গোটা পাড়াটা পোড়াইয়া
গোটা পাড়াটা পোড়াইয়া দিবার অভিপ্রায় শ্রীহরির ছিল না। কিন্তু যখন পুড়িয়া গেলই, তখন তাহাতেও বিশেষ আফসোস তাহার হইল না। পুড়িয়াছে বেশ হইয়াছে, মধ্যে মধ্যে এমন ধারায় বিপর্যয় ঘটিলে তবে ছোটলোকের দল সায়েস্তা থাকে, ক্রমশ বেটাদের আস্পর্ধা বাড়িয়া চলিতেছিল। তাহার উপর দেবু ঘোষ ও জগন ডাক্তারের উস্কানিতে তাহারা লাই পাইতেছিল। হাতের মারে কিছু হয় না, ভাতের মার—অর্থাৎ ভাতে বঞ্চিত করিতে পারিলেই মানুষ জব্দ হয়। বাঘ যে বাঘ তাহাকে খাঁচায় পুরিয়া অনাহারে রাখিয়া মানুষ তাহাকে পোষ মানায়।
এ সব বিষয়ে তাহার গুরু ছিল দুর্গাপুরের স্বনামধন্য ত্রিপুরা সিং। দুর্গাপুর এখান হইতে ক্রোশ দশেক দূর। শ্ৰীহরির মাতামহের বাড়ি ওই দুর্গাপুরে। তাহার মাতামহ ত্রিপুরা সিংয়ের চাষবাসের তদ্বিরকারক ছিল। বাল্যকালে শ্রীহরি মাতামহের ওখানে যখন যাইত, তখন সে ত্রিপুরা সিংকে দেখিয়াছে। লম্বা চওড়া দশাশয়ী চেহারা। জাতিতে রাজপুত। প্রথম বয়সে ত্রিপুরা সিং সামান্য ব্যক্তি ছিল। সম্পত্তি ছিল, মাত্র কয়েক বিঘা জমি। সেই জমিতে সে পরিশ্রম করিত অসুরের মত। আর স্থানীয় জমিদারের বাড়িতে লক্ষ্মীর কাজ করিত। আরও করিত তামাকের ব্যবসা। হাতে লাঠি ও মাথায় তামাকের বোঝা লইয়া গ্রাম-গ্রামান্তরে ফেরি করিয়া বেড়াইত, ক্ৰমে শুরু করে মহাজনী। সেই মহাজনী হইতে প্রথমত বিশিষ্ট জোতদার, অবশেষে তাহার মনিব জমিদারের জমিদারির খানিকটা কিনিয়া ছোটখাটো জমিদার পর্যন্ত হইয়াছিল। ত্রিপুরা সিংয়ের দাড়ি ছিল, বড় শখের দাড়ি, সেই দাড়িতে গালপাট্টা বাঁধিয়া গোঁফে পাক দিতে দিতে সে বলিত, শ্ৰীহরি নিজের কানে শুনিয়াছে—সে ছেলেবেলায়—এহি গাও হমি তিন-তিনবার। পুড়াইয়েসি, তব না ই বেটালোক হমাকে আমল দিল!
হা-হা করিয়া হাসিয়া সিং বলিত—এক এক দফে ঘর পুড়ল আর বেটা লোক টাকা ধার নিল। যে বেটা প্রথম দুফে কায়দা হইল নাইসে দুদকে হইল, দুদকেও যারা আইল না তারা আইল তিন দফের দফে। পাওয়ের পর গড়িয়ে পড়ল। এইসব কথা বলিতে তাহার এতটুকু। দ্বিধা হইত না। বলিত-বড় বড় জমিদারের কুষ্ঠী-ঠিকুজী নিয়ে এস, দেখবে সবাই ওই করেছে। আমার ঠাকুরদা ছিল রত্নগড়ের জমিদারবাড়ির পোষা ডাকাত। বাবুদের ডাকাতি ছিল ব্যবসা। সীতানগরের চাটুজ্জে বাবুরা সেদিন পর্যন্ত ডাকাতির বামাল সামাল দিয়েছে।
সিং নিজে যে কথাগুলি বলে নাই অথবা সিংয়ের মুখ হইতে ইতিহাসের যে অংশ শুনিবার শ্ৰীহরির সুযোগ-সৌভাগ্য ঘটে নাই, সে অংশ শ্রীহরিকে শুনাইয়াছে তাহার মাতামহ। রাত্রিতে খাওয়া-দাওয়ার পর তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ নিজের নাতিকে সেইসব অতীতের কথা বলিত। ত্রিপুরা সিংয়ের শক্তির কাহিনী, সে একেবারে রূপকথার মত; ত্রিপুরা সিংয়ের জমির পাশেই ছিল সে গ্রামের বহুবল্লভ পালের একখানা আউয়ল জমিমাত্র কাঠাদশেক