Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গহনগোপন || Prafulla Roy » Page 3

গহনগোপন || Prafulla Roy

সুকান্ত খুব ঘুমকাতুরে। অনেক বেলায় তার মুখ ভাঙে। বিশেষ করে শীতকালে আর বর্ষায় তো কথাই নেই। নটা-সাড়ে নটার আগে তাকে বিছানা থেকে টেনে হেঁচড়েও ভোলা যায় না।

হোটেল পহেলগাঁওয়ের রুম-হিটারের আরামদায়ক উষ্ণতায় ভারী কম্বলের তলায় তার জম্পেশ করে ঘুমোবার কথা।

কিন্তু এতকালের রুটিনটার হেরফের হয়ে গেল। কাল রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। সাতটা বাজতে না-বাজতেই আজ সে উঠে পড়ল।

তার একপাশে শমিতা, আরেক পাশে তাতান। দুজনেই গভীর ঘুমের আরকে ডুবে আছে। কয়েক লহমা সুকান্ত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু শমিতার মুখটা দেখা যাচ্ছে না; কেননা দীর্ঘকালের অভ্যাসে সে কম্বল মুড়ি দিয়ে রয়েছে। তবে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের হালকা শব্দ কানে আসছে।

স্ত্রী বা ছেলে কারওকেই জাগাল না সুকান্ত। নিঃশব্দে অ্যাটাচড বাথরুমে ঢুকে মুখ-টুথ ধুয়ে ফিরে এসে পোশাক বদলে তার ওপর গরম ফুল-স্প্রিভ পুল-ওভার চাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আজ সকালের প্রথম কাজটা কী হবে, কাল রাতে শুয়ে শুয়েই তা ঠিক করে রেখেছিল সে।

রোদ উঠে গিয়েছিল। কাশ্মীর উপত্যকায় সকালের দিকের শীতল রোদ। কনকনে হাওয়াও দিচ্ছে। লিডার নদী ঝুম ঝুম সুরেলা আওয়াজ তুলে বয়েই চলেছে।

হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় চলে এসেছিল সুকান্ত। চারদিকে প্রচুর লোকজন। তাদের মধ্যে ট্যুরিস্টই বেশি।

সুকান্ত কোনও দিকে তাকাল না; পাঁচ-সাত মিনিটের ভেতর হোটেল প্যারাগন-এ চলে এল। রিসেপশন ডেস্কে একটি যুবক বসে ছিল। সে ইংরেজিতে বলল, গুড মর্নিং স্যার। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?

সুকান্ত জানায়, কলকাতা থেকে একজন টুরিস্ট এখানে এসে উঠেছেন। তাঁর নাম দীপেন ঘোষ। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

সরি স্যার

সরি কেন?

আজ খুব সকালে, তখনও ভালো করে রোদ ওঠেনি, তিনি আমাদের ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুর কোম্পানি থেকে একটা গাড়ি ঠিক করে দিতে বলেন। অথচ কাল দুপুরে লাঞ্চের পর বেড়াতে বেরিয়ে বেশ রাত করে মিস্টার ঘোষ যখন ফিরলেন তখন তিনি ভীষণ অসুস্থ। দুহাতে বুক চেপে ধরে ছিলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তাঁর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাড়াতাড়ি বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ডাক্তার ইসমাইলকে খবর দিলাম। তিনি এসে পেশেন্টকে পরীক্ষা করে বললেন, হার্টের কন্ডিশন মোটেও ভালো নয়। নানারকম টেস্ট করতে হবে। ওষুধ লিখে দিয়ে আপাতত তিনদিন কমপ্লিট বেড়-রেস্ট। আমরা ওষুধ কিনে এনে খাইয়ে দিলাম। কিন্তু আজ সকালে তিনি একটা গাড়ি ডেকে দেবার জন্যে ইনসিস্ট করতে লাগলেন। আমরা ডাক্তার ইসমাইলের কথাগুলো তাঁকে বার বার মনে করিয়ে দিলাম। মিস্টার ঘোষ কোনও কথাই শুনলেন না। বোর্ডারের মর্জি। কী করতে পারি! গাড়ি ডাকতেই হল। তিনি হোটেলের বিল মিটিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। আমাদের আর কিছু করার ছিল না স্যার

সুকান্ত বেশ কিছুক্ষণ হতবাক দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর জিগ্যেস করে, ডাক্তার ইসমাইল সাহেব কোথায় থাকেন? আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

রিসেপশনিস্ট যুবকটি জানায়, ডাক্তার সাহেব কাছেই থাকেন। সামনের রাস্তা দিয়ে ডানদিকে মিনিট তিন-চারেক হাঁটলেই রাস্তার ওপারে যে নীচু নীচু পাহাড়গুলো রয়েছে সেখানেই তাঁর বাংলো। যে-কোনও লোককে জিগ্যেস করলেই দেখিয়ে দেবে।

