্যে যা করেছিস তার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারবো না। আমার বর যে আমাকে কী চোখে দেখে তোকে বলে বোঝাতে পারব না। আমি যাই করি তাই ওর কাছে আশ্চর্য। এতো প্রশংসা আমি কখনও কারো কাছ থেকে পাইনি। আর এ দেশে এসে যে কী ভালো লাগছে তা-ও ভাষায় বোঝাতে পারব না। ও সারাদিন ব্যস্ত থাকে। কিন্তু আমার অনেক কাজ থাকে। চমৎকার সময় কেটে যায়। ভাবছি একটা গান শেখাবার স্কুল খুলব। সাহেবগুলোও দেখি আমাকে দেখে বেশ চনমনিয়ে ওঠে। আলাপ করবার জন্যে উশখুশ করে। ব্যাপারটা সত্যি বলতে ভাই, আমার দা-রুণ লাগে। মনে হয় আমীর খাঁর সেই’ ঝনন ঝনন পা-এল বা-আ-আ-জে’টা শুনিয়ে দিই। ব্যাটারা ভড়কে যাবে। পায়ের তলায় সটান পড়ে যাবে। এ ব্যাপারগুলোয় বিদ্যুৎ খুব গর্বিত। কিন্তু বোধহয় মাঝে মাঝে একটু ভাবিত হয়ে পড়ে। কালকে একটা পার্টি ছিল। বাঙালিও ছিল, ইংরেজ, ইটালিয়ান, মার্কিনও ছিল। রাতে শুয়ে শুয়ে চুপি চুপি বললে—‘দীপু, আমার দীপ আমাকে কখনও ফেলে যাবে না তো!’ বোঝ একবার, বাবুর ভয় হয়েছে যদি ওই মার্কিন, ইটালিয়ান, ইংরেজদের ফর্সারঙ আর হাইট দেখে আমি ওদের সঙ্গে কোনও কারবার করে ফেলি। হায় কপাল অপু! ও তো জানে না দীপালি বা ওর দীপ কি ধরনের পোড়-খাওয়া মেয়ে! মেঘ না চাইতেই জলের মতো এলো বটে আমার জীবনে! কিন্তু এতো বর্ষণ তো আমি স্বপ্নেও আশা করিনি। কলকাতায় খাইনি, এখানে এসে খাস বাংলাদেশের অসাধারণ ইলিশ খাচ্ছি, ভাজা, ডিম, কালো জিরে কাঁচা লঙ্কার পাতলা ঝোল, পাতুড়ি, আর কত বলবো? আমরা কেন্ট বলে একটা জায়গায় থাকি। গাড়ি ছাড়া গতি নেই। আমিও শিখছি। শিখে গেলে, লাইসেন্স পেয়ে গেলে আমার নিজস্ব একটা গাড়ি হবে অপু। একদম নিজস্ব। ভাবতে পারিস! গান গেয়ে গেয়ে এক সময় ঘেন্না ধরে গেছিল। বিশেষ করে শিখিয়ে শিখিয়ে। কিন্তু এখন বাড়িতে, কোন ভারত-বাংলাদেশী মজলিশে, বা মিশ্রিত পার্টিতে যখন ‘সই ভালো করে বিনোদবেণী বাঁধিয়া দে’ কিম্বা ‘মৈষাল মৈষাল কর বন্ধ রে/ওরে শুকনা নদীর কূলে/মুখখানি শুকাইয়া গ্যাছে, চৈত মাইস্যা ঝামেলে গানগুলো ধরি পার্টি শুধু আমার জন্যেই জমে যায়। ভাটিয়ালিটা গাওয়ার সময় এতগুলো দেশের লোক যখন একসঙ্গে নির্ভুল তালি দেয় তখন তার উন্মাদনাই আলাদা। তুই ঠিকই বুঝেছিস। সঙ্গীত ইজ দি থিং।’
ইতি
তোরই দীপুদি
অপালার চিঠিটা এতো ভালো লাগল! আর দীপুদির সুখ-সৌভাগ্যের আতিশয্যে তার সামান্য অবদান আছে মনে করে এতো আনন্দ হল যে সে অবিলম্বে উত্তর দিল চিঠিটার। দীপালির চিঠিও পরের ডাকেই। এ মাসে যদি একটা চিঠি-বিনিময় হয়, তো দ্বিতীয় মাসেই আবার একটা। শিবনাথের পোর্ট-ফোলিওয় খুঁজলেই দু একটা এয়ার লেটার পাওয়া যাবে। দীপালির চিঠি পেয়ে অপালা যখন হন্তদন্ত হয়ে বলে—‘শুনছো, আমাকে একটা এয়ার-লেটার এনে দাও না।’ শিবনাথ চোখ বুজিয়ে চা খেতে খেতে বলে—‘এখন তো পোস্ট অফিস বন্ধ হয়ে গেছে।’ অপালা বলে—‘আহা, আজকে আনতে বলছি নাকি? কাল এনে দিও।’
শিবনাথ জানলার দিকে তাকিয়ে বলে ‘কালকে তো আমার পোস্ট অফিস যাবার সুবিধে হবে না!’ ‘তোমাকে নিজেকে যেতে হবে কেন? তোমাদের পিওন, বেয়ারা এসব নেই?’ তখন শিবনাথ নির্লিপ্ত হয়ে বলবে—‘বাড়িতেই ক্লাস ফোর স্টাফের আচরণ দেখছ আর সরকারি অফিসের পিওনকে ব্যক্তিগত কাজে পাঠাতে বলছো? কিছুই জানো না অপু!’ তখন অপালা হতাশ হয়ে বলবে—‘ঠিক আছে, কাল আমিই বেরিয়ে আনব, এখন।’ শিবনাথের ততক্ষণে চা শেষ হয়েছে, সে বলবে—‘পোর্টফোলিওটা একটু এগিয়ে দাও তো! টিফিন-বাক্সটা বার করে দিই।’ অপালা পোর্টফোলিওটা এগিয়ে দেবে খুলে টিফিন বাক্সটা বার করে দেবে শিবনাথ। তারপরে হঠাৎ বলবে—‘আরে এই তো একটা চিঠির কাগজ রয়েছে। দেখি তো ইনল্যান্ড, না এয়ার! আরে এয়ার-লেটারই তো দেখছি। কোথা থেকে এলো বলো তো! আমার তো কোনও সাহেব বা মেমসাহেব বন্ধু নেই! অপু তুমি তো দেখছি ম্যাজিক জানো!’ তখন দুজনেই হাসতে থাকবে।