তাহার পরিমাণ। সিং ওই জমিটুকুর জন্য, একশো টাকা পর্যন্ত দাম দিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু বহুবল্লভের দুৰ্ম্মতি ও অতিরিক্ত মায়া। সে কিছুতেই নেয় নাই! শেষ বর্ষার সময় একদিন রাত্রে সিং নিজে একা কোদাল চালাইয়া দুইখানা জমিকে কাটিয়া আকারে প্রকারে এমন এক অখণ্ড বস্তু করিয়া তুলিল যে, পরদিন বহুবল্লভ নিজেই ধরিতে পারিল না, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে কোথায় কোনখানে ছিল তাহার জমির সীমানার চারিটি কোণ। বহুবল্লভ মামলা করিয়াছিল। কিন্তু মামলাতে বহুবল্লভ তো পরাজিত হইলই, উপরন্তু কয়েকদিন পর বহুবল্লভের তরুণী-পত্নী ঘাটে জল আনিতে গিয়া আর ফিরিল না। ঘাটের পথে সন্ধ্যার অন্ধকারে কে বা কাহারা তাহাকে মুখে কাপড় বাঁধিয়া কাঁধে তুলিয়া লইয়া গেল।
বৃদ্ধ চুপিচুপি বলিত—মেয়েটা এখন বুড়ো হয়েছে, সিংজীর বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। একটা নয়, এমন মেয়ে সিংজীর বাড়িতে পাঁচ-সাতটা।
ত্রিপুরা সিংয়ের বিষয়বুদ্ধি, দূরদৃষ্টির বিষয়েও শ্রীহরির মাতামহের শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। বলিত—সিংজী লক্ষ্মীমন্ত পুরুষ, কি বিষয়বুদ্ধি! জমিদারের বাড়িতে লক্ষ্মীগিরি করতে করতেই বুঝেছিল—এ বাড়ির আর প্রতুল নাই। লাটের খাজনা মহল থেকে আসে; কিন্তু খাজনা দাখিলের। সময় আর টাকা থাকে না। সিংজী তখন নিজে টাকা ধার দিতে লাগল। যখন যা দরকার হয়েছে, না বলে নাই, দিয়েছে। তারপর সুদে-আসলে ধার হ্যান্ডনোট পালটে পালটে শেষমেশ যখন। নিজের কাছে না থাকলে আট আনা সুদে কর্জ করে এনে এক টাকা সুদে বাবুদিগে চেপে ধরলে টাকার লেগে, তখন বাবুদের জমিদারিই ঘরে ঢুকল। ক্ষ্যাণজন্মা লক্ষ্মীমন্ত পুরুষ! বলিয়া সে তাহার মনিবের উদ্দেশে প্রণাম করিত।
শ্ৰীহরির বাপ ছিল কৃতী চাষী। দৈহিক পরিশ্রমে মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া পতিত জমি ভাঙিয়া উৎকৃষ্ট জমি তৈয়ারি করিয়াছিল। শ্রম ও সঞ্চয় করিয়া বাড়ির উঠানটি ধানের মরাইয়ে মরাইয়ে একটি মনোরম শ্রীভবনে পরিণত করিয়া তুলিয়াছিল। বাপের মৃত্যুর পর শ্ৰীহরি যখন এই সম্পদ হাতে পাইল তখন তাহার মনে পড়িল মাতামহের স্বনামধন্য মনিব ত্রিপুরা সিংকে। মনে মনে তাহাকেই আদর্শ করিয়া সে জীবন-পথে যাত্রা শুরু করিল।
পরিশ্রমে তাহার এতটুকু কাৰ্পণ্য নাই; তাহার বিনিময়ে ফসলও হয় প্রচুর। সেই ফসল সে বাপের মত কেবল বাঁধিয়াই রাখে না, সুদে ধার দেয়। শতকরা পঁচিশ হইতে পঞ্চাশ পর্যন্ত সুদে ধানের কারবার। এক মন ধান ধার দিলে বৎসরান্তে এক মন দশ সের বা দেড় মন হইয়া সে ধান ফিরিয়া আসে। অবশ্য এটা শ্ৰীহরির জুলুম নয়। সুদের এই হারই দেশ-প্রচলিত। প্রচলনের অভ্যাসে খাতকও এ সুদকে অতিরিক্ত মনে করে না বরং অসময়ে অন্ন দেয় বলিয়া মহাজন তাহার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র।