ধন্যবাদ জানিয়ে একটু পরেই ডাক্তার ইসমাইলের বাংলোর চলে এল সুকান্ত।

ডাক্তার ইসমাইলের বয়স ষাট পেরিয়েছে। নিজের দোতলা বাংলোর একতলায় তাঁর চেম্বার। ভারী সজ্জন, সুভদ্র মানুষ। তাঁর দিকে তাকালে মনে সম্ভ্রম জাগে। নিজের পরিচয় দিতেই বেশ সমাদর করে সুকান্তকে বসালেন। বললেন, আপনিও ডাক্তার। গুড। আমরা তা হলে একই ঝাঁকের পঞ্জী।

সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সুকান্ত বলল, আপনার কাছে একটা প্রয়োজনে এসেছি।

হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন

হোটেল প্যারাগন থেকে কাল বেশ অনেকটা রাত্তিরে একজন পেশেন্টকে দেখার জন্যে আপনাকে কল দেওয়া হয়েছিল

আপনি জানলেন কীভাবে?

ওই হোটেলের রিসেপশন থেকে আমাকে বলেছে।

আপনি দীপেন ঘোষকে চেনেন?

খুব সামান্য। এখানে এসে ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। ওঁর সম্বন্ধে আমি জানতে চাই। মানে পেশেন্টের ফিজিক্যাল কন্ডিশনটা কেমন দেখেছিলেন?

দেখুন, দীপেন ঘোষ দিন চার-পাঁচেক আগে পহেলগাঁওয়ে এসেছেন। এসেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বললেন, কয়েক বছর আগে তাঁর পর পর দুটো অ্যাটাক হয়। প্রথমটা তত মারাত্মক নয়। কিন্তু সেকেন্ডটা ম্যাসিভ। তারপর বাইপাস করায় মোটামুটি ভালোই আছেন। জানালেন তাঁর বেড়াবার খুব শখ। যেখানেই যান প্রথমে সেখানকার কোনও ডাক্তারের সঙ্গে কনট্যাক্ট করেন। হার্টের ব্যাপার কখন কী ঘটে যাবে, আগে থেকে তো বলা যায় না। যিনি ওঁর বাইপাস করেছেন সেই সার্জনের প্রেসক্রিপশন দেখালেন। আমি ওঁর হার্টের কন্ডিশন দেখলাম। ইয়াং বয়সের মতো টগবগে হওয়া সম্ভব নয়; তার ওপর বাইপাস হয়েছে। তবু দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ওঁর ডাক্তার ঠিক মেডিসিনই প্রেসক্রাইব করেছেন। কিন্তু কাল রাতে ওঁকে পরীক্ষা করে চমকে উঠি। হার্টের অবস্থা ভালো নয়। মনে হয় কোনও কারণে মেন্টাল শিক পেয়েছেন কিংবা কোনওরকম মানসিক প্রেশার। আমি ওঁর জন্যে ওষুধের ব্যবস্থা করে তিন দিনের ফুল বেড-রেস্টের কথা বলে আসি।–বেলা আরেকটু বাড়লে ওঁকে একবার দেখে আসব।

সুকান্ত বলল, দেখা হবে না ডক্টর ইসমাইল

সোজাসুজি সুকান্তর চোখর দিকে তাকালেন ডাক্তার ইসমাইল–মানে?

আজ খুব সকালে উনি একটা গাড়ি নিয়ে চলে গেছেন।

বলেন কী! আমি তো হোটেলের লোকদের বার বার বলে এসেছি, মিস্টার ঘোষের ওপর যেন নজর রাখে।

হোটেলের এমপ্লয়িরা বাধা দিয়েছিল। উনি কারও কথা শোনেননি। জোর করেই চলে গেছেন।

চোখে-মুখে তীব্র উৎকণ্ঠা ফুটে ওঠে ডাক্তার ইসমাইলের। আস্তে আস্তে মাথা নাড়তে নাড়তে বিষঃ গলায় বলেন, এ তো সুইসাইডের মতো ব্যাপার।

ডাক্তার ইসমালের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ফের রাস্তায়। অন্যমনস্কর মতো হাঁটতে হাঁটতে হোটেল পহেলগাঁও-এর সামনে চলে এল সুকান্ত। বড় রাস্তা থেকে একটা চওড়া নুড়ি-বিছানো ঢালু পথ সোজা হোটেলে গিয়ে ঠেকেছে। সেই পথটায় নামতেই হঠাৎ কী ভেবে ওপর দিকে তাকাল। তাদের সুইটটা দোতলায়; ড্রইংরুম বড় রাস্তার দিকে। চোখে পড়ল, শমিতা পর্দা সরিয়ে জোড়া জানলার কাঁচের পাল্লা খুলে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

দু-এক লহমা থমকে দাঁড়িয়ে গেল সুকান্ত। তারপর চোখ নামিয়ে হোটেলে ঢুকে লিফটে দোতলায় সোজা নিজেদের স্যুইটেবাইরের দরজাটা ভেজানো ছিল। তার জন্যই কি শমিতা ওটার লক খুলে ওইভাবে রেখে দিয়েছে?