মনীষার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। তার বাবা বদলি হয়ে গেছেন, একটা চিঠি দিয়েছিল, তাতে ঠিকানা দিতে ভুলেছে। সুতরাং মনীষার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সোহম একদম বেপাত্তা। রামেশ্বরজীর বাড়ি গিয়েও সব সময়েও মিতুলের সঙ্গে দেখা হয় না অপুর। আর মিতুল তো ঠিক তার বন্ধু নয়। ছোট অনেক। বয়সের হিসেব ধরতে গেলে হয়ত তফাতটা খুব বেশি নয়। কিন্তু সে এক বিবাহিত রমণী যাকে মাথায় আধঘোমটা দিয়ে নিত্য শ্বশুরবাড়ির কিছু-না কিছু কৃত্য করতে হয়। একটু তটস্থ হয়েই। একটি পুরুষমানুষের মনোরঞ্জন করতে হয়, সে বেশ পরিণত গায়িকাও। এদিকে মিতুল স্কুল থেকে এখন সবে কলেজে। তার বন্ধুর শেষ নেই। যদি বা কোনদিন অপালার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, সে হুড়হুড় করে এক গঙ্গা কথা বলে যাবে। বা কোনদিন একটু স্থির হয়ে বসে কোনও বিশেষ গানের শক্ত অংশগুলো অপুর সাহায্যে গলায় তুলবে। হয়ে গেলে বলবে—‘ওহ, ইউ আর গ্রেট অপুদি, রিয়্যাল গ্রেট।’
দীপালির চিঠি, সুখে-আনন্দে-ভরা চিঠি অপালার কাছে খুব প্রত্যাশা ও আগ্রহের জিনিস। সে নিজেকে এভাবে প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু দীপালি যখন প্রকাশ করে তখন পূর্ণভাবে উপভোগ করে।
অপু রে, দীপালি লেখে,
এখন নিজেই গাড়ি চালাচ্ছি। এখানকার বাংলাদেশি পাকিস্তানী আর ইন্ডিয়ান মাগুলো তাদের খুদেগুলোকে পাঠাতে শুরু করেছে। বেশ হাই ফিজ করেছি, বুঝলি। ডাক্তারটা বাগড়া দিচ্ছিল। তার নাকি মানে লাগে। এক দাবড়ানি দিয়েছি। গলার কসরত করব, সময় দেবো, জিভে পাথরের নুড়ি রেখে উচ্চারণ শেখাবো আর ফিজ নেবো না! ইল্লি নাকি? আই অ্যাম অ্যাবসল্যুটলি প্রোফেশন্যাল। এদেশের লোকগুলোও ঠিক তাই। সব কিছুতেই ফেলো কড়ি, মাখো তেল’ খালি আমার বিদ্যুৎকান্তিই লজ্জায় বেগনি হয়ে যাচ্ছেন। যাই হোক আমার পেশাদারির সাবান ঘষে ঘষে বেগুনি বর্ণকে স্বাভাবিক কৃষ্ণবর্ণে নিয়ে এসেছি। সাহেবগুলোও ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক শিখতে আসছে। এক এক জন মেম সাহেবের গলা কি মাইরি, আ বলতে বললে, বলে ‘হা’, এমনি বাজখাই যে ফৈয়জ খাঁকে হার মানায়। অদূর ভবিষ্যতে রবিশংকর হয়ে যাবো আশা করছি। তখন প্রধান মন্ত্রী-টন্ত্রী মারা গেলে আমাকে এখান থেকে ভজন গাইতে নিয়ে যাবে। তোরা থাকতে। দেখিস ভবিষ্যদ্বাণী করে দিচ্ছি। এক লম্বা চুল, বড় বড় ঘোড়ার মতো হলদে-দাঁত ছোকরার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আইরিশ। একদম নীল চোখ। সোনালি গোঁফ দাড়ি চুল। প্রত্যেকবার গান শিখে উঠে যাবার সময়ে আমার হাতে চুমো খেয়ে যায়। ডাক্তারসাহেব একদিন দেখে ফেলেছিল, সেই থেকে রঙটা ফর্সা হতে শুরু করেছে। এতো ফ্যাকাশে হয়েছে যে কী বলবো! তোদের সবাইকে খুব মিস করি। আনন্দ ভাগ করে নিলে বাড়ে। হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছি। কি যে একটা ‘কহ গৌরাঙ্গ ভজ গৌরাঙ্গ’ সরকারি অফিসারকে বিয়ে করলি! বিদেশে আসার চান্স্ রইল না। বিয়ে করতে হয় ডাক্তার, নয় এঞ্জিনিয়ার, নয় মার্চেন্ট অফিসের অফিসার। চিঠিটা যেন আবার শিবসাগরকে দেখাসনি। হয়ত তোর লাইফ হেল করে দেবে। আজ আসি—দীপুদি।