শ্ৰীহরিকেও লোকে খাতির করে না এমন নয়; কিন্তু শ্রীহরি তাহা পর্যাপ্ত বলিয়া মনে করে না। সে অনুভব করে, লোকে ওই মৌখিক শ্রদ্ধার অন্তরালে তাহাকে ঈর্ষা করে, তাহার ধ্বংস কামনা করে। তাই এক এক সময়ে তাহার মনে হয়, সমস্ত গামখানাতেই সে আগুন লাগাইয়া লোকগুলাকে সর্বহারা করিয়া দেয়।
পথ চলিতে চলিতে জগন ডাক্তারের মত এবং অনিরুদ্ধের মত শত্রুর ঘর নজরে আসিলেই বিদ্যুচ্চমকের মত তাহার ওই দুরন্ত অবাধ্য ইচ্ছাটা অন্তরে জাগিয়া ওঠে। কিন্তু ত্রিপুরা সিংয়ের মত দুর্দান্ত সাহস তাহার নাই। সে আমলও যে আর নাই! ত্রিপুরা সিং যে ইচ্ছা পরিপূর্ণ করিতে পারি, আমলের চাপে শ্ৰীহরিকে সে ইচ্ছা দমন করিতে হয়। তাছাড়া শ্ৰীহরির অন্যায় বোধ কালের পার্থক্যে ত্রিপুরা সিংয়ের চেয়ে কিছু বেশি।
এই অন্যায় বোধ ত্রিপুরা সিংয়ের চেয়ে তাহার বেশি বলিয়াই সে বার বার আপনার মনেই গত রাত্রের কাটার জন্য নানা সাফাই গাহিতেছিল। বহুক্ষণ বসিয়া থাকিয়া সে অকস্মাৎ উঠিল।
এই ভস্মীভূত পাড়াটার দিকেই সে চলিল। যাইতে যাইতেও বারকয়েক সে ফিরিল। কেমন যেন। সঙ্কোচ বোধ হইতেছিল। অবশেষে সে নিজের রাখালটার বাড়িটাকেই একমাত্র গন্তব্যস্থল স্থির করিয়া অগ্রসর হইল। তাহার বাড়ির রাখাল, সে তাহার চাকর, এ বিপদে তাহার তল্লাশ করা যে অবশ্য কর্তব্য। কার সাধ্য তাহাকে কিছু বলে, আপনার মনেই সে প্রকাশ্যভাবে চিৎকার করিয়া উঠিল—এ্যাঁও!
বোধ করি যে তাহাকে কিছু বলিবে তাহাকে সে পূর্ব হইতেই ধমকটা দিয়া রাখিল। আসলে সে তাহার মনেই ওই অবাধ্য স্মৃতি উদ্ভূত সঙ্কোচকে একটা ধমক দিল।
রাখালটা মনিবকে যমের মত ভয় করে। ছিরু আসিয়া দাঁড়াইতেই সে ভাবিল আজিকার গরহাজিরের জন্যই পাল তাহার ঘাড় ধরিয়া লইয়া যাইতে আসিয়াছে। ছেলেটা ড়ুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল—ঘর পুরে গেইছে মশাই—তাতেই–
পুড়িয়া যাওয়ার পর এই গরিব পাড়াটার অবস্থা স্বচক্ষে দেখিয়া শ্ৰীহরি মনে মনে খানিকটা লজ্জাবোধ না করিয়া পারিল না। সে সস্নেহে ছেলেটাকে বলিলতা কাঁদিস কেনে? দৈবের ওপর তো হাত নাই। কি করবি বল? কেউ তো আর লাগিয়ে দেয় নাই।
রাখালটার বাপ বলিলতা কে আর দেবে মশাই? কেনেই বা দেবে? আমরা কার কি করেছি বলেন যে ঘরে আগুন দেবে!
শ্ৰীহরি চুপ করিয়াই পোড়া ঘরগুলার দিকেই চাহিয়া রহিল। তাহার পায়ের তলার মাটি যেন সরিয়া যাইতেছে।
রাখালটার বাপ আবার বলিল—ছোটনোকদের কাণ্ড, শুকনো পাতাতে আগুন ধরে গেইছে আর কি! আর তা ছাড়া মশাই, বিধেতাই আমাদের কপালে আগুন লাগিয়ে রেখেছে।
শুষ্ককণ্ঠে শ্রীহরি বলিল, এক কাজ কর। যা খড় লাগে আমার বাড়ি থেকে নিয়ে আয়। বাঁশ কাঠ যা লাগে নিবি আমার কাছে; ঘর তুলে ফেল।তারপর রাখালটার দিকে চাহিয়া বলিল–বাড়িতে গিয়ে চাল নিয়ে আয় দশ সের। কাল বরং ধান নিবি, বুঝলি!
রাখালটার বাপ এবার শ্ৰীহরির পায়ে একরকম গড়াইয়া পড়িল।
ইহারই মধ্যে আরও জনদুয়েক আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল; একজন হাত জোড় করিয়া বলিল আমাদিগে যদি কিছু করে ধান দিতেন ঘোষমশায়।
—ধান?
–আজ্ঞে, তা না হলে তো উপোস করে মরতে হবে মশায়।
–আচ্ছা, পাঁচ সের করে চাল আজ ঘরপিছু আমি দেব। সে আর শোধ দিতে হবে না। আর ধানও অল্প অল্প দোব কাল। কাল বার আছে ধানের। আর–
–আজ্ঞে—
–দশ গণ্ডা করে খড়ও আমি দোব প্রত্যেককে। বলে দিস পাড়াতে।
–জয় হবে মশায়, আপনার জয়জয়কার হবে। ধনে-পুতে লক্ষ্মীলাভ হবে আপনার।
শ্ৰীহরির দাক্ষিণ্যে অভিভূত হইয়া লোকটা ছুটিয়া চলিয়া গেল পাড়ার ভিতর। সংবাদটা সে প্রত্যেকের ঘরে প্রচার করিবার জন্য অস্থির হইয়া উঠিয়াছে।
দরিদ্র অশিক্ষিত মানুষগুলি যেমন শ্ৰীহরির দাক্ষিণ্যে অভিভূত হইয়া গেল শ্ৰীহরিও তেমনি অভিভূত হইয়া গেল ইহাদের কৃতজ্ঞতার সরল অকপট গদগদ প্রকাশে। এক মুহূর্তে ও সামান্য দানের ভারে মানুষগুলি পায়ের তলায় লুটাইয়া পড়িয়াছে। বিশেষ করিয়া শ্ৰীহরির মনে হইল—যে-অপরাধ সে গত রাত্রে করিয়াছে, সে-অপরাধ যেন উহাদেরই ওই কৃতজ্ঞতায় সজল চোখের অশ্ৰু-প্রবাহে উহারা ধুইয়া মুছিয়া দিতে চাহিতেছে। ভাবাবেগে শ্রীহরিরও কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইয়া আসিয়াছিল; সে বলিল—যাস, সব যাস। চাল-খড়-ধান নিয়ে আসবি।
অনেকখানি লঘু পবিত্ৰ চিত্ত লইয়া সে বাড়ি ফিরিয়া আসিল।
বাড়ি ফিরিবার পথে সে অনেক কল্পনা করিল।
গ্রীষ্মকালে জলের অভাবে লোকের কষ্টের আর অবধি থাকে না। পানীয় জলের জন্য মেয়েদের ওই নদীর ঘাট পর্যন্ত যাইতে হয়। যাহারা ইজ্জতের জন্য যায় না তাহারা খায় পচা পুকুরের দুর্গন্ধময় কাদা-ঘোলা জল। এবার একটা কুয়া সে কাটাইয়া দিবে।
গ্রামের পাঠশালার আসবাবের জন্য সেবার লোকের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষাতে পাঁচটা টাকাও সংগৃহীত হয় নাই; সে পঞ্চাশ টাকা পাঠশালার আসবাবের জন্য দান করিবে।
আরও অনেক কিছু। গ্রামের পথটা কাকর ঢালিয়া পাকা করিয়া দিবে। চণ্ডীমণ্ডপটার মাটির মেঝেটা বাঁধাইয়া দিবে : সিমেন্ট-করা মেঝের উপর খুদিয়া লিখিয়া দিবে—শ্ৰীচরণাশ্রিত শ্ৰীহরি ঘোষ। যেমন কঙ্কণার চণ্ডীতলায় মার্বেলবাঁধানো বারান্দার মেঝের উপর সাদা মার্বেলের মধ্যে। কালো হরফে লেখা আছে কঙ্কণার বাবুদের নাম।
সে কল্পনা করে, অতঃপর গ্রামের লোক সসম্ভ্ৰমে সকৃতজ্ঞচিত্তে মহাশয় ব্যক্তি বলিয়া নমস্কার করিয়া তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিতেছে।
আজ নূতন একটা অভিজ্ঞতা লাভের ফলে শ্রীহরির অন্তরে এক নূতন মন কোন্ অজ্ঞাত। নিক্ষিপ্ত বীজের অঙ্কুর-শীর্ষের মত মাথা ঠেলিয়া জাগিয়া উঠিল। কল্পনা করিতে করিতে সে গ্রামের মাঠে কিছুক্ষণ ঘুরিয়া বেড়াইল। যখন বাড়ি ফিরিল তখন বেলা প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। আসিয়াই দেখিল, বাড়ির দুয়ারে দাঁড়াইয়া আছে ওই দরিদ্রের দলটি নিতান্ত অপরাধীর মত। আর তাহার মা নির্মম কটু ভাষায় গালিগালাজ করিতেছে। শুধু ওই হতভাগ্যদিগকেই নয়—শ্ৰীহরির ওপরেও গালিগালাজ বর্ষণ করিতে মায়ের কার্পণ্য ছিল না। ক্রুদ্ধচিত্তেই সে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল। মা তাহাকে দেখিয়া দ্বিগুণবেগে জ্বলিয়া উঠিয়া গালিগালাজ আরম্ভ করিল—ওরে ও হতচ্ছাড়া বাঁশবুকো বলি দাতাকৰ্ণ-সেন হলি কবে থেকে? ওই যে পঙ্গপাল এসে দাঁড়িয়েছে, বলছে তুই ডেকে এনেছিস–
শ্ৰীহরির নগ্ন-প্রকৃতির একটা অতি নিষ্ঠুর ভঙ্গি আছে; তখন সে চিৎকার করে না, নীরবে। ভয়াবহ মুখভঙ্গি লইয়া অতি স্থিরভাবে মানুষকে বা পশুকে নির্যাতন করে যেমন শীতের স্বচ্ছ জল মানুষের হাত-পা হিম করিয়া জমাইয়া দিয়া শ্বাসরুদ্ধ করিয়া হত্যা করে। সেই ভঙ্গিতে সে অগ্রসর হইয়া আসিতেই তাহার মা দ্রুতপদে খিড়কির দরজা দিয়া পলাইয়া গেল।
শ্ৰীহরি নিজেই নীরবে প্রত্যেককে চাল দিয়া বলিলখড় আর ধান কাল নিবি সব। সর্বশেষে বলিল-মায়ের কথায় তোরা কিছু মনে করিস না যেন, বুঝলি?
তাহার পায়ের ধূলা লইয়া একজন বলিল,-আজ্ঞে দেখেন দেখি, তাই কি পারি? তারপর রহস্য করিয়া ব্যাপারটা লঘু করিয়া দিবার অভিপ্ৰায়েই সাধ্যমত বুদ্ধি খরচ করিয়া সে বলিল, মা আমাদের ক্ষ্যাপা মা গো! রাগলে আর রক্ষে নাই।
শ্ৰীহরি উত্তর দিল না। সে আপন মনেই চিন্তা করিতেছিল, ওই মা হারামজাদীই কিছু করিতে দিবে না। তাহার আজিকার পরিকল্পনা কার্যে পরিণত করিতে এত টাকা খরচ করিলে এই হারামজাদী নিশ্চয়ই একটা বীভৎস কাও করিয়া তুলিবে। আজ পর্যন্ত বড় কাঠের সিন্দুকটার চাবি ওই বেটী বুকে অ্যাঁকড়াইয়া ধরিয়া আছে। টাকা বাহির করিতে গেলেই বিপদ বাধিবে। টাকার জন্য অবশ্য কোনো ভাবনা নাই; কয়েকটা বড় বড় খাতকের কাছে সুদ আদায় করিলেই ওই কাজ কয়টা হইয়া যাইবে।
হ্যাঁ, তাই সে করিবে।
আজিকার এই ক্ষুদ্র ঘটনাটি যেন বটবৃক্ষের অতিক্ষুদ্র একটি বীজকণার সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু সেই এক কণার মধ্যেই লুকাইয়া আছে এক বিরাট মহীরুহের সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনার প্রারম্ভেই শ্ৰীহরি যেন তাহার এতকালের বদ্ধ-অন্ধকার দুর্গন্ধময় জীবন-সৌধের প্রতিটি কক্ষে দেহের প্রতিটি গ্রন্থিতে প্রতিটি সন্ধিতে এক বিচিত্র স্পন্দন অনুভব করিতেছে। সৌধখানি বোধহয় ফাটিয়া চৌচির হইয়া যাইবে।