ড্রইংরুমে এসে একটা সোফায় ধপ করে বসে পড়ল সুকান্ত। জানলার কাছ থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে অন্য একটা সোফায় বসল শমিতা। চোখের দৃষ্টি আগের মতোই স্থির। পলক পড়ছে না। চাপা গলায় জিগ্যেস করল, সকালবেলা উঠে কারওকে কিছু না বলে কোথায় গিয়েছিলে?

সুকান্ত বলল, তোমাদের তখনও ঘুম ভাঙেনি। তাই আর ডাকাডাকি করিনি। ভাবলাম একটু ঘুরে-টুরে আসি। তাই বেরিয়ে পড়লাম।

কোনওদিন তো নটা-সাড়ে নটার আগে বিছানা ছাড়ো না। আজ হঠাৎ তাড়াতাড়ি নিদ্রাভঙ্গ হল যে? শমিতার কণ্ঠস্বরে সামান্য ঝাঁঝ ফুটে বেরোয়।

রোজ কি একসময় ঘুম ভাঙে নাকি? দু-একদিন আগেও তো ভাঙতে পারে।

তা পারে। কিন্তু এত বছর বিয়ে হয়েছে, কোনও দিন তো তোমাকে মর্নিং ওয়াকে যেতে দেখিনি।

কোনও দিন যাইনি বলে আজও যে যাব না, এমন কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?

মুখটা শক্ত হয়ে উঠল শমিতার। কঠিন গলায় বলল, তুমি ওই উটকো লোকটার কাছে গিয়েছিলে

গলার স্বর উঁচুতেও তুলল না সুকান্ত, নীচেও নামাল না। কণ্ঠস্বরকে এক জায়গায় রেখে বলল, গেসটা কারেক্ট। সঠিক অনুমান।

কী বলতে গিয়ে থেমে গেল শমিতা। টের পাচ্ছে তার কপালের দুপাশের রগগুলো দপদপ করছে।

সুকান্ত একই ভঙ্গিতে বলতে লাগল, উটকো হোক, লম্পট হোক, দুশ্চরিত্র বা ঠক-জোচ্চোর যা-ই হোক, একটা মানুষ তো। শুধু মানুষ নয়, ভয়ংকর অসুস্থ মানুষ। দু-দুটো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, বাইপাস হয়েছে।

সুকান্ত টুকরো টুকরোভাবে কাল রাতে এখান থেকে যাবার পর লোকটার কী কী হয়েছে, ডাক্তার ইসমাইল কী কী বলেছেন সব জানিয়ে বলল, ডাক্তার ইসমাইলের বারণ, হোটেল এমপ্লয়িদের আটকানোর চেষ্টা, কোনও কিছুই তাকে ঠেকাতে পারেনি। ডাক্তার ইসমাইল বলেছেন, লোকটা সুইসাইডের পথ ধরেছে। অথচ

নিজের অজান্তেই শমিতা বলল, অথচ কী?

তুমি যদি কাল রাত্তিরে একটু করুণা করতে

শমিতা চমকে উঠল। পৃথিবীতে হাজার হাজার দীপেন ঘোষ রয়েছে। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের এই দীপেন ঘোষ ঠিক কে, কী তার পরিচয়, হয়তো হয়তো বুঝতে পেরেছে সুকান্ত। অথচ তার সঙ্গে বিয়ের আগে সুচরিতাদি, সুকান্ত এবং তার মা-বাবার কাছে অকপটে তার ব্যর্থ, বিধ্বস্ত বিয়ের কথা সবিস্তারে জানিয়ে দিয়েছিল শমিতা। তখন বার বার দীপেনের নাম উঠে এসেছিল। বিয়ের পর এতগুলো বছরে শমিতা, সুকান্ত বা কেউ একবারও দীপেনের নাম উচ্চারণ করেনি। মনে হয়েছিল ওই পর্বটা দীপেন সমেত বাড়ির সবাই চিরতরে ভুলে গেছে।

কিন্তু সত্যিই কি তাই? নইলে সকাল হতে-না-হতেই সুকান্ত দীপেনের হোটেলে ছুটবে কেন? মানুষের স্মৃতি বা মনের অন্ধকার সব অলিন্দে কত কিছুই তো লুকিয়ে থাকে যা কোনও কোনও মুহূর্তে আচমকা বেরিয়ে আসে।

শমিতা তার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনির শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। জিগ্যেস করল, কীসের করুণা?

তুমি যদি কাল রাতে লোকটাকে আমাদের সুইটে থেকে যাবার কথা বলতে, সে বেঁচে যেত। আমার ধারণা সে শ্রীনগরের দিকেই গেছে। মনে হয় পথেই মারাত্মক কিছু একটা হয়ে যাবে। হি উইল ডাই। সে খুব সম্ভব বাঁচবে না।

সুকান্ত কি বিয়ের এতদিন পর তাকে পরখ করতে চাইছে? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মনটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেছে। স্তব্ধ হয়ে বসে রইল শমিতা।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress