ফসলশূন্য ক্ষেত্ৰখানা
অনিরুদ্ধ ফসলশূন্য ক্ষেত্ৰখানার আইলের উপর স্থিরদৃষ্টিতে দাঁড়াইয়া কিছুক্ষণ দেখিল। নিম্ফল আক্ৰোশে তাহার লোহা-পেটা হাত দুখানা মুঠা বাঁধিয়া ডাইসযন্ত্রের মত কঠোর করিয়া তুলিল। তাহার পর সে অত্যন্ত দ্রুতপদে বাড়ি ফিরিয়া হাতকাটা জামাটা টানিয়া সেটার মধ্যে মাথা গলাইতে গলাইতে বাহির দরজার দিকে অগ্রসর হইল।
অনিরুদ্ধের স্ত্রীর নাম পদ্মমণিদীর্ঘাঙ্গী পরিপূর্ণ-যৌবনা কালো মেয়েটি। টিকালো নাক, টানা-টানা ভাসা-ভাসা ডাগর দুটি চোখ। পদ্মের রূপ না থাক, শ্ৰী আছে। পদ্মের দেহে অদ্ভুত শক্তি, পরিশ্রম করে সে উদয়াস্ত। তেমনি তীক্ষ্ণ তাহার সাংসারিক বুদ্ধি। অনিরুদ্ধকে এইভাবে বাহির হইতে দেখিয়া সে স্বামী অপেক্ষাও দ্রুতপদে আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল—চললে কোথায়?
রূঢ়দৃষ্টিতে চাহিয়া অনিরুদ্ধ বলিল—ফিঙের মত পেছনে লাগলি কেন? যেখানে যাই না, তোর সে খোঁজে কাজ কি?
হাসিয়া পদ্ম বলিল—পেছনে লাগি নাই। তার জন্য সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আর, খোঁজে আমার দরকার আছে বৈকি। মারামারি করতে যেতে পাবে না তুমি।
অনিরুদ্ধ বলিল-মারামারি করতে যাই নাই, থানা যাচ্ছি, পথ ছাড়।
–থানা? পদ্মর কণ্ঠস্বরের মধ্যে উদ্বেগ পরিস্ফুট হইয়া উঠিল।
–হ্যাঁ, থানা। শালা ছিরে চাষার নামে আমি ডাইরি করে আসব। রাগে অনিরুদ্ধের কণ্ঠস্বর রণ-রণ করিতেছিল।
পদ্ম স্থিরভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিলনা। সত্যি হলেও ছিরু মোড়ল তোমার ধান চুরি করেছে—এ চাকলায় কে এ কথা বিশ্বাস করবে?
অনিরুদ্ধের কিন্তু তখন এ পরামর্শ শুনিবার মত অবস্থা নয়, সে ঠেলিয়া পদ্মকে সরাইয়া। দিয়া বাহির হইবার উদ্যোগ করিল।
অনিরুদ্ধের অনুমান অভ্রান্ত,ধান শ্ৰীহরি পালই কাটিয়া লইয়াছে।
কিন্তু পদ্ম যাহা বলিয়াছে সে-ও নিষ্ঠুরভাবে সত্য, ধনীকে চোর প্রতিপন্ন করা বড় সহজ। নয়। শ্ৰীহরি ধনী।
এ চাকলায় কাছাকাছি তিনখানা গ্রাম—কালীপুর, শিবপুর ও কঙ্কণা-এ তিনখানা গ্রামে ছি পাল বা শ্রীহরি পালের ধনের খ্যাতি যথেষ্ট। কালীপুর ও শিবপুর সরকারি সেরেস্তায় দুখানা ভিন্ন। গ্রাম হিসাবে জমিদারের অধীন স্বতন্ত্র মৌজা হইলেও কার্যত একখানাই গ্রাম। একটা দিঘির এপারওপার মাত্র। শ্ৰীহরির বাস এই কালীপুরে। এ দুখানা গ্রামের মধ্যে শ্ৰীহরির সমকক্ষ ব্যক্তি আর কেহ নাই। শিবপুরের হেলা চাটুজ্জেরও টাকা ও ধান যথেষ্ট; তবে লোকে বলে—শ্ৰীহরির ঘরে সোনার ইট আছে, টাকা ধানও প্রচুর, তা হইলেও দুইজনের তুলনা হয় না। ক্রোশখানেক দূরবর্তী কঙ্কণা অবশ্য সমৃদ্ধ গ্রাম। বহু সম্ৰান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের বাস। সেখানকার মুখুজ্জেবাবুরা লক্ষ লক্ষ টাকার অধিকারী এ অঞ্চলের প্রায় গ্রামই এখন তাহাদের কুক্ষিগত। মহাজন হইতে তাহারা প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার হইয়া উঠিয়াছে; শিবপুর কালীপুর গ্রাম দুখানাও ধীরে ধীরে তাহাদের গ্রামের আকর্ষণে সর্পিল জিহ্বার দিকে আগাইয়া চলিয়াছে। কিন্তু সেখানেও শ্ৰীহরি পালের নামডাক আছে। ময়ূরাক্ষীর ওপারে আধা শহর রেলওয়ে জংশন, সেখানে ধনী মারোয়াড়ীর গদি আছে—দশবারটা চালের কল, গোটা দুয়েক তেল-কল, একটা আটার কল আছ—সেখানেও শ্ৰীহরি পালকে ঘোষ মশায় বলিয়াই সম্বর্ধিত করা হয়। ওই জংশন-শহরেই এ অঞ্চলের থানা অবস্থিত।
সুতরাং পদ্মের অনুমানের ভিত্তি আছে। কঙ্কণায় অথবা জংশন-শহরে কেহ এ কথা বিশ্বাস করিবে না; কিন্তু শিবকালীপুরের কেহ এ কথা অবিশ্বাস করে না। হিরু ভয়ঙ্কর ব্যক্তি এ সংসারে তাহার অসাধ্য কিছু নাই! এ ধান কাটিয়া লওয়া তাহার অনিরুদ্ধের উপর প্রতিশোধ লইবার জন্যই নয়—চুরিও তাহার অন্যতম উদ্দেশ্য। এ কথাও শিবকালীপুরের আবাল-বৃদ্ধবনিতা বিশ্বাস করে। কিন্তু সে কথা মুখ ফুটিয়া বলিবার সাহস কাহারও নাই।
শ্ৰীহরির বিশাল দেহ কিন্তু স্থূল নয়, একবিন্দু মেদশৈথিল্য নাই। বাঁশের মত মোটা হাতপায়ের হাড়—তাহাতে জড়ানো কঠিন মাংসপেশী। প্রকাণ্ড চওড়া দুখানা হাতের পাঞ্জা, প্রকাণ্ড বড় মাথা, বড় বড় উগ্র চোখ, থ্যাবড়া নাক, আকর্ণ-বিস্তার মুখগহ্বর, তাহার উপর একমাথা কোঁকড়াঝাঁকড়া চুল। এত বড় দেহ লইয়া সে কিন্তু নিঃশব্দ পদসঞ্চারে দ্রুত চলিতে পারে। পরের ঝাড়ের বাঁশ কাটিয়া সে রাতারাতি আনিয়া আপনার পুকুরে ফেলিয়া রাখে, শব্দ নিবারণের জন্য সে হাত-করাত দিয়া বাণ কাটে। খেপলা জাল ফেলিয়া রাত্রে সে পরের পুকুরের পোনামাছ আনিয়া নিজের পুকুর বোঝাই করে; প্রতি বৎসর তাহার বাড়ির পাঁচিল সে নিজেই বর্ষার সময় কোদাল চালাইয়া ফেলিয়া দেয়, নতুন পাচিল দিবার সময় অপরের সীমানা অথবা রাস্তা খানিকটা চাপাইয়া লয়। কেহ বড় প্রতিবাদ করে না, কিন্তু ব্যক্তিগত সীমানা আত্মসাৎ করিলে প্রতিবাদ না করিয়া উপায় থাকে না। তখন ছিরু কোদাল হাতেই উঠিয়া দাঁড়ায়; দন্তহীন মুখে কি বলে বোঝা যায় না। মনে হয় একটা পশু গৰ্জন করিতেছে। এই চুয়াল্লিশ বৎসর বয়সেই সে দন্তহীন, যৌনব্যাধির আক্রমণে তাহার দাঁতগুলো প্রায় সবই পড়িয়া গিয়াছে। হরিজন-পল্লীতে সন্ধ্যার পর যখন পুরুষেরা মদে বিভোর হইয়া থাকে, তখন ছিকু নিঃশব্দ পদসঞ্চারে শিকার ধরিতে প্রবেশ করে। কতবার তাহারা উহাকে তাড়া করিয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়াছে—কিন্তু ছিরু ছুটিয়া চলে অন্ধকারচারী হিংস্র চিতাবাঘের মত।
এই শ্ৰীহরি ঘোষ, ওরফে ছিরু পাল বা ছিরে মোড়ল।
শ্ৰীহরিকে ভাল করিয়া চিনিয়াও অনিরুদ্ধ স্ত্রীর কথা বিবেচনা করা দূরে থাক, তাহাকে ঠেলিয়া সরাইয়া দিয়া, বাড়ি হইতে রাস্তায় নামিয়া পড়িল। পদ্ম বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে রাগ অভিমান করিল না, আবার ডাকিল—ওগো, শোনোন, ফেরো। অনিরুদ্ধ ফিরিল না।
এবার একটু ক্ষীণ হাসিয়া পদ্ম ডাকিল—পেছন ডাকছি, যেও না, শোন!
সঙ্গে সঙ্গে অনিরুদ্ধ লাঙুলসৃষ্ট কেউটের মত সক্রোধে ফিরিয়া দাঁড়াইল।
পদ্ম হাসিয়া বলিল—একটু জল খেয়ে যাও।
অনিরুদ্ধ ফিরিয়া আসিয়া পদ্মের গালে সজোরে এক চড় বসাইয়া দিয়া বলিল—ডাকবি আর পিছন থেকে?
পদ্মের মাথাটা ঝিনঝিন করিয়া উঠিল, অনিরুদ্ধের লোহাপেটা হাতের চড়–নিদারুণ আঘাত। পদ্ম বাবা রে বলিয়া হাতে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়িল।
অনিরুদ্ধ এবার অপ্রস্তুত হইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে একটু ভয়ও হইল। যেখানে-সেখানে চড় মারিলে নাকি মানুষ মরিয়া যায়; সে ত্রস্ত হইয়া ডাকিল পদ্ম! পদ্ম! বউ!
পদ্মের শরীর থরথর করিয়া কাঁপিতেছে—সে ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছে। অনিরুদ্ধ বলিল–এই নে বাপু, এই নে জামা খুললাম, থানায় যাব না। ওঠ। কাঁদিস না, ও পদ্ম।…সে পদ্মের মুখ-ঢাকা হাতখানি ধরিয়া টানিলও পদ্ম!
পদ্ম এবার মুখ হইতে হাত ছাড়িয়া দিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল; মুখ ঢাকা দিয়া পদ্ম কাঁদে নাই, নিঃশব্দে হাসিতেছিল। অদ্ভুত শক্তি পদ্মের; আর অনিরুদ্ধের অনেক কিল চড় খাওয়া তাহার অভ্যাস আছে-এক চড়ে তাহার কি হইবে।
কিন্তু অনিরুদ্ধের পৌরুষে বোধহয় ঘা লাগিল—সে গুম হইয়া বসিয়া রহিল। পদ্ম খানিকটা গুড় আর প্রকাণ্ড একটা বাটিতে এক বাটি মুড়ি ও টুনি ঘটির এক ঘটি জল আনিয়া নামাইয়া দিয়া বলিল—তুমি ছিরু মোড়লকে সুবে করে এজাহার করবে, গায়ের লোক কে তোমার হয়ে সাক্ষি দেবে বল তো? কাল থেকে তো গায়ের লোক সবাই তোমার ওপর বিরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাল সন্ধ্যার পর আবার মজলিস বসিয়াছিল, অনিরুদ্ধের ওই মজলিসকে মানি না কথাটা সকলকে বড় আঘাত দিয়াছে। সন্ধ্যার মজলিসে অনিরুদ্ধ এবং গিরিশের বিরুদ্ধে জমিদারের কাছে নালিশ জানানো স্থির হইয়া গিয়াছে।
কথাটা অনিরুদ্ধের মনে পড়িল, কিন্তু তবু তাহার মন মানিল না।